পরাণ প্রিয়া - পর্ব ৩৬ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


প্রিয়তা বাকরুদ্ধ হয়েই তাকিয়ে আছে।কি বলবে বুজতে পারছে না।নিবিড়ের দিকে চোখে চোখ রাখতেই লজ্জা পাচ্ছে প্রিয়তা।তবুও তাকিয়ে বুজার চেষ্টা করছে তাকে।
নিবিড় কাছে এসে,তুমি এমন একটা মেয়ে যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।আমি ভাবি পৃথিবীতে যত মেয়ে আছে তুমি সবার থেকে আলাদা। হুম সেটা শুধু আমার চোখে।কিন্তু তুমি কি করলে এইটা? আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলা করছো? আমার বোনকে নিয়ে তোমার মনে এতো হিংসা?  হ্যাঁ হয়তো রিসাদ একটা ভুল করেইছে।তাই বলে তুমি আমার বোনের জীবন নিয়ে খেলা করবে? তোমরা মেয়েরা নিজের স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছু বুজো না তাই না? আমার বোনের জন্য একবার তোমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি তারপরেও তুমি আবার আমার বোনকে নিয়ে,,,ছিঃ আমার ভাবতেও অবাক লাগছে তোমার মতো একটা নিচ মনের মানুষের  সাথে এতোদিন সংসার করে আসছি।
তোমার একটা বাচ্চাই তো নষ্ট হয়েছে তাই না? দরকার হলে তুমি আবার বাচ্চা নিবে সমস্যা মিটে গেছে তাই না? তাই বলে তুমি আমার বোনের সাথে তো অন্যায় করতে পারো না।আমার বাড়িতে থেকে এইসব পাগলের ড্রামা করে আমার খেয়ে আমার বোনের পিছনেই লাগবে এইটা তো আমি হতেই দিবো না।তুমি এখুনি এই মুহুর্তে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।তোমার এইসব ড্রামা তোমার মা আর বোনকে গিয়ে দেখাও আমার আর আমার ফ্যামিলির সাথে নয়।
কথাগুলো শেষ করে নিবিড় প্রিয়তার দিকে রাগন্বিত টকটকে লাল চোখে তাকিয়ে আছে।

প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে ফেললো,,,নিবিড়কে তার মনে যে জায়গায় রেখেছে বিয়ের পর থেকে আজ কি সে জায়গাটা পাল্টাতে যাচ্ছে? নিবিড় তো অন্যায় সহ্য করে না।অবশ্য নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ সবই পারে।সে তো আর ফেরেশতা নয় কোনো পাপ থাকবে না।ঠিক আছে ওকে আমিও বলে দিচ্ছি আমি চলে যাবো ওর জীবন থেকে।
প্রিয়তা চোখ খোলার আগেই নিজের গালে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে অবাক হয়ে চোখ খুলে,  আপনি,,,,,
নিবিড় নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে,, হিসসসসস,,,
প্রিয়তার চোখের পানি মুছে দিয়ে কি ভেবেছিলে আমি তোমায় একটু আগে বলা এই কথাগুলো বলবো? কখনোই না! 
পানি ছাড়া যেমন কাঁদা মাটি  অসম্ভব, ফুল ছাড়া যেমন ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া অসম্ভব, মানুষ ছাড়া যেমন ভালোবাসা অসম্ভব, আকাশ ছাড়া তারা যেমন অসম্ভব তেমনি প্রিয়তা ছাড়াও এই নিবিড় অসম্ভব  অসম্পূর্ণ। 
প্রিয়তা কিছু বলতে পারছে না।কান্নায় যেনো গলার ভিতরটা আটকা পড়েছে।ঝাপটিয়ে নিবিড়ের বুকে মাথা রেখে নিবিড়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কান্নার গতি যেনো বাড়িয়ে চলছে।
নিবিড় প্রিয়তার মাথায় চুলের বিলি কেটে দিতে দিতে,তুমি ভয় পাচ্ছো কেনো পাগলী? আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই।নিবিড় অন্যায় কখনো সহ্য করেনি আর কখনো করবেও না।সারাজীবন তোমার নিবিড় তোমার হয়েই থাকবে।

প্রিয়তা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, আমি খুব ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু আমি কী করবো বলুন? আমার বাচ্চার কথা খুব মনে পড়ে।যখনি মনে পড়ে নিজেকে আর সামলাতে পারি না।

-আমি জানি বুড়ী। চিন্তা করো না।তুমি সুস্থ হও আল্লাহ চাইলে আমাদের বেবি আবার আসবে।

প্রিয়তা কিছু না বলে কান্না করছে।নিবিড় হঠাৎ করেই প্রিয়তার মাথা নিজের বুক থেকে উঠিয়ে, বুড়ী একটা কথা না বললেই নয়।তুমি যে অভিনয় দেখালে সিনেমাতেও মানুষ এতো সুন্দর অভিনয় দেখায় না।
তবে এই নিবিড় ইসলামের কাছে তোমার অভিনয় ধোঁপে টিকেনি।

প্রিয়তা ভেংচি কেটে, ওওওও তাই? তাহলে এতো যত্ন, খাইয়ে দাওয়া,ঘুম পাড়ানো,গোসল করিয়ে দাওয়া,চেঞ্জ করে দেওয়া। চুলের পানি অনেক যত্নে মুছে দেওয়া এইগুলো তো আমি সুস্থ থাকলে করেন না। তাহলে এতোদিন কেনো করলেন?

-আসলে কি করবো বলো,,কোনো পাগলী যে রাতে উঠে থেঁতলিয়া যাওয়া ক্ষত জায়গায় মলম লাগাতে পারে আমারও জানা নেই।কথাটা বলেই নিবিড় মুচকি হেসে, আসলে সত্যি বলতে আমি এতোদিন দ্বিধায় ছিলাম।কিন্তু কাল রাতে পুরোপুরি শিওর হলাম তুমি নাটক করছো।
এখন শুনো, কেউ আসার আগেই বলে রাখা ভালো।আমি চাই যে নাটক এতোদিন চালিয়ে গেছো সেটা আরও কয়েকদিন করো।এর ফাঁকে আমি ওর ফ্ল্যাটের কাগজ পত্রগুলো বের করে নিয়ে আসি।ও কি করেছে জানো?
-কী?
-ফ্ল্যাট ওর নিজের নামে নেয়নি।নিয়েছে তোমার নামে।
-মানে?
-আসলে মানুষের পাপের ঘোরা পূর্ণ হয়ে আসলে যা হয়।তুমি রিসাদকে এটা এখন বুজাবে যে তুমি ওকে মন থেকে চাও।এখান থেকে তুমি ওকে নিয়ে চলে যেতে চাও।আর তখনি ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবে এইটা আমি শিওর। 
-আপনি কীভাবে এতোটা নিশ্চিত হচ্ছেন?
-নিবিড় এমনি এমনি কথা বলে না এইটা তুমি ভালো করেই জানো।নিবিড় কাগজ পত্র দিয়েই কথা বলে।
- হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি।রিসাদকে এগ্রিমেন্ট পেপারে সাইন করিয়ে নিয়ে আসাটা।
-হু,,বোনের জন্য করেছিলাম।কিন্তু তা আমার জন্য এতোটা কাল হয়ে দাঁড়াবে বুজতে পারিনি।
কথাটা বলেই নিবিড় গলাটা ঝেড়ে, আমি কি করে জানবো ওইটা যে আপনার বিয়ের আগের আশেক।সত্যি করে বলো তো কী এমন দেখিয়েছো বা বুজিয়েছো যার জন্য ও তোমার এতোটাই পাগল? 
প্রিয়তা ন্যাকামি করে, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি। 
-হু,, সেই জন্যই আপনার পিছু ছাড়ছে না।এখন এসব বাদ দিন বুড়ী। অনেক ক্ষুধা লেগেছে।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর একসাথে খেতে যাবো।
-আমাকে কিন্তু আগের মতো খাইয়ে দিতে হবে হু,,,
-বলতে হবে না।তোমার মতো আমি মাথা মোটা নয়।
প্রিয়তা কিছু বলার আগেই নিবিড় দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো আর প্রিয়তা সেই দৃশ্য দেখে নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো।

মোশারফ হোসেন নিজের রুম থেকে এসে খেতে বসলো। আগের থেকে শরীরটা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় এখন। ডাক্তারকে ফোন দিয়ে আসার জন্য বলছে।কিন্তু ডাক্তার উল্টো মোশারফ হোসেনকে যেতে বললেন। 
ডাক্তারকে সন্ধ্যার পরে যাবে বলে আস্বস্ত করলেন।
নিবিড় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে, কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো।
নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে, আপু রিসাদ এখনো এলো না?
-নারে,,তুই নাকি কোনো একটা কাজে পাঠিয়েছিস?
-হু,,,এখন তো চলে আসার কথা।আপু তুই ফোন দিয়ে দেখ।
-চিন্তা করিস না,,ও আমাকে বলে গেছে ওর একটু লেট হবে।
-কোথায় গেছে বলে যায়নি?
-না।
-তুই জিজ্ঞেস করিসনি?
-ভাই আমি ওকে বিশ্বাস করি। এরচেয়ে বড় কিছু হতেই পারে না। 
নিবিড় কিছু বললো না।খাওয়া শেষ করে, বাবা আপনার কি শরীর খারাপ?
নিবিড়ের কথায় মোশারফ হোসেন চমকে উঠে, হু,,,,?
-আপনি কী কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?
-কই না তো!
-শরীর খারাপ?
-তা একটু,,তবে তুই চিন্তা করিস না।আমি আজ ডাক্তার দেখিয়ে নিবো।
-তাহলে সাথে আপুকেও নিয়ে যাবেন।
মোশারফ হোসেন নিবিড়ের কথায় উত্তর না দিয়ে উঠে নিজের রুমে গেলেন।
জুহির দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যায়।মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারলেই মরেও শান্তি পাবো।আজ বিকেলে জুহিকে দেখতে আসার কথা।ছেলের বাবাই সকালে সরাসরি ফোন দিয়ে কথা বলেছে।কিন্তু নিবিড়কে তো এই ব্যাপার কিছু বলা হয়নি। ছেলেটাকেও বা কি বলবো? প্রিয়তাকে নিয়ে যা যাচ্ছে ছেলেটার উপর দিয়ে তারপর কোন মুখে বলবো? কিন্তু আলাপ তো করা প্রয়োজন। 
আরও অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোশারফ হোসেন।

নাদিয়া জুহিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। নিবিড় রাগ করেই রুমে বসে আছে।বাবা তাকে না জানিয়ে এমন একটা কাজ করলো কীভাবে?  
প্রিয়তা অনেক বুজানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু নিবিড়ের এক কথা,বাবা কেনো তাকে একটা বার জিজ্ঞেস করতে পারলো না।প্রিয়তা তুমি বলো,আমি কী বোনদের খারাপ চাই? যার কারণে বাবা আমাকে একটা বার জিজ্ঞেস করেনি!
-বাবা হয়তো বুজতে পারেনি কিংবা মনে ছিলো না।বাবার এখন শরীর কিন্তু মোটেও ভালো নয়।আর আপনি তো উনারই ছেলে,বাবা একটা কাজ করতেই পারে আপনাকে না জিজ্ঞেস করে।তাই বলে আপনি রুমে বসে থাকবেন?
ছেলে পক্ষের লোক কিন্তু নিচে এসে বসে আছে।প্লিজ আপনি যান।
-কিন্তু প্রিয়তা,,,আমার কেনো জানি ভালোই লাগছে না।আর এই কেমন মেয়ে দেখা? ছেলে আর ছেলের বাবা।
তাদের ফ্যামিলিতে কী আর কোনো লোক নেই? 
-একটা কথা বলবো?
-বলো!
-মাহিদ ভাইয়াও কিন্তু জুহির জন্য খারাপ না!
কথাটা শুনেই নিবিড় পাশে ফিরে প্রিয়তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে, যত্তসব ফাউল চিন্তা ধারা।
নিবিড় নিচে নেমে গেলো।আর প্রিয়তা গম্ভীর হয়ে বসেই রইলো।

জুহিকে এনে ছেলের সামনের সোফায় বসিয়ে দিলো নাদিয়া।
নিবিড়ও এসে ছেলে পক্ষের সাথে হ্যান্ডশেক করে, বসে পড়লো।মোশারফ হোসেন নিবিড়ের মন বুজার চেষ্টা করছেন।নিবিড় সেদিকে মন না দিয়ে নিজের মতো করে ফোন টিপাটিপি নিয়েই ব্যস্ত।

ছেলের বাবা মুচকি হেসে, মা তোমার নাম কী?
জুহি বলার আগেই নিবিড় ফোন টিপতে টিপতে বললো,নাম না জেনেই মেয়ে দেখতে আসলেন? 
ছেলের বাবা নিবিড়ের দিকে ফিরে কিছু না বলে আবার জুহির দিকে তাকিয়ে, কোন ক্লাসে পড়ো?
-আপনারা এটাও জেনে আসেননি? আজব পাবলিক আপনারা।
ছেলের বাবা এইবারও কিছু না বলে জুহিকে বললো,মা রান্নাবান্না পারো? এখন আবার বড়লোকের মেয়েরা এসব পারে না।
-এইযে মিস্টার, বাসার জন্য কাজের লোক খুঁজছেন নাকি? তা হলে এইভাবে খোঁজে কি লাভ? পেপার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন।তবে এইভাবে নয়।
ছেলের বাবা এইবার নিবিড়ের দিকে ফিরে,আপনি বারবার আমায় অপমান করছেন!
নিবিড় দাঁড়িয়ে, শেটাপ, অপমানের এখনো কিছুই দেখেননি।আপনি এখনো মেয়ে দেখতে আসছে নাকি অন্য কোনো মতলব? 
লোকটা ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে,  মানে?
-মানে খুব সোজা,ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন আপনাদের যে লোক এইখানে পাঠিয়েছে সে কিন্তু মোটেও ভালো করেনি।তাকে বলে দিবেন আমার বোনদের কেউ ক্ষতি করতে এলে তাদের  সামনে বড় একটা দেওয়াল আছে যেটা টপকাতে তাকে আরও সাতবার জন্মনিতে হবে।
কথাটা শুনেই মোশারফ হোসেন এতোক্ষণ কিছু না বললেও এইবার উঠে দাঁড়িয়ে, কি বলছিস তুই এসব?
-বাবা প্লিজ আমি ওদেরকে অনেক আগে থেকেই চিনি।আর ওরা কার কথায় এখানে এসেছে সেটাও আমি এখন বুজেছি।
আপনাদের এখন পুলিশের কাছে দেওয়া উচিত কিন্তু আমি করবো না।কারণ সবচেয়ে নাটেরগুরুটাকে আমার চাই। ওকে গিয়ে বলবেন সাহস থাকলে নিবিড়ের সামনে এসে লড়াই করতে চোরের মতো পালিয়ে পিছনে নয়। 

নিবিড় উপরে উঠেই দেখে প্রিয়তা করিডরে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমে যাও এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
-আপনি ওদের চিনেন? 
নিবিড় রুমে এসে খাটে হেলান দিয়ে বসে,এরা রিসাদের লোক।
প্রিয়তা অবাক হয়ে,আপনি জানলেন কী করে? 
-প্রিয়তা! রিসাদ ওই অফিসে কি করে না করে আমার সব জানা এবং দেখা।যার উপর আমার একবার সন্দেহ হয় তাকে আমি সাবলীলভাবে ছেড়ে রাখি না।
-আপনি একটা আজব অদ্ভুত একটা লোক।যার সাথে সারাজীবন থাকলেও জানার শেষ হবে না।
নিবিড় মুচকি হেসে,কালকের জন্য রেডী থাকো।
-কেনো?
-রিসাদের জীবনে ঝড় দেখবে না?
-আপনি দেখাবেন?
-তুমি দেখাবে।
প্রিয়তা অবাক হয়ে, আমি!
- হ্যাঁ তুমি।আর আমি যা যা শিখিয়ে দিবো।শুধু তাই করবে।বেশি করছো তো খবর আছে।
প্রিয়তা অবাক হয়ে, শেষে আপনিও?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন