গত চারদিন যাবৎ জ্বর আর মাইগ্রেন নিয়ে অফিস যাচ্ছে নিশাদ।শরীরটা এখন চলতে চায়না।টেনে টেনে চলাত হচ্ছে।আজ পঞ্চম দিন জ্বর কমলেও ঘাড় মাথায় চিনচিনে ব্যাথা বিদ্যমান।দিনটা শুক্রুবার।বাসায় সবাই আছে মোটামুটি।শুধু লাবনী গেছে টিউশানিতে।কুঞ্জন ওকে নিয়ে গেছে।নিশাদ নাস্তা সেড়ে রুমে এসে খাটে শরীর এলিয়ে দেয়।চোখজোড়ায় ভর করে রাজ্যের ক্লান্তি।রাত থেকে ইমতিয়াজের অনবরত কল এসে যাচ্ছে।নিশাদ দেখে ও না দেখার ভান করে পড়ে থাকে।সকালে আর কল আসেনি ইমতিয়াজের।নিশাদ ফোন হাতে নিয়ে ইমতিয়াজ থেকে আসা কল গুলো দেখতে থাকে।ওর ভীষন কষ্ট হচ্ছে ইমতিয়াজকে এভাবে এভয়েড করতে।কিন্তু ইদমতিয়াজের সাথে কথা বললে হয় ইদ্রিকে পাওয়ার আকাঙ্খা বেড়ে যাবে।ওকে দেখার জন্য ওর চোখজোড়া হাহাকার শুরু করবে।হঠাৎ সাঁঝ এসে বলল,
''ভাইয়া ইমতিয়াজ ভাই কল দিয়েছিলো।"
নিশাদ কিছুটা চমকে গিয়ে বলল,
''কথা বলেছিস?"
''হ্যা বললাম।ওনি বলল তুই কল ধরছিস না।আমি বললাম তোর জ্বর।তাই আসছেন কিছুক্ষনের মধ্যে।"
নিশাদ কি বলবে বুঝতে পারছেনা।ইমতিয়াজ অনেক প্রশ্ন করবে।ও কিভাবে এত উত্তর দিবে?ভাই কে চুপ দেখে সাঁঝ বলল,
''ভাই কি হইছে?"
নিশাদ মাথা নেড়ে বলল,
''না কিছু না।নাস্তা রেডি কর ওকে কি দিবি দিস।আমি একটু বাহির থেকে আসি।"
সাঁঝ অবাক হয়ে বলল,
''ভাইয়া ইমতিয়াজ ভাই আসবে তো।"
''আমি আসতেছি কিছুক্ষনের মধ্যে।"
নিশাদ শার্ট পাল্টে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিবে তখনই ইমতিয়াজ ভিতরে প্রবেশ করতে করতে রেগে বলল,
''কই যাস তুই?তোর না জ্বর?"
নিশাদ রুমে ফিরে এসে খাটে বসে বলল,
''কাজ ছিলো।"
ইমতিয়াজ নিশাদের কপালে হাত রেখে বলল,
''ভালোই জ্বর।কবে থেকে জ্বর?"
''চার পাঁচদিন যাবৎ।"
ইমতিয়াজ নিশাদের পাশে বসে হালকা শ্বাস ছেড়ে বলল,
''কল পাসনি আমার?"
নিশাদ মৃদু মাথা নেড়ে বলল,
''ফোনে প্রবলেম। কল রিসিভ করতে পারিনা।"
ইমতিয়াজ হালকা শব্দ করে হেসে বলল,
''একটা মাস হলোনা নতুন ফোন।তাও আবার আইফোন।এমন সমস্যা তো হওয়ার কথানা।"
নিশাদ চুপ করে রইলো।কি জবাব দেবে ও?মিথ্যা বলেও ধরা খেলো।ইমতিয়াজ হেসে ওর হাত ধরে বলল,
''কি হইছে তোর?এমন করিস কেন?"
নিশাদ হঠাৎ ইমতিয়াজ কে জড়িয়ে কেঁদে দিয়ে বলল,
''আজকাল বড় ক্লান্ত লাগে রে।"
ইমতিয়াজ বন্ধুকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
''আমি মনে হয় বুঝতে পারছি দুনিয়ার এই রঙ্গমঞ্চে হার আর প্রাপ্তির এই খেলায় হারানোর দায়িত্বটা ও আমাকে নিতে হবে।একজ না দুজন না তিনজন একান্ত ভালবাসার মানুষের জন্য।"
হঠাৎ ইমতিয়াজের দৃষ্টি দরজায় পড়তেই দেখলো সাঁঝ দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে।ইমতিয়াজ ইশারা করলো ওকে চলে যেতে।ইমতিয়াজ বন্ধুকে কষ্টে সামলে বলল,
''দোস্ত সব ঠিক হয়ে যাবে।বিশ্বাস করিসনা আমাকে?"
নিশাদ কিছু বলতে পারলোনা ভরসার দৃষ্টিতে ইমতিয়াজ কে দেখা ব্যাতীত।সেদিন রাতে ইমতিয়াজ ডিনার শেষে খাটে এসে বসতেই ফোন বেজে উঠে।ইমতিয়াজ ফোন হাতে নিতেই বুকটা কেমন অস্থির হয়ে উঠে।সাঁঝের নামটা ওর চোখের সামনে।খুব কষ্টে নিজেকে সামলে কল রিসিভ করে ইমতিয়াজ।সাঁঝ বলতে লাগলো,
''ভাইয়া বড় ভাইয়া কান্না করছিলো কেন?বাসায় কিছু বলিনি।কিন্তু ভাইয়াকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখিনি।"
ইমতিয়াজ মৃদু হাসে।নিশাদ ভীষন ভাগ্যবান বলতে হয়।ভাই বোনের কতো ভালবাসা পাচ্ছে ও।ইমতিয়াজ ওকে আশ্বস্ত করে বলল,
''আরে বোকা মেয়ে বাসায় বলতে হবেনা।চিন্তা করোনা। ওর অফিসে প্রবলেম চলছিলো তাই চিন্তায় এমন হয়ে গেছিলো।আমি সল্ভ করে দিয়েছি সব।"
সাঁঝ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
''ভাইয়া আপনার মতো ফ্রেন্ডের দরকার আছে সবার।আজ আপনাকে আমার বড় ভাইয়ের স্থানে রাখলাম।ভাইয়ার খেয়াল রাখবেন প্লিজ।"
সাঁঝের কথায় ইমতিয়াজের ভীষন কষ্ট হতে থাকে।বুকটা ভারি হয়ে আসে।চোখজোড়া জলতে শুরু করে।নিজেকে সামলে ইমতিয়াজ বলল,
''অবশ্যই খেয়াল রাখবো।চিন্তা করোনা।যতদিন আছি নিশাদের পাশো থেকে ওর সকল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাবো।"
সাঁঝ হেসে বলল,
''ধন্যবাদ ভাইয়া।আজ রাখছি তাহলে।ভালো থাকবেন।"
ইমতিয়াজ গভীর নিশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পড়ে খাটে।
...................... আজকাল প্রিয়াশাকে তেমন একটা আশেপাশে দেখা যায়না আদনানের।তবে ব্যাপারটা হলো আদনান ওর সাথে বেশি কথা বলছে না।এড়িয়ে চলছে প্রিয়াশাকে।প্রিয়াশার মাঝে আদনানের সাথে কথা বলার তেমন কোন আগ্রহ দেখেনি আদনান।যখন ওদের চোখাচোখি হতো প্রিয়াশা মৃদু হাসতো তবে আদনান মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছে।প্রিয়াশা অবশ্য কথা বলার চেষ্টা করেনি।আদনান ওকে যতোই এড়িয়ে চলছিলো কিন্তু প্রিয়াশার কথা না বলায় কোথায় যেন ভীষন খারাপ লাগা কাজ করছিলো।তবু ও নিজের ইমোশন কে সরিয়ে রেখে কাজে মন দেয় আদনান।
সেদিন আকাশী রঙ্গের শাড়ী পরে এসেছিলো প্রিয়াশা।চুল গুলো কে খোঁপায় জড়িয়ে অফিসে প্রবেশ করে।আদনান ঠিক ওকে দেখতে পেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।আজকাল কথা না বলে ও যেন প্রিয়াশার দিকে খুব দ্রুত ধাবিত হচ্ছে আদনান।কেন হচ্ছে ও জানেনা।তবে ভালোই লাগছে।অন্যরকম একটা অনুভূতি খেলে যাচ্ছে ওর বুকে।সেদিন আদনান প্রিয়াশার রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার মুহূর্তে ফুঁপানোর শব্দে খানিকটা অবাক হয়ে উঁকি দিতেই খেয়াল করলো প্রিয়াশা নিজের হাতে কিছু একটা লাগাচ্ছে আর কাঁদছে।আদনান কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেও নিজেকে সরিয়ে নেয়।ও কিছু বলবেনা।মেয়েটা যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওকে কিছু বলবেনা তাহলে আদনান ও কিছু বলবেনা।কতদিন লুকিয়ে রাখতে পারে দেখবে।আদনান সেখান থেকে সরে আসে চুপচাপ।
...............................দুপুর গড়িয়ে রাত বেলা বারান্দায় বসে আছে মেয়েকে কোলে নিয়ে।অনেকটা বছর পার হয়ে গেলো।আজো মানুষ গুলো কে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওর।বেশি মনে পড়ে বাবাকে।তের বছর পর ও বাবাকে দেখতে পায়নি।বাবা বলে ডাকতে পারেনি।পূর্না বিরক্ত হচ্ছিলো বারান্দায় বসে থাকতে।মা তো ছাড়ছেই না বরং শক্ত করে ধরে আছে।পূর্না কিছুটা রাগ করে বলল,
''একানে আল কতক্কন বাতবা?আমি কেলবো।"
বেলা মৃদু হেসে মেয়ের দিকে তাকায়।পূর্না ঠোঁট ফুঁলিয়ে রেখেছে। মেয়েকে সামনে এনে বেলা বলল,
''বাব্বাহ আমার মায়ের এতো রাগ?"
''লাগ কব্বো না তো কব্বো?এবাবে কেউ বতে তাকে?পতা!!!"
বেলা অবাক।পূর্না ওকে পচা বলল।বেলা মেয়েকে শক্ত করে ধরে বলল,
''কে পঁচা পূর্না নাকি জর আম্মু?"
''অবত্যই মস।পুন্না বালো।"
বেলা খিলখিলিয়ে হেসে বলল,
''কে বলল পূর্না ভালো?পূর্না অনেক দুষ্টু।"
পূর্না ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
''আমি পতা?"
''না বাবা মা মজা করছিলাম।আমার মেয়ে অনেক ভালো।"
পূর্না বেলার কোল থেকে নেমে যাওয়ার জন্য জেদ করতে থাকে।বেলা ওকে ধরে রাখতে পারছেনা।কোনমতে আটকে বলল,
''মারে এমন করিসনা।আর বলবো না।"
পূর্না হেসে বলল,
''আমি কেলবো একন।"
বেলা ছেড়ে দিতেই পূর্না দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে গেলো।বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে রইলো।লোকটা এখনো এলোনা।এমন কখনো করেনা।বারোটা বাজতে যাচ্ছে।পূর্নাকে খাইয়ে দিয়েছে কিন্তু বিভান এখনো আসছেনা বলে বেলাও খেতে পারছেনা।বেলা চিন্তিত মুখে বিভানের নম্বরে কল দেয় কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা।বেলার কেমন ভয় হতে থাকে।এমনটানা কখনোই হয়না।বেলা উঠে রুমে এসে অফিসে কল দিতেই একজন রিসিভ করে।কিন্তু কল রিসিভ হয়না।বেলা বিভানের নম্বরে কল দিতে থাকে।কিন্তু রিসিভ হয়না।পূর্না মাকে এমন বিচলিত দেখে বলল,
''কি অয়েতে?"
''কিছু না তুমি খেলো।"
''আত্তা।"
বেলার ভীষন চিন্তা লাগছে। হঠাৎ ডোরবেল বাজে।বেলা দৌড়ে দরজা খুলতেই দেখলো বিভান দাঁড়িয়ে।বেলা রেগে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসে।বিভান বুঝতে পারলো বেলা রেগে।এদিকে পূর্না বাবাকে দেখে দৌড়ে কোলে উঠে গেলো।বিভান মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বলল,
''মা রেগে গেছে।তুমি খেলো বাবা কথা বলে আসি।"
বেলা রুমে এসে বিভানের কাপড়চোপড় বের করছিলো।বিভান এসে দরজা চাঁপিয়ে বেলা কে পিছন থেকে জড়িয়ে নেয় বুকে।বলতে লাগলো,
''সরি বেলা।আর এমন হবেনা।"
বেলা অভিমানী কন্ঠে বলল,
''সরুন।কথা নেই আপনার সাথে।"
বিভান বেলা কে আরো জোরে জড়িয়ে বলল,
''প্লিজ রাগ করেনা।আমার ফোনটা কাজ করছিলোনা।তোমার কল দেখছিলাম কিন্তু রিসিভ করতে পারছিলাম না বারবার হ্যাং হয়ে যাচ্ছিলো আর রাস্তায় অনেক ট্রাফিক ছিলো।"
বেলা একটু নরম হয়ে বলল,
''জানেন কতো টেনশনে ছিলাম।কতো অসহায় লাগছিলো।অফিসে ও কল করতে পারছিলাম না।"
বিভান বেলাকে সামনে ফিরিয়ে বলল,
''আবারো সরি।আর হবেনা এমন।ফোনটা ঠিক করিয়ে নিবো।বেশ কয়েকদিন যাবৎ সমস্যা করছে।"
বেলা হেসে বলল,
''গিয়ে ফ্রেশ হন। খাবার রেডি করছি।"
বিভান হেসে ফ্রেশ হতে চলে যায়।রাতে ঘুমের সময়ে পূর্না বিভান আর বেলার মাঝে বসে আছে তবে মুখ ফুলিয়ে।বিভান বেলা বারবার জিজ্ঞেস করছিলো কি হয়েছে।পূর্না কিছু বলেনি।হঠাৎ বিভানকে ধরে বলল,
''বাবা দানো মা আমাতে পতা বলেতে।"
বেলা অবাক।ও তখন না ঠিক হয়ে গেছিলো।এখন আবার এ কি বলল?বিভান হাসতে শুরু করেছে।হেসে বলছিলো,
''বেলা এত্তবড় সাহস আমার মেয়েকে পচা বলেছো?"
বেলা কিছু বলতে পারছেনা।পূর্না ও বাবার সাথে বেলার দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করে।
!!!!
সৈয়দা বেগমের রুম থেকে সুরেলা কন্ঠে গান বেজে যাচ্ছে।বিকেলের সময় টা ওনার এভাবেই কেঁটে যায়।বিভিন্ন পুরোনো বাংলা গান শোনা যেন ওনার শখ।
রোজ রোজ আকাশ নীলে
কতো তারা রাতে জ্বলে..................
মন তবু এই যে বলে,
তোমারি দুচোখে শুধু সেই আলো জ্বলে
হো..... রোজ রোজ আকাশ নীলে.....................
কান থেকে ফোন রাখে ইমতিয়াজ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষন ফোনের দিকে চেয়ে থাকে।কানে খুব সুন্দর গানের ধ্বনি ভেসে আসছে।একটু আগে যে কল টা এসেছিলো এখন মনে হচ্ছে ওর কাজটাকে বাস্তবায়ন করার পালা।ইমতিয়াজ রুমে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে।তারপর একজায়গায় দাঁড়িয়ে বলল,
''নাহ ভুল কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছিনা।"
কথাটা বলেই চোখবুজে বার কয়েক শ্বাস ছাড়ে ইমতিয়াজ।তারপর কন্ঠকে কিছুটা ভারি করে ডাকতে লাগলো,
''ইদ্রি!!!"
বোনের কোন সাড়াশব্দ নেই।আজকাল না মেয়েটা খুব বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে।একদম নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকে রুমে।ভূবনের বিয়ের পরদিন থেকেই একদম চুপচাপ।ইমতিয়াজ কিছুটা রেগে গিয়ে আবার ও ডাকলো,
''কিরে ইদ্রি?আসলিনা এখনো?"
হঠাৎ ইদ্রির কন্ঠস্বর শোনা গেলা পাশের রুম থেকে।ইমতিয়াজ আবার ও কাঠিন্য কন্ঠস্বরে বলল,
''কাম ফাস্ট!!"
''জি ভাইয়া।"
বলেই ইমতিয়াজের রুমে আসে ইদ্রি।মেয়েটার চেহারা মলিনতায় পরিপূর্ন। ইদ্রির চোখজোড়া বড্ড শুকনো।বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে ইমতিয়াজ কঠিন স্বরে বলল,
''জলদি রেডি নেয়।"
ইদ্রি ভাইয়ের কন্ঠে কিছুটা অবাক।কিছু কি হয়েছে?কোন ভুল হয়েছে ওর?ভাইয়া এতো রেগে কেন?বোনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ পুনরায় ধমকে উঠলো,
''কি হলো দাঁড়িয়ে কেন?কথা শুনিস না কানে?"
ইদ্রি নড়ে উঠে।তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
''ভাই কোথাও কি যাবে?আর কি হয়েছে?"
ইমতিয়াজ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
''এত কথা বলার সময় নেই এক্ষুনি যা।"
''ঠিক আছে।"
ইদ্রি ধীর পায়ে বেরিয়ে যায়।কিছুসময় পর নীল স্যালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে আসে।চুল গুলো ছেড়ে দেয়া পিঠের ওপর।চোখের চিকন করে টানা নীল কাজল আর হাতে রয়েছে চিকন চেইনের ঘড়ি।ইমতিয়াজ শার্ট পরে নিয়ে চুল আঁচড়ে নেয়।তারপর ইদ্রিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।ইদ্রি ভাইয়ের দিকে তাকায়। কখনো এমন দেখেনি ভাইকে?ইমতিয়াজ কি কোন কারনে রেগে ওর ওপর?ইদ্রির ভয় হচ্ছে।ইমতিয়াজের গাড়ি একটা পার্কের সামনে এসে থামে।আশপাশে তেমন কেউ নেই।ইদ্রি খানিকটা অবাক।ভাই হঠাৎ এখানে কেন এলো?ইমতিয়াজ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ইদ্রির পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে বলল,
''বের হ।"
ইদ্রি বেরিয়ে আসে।ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে।ইদ্রি বারবার ভাইকে দেখছে।ইমতিয়াজ বোনকে নিয়ে একটা জায়গায় এসে থামে।তারপর ইদ্রিকে রেখে একটু দূরে গিয়ে কাকে যেন কল দিয়ে কথা বলতে শুরু করে।ইদ্রি একটা বেঞ্চে বসে ভাইয়ের অপেক্ষায়।একটু পর ইমতিয়াজ ফিরে এসে বোনের পাশে দাঁড়ায়।ইদ্রি মিনমিন স্বরে বলল,
''ভাইয়া আমরা কি কারোর অপেক্ষায়?"
''সেটা একটু পরই বুঝবি।"
গাম্ভীর্যের স্বরেই বলে ইমতিয়াজ।আবার চুপ হয়ে গেলো।কিছুক্ষন পর ইদ্রি না চাইতে ও উঠে দাঁড়িয়ে যায় সামনের থেকে এগিয়ে আসা মানুষটিকে দেখে।দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।সে যতোই এগিয়ে আসছে ওর নিশ্বাস ততোবেশি আটকে আসছে।তাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।ইদ্রি সামনের থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে ভাইকে দেখে।ইমতিয়াজের চোখজোড়া সামনে নিবদ্ধ।এদিকে নিশাদ যতোই এগিয়ে আসছিলো ওর ভেতরকার উন্মাদনা ততোটাই বেড়ে যাচ্ছিলো।নিশাদ ভীষন অবাক।ইমতিয়াজ ওকে ডেকেছিলো আসতে।কিনৃ্্তু ও বুঝতেই পারেনি ইদ্রি ও থাকে।নিশাদ ঠিক ভাবে তাকাতে পারছেনা।ইদ্রি নিজে ও প্রচন্ড অবাক।ভাইয়া ওনাকে কেন ডাকলো।তাহলে কি জেনে গেছে ভাইয়া?নিশাদ একটু দূরত্বে দাঁড়ায় ওদের থেকে।ইমতিয়াজ মৃদু হেসে উঠে নিশাদের দিকে।নিশাদ কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
''কিছু হয়েছে?"
ইমতিয়াজ ইদ্রির হাত ধরে বন্ধুর দিকে এগুতে এগুতে বলল,
''হয়েছে অনেক কিছু।"
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে ইদ্রির দিকে তাকায়।মেয়েটাকে না খুব সুন্দর লাগছে একদম নীলপরী।ইমতিয়াজ বন্ধুর দিকে এগিয়ে এসে নিশাদের হাত ধরে ম্লান কন্ঠে বলল,
''জানিস আমার জীবনে না সবচেয়ে দামী আমার বোন।আর সবচেয়ে প্রিয় তুই।তোরা আমাকে ঠিকমতো বুঝতে পারিস নি হয়ত এটাই আমার ব্যার্থতা।ইমতিয়াজ বোনের দিকে তাকিয়ে ওর মাথা হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,
''আমার ছোট বোনটা অনেক ছোট সবে আঠারোয় পা রেখেছে।অনেক কিছুই বোঝেনা।খুব জেদী ও কিন্তু ভীষন ভালো।লক্ষী মেয়ে।"
নিশাদের হাতে ইমতিয়াজ ইদ্রির হাত রেখে বলল,
''আমার সবচেয়ে প্রিয়মানুষটার কাছে আজ মহামূল্যবান জিনিসটাকে সঁপে দিলাম।এখন ওর দায়িত্ব তোর।ওকে দেখে রাখিস নিশাদ।আমি জানি তুই পারবি।কিছুক্ষনের জন্য ভাবছিলাম বোনটাকি তোর সাথে ভালো থাকবে তো কিন্তু মনে হচ্ছে আমি ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি।যাই হোক একসাথে থাক তোরা কথা বল।আমি আসি।"
কথা গুলো বলে নিশাদের হাতকে ইদ্রির হাতে চেঁপে পিছনে ফিরে হাঁটতে থাকে ইমতিয়াজ। ইদ্রি আর নিশাদ একেঅপরের দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে কি হচ্ছিলো।ভাইয়া ওকে নিশাদের হাতে তুলে দিয়ে গেলো সত্যি?এদিকে নিশাদ নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা ওকি নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়ে গেলো।ইদ্রির নরম হাত নিশাদের শক্ত হাতের মাঝে ঘেমে একাকার।নিশাদ হঠাৎ এগিয়ে আসে ইদ্রির দিকে।সাথে সাথে ইদ্রি নিচে তাকায়।নিশাদ কিছু ভাবতে পারছেনা।সামনে থাকা পুতুল টা কে আজ নিজের মতো করে পেয়ে গেছে।তাই আর ভাবা ভাবির প্রশ্নই উঠেনা।ইদ্রিকে প্রচন্ড অবাক করে নিশাদ ওর থুতনি শক্ত হাতে ধরে মুখ উপরে তুলে ওর ঠোঁটজোড়ার ভাজে নিজের ঠোঁটজোড়া সঁপে দেয়।ইদ্রির চোখ বড় হয়ে আসে।নিশাদ ওর একহাত পৌছে দেয় ইদ্রির পিঠে অপরহাত ইদ্রির হাত ছাড়িয়ে ওর কোমড় চেঁপে নিজের দিকে নিয়ে আসে।ইদ্রি ছাড়াতে চাইছিলো নিশাদকে।কিন্তু নিশাদ এতোটাই ডুবে গেছে ওর ঠোঁটজোড়ায় যে ইদ্রির জোরে ধাক্কা গুলো ওকে বিন্দুমাত্র নড়াতে সক্ষম নয়।ইদ্রি অনেকবার চেষ্টার মাঝে দেখলো নিশাদের শরীর গরম।ওর গালে নিশাদের উত্তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।ইদ্রি আর পারেনা সরাতে।একপর্যায়ে নিশাদকে জড়িয়ে ধরে ও।নিশাদ এতোটাই উন্মাদ যে ইদ্রিকে পাওয়ার জন্য ওর হৃদয় হাহাকার শুরু করে দিয়েছে।নিশাদ ইদ্রির গলায় মুখডুবিয়ে ওকে ওকে ভেজা ঘাসের দিকে ঠেলতে থাকে।ইদ্রি দাঁড়াতে পারছেনা।নিশাদকে ধরে ভর করার শক্তি হারিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে।নিশাদ ইদ্রির গলায় ঠোঁট বুলানোর মাঝের জামার হাতায় চলে যায় নিশাদের উন্মাদ হাত।এদিকে ইমতিয়াজ গাড়ির কাছে এসে বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে ফুঁপাতে শুরু করে।চোখজোড়া বেয়ে দ্রুত গতিতে নামতে শুরু করে অশ্রু ধারা।গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলে ও পারেনি।দুহাতে চোখঢেকে গাড়ির পাশ ঘেষে বসে পড়ে।পুরুষ মানুষ কাঁদেনা তাদের শক্ত হতে হয় কিন্তু ইমতিয়াজ ও আজ পারছেনা নিজেকে শক্ত রাখতে।আঁধার নেমে এলো আকাশের বুক চিরে।নিজেকে টেনে দাঁড় করায় ইমতিয়াজ।গাড়িতে ঢুকে ড্রাইভ করতে থাকে।চোখজোড়ায় আজ অশ্রুদের কোন বাঁধা নেই।একহাতে চোখ মুছে নিচ্ছে অপরহাতে ড্রাইভ করছে ইমতিয়াজ।সবার জীবনে ভালবাসা হয়ত সফল হয়ে আসেনা।অনেকেরটা অসম্পূর্ণ ও থেকে যায়।ঠিক যেমন টা ইমতিয়াজের জীবনে।জীবনে কখনো কাউকে ভালবাসবে ভাবেনি ও।কখনো কাউকে সেভাবে চোখে পড়েনি।তবে সাঁঝ যে ওর জীবনে মুহূর্তের জন্য ভালবাসা ভালো লাগার ছোঁয়া এনেছিলো সে আসলে কখনোই ওর ছিলো না।তার মনে প্রানে অন্তরে তো বসবাস ছিলো অন্য কারোর।ইমতিয়াজের একতরফা এই ভালবাসা কখনোই পূরন হবেনা তা বুঝে গিয়েছিলো কাল যখন সাঁঝ ওকে ভাইয়ের জায়গায় বসিয়েছিলো।তখন শুধু একটা কথাই মনে আসছিলো সেটা ছিলো ইমতিয়াজ ফিরিয়ে বলতে পারেনি সাঁঝ তুমি ও ভালো থেকো।আমার ভালবাসা সবসময় তোমার সাথেই থাকবে।কখনো বুঝতে ও পারবেনা আমার ভালবাসার গভীরতা কতোটুকু ছিলো।যখনই আমাকে ডাকবে পেয়ে যাবে।কখনো ভালবাসার দাবি নিয়ে তোমার সামনে আসবোনা।এতোটুকু ভরসা রেখো।তোমাকে দূর থেকে ভালবেসে তবে সেটার আঁচ কখনো পাবেনা।কখনো আমার কাছে আসতে দেবো না কারন তু্মি আমার ভালবাসার জোরে টিকে থাকতে পারবেনা।যাকে ভালবাসো সে ভীষন ভাগ্যবান তোমায় পেয়ে।বড় দায়িত্ববান বোন তুমি নিশাদের।ছোট হয়ে ও বড় বোনের মতোই ওর আশেপাশে থাকছো।শুধু আমিই দূর্ভাগা যে তোমার ভালবাসায় কাঙ্গাল হয়ে ও ভালবাসা পাইনি।ভালো থেকো সাঁঝ।আমার বুকের অসংখ্য ভালবাসায় তুমি ছিলে আছো থাকবে।আজ অত্যন্ত প্রিয় মানুষের কাতারে তুমি ও পড়ে গেলে তবে সেটা আঁচ করতে পারবেনা কখনো।ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসি!!!!গুঁমড়ে কেঁদে উঠে ইমতিয়াজ।আজ ওর কান্না গাড়ির ভেতরেই নিবদ্ধ। কারোর কান পর্যন্ত পৌছাবে না।
.........................বিকেলে নিঝুম সাবিয়াহ এলো হুমায়রার সাথে গ্রুপস্টাডি করার জন্য।প্রত্যেক শনিবারে ওরা একসাথে পড়ে থাকে।পড়ার মাঝেই হুমায়রার ফোনে কল আসে।নম্বরটা দেখে হুমায়রা ধীরে বলল,
''আমি আসছি একটু কথা বলে।"
হুমায়রা উঠে বারান্দায় চলে যায়।হৃদয়ের কল পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠে ওর।সে কয়েকদিন যাবৎ দেশের বাহিরে ছিলো।তাই বেশি কথা হতে পারেনি।আজ হৃদয়ের নম্বর দেখে বারান্দায় এসে কল রিসিভ করে হুমায়রা।ফিনফিনিয়ে বলল,
''খবর কি তোমার?একেবারে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেলে যে?"
হৃদয় হেসে উঠে হুমায়রার কথায়।বলল,
''না জান অমাবস্যার চাঁদ হইনি।ব্যাস্ত ছিলাম সেটা জানোই।তা বলো কেমন আছো?"
''ভালো। তুমি?"
''বেশ ভালো।দেখা করবে?"
হুমায়রা অবাক হয়ে বলল,
''এখন?"
''হ্যা তো?"
''মানে আমার ফ্রেন্ডরা এসেছে গ্রুপস্টাডি করবে বলে।আজ না আরেকদিন দেকা করি।"
''এখন আসতে একেবারেই পারবেনা?"
''না প্লিজ। মন খারাপ করোনা।"
''ওকে।বাট এসো কিন্তু শীঘ্রই। তোমাকে ভীষন মিস করেছিলাম বুঝোইতো?"
''হুম।রাখি বায়।"
''ওকে।"
হুমায়রা কল কেঁটে পাকঘরে উঁকি দিয়ে জুলেখা বানুকে বলল,
''মা একটু চা আর বিস্কুট পাঠিয়ে দিও।"
জুলেখা বানু চুলায় পানি বসিয়েছিলেন কাপড় ভেজানোর জন্য।জোর গলায় বললেন,
''আইচ্ছা যা।লাবনীরে দিয়া পাঠায় দিমু।"
হুমায়রা রুমে যেতেই নিঝুম বলল,
''তুই হৃদয়ের সাথে এখনো কথা বলিস?"
হুমায়রা ভ্রু কুঁচকে বলল,
''কেন বলবোনা?ওকে ভালবাসি আমি।"
সাবিয়াহ বলল,
'''হুমু দেখ ও তোর.............
হুমায়রা সাবিয়াহ কে থামিয়ে বলল,
''প্লিজ আমি কিছু শুনতে চাইনা।পড়তে এসেছিস পড়।"
নিঝুম আর সাবিয়াহ আর কিছুই বলতে পারেনি।
অনেক বোঝানো সত্ত্বেও হুমায়রা বুঝেনি।হুমায়রা নিজের রঙ্গীন দুনিয়ায় এতোটাই হারিয়ে যে বাস্তবটা দেখতে পারছেনা।"
................................রিদ্ধিকে পড়াতে গিয়েছিলো সাঁঝ।আজকাল সেখানে যেতে ভালো লাগেনা ওর।মনে হতে থাকে কোন এক অপরিপূর্ণতা রয়ে গেছে।আগে যেমন সেখানে গেলে মনে হতো এই যে সাইমনের দেখা পাবে এখন।কিন্তু এখন পায়না।তাই ভালো ও লাগেনা।সাঁঝ বেরিয়ে এসে রিক্সার জন্য দাঁড়ায়।হঠাৎ ওর সামনে একটা গাড়ি থামলো।সাঁঝ গাড়িটি চিনতে পেরে মৃদু হাসে।গাড়ির জানালা খুলে সাইমন ওকে এসে বসতে বলল।আজ তাকে আগের মতো লাগছে।এখন তার চেহারায় ক্লান্তি নেই বরং আগের মাধুর্যতা ফিরে এসেছে।গাড়িতে বসে সাঁঝ বলল,
''কি করে জানলেন পড়াতে আসবো?"
সাইমন স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বলল,
''কেন জানবো না তুমি আছো?"
''মানে?"
কিছুটা অবাক সাঁঝ।সাইমন বলল,
''গাঁধি কাল তুমিই বলেছিলে আজ রিদ্ধিকে পড়াবে।"
সাঁঝের মনে পড়তেই নিজেকে ভীষন বোকা মনে হতে থাকে।মৃদুস্বরে বলল,
''আসলেই ভুলে গিয়েছিলাম।"
সাইমন হেসে সাঁঝকে টেনে বুকে নিয়ে অপরহাতে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে।ঘরে ফিরে রুমে ঢুকে যায় সাঁঝ।গায়ের উড়না ছাড়তেই ফোনে ইমেইল টোন বেজে উঠলো। দ্রুততার সাথে ফোন হাতে নিয়ে ইমেইলটার দিকে কিছুক্ষন চোখ বড় করে হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইলো সাঁঝ।।
-কংগ্রাচুলেশন্স ডিয়ার সাঁঝ।। ইউ আর সিলেক্টেড ফর দা পোস্ট অফ অ্যাসিস্ট্যান্ট একাউন্ট্যান্ট ফর আওয়ার কোম্পানি।।।।। "
বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছিলো সাবলম্বী হয়ে সংসারে কিছু কন্ট্রিবিউট করার।। ভাই বাপের আড়ালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছে এমনকি সাইমনকেও জানায়নি।।। সেসব জায়গার মধ্যে থেকেই এক জায়গা থেকে এই মেইল টা এসেছে।। খুশিতে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো সাঁঝের।। যদিও জানে নিশাদ ভাইয়া করতে দেবেনা প্রথমে কিংবা সাইমনও রাজি হবে না তবুও ও মানাবে সবাইকে।।। ওর বিশ্বাস সবাই ওকে ভরসা করবে।সাঁঝ ফোনটা দুহাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।