রংধনু - পর্ব ৪৬ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


রুমে এসে কুঞ্জনের দিকে তাকায় ইমতিয়াজ।পাশের রুম থেকে  ইদ্রি আর্তনাদ উপরে নিশাদের হৃদয়ভাঙ্গা কান্না ইমতিয়াজের হৃদয়কে ভেঙ্গে চূর্ন বিচুর্ন করে দিচ্ছে।রুমে এসেই বারান্দায় চলে যাই ইমতিয়াজ।সেখানে গিয়ে একটা নম্বরে কল করে ও।অপরপাশ থেকে এক রিং হতেই কে যেন কল রিসিভ করে।ইমতিয়াজ বলল,
''তোমাকে একটা ডিটেইলস দিচ্ছি।আর কোম্পানীর নাম ও পাঠাচ্ছি।আমাকে জানাও যে অফিসে ওর পারফরম্যান্স কেমন?মেয়েদের সাথে ব্যাবহার কেমন?ইটস আর্জেন্ট। "
অপর পাশ থেকে কিছু শুনে কল কাঁটে ইমতিয়াজ।তারাপর বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায়। চোখজোড়া ভরে আসতে থাকে ওর আবার ও।সাঁঝের কথা গুলো মনে আসতেই ইচ্ছে হতে থাকে মরে যেতে।প্রথম ভালবাসা পেলো না ও।ইমতিয়াজ ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
"নিশাদ, ইদ্রি.. একজনকে আমি সব কিছু দিয়ে বিশ্বাস করি আরেকজনকে সবকিছু দিয়ে আগলে বড় করেছি ছোটবেলা থেকে...আজ আমারই সামনে এতকিছু ঘটে গেল আমাকে তোরা একবার বলার প্রয়োজনও মনে করলিনা..আমি কি তাহলে ধরে নিবো আমি ভাই এবং বন্ধু উভয় হিসেবেই ব্যার্থ ...তোর কোন আবদার আমি অপূর্ণ রাখিনি ইদ্রি তুই এই ভাইটার কাছে বলার মতো বিশ্বাসটুকু করতে পারলি না আমি সবসময় তোর ভাই কম বন্ধু হবার চেষ্টা করেছি সেই জায়গাটা অর্জন করতে না পাড়ার ব্যার্থতা আজ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে....আর নিশাদ!! তোকে ঠিক কতটা বিশ্বাস করেছিলাম সেটা তুই নিজেও ধরতে পারলিনা..এই উভয়মেরুর ব্যার্থতার দায়ভার যখন আমার তখন এর ইতিটাও আমিই টানবো...আমি প্রমাণ করবো আমার কাছে বোন প্রিয় না বেস্ট ফ্রেন্ড.. তোদের খেল শেষ এবার আমার খেল দেখবি... "
পরদিন ইমতিয়াজের ঘুম ভেঙ্গে দেখে পাশে কুঞ্জন নেই নিশাদ ও নেই।ইমতিয়াজ ভেবেছিলো হয়ত নিচে। কিন্তু নিচে গিয়ে একজনকে ও না পেয়ে বড় মামীকে জিজ্ঞেস করতেই ওনি বললেন,
''ওরা সকালেই চলে গিয়েছে।নিশাদ বলছিলো কি ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে ওকে জয়েন করতে হবে।আমরা অনেক থামাতে চেষ্টা করলাম।ও থাকলোইনা।ইমতিয়াজ ভাবনায় পড়ে যায়।
নিশাদকে কল দিতেই খেয়াল করলো নিশাদ কল কেঁটে দিয়েছে।আদনান সাঁঝের নম্বরে কল দিয়ে ও কথা বলতে পারেনি।সেদিন ইশিতা আর ভূবনের বৌভাতের পর ঢাকায় ফিরে আসে ওরা।ইমতিয়াজ নিজেকে কোনভাবেই স্বাভাবিক করতে পারেনি।
..............................কপালের দুপাশে হাত চেঁপে বসে আছে আদনান।বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছে তিন চারদিন যাবৎ।ব্যাপারটা ঘটেছিলো দশমির দিন যেন প্রিয়াশার বাসায় গিয়েছিলো।আর যা দেখলো শরীরের শিরা উপশিরায় রক্তের বেগ বেড়ে যেতে থাকে।ঠিকমতো কাজে মন দিতে পারছেনা এ দৃশ্য দেখার পর থেকে।রেস্টুরেন্টের মেন্যু কার্ড টায় চোখ বুলায় আদনান।কি অর্ডার দিবে কিছুই বুঝতে পারছেনা আদনান।বুকটা বড্ড অস্থির হয়ে আসছে ওর।সেদিন পুজায় প্রিয়াশার বাসায় গিয়ে দেখেছিলো প্রিয়াশা ঘরে নেই।আদনানের সামনে দরজা খুলে দিয়েছিলো একজন মাঝ বয়স্ক মহিলা।মুখে মিথ্যা হাসি দিয়ে বলছিলো,
''আপনি কেডা?"
মহিলার হাসিতে কিছুটা বিরক্ত আদনান।এমন হাসি দেয়ার মানে কি?কিছু হাসি আছে না দেখলে রাগ লাগে।ঠিক তেমন।আদনান মৃদু হেসে বলল,
''প্রিয়াশা আছেনা?"
আদনান কথাটা শেষ করতে না করতেই ভিতরের রুম থেকে একমেয়েলি কন্ঠের চিৎকার শোনা গেলো।কিছুটা চমকে উঠে আদনান।আশেপাশের পুরো পরিবেশ টা এত উৎসব মুখর আর এখানে কে এভাবে চিৎকার করছে?মনে হচ্ছে অনেক যন্ত্রনায় কেউ চেঁচাচ্ছে।মহিলাও পিছনে তাকিয়ে আবার ও আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,
''কেডারে চান?"
''প্রিয়াশা আছেনা?"
''জি আছে।আপনি কেডা?"
''আমি ওর অফিস থেকে এসেছি।আদনান আদিয়াত রাহমান।"
মহিলা আদনানকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, 
''আয়েন বয়েন।"
আদনান ভ্রু কুঁচকে সোফায় বসলো।মহিলা পান চিবানো লাল ঠোঁট নেড়ে বলল,
''আমি প্রিয়াশার কাকী।"
আদনানের ঠোঁটে সৌজন্যতার হাসি।মহিলা বলল,
''তা প্রিয়াশার কেন খুঁজেন?নামেতো মুসলিম লাগতাছে।"
''আমি মুসলিম।প্রিয়াশা আসতে বলেছিলো।প্লিজ ওকে ডেকে দিন।"
হঠাৎ আবার ও একটা মেয়ের চিৎকার। আদনান উঠে দাঁড়িয়ে যায়।অস্থির কন্ঠে বলল,
''আপনাদের বাসায় কোন প্রবলেম?"
''আরে না না।আমার পাগল ভাগনী আছে একডা।হেই চিল্লায়।"
''ওহ।"
আদনান আবার ও বসে।মহিলা প্রিয়াশাকে ডাকছে বলে চলে যায় আদনানের বসার রুমের দরজা একটু আলগিয়ে।আদনানের কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।কেন যেন খুব বিপদ লাগছে ওর।ভাবছিলো মুখ ধুলে হয়ত একটু ভালো লাগবে।আর বাথরুমে যেতে হবে ওর।উঠে দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ খেয়াল করে দরজা খুলে একটু এগুতেই দেখলো একটা রুমের দরজা খুলা।ভিতর থেকে পানির ছপছপ শব্দ আসছে।আদনান অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু উঁকি দিয়ে দেখলো প্রিয়াশা রুমাল দিয়ে কি যেন মুছে বোলের পানিতে লাল হয়ে যাওয়া রুমাল ভিজাতেই  পানি লাল হয়ে গেলো।আদনান সরে আসে।এ কি দেখলো?আদনান পিছনে ফিরতেই দেখলো প্রিয়াশার চাচী দাঁড়িয়ে। মহিলা হেসে বলল,
''কি দেহেন?"
আদনান নিজেকে সামলে বলল,
''কিছুনা।বাথরুমে যাবো।"
''ওহ ঐ যে সোজা বাথরুম।"
আদনান মৃদু হেসে বাথরুম চলে যায়।বাথরুমে ঢুকতেই মনে হলো বোঁটকা একটা গন্ধ।গা গুলিয়ে এলো আদনানের।সাথে সাথে বেসিনের দিকে ফিরে ভড় ভড় করে বমি করে দিলো।প্রিয়াশা নিজের মুখ থেকে রক্ত মুছে নিচ্ছিলো?কি হচ্ছে ওর সাথে?কি হচ্ছে?আদনান দুহাতে মাথা চেঁপে ধরে।কিছুক্ষন পর বেরিয়ে এসে দেখলো প্রিয়াশা বসার ঘরে নাস্তা রেডি করেছে।লাল রং এর শাড়ী পরেছে।শাড়ীর ফাঁকে সাদা ধবধবে পেট দৃশ্যমান।আদনান সেদিক থেকে যেন চোখ সরাতে পারছেনা।অজানা এক ঘোরে চলে গেলো ও।লম্বা কোঁকড়ানো চুল গুলো খোলা পিঠের ওপর।প্রিয়াশা খাবার সাজিয়ে আদনানের দিকে তাকায়।আদনান পেটের থেকে চোখ সরিয়ে প্রিয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠোঁটের কোনে হালকা লাল দাগ।ঠোঁট ঘেঁষে গাল পর্যন্ত।ওর মেকাপে ও ঢাকা পড়েনি।আদনান কে দেখে প্রিয়াশা হেসে বলল,
''কখন এলেন?"
আদনান প্রিয়াশার দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল,
''আপনার চাচী আপনাকে বলেনি?"
প্রিয়াশা হেসে বলল,
''ভুলে গেছি বসুননা।"
আদনান সোফায় এসে বসে।প্রিয়াশা দাঁড়িয়ে ওর সামনে।আদনান হেসে বলল,
''বসুন না।দাঁড়িয়ে কেন?"
প্রিয়াশার চেহারা আতঙ্কে ভরে গেলো।আদনান ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার ও বলল,
''বসুন।"
''দরকার নেই।আপনি নিন না।"
আদনান প্রিয়াশার হাত টেনে বসিয়ে বলল,
''আমি খাবোনা।তবে আপনার সাথে কথা আছে।"
প্রিয়াশা কিছু বলতে গেলে একজন রুমে প্রবেশ করলো।একজন পুরুষ সে।লোকটাকে দেখে প্রিয়াশা উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।আদনানের সামনে এসে লোকটা দুহাত জোড় করে বলল, 
''নমস্কার।"
আদনা মৃদু হাসলো তবে কিছু বলেনি।লোকটা প্রিয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল,
''প্রিয়াশা আমার পরিচয় করাবিনা ওনার সাথে?"
''জি দাদা। স্যার ওনি আমার চাচাতো ভাই ধনেশ।"
আদনান আবার ও একটু হাসলো।লোকটা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
''হাত তো মিলাতে পারি।"
''জি।আমি আদনান আদিয়াত রাহমান।"
লোকটার হাতে হাত মিলিয়ে বলল আদনান।লোকটা আদনানের সামনে যে বসলো সরলোই না।প্রিয়াশা খাবার সাজিয়ে যাওয়ার সময় আদনান খেয়াল করলো লোকটা প্রিয়াশার কোমড় পেটের দিকে চেয়েছিলো।আদনানের বেশ খারাপ লাগলে ও নিজেকে সামলে নেয়।সেদিন বেরিয়ে আসার সময় প্রিয়াশার সাথে দেখা হয়নি ওর।কথগুলো ভাবার মাঝেই প্রিয়াশার আগমন।প্রিয়াশা আদনানের সামনে এসে বসে।আদনান সোজা হয়ে বসলো।প্রিয়াশা বলল,
''কেন ডেকেছেন?"
আদনান একটু এগিয়ে এসে বলল,
''কি হচ্ছে আপনাদের বাসায় আপনার সাথে?"
প্রিয়াশা যেন ভয় পেয়ে গেলো।কম্পিত গলায় বলল,
''এটা বলার জন্য ডেকেছেন?"
''হ্যা।কারন আপনি ঠিক নেই।কি হচ্ছে সেখানে?"
প্রিয়াশা বলল,
''কিছুনা।আর কিছু বলতে চান?"
''দেখুন প্রিয়াশা না করতে পারবেননা কারন আমি দেখেছিলাম আপনি পানি দিয়ে নিজের মুখের রক্ত পরিষ্কার করছিলেন।সেটা দেখার পর থেকে আমি এখনো স্বাভাবিক হতে পারছিনা।আপনার চাচী ভাইয়ের কথা বাদই দিলাম।ওনাদের কাউকেই বিন্দুমাত্র ভাল লাগেনি আমার।কি হচ্ছে আমাকে বলুন।"
প্রিয়াশা গলা স্বাভাবিক করে বলল,
''দেখুন তেমন কিছুনা।আমি ঠিক আছি।ঐদিন ব্যাথা পেয়েছিলাম মুখে।"
''আমার তো তেমন মনে হয়নি।মনে হচ্ছিলো ধারালো কিছু দিয়ে কিংবা কামড়ে রক্ত বের করা হয়েছে।কি হয়েছে বলুন।"
''এমন কিছুনা স্যার বেশি ভাবছেন আপনি।"
''একদমই বেশি ভাবছিনা প্রিয়াশা।আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন হয়ত আপনার সাহায্যে ও আসতে পারি।"
প্রিয়াশা এবার গলা শক্ত করে বলল,
''দেখুন আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।এমন কিছুনা।ওখানে খুব ভালো আছি।"
আদনান কিছু বলার আগে প্রিয়াশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''আমি উঠলাম।আর কখনো এমন প্রশ্ন করবেননা।"
বলেই বেরিয়ে গেলো ও।আদনান প্রিয়াশার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো।আদনানের মনে হতে থাকে প্রিয়াশা যাই বলছে কোনভাবেই ও ঠিক নেই।
..............................শাড়ীর ভেতরে ফুলে উঠা কোমড়ের থেকে চোখ সরিয়ে বেলার দিকে তাকায় বিভান।আজ বেলা কাতানের মেহেদী রং এর একটা শাড়ী পরেছে।বেলাকে দেখতে অপরুপ লাগছে।এসবই বাহানা।বিভানকে পাগল করাই যেন বেলার মূল উদ্দেশ্য। লম্বা দুয়েক শ্বাস ফেলে বিভান পাকঘরে প্রবেশ করে।বেলা ডাল নাড়ছে।বিভান বেলার পাশে গিয়ে ওর কোমড়ে দুহাত রেখে বেলার গালে চুমু খেয়ে বলল,
''আজ তোমাকে দেখে নিজেকে উন্মাদ লাগছে।বড় অস্থির লাগছে।আজ এই অস্থিরতা কাঁটিয়ে দাওনা।পাগল হয়ে যাবো নাহলে।"
বিভানের এই আকস্মিক আগমন তারপর এমন স্পর্শ তারওপর এই লাগামহীন কথা বার্তা বেলাকে প্রচন্ড লজ্জা পাইয়ে দেয় বিয়ের তের বছর পর ও।বেলা কম্পিত কন্ঠে বলল,
''পূর্না চলে আসবে।"
বিভান বিরক্তের শব্দ করে বলল,
''তুমি বেশিই কথা বলো।"
বেলার পেট শক্ত করে চেঁপে ধরে বিভান।বেলা বলল,
''কি করতে চাইছেন বিভান?ডাল বসানো তো।"
 বেলার কাঁধে নাক রেখে বিভান বলল,
''দেখো তোমাকে আমার লাগবে এখন।তারপর ও যদি চাও কাজ টা সহজ করতে পারি।"
বেলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
''কি?"
বেলাকে সামনে ফিরায় বিভান।বেলা অবাক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে।তার চোখজোড়াও আজ প্রচন্ড নেশায় পরিপূর্ন।বিভান বলল,
''কিস মি।"
বেলার দুগাল লাল হয়ে আসে।লোকটার কথায় ওর ভীষন লজ্জা হয় অজানা কোন কারনে।বিভান বেলার কোমড় ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,
''কথা কানে যায়না।আমাকে চুমু খাও।নাহলে ডাল শুকিয়ে যাবে।"
বেলা লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল, 
''হয়েছে টা কি আপনার?এভাবে কেন বলছেন?"
''আজ তোমায় দেখে তের বছর আগে পৌছে গেলাম।তোমার সেই রুপ যৌবন আজো পাগল করে আমায়।"
বেলা যেন বিভানের কথায় ডুবে যাচ্ছিলো।বিভান ওর ঘোর কাঁটিয়ে বেলাকে বেসিনের পাশে বসিয়ে আবার বলল,
''বেলা প্লিজ জলদি করো।"
বেলা বুঝতে পারছেনা কি করবে?তবে লোকটাকে ও তো ভালবাসে।তার মাঝে ও মিশে যেতে চসয় ও।তাই বেলা অপেক্ষা না করে বিভানের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে বিভানের গলা জড়িয়ে ধরে।উষ্ম ভালাবাসায় ডুবে যাচ্ছিলো ওরা।হঠাৎ কিছু একটা পড়ার শব্দে একে অপর থেকে সরে এসে দুজনে পিছে তাকিয়ে দেখলো পূর্না ওদের দিকে তাকিয়ে আছে ভাষাহীন চোখে।ওর হাতের ছোট্ট গাড়িটা নিচে পড়ে আছে।বেলা নিচে নেমে আসে আর বিভান ও বেরিয়ে যায়।বেলা লজ্জায় মুচকি হেসে ভিজে যাওয়া ঠোঁটের উপরি ভাগ মুছে মেয়েকে বলল,
''আসো আম্মু।"

!!!!

সিরাজগঞ্জ থেকে ফেরার পরপরই নিশাদের একশত তিন ডিগ্রি জ্বর উঠে যায় সেই সাথে প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যাথা।জ্বর কমার নামই নিচ্ছেনা সাথে মাইগ্রেন ও।সারারাত বিছানায় কাতরাচ্ছিলো মা বাবার কোলে।ইকরাম রাহমান যত কঠোর হৃদয়েরই হননা কেন সন্তানদের জন্য ছিলো অপরিসীম ভালবাসা।নিশাদ প্রচন্ড জ্বরে প্রলাপ বকছিলো সারারাত। বারবার মায়ের হাত ধরে ক্ষমা চাচ্ছিলো দুচোখ বোজা অবস্থায়। চোখের কোনা দিয়ে বারবার পানি গড়াচ্ছিলো।জুলেখা বানু চোখ মুছে ও কুল পাচ্ছিলেননা।এক পর্যায়ে তিনি ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।ইকরাম রাহমান রেগে বলছিলেন,
''চুপ থাক।কিছু হয়নি এডার।কান্দোস কিল্লাই?"
''আমনে রাগ দেহাইয়েননা।আর ফোলাডার কি হই গেছে।আব্বা নিশাদ উঠ আব্বা।"
মা বাবার কান্নায় সাঁঝ আদনান হুমায়রা লাবনী কুঞ্জন উঠে চলে আসে।সাঁঝ এসে ভাইয়ের কপাল ছুঁইয়ে দিয়ে চমকে উঠেছিলো।আদনান ও পরপরই ভাইয়ের কপাল ছুঁয়ে বলল,
''এত্ত জ্বর।আর তোমরা ডাকলাওনা"
তারপর হুমায়রার দিকে চেয়ে আদনান বলল,
''যাহ পানি আন।মাথায় পানি ঢালবো।"
হুমায়রা দৌড়ে পানি আনতে চলে যায়।লাবনী ও অজু করে কোরআন শরীফ নিয়ে বসে।সাঁঝ ভাইয়ের মাথায় পানি ঢালছিলো।জুলেখা বানু কাঁদছিলেন তখন ও।আদনান বাবা মাকে বলল,
''যাও তোমরা ঘুমাও।হুমু লাবু যা ঘুমা।কুঞ্জন তুই ও যা।"
জুলেখা বানু রেগে বললেন,
''আমি ঘুমামু না।আমার পোলাডা মইরা যাইতাছে।"
আদনান কিছু বলতে গেলে সাঁঝ হাত ধরে থামিয়ে বলল, 
''ভাই প্লিজ।"
রাত দুটোয় জ্বর কিছুটা কমে আসে।আদনান সাঁঝ আর মা যে যার রুমে চলে যায়।নিশাদ অজ্ঞানের মতো পড়ে থাকে।পরদিন থেকে শুরু হয় মাইগ্রেনের ব্যাথা।কিন্তু কাউকে জানায়নি নিশাদ ঘুম থেকে উঠে গোসল সেড়ে নেয়। মাথা ব্যাথা কমার কোন নাম নেই।মাইগ্রেনকে পাত্তা  না দিয়ে নাস্তা খেতে বসে নিশাদ।ওকে রেডি হওয়া দেখে জুলেখা বানু বললেন,
''কই যাস তুই? তোর চোখ এত লাল কেন?"
নিশাদ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
''অফিসে যাইতেছি।"
''কি কস?"
চেঁচিয়ে উঠে জুলেখা বানু। রেগে বললেন,
''জ্বর নিয়া যাওনের দরকার নাই।"
নিশাদ কিছুটা বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল,
''আম্মা প্লিজ এমন কইরোনা।জ্বর নাই।"
জুলেখা বানু নিশ্চিত হতে পারলেননা।দৌড়ে এসে ছেলের কপালে হাত দিয়ে রেগে বললেন, 
''কিরে শুয়োরের বাইচ্ছা তোর নাকি জ্বর নাই?গা পুইড়া যাইতেছে।"
নিশাদ চটজলদি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সাথে সাথে চেয়ার ধরে বলল, 
''লাবনী বের হ।"
জুলেখা বানু ছেলের হাত ধরে বললেন,
''আব্বা যাইস না।"
''মা জেদ কইরোনা।অনেক কাজ পড়ে আছে।তারা কি আমারে বসায় বসায় টাকা দিবে?"
মায়ের হাত ছাড়িয়ে লাবনীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।লাবনী ভাইয়ের দিকে মলিন দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
''ভাইয়া তুই পারবি?"
জবাবে মাথা ঝাঁকায় নিশাদ।সেদিন অফিসে গিয়ে বারবার কফি খাচ্ছিলো নিশাদ।নিচে তাকাতেই যেন মাথা ছিড়ে যাচ্ছিলো।চোখজোড়াও টনটন করছে।ওকে বারবার কফি খেতে দেখে ফারুজ খান বলছিলেন,
''কি তুমি কি পার্সোনালি কফি মেশিনডা কিন্না ফেলছো?"
জবাবে নিশাদ বলল,
''প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যাথা স্যার।"
ওনি ও কি গজগজ করতে করতে চলে গেলেন ওর সামনে থেকে।কফির মগে চুমুক দেয়ার মাঝেই নিশাদ দেখলো ইমতিয়াজ কল করছে।নিশাদ কল কেঁটে ফোন উল্টে রাখে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেয় নিশাদ।নিশাদ সিটে হেলান দিয়ে চোখজোড়া বুজে নেয়।সেদিন ইদ্রির দিকে কথা গুলো বলার সময় ও তাকাতে পারছিলোনা।ওর সাহস হচ্ছিলো না।ইদ্রির কাছে কি নিশাদ সার্থপর খুব জঘন্য একজন লোক হয়ে গেলো?নিশাদ তো এটাই চেয়েছিলো।ইদ্রির জন্য অনেক ভাল ছেলে আসবে আরো জোয়ান।ও খুব ভালো থাকবে সুখে থাকবে।নিশাদ চায় ইদ্রি ভালো থাকুক।অন্য কেউ আসবে ওর জীবনে ইদ্রি অন্য কারোর জীবনের সাথে জড়িয়ে যাবে।সেটা কি সহ্য করতে পারবে নিশাদ?সহ্য করবে ও পারতে হবে ওকে।অন্তত নিজের এই জীবনে মেয়েটাকে জড়িয়ে ওর সুন্দর জীবন নষ্ট করতে চায়না নিশাদ।আর চাইবেই বা কি করে? মেয়েটাকে ভালবাসে ভীষন ভাবে।জ্বর বেড়ে চলেছে নিশাদের।আর বাকি অনেক কাজ।আটটার আগে বেরুতে পারবেনা।
........................ সাঁঝ আর সাইমন একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সাঁঝ চোখ রাঙ্গিয়ে সাইমনের দিকে তাকাচ্ছে।সাইমন কে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে।সকালে সাঁঝকে কল দিয়ে অফিসের সামনে ডেকেছিলো সাইমন।সাঁঝ যেতেই ওকে সাইমনের কামরায় ডেকে পাঠানো হলো।সাঁঝ সেখানে গিয়ে দেখেছিলো সাইমন ভালো নেই।চোখের নিচের কালো দাগ,গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।সাঁঝের চোখ ভরে আসে।সাইমনের গাল স্পর্শ করে বলছিলো,
''এ কি হাল করেছেন নিজের?"
সাইমন সাঁঝকে জড়িয়ে নেয় বুকে।সাঁঝ অনূভব করতে পারছিলো সাইমনের বুক ভীষন কাঁপছে।সাঁঝ বলল, 
''ঠিক আছেন?কি হলো আপনার?"
''জানো এতোটা দিন কতো কষ্টে কাঁটিয়েছি।একেকটা দিন কতো যন্ত্রনাদায়ক ছিলো।সাঁঝ তোমাকে ছেড়ে থাকাটা দিনকে দিন খুব কঠিন হচ্ছে।"
সাঁঝ সাইমনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
''সব ঠিক হয়ে যাবে।"
''জানো কিছুক্ষনের জন্য মনে হচ্ছিলো হারিয়ে ফেলবো তোমায়।ভয় টা বুকে বসে গিয়েছিলো।"
সাঁঝ সরে এসে বলল, 
''আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি?"
সাইমন সাঁঝের চুল হাতিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল,
''এমনটা নয়।ওখানে ভাইয়া আনমেরিড ফ্রেন্ড ছিলো।"
সাঁঝ রেগে বলল,
''আর আপনি ভেবেছেন আমি ওখানে বিয়ে করবো?"
সাইমন বলল,
''ভাইয়া তোমাদের জন্য অনেক ইম্পরট্যান্ট। হয়ত ওনির কথা শুনেই.........."
সাঁঝের রাগ লাগছে প্রচন্ড রকমের।লোকটা আসলে কি?ভাইয়া যাই করুক ওকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া এমন কখনোই করবেনা।সাঁঝ শক্ত গলায় বলল,
''ভাইয়া যাই করুক অন্তত আমার পারমিশান নিবে।"
সাইমন সাঁঝকে বুকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু পারেনি।সাঁঝ ঘাড় শক্ত করে রেখেছে।সাইমন ওর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলো।সাঁঝ কিছু বলছে ও না।সাইমন হঠাৎ ওর হাত ছেড়ে নিজের ডেস্কের কাছে গিয়ে একটা ছোট্ট বক্স নিয়ে সাঁঝের সামনে এসে দাঁড়ায়।
সাঁঝ সেদিকে আড় চোখে তাকিয়ে অন্যদিকে মাথা ঘুরালো।সাইমন বলল, 
''দেখো রেগে থাকলে এই নুপুরটা লিজা কে পরাবো।ভেবে দেখো।"
''পরান।"
হঠাৎ সাঁঝের ভাবান্তর ঘটলো।মনে হলো লিজাটা কে?সাঁঝ রেগে বলল,
''এই লিজা কে আবার?"
সাইমন একটা ভ্রু উঁচু করে বলল,
''আছে বলা যাবেনা।"
সাঁঝ রেগে সাইমনের কলার টেনে বলল,
''বল কে সে?আমি ওখানে যেতেই আরেকটা জুটিয়ে ফেলেছিস?এখন আমি বাসায় কি বলবো তোর কথা?"
সাইমন অবাক।আপনি থেকে তুইতে নেমে গেলো।সাইমন চোখজোড়া ছোট করে বলল,
''বাহ তুমিও না ডিরেক্ট তুই?"
সাঁঝ ওর কলার ধরে নিজের দিকে টেনে শক্ত গলায় বলল,
''এবার তো শুধু তুই গালি গালাজ করিনি।বল কে সে লিজা?"
সাইমন এবার হো হো করে হাসতে লাগলো।সাঁঝ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।লোকটার হাসি ওর বিরক্ত লাগছে।সাইমন হাসি থামিয়ে বলল,
''একটু আগে একটা মেয়ে ঝাড়ু দিয়ে গেলো খেয়াল করেছিলে?"
অভিমানী কন্ঠে সাঁঝের জবাব, 
''হুম।"
''ওর নাম লিজা।"
সাঁঝ প্রচন্ড রেগে সাইমনের বুকে মারতে লাগলো।বলতে থাকলো এমন দুষ্টুমির মানে কি?"
সাইমন আবার ও ওকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বলল,
''হয়ে গেছে সরি।ভালবাসি সাঁঝ।তোমাকে দেখার পর থেকে আর কেউ মনেই আসেনি।"
সাঁঝ কেঁদে ফেললো।সাইমন ওকে সোফায় বসিয়ে চোখ মুছে দিয়ে সাঁঝের ডান পা নিয়ে রানে উঠিয়ে একটা স্বর্নের নুপুর পরিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর চুমু দেয়।সাঁঝ লজ্জায় মাথা নিচু করে।
................................পূর্না কে বেলা আবার ও ডাকতে পূর্না দৌড়ে এসে মায়ের কোলে উঠে যায়।বেলা মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আম্মু কিছু খাবে তুমি?"
পূর্না মাথা নেড়ে বলল,
''কাবোনা।কেতে বালো লাগেনা।"
সাঁঝ হেসে বলল,
''এমনটা বললে হবে?খেতে হবে তো?আজ আম্মুটার জন্য কি বানাবো?"
''নুডুস।"
বেলা হেসে ফেললো।হাসি থামিয়ে বলল,
''আম্মুটা নুডুলস খেতে চায়?সুপ করে দিবো নাকি ভেজে দিবো ওদিনকার মতো?"
''ভেদে দাও।দিম দিও তাথে।"
''ওকে।বাবার কাছে যাও।মা নুডুলস নিয়ে আসছি।"
পূর্না বেলার কোল থেকে নেমে বিভানের কাছে এসে দাঁড়ায়।বিভান খাটে বসে আছে।মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।পূর্না বলল,
''বাবা কোনে নাও।"
বিভানের বেশ লজ্জা লাগছে কোন এক অজানা কারনে।ওর মেয়েটা এসব বোঝেনা।তারপরও কেন যেন?পূর্নাকে কোলে নিতেই ও বলল,
''তুমু দাও।"
বিভান মেয়ের দুগালে চুমু দিয়ে বলল,
''এই যে দিলাম আম্মু।তোমার মা কি করে?"
''নুডুস লান্না কলে।"
''নুডুলস কি আমার বুড়িটা খাবে?"
হেসে বলল বিভান।জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো পূর্না।সেদিন বিকেলে বিভান বেলা আর পূর্না কে নিয়ে বের হয়।বেলা বাসন্তী রং এর শাড়ী পরেছে সাথে হাতে দুটো চুড়ি,চুল খোঁপায় বাঁধা।তবে খোপায় আছে দুটো সাদা ফুল।আর চেহারায় হালকা সাজ।বিভান সাদা পাঞ্জাবী পরেছে আজ।লোকটা পাঞ্জাবীতে ভীষন সুন্দর লাগে।সেটা যেকোন বর্নেরই হোকনা কেন?তবে সাদায় তাকে অনেক বেশি মানায়।বিভান সেটা জানে বেলা ওকে সাদা পাঞ্জাবীতে পছন্দ করে।ওরা গাড়িতে যাচ্ছে লংড্রাইভে।পূর্না অনেকটা সময় দুষ্টুমি করে ক্লান্ত হয়ে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।বিভান মেয়ের দিকে মায়াবী হাসি দিয়ে বলল,
''বেলা বাংলাদেশ থেকে একবার ঘুরে আসা উচিৎ তাইনা?"
বেলার বুক কেমন করে উঠে।বাংলাদেশের কথায় ওর বুক ভারি হয়ে আসে।লোকটা হঠাহ এ কথা কেন বলল?বেলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
''হঠাৎ বাংলাদেশের কথা?"
''পূর্নার দেখা উচিৎ ওর মায়ের দেশ।ওর আরো একটা সুন্দর পরিবার আছে।"
''বিভান আমি এখনই বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছিনা।ওকে আগে এখানে সেটেল হতে দিন।এমনিতেই কম ধকল যায়নি।মেয়েটা স্বাভাবিক হয়েছে ঠিক তবে মাঝে মাঝে ঘুমে কেঁপে উঠে।"
বিভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
''সেটা ও ঠিক হয়ে যাবে।"
বেলা কিছু না বলে জানালার দিকে তাকায়।ওর ও বড় ইচ্ছা হয় মানুষ গুলো কে দেখার ছুঁয়ে দেয়ার।ওতো ভীষন স্মরন করে তাদের।বাবা মা নিশাদ আদনান সাঁঝ কুঞ্জন হুমায়রা আর লাবনী।ওর ও হৃদয় কাঁদে মানুষগুলোকে দেখার জন্য।কতোদিন মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো হয়না।বাবার আদর করে বেলা ডাকটা শোনা হয়না।বেলা অজান্তে কেঁদে দেয় গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন