রংধনু - পর্ব ৫৮ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


ইমতিয়াজের বাসায় বুক ফাঁটা কান্নার আওয়াজে চারিদিক কেঁপে উঠেছে।ওর বাবার মৃত্যুতে শুধু সৈয়দা বেগমই বিধবা হননি সন্তান হারা হয়েছে ইমতিয়াজ আর ইদ্রি ও।রাত তিনটা বেজে উনচল্লিশ মিনিট।বাসায় পাশের ফ্ল্যাটের ইয়াসমীন আন্টি চলে এসেছেন ওদের কান্নার শব্দে।ঘরে ঢুকে দেখেন বেগতিক অবস্থা।সৈয়দা বেগম ফ্লোরে স্থলে উঠে যাওয়া ছটফট করা মাছের মতো তড়পাচ্ছে।চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছেন।পাশে রানু খালা ওনাকে স্বান্তনা দিয়েই যাচ্ছেন।ইয়াসমীন আন্টি বুঝতে পারছেননা কি হয়েছে?ওনি এগিয়ে এসে সৈয়দা বেগমের দিকে তাকান।অজান্তে ওনার চোখের কোনা ভরে এসেছে।কিছু বলতে যাবেন তখনই শুনতে পেলো ওপরের রুম থেকে ইদ্রির বুক ফাঁটা কান্না আর আহজারি।ইদ্রি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো,
''আব্বু আমাকে নিয়ে যাও তোমার সাথে।আমি এখানে থাকতে চাইনা।আব্বু তুমি কোথা ও যাওনি আমি জানি।সবাই কেন বলছে তুমি নেই?আমি জানি তুমি আমাদের সাথেই আছো।আব্বু প্লিজ ফিরে আসো।আর তোমার কাছ থেকে চলে আসার জন্য জেদ করবোনা।মাফ করে দিও আব্বু।"
ইয়াসমীনের বুঝতে দেরি হলোনা যে এদের মাথার ওপর থেকে সবচেয়ে ভরসার হাতটা উঠে গেছে।ইয়াসমীন আন্টি চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন ইমতিয়াজকে।ছেলেটা কই গেলো?মা বোন এভাবে কাঁদছে আর এই ছেলে কই গেলো?রানুখালাকে জিজ্ঞেস করেন,
''ইমতিয়াজ কই?"
''ওনি সুইডানে কতা কইতাছে।ভাইসাবের লাশ লই আওনের লাইগ্গা।"
''ওহ।"
এদিকে সৈয়দা বেগম কাঁদছেন।কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে ওনার।বলছিলেন,
''তুমি কেমনে চলে গেলা?তোমার ছেলে মেয়ের কথা কেন ভাবলানা?এখন কি করবো আমি?ছেলে মেয়ে একজনকে ও সুখী দেখে যাইতে পারলানা।আমার কি হয়ে গেলো ভাবি?আমার স্বামী নামক ছায়াটা সরে গেলো।আমার ছেলে মেয়ে দুটোর কি হবে?"
