রংধনু - পর্ব ০৩ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


ড্যান্স ক্লাশ থেকে বেরিয়ে কোচিং এর পথে রওনা হচ্ছিলো বেলা।লম্বা চুল গুলো কে খোঁপায় গুঁজে দিয়ে পাশের নিদ্রা ম্যামের দিকে হেসে বলল,
''কাল আবার ও দেখা হচ্ছে ম্যাম।রুপালী দলের মেয়ে গুলো বেশ ভদ্র। কথা শুনে খুব করে।"
নিদ্রা ম্যাম হেসে বলল,
''যাই বলো বেলা তোমাকে কিন্তু সবাই বেশি পছন্দ করে।"
''বাচ্চাদের মনটা আসলেই খুব নরম। আমার ও বেশ ভালো লাগে ওদের সাথে থাকতে সময় কাঁটাতে।"
''তুমি বেশ ভালো মা হতে পারবে বেলা।আচ্ছা তোমার তো কোচিং ও আছে।যাও তাহলে পরে কথা হবে। "
''অবশ্যই। "
নিদ্রা চলে যেতেই বেলা সামনে এগিয়ে একটা খালি রিক্সা দেখতে পেয়ে বলল,
''এই খালি যাবা হাতির পুল?"
রিক্সা টা ওর সামনে এসে থামলো।
''কতো দিবেন?"
''বিশ টাকা দিবো।"
''ত্রিশটাকা দিয়েন আপা।অনেক গরম লাগতাছে।সারাদিন খাইনাই কিছু।"
বেলার বেশ মায়া লাগলো।তারপর আর তর্ক না করেই উঠে পড়লো।লোকটা বেশ বয়স্ক।এদের সাথে তর্ক না করে টাকা দেয়া উচিৎ।বেচারার রিক্সা চালিয়ে কতো টাকাই বা পায়।মনটা খারাপ হয়ে যায় বেলার।দিনে দুমুঠো ঠিক মতো খেতে পারেনা। হাতিরপুল কোচিং সেন্টারটির সামনে এসে নেমে পড়লো বেলা।পঞ্চাশ টাকা বের করে লোকটির হাতে ধরিয়ে দিতেই সে বলল,
''তিরিশ টাকা কইছিলাম।"
''নেন মামা সমস্যা নেই।"
লোকটার মুখে হাসি দেখতে পেলো বেলা।চোখে ও ফোঁটা অশ্রু।তবে বেলা জানে এ টাকা দিয়ে চাল ও পাওয়া যাবেনা।তবে অল্পতেই খুশি হয়েছে দেখে ভালো লাগছে ওর।লোকটা ওকে দোয়া করে চলে গেলো রিক্সা নিয়ে।কোচিং সেন্টারের ভিতর ঢুকে গেলো বেলা।ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ছে বেলা।অবশ্য এখানেই ইন্টার প্রথম বর্ষের ও ক্লাশ নেয়।সকাল ছয়টায় বেরিয়ে যায় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।বাংলাদেশ  টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত ও।ভার্সিটি থেকে নয়টায় ড্যান্স ক্লাশে চলে আসে আর সেখান থেকে কোচিং এ।ক্লাশ শেষ করে ইন্টারের ক্লাশ নিতে চলে যায় বেলা।ক্লাশ নিয়ে বাসার পথে রওনা হয়।বাসা দূরে নেই তাই কিছু বাজার করে নিলো হাঁটতে হাঁটতে।ঘরে পৌছুতেই মা বলল,
''এত দেরি করে ঘরে ফিরিস আমার ভয় হয় তোকে নিয়ে।"
''মা কিছু হবেনা।তোমরা খেয়েছো?"
''হ্যা। বাজার নিয়ে এসেছিস?"
''আরে হ্যা আব্বা লাল শাক দিয়ে রুই মাছের ঝোল খেতে চেয়েছিলো সেটাই নিয়ে এলাম।"
বেলার হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে জুলেখা বানু বললেন,
''যা গোসল কইরা নে।আমি তোর লাইগা চা বানায় আনি।"
''ঠিক আছে মা।"
বেলা রুমে যেতে নিলে সাঁঝ এসে দাঁড়ায় ওর কাছে।তারপর বলল,
''জানিস কি হয়েছে?"
