__প্রিয়তাকে এই নিয়ে ছাব্বিশ বার রিজেক্ট করেছে পাত্র পক্ষ।আজও দেখতে আসছে তাকে।ভালো করে মেকাপে নিজেকে সজ্জিত করে ফুটিয়ে তোলার একটু চেষ্টা। বয়স তো গুনে গুনে একত্রিশে পা দিলো।
গ্রাম হলে আরও আগেই তাকে গ্রাম ছাড়া করতো।কিন্তু ইট পাথরে ঘেরা এই শহরে তেমন একটা মানুষ উপরের চিন্তা মাথা নিয়ে ঘোরার সময় নেই।যে যার মতো ব্যস্ত।
প্রিয়তা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুড়ি গুলো পরে হালকা লিপস্টিক দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে আয়নায় নিজেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।কোনো কিছু কম পড়ে গেলো কিনা।আজও কি তাকে পাত্রপক্ষ রিজেক্ট করে দিবে?করলে করবে তাতে তাঁর দোষ কী?আল্লাহ ভালোবেসে তাকে বানিয়েছে তাতে তাঁর দোষ কোথায়?
মানুষ কালো রঙ পছন্দ করে কিন্তু কালো মানুষ কখনো পছন্দ করে না।কিন্তু আমি তো কালো নয়।হয়তো বয়সটাই বেশি।
-কিরে আপু তোর হলো?সাজতে এতোক্ষণ লাগে?এই বুড়ো বয়সে সেজেই বা লাভ কী। তোকে পাত্র পক্ষ বার বার রিজেক্ট করে দিয়ে যায়।
অনিলার কথা শুনে প্রিয়তা মুচকি হেসে শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিলো।এখন আর এসব কথা তাঁর গায়ে লাগে না।অনিলা প্রিয়তার ছোট বোন।বিয়ে হয়েছে তিন বছর পেরিয়ে গেলো।একবছরের একটা বাচ্চাও আছে অনিলার।
প্রিয়তা অনিলার দিকে তাকিয়ে, মা কোথায় রে?আর ইভা আসবে না আজকে?
অনিলা খাটের কিনারায় বসে পায়ের উপর পা দিয়ে,মাকে তো দেখলাম রান্না ঘরে।আর মেজো আপুর কথা যদি জানতে চাস তাহলে বলবো সে আসবে না।কারণ আপুকে ফোন দিয়ে ছিলাম।আপু বললো,আমার ঘরসংসার রেখে বার বার ওই বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না।মেজো আপুর কী দোষ বল? ছেলেরা যেভাবে তোকে রিজেক্ট করে,,,
অনিলা এটুকু বলেই থেমে গেলো।প্রিয়তা হেসে বললো,ঠিকি তো তোদের ঘরসংসার আছে।সবসময় কী আর ফালতু কাজে সময় নষ্ট করা যায়?
কথাটা বলেই প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
পাত্র পক্ষ এসে ড্রইংরুমে বসেছে।প্রিয়তার মা নুর জাহান বেগম তাদের আপ্যায়ন করছে। অনিলার স্বামী রিসাদ এসে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে।অনেক কথা হলো তাদের।রিসাদ উঠে গিয়ে অনিলাকে ইশারা করলো প্রিয়তাকে নিয়ে আসার জন্য।
প্রিয়তা সবার জন্য চা নিয়ে এসে সালাম দিয়ে চায়ের ট্রেটা টেবিলের উপর রাখলো।
সবাই প্রিয়তাকে দেখে বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে আছে।এমন ভাবে তাকিয়ে দেখছে যেনো মঙ্গল অভিযান থেকে প্রিয়তা ফিরে এসেছে।
বয়স্ক একজন মহিলা বললো,বসো।কী নাম আপনার?
কথাটা মহিলাটি প্রিয়তাকে ইচ্ছে করেই বেঙ্গ করতে বলেছেন প্রিয়তার বুজতে একটুও অসুবিধা হয়নি।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে, প্রিয়তা।
-আগে পিছে কিছু আছে? নাকি শুধুই প্রিয়তা?
-মেহের আফরুজ প্রিয়তা!
-তো মা এই বুড়া বয়সে বিয়ে করার আর কী দরকার? যৌবন কালে কী বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে নির্বাসনে গেছিলা নাকি?
কথাটা শুনে প্রিয়তা নিজের জড়তা ভেঙ্গে বিষন্ন চোখে তাকালেন।প্রিয়তা যেনো ভুলেই গেছে তাকে কথার ছলে অপমান করা হচ্ছে।তাঁর মাথায় তখন একটা কথায় ঘুরছে এবারও কী তাকে রিজেক্ট করা হবে?
-ওইভাবে তাকিও না মা।আমার আবার হার্টের সমস্যা আছে।ওইরকম তাকাইলে আমি কি আর ঠিক থাকুম?
তো মা তুমি নাকি চাকরি করো শুনছিলাম।কিসের চাকরি করো?
প্রিয়তা নিজেকে সামলিয়ে শান্ত গলায় বললো, কলেজের প্রফেসর।
-তো মা তুমি মেট্রিক পাশ দিছো? আমার ছেলে কিন্তু এইট পাশ তার জন্য যদি মেট্রিক পাশ মাইয়া ঘরে না নিয়ে যাই তাইলে কি সম্মান বাঁচবো?
কথাটা শুনে প্রিয়তা একটুও অবাক হয়নি।শুধু পাশে ফিরে নুর জাহান বেগমের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আবার সামনে থাকা মহিলার দিকে ফিরে মাথা নেড়ে বুজালো সে মেট্রিক পাশ করেছে।
প্রিয়াতা বুজে গেছে তার এখন যোগ্য পাত্র দেখার বয়স নয়।শুধু বিয়েটা হলেই হলো।বিয়েটা কী সত্যিই জরুরী? হ্যাঁ এখন খুবে জরুরী।কারণ এখন সে এই পরিবারে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।ছোট বোনেরা তাঁর জন্য শ্বশুর বাড়িতে মুখ দেখতে পারছে না।তাঁর মা নাকি রাস্তাঘাটে যেতে পারে না।অনেকেই বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে।তখন মায়ের সম্মান থাকে না।আচ্ছা! তাদের এই সম্মান কোথায় ছিলো এতো বছর? বাবা যখন ছোটো ছোটো তিন বোনদের তাঁর হাতে উঠিয়ে দিয়ে পরকালে পাড়ি দিলেন, তখন আমার কথা কী একবারও ভেবেছিলো?যখন মানুষের বাড়িতে গিয়ে টিউশনি করতাম তখন কোথায় ছিলো তাদের সম্মান? যখন কাজের খোঁজে বিভিন্ন জাগায় না খেয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি তখন কোথায় ছিলো তাদের সম্মান?যখন নিজের খাবার, ভালো জামা কাপড় পরার চিন্তা না করে তাদের দিয়েছি তখন কোথায় ছিলো তাদের সম্মান? যখন নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিন বোন থেকে দুই বোনকেই বিয়ে দিয়েছি আরেকটাকে কলেজে পড়াচ্ছি তখন তাদের সম্মান ইজ্জত কোথায় ছিলো? আজ আমার জন্য তাদের নাকি প্রশ্নের সমক্ষে হতে হয়? তাই আজ তাদের এতো অভিযোগ। কই আমার তো তখন কারো উপর অভিযোগ ছিলো না।সব কষ্ট গুলোকে হাসি মুখে মেনে নিয়ে সবকিছু একা হাতে সামলিয়ে নিয়েছি।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের সিমান্ত পেরিয়ে গাল বেয়ে অশ্রুগুলো নিচে পড়ছে সেইদিকে খেয়াল নেই প্রিয়তার।দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে খাটের সাথে হেলান দিয়ে কপালে হাত রাখতেই নুর জাহান বেগম দৌড়ে এসে প্রিয়তার সামনে বসে উৎকন্ঠে বললো,কীরে তুই কী ঘুমাচ্ছিস?
প্রিয়তা তড়িঘড়ি করে ওঠে বসে,কী হয়েছে মা? কোনো সমস্যা?
হাসি মুখে বললো,আরে নাহ্।খুশির খবর।
-কী?
-আজ তোকে যারা দেখতে আসছিলো তাদের নাকি তোকে পছন্দ হয়েছে।এবং কী ছেলে নাকি বলেছে মায়ের পছন্দই তাঁর পছন্দ। কী মা আনুগত্য সন্তান। এসব ছেলেই ভালো হয়।
-মা,ছেলেটা মাত্র এইট পাশ!
-তাতে কী হয়েছে? বেশি পাশ করে তোকে কী করবে? পড়াবে? তোর যদি বেশি পড়াতে ইচ্ছে করে তাহলে বিয়ের পর পড়িয়ে নিস।তোর কলেজে ভর্তি করিয়ে দিস তাহলেই তো হলো।
প্রিয়তা বিরক্তিকর গলায় বললো,ওই মহিলার সাথে কথা বলে দেখছি তোমার মাথাটাও গেছে।আমি কলেজের শিক্ষক শুনেও যে লোক জিজ্ঞেস করে আমি মেট্রিক পাশ করেছি কিনা তাহলে ওই ফ্যামিলির কথা একবার ভেবে দেখেছো?
-আমি কিছু ভাবতে চাই না।বিয়ে তোকে করতেই হবে।তোর কপালে লিখা আছে বলে মেনে নে মা।এই বয়সে তোকে কে বিয়ে করবে বল?তুই একটা বার নিজেই ভেবে দেখ আমি কিছু বলবো না।
প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে, ঠিক আছে।এতে যদি তোমরা মনে করো তোমাদের সবার মান-মর্যাদা বাড়বে তাহলে বিয়েটা আমি করবো।কারণ সারাজীবন তোমাদের জন্যই তো নিজের জীবনটাকে বিলিয়ে দিয়েছি আজও না হয় দিলাম।
এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে মোশারফ হোসেন। বড় ছেলে নিবিড় বাড়িতে আসছে দুই মাস পর।ব্যবসার কাজে সে প্রায় বিভিন্ন দেশে যেতে হয়।এইবার সুইজারল্যান্ড থেকে পার্সোনাল পিএ তনুসাকে নিয়ে ফিরে এসেছে সে।
এই মেয়েটাকে মোশারফ হোসেনের বড় বিরক্তিকর লাগে।কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলে না।
নিবিড় মোশারফ হোসেনের কাছে এসে,কেমন আছেন বাবা?
মোশাররফ হোসেন তনুসার দিকে তাকিয়ে, ভালোই তো ছিলাম কিন্তু এখন তেমন একটা ভালো লাগছে না।
-হাই আংকেল,কেমন আছেন?
মোশারফ হোসেন বিরক্তি নিয়ে, আচ্ছা মা,দর্জির দোকানে কাপড়ের বড়ই অভাব তোমার জন্য?
তনুসা হাসি মুখটা নিমজ্জিত করে,আংকেল আপনি এইসব কী বলছেন? কাপড়ের অভাব হবে কেনো এইটা তো এখন ফ্যাশন।
নিবিড়কে ব্যাগপত্র গাড়িতে রাখতে দেখে মোশারফ হোসেন ভাবলেন নিবিড় আসার আগেই এই মেয়েরে একটু সাইজ করি।
-আচ্ছা মা, এইটা যদি ফ্যাশন হয় তাহলে এইটুকুও পরার দরকার নেই।কারণ আমার মতো পরে অনেকেই ভাববে তুমি ফকির টাকা পয়সা নাই বিধায় এইসব ছোটো খাটো জামা-কাপড় পরে আছো।কেউ তো আর জানে না আমার ছেলে মাস শেষে তোমার হাতে মোটা অংকের টাকা তুলে দেয়।
তনুসা কথা গুলো অপমান বোধ করলেই নিবিড়ের বাবা বলে মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে।
জুহি কলেজ থেকে এসে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সালমা বেগমের মুখের উপর।
এই মেয়েটার একটাই সমস্যা কিছু হলেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে।সালমা বেগম ভেবে পায়না দরজা বন্ধ করে বসে থেকে কী লাভ?
এইদিকে ছেলেটাও বাড়ি আসছে।এসে যদি দেখে জুহি রাগ করে আছে তাহলে আমার অবস্থা পুরোই খারাপ করে ছাড়বে।আমি যে তাঁর মা হয়তো সেটাও ভুলে যাবে।
সালমা বেগম জুহির দরজায় এসে কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে আবার নিজের কাজে মন দিলেন।
নিবিড় বাড়িতে এসেই জুহিকে ডাকতে লাগলো।
সালমা বেগম কপালে হাত দিয়ে,এইবার কী হবে?
মেয়েটা আমাকে আজ কথা শুনাতে ছাড়বে না।
-মা, ও মা! কোথায় তুমি?
নিবিড় সালমা বেগকে ডাকতে ডাকতে সোফায় এসে বসলো।
সালমা বেগম এগিয়ে এসে,এইতো বাবা।তোদের এতো দেরি হলো কেনো?
-আর বলো না।রাস্তায় যে জ্যাম। আচ্ছা মা জুহি কোথায়? পাগলীটাকে দেখছি না কেনো?
সালমা বেগম ঢোক গিলে,কী বলি বল? কলেজে কী হয়েছে কে জানে। সেখান থেকে এসেই দরজা বন্ধ করে আছে।আর তুই তো জানিস ওর রাগ কিংবা মন খারাও হলেই এমন করে।
নিবিড় সালমা বেগমকে কিছু না বলে জুহির রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, জুহি,এই জুহি।ভাইয়া আসার পরেও দরজা খুলবি না?
কথাটা বলতেই দরজাটা খুলে জুহি নিবিড়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।
জুহির ভালো লাগা মন্দ লাগা সবি নিবিড়কে বলে নিজেকে শান্ত করে।
কিন্তু আজ সে যা শুনে এসেছে সেটা তো আর নিবিড় কিছুই করতে পারবে না।
জুহির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না দেখে নিবিড়েরও কান্না পাচ্ছে।জুহির কান্না নিবিড়ের মোটেও সহ্য হয়না।
-কী হয়েছে তো বলবি আমাকে?
জুহিকে এনে খাটে বসালো।
মোশাররফ হোসেন আর সালমা বেগমও এসে দাঁড়িয়েছে।কেউ কিছু বলছে না।নিরব হয়ে দেখা ছাড়া এখন তাদের কোনো উপায় নেই।
নিবিড় জুহির চোখ মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বললো,কী হয়েছে বোন,বলনা?
-আমাদের কলেজের ম্যাডামের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
কথাটা বলে এ্যাঁ এ্যাঁ বলে আবার কান্না করতে শুরু করলো।
-জুহি,ম্যাডামের বিয়ে হবে না? ওনার তো বিয়ে আরও আগেই করা উচিত ছিলো।এখন হয়তো ওনার মনে হয়েছে বিয়ে করার সময় হয়েছে করুক না।তাতে তোর ক্ষতি কী?
-ওনি বিয়ে করলে আমায় কী আর আগের মতো ভালোবাসবে? সব তো ওনার বরকেই দিয়ে দিবে।
জুহির কথা শুনে নিবিড় না হেসে পারলো না।ছোট্র একটা হাসি ফুটিয়ে তোলে বলো,তুই কী এখনো বাচ্চা আমায় বলতো? জুহি মানুষের বিয়ের একটা বয়স থাকে।ওনি কিন্তু সেটা অনেক আগেই পার করে আসতেছে।এখন হয়তো ওনার মনে হয়েছে বিয়েটা করা ওনার জন্য খুব জরুরী। এতে তুই কিংবা কেউ বাঁধা দিতে পারিস না।আর তুই ওনার বাঁধা দেওয়ার কোনো বিশেষ ব্যাক্তি নয় যে তোর কথা ওনি বিয়ে করবে না।
-তুই জানিস না ভাইয়া।কলেজের সবার থেকে ম্যাডাম আমাকেই বেশি ভালোবাসে। খুব আগলে রাখে আমায়।তোকে একদিন বলেছিলাম না এই ম্যাডামের কথা?
-আমার এখন মনে নেই।আচ্ছা এখন তুই কী করে জানলি তোর ম্যাডামের বিয়ে?
-ম্যাডাম আমায় দাওয়াত করেছে।বলেছে সবাইকে নিয়ে যেনো আমি ওনার বিয়েতে যাই।
এখন তুই বল,ওনার বিয়ের দাওয়াত খেতে গেলে কি আমার কষ্ট হবে না?
কথাটা শুনে নিবিড় হা হা হা করে হেসে আচ্ছা ঠিক আছে তোর ম্যাডামের সাথে আমায় কথা বলিয়ে দিস।তখন বলবো ম্যাডাম আপনি আমার বোনকে ছেড়ে যাবেন না।সে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
-ভাইয়া,,,,,,!