ইয়াসমীন আন্টির ভীষন কান্না পাচ্ছে।এসময়ে ওনাদের স্বান্তনা দেবার মতো ভাষা ওনার জানা নেই।তারপর ও বলতে লাগলেন,
''ভাবি আপনি এমন করলে ছেলে মেয়ে দুটো ভালো থাকতে পারবেনা।সবাই তো একদিন চলে যাবে ভাবি। আমি জানি এসব বলে কোন কাজে আসবেনা।কিন্তু ইদ্রিকে দেখলেন মেয়েটা পাগলের মতো কাঁদছে।ওদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিন।"
এদিকে কথা শেষ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ইমতিয়াজ।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে ও।মা ইদ্রি কেউই ভালো নেই।বাবা ওদের মাঝে থাকলে কতোটাই না ভালো হতো।বাবা চলে যেতেই সব শেষ হয়ে গেলো যেন।ইমতিয়াজ চোখ মুছে হাঁটতে হাঁটতে ইদ্রির রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়।ভিতর থেকে ইদ্রির চিৎকার শোনা যাচ্ছে।ইমতিয়াজ ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলো ইদ্রি ফ্লোরে বসে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে।চুল গুলো একদম আউলানো।কিছুসময়ের মাঝেই সব পাল্টে গেলো।কয়দিক সামাল দেবে?একদিকে বাবার মৃত্যু অপরদিকে মা বোন।সাঁঝকে না পাওয়ার কষ্ট সামাল দিতে না দিতেই বাবা কে হারানোর মতো তীব্র যন্ত্রনা ওর হৃদয় চিরে ফেলছে।ইমতিয়াজ কাছে গিয়ে বোনের সামনে বসে।ইমতিয়াজের মুখটা আবার ও কুঁচকে এসেছে কান্নার দমকে।ইদ্রিকে টেনে নিলো বুকে।ভাইয়ের বুকে আশ্রয় পেয়ে ইদ্রি কেঁদে উঠে চিৎকার করে।ইমতিয়াজ বলতে লাগলো,
''ইদ্রি বাবু এমন করিসনা বোন।আমি আছিনা?ভাইয়া আছিতো।তুই এমন করলে মাকে কে দেখবে বল?মা তো স্বামী হারিয়েছে।ইদ্রি ভাবিসনা বোন বাবা নেই আমি আছি।তোর কোন চিন্তা নেই।"
ইমতিয়াজ কে অবাক করে দিয়ে সামনে এলো ইদ্রি।অশ্রুসজল চোখে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
''কে বলল আব্বু নেই?অবশ্যই আছে আব্বু।আমি এখনই আব্বুকে ফোন দিবো।বলে দিবো তুই বলছিস আব্বু চলে গেছে।"
বলেই ইদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।এতক্ষনে হুঁশ হলো ইমতিয়াজের। মেয়েটা দৌড়ে বেরিয়ে গেছে।মাথা ঠিক নেই।পড়ে যেতে পারে।ইমতিয়াজ দৌড়ে বোনের পিছু নিতে থাকে।জোরে জোরে ডাকতে শুরু করে,
''ইদ্রি দাঁড়া প্লিজ।কথা শুন আমার। "
ইদ্রি দৌড়ে নামতে থাকে সিড়ি ভেঙ্গে।হঠাৎ টালসামলে পড়ে যেতে নিলে ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে কম্পিত কন্ঠে বলল,
''সাবধানে।এমন করিসনা।ব্যাথা পাবি।"
নিজের হাত ছাড়াতে চেয়ে ইদ্রি বলতে লাগলো,
''আমি আব্বুর কাছে যাবো যেতে দে।আমি যাবো গা আব্বুর কাছে।ছাড় আমাকে।আমি আব্বুর কাছে যাবো।"
ইদ্রিকে কোনমতেই সামলাতে পারছিলোনা ইমতিয়াজ।ও মানতেই পারছেনা বাবা নেই।সৈয়দা বেগম মেয়েকে এমন করতে দেখে কাঁদতে কাঁদতে এসে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
''এমন করিসনা মা।তোর বাবা নেই আর মানতে হবে তোকে।"
ইদ্রি সরে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
''না মিথ্যা বলছো তোমরা আব্বু আছে।আমি যাবো আব্বুর কাছে।"
ইয়াসমীন আন্টি ইদ্রিকে দেখে ইমতিয়াজ কে বললেন ওকে রুমে নিয়ে ঘুমিয়ে পাড়ানোর ব্যাবস্থা করে যেন।ইদ্রি বাবার ভীষন আদরের ছিলো।অনেকটা বছর বাবার সাথে ছিলো ও।ভীষন আদরে বড় হয়েছিলো।তাই হয়ত মেনে নিতে পারছেনা।সময়ের সাথে মেনে নিতে বাধ্য হবে।ইদ্রিকে প্রায় কোলে তুলে রুমে আনে ইমতিয়াজ।ইদ্রি কোনভাবেই ঘুমোচ্ছেনা।বরং চিৎকার করছে।বেরিয়ে আসতে চাইছে রুম থেকে।না চাইতেও একটা ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দেয় ইদ্রিকে ইমতিয়াজ। এতক্ষন পাগলামী করতে থাকলে ও।ধীরে ধীরে ইদ্রির শরীর নিথর হয়ে আসে।চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে ওর।ইমতিয়াজ ইদ্রির মাথায় হাত বুলাতে থাকে পাশে বসে।হারিয়ে যায় সেই সময়টায়।যখন আলতাফ আঙ্কেলের কথায় কেঁদে উঠে ও।চিৎকার করে উঠে ইমতিয়াজ। ওর চিৎকারে ইদ্রি আর মা চলে এসে বলছিলো,
''কিরে আব্বু কাঁদছিস কেন?"
ইমতিয়াজ বেশি কিছুই বলতে পারেনা।শুধু এতক্টুকুই বলতে পারলো, 
''বাবা নেই আর আমাদের মাঝে।"
সাথে সাথে বাসার পুরো পরিবেশ টাই বদলে গেলো।স্বজন হারানোর যন্ত্রনায় কেঁদে উঠে ইদ্রি আর মা।
...........................এদিকে রাহমান পরিবার খুশির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে।একদিকে সাঁঝের বিয়ের প্রস্তুতি অপরদিকে বেলার আগমনের খুশি।কোনটাই কম নয়।পূর্নাকে নিয়ে সবাই মেতে উঠেছে।ওকে কোলে নেয়ার জন্য ঝগড়া বেঁধে যায় ইকরাম রাহমান আর কুঞ্জন লাবনীর সাথে।ওনি কোন ভাবেই নাতনীকে কোল থেকে নামাতে চাননা। কিন্তু কুঞ্জন লাবনী চায় ওরা ভাগনীকে কোলে নিবে।ওদের এসব দেখে বেলা মুচকি হাসে।এতগুলো বছর যাবৎ এসময়টার অপেক্ষায় ছিলো ও।কতোইনা মনোমুগ্ধকর সময় কাঁটছে ওর।শুধু বাবা ওর সাথে কথা বলছেনা।হঠাৎ বিভান ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
''বেলা!!!"
পাশ ফিরে তাকায় বেলা।বিভান বলল,
''চলো বেরিয়ে আসি।এখানে আসার পর থেকে তো কোথা ও ঘোরা হয়নি।"
বেলা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,
''আব্বা আম্মা আছে।ওনাদের সামনে বের হবো আমরা?"
বিভান মাথা নেড়ে বলল,
''নিশাদ সাঁঝ,লাবনী আর আদনান ও বেরুবে।হুমায়রা পড়ছে ও বলল যাবেনা।"
বেলা কিছুটা চুপ হয়ে গেলো।হুমায়রার কথাবার্তা কাজ ওর কাছে বড় অদ্ভুত লাগছে।কিছু বলতে পারেনা বেলা।ওরা সবাই বেরিয়ে পড়ে।নিশাদ গায়ে জ্যাকেট জড়িয়েছে।আদনান লম্বা হাতার মোটা গেঞ্জি আর সাঁঝ আর বেলা গায়ে শাল জড়িয়েছে।বিভান সবসময়কার মতো সাদা পাঞ্জাবীর সাথে একসাইডে খয়েরী রংয়ের চাদর পরে নিলো।তিনজনে বেরিয়ে পড়ে।আদনান বিভানকে বলতে লাগলো,
''ভাই আপনাকে এভাবে অনেক মানায়।"
বিভান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
''কিভাবে?"
''এই যে একপাশে চাদর আর সাদা পাঞ্জাবী।একদম মোহাব্বাতে মুভির অমিতাভের মতো লাগে।"
বিভান একটু হেসে উঠে।নিশাদ বলল,
''তা হঠাৎ বের হলেন যে ভাই?রাত তো কম হলোনা।"
''আসলে তোমাদের সাথে কোথাও বের হইনি।আবার কবে সুযোগ পাবো জানিনা।তাই বের হলাম।"
সাঁঝ বেলার হাতের ভীতর হাত ঢুকিয়ে হাঁটছে।লাবনী কিছুটা রেগে বলল,
''সাঁঝ আপু বেলা আপা তোরা আমার হাত ধরে হাঁটছিসনা।দুবোন একসাথে হাঁটছিস।"
ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বিভান বলল,
''কে বলল তুমি একা?এই যে আমি আছি।চলো আমরা একসাথে হাঁটি।তোমার আমি থাকতে আর কাকে লাগবে বলো আমার ছোট শালী?"
বলেই লাবনীর হাত ধরে বিভান।লাবনী ও বলল,
''সেটাই ভাইয়া আপনিই আমার আপন ওরা বড় খারাপ।"
লাবনীর কথায় ওরা সবাই হেসে ফেলে।টঙ্গের দোকানে চা খায় ওরা একসাথে।বিভান চায়ে চুমুক দেয়ার মুহূর্তে বেলার দিকে আড়চোখে তাকায়।বেলা কি সেই দিনটা ভুলে গেছে?ওদের বিয়ের আগের রাতটা।ওরা ও তো এভাবেই চা খেয়োছিলো সেদিন তারপর হাঁটতে হাঁটতে দুজনে ভীষন ঘনিষ্ট হয়ে গেছিলো।সেদিন আবেগ ওদের একে অপরকে নিজেদের ভালবাসায় এতোটাই আবিষ্ট করে ফেলেছিলো যে সেদিনের পর থেকে তারা একে অপরকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি।সে রাতটা হয়ত ওদের চিরদিনের জন্য এক হতে বাধ্য করেছিলো।ঠিক সেই সময়ে বেলা বিভানের দিকে তাকায়।বেলার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখে ফুঁটে উঠে।বিভান বুঝতে পেলো বেলা ও হয়ত সেদিনটাকেই ভাবছে।এদিকে নিশাদ চা খেতে খেতে বিভানের সাথে বিয়ের আলাপ করছিলো।ঘন্টাখানেক ঘুরে ওরা বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়।ঘরে ফিরেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।পূর্না আজ মা খালামনিদের মাঝে শুয়েছে।বেলা বারবার না করার পর ও কথা শুনেনি।শেষপর্যন্ত সাঁঝের বুকে উঠেই ঘুম মহারানী।
পরদিন সকালে সবাই উঠে পড়ে।নিশাদের মুখ থেকে শুনেছিলো ইমতিয়াজকে নিয়ে কই যেন যাবে বিয়েরই কোন এক কাজে।তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সেড়ে নেয় নিশাদ।তারপর ফোন নিয়ে ইমতিয়াজের নম্বরে ডায়াল করে কোন কথা বলেনি।কি যেন শুনছিলো তারপর কোন কথা বার্তা না বলেই ফোন কানে রেখে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে।

!!!!

সেদিন বন্ধুকে দেখে ইমতিয়াজ নিজেকে একেবারেই সামলাতে পারেনি।বরং নিশাদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলো ও।বলছিলো,
''বাবা এভাবে চলে গেলো।আমার মা আর ইদ্রির কি হবে দোস্ত।ইদ্রিটাতো এখনো অনেক ছোট।আমার ছায়াটা চলে গেলো যে দোস্ত।আমার কি হবে নিশাদ?ইদ্রি একদম পাগলের মতো হয়ে গেছে।ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না বাবা আর নেই।"
নিশাদের চোখজোড়া ভরে আসে। বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলছিলো, 
''তুই এমন করলে আন্টি আর ইদ্রিকে সামলাবে কে বল?ইদ্রির জন্য আছি আমি।তুই ওর চিন্তা করিসনা।।"
ইমতিয়াজ সামনে এসে চোখ মুছে নিচ্ছিলো।নিশাদ বলল,
''আন্টি কই?"
''মা ইদ্রির রুমে।ওকে সামলানোর চেষ্টা করছে।"
''আমি একটু দেখবো ওকে?"
ইমতিয়াজ নিশাদের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে বলল,
''চল আমার সাথে।" 
নিশাদ ইমতিয়াজের সাথে হেঁটে হেঁটে ইদ্রির রুমে চলে আসে।ইদ্রি খাটের ওপর ঝাপটাচ্ছে।কেঁদে যাচ্ছে অনবরত।বলছিলো,
''আব্বুর কাছে যেতে দাও আমি এক্ষুনি যাবো।আব্বু!!!!!
সৈয়দা আন্টি ওকে সামলাতে চেষ্টা করছে।ওনি নিজে ও কাঁদছেন।ইমতিয়াজ মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
''মা নিশাদ ওকে একটু দেখবে।"
সৈয়দা বেগম পাশে তাকিয়ে দরজার বাহিরে নিশাদকে দেখে বলল,
''আসতে বল।"
ইমতিয়াজ নিশাদকে ভেতরে আসার জন্য ইশারা করলো।নিশাদ ভিতরে ঢুকতেই সৈয়দা বেগম দাঁড়িয়ে গেলো।নিশাদ ভিতরে প্রবেশ করে ইদ্রির দিকে এক পলক তাকিয়ে সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ বুঝতে পারলো নিশাদ হয়ত মায়ের উপস্থিতের কারনে ইদ্রির সাথে কথা বলতে পারছেনা।ইমতিয়াজ সৈয়দা বেগমের কাছে এসে বলল,
''মা তুমি রুমে যাও আমি আছি এখানে।"
সৈয়দা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, 
''দেখে রাখিস বাবা।"
সৈয়দা বেগম যেতেই ইমতিয়াজ ও বেরিয়ে আসে।ইদ্রির পাশে এসে দাঁড়ায় নিশাদ।ইদ্রি এখন ও পাগলের মতো কেঁদে যাচ্ছে।নিশাদ ইদ্রির পাশে বসে ওর হাত নিজের হাতে নিতেই ইদ্রি বলতে লাগলো,
''প্লিজ বাবার কাছে দিয়ে আসুন।"
নিশাদ ওর গালে হাত ছুঁইয়ে বলল,
''ইদ্রি শুনো আমি তুমি আমরা কেউই সারাজীবন বেঁচে থাকবোনা।আগে পরে সবাই চলে যাবো।তোমাকে ও মেনে নিতে হবে এই বাস্তবটা।জানি অনেক কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।একটু কষ্ট করো।"
ইদ্রি যেন রেগে গেলো। বলতে লাগলো,
''মানে কি?আপনি ও বলছেন আব্বু নেই?আমার আব্বু আছে।কিছুদিন পর চলে আসবে।তখন দেইখেন আপনারা।"
নিশাদ যতোই বুঝাতে চাইলো ইদ্রি ওকে ধাক্কা মারতে থাকলো।ওর শার্ট টেনে বুঝাতে চাইলো ওর বাবা বেঁচে আছে।এভাবে দুটো দিন কেঁটে গেলো।
নিজের ঘরে বসে ক্লান্ত ইমতিয়াজ ভাবছিল এই দুইদিনের কথা...ইদ্রি অলমোস্ট আউট অফ কন্ট্রোলে চলে গেছিল....মেয়েটার বয়স কেবল আঠারো হয়েছে।সেভাবে ম্যাচিউরিটি আসার কথা না। তার উপরে একমাত্র মেয়ে তাই আদরের শেষ ছিলনা....কিছুতেই ওকে খাওয়ানো যাচ্ছিলোনা শান্ত ও হচ্ছিলো না...."বাবা আর নেই" এটা কেউ বললে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরে যায়..এমনকি নিশাদকেও দিয়েছে প্রথম দিন থেকে কয়েকবার... 
কিন্তু দূরে সরাতে পারেনি নিশাদকে.. দুইটা হাতে শক্ত করে ইদ্রিকে চেপে ধরে ফ্লোরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে তবেই একটা সময় শান্ত করতে পেরেছিলো ইদ্রিকে.. আসলে ও ক্লান্ত হয়ে নিশাদের কোলে চুপ হয়ে পরে থাকতো..এই দৃশ্য দেখে ইমতিয়াজের মা মুখে আঁচল চেপে কেঁদেছিলেন দুটো দিন। শুধু...আর ইমতিয়াজের শুধু মনে হলো ও সেদিন ভুল করেনি বোনকে নিশাদের সাথে মেনে নিয়ে....গতকাল দিনের বেলা নিশাদের বাবা, মা, বড় বোনও এসেছিল এত ব্যাস্ততার মাঝেও একঝলক ওদের দেখতে..
হায় রে নিয়তি..!ওনারা সাঁঝের সাথে ইমতিয়াজের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতেও আসতে পারতেন কিন্তু এলেন বাবা হারা পরিবার টাকে শান্ত্বনা দিতে..নিশাদ এসেছে সন্ধ্যায়...বিভানের হাতে শপিংয়ের দায়িত্ব দিয়ে এদিকটায় ইদ্রিকে সামাল দেয়ার কাজটা করে যাচ্ছে পুরোদমে..
তমা সারাদিনরাত ইমতিয়াজকে ফোন করে খবর নিচ্ছে...বাসায়ও এসেছে দুইবার নিজের হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে...আবার চলে গেছে...ইমতিয়াজ ওকে দেখে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো কেবল...বোনকে খাওয়াতে না পেরে নিজে ও খেতে পারছিলনা...জোর করে তমা ওকে মুখে তুলে খাইয়েছে এমনকি ওর মাকেও.....সারা বাসায় আত্মীয় স্বজন ছিল....তারা তমার এহেন দায়িত্বশীল আচরণে মুগ্ধ হয়ে ভেবেছে "কে এই মেয়েটা..?"..
এসব ভাবতে ভাবতে ইমতিয়াজের মনে হল
"বন্ধুদের অবদানের কাছে ও আজীবন ঋণী হয়ে গেল..."
........................এদিকে ইকরাম রাহমানের বাসায় সাঁঝের হলুদের প্রস্তুতি চলছে বেশ ভালভাবেই।তবে আদনান আর বিভানের ওপর চাপ টা একটু বেশিই কারন নিশাদ সন্ধ্যা হলেই চলে যেতো ইদ্রিকে দেখতে।হলুদ বাটা গুলো ডালায় সাজাচ্ছে লাবনী আর হুমায়রা।বেলা একটা আনারস ছিলে ওদের সামনে এনে বলল,
''আঙ্গুরে টুথপিক ঢুকিয়ে আনারসের গায়ে লাগিয়ে দেয়।জানিস তো কিভাবে?"
দুইবোন মাথা নাড়লো।এদিকে সাঁঝ গোসল সেড়ে এসে খাটে বসলো।চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেছে।তখনই ফোনে মেসেজ এলো।ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সাইমন মেসেজ পাঠিয়োছে।সেটি ছিলো ''সেজে আমাকে ছবি পাঠাও।আমি দেখবো।"সাঁঝ মৃদু শব্দ করে হাসলো তারপর ফোনটাকে উপুড় করে খাটের ওপর রাখলো।হঠাৎ জুলেখা বানু এসে বলতে লাগলেন,
''অহনো চুল মুছোস নাই?"
সাঁঝ গামছা মায়ের দিকে বাড়িয়ে বলল,
''মুইচ্ছা দাও না আম্মা।"
জুংেখা বানু গামছা হাতে নিয়ে রেগে বললেন,
''বুড়ি খাসি কয় চুল মুইছতো ফারেনা।"
সাঁঝ হেসে ফেললো।জুলেখা বানু সযত্নে মেয়ের মাথা মুছে দিতে থাকে।বেলা হলুদের কাপড় ডালা নিয়ে সাঁঝের রুমে আসার সময় দেখলো পূর্না জামা হাতে দৌড়াচ্ছে।ওর পিছু বিভান দৌড়াচ্ছে।পূর্না বারবার বলছে, 
''তোমাল আতে পলবোনা।"
এদিকে বিভান দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে, 
''পরতে হবে মা।এদিকে আসো।"
বেলা সেখানে গিয়ে মেয়েকে থামিয়ে বলল,
''জামাটা আমাকে দিন। "
বিভান বেলার হাতে জামাটা ধরিয়ে দিলো।বেলা পূর্না জামাটা পরিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো।তারের বিভান কে বলল,
''আপনি আসরের নামাজ পরে রেডি হয়ে নিন।"
''হুম।"
বেলা মেয়েকে আর সাঁঝের কাপড়চোপড় নিয়ে সাঁঝের রুমে প্রবেশ করে।সাঁঝকে দেখে পূর্না মায়ের কোল থেকে নেমে দৌড়ে সাঁঝের কোলে উঠে যায়।আসলে এই কয়েকদিনে সাঁঝের সাথে পূর্নার বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।সাঁঝ ভাগনীর গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আম্মুটাকে একদম বৌ সাজিয়ে দেবো ওকে?"
পূর্না অবাক কন্ঠে বলল,
''তৌ কি দিনিত?"
সাঁঝ শব্দ করে হেসে ফেললো।তারপর পূর্নার গাল টেনে দিয়ে বলল,
''তৌ না আম্মু বৌ।বৌ হচ্ছে যারা বিয়ে করে তারা।"
''তুমি তি বিয়ে কব্বা?"
সাঁঝ শব্দ করে হেসে ফেললো।তারপর পূর্নার গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আপা তোর কি পাজি মেয়ে।"
বেলা হাসছিলো মেয়ে আর বোনের কথা শুনে।সাঁঝের চুল মুছা শেষে বেলা বোনকে সাজাতে শুরু করে।তারপর সব শেষে কাঁচা ফুলের অলঙ্কার গুলো পরিয়ে দিতে থাকে।লাবনী আর হুমায়রা ও শেষ মুহূর্তে এসে ছিলো গয়না পরানোর সময়। লাবনী তো জোরে চিৎকার করে,
''আপা দেখ আপুকে কতো সুন্দর লাগতেছে একদম ফুলপরী।"
বেলা হেসে বলল,
''আমাদের সাঁঝ পরী থেকে কম কিসে?মাশাল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে।"
এদিকে খালাকে ফুল দিয়ে সাজতে দেখে পূর্না চিৎকার করে বলছিলো,
''পুল দিয়ে তাদায় দাও মা।"
বেলা নাকচ করে বলল,
''না আম্মু খালামনি কে একটু পর হলুদ দিবো তো।তোমাকে এমনিতেই ফুলের মতো লাগছে।ফুলকে ফুল দিয়ে সাজানো যায়না মা।"
পূর্না জোরে জোরে হেসে লাফিয়ে বলতে লাগলো,
''আমি পুল!!আমি পুল......"
সাঁঝকে সাজানো শেষে লাবনী বেলা আর হুমায়রা সাজতে লাগলো।সাঁঝ ও পূর্নাকে হালকা সাজিয়ে দিলো।ওরা যখনই বের হবে তখন হঠাৎ কুঞ্জন রুমে এসে সাঁঝের দিকে কিছুক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
''এচ্ছি তেলাপোকা লাগছে তোকে। "
সাঁঝ ভ্রু উঁচু করে মৃদু হাসছিলো।তখনই লাবনী বলল,
''আপা সাজিয়েছে।"
কুঞ্জন সেই মুহূর্ত নিজের করা মন্তব্য পাল্টে বলল,
''এজন্যইতো বলি ছিপকালিকে পরী লাগছে কেন?আসলে আপার সব জাদু বুঝতেই পারিনি।"
বেলা কুঞ্জনের কান টেনে দিয়ে বলল,
''ফাজলামি হচ্ছে? যাহ এখানে থেকে।"
কুঞ্জন যেতে নিবে তখনই আদনান দরজা হালকা ফাঁকা করে বলল,
''সাঁঝকে নিয়ে আয় আপা।"
বেলা আর বাকি দুবোন মিলে সাঁঝ কে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।আদনান পূর্নাকে কোলে নিয়ে ছাদে আগেই চলে গেছে।স্টেজ সাজানো হয়েছে ছাদে।ড্রয়িং রুমে পৌছুতেই নিশাদ এসে বোনের কপালে চুমু দেয়।ওর চোখের কোনা গড়িয়ে অশ্রুর ফোঁটা ঝরে পড়ে।নিশাদ বোনকে বুকে চেঁপে  বলল,
''অনেক সুন্দর লাগছে তোকে।চল আপা ছাদে যাই।"
ওরা সবাই ছাদে চলে আসে।চারিদিকে আলোর ঝলকানিতে ছাদটাকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে।বিভান দুরন্ত পূর্নাকে সামলাচ্ছে।ওদের দুই মামা আর মামী আর চাচীকে দেখা গেলো।নানু ও ছিলেন সেখানে।সাঁঝকে তিনবোন স্টেজে বসিয়ে দেয়।বেলা দেখলো নিশাদ বারবার ফোন চেক করছে।বেলা জানে নিশাদ ইদ্রির চিন্তা করছে।নানু আর বাবা মা হলুদ দেয়ার পর বেলা নিশাদকে বলল,
''তুই সাঁঝকে হলুদ টা দিয়ে ইদ্রির কাছে যা।ওর দরকার তোকে।"
নিশাদের চোখ ছলছল করে উঠে।বেলার থেকে চোখসরিয়ে সাঁঝের দিকে তাকায় নিশাদ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন