' তুই এক সপ্তাহের জন্য জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে চলে আয় তো।'
' কোথায় যাব?'
' আরে গাধা কোথায় আবার? আমার বাসায়। '
' ওয়েট ওয়েট। কি বললি তুই? ঠিক বুঝতে পারলাম না। জীবনে তো একদিন তোর বাসায় নিলি না। আজ হঠাৎ করে বলছিস এক সপ্তাহের জন্য চলে যেতে। ব্যাপার কি রে?'
'তুই তো বিয়ে টিয়ে করিস নি। শ্বশুড়বাড়িতেও যেতে পারিস না। তাই ভাবছিলাম তোকে আমাদের বাসায় এনে জামাইআদর করবো।'
জয়ের কথা শুনে ফোনের ওপাশের ছেলেটা হাসতে লাগলো। জয় বলল,
' হাসিস না তো। আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর এক সপ্তাহ পরেই বিয়ে। এখনো কত কাজ বাকি। বাসায় এটাই প্রথম বিয়ে তাও আমার একমাত্র বড় বোনের। সব দায়িত্ব এসে আমার উপর পড়েছে। এখনো কিছুই করা হয়নি। তুই এলে দু'জনে হাত লাগিয়ে দুই দিনেই সব কাজ করে ফেলবো।'
' ওকে আমি দেখছি। '
' দেখছি না। তুই আজই চলে আয়। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার বোন তোরও বোন। বোনের বিয়েতে কাজ করা এটা তোর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাড়াতাড়ি এসে দায়িত্ব পালন কর তো। আমি একা আর পারছি না। চারপাশে এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে কাজের কারণে কারো দিকে তাকানোর সময়টুকুও পাচ্ছি না।'
' আচ্ছা আসছি।'
' আর শোন তুই বাসায় এসে আমাকে না পেলে আবার চলে যাস না। ভেতরে এসে আমার রুমে বসবি। মা'র কাছে তোর কথা অনেক বলেছি। মা তোর নাম শুনলেই তোকে চিনে যাবে।'
' তোকে পাবো না কেন? তুই আবার কোথায় যাবি?'
' খালামণির দুই মেয়েকে আনতে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। ওদের নিয়ে ফিরে তোর সাথে দেখা হবে। এখন রাখি রে। তুই জলদি আয়।'
জয় স্পৃহার রুমে বসে আছে। তোহা মুখ কালো করে কাঁদো কাঁদো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জয় বলল,
' তাহলে আজ তুই যাবি না তোহা?'
' কিকরে যাব ভাইয়া? আজই তো পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আজকের পরীক্ষাটা দু'দিন পিছিয়ে দিয়েছে।'
' সেকি! আমি তো আরো তোদের নিতে এসেছিলাম। খালামণি বললো উনারা বিয়ের দু'দিন আগে যাবে। আঙ্কেল নাকি ছুটি পায়নি। এখন তো দেখি তোকে খালামণির সাথেই যেতে হবে। '
' হুম বিয়ের সব মজা শেষ হয়ে যাবে। তোমরা সব কাজ সেরে ফেলবে। তখন আমি মেহমান সেজে যাব। ভাল্লাগে না ছাতা। আমি পরীক্ষাই দিব না।'
' একথা শুনলে না খালামণি তোকে আস্ত খেয়ে ফেলবে।'
জয় স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
' তোহা তো যেতে পারবে না। ভেবলি তুই রেডি হ। তোর তো কোনো সমস্যা নেই। এসেছি যখন তোকে নিয়েই ফিরি।'
স্পৃহা আমতা আমতা করে বলল,
' ভাইয়া আমিও নাহয় সবার সাথে যাব।'
' সবার সাথে যাব কি হুম? বিয়ে বাড়ির এতো এতো কাজ আমি একা করবো নাকি? তোরা একেকটা জমিদার সেজে বসে থাকবি আর আমাকে দিয়ে কামলা খাটাবি। এটাতো হতে পারে না। তুইও আমার সাথে বিয়ে বাড়ির সব কাজ করবি। আর তুই আজ না গেলে আমি এমনি এমনি কষ্ট করে এসেছি কেন? '
জয় এতো সহজে বুঝ মানার পাত্র না। সে যেহেতু বলেছে স্পৃহাকে তার সাথে নিয়ে যাবে, তার মানে যাবেই। এখন সে স্পৃহার কোনো কথাই শুনবে না। স্পৃহা মা বাবাও তাকে জয়ের সাথে যেতে বলছে। তানিয়া বললেন,
'জয় এসেছে তুই ওর সাথে চলে যা না মা। আমরা তো সমস্যায় পড়েছি তাই আজ যেতে পারছি না। তোর তো আর কোনো সমস্যা নেই। তুই জয়ের সাথে যা। বিয়ে বাড়িতে কত কাজ হয়। মারিয়া তো আর নিজের বিয়ের কাজ নিজেই করবে না। তোর খালামণি একা হাতে কীভাবে সব সামলাবে? তার তো আর কোনো মেয়ে নেই। তুই গিয়ে খালামণির হাতে হাতে একটু কিছু তো করতে পারবি। আমার বোন তো তোকে কোনোদিন নিজের মেয়ের থেকে কম দেখে নি।'
জয় স্পৃহার ঘরে ওর বিছানায় বসে পা নাচাতে নাচাতে বলল,
'খালামণি তুমি বুঝতে পারবো না। বিয়ে বাড়িতে গেলে কাজ করতে হবে এটা ওর সমস্যা না। ওর আসল সমস্যা হলো বিয়ে বাড়িতে অনেক মানুষ থাকবে।ওকে সবার সামনে যেতে হবে। সবার সাথে কথা বলতে হবে এটাই ওর আসল সমস্যা। কি এক মেয়ে যে তৈরি করলে না খালামণি! একে তো মেয়ে বলা চলে না। একে ঘরকুনো ব্যাঙ বললেই চলে। সারাক্ষণ ঘরের কোণে বসে থাকে।'
' কি করবো তুই-ই বল। তোহাটা এতো খোলামেলা আর স্পৃহাটা একদম গম্ভীর। ওর বাবা আমি কেউই তো এতো গম্ভীর না। ও কীভাবে এমন হলো তা আল্লাহই জানেন।'
জয় স্পৃহার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
'একে বিয়ে দিলে তোমাদের খুব সমস্যায় পড়তে হবে খালামণি। আমি যা বুঝতেছি তাতে তো আমার মনে হচ্ছে স্পৃহা শ্বশুরবাড়ি গিয়েও কারো সাথে কথা বলবে না। শুধু নিজের শ্বশুর শাশুড়ি আর স্বামীর সাথে কথা বলবে আর অন্য কারো সাথে বলবে না, এমন করলে তো শ্বশুড়বাড়িতে আমাদের মেয়েটার বদনাম হবে।'
তোহা স্পৃহার সাথে তার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিল। স্পৃহা আলমারি থেকে কাপড় বের করে দিচ্ছে তোহা বেছে বেছে তার যেটা পছন্দ হচ্ছে সেটা ব্যাগে ঢোকাচ্ছে। জয়ের কথা শুনে স্পৃহা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। নিজের মায়ের সামনে জয় ভাইয়া তাকে নিয়ে এসব কি কথা বলছে? তোহা জয়ের কথা শুনে ব্যাগ গোছানো রেখে উঠে এসে জয়ের পাশে বসতে বসতে বলল,
'আমার বোনকে নিয়ে তোমার দেখছি অনেক চিন্তা। আপুর শ্বশুরবাড়ির চিন্তায় চিন্তায় তুমি তো দেখছি অস্থির হয়ে পড়েছ। তা ভাইয়া খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করছো? নাকি আপু শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কীভাবে সবার সাথে থাকবে এই চিন্তায় খাওয়াদাওয়াও ছেড়ে দিয়েছ?'
জয় তোহার মাথা চাপড় মেরে বলল,
'তোর বোনকে নিয়ে আমার চিন্তা হবে কেন রে? আমার তো আমার ভেবলিকে নিয়ে চিন্তা হয়। ভেবলিটা তো তোর মত পাকা না। তুই তো আস্ত একটা হাড় পাকা বুড়ি।'
'হুম হয়েছে হয়েছে। এখন আর তুমি আমার পেছনে পড়ো না। তুমি তোমার ভেবলিকে নিয়েই থাকো।'
স্পৃহা বাবার কাছে বলে যেতে পারলো না। কারণ বাবা এখন বাসায় নেই। মা আর তোহার থেকে বিদায় নিয়ে স্পৃহা গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো। জয় স্পৃহার হাত থেকে ব্যাগ নিতে নিতে বলল,
'আমি থাকতে তুই ব্যাগের বোঝা টানছিস কেন? দে ব্যাগটা আমার কাছে দে।'
তানিয়া মেয়েকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো। তোহাও সাথে এসেছে। জয় সিএনজি নিয়েছে। একটু সামনে গিয়ে বাস ধরবে। তানিয়া স্পৃহাকে বললেন,
'সাবধানে থাকিস মা। আর সব সময় খালামণির সাথে থাকিস। একা কোথাও যাস না কেমন?'
স্পৃহা মাথা নাড়িয়ে বলল,
'আচ্ছা। '
'শোন বিয়ে বাড়িতে অনেক ছেলেপুলে আসবে। মারিয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকেও আসবে। বিয়েতে এমন একটু আধটু দুষ্টুমি হয় জানি। তবুও কেউ যদি তোকে বিরক্ত করে তাহলে তুই জয়কে বলবি। অবশ্য জয় থাকতে আমার ওসবের চিন্তা করায় বৃথা। জয় তোকে সব সময় চোখে চোখে রাখবে।'
তোহা স্পৃহাকে মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
'আপুকে ছাড়ো তো মা। কি সব বাজে কথা নিয়ে পড়ে আছো তুমি। তোমার মেয়ে চার পাঁচ বছরের কোনো ছোট বাচ্চা না যে,তাকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে। আপু কনের বোন হয়। ছেলেপুলেরা ওর সাথে একটু আধটু দুষ্টুমি করবে না তো কার সাথে করবে?'
তানিয়া চোখ রাঙিয়ে তোহার দিকে চেয়ে বললেন,
'অনেক বড় হয়ে গেছিস তুই, তাই না?'
এতক্ষণে জয় স্পৃহার ব্যাগ সিএনজিতে রেখে ওদের কাছে এসে বলল,
'মা মেয়েরা মিলে কি এতো কথা হচ্ছে? এই স্পৃহা তুই গিয়ে সিএনজিতে বোস। খালামণির কথা সারাদিনেও শেষ হবে না। কিন্তু আমাদের সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে।'
স্পৃহা যাবার আগে তোহা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
'যা আপু যা। তুই একা একা গিয়েই বিয়ে বাড়ির মজা নে। আমি নাহয় পরীক্ষা দিয়ে দুদিন পরেই আসব। আর শোন মারিয়াপুকে বলবি আমি তার উপর অনেক রেগে আছি। সে কেন বেছে বেছে আমার পরীক্ষার সময়ই বিয়ে করতে গেল? কিছুদিন আগে বা পরে করলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত। সুন্দর সুন্দর বেয়াইরা আসবে আর আমি তাদের সাথে মজা করতে পারবো না। এতো কষ্ট আমি কোথায় রাখবো তুই-ই বল?'
জয় তোহাকে টেনে স্পৃহার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
'ঐ নটাংকি ছাড় আমার ভেবলিকে। তোর সব কথাই কিন্তু আমি শুনেছি। খালামণিকে বলবো তুমি কত বড় হয় গেছো?'
'ভাইয়া তুমিও না! ভাল্লাগে না ছাতা। '
স্পৃহা সিএনজিতে উঠে বসলে তানিয়া বললেন,
'জয় ওকে নিয়ে সাবধানে যাস। আর স্পৃহা, মা তুই নিজের খেয়াল রাখিস।'
জয় খালামণিকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
'তুমি চিন্তা করো না তো খালামণি। কেউ ওর খেয়াল না রাখলেও আমি ওর খেয়াল রাখব। স্পৃহার একটুও অযত্ন হবে না। তোমরা দু'দিন পর চলে এসো। তোমাদের ছাড়া ভালো লাগবে না।'
'আচ্ছা আসবো।'
সন্ধ্যার আগে আগে জয় স্পৃহাকে নিয়ে বাসায় এসে পরেছে। বাড়ির সামনে ওরা দু'জন রিকশা থেকে নামলো। জয় রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে যেতে দেখে তার কাছে ভাংতি টাকা নেই। জয় বলল,
'মামা আপনার কাছে এক হাজার টাকা ভাংতি হবে?'
' না। আমার কাছে তো এতো টাকা নাই মামা।'
'ওহ। আচ্ছা তাহলে আমি ভাংতি নিয়ে আসছি। আপনি একটু দাঁড়ান মামা।'
'আচ্ছা। '
জয় স্পৃহাকে বলল,
'বাসার সামনে তো এসেই গেছি। তোকে আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমি ভাংতি নিয়ে আসছি। তুই ভেতরে চলে যা। ব্যাগ এখানে থাক আমি নিয়ে যাব।'
'আচ্ছা। '
স্পৃহা গেট দিয়ে ঢোকার একটু পরই তার ফোন বেজে উঠলো। তোহা ফোন দিয়েছে। স্পৃহা ফোন তুলে বলল,
'হ্যা বল।'
'আপু তোমার পৌঁছে গেছো?'
'হুম এইতো একটু আগেই এলাম। আমি এখন ভেতরে যাচ্ছি।'
'ওহ আচ্ছা। মা তোমাকে নিয়ে টেনশন করছিল তো তাই ফোন দিয়ে জেনে নিলাম।'
'হুম। মা কোথায়? '
'রান্নাঘরে। কথা বলবে? ফোন নিয়ে যাব?'
'না এখন থাক। ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিই পরে আবার ফোন দিব। তখন নাহয় কথা বলে নিব।'
'আচ্ছা। এই আপু শোন তোমার ব্যাগে আমি মারিয়াপুর জন্য একটা গিফট রেখে দিছিলাম। ওটা আপুকে মনে করে দিও তো।'
'কোন ব্যাগে?'
'আরে তোমার হাত ব্যাগে। দেখো ওটাতে পেয়ে যাবে।'
'আচ্ছা দাঁড়া দেখছি।'
স্পৃহা কাঁধ দিয়ে কানের সাথে ফোন চেপে রেখে হেঁটে যেতে যেতে ব্যাগের ভেতর খুঁজতে লাগলো। এমন সময় সামনে থেকে আসা একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খেলো সে। ধাক্কা খেয়ে স্পৃহার ফোন নিচে পড়ে যায়। ছেলেটাও ফোনে কথা বলতে বলতে আসছিল তাই সে স্পৃহাকে দেখে নি। স্পৃহা অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা নিচে থেকে স্পৃহার ফোন তুলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
'সরি। আসলে আমি ফোনে কথা বলছিলাম তো তাই আপনার দিকে লক্ষ করিনি। এই নিন আপনার ফোন।'
জীবন ফোনে কথা বলতে বলতে আসছিল তাই সে স্পৃহাকে দেখে নি। স্পৃহা তার সামনে জীবনকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছিল এই ছেলেটার সাথে হয়তো আর কখনো তার দেখা হবে না। কিন্তু না আজ আবার তাদের সামনাসামনি হয়ে গেল। স্পৃহা ঠিকই জীবনে চিনেছে। কিন্তু জীবন স্পৃহাকে চিনতে পারেনি। কারণ স্পৃহা বোরখা পড়ে হিজাব করে মুখ ঢেকে রেখেছে। জীবন নিচে থেকে স্পৃহার ফোন তুলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
'সরি। আসলে আমি ফোনে কথা বলছিলাম তো তাই আপনার দিকে লক্ষ করিনি। এই নিন আপনার ফোন।'
স্পৃহা কোনো কথা না বলে জীবনের হাত থেকে ফোন নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। জীবন মেয়েটার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।
তোহা হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে কিন্তু এপাশ থেকে কোনো কথা শুনতে পারছে না। তোহা ফোনের মাঝে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
'এই আপু,,, কি হয়েছে তোমার? কথা বলছো না কেন? '
তোহার চেঁচানো শুনে স্পৃহা মনে পড়লো তোহা এতক্ষণ ধরে লাইনে আছে। তোহা বলল,
'একটু আগে কোথায় গিয়েছিলে হ্যা? কথা বলছিলে না কেন? '
'একজনের সাথে ধাক্কা লেগে ফোন নিচে পড়ে গিয়েছিল।'
স্পৃহা তোহাকে কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। একেতো সে মিথ্যা বলতে পারে না। কিন্তু তোহাকে সব সময় সত্যিটা বলাও যায় না। এই কথাটা বলে ফেলে এখন স্পৃহা আফসোস করছে। তোহা ধাক্কা লাগার কথাটা শুনে বেশ জোরেই বলল,
'কি বলছো তুমি আপু? বিয়ে বাড়িতে গিয়ে তো এখনও দুমিনিট দাঁড়ালে না। মাত্রই গেলে। আর এর মধ্যেই একজনের সাথে ধাক্কাও খেয়ে ফেললে! ইশ,আমার কাছে তো ব্যাপারটা অনেক রোমান্টিক লাগছে। আচ্ছা আপু ছেলেটা কে? চেনো তুমি? আগে কখন দেখেছো? নাকি বিয়ে বাড়ির নতুন মেহমান? আচ্ছা ওসব বাদ দাও। এটা তো ছেলেটা দেখতে কেমন? '
স্পৃহা তোহাকে ধমক দেয়ার মত করে বলল,
'তোহা তুই বড্ড বেশি কথা বলিস আজকাল। আমি বলেছি একজনের সাথে ধাক্কা লেগেছে। সে ছেলে না মেয়ে তা তো তোকে বলিনি। তুই নিজে থেকে ভেবে নিলি ও ছেলে? কেন মেয়ের সাথে কি ধাক্কা লাগা যাবে না?'
'আপু তুমিও না! মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগবে কেন? বিয়ে বাড়িতে একটা মেয়ের একটা ছেলের সাথেই ধাক্কা লাগবে এটাই নিয়ম। সবকিছুতে রোমান্টিকতার একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না।'
'তুই থাক তোর রোমান্টিক ব্যাপার সেপার নিয়ে। আমি এখন রাখছি।'
তোহা হেসে বলল,
'আচ্ছা বাই। নিজের খেয়াল রেখো।'
'অ্যাই তুমি একটু আগে কার সাথে কথা বললে? কাকে সরি বললে তুমি?'
'আরে তোমার সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম সামনে থেকে হঠাৎ একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগে গেল।'
'ওহহো! বিয়ে বাড়িতে গিয়ে এখনো একদিন পার করলে না। আর তার মধ্যেই ধাক্কা টাক্কা লেগে রোমান্টিক কান্ডকারখানা ঘটে গেল।'
' তুমি যেমন ভাবছো তেমন না। মেয়েটার ফোন নিচে পড়ে গিয়েছিল। আমি তুলে দিয়ে সরি বলে চলে আসলাম।'
'তুমি সরি বললে কেন? আর মেয়েটার সামনে ভালো সাজতে ফোনটাই বা নিচে থেকে তুলে দিতে গেলে কেন?'
'নূপুর তুমি ভুল বুঝছো আমাকে? '
'মোটেও না। তোমাকে ভুল বোঝার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু যে মেয়েটার সাথে ধাক্কা খেলে, হতে পারে সে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে।'
'ইচ্ছে করে করতে যাবে কেন? '
'কেন করবে তার আমি কি জানি? হতে পারে সুন্দর ছেলে দেখে প্রেমে পড়ে গেছে। এসব মেয়েদের আমি খুব ভালো করে জানি। আমার ফ্রেন্ড গুলোই তো সুন্দর ছেলে দেখলে যেচে গায়ে পড়ে কথা বলতে যায়। এই মেয়েটাও নিশ্চয়ই তেমন। সব ছেলে পটানোর ধান্দা। বুঝি না মনে করেছে।'
নূপুরের কথা শুনে এবার জীবন হেসে ফেললো। মেয়েটা ওকে নিয়ে সব জায়গাতেই এতটা সিরিয়াস কেন? জীবন হাসতে হাসতেই বলল,
'নূপুর তুমি বড্ড জেলাস ফিল করছো। আর তাই রাগ করে এসব উল্টোপাল্টা কথা বলছো। মেয়েরা যে তাদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে জেলাস হয় তা জানতাম। কিন্তু তুমি যে এতটা হও তা আগে জানা ছিল না।'
নূপুর রেগে বলল,
'কে জেলাস হচ্ছে? আমি? মোটেও না। আমি কেন জেলাস হবো? তুমি আমার কে হও?'
'আমি তোমার কে তুমি জানো না?'
'না। জানি না। '
'আচ্ছা তাহলে আমি ঐ মেয়েটার সাথে গিয়ে আবার ইচ্ছে করে ধাক্কা খাই। আর সরি বলতে গিয়ে ফোন নাম্বারটাও নিয়ে আসি। তুমি দুই মিনিট ধরো কেমন? '
নূপুর ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে জীবনের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলো।
'অ্যাই জীবন একদম খুন করে ফেলবো কিন্তু। অসভ্য। বাজে ছেলে একটা। এজন্য তোমাকে বিয়ে বাড়িতে যেতে না করেছিলাম। আমি তো জানি ছেলেরা কেমন হয়। ওরা সুন্দর কোনো মেয়ের সামনে গেলে এটা ভুলে যায়,তাদের যে আগে থেকেই একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। সব ছেলে এক জাতের। গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বত্বেও তাদের অন্য মেয়েদের দিকে তাকাতে হয়। শুধু কি তাকায়? লাইন মারার চেষ্টায় থাকে। মেয়েদের দেখে ইনোসেন্ট স্মাইল দেয়।'
জীবন এবার শব্দ করে হাসছে। হঠাৎ নূপুরকে এতটা রেগে যেতে দেখে জীবন নিজের হাসি কন্ট্রোল করে রাখতে পারছে না।
'হাসছো কেন অসভ্য। একদম হাসবে না।'
জীবন না থামলে নূপুর আবার বলল,
'হাসি না থামালে আমি কিন্তু কল কেটে ফোন অফ করে রাখব। এক সপ্তাহ আর কথাই বলবো না।'
জীবন সাথে সাথে হাসি থামিয়ে বলল,
'এই না না। জান একদম এরকম করবে না। তোমার সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারবো না। তখন কিন্তু সবকিছু ছেড়েছুড়ে তোমার কাছে চলে আসব।'
'আচ্ছা ফোন অফ করবো না। তাহলে তুমিও কিন্তু কোনো মেয়ের দিকে তাকাবে না।'
'পাগল! আমি তোমাকে ছাড়া আর কোনো মেয়ের দিকে তাকাব। তোমার এটা মনে হয়?'
' হয় না। তবুও আজকালকার মেয়েগুলোর উপর বিশ্বাস নেই। যা রঙ্গিঢঙ্গি!'
'আচ্ছা তুমি যেমন বলবে তেমনই হবে। '
'আর শোনো। একটু আগে যে মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়েছ,ওর থেকে কম করে হলেও দেড়শো হাত দূরে থাকবে। মনে থাকবে? '
'হুম থাকবে। '
'আচ্ছা তাহলে এখন রাখি? '
'এখনই রাখবে? '
'হুম। '
'আচ্ছা। লাভ ইউ। '
'লাভ ইউ টু।'
জীবন এতক্ষণ নূপুরের সাথে কথা বলছিল। এখানে আসার পর একবারও কথা হয়নি। তাই ফোন হাতে নিয়ে মাত্র বাইরে বেরিয়ে এসেছে এমন সময় ঐ মেয়েটার সাথে ধাক্কা লেগে যায়। ফোন হাতে নিয়ে জীবন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। নূপুরের সাথে কথা বললে সময় কখন কেটে যায় তা সে বলতেই পারে না। ইচ্ছে করে সব সময় এই মেয়েটার সাথে কথা বলতে। নূপুরের কন্ঠ শুনলে তার শত মন খারাপের মাঝেও মন ভালো হয়ে যায়। মেয়েটা কি জাদু জানে? কীভাবে তাকে এতটা দুর্বল করে দিলো?
স্পৃহা ভেতরে এসে খালামণির সাথে দেখা না করেই দৌঁড়ে মারিয়ার রুমে গেল। মারিয়া রুমেই ছিল। সে স্পৃহাকে দেখে বলল,
'আর স্পৃহা তুই কখন এলি?'
'আমি কখন এসেছি, কার সাথে এসেছি এসব কথা পরে হবে আপু। আগে বলো ঐ ছেলেটা তোমাদের বাসায় কি করছে? '
স্পৃহা এক দমে হড়বড় করে কথা গুলো বলে ফেলেছে। কিন্তু মারিয়া তার কথার আতা মাথা কিছুই বুঝতে না পেরে বলল,
'ঐ ছেলেটা,কোন ছেলেটা স্পৃহা? কোন ছেলেটা আমাদের বাসায় কি করছে? কার কথা বলছিস তুই? '
'আরে আপু ঐ ছেলেটা।'
'কোন ছেলেটা? '
মারিয়া ঠিক আগের মতই ভ্রু কুঁচকে উল্টো স্পৃহাকে প্রশ্ন করছে। স্পৃহা মারিয়াকে তার কথা বুঝাতে না পেরে বিরক্ত হচ্ছে।
'আরে আপু ঐ ছেলেটা। যে ছেলেটা আমার জন্য মারামারি করে ছিল। ঐযে ঐদিন ঘটনাটা ঘটেছিল। মনে পড়ছে? '
'শাড়ি পরার ঘটনার কথা বলছিস? বাইক ওয়ালা ছেলেটা? '
'হ্যা। '
মারিয়া স্পৃহার থেকেও বেশি আশ্চর্য হয়ে বলল,
'ঐ ছেলে এখানে কি করবে? কই আমি তো ওকে দেখিনি। তুই কোথায় দেখলি?'
'গেটের সামনে। '
'সর্বনাশ! ছেলেটা তোকে দেখেছে? বাড়ির কেউ যদি ঐ ঘটনা জানতে পারে না তাহলে আমার বিয়ে খুব ভাল ভাবে হয়েছে।'
'আমাকে কীভাবে দেখবে? মুখ বাধা ছিল তো।'
'ভালো হয়েছে। কিন্তু ছেলেটা এখানে কোত্থেকে এলো?'
'আমি কি জানি।'
জয় গেটের ভেতর এসে দেখে জীবনের বাইক দাঁড় করানো। তার মানে জীবন চলে এসেছে। জয় একটু এগিয়েই জীবনকে দেখতে পেলো।
'জীবন এসে গেছিস?'
'না। এখনো আসিনি। শালা না আসলে তোর সাথে দাঁড়িয়ে থাকতাম কীভাবে? এসে গেছিস না বলে জিজ্ঞেস কর কখন এসেছিস। '
'কখন এসেছিস?'
'অনেকক্ষণ হয়েছে। ভেতরে গিয়ে তোকে পাইনি। আন্টিকে আমার নাম বলার পর, আন্টি সত্যিই জামাই আদর শুরু করে দিয়েছে।'
জয় হেসে বলল,
'মা এমনই। '
'হুম। কিন্তু তুই কোথায় গিয়েছিলি?'
'স্পৃহাকে আনতে। '
'স্পৃহা? '
'আরে স্পৃহা আমার খালামণির বড় মেয়ে। ওকে নিয়েই তো ফিরেছি। একটু আগেই হয়তো ভেতরে গেছে। তোর সাথে দেখা হয়নি? '
'না। '
'আচ্ছা ভেতরে আয়। রাতে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিব।'
'হুম। '
স্পৃহার সাথে জীবনের দেখা হয়েছে। কিন্তু ওরা দু'জন দু'জনকে চেনে না। নামও জানে না। তাই জীবন বলতে পারল না স্পৃহা সাথে যে ইতিমধ্যেই তার দেখা হয়েছে।
রাতে খাবার টেবিলে জীবনকে দেখে স্পৃহা মারিয়া দু'জনই বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলো। দু'জনই চোখ বড় করে জীবনের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনকে তারা এখানে এভাবে দেখবে তা কখনো আশা করেনি। স্পৃহা মারিয়া দু'জন নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে নিজেদেরকে সামলে নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। জীবন ওদের দেখে একদম স্বাভাবিক আছে। স্পৃহা জীবনের সোজাসুজি বসেছে। জয় সবার সাথে জীবনের পরিচয় করিয়ে দিলো। জীবন সবার সাথে কথা বলে এখন খাচ্ছে। স্পৃহা খাবার মাঝে বেশ কয়েকবার জীবনের দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু জীবন একবারও এদিক ওদিক তাকায় নি। সে মাথা নামিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। মারিয়া স্পৃহার কানের কাছে এসে বলল,
'স্পৃহা দেখ ছেলেটা এমন ভাব করছে যেন আজকের আগে আমাদেরকে কখনো দেখে নি।'
স্পৃহাও ফিসফিস করে বলল,
'আমিও তাই ভাবছি আপু। এতো স্বাভাবিক আছে কিকরে? কৌতুহল বশতও তো আমাদের দিকে একবার তাকাবে। '
'হুম। আমারও একই কথা।'
মেহেরুন বললেন,
'তুমিতো এর আগে কখনো আমাদের বাসায় আসো নি বাবা। জয়কে কতবার বলি। বন্ধুবান্ধবদের মাঝে মাঝে বাসায় নিয়ে আসবি। কিন্তু কে শুনে কার কথা?'
জয় বলল,
'মা জীবন কারোর বাসাতেই যায় না। কীভাবে নিয়ে আসবো বলো তো? আপুর বিয়ের দোহাই দিয়ে এবার নিয়ে আসলাম।'
জীবন জয়কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
'না আন্টি জয়ই আমাকে এতদিন নিয়ে আসেনি। আমি যদি জানতাম জয়ের মা আপনার মত মিষ্টি একজন মানুষ। তাহলে এতদিন ওর নিয়ে আসার অপেক্ষা না করে নিজেই চলে আসতাম।'
'এই তুই আমার সামনে আমার মা'কে পাম দিচ্ছিস?'
'মোটেও পাম না। মায়ের মন তো সবকিছু বুঝে। আন্টি আপনি বলুন তো আমি পাম দিচ্ছি নাকি সত্যি বলছি?'
মেহেরুন খুশিতে গদগদ করে বললেন,
'তুমি পাম দেওয়ার মত ছেলে না বাবা। জয় ফাজলামি করে বললেই তো হবে না। আমি জানি তুমি আমার সোনার টুকরো ছেলে।'
মারিয়া আর স্পৃহা খাওয়া রেখে হা করে ওদের সবার কান্ড দেখছে৷ অন্যদিন মারিয়ার কথার জন্য অন্য কেউ কথা বলার চান্স পায় না। আজ মারিয়াই কিছু বলার চান্স পাচ্ছে না। স্পৃহা সবকিছু দেখে কথা বলতেই ভুলে গেছে। জয় মারিয়া দিকে তাকিয়ে বলল,
'আপু আজ তুই মুখে তালা দিয়ে রেখেছিস কেন? আরে লজ্জা পাস না। আমার বন্ধু মানে তোর ছোট ভাই-ই হয়।'
মারিয়া অবশেষে মুখ খুললো। সে বলল,
'জানি। ও বয়সে আমার ছোট হবে। ওর সামনে লজ্জা কিসের? তোরা কথা বলছিলি তা-ই শুনছিলাম। '
জয় স্পৃহাকে দেখিয়ে বলল,
'জীবন দেখ এ হলো আমার ভেবলি। তোর সাথে তো পরিচয় করানো হয়নি। '
জীবন কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
'ভেবলি?'
জয় হেসে ফেলে বলল,
'আরে সেটা তো আমি ওকে ভালোবেসে ডাকি। বোকাসোকা মেয়ে তো। ওর নাম স্পৃহা। তোকে তো ওর কথা বলেছিলাম।'
'হ্যা।'
জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
'হ্যালো।'
স্পৃহা জীবনের হ্যালোর উত্তরে হাই, হ্যালো,সালাম কিচ্ছু দিতে না পেরে বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো। জয় ব্যস্ত হয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
'আস্তে খাবি তো ভেবলি। খাবার গলায় বাজিয়ে দিচ্ছিস কীভাবে? ধীরেসুস্থে খা।'
স্পৃহা পানি খেয়ে জীবনের দিকে একপলক তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। মেহেরুন বললেন,
'তুই ঠিক আছিস তো স্পৃহা? '
স্পৃহা মাথা নাড়ালো। জীবন মনে মনে স্পৃহা নামটা কয়েকবার আওড়াল,
'স্পৃহা,ভেবলি।
ভেবলি, স্পৃহা।
স্পৃহা,,,?'