রংধনু - পর্ব ১৫ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


কলেজের ক্যাম্পাসে কয়েকজন ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।খড় ফাঁটা রোদে দাঁড়িয়ে আছে ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের চারজন।তার মাঝে ছিলো কুঞ্জন ও।দোষ ছিলো ধুমপান।কলেজের কেরানী ওদের চারজনকে মিলে ধুমপান করতে দেখে ক্লাশ টিচার কে জানালে ওনি ওদের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।কুঞ্জন মাথা নিচু করে আছে।ওর ভয় হচ্ছে। গার্জিয়ানকে জানানো হলে খুব সমস্যায় পড়বে ওরা।ভাইতো মেরেই ফেলবে।আব্বার কথা বাদই।দূর থেকে ভাইকে এমনটা দেখে লাবনীর মন ছোট হয়ে যায়।ক্লাশ চলা কালীন ইস্মিতা ওকে বলল,

''জানিস তোর ভাই সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা খেয়েছে।এখন রোদে দাঁড়িয়ে আছে।"

একটু রাগ হলো লাবনী।গলায় ঝাঁঝ এনে বলল,

''ভাইয়া এগুলো কখনো করেনা।মিথ্যা বলবিনা। "

হেসে ফেলে স্মিতা।তারপর মুখ শক্ত করে বলল,

''যেয়েই দেখ।আজ যখন নিশাদ ভাইয়া জানবে কি যে করবে?"

লাবনীর ভয় লাগতে শুরু করে।ওর আর কুঞ্জনের মাঝে ঝগড়া লেগে থাকে কিন্তু ওর ভাই এসব খেতে পারেনা ও জানে।তাই কিছু না বলে ক্যাম্পাসের সামনে এসে বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।সবার মাঝে কুঞ্জন অপরাধীর মতো কান চেঁপে দাঁড়িয়ে আছে।লাবনী সরে আসে।এটা কি দেখলো?ভাইয়া কি সত্যি ধুমপান করেছে?বড় ভাইয়া বলেছিলো ওদের সাথে না মিশতে।কিন্তু কুঞ্জন ভাইয়া না বলে ওদের সাথে থাকে। এরই মাঝে প্রিন্সিপাল ম্যামের ডাক পড়ে।চারজনকে ডেকে নেয়া হয় ওনার কক্ষে।ওনি ভীষন রাগী।সবাইকে তটস্থ রাখেন।চারজনকে উদ্দেশ্য করে ম্যাম বললেন,

''গার্জিয়ানদের নম্বর দিন।আপনাদের টিসি দিয়ে দিবো।এমন অসভ্য ছেলে এই কলেজে রাখবোনা।"

চারজনই বেশ ভয় পেলো।কিন্তু কুঞ্জন চিন্তায় পড়ে গেলো।ভাইয়া ওকে মেরেই ফেলবে।এখন কি করবে ও?কুঞ্জন কে অবাক করে ম্যাম বলল,

''কুঞ্জন আপনার বড় ভাই কষ্ট করে টাকা আয় করে কলেজে পাঠায় আপনাকে শিক্ষিত বানাতে।সবার বাবা মা কষ্ট করে কিন্তু আপনার ভাই অল্প বেতনে জব করে।সেটা দিয়ে আপনারা পড়াশুনা করছেন।আপনার ভাই জানলে কতোটা কষ্ট পাবে আপনার খেয়াল আছে?"

কুঞ্জন নীরব।আসলে বলার মতো কিছু নেই।কথা গুলো সত্যি।কিন্তু ও খেতে চায়নি সেটা সত্যি।মাঝ থেকে দীপক বলল,

''ম্যাম আর হবেনা।মাফ করে দেন। "
''দেখুন সেটা হবেনা।আপনারা আগে ও এমন করেছিলেন।তখন ও সরি বলে পার পেয়ে গিয়েছিলেন।কিন্তু কুঞ্জন তো এমন করেনি আগে।আজ কি হলো ওনার?দিন গার্জিয়ানদের নম্বর। কারো কথা শুনবো না।"

কুঞ্জন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,

''ম্যাম সত্যি আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে।আমি আগে কখনো সিগারেট ধরিনি।শুধু একবার টান দিয়েছি বেশি না ম্যাম।ভাইয়া জানলে অনেক কষ্ট পাবে আমার পড়া বন্ধ হয়ে যাবে ম্যাম।"
''সেটা আপনার আগেই ভাবার দরকার ছিলো।"
''ম্যাম প্লিজ।আর হবেনা।নেক্সট টাইম এমন কিছু হলে আমি নিজেই বিদায় নেবো কলেজ থেকে।"

প্রিন্সিপালের কেন যেন মায়া হলো।তারপর ও বললেন,

''এটা লাস্ট টাইম।আর কিছু দেখলে আমি আপনার কোন কথাই কানে নিবো না।আর বাকি তিনজন গার্জিয়ানদের নম্বর দিন।আপনারা এর আগে ও এমন করেছিলেন।আপনাদের মাফ করবো না।"

কুঞ্জন বেরিয়ে দেখলো লাবনী দাঁড়ানো।কুঞ্জন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে শুরু করে।লাবনী কিছু না বলে সামনে থেকে সরে যায়।লাবনীর চোখজোড়া অশ্রু সিক্ত ছিলো।কুঞ্জন ক্লাশে গিয়ে বসলো।কিন্তু ক্লাশে মন লাগাতে পারছেনা।ওর কাজে লজ্জিত লাবনী।কাঁদছিলো ছোট মেয়েটা।এদিকে কাটাবনের একটা ফুলের দোকানে ঢুকে নিশাদ।মাথা ব্যাথা আজ ও ছাড়েনি।একপাশ ধরে আছে ব্যাথাটা। মাঝারি সাইজের একটা ফুলের তোড়া কিনে নিলো নিশাদ।ওর গায়ে জড়িয়ে আছে ধূসর বর্নের একটা শার্ট আর নীল ডেনিম প্যান্ট।ফুলের টাকা দিয়ে এসে রিক্সার জন্য দাঁড়ায়।একটা রিক্সা পেয়ে ও যায়। রিক্সায় উঠে যায় নিশাদ।সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরেই কাটাবনে এসেছিলো।কিছুক্ষনের মাঝে ইমতিয়াজের বাসায় পৌছে ও যায় নিশাদ।বিল্ডিংটা খুব সুন্দর সাজানো।নিশাদ ভাবছে এটা ইমতিয়াজদের নিজের বাড়ি।আজ ওর বোনের জন্মদিন তাহলে এতো সাজানো কেন?
নিশাদ চিন্তায় পড়ে গেলো। ভুল জায়গায় এলো না তো?নিশাদ মোবাইল বের করে ইমতিয়াজের নম্বরে কল দেয়।ইমতিয়াজ কল রিসিভ করে বলল,

''কিরে কই তুই?"
''তোদের বিল্ডিং এতো সাজানো।বিয়ে হচ্ছে নাকি?"
''আরে নাহ।ইদ্রির জন্মদিন তাই।তুই চলে আয়।"
''জি।"

নিশাদ ভিতরে চলে গেলো।এদিকে সেদিন সকালে বেলা পাকঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলো।তখনই ওর সামনে হেঁটে আসেন বন্দনা আখতার।বেলা ম্লান হেসে বলল,

''মা আপনি বসুন নাস্তা দিচ্ছি।"

বেলার কথায় খুব রেগে যান বন্দনা আখতার।চেঁচিয়ে উঠে বললেন,

''মরিচ বাটা গুলো কোথায় রেখেছিস?"
''মা ওগুলো ফ্রিজেই আছে।"

বেলাকে শান্ত দেখে চেঁচিয়ে উঠেন বন্দনা আখতার।চিৎকার করে বললেন,

''আর কতো আমার ছেলেকে নিজের আঁচলের নিচে রাখবি?ঠিকইতো ও আসার সাথে সাথে উঠে গিয়েছিলি।"

বেলা অবাক।ও তো উঠতে চায়নি।ওনিই নিয়ে গিয়েছিলেন।বেলা বলল,

''মা ওনাকে খুব বুঝিয়েছিলাম।জোর করে নিয়ে গেলো।"
''তোকে আমি ঠিকই চিনি।আমার নামে অবশ্যই কিছু লাগিয়েছিস।নাহলে সকালে আমাকে না বলে অফিসে চলে গেলো।"

বেলার চোখে পানি।ও বলল,

''মা এমন কিছুই হয়নি।ওনাকে কিছুই বলিনি আমি।"
_________________________________________
বেলাকে কথা বলতে দেখে তেড়ে এলেন বন্দনা আখতার।জোর চড় বসিয়ে দিলেন ওর গালে।চিৎকার করে বললেন,

''এতো বড় সাহস তর্ক করিস আমার সাথে?"

বেলা স্বাভাবিক ভাবে গালটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল,

''ওনি সকালে ভোরে চলে গিয়েছিলেন।তাই আপনাকে বলতে পারেননি।"

ওনি দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে বলল,

''আজ ও আসুক।তোকে দেখে নেবো।আমার সাথে তর্ক করা বের হবে তোর।আর আমার বোন আসবে।ওর জন্য ইলিশ আর বাটা মরিচের পাতুরি করে নিবি।"

বলেই মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলেন বন্দনা আখতার।বেলা চোখ মুছে নিয়ে ইলিশমাছ ভিজিয়ে দিলো।এই তের বছরে ওনার এমন অমেক আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে বেলা। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। কারন বিভান ওনাকে খুব ভালোবাসে।বিকেলে বন্দনা আখতারের ছোট বোন সাজিয়া খালা এলেন তার মেয়ে রুকমনী সহ।রুকমনী মেয়েটা খুব সুন্দরী।বেলাকে দেখে সাজিয়া খালা বলেন,

''এখনো এখানে আছো তুমি?তোমার ধৈর্য আছে বলতে হবে।"

বেলা মলিন হেসে বলল, 

''বিয়ে করে এসেছি এখানে মৃত্যুর আগপর্যন্ত থাকতে।আল্লাহ তা'আলা আমার সাথে যতক্ষন আছেন সব সহ্য করে যেতে পারবো বিভানের জন্য।"

বলে সরে আসে বেলা। আসলেই এই বাসায় ও এখন ও টিকে আছে ওর লোকটার জন্য।তাকে ভালবেসেই এখানে এখনো রয়েছে।এই তের বছরে কম অত্যাচার হয়নি ওর সাথে।তবে ও ভালো আছে ওর লোকটার জন্য।তখনই রুকমনী এসে বলল,

''ভাবি আসতে পারি?"

বেলা হেসে বলল,

''আসো।"
''মায়ের কথায় কষ্ট পেওনা।"

রুকমনী বেলার কাছে এসে বসে।বেলা বলল,

''কি যে বলো।ওনারা মুরব্বী।কষ্ট কেন পাবো?তা বলো কেমন আছো?"
''এই তো ভালো।ভাইয়া কই?"
''অফিসে।চলে আসবেন।"
''ভাবি খালামনি তোমাকে খুব কষ্ট দেয় তাইনা?"
''দেখো ওনি আমার শাশুড়ী।বকা ঝকা দিতেই পারেন।সমস্যা নেই।"

রুকমনী হাসে।অন্তত বেলার কষ্ট কিছু টা হলে ও বুঝে ও।তবে এতো বছর বেলা কিভাবে এসব সহ্য করছে ভাবতেই অবাক লাগে ওর।বেলা ওর ঘোর কাঁটিয়ে বলল,

''অতো ভাবতে গেলে যুগ পেরিয়ে যাবে।চলো তোমাদের খাবার দেই।"

রুকমনি হেসে বেরিয়ে গেলো বেলার সাথে।এদিকে কুঞ্জন কলেজ থেকে আসার সময় লাবনী কে খুব বুঝায়।লাবনীর ভীষন মন খারাপ ছিলো।তারপর ও ভাইয়ের কথা চিন্তা করেই চুপ রইলো।অবশ্য ওরা ঘরে ফিরে নিশাদ কে পায়নি। বাবা ঘুমোচ্ছিলেন।কুঞ্জন কোন রকম খেয়ে শুয়ে থাকে।।কেন যেন খাওয়াটাও গলা দিয়ে নামছিলো না।প্রচন্ড অস্বস্তি কাজ করছিলো নিজের ওপর।নিশাদ ইমতিয়াজের সাথে বসে আছে।ইমতিয়াজ বলল,

''না করলাম তোরে গিফট কিনতে।ফুল আনতে গেলি যে?"
''আরে ও তো ছোট বোনের মতো।ওর জন্মদিনে খালি হাতে কি করে আসবো?"
''হুম।"
''তা ইদ্রি কই?"
''ও আছেই এখানে।দাঁড়া ডেকে আনি।"

ইমতিয়াজ উঠে চলে গেলো কই যেন।নিশাদ বসে ফুল গুলো দেখছে।এদিকে বিভান রাতে ফিরে আসে ঘরে।তখন রুমে বেলা আর রুকমনী গল্প করছিলো।বিভান রুমে ঢুকে রুকমনীকে দেখে বলল,

''বেলা খালা এসেছে?"

বেলা দরজায় তাকিয়ে বিভানকে দেখে বলল, 

''বিকেলে এসেছে।যান গিয়ে দেখা করে আসুন।"
''এখন না।আমার ফ্রেশ হতে হবে।"

রুকমনী উঠে বিভানকে জড়িয়ে ধরে বলল,

''ভালো আছো ভাইয়া?"
''হ্যা তুই কেমন আছিস?"
''আলহামদুলিল্লাহ। খেয়েছো?"
''নারে।আজ ঘরে খাবো।"
''ওহ।"

সরে এলো রুকমনী বেলা আর বিভানকে একবার দেখে বলল,

''তাহলে তোমাদের একা ছেড়ে দেই।অনেক কাজ থাকতে পারে।"

বলেই বেরিয়ে গেলো রুকমনী।ও চলে যসওয়ার পর বেলা বিভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

''মাকে না বলে অফিসে গেলেন কেন?"
''সকালে কাজ ছিলো।কেন কিছু হয়েছে?"
''না মায়ের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।আপনি গিয়ে দেখা করে আসুন।"

বিভান এগিয়ে এসে বেলাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ ঘষে নিতে নিতে বলল,

''আগে একটু ভালবেসে নেই তারপর।"

বেলা বিভানকে সরাতে একটু ধাক্কা দিচ্ছিলো।বিভান ওকে আরো শত করে ধরে বলল, 

''কেন এমন করছো বেলা।সারাটাদিন দেখিনা তোমাকে।আর এখন সরিয়ে দিচ্ছো।"
''মাত্র বাহির থেকে এসেছেন।গায়ে ধুলাবালি আছে।গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে দেখা করে আসুন।"

বিভান যেন বেলার কথা শুনতে পাচ্ছেনা।বেলাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ওর ওপর আলগা হয়ে শুয়ে পড়তেই বেলা বলল,

''পাগল হয়ে গেলেন?যান ফ্রেশ হয়ে নিন।"

বিভান বলল,

''দেখো আমাকে আতে ভালবাসতে দাও।তারপর সব হবে।"

বলেই বেলার অধরযুগল নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে নিয়ে নিলো।অন্যরকম অনুভূতিতে শুষে নিতে থাকলো সকল মিষ্টতা।এদিকে নিশাদের সামনে এসে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ।নিশাদ কে উদ্দেশ্য করে বলল,

''ইদ্রি ও নিশাদ।আমার ছোট বেলার বন্ধু।আর নিশাদ ও ইদ্রি আমার ছোট বোন।"

নিশাদ সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় ইদ্রিকে।এক কথায় খুব সুন্দরী ইদ্রি।চোখজোড়া বেশ বড় আর জ্বলজ্বলে।ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।গায়ে কালো গাউন জড়িয়ে আছে ইদ্রি।বেশ দামীই লাগছে কাপড়টাকে।নিশাদ মুচকি হেসে ফুলপর তোড়াটা এগিয়ে  বলল,

''হ্যাপি বার্থডে ইদ্রি।"

নিশাদ কে অবাক করে দিয়ে ইদ্রি তোড়াটা হাতে নিয়ে বলল,

''ওয়েলকাম।থ্যাংক ইউ বাকেটটার জন্য।ফুল আমার খুব পছন্দ।"

নিশাদ মুচকি হেসে রইলো তবে কিছু বললনা। ইদ্রি হয়ত আশা করেছিলো নিশাদ কিছু বলবে তবে নিশাদ ওর সামনে থেকে চলে গেলো।

!!!!

ইমতিয়াজ নিশাদকে নিয়ে গল্প করছিলো।অনেকটা সময় পার হয়ে যায়।এরই মাঝে ইমতিয়াজের মা সৈয়দা বেগম এসে বললেন,

''কিরে ছেলেটা কখন আসলো তুই না খাওয়ায় গল্পই করাবি?"

ইমতিয়াজ বলল,

''মা ও ব্যাস্ত মানুষ।দেখাই হয়না।চল নিশাদ খেয়ে নে।"

নিশাদ বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,

''আন্টি সমস্যা নেই।আমার নিজের ও খিদে নেই।"

সৈয়দা বেগম বললেন,

''তোমার চোখ এমন লাল কেন বাবা?শরীর ভালো না?"
''না আন্টি আসলে মাইগ্রেন হচ্ছে কাল থেকে।এখন ও ব্যাথা হচ্ছে।"
''ওহ। মাইগ্রেন খুব বাজে।যাই হোক খেতে আসো।তোমার জন্য চায়ের ব্যাবস্থা করবো।"
''জি ধন্যবাদ।"

ইমতিয়াজ নিশাদকে নিয়ে খেতে চলে গেলো।ইমতিয়াজের একপাশে ইদ্রি বসেছে আর অপরপাশে নিশাদ।ইদ্রি খেতে খেতে বলল,

''ভাইয়া তোর বন্ধু শুকনা পোলাউ খাচ্ছে।"

বোনের কথায় ইমতিয়াজ পাশে তাকিয়ে বলল,

''আসলেই তো।কি দিবো তোকে?"

নিশাদ নিষেধ করলো।ও বলতে লাগলো,

''শুকনা খেতে ভাল লাগে।কিছু দিসনা।মাছটাই শেষ হয়নি।"

ইমতিয়াজ কিছু না বলে জোর করে মুরগীর রোস্টের রানের পিস আর ঝোল দিয়ে নিশাদের পাতে।নিশাদ বলল,

''ইমতিয়াজ এতো খেতে পারবো না।"

পাশ থেকে বলল,

''খেয়ে নিন।ডাবর পুদিনহারা আছে।"

নিশাদ ইদ্রির দিকে না তাকিয়ে ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,

''আরে না।আমার পোলাউটা তেমন পছন্দ না।বেশি খেতে ও পারিনা।"

ইদ্রি এবার সরাসরি নিশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

''কি পছন্দ আপনার?"

নিশাদ কিছুটা অস্বস্তির হাসি হেসে বলল,

''তেমন কিছুনা। প্লেইন রাইস।"

ইমতিয়াজ মাঝ খান থেকে বলল,

''ইদ্রি ওর খিচুরী খুব পছন্দ ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে।"

নিশাদ ধীরে বলল, 

''টেস্ট চেঞ্জড।এখন ওগুলো খাওয়া হয়না।"

ইদ্রি কিছুটা অবাক করা চাহনিতে নিশাদ কে দেখছে।অর্থহীন এক চাহনি ওর চোখজোড়ায়।ঠোঁটে অদ্ভুত নেশা লাগানো হাসি।খাওয়ার পর ও ইদ্রি নিশাদ আর ইমতিয়াজকে ছাড়েনি।ওদের সাথেই গল্প করছিলো।ইদ্রি বলল,

''ভাই কম্পিউটার শিখতে চাই।"

ইমতিয়াজ হেসে বলল,

''আমাদের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আছেন।তোকে শিখিয়ে দেবে।"

নিশাদ কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,

''কি বলিস?আমি কিভাবে?"
''আরে শালা।তুই ইঞ্জিনিয়ার মানুষ তোর চেয়ে ভালো কি কেউ শিখাতে পারবে?"
''তারপরও ইমতিয়াজ আমার অফিস আছে।তুই জানিস।"

মাঝ থেকে ইদ্রি বলল,

''আপনি কি মানা করছেন আমাকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব?"

নিশাদ এবার প্রচন্ড অবাক।মেয়েটা ওর সাথে এভাবে কথা বলছে যেন ও ওর ভাইয়ের বন্ধু না তবে মেয়েটার কথায় একই সাথে লজ্জায় আর অস্বস্তি বোধ ও করছে।ইদ্রি এখন ও মায়াবী চোখে নিশাদ কে দেখছে।মেয়েটার চোখজোড়া জ্বলজ্বলে।নিশাদ তাকাতে পারেনা।ইমতিয়াজ বলল,

''আরে শিখিয়ে দে না।আমাদের ও গল্প হবে।তুই যখনই ফ্রি হবি চলে আসিস।"

ইমতিয়াজের কথা শেষ না হতেই ইদ্রি বলল,

''আ'ম অলওয়েজ ফ্রি ফর ইউ।"

কথাটা যেন কেমন শুনা গেলো নিশাদের কাছে।মেয়েটা ওর ভাইয়োর সামনে এভাবে কথা বলছে কেন?এদিকে ইমতিয়াজ বোনের কথায় অবাক হয়ে বলল,

''কি বলছিস তুই?"

ভাইয়ের কথায় ইদ্রি হেসে উঠলো।শব্দ করে হাসছে ও।নিশাদ আর ইমতিয়াজ বেশ অবাক দুজনেই।হাসি সামলে ইদ্রি বলল,

''মজা করছিলাম।ডোন্ট গেট মি রং।প্লিজ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শিখাবেন আমাকে।"

নিশাদ না করতে পারেনা।ইমতিয়াজ ও বারবার বলছে।তাই ও বলল,

''চেষ্টা করবো আমি।"

ভয়ার্ত কন্ঠে কথাটা বলে ইদ্রিকে দেখে নিলো নিশাদ।ইদ্রির ঠোঁটে ও হাসি ফুঁটে গেছে।নিশাদ বেরিয়ে এলো।যতটা সময় ইদ্রি ছিলো ততক্ষন বেশ অস্বস্তিকর অনুভূতি করছিলো নিশাদ।কেন যেন মেয়েটা ওকে উদ্দেশ্য করে অনেক কিছু বুঝাতে চাইছিলো।নিশাদের লজ্জা হচ্ছিলো ইদ্রির দিকে তাকাতে।ওর সাথে কথা বলতে।ওকে কম্পিউটার শিখাতে হলে ওর সাথে অনেকটা সময় পার করতে হবে।
নিশাদের মাথা প্রচন্ড জ্বলছে।একটা পাশ ধরে আছে
হঠাৎ ওর নম্বরে কল এলো সাঁঝের নম্বর থেকে।নিশাদ নাক টেনে কল রিসিভ করতেই সাঁঝ বলল,

''ভাই মাথা ব্যাথা কমেছে?"
''নারে।কিছু লাগবে?"
''আরে নাহ এমনি।কই তুই?"
''রাস্তায়।বেশি সময় লাগবেনা।কুঞ্জন কই?"
''বাসায়।আজ না কোথাও বের হয়নি।"
''ওহ ভালো হলো।তোর খাইলি?"
''হুম।আম্মার পায়ে খুব ব্যাথা।আমি তেল মালিশ করে দিবো।"
''এই না আমার ড্রয়ারে মুভ ক্রিম আছে লাগায় দে।"
''আচ্ছা ভাইয়া রাখি।"
''ওকে।"

নিশাদ ফোন কেঁটে হাঁটতে শুরু করে।এদিকে রাত একটায় নিভান বেরিয়ে আসে গোসল সেড়ে।শরীর টা বেশ ফুরফুরা লাগছে।বেরিয়ে এসে দেখলো খালা ঘুমাচ্ছে।বিভান পানি খাওয়ার জন্য বেরুতেই বন্দনা আখতারকে দেখে একটু হাসলো।ছেলে কে দেখে কিছুটা অভিমান করে এগিয়ে এলেন ওনি।বললেন,

''বাহ ঘরে এসেই রুমে।তোর একজন মা ও আছে তোর সেদিকে খেয়াল নেই?তোর খালা আসলো জানিস তো?নাকি তোর বৌ তোকে বলেই নি।"

বিভান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

''বেলা বলেছে তবে ভাবলাম ওনি টায়ার্ড সারাদিনের জার্নিতে।তাই যাইনি।"
''হোয়াট এভার!!এত টাইম রুমে কি করিস?"

বিভান চমকে গিয়ে বলল,

''মা আমি ঘুমিয়েছি।খুব টায়ার্ড ছিলাম।রুমে কি করতে পারি আমি?"
''বুঝছি।সকালে খালার সাথে দেখা করবি অবশ্যই।"
''জি মা।"
_________________________________________
বন্দনা আখতার চলে যান বিভানের সামনে থেকে।বিভান ভাবতে থাকে মা এটা কি বলল?ও এতক্ষন রুমে কি করে?মা এমন প্রশ্ন আগে কখনোই করতো না।বিভান রুমে চলে আসে।বেলা চুল মুচ্ছে খাটে বসে।বিভান পাশে বসে কাঁধে নাক ছুঁইয়ে বলল,

''ভালবাসি আমার বেলা রানী।"

বেলা নিঃশব্দে হেসে বলল,

''ঘুমিয়ে পড়ুন।অফিস আছে কাল।"
''ভুলে গেলা কাল হলিডে।"
''ওহ।আসলেই মনে ছিলো না।"

বিভান বেলার শরীরের ঘ্রান নিশ্বাসে মিশিয়ে নিচ্ছে।বেলার নিশ্বাস আবার ও ভারি হয়ে আসতে থাকে।বিভান ওকে শুইয়ে দিতে নিলে বেলা বলল,

''সকালে উঠতে হবে।ঘুমিয়ে পড়ুন আপনি?"

বিভসন বেলার কাঁধজোড়া জড়িয়ে বলল,

''কিছু হবেনা আমি আছি।"
''আমার ভালো লাগছেনা এখন।ঘুম পেয়েছে।"

বেলার কথায় বিভান ওর দিকে চেয়ে কি যেন ভাবলো।বেলার জ্বলজ্বলে চোখজোড়া ওর ভিতর তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে।ওর গাল বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।বিভান পারেনা আগাতে।বেলাকে শুইয়ে দিয়ে বিভান ও শুয়ে পড়ে।বেলা আজ সারাদিনের কথা মনে করতে থাকে।একমাত্র এ মানুষটার জন্য ও এখনো টিকে আছে।বাবাকে খুব মনে পড়ে এখন।বাবার ওর সাথে থাকলে কেউই হয়ত এখন এতোটা সাহস পেতোনা ওকে আঘাত করার।মুখে হাত চেঁপে কেঁদে ফেলে বেলা।পরদিন সকাল বই নিয়ে বসে আছে নিশাদ।মাইগ্রেনের তিনদিন আজ।ব্যাথাটা কমবারই নয়।জায়গায় জায়গায় যেন কামড়ে উঠছে।তখনই আদনানের প্রবেশ নিশাদের রুমে।আদনান একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলল,

''ভাইয়া এটা খেয়ে দেখ একটু হলে ও কমবে।"

নিশাদ বিরক্ত হয়ে বলল,

''জানিস আমি ট্যাবলেট খাইনা।আচ্ছা রেখে দে।লাবনী আর কুঞ্জন কই?"
''ওরা কলেজে আর স্কুলে গেলো।"
''ওকে।তুই ভার্সিটি যাবিনা?"
''ভাই ইন্টার্নির আর কিছুদিন বাকি।তবে আজ নেই।"
''ওকে।তাহলে আমি অফিসে যাই।বাসার খেয়াল রাখিস।"

বলেই নিশাদ উঠে রেডি হতে থাকে অফিসের জন্য।বের হওয়ার সময় ট্যাবলেটটা নিয়ে নেয় নিশাদ।
অফিসে পৌছুতেই রাফিজ সাহেব বললেন,

''স্যার তোমাকে টঙ্গীর অফিসে যেতে হবে।কিছু ফাইল নিয়ে।"

বলেই অনেকগুলো ফাইল ওর হাতে তুলে দিলেন।নিশাদ বলল,

''আচ্ছা।যাচ্ছি।"

নিশাদ বেরিয়ে যেতে নিবে তখনই রাফিজ সাহেব বললেন,

''তোমার কাছে ১৫০ টাকা হবে?"

নিশাদ পিছনে ফিরে বলল,

''আমার কাছে দুইশত টাকা আছে।আমার ঘরে ও ফিরতে হবে।"
''আচ্ছা শুনো এখন আমাকে দাও।পরে নাহলে তুমি আসলে তোমাকে ব্যাক করে দেবো।"

নিশাদ কিছু বলতে পারেনা। এমনিতেই ওর এখানে অতিরিক্ত কথা বলার অধিকার নেই শক্তি ও নেই।আর কিছু বলেনা নিশাদ।
টাকাটা রাফিজ সাহেবের হাতে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিশাদ।ফাইল গুলো বেশ ভারি।ওকে বাস নিতে হবে কারন গাড়ি ভাড়া করলে পরে আসার টাকা থাকবেনা।কথা গুলো ভেবেই একটা বাসে উঠে যায় নিশাদ।একটা সিট পেয়ে বসে গেলো।ওর মাথাটা ভিতরে ভারি হয়ে আছে।ব্যাথায় টনটন করছে।বাসে প্রচুর মানুষ।ভীষন চাঁপাচাপি।কোন মতে সেখানকার কাজ সেড়ে অফিসে চলে আসে নিশাদ।রাফিজ সাহেব নেই।সে নাকি অনেক আগেই চলে গেছিলো নিশাদের বেরিয়ে যাবার পরপরই।নিশাদের পকেটে ১০ টাকা আছে মাত্র।ও কি করবে এখন?ঘরে কিভাবে পৌছাবে?কিছু কাজ সেড়ে নেয় নিশাদ।তারপর বেরিয়ে আসে ঘরে যাবার জন্য।হঠাৎ দেখলো বাস যাচ্ছে।ফার্মগেট ফার্মগেট বলে চিৎকার করছে কন্ডাক্টর। নিশাদ অপেক্ষা না করে সেটায় উঠে যায়।এদিকে সাঁঝ সেদিন রিদ্ধিদের বাসায় এলো।লিফটের সামনে দাঁড়াতেই একজন কে দেখতে পেলো ও। তবে মনে হচ্ছিলো সেদিন লিফটের লোকটাই।সাঁঝ লিফটে চাঁপ দেয়।পাশের লোকটাও ওকে আড়চোখে একবার দেখে নিলো।সাঁঝ চুপচাপ লিফটে উঠে যায় সাথে লোকটাও।লিফট ধীরে ধীরে উপরে উঠছে।সাঁঝ লোকটার ফোনে কথা বলা শুনতে পেয়ে বুঝলো এই লোক ওকে সেদিন রিদ্ধির মামা সাহেদ থেকে বাঁচিয়েছিলো।
সাঁঝ প্রচন্ড প্রয়োজন বোধ করলো ধন্যবাদ জানানোর। লোকটার ফোনে কথা বলাও শেষ।সাঁঝ কিছু বলতে যাবে তখনই লিফট বন্ধ হয়ে লাইট চলে গেলো।প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠে সাঁঝ।পাশ থেকে লোকটা ধমকে বলল,

''চুপ করুন।এভাবে চিৎকার করলে লিফট ঠিক হয়ে যাবে?"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন