ইষৎ অন্ধকারে বেলাকে দেখেই চলেছে বিভান।কেমন এক মোহ কাজ করছে ওর ভেতর এক অদ্ভুত মোহনীয়তা।প্রচন্ড বাতাস বইছে। বেলা নিজের লেহেঙ্গাটাকে ঠিক রাখতে পারছেনা।কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম দেখা যাচ্ছে।সেদিকে বিভানের নজর নেই। বেলাকে দেখে যাচ্ছে বিভান।বেলা কিছু বলছেনা।সরতে ও পারছেনা।বিভান ওকে দেখে তারপর সামনে আগাতে শুরু করলে বেলা বলল,
''অনুষ্ঠান শেষ আপনাদের ফিরে যাওয়া উচিৎ।"
কথাটা বলেই বেলা চুপ।হঠাৎ করে কি বলল ও?এখন ও খাওয়া হয়নি।বিভান থেমে বলল,
''আমার মনে হচ্ছে ডিনার করাবে ওনারা।একচুয়ালি কিরন কে খুঁজছিলাম।পাচ্ছিনা।"
''কিরন ভাই কে তো ওখানে দেখলাম বিন্তীর সাথে।"
''ওহ।আই থিংক দে নিড প্রাইভেসি।"
বেলা বুঝতে পারলো কিরন আর বিন্তীর রিলেশনের কথা বিভান জানে।চুপ করে রইলো।বিভান বলল,
''একচুয়ালি কিছু বুঝতে পারছিনা এখানকার।সত্যি বলতে নার্ভাস আমি।"
বেলা হেসে দেয়।বিভান বেলাকে হাসতে দেখছে সামনাসামনি।হাসিটা ভীষন মায়াভরা।হাসতে হাসতে ঠোঁটে হাত রেখে হাসি থামানোর চেষ্টা করে বেলা বলল,
''নার্ভাস কেন?আমি পজেসড বলে?"
''না আসলে তা না।এখানকার কালচার সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই।আর ভাষার কথা বাদই দিলাম।নিজেকে পুতুল মনে হচ্ছে।কোথাও গিয়ে বসে থাকো কারোর সাথে ইচ্ছে হলে কথা বলা যায়না।নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।"
বেলার বেশ মায়া লাগলো।আসলেই নিজের দেশেই বড় শান্তি লাগে।নিজের মন মতো কথা বলা যায়।যেখানে সেখানে যাওয়া যায়।কিন্তু ওনার অবস্থা একদম বন্দী প্রায়।বেলা কে চুপ দেখে বিভান বলল,
''বিরক্ত হচ্ছেন মনে হয়।"
নিশাদ সোফায় বসে আছে।গাযের সাদা পাঞ্জাবীটা ভিজে গেছে ঘামে।বাহিরে বাতাস হচ্ছে।ঘরে ঋতু ও আদনান আর সাঁঝ আছে।আর বাকিরা পিছনের ঘরে।বেলাকে না পেয়ে নিশাদের চিন্তা লাগতে শুরু করে। বাহিরে দমকা হাওয়া বইছে বৃষ্টি হতে পারে আপা কই গেলো?নিশাদ সাঁঝের সাথে বেলাকে দেখে ছিলো।তাই জিজ্ঞেস করে বসলো,
''আপা কই সাঁঝ?"
''ভাই দেখি নাই তো।আমাকে ঘরে পাঠিয়ে বলল বিন্তী আপার সাথে কথা বলতে চলে গেলো।"
হঠাৎ আদনান বলল,
''কিন্তু বিন্তী আপুকে তো কিরন ভাইয়ের সাথে দেখলাম।"
বোনের কথা শুনে একদম চুপসে গেলো ঋতু।নিশাদ রেগে বলল,
''তোরা বসে আছিস কেন?আপা কই?"
সাঁঝ বলল,
''ভাই হয়ত পিছনের ঘরে।আমি গিয়ে দেখে আসি।"
''নাহ বাহিরে যেতে হবেনা আমিই যাচ্ছি।"
নিশাদ উঠে দাঁড়িয়ে বাহিরে আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।ঋতু পিছন থেকে বলল,
''ছাতা দেই ভাইয়া?"
''দাও।"
ভিতর থেকে ছাতা নিতে চলে গেলো ঋতু।এদিকে বৃষ্টি দেখে বেলা পাশের একটা গাছের নিচে দাঁড়ায়।বিভান ও ওর থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়।বেলা বৃষ্টি দেখে বলল,
''বৃষ্টি তো অনেক হচ্ছে।কমতে সময় লাগবে।এভাবে কতক্ষন অপেক্ষা করবো?"
বিভান বলল,
''আমরা ঘরে চলে যাই তাহলে।"
''জি চলুন।"
বেলা মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়। দুজনে রুত ঘরের দিকে এগুতে শুরু করে।ঘরের কাছা কাছি আসতেই ছাতা হাতে নিশাদ কে দেখতে পায় বেলা। বোনকে ভিজতে দেখে নিশাদ এগিয়ে এলো ছাতা নিয়ে। বেলার মাথার ওপর ছাতা দেয়ার সময় বিভান কে দেখতে পায় পিছন থেকে আসছে।নিশাদ বেলার হাত ধরে বলল,
''চল আপা।"
''হুম।"
বেলার হাত ধরে দ্রুত ঘরে নিয়ে এলো নিশাদ।বেলার চুল মুছার জন্য ঋতু তোয়ালে দিলো।বেলা চুল মুছে নিচ্ছে।বিভান ও ঘরে এসে ঢুকলো।ঋতু আরেকটা গামছা এনে দেয় বিভানকে।বেলাকে খোলা ভেজা চুলে দেখতে পায় বিভান।আড়চোখে দেখছে ওকে।কি করবে ও?কেন এভাবে বিমোহিত হয়ে মেয়েটাকে দেখছে ও?কি হয়েছে ওর?বেলা সুন্দর তবে এতো আহামরি ও নয়।বিভান গামছাটা ঋতুকে দিয়ে এককোনায় বসে পড়লো।বেলা রুমে চলে গেলো চুল মুছতে।বিভানকে অসহায় দেখাচ্ছে।বেচারা চুপ করে আছে।কথাও বলতে পারছেনা।কারোর কথা ও ঠিক মতো বুঝতে পারেনা।হঠাৎ খেয়াল করলো নিশাদ ওকে দেখছে।বিভান হালকা হেসে তাকায় নিশাদের দিকে কিন্তু নিশাদ হাসছেনা।বিভান মোনাইলে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।বৃষ্টি থামতেই খাবার ঘরে নিয়ে এলো বাবুর্চিরা।সবাই খাবার সেড়ে নেয়।বিভান কিরন কে গুঁতো দিয়ে রেগে বলল,
''এতো প্রেম করার কি হলো?সারারাত ফিসফিস করে কথা বলে হয়না?এখানে এসে ও প্রেম করতে হয়?"
''শশশ আস্তে। ধরিয়ে দেবে নাকি?কথা বলছিলাম আমরা।এতো রেগে আছো কেন?কি হয়েছে?"
''আমার ভালো লাগছেনা।ঘরে চলো।"
''হ্যা যাবো। তবে রাস্তায় কাঁদা কিন্তু।গাড়ি পর্যন্ত যেতে পারবে তো?"
''ফাজলামো করছো মনে হচ্ছে?কি ইচ্ছে হচ্ছে তোমার?থেকে যাবে এখানে?সারারাত লাইভ প্রেম করবে নাকি?"
''আরে নাহ।বলছিলাম সেদিন মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলে।মুখের ক্ষত এখন ও ঠিক হয়নি।আবার ও পড়তে পারো।"
বিভান রেগে কিরনের দিকে দু কদম এগিয়ে বলল,
''এর মানে এই না যে সারাক্ষন পড়তে থাকবো।তুমি চলো ঘরে।"
কিরন কিছুটা ভয় পেয়ে বলল,
''যাচ্ছি যাচ্ছি চলো।"
বিভান আর কিরন সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়ে।বেরুনোর সময় বেলার দিকে এক পলক তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।বেলা বিভানের তাকানোর মানে বুঝতে পারেনা।ওর মনে হতে থাকে বিভানের অভিমান হয়েছে সেটা আর কারো না বেলার ওপর।
কাল মেহেদী দেয়া হবে রুমকির হাতে।বিন্তী ও অনেক গুলো মেহেদী এনে রেখেছে।পরদিন বেলার মন কেমন যেন করতে থাকে।কেমন চুপ হয়ে গেছে। বিন্তী টেনে বেলাকে বসিয়ে মেহেদী পরাতে শুরু করে।সাঁঝ আর ঋতু নিজেদের হাতে মেহেদী পরে নিচ্ছে।বিন্তী বলল,
''জানিস কাল কিরন আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছিলো।"
বেলা হেসে বলল,
''কি দিয়ে প্রপোজ করলো?"
বিন্তী হাতের নতুন আংটিটা দেখায় বেলাকে।বেলা বলল,
''সুন্দর তো।"
''হুম।বলল ওর বাবা মা কে নিয়ে আসবে বাসায় ভাইয়ার বিয়ের পর।"
''শুভ কামনা। "
________________________________________
বেলা সারাটাদিন কেমন একটা অস্থিরতার মধ্যে কাঁটালো।বিয়ের দিন বিভানকে আসতে দেখা গেলো।মেরুন রং এর ব্লেজার পরে আছে।চুল করে সুন্দর করে আঁচড়ানো।বেলা এক মুহূর্তের জন্য বিভানকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো।রংটা মানিয়েছে লোকটাকে।বেলাকে দেখে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে বিভান তারপর সরে গেলো অন্যদিকে।বেলা একটু চিনৃতায় পড়ে গেলো।এমন করছে কেন লোকটা?আগে দেখলে হাসতো আর আজ কেমন সরে সরে আছে।বেলা ভাবলো সে কথা বলুক আর না বলুক ওর সমস্যা হওয়ার কথা নয়।আজ বেলা রানী গোলাপী বর্নের শাড়ী পরেছে। লম্বা চুল গুলো কে ছেড়ে দিয়েছে পিঠের ওপর।সামনে একটু পেঁচিয়ে বাঁধা।কাজটা করেছে বিন্তী।চুল ভালো বাঁধতে পারে মেয়েটা।সাঁঝ লাল শাড়ী পরেছে।চুল গুলো খোঁপা করা ওর।বিভান দূর থেকে বেলাকে দেখছে।তবে মেয়েটার ওপর অজানা অভিমান কাজ করছে ওর ভিতর।কোন কারন নেই অভিমানের। কিরন খেয়াল করেছে বিভানকে হলুদের পর থেকে।কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।কিরনের সাথে ও ঠিকমতো কথা বলছেনা।কিরন বারবার জিজ্ঞেস করে ও উত্তর পায়নি।
খাবারের সময়ে বেলা আর বিভান মুখো মুখি হলো।বেলা খাবার বাড়ার সময় কিছু বলতে চেয়ে ও বলেনি।কি বলবে ও?কিছু বলার আছে?লোকটাকে চেনে না ও।কয়েকদিনের আলাপ মাত্র।দুজনেই মেহমান।কয়েকদিন পর ওরা যে যার ঘরে ফিরে যাবে।তাহলে ও কেন এতো ভাবছে।লোকটার হয়ত ওর সাথে আর কথা বলতে চাইছেনা।বেলা খাবার নিয়েই চলে গেলো।বিভান পিছনে ফিরে বেলার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে।
বিয়ে হয়ে যায় রবিন আর রুমকির।সবাই মজা করছে রবিন আর রুমকি কে পাশে বসিয়ে।সেখানে সাঁঝ ঋতু,কিরন বিন্তী, বেলা সবাই আছে শুধু বিভান নেই।বেলা হঠাৎ উঠে গেলো।পানির জন্য ডাইনিং রুমে এসে দেখলো বারান্দায় কারো ছায়া।বেলা বুঝতে পারলো বিভান হতে পারে।কারন সবাই বাহিরে আর আদনান কিংবা নিশাদের মতো ও লাগছে না ছায়টাকে।বিভান বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।কয়েকটাদিন ধরে মেয়েটাকে দেখছে। আর দেখার সময় ও যেন নিজ দুনিয়ায় থাকেনা।কি হচ্ছে ওর সাথে?বেলার নিরবতা কেন ওকে অস্থির করে তোলে?কেন ইচ্ছে হয় পাশাপাশি বসে দুটো কথা বলতে? এর কোন উত্তর বিভানের জানা নেই।পাগল হয়ে যাবে ও এমনটা চলতে থাকলে।এদিকে বিভানের ছায়া নড়ে উঠতে দেখে বেলা সরে এলো।আসরে বসে পড়লো। বেশ রাত করে কিরন আর বিভান চলে যায় গেস্ট হাউজে।নিশাদ বেলাকে এসে জিজ্ঞাসা করলো,
''ট্রেনের টিকিট বুকিং দিবো আপা?"
''হুম।যত জলদিই সম্ভব যেতে চাই আমি।"
''ঠিক আছিস তুই?"
''হুম।নাচের ক্লাশ কোচিং এ ক্লাশ পড়ে আছে।সামনে আমার পরীক্ষা।এমনিতেই অনেকদিন পেরিয়ে গেলো এখানে।তোর ও তো ভার্সিটি আছে।আদনানের ও আছে।"
''হুম আচ্ছা দেখি কখনকার টিকিট পাওয়া যায়?"
নিশাদ বেরিয়ে গেলো বেলার রুম থেকে।এদিকে গেস্ট হাউজে পৌছে বিভান একা বসে রইলো ছাদ টায়।কিরন এসে বিভানের সামনে বসলো।তারপর বেশ জোর দিয়ে বলল,
''কি হয়েছে বলো আমাকে?"
''আমি একা থাকতে চাই।প্লিজ যাও এখান থেকে।
''তিনটা দিন যাবৎ তো একাই আছো।না ঠিক মতো কথা বলছো না খাচ্ছো না কিছু করছো।সব ঠিক আছে তো?"
''সবই ঠিক আছে।"
কিরন মানতে পারেনা।কারন বিভানের এ আচরন নতুন ওর কাছে।কিছু তো হয়েছে যা বিভান ওকে বলছেনা।কিরন আবার ও জিজ্ঞেস করলো,
''কি হয়েছে বলো আমাকে।"
''নিজেই জানিনা কি বলবো তোমাকে?"
''ওকে।তোমাকে জ্বীন ধরেছে।হুজুর ডাকতে হবে।"
মুখ থেকে সিগারেট সরিয়ে বিভান রেগে কিরনের দিকে তাকায়।তারপর মোটা গলায় বলল,
''পাগল হয়ে গেছো?তেমন কিছুই না আমি দ্রুত দেশে ফিরতে চাইছি।"
বিভানের দেশে ফিরার কথায় অবাক কিরন।কিছুদিন আগে ও বলেছিলো লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছে।বেশ কয়দিন থাকবে।কিরন বলল,
''বলেছিলে বেড়াবে অনেকদিন।আর এখন যাওয়ার কথা বলছো।ঠিক আছে সব?"
''কিছু হয়নি বললাম তো।কাজ পড়ে আছে।"
''তুমি না লম্বা ঋুটি নিয়ে এসেছো?"
''আমার থিসিস বাকি সেটা তুমি জানো।তারপর ও জিজ্ঞেস করছো কেন?"
''হুম।কিছু হয়েছে তোমার সেটা বুঝতে পারছি।"
বিভান নিঃশব্দে সিগারেটে লম্বা টান দিতে থাকে।
!!!!
রবিন আর রুমকির বিয়ের পুরো একদিন হয়ে গেলো।আজ রাফিজ সাহেবের ঘরে ভোজ হবে।সকাল থেকে রান্না বান্না চলছে।রুমকির বাবা মা আরো অনেক আত্মীয় স্বজন ও আসবে।সকাল থেকেই ঘর গুছানোর কাজ ও চলছে।রুমকি একটু আধটু কাজ করছে।বেলা আর সাঁঝ ও বসে নেই।ওরা টুকটাক কাজ গুলো করে নিলো।ফারজানা সবাই কে গোসলে পাঠিয়ে নিজে আরো কিছু কাজ করতে থাকে।তারপর গোসল সেড়ে নেন।নিশাদ ঘুম থেকে কেবল উঠলো।চোখ এখন ও বোজা।ঘুম থেকে উঠতেই নাকের সামনে গরম চায়ের ঘ্রান পেয়ে ঘুমন্ত কন্ঠে বলল,
''আপা চা ও রেডি করে ফেলেছিস?"
বেলা চায়ের কাপটা রেখে বলল,
''হুম।জানিস বারোটা বাজে।একটু পর মেহমান আসবে।তুই এখনো ঘুমোচ্ছিস?"
চোখ খুলে নিশাদ।বোনের বকা শুনে চোখ জোড়া আধো খুলে বলল,
''আদনান কই?"
''রবিন নিয়ে গেছে পুকুরে গোসল করতে।তোকে ও ডেকেছিলো।"
''ওহ।"
নিশাদ উঠে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
''আব্বা আম্মা কেউ কল দিয়েছিলো?"
''না কেন?"
''এমনি।ট্রেনের টিকিটের জন্য বুকিং দিয়েছিলাম।এখনো তো খবর এলো না।"
''আসবে।তুই ফ্রেশ হয়ে নেয়।নাস্তা দিচ্ছি।"
বলে উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো বেলা।নিশাদ চায়ের কাপটা রেখে বোনের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো।বেশ শীত পড়ছে আজকাল। আদনান পুকুর থেকে উঠে কাঁপতে শুরু করলো।রবিন ডুব দিয়ে আবার ও ভুঁশ করে উঠে। আদনান বলল,
''আপনার শীত করছেনা?"
''অতোটা না।তোমার কি খুব শীত করছে?"
''তাতো করছেই। তবে হাঁটতে শুরু করলো গরম লাগতে শুরু করবে।"
রবিন পানি তে থেকে ভারি আওয়াজে বলল,
''একটা কাজ করো।"
''কি?"
''তোমার তো খুব শীত করছে তাই না?"
''তা তো করছেই।"
''এখান থেকে ঐ দূরে দেখো গরুর দড়ি বাঁধা তাল গাছের সাথে ওখানে দৌড়ে যাও আবার দৌড়ে এখানে আসবে।"
আদনান হেসে বলল,
''পাগল নাকি?মানুষ কি মনে করবে?ওখানে দৌড় দিবো কেন?ঘরে যেতে যেতেই গরম লাগতে শুরু করবে।"
''তোমাকে তো ভালো বুদ্ধিই দিয়েছিলাম।যাইহোক আমি আবার ও সাঁতরে নেই তুমি বসো।"
বলে স্বজোরে সাঁতরে একটু দূরে চলে যায় রবিন।নিশাদের নাস্তা রেডি করে তিনজনের জামা নিয়ে বাথরুমে চলে যায় বেলা।কাপড় গুলো ভিজিয়ে সেখানে সাবান ডলতে শুরু করে।সাঁঝ ও বেলার পিছে এসে দাঁড়ায়।বেলাকে কাপড় ধুতে দেখে সাঁঝ বলল,
''আপা আমার কাপড় ধুবো আমি তুই রাখ এগুলো।"
''আরে নাহ করছি আমি।ঋতুর সাথে গিয়ে কথা বল।"
''আমি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।ধুতাম পরে।
''হয়েছেরে বাবা।যা তুই।দেখ গিয়ে নিশাদের লাগবে নাকি কিছু।"
''ওকে।"
সাঁঝ চলে যায় সেখান থেকে।বেলা কাপড় ধুতে থাকে।হঠাৎ বিভান নামটা ওর মনের মাঝে চেঁপে বসে।লোকটা কেন এভাবে এড়িয়ে চলল রবিন ভাইয়ের বিয়ের দিন।যদি এতো এড়িয়েই চলবে তাহলে এই তের দিন ওকে কেনোই বা দেখতো কেনই বা কথা বলতে চাইতো।বুঝতে পারছেনা বেলা আর এটা ও বুঝতে পারছেনা লোকটাকে নিয়ে কেন ভাবছে ও?কাপড় ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সেগুলোর পানি ঝেড়ে বেরিয়ে আসে।কাপড় গুলো রোদে দিয়ে কাপড় পাল্টে একটা হলুদ স্যালোয়ার কামিজ পরে নিলো।আর সেই সাথে চোখে কাজল আর কিছু না।চুল আঁচড়ে বেরিয়ে আসে বেলা।গেস্ট আসতে শুরু করেছে।বেলা সবাই কে হাসি মুখে সালাম জানিয়ে কথা বলছে।এরই মাঝে কিরন কে আসতে দেখা গেলো।তবে একা।বিন্তী দৌড়ে গেলে ও কাছে ঘেষেনি।কিরনের সাথে বিভানকে না পেয়ে রবিন বলল,
''বিভান ভাই কই?"
''আরে আসবেই না।কতো বললাম আসলো না।"
রবিন কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
''আমাদের কারো কথায় কষ্ট পেয়েছে?"
''বুঝতে পারছিনা।বলল মাথা ব্যাথা।"
''ওনার এখানকার সিম আছে?"
''হ্যা আছে গ্রামীন সিম।"
''ওকে।নম্বর দে কল দিচ্ছি।"
কিরন বিভান নম্বর দিতেই রবিন বিভানের নম্বরে কল করে।কিন্তু কল রিসিভ হয়না।কিরন বলল,
''ফোনের কাছে নেই হয়ত।আবার কল দে।"
''ওকে।"
বিভান বারবার কল দেয়ার এক পর্যায়ে ফোন রিসিভ হয়।অপরপাশ থেকে বিভান কিছু বলতে যাবে রবিন বলল,
''আপনি কই?"
''বাসায়।একটু ঘুমোবো।"
''ঘুমাবেন মানে?আজকে দাওয়াত আপনাদের।কিরন যাচ্ছে আপনি আসেন।"
''না রবিন এমন করোনা।ভাল লাগছেনা।আসতাম কিন্তু সকাল থেকেই মাথা ব্যাথা করছে।"
''এখানে এসে শুয়ে থাকবেন।কেউ বিরক্ত করবে না আপনাকে।"
''আরে নাহ কি যে বলো না।সত্যি আমি আসতে পারবোনা।"
''আপনি তাহলে আসবেননা।কিরনের কাছে খাবার পাঠিয়ে দেবো খেয়ে নিয়েন।"
''ওকে।"
রবিন ফোন রেখে বলল,
''ত্যাড়া মানুষ!! আসবেনা।"
''হুম।"
বিভান আসবেনা শুনে নিশাদ মনে মনে শান্তি পেলে ও বলল,
''আসতে পারতো।এখানে এসে রেস্ট করতো।"
''এখন আসবেননা।কি আর করা?"
বেলার কানে কথাটা যায়।বিভান আসছেননা।কি নিয়ে রাগ করে আছে লোকটা?আসলেই রাগ নাকি বেলার মনের ভুল সম্পূর্নটুকুই।বেলা স্বাভাবিক থাকতে চাইলো সারাটাক্ষন কিন্তু কেমন অস্থির হয়ে আছে।গত তিনদিন যাবৎ যতোটা অস্থির ছিলো আজ আরো বেশি।ভালো লাগেনা বেলার। কিছু বুঝতে পারছেনা ও।এমন অস্থিরতার কারন কি?সে কি অজানা কোন মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে না তো?
________________________________________
ল্যাপটপে কাজ করতে চাইলো বিভান।তবে কাজে মন বসছেনা।এমনটা না যে মাথা ব্যাথা করছেনা।ব্যাথা করছে তবে এতো সাংঘাতিক নয় যে কোথা ও যেতে পারবেনা।কারন ও যেতে চাইছিলো না।কেন চাইছিলো না সেটা অজানা নয়।কারন বেলাকে দেখতে হবে।সেটা চায়না।কারন এই মায়া সাময়িকের।বাড়িয়ে কি লাভ??মেয়েটা বুঝবেনা ওর মনের খবর বুঝবেনা ওর মনের ব্যাথা।সেই ট্রেনে যখন দেখেছিলো সেদিনই কি মোহে পড়ে যায়নি?সেদিন থেকেই তো কেমন ঘোরে চলে যায়নি?এরপর এতোটা দিন তাকে সামনে দেখে মনের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি হয়নি? হয়েছিলো তবে মনের গহীনে চাঁপা দিয়ে রেখেছিলো বিভান।প্রকাশ করতে চায়না।কারন জানে সাময়িক মায়া এই অনুভূতি আবেগ মাত্র যা ভারতে পৌছানো মাত্র শেষ হয়ে যাবে।কাজ করতে পারছেনা বিভান। ফোন বের করে বেলার নাচের ভিডিও টা বের করে।হলুদের দিন বিভানের ফোনে কিরন নাচের ভিডিও করেছিলো।সেটা থেকে গেছে।নাচটাকে বারবার ঘুরিয়ে দেখতে থাকে বিভান।এভাবে দেখে তাকে দেখার লোভ বেড়ে যাচ্ছে।ফোনটার সুইচ অফ করে ল্যাপটপ অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে বিভান।চোখ বন্ধ করতেই ঘুম নেমে আসে বিভানের চোখজোড়ায়।
অপরদিকে গেস্টরা চলে গেলো।গেলো কিরন ও বিভানের খাবার নিয়ে।রুমকি কে ঘিরে বসে আছে সাঁঝ, বেলা,আদনান, নিশাদ আর রবিন।ট্রেনের টিকিট কনফার্ম হয়নি।নিশাদ আবার ও খোঁজ নিলো ট্রেনের।নিশাদকে অস্থির হতে দেখে রবিন বলল,
''শুধু শুধু চিন্তা করছো ট্রেন পাবেনা এখন।ঢাকাতে গেছে যাত্রী নিয়ে।দুদিন তিনদিন অপেক্ষা করো।"
''আসলে সবার ক্লাশ আছে।সাঁঝের সামনে ফাইনাল পরীক্ষা।"
''হয়ে যাবে সব।চিন্তা করোনা।"
রুমকি সবার কথা শুনে বলল,
''দেখো এখন যেহেতু কেউ যাচ্ছে না তাহলে কোথাও ঘুরে আসতে পারি আমরা। "
''কই যাবে তুমি?"
জানতে চায় রবিন।রুমকি বলল,
''সিলেটের ভীষন সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে।কোথা ও যাওয়া উচিৎ সবার।"
আদনান রুমকির কথা শুনে নিশাদকে বলল,
''ভাইয়া আমার ফ্রেন্ড ইলিয়াস ওর আব্বু আম্মুকে নিয়ে জাফলং গিয়েছিলো আমরা ও যেতে পারি।"
রবিন বলল,
''ঝড়নার কাছে যাওয়া যায়না।দূর থেকে দেখতে হয়।"
মাথা নাড়ে আদনান।তারপর বলল,
''মাসখানেক হলো সিড়ি বানানো হয়েছে।স্পিড বোটে ও কিছু রাস্তা যেতে হয়।"
''ওহ তাই নাকি জানতাম না।"
''ওহ।"
রুমকি উত্তেজিত হয়ে রবিনকে বলল,
''সবাই যেহেতু আছে চলো না যাই আমরা।"
রবিন বলল,
''আব্বা আম্মা রাজি হবে নাকি?পাহাড়ে সিড়ি বানানো হয়েছে।বয়স হয়েছে ওনাদের।"
''হুম তাও ঠিক।"
বিন্তী বলল,
''আব্বা আম্মাকে বলে আসি।কি বলে ওনারা?তারপর নাহলে আমরা গেলাম।"
বিন্তী ফারজানার কাছে জাফলং এর কথা বলতেই দুজনে নাকোচ করে দিলেন।রাফিজ সাহেব চোখে চশমা জড়িয়ে বললেন,
''তোরা গিয়ে ঘুরে আয়।ভালো লাগবে।বৌ ও আছে।"
বিন্তী খুশি মনে ফিরে আসে।রুমকি ও বেশ খুশি।গাড়ির জন্য কল করা হয়েছে।মাইক্রো লাগবে।কিরনকে ও বলা হয়েছে।ও জানিয়েছে আসবে বিভানকে নিয়ে।সেরাতে ঘুমিয়ে পড়লো সবাই।সকালে বের হবে সবাই।
সকালে,
বিভান একদম না করে দিয়ে বলল,
''আমি যেতে পারবোনা কিরন।তোমরা যাও।"
বিভানের না করায় বেশ রেগে গেলো কিরন।তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
''পেয়েছ টা কি?কাল থেকে কোথাও বের হচ্ছো না?এখানে এসেছো ঘুরে দেখবে।আবার আসবে যে সেটার ও তো নিশ্চয়তা নেই।তুমি আসবে এটা ফাইনাল।"
বিভান নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
''কিরন বুঝতে চেষ্টা করো।"
''দেখো কিছু বুঝতে চাইনা।তুমি যাচ্ছো নয়তো আমি ও যাবোনা।তখন সবাই কি মনে করবে বলো।"
বিভান সোফায় বসে পড়লো দাঁড়ানো থেকে তারপর অস্থিরতা ভরা কন্ঠে বলল,
''দেখো আমি পারবো না যেতে।"
বিভানের পাশে বসলো কিরন তারপর বলল,
''কি হয়েছে বলবে?কেন এমন করছো?ওনারা মনে করছেন তুমি ওনাদের কোন কথায় কষ্ট পেয়েছো নাকি?"
''আরে না কি বলো রাগ কেন করবো?আমি কাউকে দেখতে চাচ্ছিনা।"
''সেটা কে? "
''বলতে পারবোনা।আমি জাস্ট তার সামনে যেতে চাইছিনা। গেলে তার মায়ায় আরো কঠিন ভাবে জড়িয়ে যাবো সেটা চাইছিনা এখন।"
''সেটা কি বেলা?"
জিজ্ঞেস করে উঠে কিরন।বিভান কাউকে জানাতে চাইছেনা।কাউকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায়না।অবশেষে সবাই রওনা হলো।সামনের সিটে বসেছে ড্রাইভার আর রবিন।তার পিছনে নিশাদ বিভান কিরন।আর পিছনে আদনান বেলা সাঁঝ বিন্তী আর রুমকি। ঋতুকে আসতে দেয়নি।ওর পরীক্ষা আজ।খুব মন খারাপ করেছিলো ঋতু কিন্তু কিছুই করার নেই।একদম চাঁপাচাপি করে বসতে হয়েছে সবাইকে তবে জার্নিটা আনন্দের।সকল কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছে ওদের।বেলার সামনের সিটের বামপাশে বসেছে বিভান।এটাই চাইছে যেন চোখাচোখি না হয় একে অপরের।
ঘন্টাখানেক জার্নির পর পৌছে গেলো জাফলং।মাইক্রো থেকে নামার পর বিভান আর বেলা একে অপরকে দেখতে পায়।বেলা সবুজ রং এর শাড়ী পরেছে।সুন্দর লাগছে বেলাকে।শ্যামবতী বেলা।আজ একদম মায়াবিনী লাগছে বিভানের চোখে।কিন্তু বিভান বেলাকে দেখতে চায়না।কষ্ট হলে ও দূরে সরে থাকবে।বিভান সরে গেলো সেখান থেকে।এখন ওদের সিড়ি পার করতে হবে।দেড়শ এর মতো সিড়ি আছে।পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সিড়ি বানানো।
বিভসন কিরনের হাত প্রায় চেঁপে ধরেছিলো।আগে কখনো এমন জায়গায় আসা হয়নি।সিড়ি গুলো ও খাড়া খাড়া যা আসলেই ভয়ানক।