পরাণ প্রিয়া - পর্ব ০৭ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___মোশারফ হোসেন প্রিয়তাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
মোশারফ হোনের বন্ধু রফিক সাহেব মেয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মোশারফ হোসেনকে সময় দিতে ব্যস্ত।
প্রিয়তাকে নিয়ে সালমা বেগম আর জুহি ভিতরে চলে গেলেন।নিবিড় মোশারফ হোসেনের কাছে থেকে সরে এসে তনুসাকে অনেক বার কল দিলো।তনুসা কেটে দিচ্ছে বার বার।
নিবিড় ব্যর্থ হয়ে বিয়ে শেষ হওয়ার পর সবাই খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরে এলো।

শেফালী দরজা খুলে,আরে খালাম্মা আপনারা এতো সক্কাল চইলা আইলেন?

-আর বলিস না শেফালী, নিবিড় ওইখানে গিয়ে মন মরা হয়ে ছিলো।প্রিয়তাও নিবিড়ের মন খারাপ দেখে কিছুই খায়নি।
কথাটা শুনে নিবিড় রুমে যাওয়ার মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে প্রিয়তার দিকে তাকালো।প্রিয়তা জুহির শাড়ির সেফটিপিন খুলে নিজের রুমেই আসতেই দেখে নিবিড় দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীরমুখে। 

-শেফালী প্রিয়তার জন্য কিছু খাবার বানিয়ে দে মেয়েটা খেয়ে ঘুমাক।কথাটা বলেই সালমা বেগম চলে গেলেন।
প্রিয়তা নিবিড়ের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে,কিছু বলবেন?
নিবিড় কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলো।
প্রিয়তা শেফালীকে কিছু না করতে বলে ঘুমাতে যেতে বলে নিজেও রুমে গিয়ে দেখে নিবিড় গায়ের কোট শার্ট  খুলে একটা এক জাগায় রেখে ওয়াশরুমে গেলো।প্রিয়তা আস্তে আস্তে সবকিছু নিয়ে গুছিয়ে রাখতে আলমারি খুলতেই নিবিড় এসে প্রিয়তার হাত ধরে ফেলে,এইটা আমার জিনিস।আমার কোনো জিনিসে কেউ হাত দিলে আমার মোটেও পছন্দ না।

-আসলে আপনার জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাই ভাবলাম আলমারিতেই রাখি।
কথাটা বলতেই নিবিড় প্রিয়তার হাতটা শক্ত করে ধরে,আমার কোনো জিনিসের উপর হাত দেওয়ার অধিকার আপনার নাই।আমার ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছে সব কিছু ফেলে রাখবো তাতে আপনার কী? আপনি কেনো করবেন এইসব?  
নিবিড় ধমকিয়ে কথাটা বলতেই প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে, আমার হাতে লাগছে।প্লিজ হাতটা ছাড়ুন!
কথাটা বলতেই নিবিড় হাতের দিকে তাকিয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়ে দ্বিতীয় বার ভুলটা যেনো আর না হয়।এইরুমে থাকতে দিয়েছি বলে এই না আপনাকে আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি।শুধু বাবার কথায় আমি এই রুমে থাকতে দিয়েছি।কথাটা বলেই নিবিড় রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

প্রিয়তা ব্যাথা পাওয়া হাতটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে খাটের সামনে বসে খানিকটা সময় কাঁদলো।

গভীর রাতে নিবিড় রুমে এসে দেখে নীল রঙে ডিম লাইটের আলোয় প্রিয়তার মুখে এক অপরুপ মায়া সৃষ্টি হয়েছে।প্রিয়তা গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে।যেনো একটুখানি উষ্ণতার দরকার।চুলগুলো মুখের সামনে এসে হালকা বাতাসে উড়ছে।আর প্রিয়তা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।
নিবিড় কাছে এসে গায়ের উপর চাদর টেনে দিয়ে হাতে দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেলো। লাল রক্তের মতো ফুটে উঠেছে। উঠে গিয়ে মলম নিয়ে এসে আলতো করে মালিশ করে দিতে দিতে,বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,আপনি কেনো আসলেন আমার জীবনে?আপনি বিশ্বাস করুন তনুকে আমি ভালোবাসি। মেয়েটাকে যে আমি ছাড়তে পারবো না।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে দেখলে আমার নিজের অজান্তেই একটু একটু করে তনুর জায়গাটা দখল করে নিচ্ছেন।
তনু আমার প্রথম ভালোবাসা আর সেটা হারিয়ে যাক আমি চাই না।আমি ওকে কথা দিয়েছি সারাজীবন এক সাথে থাকার।
কথাগুলো বলে নিবিড় প্রিয়তার হাত মালিশ করে দিয়ে উঠতেই যাবে তখন প্রিয়তা আরেকটা হাত দিয়ে নিবিড়ের হাত চেপে ধরেছে গালের সাথে নিয়ে।
নিবিড় করুণ চোখে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উঠে গিয়ে বারান্দায় ইজিচেয়ারটায় বসলো।কপালের উপর হাত রেখে সন্ধ্যা দৃশ্যটা চোখের উপর ভাসতে লাগলো।প্রিয়তার লজ্জাজনক চাহনি, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট।খোঁপায় বেলীফুলের মালা।সম্ভব মায়াবী। কে বলবে বয়স একত্রিশ?  এখনো তাকালে মনে হয় সদ্য আঠারোতে পা পড়েছে । 
ওই চাহনির দিকে তাকালে যে কেউ বলবে,

”লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে তাকিও না মেয়ে।
কারণ তোমার লজ্জাতে আমি যেনো যাই মরে।
তোমার চাহনিতে আমি খুঁজে পাই,
টুকরো টুকরো ভালোবাসার আবেশ।
দিবে মেয়ে তুমি আলতো করে ছুঁয়ে আমার 
হৃদয়ের গহিন স্পর্শকে।"

সালমা বেগম ফজরের নামাজ আদায় করেই রান্নাঘরে গেলেন।প্রতিবছর এইদিনে তিনি ফজরের নামাজ পড়েই রান্নাঘরে গিয়ে পায়েশ রান্না করেন।কিন্তু যার জন্য রান্না হয় সে পাঁচ বছর থেকেই এই বাড়িতে থাকে না।কিন্তু তাঁর স্মৃতিগুলো নিয়ে বেঁচে আছে প্রতিটি মানুষ। 

নিবিড় ভোরের আলোয় চারদিকে চিকমিক করতেই উঠে ঘড়ির দিকে তাকালো।আজকের দিন এইবাড়িতে কেউই ভুলে না।নিবিড় গোসল করে এসে পাঞ্জাবি পরে 
 ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করতেই প্রিয়তা চোখ খুলে তাকালো।গায়ের উপর চাদর দেখে কিছুটা অবাক হলেও উঠে বসলো।হাতের ব্যাথাটাও একদম কমে গেছে।কিন্তু এইরুমে তো কেউ আসে না তেমন।হঠাৎ নিবিড়ের দিকে চোখ পড়তেই, তাহলে কী চাদর ওনি দিয়েছেন? বালিশের পাশে মলম দেখে তাহলে কী আমার হাতে মলমও দিয়েছেন? 
প্রিয়তা কথা গুলো ভেবতেই ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তোলে খাট থেকে নেমে, কিন্তু ওনি এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছে? অফিসে যাচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না।একবার জিজ্ঞেস করবো?
প্রিয়তার রাতের কথা মনে পড়তেই কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

নিবিড়ও এই ফাঁকে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে গিয়ে, মা তোমার হয়েছে?
-হ্যাঁ বাবা হয়েছে।
রান্নাঘর থেকে অনেক গুলো বড় বড় ব্যাগ নিয়ে এসে।আমি সব একসাথেই নিয়ে নিয়েছি।
নিবিড় কিছু না বলে জুহিকে ডাকতে গেলো।
সালমা বেগম নিজে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে, নিবিড়!  প্রিয়তা যাবে না?
-মা ওকে এইসবের মধ্যে না জড়ালেই ভালো হবে।বাড়িতে এসেছে কয়েকদিন যাক তারপর না হয় বলবো।
মোশারফ হোসেন রেডি হয়ে এসে,কোনো কিছু পরে হবে না।আমরা যাচ্ছি ও আমাদের সাথে যাবে।
প্রিয়তা,মা প্রিয়তা!
প্রিয়তা তড়িঘড়ি করে রুম থেকে এসে,বাবা আমায় ডেকেছেন?কথাটা বলে সবার দিকে খেয়াল করতেই বললো,আপনারা কী কোথাও যাচ্ছেন?
- হ্যাঁ মা।যাও তুমিও রেডি হয়ে আসো।আমরা আজ অনাথ আশ্রমে যাবো।সেখানে বাচ্চাদের সাথে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরবো।
প্রিয়তা কোনো প্রশ্ন না করেই মাথা নিচু করে রুমের দিকে পা বাড়াতেই, দাঁড়াও।
কথাটা শুনে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে মোশারফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে, বাবা!কিছু বলবেন?

-তুমি এই বাড়ির লক্ষ্মী।তুমি যদি মাথা নিচু করে হাঁটো তাহলে আমার এই ঘরের কোনো মূল্য নেই মা।আল্লাহ ছাড়া কারো কাছেই মাথা নত করবে না।সবসময় মাথা উঁচু করে হাঁটবে।এইটা তোমার বাবার আদেশ।

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুজিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ইশাককে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো সে আজ কলেজে যাবে না।

অনাথ আশ্রমে এসে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের দেখে প্রিয়তা যেনো সেই পুরোনো দিনগুলো খুঁজে পেলো।সালমা বেগমকে অনেক বার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও যেনো থেমে গেলো।তবে প্রিয়তা বার বার মনকে প্রশ্ন করছে কিছু একটা তো আছেই যার কারণে এতো আয়োজন। বাচ্চাদের সবার জন্য জামাকাপড়, বিরিয়ানি, পায়েস, কিছু ফল আর চকলেট নিয়ে এসেছে তাঁরা।
প্রিয়তাকে পেয়ে বাচ্চারা যেনো তাদের আপন কাউকে পেয়ে গেছে।যুগযুগান্তর থেকে এই সম্পর্কের বাঁধন।প্রিয়তাকে ঘিরে আছে সবাই কেউ কোলে,কেউ কাঁধ জড়িয়ে, চারপাশ মুখরিত হয়ে  বাচ্চারা বসেছে।
নিবিড় দূরে বসে সেই দৃশ্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে।
বিয়ের পর থেকে এই প্রথম প্রিয়তার হাসি দেখেছে সে।বাচ্চাদের অনেক রকম গল্প শুনিয়ে সবাইকে হাসাচ্ছে নিজেও হেসে তাদের সাথে তাল মিলাচ্ছে।
সালমা বেগম আর মোশরাফ হোসেন বাচ্চাদের খাবার জন্য ডাকতেই প্রিয়তা সবাইকে বললো আগে সবাই খেয়ে আসো তার পর আবার গল্প হবে।
প্রিয়তার কথায় সবাই দৌড়ে সালমা বেগম আর মোশারফ হোসেনের কাছে গেলো।প্রিয়তা মুচকি হেসে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে নিবিড় দাঁড়িয়ে আছে।
মুখটা নিমিষেই মলিন করে গম্ভীর হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। 
-বাবা আপনাকে সকালে কী বললো এখুনি ভুলে গেলেন?বাবাকে ডেকে কথাটা বলবো?
প্রিয়তা মাথা উঠিয়ে তাকিয়ে, শান্ত গলায় বললো, ধন্যবাদ। আমাকে এমন একটা দিন উপহার দেওয়ার জন্য।এই প্রথম মনে হলো আমি অনেক সুখী একজন মানুষ। কথাটা বলতেই প্রিয়তার চোখের পানিগুলো গাল বেয়ে নিচে পড়ছে।

-ধন্যবাদ আমাকে নয় বাবাকে দিন।কারণ আজ ওনি আপনাকে নিয়ে এসেছেন এখানে।

-আপনারও অবদান সম্পূর্ণ না থাকলেও কিছু পরিমাণ আছে। আপনার সাথে আমার বিয়েটা না হলে তো আমি জানতামই না আশ্রমেও এসে সুখ পাওয়া যায়।
আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? যদি কিছু না মনে করেন?

-বলুন?

-আজ কি কোনো বিশেষ দিন?
প্রিয়তা কথাটা বলতেই নিবিড়ের চোখ দুটো টলমল করছে।গলার মধ্যে যেনো সব আটকা পড়ে গেছে।তবুও আস্তে করে বললো,আজ আমার,,,,,
ফোনের শব্দে কথাটা না বলে নিবিড় হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে,  হুম তনুসা বলো?

-একটা ফাইল আছে ওইটাতে ইমার্জেন্সি সাইন করতে হবে। 
নিবিড় সরে গিয়ে, কিন্তু তনু আমি তো আসতে পারবো না। কারণ আমি আশ্রমে এসেছি।আর আজকের দিনটা আমি অফিসে যাই না তুমি ভালো করেই জানো।
-কিন্তু স্যার সাইনটাতো এখুনি লাগবে।
-এককাজ করো,তুমি চলে আসো আশ্রমে।
- ওকে স্যার আমি এখুনি আসছি।

নিবিড় পিছনে আবার প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দেখে, প্রিয়তা সবার সাথে কানামাছি খেলছে।
নিবিড় মুচকি হেসে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। 

জুহি সালমা বেগমের সাথে বসে,বাবা ভাবীকে দেখেছো,কতটা সহজ সরল? বাচ্চাদের একদম আপন হয়ে গেছে।
- এইভাবে নাদিয়াও এইখানে আসলে ওদের সাথে এইভাবে মিশে যেতো।কিন্তু আজ ওর জন্মদিন। আমেদের তো ঠিক মনে আছে ওর কথা।কিন্তু ও!  কতটা পাষাণ হলে একটা বার আমাদের খবর নেয়নি।তোর বাবা না হয় রাগের মাথায় কয়েকটা কথা বলেই ফেলেছে তাই বলে আমাদের থেকে দূরে চলে যাবে?
নিবিড়, আমার, তোর কথা একটা বারও ভাবলো না?
আমরা কী ওকে এতোই কম ভালোবেসেছি?
কিরে এখন কিছু বলিস না কেন? 

-মা থাক না।পুরনো এসব কথা তুলে লাভ কী বলো?
বাবা তুমি মাকে বুজাও না।
মোশারফ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে থাকনা সালমা, এইসব বাদ দাও।আমার তো প্রিয়তাকে পেয়েছি তাই না।ও আমাদের ছেড়ে কখনো যাবে না দেখো!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন