মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ০৩)


' এই সময় আবার কে এলো রে বাব?'
তোহার ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও টিভি অফ করে দরজা খুলতে উঠে এলো। দরজা খুলে দিয়ে এক চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল,
' খালামণি,,, আপু!' 
তোহা এসে খালামণিকে জড়িয়ে ধরলো। মেহেরুন বললেন, 
' খালামণি বলে চিৎকার দিয়ে তো কানের পোকা নাড়িয়ে ফেলেছিস। একটু আস্তে চিৎকার করবি তো।'
' তুমি এতদিন পর এসেছ। আমি তোমাকে দেখে চিৎকার করবো না? তুমি কেমন মানুষ? আমি কত করে বলেছি খালামণি আমাদের বাসায় আসো। দু'তিন দিন থাকবে। তুমি কি করলে? নানা কাজের অজুহাত দেখিয়ে এলে না। আজ যে তুমি আসবে তা তো আমরা কেউই জানি না। তুমিও ফোন করে বলোনি। আপুও তো কিছু জানায়নি।'
স্পৃহা ভেতরে ঢুকে গেছে। তোহা এখনো মেহেরুনকে জড়িয়ে ধরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরুন বললেন, 
' এই বাচাল মেয়ে একটু কম কথা বল। তুই হয়েছিস স্পৃহার থেকে একদম উল্টো। সে কথা বলতে চায়না। জোর করেও তাকে দিয়ে কথা বলানো যায় না। আর তুই কথা বলতে শুরু করলে থামার নাম নিস না। জোর করেও থামানো যায় না।'
' আঙ্কেল এসে আপুকে নিয়ে গেল। আমাকে কেন সাথে নিলো না। তোমরা আপুকে এতো ভালোবাসো। তাহলে আমাকে কেন এতো কম ভালোবাসো?'
' আরে পাগলী তোর তো স্কুল চলছে। তুই গেলে ক্লাস মিস হতো না? তাই তো... '
' হয়েছে হয়েছে। আমি সব বুঝি। তোমরা আমাকে যতটা ছোট ভাবো আমি কিন্তু ততটাও ছোট না। আমি জানি তোমরা সবাই আপুকেই বেশি ভালোবাসো। আমার থেকেও অনেক বেশি।'
তোহা খালামণিকে ছেড়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। মেহেরুন তোহার মাথায় গাট্টা মেরে বললেন,
' আবার শুরু হয়েছে তোর নাটক। তানিয়াটা কেন যে তোকে দু মাসের এক্টিং ক্লাসে পাঠিয়েছিল। এখন তো তোর এক্টিং দেখতে দেখতে অসহ্য লাগে। যখন তখন শুরু হয়ে যাস।'
তোহা খালামণির কথায় হেসে দিয়ে বলল,
' এবার কিন্তু আমিও যাব। আমার পরীক্ষা শেষ হলেই তুমি আঙ্কেলকে পাঠিয়ে দিবে।'
' তা কি তোকে বলে দিতে হবে? এখন বল তোর মা কোথায়? '
' মা সবসময় যেখানে থাকে।'
' স্কুলে? '
' আরে নাহ। রান্নাঘরে। '
স্পৃহা বাসায় এসেই নিজের রুমে চলে গেল। বোরখা খুলে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তানিয়া অনেকদিন পর নিজের বোনকে দেখে একটু আবেগী হয়ে উঠলেন। দুপুরে দুই বোন মিলে রান্না করলেন। তোহা স্পৃহার সাথে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিয়েছে। এই কয়দিন বাসায় কী কী হয়েছে, স্কুলে কী করেছে সবকিছু ডিটেইলসে বলছে।

জীবন নূপুরকে নিয়ে সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে। রাতে দু'জনে রেস্টুরেন্টে খেয়ে ফিরে যাবার জন্য বাইকে উঠেছে। আজ পুরোটা দিন নূপুর জীবনের সাথে ছিল। কিন্তু এখন নূপুর বাসায় ফিরে যাবে। জীবন চায় না নূপুর তার থেকে দূরে থাকুক। সে চায় নূপুর সবসময় তার কাছে, তার পাশে থাকতে। জীবন চুপচাপ বাইক চালাচ্ছে। নূপুর তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। নূপুর ঠিক বুঝতে পারছে জীবনের মন খারাপ। নূপুরেরও তো কিছু করার নেই। সেও জীবনের সাথে থাকতে চায়। জীবনের থেকে দূরে থাকতে তারও কষ্ট হয়। ফাঁকা রাস্তা, অন্ধকার রাত,সাথে প্রচুর বাতাস বইছে। নূপুরের খোলা চুল বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে। হালকা শীত শীতও লাগছে। নূপুর আরো শক্ত করে জীবনকে জড়িয়ে ধরলো। 
জীবনের বাইক নূপুরদের বাসার গলিটার সামনে থামলো। 
' এই এখানেই থামো। আর ভেতরে যেতে হবে না। কেউ দেখে ফেললে... বুঝতেই তো পারছো।'
' হুম। '
নূপুর নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
' তুমি ঐদিন আমাদের বাসার সামনে এসে ছিলে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিলে তাই না?'
' হুম। ' 
' কেন এমন করো তুমি? তুমি তো জানোই আমার ভাইয়ারা কেমন? ওরা বাসার সামনে কোনো ছেলেকে ঘুরাঘুরি করতে দেখলেই ঝামেলা করে। ছেলেটাকে ধরে মারধর করে। হোক সে আমার জন্য এসেছে বা এমনি এসেছে। তুমি সব জেনেও কেন এসেছিলে?'
' তোমাকে দেখার জন্য। '
নূপুর মুখ কালো করে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
' আমাকে দেখার জন্যও আর কোনোদিন আসবে না। আমি চাই না বাসায় তোমার কথা জানানোর আগে ভাইয়াদের কারো সাথেই তোমার ঝামেলা হোক। যেভাবেই হোক আমি ভাইয়াদের রাজি করাব। ওরা আমার সুখের বাইরে অন্য কিছু চাইবে না। তুমি শুধু একটু সময় দাও। আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। '
' হুম। '
' জীবন তুমি হয়তো জানো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমাকে কতটা চাই। জানলে তুমি এমন করতে না।'
' আর আসবো না। '
জীবনের মন খারাপ। সে নিজের উপর রেগে আছে। কেন সে নূপুরকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নিতে পারছে না। কেন সব সময় দু'জনকে ভয়ের মধ্যে থাকতে হচ্ছে? এটা কি তার ব্যর্থতা না? সে কি পারে না সব ঠিক করে দিতে? জীবন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নূপুর তার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জীবনও নূপুরের দিকে তাকালো। দু'জনই বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। তারা একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে মনের কথা বুঝতে চাইছে। দু'জনের মনের ভেতর ভয়ে যাওয়া ঝড়ের গতি আন্দাজ করছে। নূপুর হঠাৎ এগিয়ে এসে চোখের পলকে জীবনের ঠোঁটে আলতো করে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে দৌঁড়ে গলির ভেতর চলে গেল। জীবন এখানেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। নূপুর চলে যাওয়ার পর একবারও পেছনের দিকে তাকায় নি। তাকালে দেখতে পেত জীবন কেমন জমে গেছে। 
' এটা আমাদের ফার্স্ট কিস ছিল! এখানে তাও এভাবে? '
জীবন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার প্রেমিকার কাছ থেকে পাওয়া প্রথম কিস মোটেও এভাবে আশা করেনি। 

তোহা মুখ হা করে চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বলল,
' কি বলছো আপু? ছেলেটা তোমার পেটে হাত...'
স্পৃহা বোনের মুখ চেপে ধরে বলল,
' আমি শুধু তোকে বলেছি। এখন তুই চেচাঁমেচি করে সবাইকে জানিয়ে দে।'
স্পৃহা হাত ছেড়ে দিলে তোহা ফিসফিস করে বলল,
' তারপর ঐ ছেলেটা কি করেছিল?'
' বললাম তো একবার। বাইক ওয়ালা ছেলেটা ঐ ছেলেটাকে অনেক মেরেছে। নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে।'
' একদম ঠিক করেছে। ওদের এমনটাই প্রাপ্ত।'
'হুম। '
' তারপর কি হলো বলো।'
' তারপর আর কি হবে? তারপর আমি আর মারিয়াপু ওখান থেকে চলে এসেছি।'
তোহা টেনে 'কিহহহহ' বলে হা করে রইলো। 
' মানে তোমাদের মাঝে মানবতা বলতে কিচ্ছু নেই। ছেলেটার সাথে সাধারণ ভদ্রতাটুকু করলে না। আর কিছু না করতে উনাকে একটা থ্যাংক্স তো বলতেই পারতে। একটা ছেলে তোমার জন্য অন্য একটা ছেলেকে মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে আর তুমি দুমিনিট সময় নিয়ে উনার নামটা জিজ্ঞেস করতে পারলে না? ফোন নাম্বারটা অন্তত চেয়ে নিতে। '
স্পৃহা চোখ পাকিয়ে তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,
' ইদানিং তুই একটু বেশি কথা বলছিস না? না মানে, বাসায় মেহমান আসলে যে তাদের সালাম দিতে চায় না। সে আজ আমাকে ভদ্রতা শেখাচ্ছে। এটা একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না।'
' মোটেও না। আমার জন্য কেউ মারামারি করলে আমি শুধু তার নাম কেন? তার কপালে একটা চুমু দিয়ে আসতাম।'
' তোহা!'
তোহা মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলে ভয়ে আর বোনের সামনে বসে থাকতে পারলো না।
সে উঠে দৌঁড়ে চলে গেল। তোহা যাবার পর স্পৃহা বিরবির করে বলল,
' নাম জেনে কি হবে? ছেলেটার তো গার্লফ্রেন্ড আছে। আর আমারও তো ওর সাথে আর কখনো দেখা হবে না। তাহলে শুধু শুধু ওকে নিয়ে ভেবে কি হবে? আজকের পর থেকে ও ওর জগতে আর আমি আমার জগতে থাকবো। নিয়তি হয়তো আমাদের আর কখনো সামনা করাবে না।'
মেহেরুন কিছু দিন বোনের কাছে থেকে ঢাকা ফিরে গেলেন। তিনি যাবার আগে,স্পৃহাকে ঢাকা নিয়ে নিজের কাছে রেখে ভার্সিটিতে পড়ানোর জন্য বোনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গেলেন। 
.
.
' তানিয়া তুই আজকেই স্পৃহা তোহা আর পলাশকে নিয়ে ঢাকা চলে আয়।'
তানিয়া বড় বোনের কথা শুনে বিচলিত হয়ে বললেন,
' কেন আপা? কিছু হয়েছে কি?'
' অনেক কিছু হয়ে গেছে রে। তুই জলদি আয়। আমার মাথা কাজ করছে না। '
' কি হয়েছে আপা তা তো বলবে? '
' এখন ফোনে এতকিছু বলতে পারব না। তুই এখানে এলেই সব বুঝতে পারবি।'
' আচ্ছা আমি দেখছি আজ আসা যায় কিনা। '
' কোনো দেখাদেখি না। তুই এক্ষুনি ব্যাগ গুছিয়ে পলাশকে স্কুল থেকে ছুটি নিতে বল।'
' আচ্ছা। তুমি বেশি চিন্তা করো না। যাই ঘটেছে ঠিক হয়ে যাবে।'
তানিয়া ফোন রেখে চিন্তায় পড়ে গেল। মেহেরুন তো এতটা অধৈর্য হয়ে পড়ার মত মেয়ে না। নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে। তা নাহলে এভাবে হঠাৎ যাওয়ার কথাই বা বলবে কেন? তানিয়া মাত্র স্কুল থেকে ফিরেছে। আজ হাফ ঘন্টা ছিল। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসেছে। পলাশ এখনো ফিরে নি। তানিয়া মেয়েদের রুমের দিকে এগোলেন। 
স্পৃহা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। মা রুমে এসেছে বুঝতে পেরে উঠে বসে ওড়না টেনে নিয়ে বলল,
' কখন এলে মা?'
' এইতো কিছুক্ষণ হলো। তোহা কোথায়? '
' ও স্কুল থেকে ফিরে গোসল করে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনো ঘুমাচ্ছে।'
' আচ্ছা। তুই তাহলে তোদের কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নে তো।'
' কেন? '
' তোর খালামণি ফোন দিয়েছিল। আজকেই যেতে বললো।'
' সেদিনই তো এলাম। আজকে আবার কেন?'
' জানি না। আপা তো খুলে কিছুই বলে নি। আমার মনে হয় ওখানে কিছু একটা হয়েছে। তুই ব্যাগ গোছা। আমি গিয়ে তোহাকে তুলে দেই।'

' তুমি কি মেয়ের বিয়ের পাকা কথা দিয়ে এসেছ? দেখো আমার কিন্তু একটাই মেয়ে। আমি না দেখে, না জেনে যার তার হাতে মেয়ে তুলে দিব না। তুমি কথা দিয়ে ফেললেও আমার যদি ছেলে পছন্দ না হয় বা ছেলের পরিবারকে ভালো না লাগে তাহলে আমার মেয়েকে বিয়ে দিব না।'
মেহেরুন এক দমে কথা গুলো স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন। জাহিদ আহমেদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললেন, 
' আরে পাগল নাকি? আমি তোমাদের না জানিয়ে মারিয়ার বিয়ে ঠিক করবো? ওরা শুধু আজ মারিয়াকে দেখতে আসবে। ছেলের চাচা আমার বন্ধু। ও এমন ভাবে চেপে ধরলো আমি আর না করতে পারলাম না। তাই আজ রাতে বাসায় খেতে আসতে বললাম। ওদের বলার আগে তোমাকে জানানো উচিত ছিল। না জানি মারিয়া ব্যাপারটা কীভাবে নিবে? ওকে তো এর আগে এভাবে কেউ দেখতে আসেনি।'
' হুম। মারিয়া তো মাত্রই জব-এ ঢুকলো। ও এখনই বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছে কিনা তা তো জানি না। '
' কি করবো বলো? মেয়ের বাবা হয়ে আমার হয়েছে জ্বালা। মেয়ে দেখতে সুন্দর। পড়াশোনায়ও ভালো। ডাক্তারী পাশ করেছে। আশেপাশের লোকজন তো বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। '
মেহেরুন উদাস গলায় বললেন, 
' দেখতে দেখতে মেয়েটা কতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। সেদিনও তো ছোট ছিল। স্কুল থেকে ফিরে খাবার জন্য চেচাঁমেচি শুরু করে দিত। কলেজে প্রথম দিন তোমার সাথে যাবার জন্য বায়না ধরেছিল। জবের প্রথম দিন আমাদের পা ছুঁয়ে সালাম করেছিল। আমি ভাবতেই পারছি না এই মেয়ে বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আচ্ছা জাহিদ মারিয়া আমাদের ছাড়া থাকতে পারবে তো? তার থেকে বড় কথা, আমরা ওকে ছাড়া থাকতে পারবো? '
' জানি না মেহু। আমার এই মেয়ে আমার সবকিছু। ওকে না দেখে আমি একটা দিনও থাকতে পারবো না। জানি না মেয়ে বিয়ে দিয়ে আমি কীভাবে থাকব।'
দু'জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। পৃথিবীর সব বাবা মা'ই হয়তো মেয়ে বিয়ে দিবার কথা ভেবে এরকম ভাবেই মন খারাপ হয়। নিজের রাজকন্যাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া নিশ্চয়ই সহজ কাজ না। তবুও সব মেয়েদেরই একদিন বিয়ে করে বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয়। 
জাহিদ আহমেদ বললেন, 
' তানিয়ারা আসছে তো?'
এতক্ষণে মেহেরুনের গলা ধরে এসেছে। তিনি নিজেকে শক্ত করে বললেন, 
' ফোন দিয়েছিলাম। তানিয়া বলেছে ওরা আসবে। '
' জয় কোথায়?'
' ও বাসায় থাকে নাকি? সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় তা সে-ই জানে।'
' ওকে বাসায় আসতে বলো। আর মারিয়াকেও রেডি হয়ে থাকতে বলবে। উনারা সন্ধ্যায় চলে আসবে। '

' জয় শোন। '
' হ্যা বল শুনছি। আমি কি কান বন্ধ করে রেখেছি? তুই কি বলবি বলতে থাক।'
জয়ের এই কথার জন্য অন্য দিন হলে সে এতক্ষণ মাথায় কয়েকটা চড় খেয়ে ফেলত। কিন্তু আজ মারিয়া কিছুই করলো না। 
' তুই তো তোর সব কথা আমার সাথে শেয়ার করিস। তাই আমিও তোকে আমার একটা কথা বলবো ভাবছিলাম। '
' আপু এতো ভাবাভাবি না করে সোজা বলে ফেল তো। '
জয় ফোনে গেমস খেলছে আর মারিয়ার সাথে কথা বলছে। সে কথা বলার সময় একবারও মারিয়ার দিকে তাকায় নি। ফোনের স্ক্রিনের দিকেই চেয়ে আছে। মারিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
' তুই ফোনটা রাখ না। তোর ফোন কেউ নিয়ে যাচ্ছে না। আর গেমসও কোথাও চলে যাচ্ছে না। পরে তো আবার খেলতে পারবি। এখন একটু বাদ দে না। '
জয় ফোন পাশে রেখে হেলান দেয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, 
' হ্যা এখন বল আসল কথা কি?'
' আমি কিছু দিন ধরে একটা ছেলেকে পছন্দ করি। মানে আমি না সে-ই আগে থেকে আমাকে পছন্দ করত। ও ব্যাংকে জব করে। আমরা দু'তিন মাস ধরে একসাথে আছি। এখন কথা হচ্ছে, ও আজ বিয়ের কথা বলতে বাবা মা'র কাছে যাচ্ছে। আমি চাই তুই একটু হেল্প কর।'
জয় চুপচাপ বোনের কথা শুনছিল এবার বলল,
' তুই তো একেবারে লাস্ট স্টেজে পৌঁছে আমাকে জানিয়েছিস। সব যখন ঠিকঠাক তাহলে আমার আবার কেমন হেল্প লাগবে? ছেলে ভালো হলে বাবা মা অবশ্যই মেনে নিবে। '
' আরে সবটা শোন না। ওর বাবা মা নেই। ও এতিম। বাবা মা নিশ্চয়ই আমাকে একটা এতিম ছেলের হাতে তুলে দিতে রাজি হবে না। '
' কি বলছিস! ওর সত্যিই বাবা মা কেউ নেই?'
' না। এজন্যই তো ভয় পাচ্ছি। আমি জানি, যে পরিবারে শ্বশুর শাশুড়ি নেই সেখানে বাবা মা কখনো আমার বিয়ে দিবে না। কিন্তু বিশ্বাস কর জয় সোম খুব ভাল ছেলে। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। শুধুমাত্র আমার কথা ভেবে ও এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইছে। আমি বাবা মা'র বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে চাইব না। কিন্তু ওকে ছাড়তেও পারব। এখন শুধু তুই-ই বাবা মা'কে বুঝাতে পারিস। ওর পরিবার নেই এতে তো ওর কোনো হাত নেই। তুই আমার এই উপকারটা কর ভাই। প্লিজ বোনের জন্য এটুকু করে দে।'

সোম তার চাচা চাচীর সাথে এসেছিল। কিছুক্ষণ আগে ওরা চলে গেছে। সবাই উনাদের সাথে খুব ভাল আচরণ করেছে। মেহেরুনের প্রথমে ছেলেকে অনেক পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু উনি যখন জানতে পারলেন ছেলের বাবা মা কেউ নেই। পরিবারে ভাই বোনও কেউ নেই। সে একাই। তখন তার মন সায় দিলেন না। তিনি এতিম ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে পিছিয়ে গেলেন। সন্ধ্যার একটু আগে আগে স্পৃহারা এখানে এসে পৌঁছেছে। এখন মেহেরুন জাহিদ, তানিয়া আর পলাশ এক রুমে বসে আছেন। স্পৃহা মারিয়া তোহা মারিয়ার রুমে বসে আছে। মারিয়া কাঁদছে। স্পৃহা তাকে কাঁদতে দেখে বলল,
' আপু তুমি সোম ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসো তাই না? '
মারিয়া স্পৃহার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। 
' কেঁদো না আপু। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা মা খালামণিকে বোঝালে খালামণি ঠিক রাজি হবেন।'

' ছেলেটা এতিম। ওর বাবা মা কেউ নেই। এমন ছেলের সাথে কীভাবে মেয়ের বিয়ে দিব বলো তো পলাশ? '
মেহেরুন ছোট বোনের স্বামী পলাশের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল। পলাশ বললেন,
' আপা আমি কিন্তু ছেলেটাকে দেখেছি। শিক্ষক হওয়ায় জীবনে অনেক ছাত্রকে মানুষ করেছি। অনেক ধরনের ছেলেপুলে দেখেছি। এই ছেলেটাকে কিন্তু আমার কাছে একটু খারাপ মনে হয়নি। ওর কথাবার্তা, আচার আচরণ সবাই পারফেক্ট। আমি শিক্ষক মানুষ প্রথম দেখাতেই কিন্তু মানুষের খারাপ দিকগুলো আমার চোখে বেসে উঠে। এই ছেলেটার কোনো খারাপ দিক নেই। হয়তো দু'একটা থাকতে পারে কিন্তু তা সাধারণ। ছেলে হিসেবে মারিয়ার জন্য এই ছেলেই পারফেক্ট হবে।'
' কিন্তু পলাশ ওর যে কেউ নেই। '
তানিয়া বললেন, 
' আপা ওর কেউ নেই এটা কি ওর দোষ? আল্লাহ ওর বাবা মা'কে নিয়ে গেছে এতে তো ছেলেটার কিছু করার নেই। ও চাইলেও নিজের বাবা মা'কে ধরে রাখতে পারতো না। আমাদের যদি আল্লাহ দুনিয়া থেকে নিয়ে যান তাহলে কি আমাদের ছেলে মেয়েরা কিছু করতে পারবে? '
জাহিদ বললেন, 
' তানিয়া ঠিক বলেছে মেহু। ছেলেটার কেউ নেই তো কি হয়েছে? বিয়ের পর আমরা ওর বাবা মা হব। আমাদের পরিবার ওর পরিবার হবে। '
জাহিদ কথা শেষ করার পরপরই জয় রুমে ঢুকে। মায়ের কাছে এসে মেহেরুনের হাত ধরে বলে,
' মা তুমি তো আমার সব কথা মানো। আমি মিথ্যা বললেও তুমি বিশ্বাস করে নেও। আমি বলছি সোম ছেলেটা আপুর জন্য সত্যিই পারফেক্ট। ওর বাবা মা নেই, ও এতিম এটাই তো সমস্যা? তুমি একবার এটা কেন ভাবো না মা। এই ছেলেটা বাবা মা'র ভালোবাসা পায়নি। আপুর সাথে বিয়ে হলে ও তোমাদের নিজের বাবা মায়ের জায়গায় বসাবে। তোমাদেরকে নিজের বাবা মা'র মত করে ভালোবাসবে। আরো একটা কথা। সোম জানে বাবা মা'র থেকে দূরে থাকা কতটা কষ্টের। তাই ও কোনোদিনও আপুকে তোমাদের থেকে দূর করে চাইবে না। আর মা শ্বশুর শাশুড়ি পেলেই কি সব মেয়ে সুখী হয়? আজকাল কয়জন শাশুড়ি ছেলের বৌকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসে? সোমের কেউ নেই এটা আপুর জন্য খারাপ না বরং এটাই ভালো। যদি এমন হতো বিয়ের পর তোমাদের একমাত্র মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অত্যাচার করতো। 
প্লিজ মা আমার কথা রাখো সবাই বলছে সোম ভালো ছেলে। আমি নিজেও খোঁজ নিয়েছি। সোম সত্যিই খুব ভাল ছেলে। কোনো ধরনের বাজে কাজে নেই, নেশা করে না, ঝগড়া, মারামারি ঝামেলা থেকে সব সময় দূরে থাকে। সবাইকে সম্মান করতে জানে, ভালো জব করে। আর সবথেকে বড় কথা সোম আগে থেকেই আপুকে পছন্দ করে। ও আপুকে অনেক সুখে রাখবে। তুমি আর না করো না। আপুর সুখের কথা ভেবে রাজি হয়ে যাও। প্লিজ মা।'
জাহিদ বললেন, 
' জয় ঠিক বলেছে। '
মেহেরুন জয়ের কথা শুনে সবার দিকে তাকালো। সবাই মাথা নাড়িয়ে উনাকে আশ্বস্ত করলেন। 

তোহা এতক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছিল। মারিয়ার কান্না দেখে তার টেনশন হচ্ছিল। তাই সে এখানে কি হচ্ছে তা দেখার জন্য চলে এসেছিল। তোহা দৌঁড়ে গিয়ে মারিয়া উপর লাফিয়ে পড়ে বলল,
' আপু খালামণি রাজি হয়ে গেছে। জয় ভাইয়া খালামণিকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। এই ছেলের সাথেই তোমার বিয়ে হবে। আমি এক্ষুনি ঐ রুম থেকে এসব কথা শুনে এসেছি। সবাই রাজি। এবার তোমার বিয়ে হবে। ইয়ে কি মজা।'
স্পৃহা তোহার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই সে জিজ্ঞেস করল,
' তুই সত্যি বলছিস তো তোহা?'
' আমি মিথ্যে বলতে যাব কেন আপু? নিজের কানে যা শুনে এসেছি তাই বলেছি।'
স্পৃহা মারিয়ার দিকে তাকালো। তোহার কথা শুনে মারিয়া কিছুই বলছে না। তার চোখে পানি কিন্তু মুখে বিজয়ের হাসি। 
মারিয়া আর সোমের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ঠিক একমাস পর ওদের দু'জনের চার হাত এর করে দেওয়া হবে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন