ইদ্রির উন্মুক্ত কাঁধে দুয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়াতেই নিশাদের বুকে জোরে ধাক্কা দিলো ও।নিশাদ সরে আসে কিছুটা চমকে।ইদ্রি রাগান্বিত দৃষ্টিতে নিশাদকে দেখতে দেখতে জামার হাতা ঠিক করে উঠে বসে।নিশাদ নিজের কাজে অবাক।কি করতে যাচ্ছিলো ও?ও তো এখনো বলেনি ভালবাসি।কিংবা ইমতিয়াজ কে ও কিছু বলেনি।ইদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ে লেগে যাওয়া ময়লা পরিষ্কার করতে থাকে।নিশাদ উঠে দাঁড়ায়।ইদ্রির ঠোঁটজোড়া কিছুটা ভিজে আছে।আংশিক লাল বর্ন ও ধারন করেছে।নিশাদ ইদ্রিকে মুগ্ধ চোখে দেখছিলো।নিশাদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইদ্রি রেগে বলল,
''কি করছিলেন এসব?
ইদ্রির চিৎকারে কিছুটা অবাক নিশাদ।তারপর নিচু গলায় বলতে লাগলো,
''আ'ম সরি ইদ্রি।আমার এমন ইনটেনশন ছিলো না সরি।"
ইদ্রি জামা পরিষ্কার করা ছেড়ে বলল,
''খুব ভালো করেই দেখতে পেরেছি কি ছিলো আপনার ইনটেনশান। আমার ভাই আপনাকে কি বলে গেলো আর আপনি তো দুবার না ভেবেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।আপনি তো আমাকে বলেছিলেন আমি শুতে চেয়েছি আপনার সাথে রাইট?আমরা হাইসোসাইটির মেয়েরা এমনই তাইনা?আপনি আমাকে অনেক অপমান করেছিলেন।আমার ভালবাসাকে অপমান করেছিলেন।আমার বয়স কম বুঝতে পারিনি কিন্তু আপনি?বেশ বয়স হয়েছে আপনার।মিনিমাম থার্টি থ্রি অর থার্টি ফোর।আপনার বুঝা উচিৎ ছিলো।আপনি তো আর অবুঝ ছিলেন না।কিন্তু না আপনি কি করলেন?আমাকে যা তা বললেন।কিন্তু এখন আমাকে ভালোবাসেন ও না কিন্তু ভাইয়া চলে যেতেই আমাকে কিস করতে লাগলেন?কেন?কারন আপনার চরিত্রে প্রবলেম।শুতে চেয়েছেন আপনি আমি না।আমি তো সত্যিকারের ভালবেসেছিলাম।কিন্তু ভুল মানুষকে ভালবেসেছি আজ বুঝলাম।"
ইদ্রির কথায় নিজেকে ছোট মনে হতে থাকে নিশাদের।ওর কথার জবাব গুলো এভাবে পাবে ভাবতে পারেনি ও।ইদ্রির চোখজোড়া অশ্রু ভেজা কিন্তু চেহারা কাঠিন্যতা প্রকাশ পেয়েছে।নিশাদ মৃদু কন্ঠে বলল,
''দেখো ইদ্রি সেদিন যা বলেছিলাম আমি সত্যি সরি।কিন্তু আমার অপারগ ছিলাম।চেষ্টা করে ও তোমাকে কাছে টানতে পারছিলাম না।আমার বাসার অবস্থা কেমন সেটা দেখেছিলে।আমি মধ্যবিত্ত ফেমেলি থেকে এসেছি।কখনো প্রেমের চিন্তা ভাবনা মাথায় আসেনি।সবসময় পরিবারের কথা চিন্তা করে গেছি।যতোটুকু পারছি পরিবারের জন্য করছি।ত্রিশ হাজার টাকা বেতনের জব করি।এতটুকু দিয়ে চলতে বেশ একটা সুবিধা করতে পারিনা।সেখানে তুমি ইমতিয়াজের আদরের বোন।অনেক ভাল পরিবারে বড় হয়েছো।কখনো অভাব দেখোনি চোখে।আমি তোমাকে কিভাবে আমার পরিবারে নিতাম বলো?চাইছিলাম তুমি আমাকে ঘৃনা করো।কারন আমার সাথে থাকতে তোমার কষ্ট হতো।কারন আমি তোমার যোগ্য না ইদ্রি।তাই দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিলাম।
ইদ্রির রাগ হতে লাগলো।ও গলায় ঝাঁঝ এনে বলল,
''আসলেই হয়ত আপনি আমার ভালবাসার যোগ্য না।ভাইয়া ও কই চলে গেলো বুঝলাম না।আমি যাচ্ছি ভালো লাগছেনা আমার।"
ইদ্রি চলে যাচ্ছিলো।নিশাদ ওর হাত ছুঁয়ে বলল,
''আমি পৌছে দিচ্ছি।"
ইদ্রি নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
''লাগবেনা।আমি একাই যাবো।"
নিশাদ ওর সামনে এসে বলল,
''তোমার ভাইয়ের কথা মনে আছে তো?কি বলেছিলো।তোমার পুরো দায়িত্ব আমার হাতে।তোমার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বটাও আমার।সুতরাং আমিই নিয়ে যাবো।"
বলে একটু হাসলো নিশাদ।ইদ্রি প্রচুর রেগে সাননে ফিরে হাঁটতে শুরু করে।নিশাদ ওর পিছু নেয়।রিক্সায় নিশাদ ইদ্রিকে বার বার দেখছিলো কিন্তু ইদ্রি একবার ও তাকায়নি।নিশাদ সবার চোখ আড়াল করে ইদ্রির হাতের ওপর হাত রেখে ওর হাতটাকে চেঁপে ধরে।ইদ্রির শরীর ঝনঝন করে উঠে।হাত ছাড়াতে চেয়ে ও পারছিলোনা।মনে হচ্ছিলো আশেপাশের সবাই ওদের দেখছে।লজ্জা লাগছিলো ওর।তাই বাধ্য হয়ে ওভাবে বসে থাকতে হয় ইদ্রিকে।বাসার সামনে আসতেই ইদ্রি নিশাদের হাত ছাড়িয়ে নেমে পড়ে। নিশাদ ও নেমে আসে।ইদ্রি নিশাদের দিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে।নিশাদ ডাকতে গিয়ে ও পারেনা।ইদ্রি ঘরে ঢুকেই আশেপাশে না তাকিয়ে রুমে এসে বারান্দায় চলে যায় ইদ্রি। রুমের আলো নেভানো।বাহিরের ল্যাম্প পোস্টের আলোয় নিশাদকে দেখতে পায় ইদ্রি।সে পকেট থেকে ফোন বের করে কি যেন করলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই ইদ্রির হাতে থাকা ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠে।ফোনের লক খুলে দেখলো সেখানে নিশাদের নম্বর থেকে একটি মেসেজ সেটা ছিলো একটা শব্দের কিন্তু হৃদয়ে তোলপাড় জাগাতে যথেষ্ঠ।মেসেজ টি ছিলো ''ভালবাসি"।
ইদ্রি মৃদু হেসে পরক্ষনে চুপ হয়ে যায়।এত দ্রুত নরম হবেনা ও।অনেক অপমানিত হতে হয়েছিলো তার কাছে।ইদ্রি ভালো করে বাহিরে খেয়াল করে দেখলো নিশাদ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো।ইদ্রি ফিরে আসে রুমে।এদিকে নিশাদের মনে হলো ইমতিয়াজ চলে গেলো কিছু বললো ও না।ওর সাথে কথা বলার দরকার।কিন্তু আজ প্রথম বার নিজের বেস্টফ্রেন্ড কে ফোন দিতে কেমন দ্বিধা বোধ হচ্ছে।কিন্তু ওর জানতে হবে ইমতিয়াজ এমনটা কেন করলো?কিভাবে জানলো নিশাদ ইদ্রির সম্পর্কের কথা?নিশাদ তারপর ও ফোনে ইমতিয়াজের নম্বর ডায়াল করে।ইমতিয়াজ গাড়ি চালাচ্ছে তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় কল রিসিভ করে খুব কষ্টে।চোখ মুছে নেয়।অপরপাশ থেকে নিশাদ বলল,
''কই তুই? তোর সাথে আর্জেন্ট কথা আছে।"
গলা কে স্বাভাবিক করে ইমতিয়াজ বলল,
''কেন?আমার বোনের সাথে প্রেম শেষ?এই একঘন্টায় ধৈর্যহারা হয়ে গেলি?"
''ফাজলামি করবিনা।তুই কই?আমি দেখা করতে চাই।"
''আমি ক্রিমসনের পাশে আছি তুই আয়।"
''আচ্ছা।"
ইমতিয়াজ কল কেঁটে মেইনরোডে গাড়ি উঠিয়ে দেয়।তারপর কোন হিতাহিতজ্ঞান ছাড়াই ড্রাইভ করতে থাকে।হঠাৎ সামনে থেকে আগত কালো গাড়ি এসে ইমতিয়াজের গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে।ইমতিয়াজ একটু ব্যাথা পেলে ও গাড়ির হেডলাইট ভেঙ্গে গেছে ভেবেই রেগে যায়।সামনের গাড়ির মালিককে গালি দিতে দিতে বেরিয়ে গাড়ি থেকে।তখনই ওর চোখ জোড়া বড় হয়ে আসে এক রমনীকে দেখে।
....................................সাঁঝ জব টা পেয়ে ভীষন আমোদে আছে।নিশাদ ভাইয়াকে জানানোর জন্য ওর মন টা কেমন করছে।ভাই জানলে হয়ত প্রথমে না করলে ও ভীষন খুশিই হবে আর ও নিজে ও মানিয়ে নেবে।নিশাদকে বার কয়েক কল দিতেই কল কেঁটে যায়।সাঁঝের মনটা খারাপ হয়ে এলো।তবে বেশিক্ষন মন খারাপ ধরে রাখতে পারেনি।আকস্মিকভাবে নানুকে দেখে প্রচন্ড অবাক আর খুশি হয় সাঁঝ।সাথে বড় মামা আর মামী আর মামাতো বোন রায়হানা ও এসেছে নোয়াখালী থেকে। ইকরাম রাহমান ওনাদের বাস স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছেন।সাঁঝকে দেখে ত্রয়োদশী রায়হানা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।সাঁঝ ও স্নেহের হাত বুলায় রায়হানার মাথায়।নানুকে দেখে সাঁঝ গিয়ে ওনার পা ধরে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরে।নাতনীকে জড়িয়ে ধরে সায়রা বানু বলেন,
''নানিরে ভুইলা গেলি?"
''না নানি কি যে কও ভুলি নাই।"
''তোর মা কই?"
''ঘুমায়।"
সাঁঝ মামা মামীকে সালাম দিয়ল রায়হানাকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে আসে।জুলেখা বানু ঘুমে কাতর।সাঁঝ লাইট জ্বালিয়ে মায়ের হাত একটু নেড়ে বলল,
''আম্মা নানু আইছে।উডো।"
জুলেখা বানুর ঘুম কিছুটা ভেঙ্গে গেলো সাঁঝের ডাকে।চড়া গলায় বলল,
''তোগোর বাপ আর মাইয়া পোলার জ্বালায ঘুমাইতাম হারিনা।"
বলেই আবার ও ঘুমোতে যাচ্ছিলো জুলেখা বানু।সাঁঝ মাকে টেনে বলল,
''আম্মা বড় মামা মামী নানু আসছে।উডো!!!"
''ফাজলামি করবিনা যা।"
রায়হানা হেসে বলল,
''ফুপি উঠো।দেখো আমরা আসছি।"
এবার আর অবিশ্বাস হলোনা জুলেখা বানুর। পাশে তাকিয়ে ভাইয়ের মেয়েকে ভালা আছোতনি রায়হানা?"
''জি ফুপি ভালো।উঠে আসেন আব্বু আম্মু আর দাদি ও আসছে।"
জুলেখা বানু উঠে বসে রায়হানাকে জড়িয়ে ওর গালে চুমু দিয়ে বললেন,
''কতোদিন তোমাগোরে দেহিনা।"
জুলেখা বানু আর রায়হানা বের হতেই ইকরাম রাহমান রুমে আসেন।সাঁঝকে দেখে বললেন,
''তোর মামা মামী এহানে থাকবো না।তোর ছোট মামার বাসাত যাইবো।টেবিলে ভাত তরকারি দে।"
সাঁঝ উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।কিচেনে এসে দেখলো ভাত কম তরকারি ও তেমন নেই।এদিকে রুম থেকে হুমায়রার কথা শুনতে পায় সাঁঝ।মেজাজ বিগড়ে যায় ওর।বাসায় গেস্ট আর সেদিকে এই মেয়ে ফোনে কথা বলছে।সাঁঝ তেড়ে রুমে গেলো।
........................... বিভানের পাশের ফ্ল্যাটের বাবু পুজার সাথে পূর্নার সখ্যতা বাড়ছে।সারাদিন পুজার সাথে খেলার পর বেশ ক্লান্ত হয়ে ওদের কাজের মেয়ে মিহির সাথে বাসায় চলে আসে।পূর
না ঘরে ফিরেই মাকে খুঁজতে লাগলো।বেলাকে রুমে না পেয়ে চিৎকার করতে লাগলো,
''মা মা!!"
বেলা গোসল করছিলো মেয়ের চিৎকার করে বলল,
''এই যে আম্মু।তুমি আসছো?"
''মা তুমি কোতায়?"
''মা গোসলে। এক্ষুনি আসছি।"
''আমাল গুম পাত্তে।"
''তুমি খাটে উঠে শুয়ে পড়ো।মা এক্ষুনি আসছি।"
বেলা চটজলদি শাড়ী পরে বেরিয়ে এসে দেখলো পূর্না ঘুমে কাতর।বেলা অবাক।এতো দ্রুত কিভাবে ঘুমালো পূর্না?বেলা মেয়েকে আর না ডেকে ভিজা কাপড় দিয়ে ওর মুখ হাত পা মুছে দিয়ে সরে আসে।রুমের আলো নিভিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।চুলায় চা চাপিয়ে পাকঘরে কিছু কাজ করছিলো বেলা।তখনই কলিংবেল বেজে উঠে।বেলা কাজ বন্ধ করে ড্রয়িংরুমে এসে দরজা খুলে দেখতে পায় বিভানকে।বিভান মৃদু হেসে বেলার কপালে ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বলল,
''মেয়ে আসছে?"
''হ্যা।আসো!! "
বিভান ভিতরে ঢুকে রুমে চলে যায়।বেলা বিভানের পিছু পিছু রুমে এসে ওর কাপড় চোপড় বের করে দেয় বিভান গোসলে চলে যায়।
সন্ধ্যার চায়ের পর বেলা বিভান সামনা সামনি বসে গল্প করছিলো।হঠাৎ বেলার ফোন বেজে উঠে ফোন তুলে দেখলো সাঁঝের কল।বেলা কিছুটা অবাক হয়ে ফোন ধরতেই সাঁঝ বলল,
''আসসালামু আলাইকুম আপা।কি খবর?"
''এই আলহামদুলিল্লাহ। তোরা কেমন আছিস?"
''ভালো।আপা আমার জব হয়েছে।"
বেলা হেসে ফেললো।একটু জোরেই বলল,
''সত্যি?"
''হ্যা আপা।এ্যাসিস্ট্যান্ট একাউন্ট্যান্ট।"
বেলা বলল,
''মাশাল্লাহ অনেক ভালো।বাসার সবাই জানে?"
''ভাইয়া বাসায় নাই।আব্বারে এখন বলবোনা।কি থেকে কি বলে।তারওপর আবার গেস্ট আসছে।"
''কে?"
ভ্রু কুঁচকায় বেলা।সাঁঝ বলল,
''নানু, বড় মামা বড় মামী আর রায়হানা।"
''ওহ।নানু কেমন আছেন রে?"
''ভালো আপা।পুর্না কেমন আছে?"
''ও ভালোই।খেলে এসে ঘুম দিলো।"
''ওহ।ভাই কই?"
''সামনেই।কথা বলবি?"
''দে ওনাকে।"
বেেলা বিভানের দিকে ফোন দিয়ে বলল,
''সাঁঝ কথা বলবে আপনার সাথে।"
বিভান মৃদু হেসে ফোন হাতে নিয়ে বলল,
''সাঁঝ কেমন আছো?"
''আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কি খবর?"
''আলহামদুলিল্লাহ।শুনলাম চাকরী হয়েছে?"
''জি আপনাদের দোয়ায়।
!!!!
সামনে তমা দাঁড়িয়ে।ইমতিয়াজের মুখে হাসি ফুঁটে উঠে।তমার ভীষন পরিবর্তন এসেছে।ওদের কলেজের বান্ধুবী তমা।মেয়েটার সাথে ওর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো।তমা তখন বেশ মোটা ছিলো যার কারনে কড়া ডায়েটে থাকতে হতো।টিচার গুলো ও জানোয়ার টাইপের ছিলো।খুব বাজে মন্তব্য করতো তমা কে নিয়ে।তবে তখনকার তমা আর এখনকার তমায় বিস্তর তফাৎ।অফিশিয়াল কোট প্যাম্ট আর ভিতরে সাদা গেঞ্জী টাইপ কিছু।সোজা চুল গুলো দুকাঁধের ওপর।চোখের নিচে মোটা কাজল।চেহারায় মাধুর্যতা বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি আর পরিচিত সেই তমাকে দেখে মুহূর্তের জন্য বেকুব বনে গিয়েছিলো ইমতিয়াজ। আসলেই কি এ সেই তমা।প্রায় ষোল বছর পর দেখা ওদের।তমার ঠোঁটের কোনের হাসিটা আরো প্রশ্বস্ত হয়।একপা দুপা করে হেঁটে ইমতিয়াজের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
''ইমতু না?"
ইমতিয়াজের মুখে একটা কথাই বের হলো,
''এতো বছর পর কোথা হতে উদয় হলি?"
জবাবে ছিলো তমার ঝঙ্কার তোলা হাসি।হাসতে হাসতে চোখের কোনে পানি এসে গেলো।তারপর ও হাসি থামছেনা।ইমতিয়াজ ভ্যাবলার মতো চেয়েছিলো তমার দিকে।তমা হাসি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে বলল,
''গোরস্থান থেকে।"
ফের হাসি তমার মুখে।ইমতিয়াজ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
''ফাজলামো করবিনা।কইছিলি এতো বছর?সেই যে ইতালি গেলি তারপর কোন খবরই নেই।"
''ইতালি থেকে কাল ফিরলাম।এখন একটা মিটিং থেকে ফিরলাম।"
'ওহ।তো ফেমেলি সহ ফিরে এসেছিস?নাকি আবার যাবি?"
''ফেমিলি বলতে আমি একাই।ভাইরা বিয়ে করে বৌ নিয়ে আলাদা।আমাদের খবর নেয়না।আর আম্মা আব্বা মারা গেছেন প্লেন ক্র্যাসে।এর পর থেকে আমিই আমার ফেমিলি।এ পার্ফেক্ট সিঙ্গেল লাইফ।"
ইমতিয়াজ ও হালকা শব্দে হাসলো তমার সাথে।তমা হঠাৎ বলল,
''ইমতু আমি যাই রে।আরেকদিন দেখা করে অনেক কথা বলবো।"
''ওকে। তোর নম্বর টা দে।"
তমার নিজের নম্বর ইমতিয়াজকে দেয়।ইমতিয়াজ সেই নম্বরে মিসডকল দেয়।তমা নিজের ফোনে ইমতিয়াজের নম্বর সেভ করে বলল,
''দোস্ত আসিরে।"
''ওকে বায়।"
রেস্টুরেন্টে সামনা সামনি বসে আছে ইমতিয়াজ আর নিশাদ।ইমতিয়াজকে খুব মলিন দেখাচ্ছে।গায়ের শার্টটা ঘেমে আছে।নিশাদ বন্ধুকে এমন আগে কখনো দেখেনি।কিছুক্ষন পর পর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে।নিশাদ মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
''কিছু হয়েছে?"
ইমতিয়াজ ম্লান হেসে মাথা নাড়লো।তারপর কফি কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
''কিছু না।তা ডেকেছিলি কেন?কি হয়েছে?"
নিশাদ চুপ হয়ে যায়।নিচে তাকিয়ে কিছুক্ষন কি যেন ভেবে বলল,
''আজ যা করলি?কারন টা জানতে পারি?কেন এমন করলি?আমরা কেউ তো তোকে কিছু বলিনি।"
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
''সব বললেই কি জানা যায়।আমি তোদের খুব আপন ভেবেছিলাম।বাট তোরা আসলে অতোটা আপন হতে পারিসনি।যে ছোটবোনকে কোলে পিঠে করে মানুষ করলাম।কখনো বড় ভাইনা বন্ধু হিসেবে ছিলাম।যে বন্ধুকে নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভেবেছিলাম।তাদের হয়ত আপন করে নিতে পরিনি। হয়ত এটাই আমার ব্যার্থতা।"
নিশাদের মনটা ভীষন খারাপ হয়ে যায়।ইমতিয়াজ কে কি ওর জানানোর দরকার ছিলো?হয়ত বড় ভুল করেছে না জানিয়ে।আর জানাতোই বা কি?ইদ্রিকে নিয়ে ওর স্বপ্ন গুলো ছিলো আবছা।সেগুলো পূরন হবার আশা করেনি ও।নিশাদকে চুপ দেখে ইমতিয়াজ বলতে লাগলো,
''ইশিতার বিয়ের দিন মনে আছে তুই ছাদে গিয়েছিলি?সিগারেট টানতে।তোর পিছু ইদ্রিও যায়।আর তোদের কথা শুনতে পাই আমি।"
নিশাদ ইমতিয়াজের দিকে অবাক দৃষ্টে তাকায়।সেদিন ইদ্রিকে অপমান করেছিলো নিশাদ।ইমতিয়াজের ভীষন খারাপ লেগেছে হয়ত।আর লাগবেই না কেন?একমাত্র বোনকে এতো বাজে কথা বললে যে কারোরই খারাপ লাগবে সে যেই হোক।নিশাদ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
''দেখ ইমতি আমি আসলে..........."
ইমতিয়াজ থামিয়ে দিলো।তারপর বলল,
''বাদ দে।আমি জানি তুই সেগুলো ইচ্ছে করে বলিসনি।"
নিশাদ মাথা নোয়ালো।ইমতিয়াজ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল,
''জানিস কার সাথে দেখা হয়েছিলো আসার সময়?"
নিশাদ মাথা উঁচু করে তাকায়।জিজ্ঞেস করে,
''কার সাথে?"
''তমার কথা মনে আছে।তমা খানম।"
নিশাদ মনে করে বলল,
''আরে হ্যা।কোঁকড়াচুলো মেয়েটা ছিলো যে।অনেক বেশি কথা বলতো।"
''হ।ওর সাথে।"
নিশাদ একটু হেসে বলল,
''এতবছর পর কই পেলি?"
''ইতালি থেকে কাল ফিরলো। এখন নাকি কোন মিটিং থেকে ফিরছিলো।তো রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো।"
নিশাদ একটু হেসে বলল,
''বিয়ে শাদি হয়েছে?"
''কথায় মনে হলো হয়নি।"
নিশাদ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে মৃদু হাসে।
....................সাঁঝ রান্না বান্না সেড়ে টেবিলে খাবার সাজাতে থাকে।মামা মামী খেয়ে চলে যাবেন।বেচারী ঘেমে ভিজে গেছে।হুমায়রা কে সেই যে ডেকেছিলো এখনো পর্যন্ত ওর কোন খবর নেই।সাঁঝের মুখ খারাপ হতে চায়।তবে বাসায় মেহমান চেয়ে ও কিছু বলতে পারেনা।কিছুক্ষন পর খেয়াল করলো মামী ওর দিকে এগিয়ে আসলেন।সাঁঝ একটু হাসলো।মামী বললেন,
''ছেলেরা বাসায় নেই কেউ?"
''বড় ভাইয়া সন্ধ্যায় বেরিয়ে ছিলো এখনো আসেনি।মেজভাই কাজে।কুঞ্জন বন্ধুর বাসায় গেলো।"
''ওহ।তোমাকে সাহায্য করতে পারি কিছু?"
মামী ওর পিছু পিছু পাকঘরে এলেন।সাঁঝ মাথা নেড়ে বলল,
''না মামী আপনারা খেতে বসুন।"
''হ্যা তোমার মামা বলছিলো তার খিদা লাগছে।"
সাঁঝ মামীকে নিয়ে বেরিয়ে আসে।ওনারা খেতে বসে। নানী এপর্যন্ত আট দশবার নিশাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন ওনাকে বারবার বলার পরও।মামা মামী খেয়ে চা নিয়ে বসলো ড্রয়িংরুমে।তখনই নিশাদের আগমন।হঠাৎ বাসায় এতো মেহমান দেখে অবাক হয় নিশাদ।তারপর ও নিজেকে সামলে সবাইকে সালাম দিয়ে রুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে ও।মামা মামীর সাথে কিছুক্ষন গল্প করার পর ওনারা চলে গেলেন।ইতোমধ্যে আদনান আর কুঞ্জন ও ফিরে এসেছে।সাঁঝ নিশাদ আর আদনানকে আলাদা করে বলল,
''ভাইয়া আমি মাস খানেক যাবৎ কিছু কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম।এখন আমার জব হয়ে গেছে ভাইয়া।এসিস্ট্যান্ট এ্যাকাউন্ট্যান্ট।
আদনান খুশি হয়ে বলল,
''মাশাল্লাহ। খুব ভালো।"
নিশাদ হাসছিলো।তবে নিমিষেই ওর হাসি একরাশ চিন্তায় ভরে গেলো।মলিন কন্ঠে বলল,
''চাকরী পেয়েছিস?মানে তুই করবি?"
আদনানের কথায় খুশি হলে ও বড় ভাইয়ের কথায় মুখের হাসি নিমিষেই যেন ম্লান হয়ে এলো।সারা বুকজুড়ে কোথায় যেন অন্ধকার নেমে আসে।আদনান ভাইয়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে।একি আসলে ওর বড় ভাইতো।সাঁঝের চোখ জ্বালা করতে শুরু করেছে।ভাই কি খুশি নয় তবে?দেবে না ওকে সংসারের হাল ধরতে?সাঁঝ
কাঁপানো গলায় বলল,
''ভাইয়া কি বলছিস?আমি অনেক কষ্ট করে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।প্লিজ ভাইয়া।"
নিশাদ শান্ত গলায় বলল,
''তুই কষ্ট করেছিস বুঝেছি।বাট জানিস তো আজেবাজে লোকের অভাব নেই।মেয়েরা রাস্তায় অবমাননার শিকার হয় জানিস তো।আমার ভয় লাগে তোদের একা পাঠাতে। "
সাঁঝ হেসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
''তুই আছিস তাহলে আমার শক্তি আছে।কেউ কিছু করতে পারবেনা তোর সাঁঝের।তোর সাঁঝ এতটা দূর্বল নয় ভাইয়া।"
নিশাদ বোনের পিঠে হাত রেখে বলল,
''আমি জানি।তবুও আমার চিন্তা হয় তুই বের হলে।তবে পড়াশুনার পাশাপাশি জব করতে পারলে আমার কোন অবজেকশান নাই।"
সাঁঝ সরে এসে বলল,
''পারবো আমি।ভাইয়া আব্বা আম্মারে বলনা।আব্বা জানিস তো কেমন?"
''ওকে বলবো আমি।জয়েনিং ডেট কবে?"
''পরশুদিন। "
''ওকে।"
নিশাদ বেরিয়ে আসে রুম থেকে সাঁঝ সহ।ইকরাম রাহমান শুয়ে টিভি দেখছেন।বড় ছেলেকে দেখে মৃদু হেসে বলেন,
''চা্রী কেমন চলতাছে?"
''আলহামদুলিল্লাহ আব্বা।তোমার শরীর কেমন?"
''ভালোই।"
নিশাদ সাঁঝের দিকে একপলক চেয়ে বলল,
''আব্বা সাঁঝের জব হইছে বেশ ভালো একটা পোস্টে।"
সাথে সাথে ইকরাম রাহমান ভ্রু কুঁচকে বললেন,
''সাঁঝ ও এখন এসব শুরু করছে?বড় ডাও তো জব করছে।তারপর কি হইছে এক ব্যাডারে লইয়া ভাগছে।চাকরীর কোন দরকার নেই।"
সাঁঝ ভাইয়ের হাত চেঁওে ধরে।নিশাদ শক্ত গলায় বলল,
''আব্বা এখন আপার কথা আনার কোন প্রয়োজন দেখিনাই।সবাই জব করলে ব্যাডা নিয়া ভাগে সেটা কোন সংবিধানে আছে?"
ইকরাম রাহমান চোখ গরম করে বললেন,
''তুই তর্ক করবিনা।যেডা ভালো ওর লাইগা হেডাই করুম।"
নিশাদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''আব্বা পড়াশুনা করছো সরকারী চাকরী ও করছো কিন্তু মন মানসিকতা পাল্টায় নাই তোমার।ও পড়াশুনা করছে তাই জব ও করবে।"
ইকরাম রাহমান বললেন,
''পড়াশুনা করাইছি ঐডাই অনেক।বাসাত থাকলে তোর মায়েরে সাহায্য করবো।"
পিছন থেকে জুলেখা বানু বললোন,
''সাঁঝ চাকরী করবো।আমার সাহায্য লাগবোনা।মাইয়ার বিয়া হয়া গেলে তখন যাইবোইগা।অন্তত নিজের পায়ে খাড়ানোর লাইগা ও কিছু করবো।"
জবাবে ইকরাম রাহমান স্ত্রীর দিকে কড়া নজরে তাকাতেই নিশাদ বলল,
''আব্বা আপনি যাই বলেন ও চাকরী করবে।সেটা আপনার ইচ্ছা আর অনিচ্ছায় হোক।"
............................এদিকে পরদিন হুমায়রা সেজে গুজে নীল স্যালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে আসে।আজ অনেকদিন পর হৃদয়ের সাথে দেখা হবে ওর।বড় মিস করছিলো তাকে।তার কথা গুলোকে তার যত্ন গুলো।এবার সব গুলো সুদে আসলে উষুল করে ছাড়বে।ভেবেই রিক্সায় উঠে হুমায়রা।আজ ধানমন্ডি লেকে দেখা করবে ওরা।এ জায়গাটা প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য বেশ জনপ্রিয়।হুমায়রা বিশ পচিশ মিনিটের মাঝে লেকে পৌছে যায়।রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে হাঁটতে শুরু করে।লেকে ঢুকতেই পানির পাশে হৃদয়কে দেখে হেসে দেয় হুমায়রা।হৃদয় এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।হুমায়রার কিছুটা অস্বস্তি বোধ হয়।তবুও নিজেকে সামলে বলল,
''হৃদয় আমরা পাব্লিক প্লেসে।সরো প্লিজ।"
হৃদয় সরে এসে বলল,
''সরি জান।তোমাকে দেখে আটকাতে পারিনি নিজেকে।"
হুমায়রা ম্লান হেসে বলল,
''চলো কোথাও গিয়ে বসি।"
হৃদয় মৃদু হেসে বলল,
''নির্জন কোন জায়গায় গিয়ে বসি।তারপর ইচ্ছেমতো আদর করবো।"
হুমায়রা ভ্রু কুৃ্ঁচকে বলল,
''আমার পছন্দ না এসব।"
হৃদয় হেসে ওকে একজায়গায় এনে বসে।জায়গাটা নির্জন না হলে ও বেশি মানুষ ছিলোনা।হৃদয় হুমায়রা পাশাপাশি বসে গল্প করতে থাকে।হৃদয় গল্পের মাঝেই হুমায়রার কোমড় চেঁপে ধরে ওর পেটে সুড়সুড়ি দিতে থাকে।হুমায়রা বারবার বলার পর ও হৃদয় কথার ছুঁতো দিয়ে ওকে স্পর্শ করেই যাচ্ছিলো।