''কি হয়েছে আবার?"
''বিন্তী আপু এসেছিলো।"
''বিন্তী এসেছিলো?"
অবাক হয় বেলা।সাঁঝ বেলার হাতে কার্ড দিয়ে বলল,
''বিন্তী আপুর ভাইয়ের বিয়ে।আমাদের যেতে বলেছে।"
''ওতো কল দেয়নি আমাকে।সিলেট থেকে এখানে চলে এলো ও।অদ্ভুত মেয়ে!!!"
''না আপি।বিন্তী আপু ঢাকায় ছিলো আজ রাতের ট্রেনে চলে যাবে।"
''ওহ।কেন এসেছিলো জানিস?"
''শপিং করতে। "
''ওহ।আচ্ছা ওকে কল দিবোনে।আমি গোসল সেড়ে নেই।"
বেলা গোসল করতে চলে যায়।বিন্তী বেলার বেস্ট ফ্রেন্ড ক্লাশ থ্রি থেকেই।কিন্তু আঙ্কেল গার্ডেন অফিসার সিলেটের তাই সেখানে চলে গেছিলো সবাই।বেলা গোসল সেড়ে  রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো ছোট্ট লাবনীকে খাওয়াতে চেষ্টা করছে সাঁঝ।লাবনী খাবেনা।মুখ এপাশ ওপাশ করছে।মা ও অনেকবার চেষ্টা করলো।শেষ মেষ বেলা কে দেখে লাবনী বলল,
''বড় আপির হাতে কাবো।"
বেলা এসে বোনকে কোলে তুলে নেয়।সাঁঝ বেলার পিছন পিছন খাওয়ার প্লেট নিয়ে আসে।খাটে বসে বেলা লাবনী কে খাওয়াতে থাকে আর সাঁঝ গল্প শুনাচ্ছে।অনেকটা সময় নিয়ে লাবনীকে খাওয়ালো দুবোন।
রাতের খাবার শেষে ছয় জন বেলার রুমে একত্রিত হলো।সাঁঝ চা বানিয়ে এনেছে সবার জন্য।কুঞ্জনের হাতে দুধের গ্লাস ধরাতেই ও বলল,
''তোরা চা খাবি আমাকে দুধ কেন দিলি?"
সাঁঝ ওর নাক টেনে বলল, 
''তুই এখনো বাচ্চা সেই জন্য।"
''আমি এখন বাচ্চা নই।বড় হয়ে গেছি। "
আদনান পাশ থেকে বলল,
''বিয়ে দিয়ে দিতে হবে বুঝলাম।"
কুঞ্জন নাক শিটকে বলল,
''বিয়ে পঁচারা করে আমি করবোনা।"
তখন নিশাদ রেগে বলল,
''চুপচাপ দুধ খেয়ে ঘুমোতে যা।হুমায়রা তুই ও ঘুমাতে চলে যা।"
হুমায়রা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, 
''ভাইয়া আমি থাকি প্লিজ।"
''একদম ঘ্যান ঘ্যান করবিনা।ক্লাশ আছে না?"
হুমায়রা মুখ ভোঁতা করে চা খেয়ে কুঞ্জন কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।আদনান সাঁঝ বেলা আর নিশাদ তাদের পুরোনো আড্ডা বসালো।প্রায় প্রত্যেক রাতেই ওরা এভাবে গল্প করে সবাই মিলে।আদনান বলল,
''ক্যারাম খেলবি তোরা?"
বেলা বলল,
''চল খেলি।"
নিশাদ গিয়ে বোর্ড নিয়ে এলো আর সাঁঝ গুটি গুলো।বোর্ডটাকে বিছিয়ে খেলতে শুরু করলো।সেদিন খেলা শেষ করে বিন্তীকে কল দিলো বেলা।বিন্তী ট্রেনে ছিলো।ও গাড়িতে কখনোই ঘুমোতে পারেনা সেটা বেলা জানে।বিন্তী ফোন রিসিভ করে বলল,
''কই ছিলি হারামজাদি?!"
''কাজে ছিলাম।তুই আসবি আগে কেন বললিনা?"
''হুম।অনেকদিন তো দেখা হয়না।যাই হোক সামনের সপ্তাহে  ভাইয়ার বিয়ে।তোরা আসছিস অবশ্যই।"
''ঠিক বলতে পারছিনা।ভার্সিটি ড্যান্স ক্লাশ কোচিং।তোকে জানাবো আমি।"
বিন্তীর ব্যাপার বাবাকে জানাতেই আপত্তি করেন ওনি।মেয়ে মানুষ এভাবে কোথাও যাওয়া ভালো দেখায় না তাও আবার সিলেটে।বড় দূর নাহ ওরা যাবেনা।
বেলার মন না চাইতে ও খারাপ হয়।বিন্তী বেস্ট ফ্রেন্ড ওর।দুজনে একসাথেই পড়াশুনা করেছিলো। গলায় গলায় ভাব ওদের।তবে বাবাকে মানাতে তেমন কাঠখোর পোহাতে হয়নি ওদের। বিন্তীর আব্বু বাবাকে বুঝিয়েছিলেন থার মেয়েরা ভালো থাকবে।বাবা রাজি হন এক শর্তে তাহলো নিশাদ ও যাবে কারন মেয়ে মানুষ এত বড় জার্নি না করাই ঠিক।আদনান ও যাবে কারন নিশাদের সঙ্গ প্রয়োজন।বেলা নিজের ভার্সিটি ড্যান্স ক্লাশ, কোচিং থেকে ছুটি নেয়।সাঁঝ ও ছুটি নিয়েছে স্কুল থেকে।নিশাদ আর আদনান নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছুটি নেয়।বেলা ওর জমানো টাকা দিয়ে চারজনের জন্য কাপড় কিনেছিলো বিয়েতে পরার জন্য।
অবশেষে বেরিয়ে পড়লো ওরা।কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌছে নিশাদ কিছু চিপস আর পানি কিনতে চলে গেলো।আদনান বোনদের সাথে বসে আছে।বিকেল চারটায় ট্রেন আসবে।এখন সাড়ে তিনটা বাজে।নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন চলে এলো।বেলা নিশাদ সাঁঝ আর আদনান ট্রেনে উঠে গেলো।বেলার দিকে মুখ করে একজন লোক বসেছে।গায়ের রং অসম্ভব রকমের ফর্সা।গালে খোঁচা দাড়ি আছে।তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে নবাব মহলের কেউ।কানে হেডফোন গুঁজে সিটে হেলান দিয়ে আছে।সাথে আরেকজন লোক ও আছে।বেলা সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।পাশে সাঁঝ ঘুমে বিভোর।
রাত অনেক হলো।বেলার মাথা টনটন করছে।এককাপ চা হলে মন্দ হয়না।উঠে পা টিপে টিপে এগুতে লাগলো। এ বগি ও বগি খুঁজে বেড়াতে থাকলো তবে কাউকে পায়নি।ট্রেনের কাঁপুনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বেলার।দেয়াল ধরে পাশে তাকিয়ে দেখলো খোলা জায়াগা।শনশন করে ঠান্ডা বাতাস ওর শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছে।বেলা সেদিকে গিয়ে দাঁড়ায়।হঠাৎ কে যেন বলল,
''আর ইউ পজেসড?"
কিছুটা ভরাট গলায় কে যেন বলল।বেলা পিছনে তাকিয়ে ঠিক মতো বুঝতে পারেনা কে বলল।হঠাৎ সে দৃশ্যমান হলো।চাঁদের আলোয় তার চেহারা দেখে নেয় বেলা।ওর সামনের ধলা লোকটাই সে। বেলা একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
''ম্যানার জানেননা?কিভাবে কথা বলতে হয়?"
লোকটা কি বুঝলো বেলা জানেনা তবে তার চেহারা দেখে মনে হলো বেলার কথা কিছু বুঝেনি সে।ভ্যাবলার মতো চেয়েছিলো ওর দিকে।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বেলা হাঁটতে শুরু করলো।ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে থাকলো লোকটা।
বেলা এসে সাঁঝের পাশে বসে পড়লো।মেয়েটা এখন ও ঘুম।নিশাদ জেগে আছে।বেলা বলল,
''ঘুমা একটু।"
''নারে আপা আসছেনা ঘুম।কই গিয়েছিলি?"
''মাথাটা ধরে আছে ভাবলাম ঠান্ডা বাতাস নেই।কিন্তু এক আধপাগলের সাথে দেখা হয়ে গেলো।"
''আধপাগল কেন?"
হালকা হেসে জিজ্ঞেস করে নিশাদ।বেলা বলল,
''জিজ্ঞেস করলো আমি কি পজেসড?তোর কি মনে হয় আমাকে ভূতে ধরেছে?"
''মনে হয়না কিন্তু অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিলি তাই হয়ত তার মনে হতে পারে।"
''হুম তোর মাথা।"
শব্দ করে হেসে উঠে নিশাদ।পরদিন ভোরে সিলেটে পৌছে গেলো ওরা।রাতে খুব ধীরে ট্রেনটা চলছিলো।সিলেটে পৌছে একটা গাড়ি ভাড়া করলো ওরা গন্তব্যে পৌছাতে।তখনই ইকরাম রহমান কল করলেন আদনান কে।ঘুমন্ত চোখে আদনান কল রিসিভ করে কানের সামনে রাখলো।অপরপাশ থেকে ইকরাম বললেন,
''কই আছিস তোরা?"
''ট্রেনের নিচে আব্বা।"
আদনানের কথায় সাঁঝ বেলা নিশাদ ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায়।ওদের কারোরই বুঝতে বাকি নেই ঘুমের ঘোরে এসব বলছে আদনান।ইকরাম রহমান ধমকে উঠেন,
''কি বলিস এসব?"
''না মানে ট্রেন থেকে বেরিয়েছি।এখন ট্যাক্সিতে।"
''আচ্ছা পৌছে জানাস কিন্তু।ওরা ভালো আছে?"
''হ্যা আব্বা।কুঞ্জন হুমায়রা স্কুলে গেলো?"
''হ্যা গেছে।তোর আম্মারে নিয়া হাসপাতালে যামু একটু।"
এবার ঘুম পুরোপুরি চলে গেলো আদনানের চোখ থেকে।চিন্তিত  হয়ে বলল,
''কেন আব্বা কি হইছে?আম্মা ঠিক আছে তো?"
''ঠিকই আছে।তোর ছোট মামী হাসপাতালে ভর্তি।পাথরের অপারেশন হইছে।হেরেই দেখতে যামু।"
''ওহ আচ্ছা যাও।সাবধানে যাইও আব্বা।"
''আচ্ছা।তোরা খাইছোস কিছু?"
''বাহিরে চা খাইছিলাম আর চিপস।ঐখানে যায়া খামু।"
''আচ্ছা আব্বা মাইয়া গুলার খেয়াল রাখিস।তোরা দুইডা ভাই গেছোস দেইখা রাখিস।"
''আচ্ছা আব্বা আল্লাহ হাফেজ।"
''আল্লাহ হাফেজ।"
আদনান ফোন কেঁটে বলল,
''ছোট মামী হাসপাতালে ভর্তি।"
বেলা জিজ্ঞেস করলো,
''কি হলো ওনার?"
''পিত্তথলিতে পাথর আছে না?ঐটার অপারেশন হইছে।"
নিশাদ তখন বলল,
''হাসান ভাইয়ের সাথে কাল ও কথা হইছিলো।কই কিছুই তো বলল না।"
''কে জানে? কেন বলে নাই।"
হাই তুলতে তুলতে বলল আদনান। 

!!!!

চারিপাশে পাহাড় আর চা বাগান আর মাঝে উচু নিচু পাথরুে পথ।সে পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিশাদ বেলা সাঁঝ আর আদনান।বাসাটা বেশি দূরে নেই তাই হাঁটতে সমস্যা হবার কথা নয়।এ রাস্তা গাড়ি চলে না তাই নেমে পড়তে হলো ওদের।নিশাদ আর আদনান লাগেজ ধরে রেখেছে আর সামনে সাঁঝ আর বেলা হেঁটে যাচ্ছে।সামনেই দেখা গেলো লাল বড় গেটটি।ওরা ভিতরে ঢুকতেই বিন্তি ফারজানা আন্টি আর রবিন ভাই বাহিরে আসে।বেলা আর সাঁঝকে জড়িয়ে ধরেন ফারজানা আন্টি।ওনি বলছিলেন,
''কতো বছর পর দেখেছি তোদের।কতো বড় হয়ে গেছিস।"
বেলা হেসে বলল,
''কতোদিন পর দেখলাম আপনাদের।খুব ভালো লাগছে আন্টি।"
তখনই সাঁঝ বলল,
''আন্টি ঋতু কই?"
ফারজানা সাঁঝের কথায় হেসে বলল,
''ঋতু তোর অপেক্ষায়।যখন শুনেছে আসছিস তোর জন্য নিজেদের পছনের জামা মেহেদী চুড়ি সব ঠিক রাখছে।"
সাঁঝ হেসে চুপ করে রইলো।ফারজানা আন্টির চোখ হঠাৎ নিশাদ আর আদনানের দিকে গেলো।ওনি বেলাকে উদ্দেশ্য করে  বললেন,
''নিশাদ আর আদনান না ওরা?"
বেলা সম্মতি জানায়।ফারজানা বললেন,
''মাশাল্লাহ কতো বড় হয়ে গেছে ছেলে গুলো।"
নিশাদ আর আদনান দুজনেই ফারজানা আন্টিকে সালাম জানায়।হঠাৎ রাফিজ সাহেব এসে বললেন,
''কি ফারজানা বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখবে ওদের?"
ফারজানা আন্টি তৎখনাৎ বললেন,
''ওহ তোমাদের পেয়ে ভুলেই গেছিলাম সব।আসো ভিতরে আসো।"
সবাই ভিতরে ঢুকে।বিন্তী এতক্ষন মায়ের জন্য  বেলার সাথে কথা বলতে পারছিলো না।এখন বেলার হাত টেনে রুমে নিয়ে আসে।বেলা বিন্তীকে জড়িয়ে ধরে। বিন্তী বলছিলো, 
''কতো বছর পর দেখা হয়েছে বুঝতে পারছিস?"
''অনেক বছর পর বিন্তু কেমন আছিস?"
''ভালো রে।"
এরপর দুই বান্ধবী বসে গল্প করতে থাকে।নিশাদ আর আদনানকে রবিনের রুমে থাকতে দেয়া হলো।রবিন কে দেয়া হলো উপরের ঘরে।সাঁঝ ঋতুর সাথে থাকবে।রাতে খাবার টেবিলে সবাই গল্প করছিলো।বেলা সেই যে ঘুমিয়েছে আর উঠেনি।খাওয়ার জন্য ডাকা হলে বলেছিলো পেটে খিদে নেই।সাঁঝ অনেকবার গিয়েছিলো বোনের কাছে তবে বেলা খেতে রাজি হয়নি।এদিকে ওদের গেস্ট হাউজে নাকি রবিনের বন্ধু কিরন আর কিরনের এক বিদেশী বন্ধু আসবে রবিনের বিয়ের জন্য।ফারজানা আন্টি কম ঝাল দিয়ে তরকারি রান্না করেছিলো সেটা বক্সে ঢুকাতে থাকে।সাঁঝ ওনার পাশে দাঁড়ানো।ও জানতে চাইলো,
''কাউকে পাঠাচ্ছেন?"
''হ্যারে।শুনেছিস না গেস্ট হাউজে একজন ফরেইনার আসবে।ওনি তো বেশি ঝাল খেতে পারেননা তাই।"
''ওহ আচ্ছা।"
রবিন খাবার নিয়ে বেরিয়ে গেলো গেস্ট হাউজের উদ্দেশ্যে।পরদিন সকালে সাঁঝ বেলা ঋতু আর বিন্তী বসে গল্প করছে।পরশু রবিন ভাইয়ের হলুদ।বিয়েটা হচ্ছে ঢাকা থেকে আগত রুমকি নামের কারোর সাথে।বিন্তী বলল,
''দেখ আমরা কিন্তু নাচবো গান ও রেডি।"
সাঁঝ জানতে চাইলো, 
''কোন গান আপু?"
''পাতা ঝরা বৃষ্টি।ঋতু ঠিক করেছে।"
বেলা বলল,
''খারাপ না।ভালোই গানটা।"
বিন্তী মুখ শক্ত করে বলল,
''দেখ যাই বলিস তুই আমাদের কোরিওগ্রাফার। আজ বিকেলে মেয়েরা আসবে।তুই কোরিওগ্রাফে থাকবি।"
বেলা ভয় পেয়ে বলল,
''কি বলছিস?এখানে নাচবো আমি?"
''এখানে নিচে হল রুম আছে ঐখানে।"
''ওহ।তারপর ও অন্য কাউকে ঠিক করা যায়না?"
''বেলা হয়েছে কি তোর?নাচের ব্যাপারে তোর থেকে বেশি কারোর ওপর ভরসা করতে পারিনা।জানিস?"
বোনের দিকে তাকায় সাঁঝ। তারপর বলল,
''এমন করছিস কেন আপা?রাজি হয়ে যা না?"
''ওকে ডান।করবো আমি।"
বিন্তী খুশি হয়ে বেলা কে জড়িয়ে ধরে বলল,
''এইতো আমার জানুটা।"
বিন্তী সরে এসে বলল,
''আচ্ছা শোন শাড়ী ঠিক হয়েছে।সবাই বেগুনী কালার সিল্কের শাড়ী পরবো।"
বেলায় চিন্তায় পড়ে গেলো।ওর আর সাঁঝ কারোরই বেগুনী শাড়ী নেই।বিন্তী বেলার মুখে দুশ্চিন্তা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
''কি হলো তোর?"
''মানে এমন শাড়ী সাঁঝ আর আমার নেই।"
বিন্তী হেসে বলল,
''নাচের শাড়ী আমরাই দিচ্ছি বুঝলি?"
বেলা এবার যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।
বিকেলে কিরন আর বিদেশী লোকটাকে নিয়ে ঘরে ফিরে রবিন।তারপর ভিতরে ঢুকে রবিন ফারজানা কে ডেকে বলল,
''মা ও কিরন তুমি তো জানোই আর ওনি কিরনের ভারতীয় বন্ধু বিভান শেখ।"
''ওহ।আসসালামু আলাইকুম মিঃ বিভান।"
বিভান তৎখনাৎ বলল,(বিভান ইংরেজিতে কথা বলবে সেগুলো বাংলায় ট্রান্সলেট করে দিচ্ছি)
''ওয়ালাইকুম আসসালাম।"
''কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো মিঃ বিভান?"
''না।আমি ঠিক আছি।ধন্যবাদ।"
ফারজানা ওদের বসতে বলে গোসলের পানি ঠিক করতে চলে গেলো।বিভান রবিনকে বলল,
''সবাই দেখছি বেশ আন্তরিক।খুব ভালো লাগছে আমার।"
রবিন হেসে বলল,
''আপনার ভালো লাগছে এটাই বড় পাওয়া।আমি আপনাদের জন্য চায়ের ব্যাবস্থা করি।"
তখন কিরন বলল,
''তুই কেন চা করবি?বিন্তী আর ঋতু কই?"
''আরে বেলা আর ওর বোন সাঁঝ এসেছে।ওরা নিচে নাচের রিহার্সেল করছে।"
''ওহ।"
রবিন আবার ও বলল,
''আমি তাহলে চা নাস্তার ব্যাবস্থা করি কিরন ওনাকে নিয়ে ওয়াশরুমে যা।"
''ওয়াশরুম নিচে না?"
''হ্যা যা ফ্রেশ হয়ে আয়।"
বিভান কে নিয়ে রবিন নিচে নামতে থাকে।
________________________________________
এদিকে রবিন মায়ের কাছে আসতেই ফারজানা বলল,
''ওনারা কই?"
''হাত মুখ ধুতে নিচে গেলো।"
ফারজানা অবাক হয়ে বলল,
''উপরেই তো ছিলো।নিচে নাচের প্র্যাকটিস হচ্ছে।"
''মা আমার খেয়াল নেই একটুও।এতক্ষনে তো চলে ও গেছে ওরা।
পত্তোণ কা হ্যায় জিসম জানম,
ভীগ জানে দো।
পত্তোণ কা হ্যায় জিসম জানম,
ভীগ জানে দো।
পাতা ঝরা বৃষ্টি বলো কেন এনেছো
পাতা ঝরা বৃষ্টি বলো কেন এনেছো?
পত্তোণ কা হ্যায় জিসম জানম,
ভীগ জানে দো।
যেখানে যাই এই বৃষ্টি তাড়া করে দিনে রাতে
সে পাড়া ছাড়া করে।
যেখানে যাই এই বৃষ্টি তাড়া করে দিনে রাতে
সে পাড়া ছাড়া করে।
তবুও রোজ ভিজে ভিজে যাই,
কে জানে কি যে কি যে চাই
জলে নেমে ত সবই জেনেছ​।
পত্তোণ কা হ্যায় জিসম জানম,
ভীগ জানে দো।
পাতা ঝরা বৃষ্টি বলো কেন এনেছো
পাতা ঝরা বৃষ্টি বলো কেন এনেছো?
পত্তোণ কা হ্যায় জিসম জানম,
ভীগ জানে দো।
নিচে নামতে নামতে বিভান আর কিরন গান আর নুপুরের শব্দ শুনতে পেলো।বিভান বলল,
''কে নাচছে মনে হয় রাইট?"
''হ্যা রবিন তো এটাই বলল।"
বিভান কিরনের হাত চেঁপে বলল,
''এভাবে যাওয়া ঠিক হবেনা।মেয়েরা বিব্রতবোধ করতে পারে।"
''আরে বোকা বাথরুমতো পাশেই ওখানে না।"
''আচ্ছা চলো তাহলে।"
বিভান ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই কিরন ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে।বিভান বাহিরে ওয়েট করছে হঠাৎ খেয়াল করলো পিছন থেকে নুপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসছে।
বিভান পিছে তাকিয়ে দেখলো কয়েকটি মেয়ে নাচছে।আর ওদের সামনে একজন।তবে তার পিঠ ওরদিকে দেয়া।চেহারা দেখতে পেলোনা।তবে ভালো নাচে সে।বিভান মুচকি হাসে।হঠাৎ কিরনের ডাকে হুঁশ হলো ওর।কিরন বলল,
''কি হলো জনাব ওভাবে মেয়েদের দেখছো।তখন না বললে মেয়েরা বিব্রত বোধ করতে পারে।"
সামনে ফিরে বিভান।তারপর আমতাআমতা করে বলল,
''আরে না।গান শুনেই তাকালাম।নাহলে দেখতাম না।"
''হুম সব বুঝি আমি।"
''কি বুঝো তুমি?"
''বুঝি যে ভারত থেকে আগত সুদর্শন পুরুষ বিভান শেখের বাংলাদেশী মেয়েদের ভালো লাগছে।কিন্তু জনাব বোন ভাবতে শিখো ওদের।তোমার এই প্রেম প্রেম নজরে দেখোনা ওদের।"
বিভান হেসে বলল,
''জনাব শুনো ওদের নাচ ভালো লেগেছে ওদের নয়।ভুল বুঝছো তুমি আমাকে।"
''মজা করছিলাম আমি মাইন্ড করোনা।"
''আমি ও মজা করেছি বুঝোনি তুমি।"
ওরা ওপরে আসতেই রবিন এসে বলল,
''সরি নিচে পাঠানোর জন্য।ওরা নাচছিলো আর তোমাদের নিচে পাঠিয়ে দিলাম আমি। "
বিভান ভরসার হাত বাড়িয়ে বলল,
''সমস্যা হয়নি রবিন।চিন্তা করোনা।"
সেদিন বিকেলে রবিনের হবুস্ত্রী চলে এলো সিলেটে।সবার কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন লাগে।ছেলেরা যায় বিয়ে করতে কিন্তু সেখানে মেয়ে চলে এলো বিয়ে বসতে।কি দুনিয়া চলে এলো।এমন কিছু কথা ছড়াচ্ছিলো পুরো এলাকা জুড়ে।সবাই কে আশ্বস্ত করলো রফিক সাহেব।ওনি বললেন,
''রুমকি আমার মেয়ের মতোই।বন্ধুর মেয়ে আমার। কিছুদিন পর তো বৌ হয়ে আসবে।ও যেহেতু আমার মেয়ে তাহলে ওরা আসুক আর আমরাই বা যাই সমস্যা কি?"
ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে নিশাদের।এমন ভাবনা চিন্তা সবার হলে দুনিয়াটাই কতোটা না সুন্দর হতো।রুমকির বাবা মা আর ছোট বোন এলো রফিক সাহেবদের বাসায়।বেলা সাঁঝ আদনান আর নিশাদ রুমে বসেছিলো বিন্তী সহ।বিন্তী বলল,
''রুমকি আপুর খুব শখ ওনি সিলেটে বিয়ে করবেন তাই ওনার বাবাও আপত্তি করেনি।"
বেলা বলল,
''ওনাদের বিয়ে বেশ স্পেশাল হবে তাইনা?"
''হুম অনেক।আমি তো ভাই চা বাগানে বিয়ে করবো।"
আদনান হেসে বলল,
''কইরেন।জোঁক এসে আপনাকে আর আপনার জামাইকে কামড়ে অজ্ঞান করে দিবে।সেই স্মরনীয় বিয়ে হবে আপনাদের তখন।"
আদনানের কথায় সবাই হো হো করে হেসে দিলো।নিশাদ বলল,
''জোঁক কেন শুধু সাপ ও তো থাকতে পারে।সবারই বিয়ে খাওয়ার অধিকার আছে।"
বেলা হাসতে হাসতে গড়িয়ে যাচ্ছে কিছু বলতে পারছেনা।তখনই রুমকির মা হোসনে আরা খালিদ রুমে এসে যায়।বিন্তী ওনাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।ওনি বললেন,
''হ্যারে বিন্তী এরা কে?"
''আন্টি ও বেলা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বেলার বোন সাঁঝ আর দুভাই আদনান আর নিশাদ।"
সবাই ওনাকে সালাম দিলো।ওনি বললেন,
''তোমরা গল্প করো তাহলে আমি যাই।"
মহিলা প্রস্থান করলেন।বেলা বলল,
''রুমকি আপু আসবেনা এখানে?"
''বিন্তী ফিসফিসিয়ে বলল,
''আরেহ গার্জিয়ানদের মধ্যে কিভাবে আসবে ওনি।তাইতো সামনের চা বাগানের সামনে একটা উঠান আছে সেখানে কাল রাতে একটা বার্বিকিউ পার্টি করবো।ওনি ওখানে আসবে।"
''এতো কম মানুষ নিয়ে বার্বিকিউ মজা হবেনা।"
বলে উঠে আদনান।বিন্তী বলল,
''অল্প কই।আমার আরো কাজিনরা আছে।তারপর কিরন ভাইয়া আর তার বন্ধু বিভান ভাই ও থাকবে।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন