ইমতিয়াজের কল পেয়ে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো তমা।মনের ভিতর কেমন এক অজানা ঝড় বয়ে গেছে।এ কেমন অনুভূতি যা ওকে ষোল বছর যাবৎ পাগল করে ছাড়ছে।ও বাহিরে গিয়ে ও নিজের মন টিকাতে পারছিলোনা। ওর গলা কাঁপছে চোখ ভারি হয়ে আসছিলো।কিন্তু বহু কষ্টে নিজের অনুভূতি ইমোশন কে এক পাশে রেখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মুখে কিছুটা দ্বিধান্বিত হাসি আর উৎসুক চোখজোড়া নিয়ে রিসিভ করলো তমা
"কি রে রোমিও !! বেঁচে আছিস তো?"
"মজা নিচ্ছিস না ?? আমার কষ্ট দেখে এখন হাসি পাচ্ছে? আচ্ছা নে ..দিন আমারও আসবে তখন সুদে আসলে মজা নিবো আমি ..দেখবো কোথায় পালিয়ে যাস..!!"
"আমি তো কখনোই পালাতে চাইনি রে.."
"মানে????????"
হুট্ করে ঘোরের বশে ফোনের ওপাশে প্রিয় কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে আর জানালা দিয়ে সন্ধ্যার ঝুম বৃষ্টির দিকে মোহগ্রস্থের মত তাকিয়ে থাকতে থাকে অমন বেফাঁস কথা কিভাবে যে বলে ফেলল তমা তা তার নিজের খেয়ালই ছিলনা ...এখন মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে চোখদুটো বন্ধ করে মুখ নিচু করে লাজুক স্বরে জবাব দিল সে
"না রে কিছু না ....এমনিই ...সরি মজা নেয়ার জন্য ..কষ্ট দিতে চাইনি আসলে ..আমার মনে হয়
i hurt your feelings !!"
"হ্যা তুই আমাকে হার্ট করছিস !!চরম লেভেলে হার্ট করলি তমা ..এটা এক্সপেক্ট করিনাই তোর কাছে ...কেমন ফ্রেন্ড তুই ..."
দুস্টু হাসি মুখে নিয়ে কাঁচের বাইরে তাকিয়ে এক হাত তাতে ভর দিয়ে অন্য হাতে ফোন কানে নিয়ে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ
তমা এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ..কি করবে এখন ....ইমতিয়াজের দুর্বল জায়গায় আঘাত করে ফেলেছে সে ...হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো
"দোস্ত আমি বুঝিনাই রে ..সরি বলছি আবারও ..রাগ করিস না প্লিজ ...কষ্ট পাস না দোহাই লাগি.. আমার উদ্দেশ্য এমন ছিলনা..তুই আমার থেকে কষ্ট পেলে আমি সহ্য করতে পারবনা!!!"
"কেন কেন কেন?? পারবি না কেন???কি লাগি আমি তোর?"
আবারো সেই দুস্টুমির হাসি মুখে নিয়ে তমাকে আরো দোটানায় ফেলতে চাইলো ইমতিয়াজ...যেন সে খুব মজার একটা খেলা পেয়েছে হঠাৎ করে ..যা নিয়ে খেলতে তার ভাল লাগছে ..তার এতোক্ষনের সব কষ্টগুলো ধুয়ে যাচ্ছে সে টেরও পাচ্ছে না ..ঠিক যেমন অনেকক্ষণ কান্না করার পর একটা বাচ্চা কোন এক্সাইটিং খেলনা পেলে কান্না ভুলে যায়, হাসিতে খুশিতে নেচে উঠে ...
খেলাটা জমে উঠলো যখন তমা আরো দিশেহারা কণ্ঠে বলে উঠলো
"দেখ আমি রিকোয়েস্ট করছি আর এমন করবো না তুই যা বলবি তাই করবো এখন যে শাস্তি দিবি আমি মেনে নিবো তবুও কষ্ট পাসনা" সে বুঝেই উঠতে পারলো না পাশের মানুষটা তার সাথে এক অদৃশ্য খেলায় মেতে উঠেছে
তমার এহেন কন্ঠ শুনে আবারো স্মৃতির পাতায় হারিয়ে গেলো ইমতিয়াজ .....ভার্সিটিতে থাকতে একবার তমা ওকে না জানিয়ে ঘুরতে চলে গিয়েছিল বাকি কিছু বন্ধুদের সাথে ...সেটা জানার পর এমনই রাগ করেছিল ইমতিয়াজ ..আর তার রাগ ভাঙাতে ঠিক একই ভাবে আকুতি জানিয়েছিল তমা ...এত বছর আগের স্মৃতি এখনো স্পষ্ট ভেসে উঠায় হাসি মাখা কন্ঠে বলল
"দেখি তোকে কি শাস্তি দেয়া যায়...আপাতত রাখছি...যাহ ভাগ..!"
বলেই ফোনটা কেটে ডেস্কের থেকে চাবিটা নিয়ে গাড়ির দিকে ছুটলো ইমতিয়াজ ঠিক একই ভাবে ..যেভাবে কয়দিন আগে রাতে ছুটে গিয়েছিল...পার্থক্য এতটুকুই যে সেদিন প্রচন্ড কষ্টে বুক ফাটা কান্না নিয়ে আশ্রয় খুঁজতে ছুটে গিয়েছিল আর আজ যাচ্ছে হাসিমুখে খুশি মনে সেই একই মানুষটাকে সারপ্রাইজ দিয়ে চমকে দিতে .......
নিয়তি এমনভাবেই হয়তো মানুষকে তার সৎ কর্মের যথাযথ প্রাপ্তি সময়মতো ফিরিয়ে দেয় যা সে টেরও পায়না...
ঝুম বৃষ্টিতে ড্রাইভিং করতে করতে হাসিমাখা মুখে ইমতিয়াজ এক হাত স্টিয়ারিংয়ে আরেক হাত গালে দিয়ে ভাবছিলো এই মুহূর্তে ওকে দেখে তমার ফেসটার এক্সপ্রেশন কি হবে ????? পাশে ভোঁ ভোঁ শব্দে ফোনটা বাজছে "toma calling " সেদিকে তাকিয়ে হাসি যেন থামছেই না তার
ওদিকে টেনশনে তমা কেঁদেই ফেলল ...ইমতিয়াজ ওকে ভুল বুঝেছে ...কি করবে এখন?? ফোনটাও ধরছেনা!!!পাজীটা গেল কই ..এই দেবদাসকে নিয়ে এখন টেনশনে তমা নিজেই পাগল বনে যাবে!!
আসলেই প্রেম ভালোবাসা কোন বয়স সময় স্থান কাল মেনে আসেনা...আসে মানুষ মেনে...ইমতিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটাকে মিউট করে পাশে রাখলো।তমার কল এসেই যাচ্ছে আর সেদিকে তাকিয়ে ইমতিয়াজ ঠোঁটজোড়াকে মৃদু প্রসারিত করে হাসছে।
...............................বাস চলছে আপন পথে।সৃষ্টি বারবার কথা বলার ছলে আদনানের গায়ের সাথে লাগছে।আদনান কিছুটা সরে আসছে তবে ঠোঁটে সৌজন্যতার হাসি হারিয়ে যায়নি।ওদিকে প্রিয়াশা বারবার আড়চোখে ওদের দুজনকে দেখছে।লোকটা এভাবে সৃষ্টির সাথে ঘেঁষছে তাতে ওর কেন খারাপ লাগছে?ওর খারাপ লাগার তো কথা নয়।আদনানের জন্য ওর হৃদয়ে তৈরি হওয়া অনুভূতি কখনো ওকে আদনানের হতে দেবেনা।আদনানকে ও নিজের করে নিতে পারবেনা।ওদের ধর্ম সমাজ কোনটাই ওদের পক্ষে থাকবেনা। শুধু শুধু দরদ বাড়িয়ে কি হবে?প্রিয়াশা জানালায় কপাল ঠেঁকিয়ে বসে থাকে। হঠাৎ মনে হলো পাশে কে যেন বসলো।প্রিয়াশা পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো আদনান ওর পাশে বসে এক হাত পৌছে দিয়েছে ওর পিছে।প্রিয়াশা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
''এখানে আসলেন কেন?"
আদনান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
''সিটটা কিনে রেখেছো বুঝি?"
প্রিয়াশা শক্ত গলায় বলল,
''কেন আপনার সৃষ্টির পাশে বসুননা?"
''ও থাকলে আসতাম নাকি?"
প্রিয়াশা ভেংচি কেঁটে বলল,
''সেটাইতো। ওর স্পর্শ ছাড়া থাকতে পারেন নাকি?"
আদনান কিছুটা মুড নিয়ে বলল,
''বেশ বুঝলে তো আমাকে।তা এটা জানো কি আমার সব মেয়েদের ছোঁয়া পেতে ভীষন ভালো লাগে।"
বলেই প্রিয়াশার নিজের উরুতে রাখা হাত আঁকড়ে ধরে নিজের উরুতে নিয়ে এসে বলল,
কিছু কিছু মানুষের কলিজা পুড়ে কয়েলা হয়ে যাচ্ছে।এই ঝুম বৃষ্টিতে ও নিভছেনা।কি করা যায়?"
প্রিয়াশা এখন নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছেনা। আদনানের হাত জোর করে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কন্ডাক্টরকে চিৎকার করে বলল,
''মামা গাড়ি থামান নামবো।"
বলেই প্রিয়াশা বেরিয়ে যেতে চায় আদনানের সামনে দিয়ে।আদনান আবার ও ওর হাত জাপটে ধরে বলল,
''চুপ করে বসুন।"
প্রিয়াশা আদনানের হাত ঝাড়ি দিয়ে ফেলে দৌড়ে নেমে গেলো বাস থেকে।আদনান কি বলবে বুঝতে পারছেনা। নিজেকে বেকুব মনে হচ্ছে ওর। এ কি করলো মেয়েটা?
...............................একটু আগে ঘটে যাওয়া কাহিনী ভাবতে ভাবতে সিএনজিতে উঠে বসে নিশাদ।আজ মেয়েটাকে দেখে ভীষন ভালো বোধ হচ্ছিলো ওর।মেয়েটাকে ধরে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,
''ভালবাসি ইদ্রি।তোমাকে আর হারাতে চাইনা আমার ডল।"
মৃদু হাসে নিশাদ।তারপর ফোনটা বের করে মেসেজ বক্সে গিয়ে টাইপ করতে শুরু করে,
আজ নিজেকে বিশ্ব বলদ মনে হচ্ছে। আর এই মুহূর্তে চরম বেহায়ার মতো একটা কাজ করতে মন চাইছে যা সেদিন নরম ঘাসের ওপর তোমায় জড়িয়ে করেছিলাম।ভীষন যন্ত্রনা হচ্ছে ইদ্রি।এই যন্ত্রনা টুকু তোমার সেই ফোল্ডারে লুকিয়ে রাখতে পারবে?আফটার অল সেটা তো আমারই ফোল্ডার.......তাইনা?"
ফোনটা পকেটে রেখে স্মীত হাসে নিশাদ।বুকের ভেতরটায় কেমন একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।ঘরে পৌছুতেই জুলেখা বানু গামছা নিয়ে দৌড়ে এসে ছেলের মাথা মুছে দেয়ার চেষ্টা করেন।না পেরে বলছিলেন,
''আব্বা তোরে ধইরতাম ফাইরতেছিনা।মাথা মুছ।"
নিশাদ মাথা নিচু করে বলল,
''আম্মা তুমি মুছে দাও। "
জুলেখা বানু মুছে দিতে থাকেন ছেলের ভিজা চপচপে মাথা।নিশাদ মাথা সোজা করে বলল,
''আম্মা ভাত বাড়ো আমি গোসল কইরা আসি।"
নিশাদ উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়।খাবার সেড়ে নিশাদ হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বাবার রুমে আসে। বাবার সাথে ওর কথা বলা জরুরি সাইমনের ব্যাপারে।ইকরাম রাহমান ছেলে কে দেখে কিছু ম্লান চেহারায় একটু নড়ে বসলো।নিশাদ পাশের চেয়ারে কাপ রেখে বাবার পাশে এসে বসে।তারপর বলতে লাগলো,
''আব্বা ঐ ছেলের সম্বন্ধে কিছু কথা ছিলো।"
''কোন ছেলের ব্যাপারে কিছু শুনতে চাইনা।"
নিশাদ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,
''শুনতে হইবো আব্বা। সাঁঝ তোমার মাইয়ার জীবনের ব্যাপার।"
ইকরাম রাহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঘুরিয়ে নেন।নিশাদ বলল,
''আব্বা ছেলেটার সম্পর্কে খবর নিয়েছিলাম দেখা ও করেছি।সে যথেষ্ঠ ভালো ভদ্র ছেলে।ইমানদার সে।বিক্রমপুর বাড়ি।তারওপর ছেলেরা দুই ভাই।ছেলে ছোট।নিজেদের ব্যাবসা আছে।ওর অফিসে খবর নিয়েছিলাম কোন বাজে রেকর্ড নাই।যথেষ্ট নম্র ভদ্র মনে হইছিলো।তুমি যদি বলো তাহলে আসতে বলবো।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো সাঁঝরে খুব ভালবাসে ছেলে।তোমার সাঁঝ অনেক ভালো থাকবে।"
নিশাদের মুখে ছেলের কথায় ইকরাম রাহমান কিছুটা নরম হন।বেশ ভালো লেগেছে ওনার।নিশাদ কথা শেষ করে খাট থেকে নেমে বাবার পায়ের কাছে বসে পড়ে।বাবার পা জড়িয়ে কেঁদে বলল,
''আব্বা মাফ করে দিয়েন আমারে।সেদিন আপনার সাথে এভাবে কথা বলা একদম উচিৎ ছিলো না আমার। কিন্তু আব্বা জানো সাঁঝ খুব বুদ্ধিমতি।যা করে বুঝেশুনে করে।তুমি ওরে ভুল বুইঝোনা প্লিজ।সাঁঝ কোন বাজে কিছু করেনাই।আব্বা আমার কষ্ট নিওনা। তাহলে আমার বদদোয়া লাগবে।আমি তো তোমার ছেলে আব্বা।তোমরা আব্বা আম্মারাই তো আমাদের সব কিছু।তোমরা জন্ম দিছিলা বলেই এই দুনিয়া দেখছি।আব্বা মাফ করে দিও আমারে।"
ইকরাম রাহমান ডুকরে কেঁদে উঠে নিশাদ কে বুকে জড়িয়ে বলেন,
''না আব্বা তুই আমারে মাফ কইরা দে।বাপ হইয়া তোগর জন্য কিছু করতে ফারলাম না।তুই বড় ভাইয়া বাফের কাম করছোস।অনেক অন্যায় করছিলাম তোগর লগে।আব্বারে মাফ কইরা দিস তুই।তোর লাইগা আমার পাঁচডা পুলাপাইন পড়াশুনা করতাছে।"
''আব্বা কইওনা। এগুলা তো আমার কলিজা তুমি জানোই।"
এদিকে নিশাদ আর বাবার কথোপকথনে জুলেখা বানু সাঁঝ আদনান কুঞ্জন হুমায়রা লাবনী সবাী চোখে পানি চলে এসেছে।জুলেখা বানু কাঁদতে কাঁদতে বারান্দায় গিয়ে বলতে থাকলেন,
''এই মুহূর্তে বড় মাইয়াডা থাকলে কতো ভালো হইতো।বেলা আম্মারে কই তুই?"
নিশাদ বাবার চোখ মুছে বলল,
''আব্বা সেদিন সাঁঝরে অনেক কথা বলছিলা।ও অনেক কান্না করছিলো।যাও কথা কও। "
ইকরাম রাহমান মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ান।বাবাকে আসতে দেখে সাঁঝ রুমে চলে গেলো।কেমন যেন লাগছে ওর।বাবার সামনে ও কিভাবে দাঁড়াবে।বাবার দিকে কিভাবে তাকাবে?ইকরাম রাহমান নিশাদ সহ সাঁঝের রুমে এসে দেখেন সাঁঝ দাঁড়িয়ে আলমারির সাথে ঘেঁষে।ইকরাম রাহমান মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগেন।বলতে লাগেন,
''আম্মা আমারে মাফ কইরা দে।আব্বারে মাফ কর।তোরে অনেক কথা কইছিলাম। তোর গায়ে হাত তুলছিলাম।আব্বারে মাফ কইরা দিস।"
বাবার কথায় সাঁঝ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।বাবার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল,
''এমন কইওনা আব্বা। তোমরা বাবা মা।তোমরা মারবা বকবা।অধিকার আছে। মাফ চাইওনা আব্বা।"
ইকরাম রাহমান সাঁঝকে বুকে জড়িয়ে নেন পরম যত্নে।
!!!!
খাওয়ার টেবিলে মায়ের সামনে বসে খাচ্ছিলো ইদ্রি।সৈয়দা বেগম চা পান করছেন মেয়ের সামনে বসে।ইদ্রি স্যান্ডুইচে কামড় দেয়ার মুহূর্তে ওর পাশে রাখা ফোনটা ভোঁতা শব্দে কেঁপে উঠে।সৈয়দা বেগম মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দেন।ইদ্রি ঢোক গিলে বলল,
''আম্মু কলেজ থেকে মেসেজ দেখি?"
সৈয়দা বেগম বললেন,
''দেখ।"
ইদ্রি ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করতেই যেন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে চাইলো।সেই সাথে হৃদয়ে সেই ছটফটানি যন্ত্রনার সঞ্চার হলো যেমনটা হচ্ছিলো যেদিন জড়িয়ে চুমু খেয়েছিলো নিশাদ।ইদ্রি চোখজোড়া বুজে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টায়।সৈয়দা বেগম মেয়েকে এক পলক দেখে বলল,
''সমস্যা কি তোর?এমন করিস কেন?"
ইদ্রি মায়ের ডাকে কিছুটা কেঁপে উঠে তারপর ফোনটা টেবিলে রেখে বলল,
''পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে তাই।"
সৈয়দা বেগম অস্ফুটশব্দ করে চায়ে মনযোগ দিলো।
......................তমার বাসার সামনে আসতেই কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায় ইমতিয়াজ।তমার বাসার দরজা একদম খোলা অবস্থায়।হৃদয় কেঁপে উঠে ওর।মজা নেয়াটা বেশি হয়ে গেলোনা তো?ইমতিয়াজ ছুটে গেলো ঘরের ভেতর। একা মেয়েটা বাসায় থাকে তার উপরে দরজাটা খোলা দেখে মুহূর্তের মধ্যে ওর কলিজাটা ধক করে উঠে ওর...কোন বিপদ হলোনা তো???...ঘরে প্রবেশ করে ডাইনিং স্পেসে কাউকে পেলোনা...ঢোক গিলে ভিতরের রুমে এগিয়ে গিয়ে ইমতিয়াজের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল......
ফ্লোরে দুই হাটুর উপরে দুই হাতে মুখ গুঁজে তমা কাঁদছে শব্দ করে...পাশের টেবিলে ডমিনোজ পিজা প্যাক করা অবস্থায় পরে আছে।অর্ডার করা খাবারের প্যাকেটটা র
খোলা হয়নি.তারমানে ডেলিভারি বয় খাবার দিতে এসেছিলো আর সে যাওয়ার পর তমা দরজাটাও লাগায়নি ...ওর পাশে এক হাটু গেড়ে বসে ওর কাঁধে হাত রেখে ইমতিয়াজ বলতে শুরু করলো,
"আমার মনে হচ্ছে জলদি তোর জন্য পাত্র দেখে তোর বিয়ে দিতে হবে...অন্তত রাতে তুই দরজা লাগাতে ভুলে গেলে সেটা লাগানোর জন্যে হলেও তোর পাশে কাউকে প্রয়োজন তমা..."
হুট করে চোখ তুলে তাকিয়ে এভাবে ইমতিয়াজকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তমা...বুঝে উঠতে সময় লাগলো ব্যাপারটা...মলিন কন্ঠে ইমতিয়াজ বললো
"তোকে সারপ্রাইজ দিতে তোর বাসায় চলে আসবো বলে তখন ফোন কেটে দিয়েছিলাম..কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমিই সারপ্রাইজড...কষ্ট আজকে তুই আমাকে না আমিই তোকে দিয়ে ফেললাম রে...সরি...."
এতটুক শুনে আর নিজেকে আটকাতে পারলোনা তমা..দুহাতে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে মুষলধারে অশ্রু বর্ষণ করতে লাগলো...আর ঠিক ওই মুহূর্তে ইমতিয়াজের মনে হলো এই মানুষটাকে ওর প্রয়োজন...অনেক প্রয়োজন... এই প্রয়োজনের পূর্নতা অন্য কাউকে দিয়ে পূরন হবেনা.. কিন্তু মুখে কিছু না বলে ওর থেকে সরে এসে পাশ থেকে খাবারের প্যাকেটটা খুলে একটুকরো পিৎজা তুলে ধরলো তমার মুখের সামনে ধরলো
"এখন যদি কান্না বন্ধ করে না খাস তো সত্যি রেগে যাবো চলেও যাবো..আর আসবোনা.."
"না না প্লিজ যাসনা আমি খাচ্ছি.."
লক্ষী মেয়ের মতো পুরো খাবারটা ওর হাতেই খেয়ে নিল তমা...ইমতিয়াজ আর কিছু না বললনা.শুধু ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলল
"আর যদি দরজা খোলা রেখে ব্যাক্কলের মতো বসে থাকিস তো আমি নিজে তোকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো বলে দিলাম..."
"নিয়ে যাবি.....সত্যি???"
"দরজা লাগাবি কি না বল?!!!!"
"আচ্ছা লাগাবো প্রমিজ...যা বাসায়.. অনেক রাত হলো..."
বাসায় ফিরতে ফিরতে ইমতিয়াজ ভাবছিলো তমাকে আসলেই ওর প্রয়োজন,,ওকে ভালো রাখার জন্য হলেও ওর তমাকে প্রয়োজন..কিন্তু সেই প্ৰয়োজনটার নাম কি আসলে????
....................রাত পেরিয়ে সকাল হলো।নিশাদের চোখে ঘুম আজকাল যেতে চায়না।বিছানা যেন আঁকড়ে ধরে ওকে।শরীরের আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় নিশাদ।নাস্তা সেড়ে লাবনী আর হুমায়রা কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।ওদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিয়ে অফিসে যাবে ও।বাদল মাহবুব অফিসে প্রবেশ করতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানায়।ওনি সবাই কে বসতে বলে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরে আসেন।চোখে পড়ে সবচেয়ে প্রিয় এমপ্লয়ি নিশাদের দিকে। ওকে সেই একই ডেস্কে দেখে বেশ অবাক ওনি।প্রায় একবছর হলো অবসর নিয়েছিলেন ওনি।ওনার পরিবর্তে এসেছিলো ওনার নিজের ছেলে বোরহান মাহবুব। ইমতিয়াজের পিঠে চাপড় মারলো ফারুজ খান।নিশাদ ওনার দিকে তাকাতেই ফারুজ খান বললেন,
''দেখোনা স্যার আসছে।"
তৎখনাৎ নিশাদ দাঁড়িয়ে যায়।বাদল মাহবুব ওকে বসতে বলে ছেলের কেবিনে চলে যান।নিশাদ বসে পড়ে। কথায় কথায় গায়ে হাত দেয়া ওর ভীষন অপছন্দের।
কিন্তু ওর চিন্তা হচ্ছিলো যেখানে বাদল স্যার ওকে ছেলের মতো আদর করতেন সেখানে ওর সাথে কথা বললেননা।
ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেলো।লাঞ্চ শেষে নিশাদ ডেস্কে ফিরে এলো।দুশত টাকা ছিলো সেটাও ফারুজ খানের জন্য শেষ হয়ে গেলো।ভীষন রাগ লাগলো ওর।তবু ও নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রেখে ডেস্কে আসতেই দেখলো বাদল স্যার হাতে একটা ফাইল নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে।ওনার সামনে সব এমপ্লয়ি দাঁড়িয়ে।নিশাদ গিয়ে দাঁড়ায় সেখানে।বাদল বললেন,
"'সবাই কি এখানে আছেন?"
সবাই হ্যা বলে জোরে।বাদল স্যার বললেন,
''এখানে আমার হাতে আপনাদের সবার পারফরম্যান্স শিট।আজ এখানে যার পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভালো তার প্রমোশন দিবো।আর বিগত সাতদিন যাবৎ ম্যানেজার ইব্রাহীম আহসান নেই আমাদের মাঝে।তিনি পরলোকগমন করেছেন।আজ এখানে পারফর্ম্যান্স অনুযায়ী ম্যানেজার পদে প্রমোট করবো আপনাদের যেকোন একজনকে।তাহলে আমি বলে ফেলি সবচেয়ে বেস্ট পারফরম্যান্স ছিলো মিঃ নিশাদ রাহমান।আর আজ থেকে ও আমাদের ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছেন।কংগ্র্যাটস নিশাদ।"
এতক্ষন নিশাদ স্তব্দ থাকলে ও আর থাকতে পারলোনা যখন মনে হলো বাদল ওকে জড়িয়ে ধরেন।বলছিলোন,
''গ্রেট জব নিশাদ।তোমার ওপর আমার ভরসা ছিলো।আমার নালায়েক ছেলেটা তোমাকে এতদিন পুরোনো পোস্টে রেখে ম্যানেজার খুঁজছিলো বাহির থেকে।কিন্তু নিজেদের অফিসে হীরার টুকরা আছে সেটাতো ওর চোখেই পড়লোনা।নিশাদ কিছু না বলে ওনার দুহাত জড়িয়ে বলল,
''কি বলে ধন্যবাদ দেবো স্যার বুঝতে পারছিনা।আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা স্যার।"
সেদিন বাদল মাহবুব নিজেই নিশাদ কে ম্যানেজারের কেবিনে নিয়ে যান।নিজ হাতে অগ্রিম বিশহাজার টাকা তুলে দেন ওর হাতে।কেবিনে গিয়েই নিশাদ বাদল মাহবুবকে বললেন,
''স্যার খবর টা আমার বাবাকে দিতে চাই।
''অবশ্যই।তোমার বাবা খুব খুশিই হবেন শুনে।কল দাও। "
কথাটা বলেই বাদল মাহবুব বেরিয়ে গেলেন।
নিশাদ ইকরাম রাহমানের নম্বর ডায়াল করে কানে চাঁপে।কয়েকবার রিং হতেই মোটা কন্ঠ শোনা যায় ইকরাম রাহমানের।
"কি রে কোন সমস্যা।।। কেবলই না গেলি অফিসে"
"বাবা!!!আমার ম্যানেজার পোস্টে প্রমোশন হয়েছে আজ এইমাত্র।।।। "
বলতে বলতে গলা ধরে আসলো নিশাদের।।।। এতটুক শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে চিৎকার করে উঠলেন ইকরাম সাহেব
"ও জুলেখা ও সাঁঝ, আদনান!!!!!!!!!!!!!!তাড়াতাড়ি আয় এদিকে।।। ভয়ানক কান্ড ঘটছে "
স্বামীর এহেন চিৎকার শুনে বিরক্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে খুঁন্তি হাতে আসলেন
"কি অইছে অমন চিল্লাও কেন?"
"আমাদের নিশাদের প্রমোশন হইছে জানো নি?? ম্যানেজার পোস্টে !!!"
হাত থেকে খুন্তি পরে গেল জুলেখার।।। শাড়ির আঁচল মুখে চেঁপে কেঁদে উঠলেন তিনি।।। এদিকে ততক্ষনে অতি আবেগে ফোনের "এন্ড কল" বাটনে চেপে কল কেটে দিয়েছেন জনাব ইকরাম।।।
ব্যাপারটা বুঝতে নিশাদের সময় লাগলো না।।।।আজ বাসায় গিয়ে কথা বলবে সবার সাথে।নিশাদ চেয়ারে বসে ইদ্রির নম্বরে মেসেজ দেয়,সেখানে লিখা ছিলো রাতে তোমার বাসার সামনে থাকবো।কল দিলে নিচে এসো প্লিজ।একটু দেখবো তোমায়। "
আজকের দিনটা একদমই অন্যরকম ছিলো নিশাদের জন্য।আর তাকে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে হবেনা।ভাবতে হবে না ও কি ইদ্রির আদৌ যোগ্য কিনা।সেদিনের মতো নিজের নতুন কাজের সমাপ্তি টেনে বেরিয়ে আসে নিশাদ।নিশাদ হাঁটতে হাঁটতে ইমতিয়াজের বাসার সামনে চলে আসে।কি মনে করে কল করে ইদ্রির নম্বরে।শোনা গেলো ইদ্রির ফিসফিসানি আওয়াজ।নিশাদ বলল,
''নিচে আসো ইদ্রি।"
''কেন?"
''প্লিজ।আমার বাসায় ফিরতে হবে।"
''ওকে।"
কিছুক্ষনের মাঝেই ইদ্রিকে নেমে আসতে দেখা গেলো।ইদ্রি ওর কাছে আসতেই নিশাদ হাঁটু ভেঙ্গে রাস্তায় বসে কাঁদতে লাগলো।ইদ্রি ভয় পেয়ে যায়।কি হলো লোকটার।ও বলতে লাগলো,
''আপনার জব চলে গেছে?ভয় পাবেননা আপনাকে ছেড়ে যাবোনা।খাওয়াতে না পারলেও কমপ্লেইন করবোনা।কাঁদবেননা।"
নিশাদ ইদ্রিকে টেনে ওর কপালের সাথে কপাল ঠেঁকিয়ে বলল,
''চাকরী যায়নি ডল। প্রমোশন হয়েছে ম্যানেজার পদে আজই।"
..............................অফিসে নিজের কেবিনে বসে সাইমন।সেদিন নিশাদ এর সাথে দেখা করার পর থেকে সাইমনের মনে হচ্ছে সাঝঁদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাবটা পাঠানো উচিত.. কিন্তু সমস্যা হলো পাঠাবে কাকে দিয়ে.. ভাই ভাবীকে এসবে জড়ানোর মানে হয়না, আছে একমাত্র ওর বৃদ্ধ দাদি.. বাবামা বিহীন সাইমনের দাদি ছাড়া আপন রক্তের আর কেউ নেই যে ওর লিগ্যাল গার্জিয়ানের ভূমিকা নিবে এই বিয়েতে...ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদির নাম্বার ডায়াল করলো সাইমন.. ওপাশে কল ধরেই বলে উঠলো ওর দাদি "কিরে আমার নাত বৌকে কবে পার্মানেন্টলি নিয়ে আসবি??"
"দাদি আমার খবর নিবানা আগে.. নাতবৌ এর আগে নাতি আসে তো?"
"না এখন আগে নাতবৌ তারপর নাতি... তুই লিস্টে পিছনে আছিস"
"তাই না??বেশ তাহলে তুমিই ব্যাবস্থা করো সব...ওদের বাসায় যাবে??আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে..?আসলে ওর ভাই আমার সাথে দেখা করেছে...উনি রাজি তাই আমি দেরি করতে চাচ্ছিনা.. কিন্তু ডিরেক্ট আমি ওদের বাসায় যেতে কেমন অস্বস্তি লাগছে আমার...বাবা মা তো একলা করে দিয়ে গেলো, ভাইয়া ভাবি বেঁচে থেকে পর হয়ে গেলো..আছো একমাত্র তুমি.....এটুক করবে আমার জন্যে?করলে আমি খুব নিশ্চিত শান্তি পেতাম..."
ফোনের ওপাশে নাতির এমন আকুতি শুনে মিসেস জাহানারা বেগমের অশ্রু গুলো বাঁধ মানতে চাইলোনা.. সেটা বুঝতে না দিয়ে তিনি বললেন
"যাব, সব করবো, এমনকি আংটি পড়ায় আসবো....তবে একটা শর্ত আছে...সেটা না মানলে কিচ্ছু করবো না"
সাইমন একটু ভয় পেয়ে গেলো...
"কি শর্ত দাদি..আমার সাধের মধ্যে হলে আমি অবশ্যই করবো.."
"বিয়ে করে সেন্টার থেকে সোজা আমার নাতবৌকে নিয়ে আমার বাসায় উঠবি.. এখানেই থাকবি বাকিটা জীবন.. যতদিন বেঁচে থাকবি ততদিন...বাকি পুরোটা জীবন..আমার নাতবৌকে নিয়ে তুই অন্যথায় পরে কষ্ট করবি একলা কোন সমস্যা হলে কাউকে বলতে পারবি না..এমন আমি বেঁচে থাকতে হতে দিতে পারবোনা....এখন বল শর্তে রাজি কি না.. নইলে আমি কিচ্ছু করবোনা বলে দিলাম..."
দাদির এমন মধুর শর্ত শুনে অমন শক্ত মনের সুপুরুষ সাইমনের চোখও ভিজে আসলো.. শুধু এতটুকুই বলতে পারলো
"আচ্ছা শর্তে আমি রাজি...আমি ওদের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাবো কবে দেখা করবে তুমি..."
"আমার কিন্তু অপেক্ষা সহ্য হচ্ছেনা কখন ওই মিষ্টি মেয়েটাকে আংটি পড়াবো....সেই ডায়মন্ডের আংটি যা তোর মাকেও পড়িয়েছিলাম..আমাদের বংশের ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে এই আংটিতে...আমাকে দেয়া কথা অমান্য করে তোকে আমার কাছে আমানত করে চলে গেছে পাজি আমার ছেলে আর বৌমা....যাই হোক আমাকে জানাস কবে কি করতে হবে.."
অশ্রুভেজা মুখমন্ডল নিয়ে শান্তস্বরে উত্তর দিলো সাইমন
"জানাবো...রাখছি দাদি.."
বলেই ফোনটা কেটে ডুকরে কেদের উঠলো সে..পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদেনা..কিন্তু তারাও মানুষ.. তাদেরও অনুভূতি আছে...আর সবসময় সেটা লুকানো যায়না....সময়ের সাথে সাথে তা খুশির রুপ ধারন করে বেরিয়ে আসে যার ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না।