পরাণ প্রিয়া - পর্ব ০৪ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___বউ সেজে বসে আছে প্রিয়তা।তবে নিজের বাড়িতে নয় নিবিড়ের বাড়িতে।জুহি একটু আগেই প্রিয়তাকে নিবিড়ের রুমে দিয়ে চলে গেলো।
প্রিয়তা রুমের চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে।এতোবড় রুম একটা মানুষের লাগে নাকি?
তবে মানুষের মন চাহিদার শেষ নেই।হয়তো একেকজনের চাহিদা একেক রকম।
কথাগুলো ভেবেই ঘড়ির দিকে তাকালো প্রিয়তা।
প্রিয়তা নিবিড়কে এখনো দেখেনি,এমনকি নিবিড়ও না।
প্রিয়তা আবারও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে বইয়ের সমাহার দেখে অবাক হলো।ওনি নাকি ব্যবসা করে তাহলে এইসব বই পড়ার সময় রাখে কখন? 

অন্ধকারে ছাদে বসে আছে নিবিড়। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে চাঁদ। আকাশে একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না।হালকা ঠান্ডা বাতাসে নিবিড়ের মনে গিয়ে লাগছে।বাবা তাঁর সাথে এমন কেনো করলো? মানুষ কী জীবনে বার বার বিয়ে করে? কেনো যে তখন জুহির কথায় ওই বাড়িতে গেলাম?যাদি না যেতাম তাহলে এখন আর আমাকে এতোবড় একটা সময়ের সামনে দাঁড়াতে হতো না।
সারাজীবন দেখে এসেছি বাবা মা কখনোই সন্তানের খারাপ চায় না।এখন আমার বাবা কোন ভালো করতে গিয়ে বয়স্ক একজন মহিলা আমার জীবনে নিয়ে এসেছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে নিবিড় ছাদেই ঘুমিয়ে গেলো খেয়াল করিনি।

প্রিয়তা বইগুলো গুছিয়ে খাটের এক কিনারায় শুয়ে পড়তেই চোখে ঘুম ধরে গেলো।সারাদিনের ক্লান্তিতে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না।
ফজরের আজান কানে ভেসে আসতেই নিবিড় চোখে খুলে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে, ফজরের আজান দিচ্ছে?
তার মানে আমি সারারাত এইখানেই কাটিয়ে দিলাম?
অচেনা অজানা একজন মহিলা আমার রুমে আছে।ওনিও নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে।যাওয়াটা কী এখন উচিত হবে? কিন্তু যেতে তো হবেই। 
নিবিড় কিছুটা সময় নিজেকে অনেক ভাবিয়ে, উঠে গিয়ে নিজের রুমের সামনে দাঁড়াতেই দেখে দরজাটা খোলা।

নিবিড় কিছুটা সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্ততবোধ করছে।তাঁর কী ভিতরে যাওয়া উচিত? ওনি কী ঘুমাচ্ছে,নাকি জেগে? 
আল্লাহ আপনি রহম করেন।যা হবার হবে কথাগুলো ভেবেই নিবিড় দরজা খুলে অবাক হলো।
দেখতে পরীর মতো একটা মেয়ে নামাজ পড়ছে।
আমি কী কোনো ভুল রুমে চলে আসলাম নাকি?
আমার বিয়েতে তো কাউকেই ইনভাইট করা হয়নি। তাহলে এতো মায়াবী এই মেয়েটা কে?

প্রিয়তা নামাজের সালাম ফিরিয়ে, নিবিড়ের দিকে চোখ পড়তেই, আসসালামু আলাইকুম।
নিবিড় নিরব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 
-আপনি ওইভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে আসুন।
প্রিয়তা নিবিড়কে দেখে ভেবে নিয়েছে এটাই তাঁর স্বামী। কারণ এই ভোর বেলা তো আর অন্য কেউ এখানে আসার কথাও না।
নিবিড় এগিয়ে এসে,আপনি প্রিয়তা?
-জ্বি।
 নিবিড় অবাক হয়ে,আপনার বয়স কত?
প্রিয়তা লজ্জিত মুখে চুপ করে আছে।
-কী হলো?  আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
প্রিয়তা আস্তে করে বললো,একত্রিশ।
কথাটা শুনে নিবিড় ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে,সত্যিই আপনার বয়স একত্রিশ? তবে দেখে তেমন মনে হয়না।তাকালেই মনে হয় বিশ একুশ বছরের যুবতী। স্যরি কথাটা আমি খারাপ কিছু মিন করে বলিনি।
প্রিয়তা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।কিছু বলার সাহস হচ্ছে না তাঁর।মনের ভেতর ভয়ের পাহাড় তৈরি হয়েছে। আর সেই পাহাড় টপকানো যে এতোটাও সহজ নয় প্রিয়তা মনে মনে ভেবেই নিয়েছে।

নিবিড় সোফায় গিয়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে,মিস প্রিয়তা,,,ওহ্ স্যরি মিসেস প্রিয়তা! আপনি ভালো করেই জানেন বিয়েটা আমি কেনো করিছি।আপনি এই বাড়িতে নিবিড়ের স্ত্রী হয়ে নয়,মোশারফ হোসেনের পুত্র বধূ এবং জুহির ভাবী হয়ে এসেছেন।কিন্তু আমার কাছে স্ত্রীর অধিকার পাবেন এই আশা করে যদি থাকেন তাহলে ভুল করবেন।আমি একটু আগে আপনার বয়স কেনো জিজ্ঞেস করলাম জানেন?
বিয়ে পড়ানোর সময় কাজী সাহেবের খাতায় আপনার বয়সটা আমি দেখেছি তাই আপনার কাছথেকে শুনে পুরোই শিউর হলাম।কথাটা বলেই নিবিড় একটুখানি থেমে আবার বললো,আপনি কী জানেন আপনি আমার তিন মাসের বড়?
কথাটা শুনেই প্রিয়তা নিবিড়ের দিকে চোখ উঠিয়ে তাকালো।
-ওইভাবে তাকাবেন না।আমার নিজেরই লজ্জা লাগে আপনার দিকে তাকাতে।আমি কেনো বাবার কথায় আপনাকে বিয়ে করেছি জানেন? 

প্রিয়তা প্রশ্ন ভরা চোখে তাকাতেই নিবিড় বললো,আমি বাবার সাথে তেমন কথা বলি না।কারণ আমি যদি সারাদিন বকবক করি বাবা আমায় ফালতু ছাড়া কিছুই ভাববে না।তখন আমার কথার কোনো দাম থাকবে না।আমি যদি দৈনিক বাবার সাথে দশটা কথা বলি বাবা সবগুলো রাখতে বাধ্য। আমি জানি আমার বাবা যখন আপনাকে বিয়ে করতে বলেছে না করলে বাবা আমাকেই বিয়ে তো করিয়ে ছাড়তো সাথে আমার রেস্পেক্টটাও কমে যেতো।তাই কিছু না বলেই আপনাকে বিয়ে করে নিয়ে আসতে আমি বাধ্য হয়েছি।
এই রুমে আপনি আমার কাছে আসবেন না।আমার সামনে বেশি থাকবেন না।আপনাকে দেখলে আমার খুব রাগ হয়।নিজের প্রতি নিজের রাগ হয়।আপনার চেয়ে আমার পিএ তনুসাকে বিয়ে করা অনেক ভালো ছিলো।তাই আপনাকে বলছি,আপনি আপনার মতো করে চলুন আমার কোনো সমস্যা নেই।আপনার কলেজ আপনার ফ্যামিলি যা ইচ্ছে করেন।আমার কোনো প্রবলেম নেই।কিন্তু আপনিও আমার কাজ নিয়ে কখনো মাথা ঘামাবেন না।কথা গুলো আমি আপনাকে চেঁচামেচি বলতে পারতাম।কিন্তু না, আমি চাইনা বাড়ির কেউ আমার আর আপনার সম্পর্কে কখনো বাজে মন্তব্য করুক।যতটা সময় বাহিরে মানে আমার ফ্যামিলির সামনে ততক্ষণ আমরা স্বামী স্ত্রী।কিন্তু এই চার দেয়ালের ভিতরে আমরা দুজন দুই পথের মানুষ। আর শেষ একটা কথা বাহিরে কখনো আমাকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিবেন না প্লিজ।বাহিরে আমার একটা সম্মান আছে।কেউ যদি এসব জানতে পারে তাহলে আমায় নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে।
কথাগুলো বলে নিবিড় এক মুহূর্তের জন্য বসলো না।উঠে ওয়াসরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
প্রিয়তা পা পিছতে পিছতে খাটের কিনায় বসে বিছানার চাদর খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে অশ্রুগুলোকে সামলাতে চাইছে।
প্রিয়তা রাতেই এসবের জন্য যতটা প্রস্তুত ছিলো নিবিড় তারচেয়ে বেশিই বলেছে।নিজেকে শান্তনা দিয়ে,আমি কী সুখ খুঁজতে চাইছি?যদি নাই খুঁজবো তাহলে চোখ কেনো বৃষ্টি ঝরাচ্ছে?
আমার যে সুখের ঠিকানা খুঁজতে নেই।আল্লহ আমাকে খুশি হয়ে যা দিয়েছেন তা নিয়ে আমাকে ধৈর্য্য ধরে পথ চলতে হবে।

ভোরের আলো ফুটে  রোদের আলোয় ঝলমলে করছে জানালার গ্লাসে।
প্রিয়তা উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে, অজানা আশায় বুকভরা নিশ্বাস নিয়ে,কোনো একদিন নতুন করে সকাল তাঁর জীবনেও আসবে।আল্লাহ তাকে নিরাশ করবেন না।কথাটা ভেবেই জোরে নিশ্বাস ফেললো প্রিয়তা। 

নুর জাহান বেগম রান্নাঘরে মেয়েদের জন্য নাশতা বানাচ্ছেন আর গুনগুন করে কান্না করছেন প্রিয়তার জন্য। তিনি প্রিয়তার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এইটা ঠিক কিন্তু এমন বিয়ে চায়নি।যে বিয়েতে মেয়েটা কেমন আছে কখনোই জিজ্ঞেস করতে পারবে না।ইভা হাই তুলতে তুলতে উঠে এসে, মা তোমার নাশতা বানানো হয়েছে?
কথাটা বলে এগিয়ে গিয়ে নুর জাহান বেগম কান্না করছেন দেখে,কী হয়েছে মা?
নুর জাহান বেগম শান্ত গলায় বললো,কিছু হয়নি।নাশতা বানিয়ে রেখেছি খেয়ে নে।

-মা তুমি এমন ভাব করছো যেনো আমরা এই বাড়িতে এসেছি খাবারের জন্য।আমার শ্বশুর বাড়িতে খাবারের অভাব নেই যে এখানে এসে পড়ে থাকতে হবে।

নুর জাহান বেগম ইভার দিকে অসহনীয় হয়ে তাকিয়ে,তুই এমন কেনো করছিস ইভা? আমার পুরো বাড়িটা যে ফাঁকা করে দিয়ে তোদের আপদ চলে গেলো তাঁর জন্যই আমি কাঁদছি।তোদের তো কিছু যায় আসে না।

-ও চলে গেছে ভালোই তো হয়েছে মা।তাই বলে তোমাকে কাঁদতে হবে? আমরা আছি তো নাকি?

নুর জাহান বেগম ধমকের স্বরে বললো, তোর মতো ইভা হাজার খানেক থাকলেও আমার বাড়িটা পরিপূর্ণ হবে নারে।কথাটা বলেই নুর জাহান বেগম নিজের রুমে চলে গেলেন।

মোশারফ হোসেন টেবিলে এসে বসেছে নাশতা খাওয়ার জন্য। এরমধ্যে নিবিড়ও এসে বসেছে।
মোশারফ হোসেন প্রিয়তাকে নিবিড়ের সাথে আসতে না দেখে,বউমা কোথায়?  তুই একা এলি!
নিবিড় মুখে খাওয়া পুরে বললো, রুমে। 
সালমা বেগম রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে এসে বসতে বসতে,জুহি? তোর ভাবীকে ডেকে নিয়ে আয়।খাওয়ার সময় আমি ডাকাডাকি একদম পছন্দ করি না এইটা আগে জানিয়ে দিস।

জুহি এসে বিরক্তিকর গলায় বললো, মা এমন করছো কেনো? তোমার সব আইন কি সবার উপর চাপিয়ে দিবে নাকি? ম্যাডাম মাত্র এই বাড়িতে এসেছে এর মাঝেই তুমি শুরু করলে?
সালমা বেগম জুহির দিকে তাকিয়ে, আমার আলমারি থেকে একটা শাড়ি নিয়ে ওকে দিয়ে আয়।কাল থেকে একি শাড়ি পরে আছে।নিবিড়ের বাবা,, তুমি না হয় কিছুক্ষণ পরে গিয়ে বউয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে এসো।
জুহি মায়ের কথা মতো আকাশী রঙের একটা শাড়ি নিয়ে রুমে ঢুকতেই প্রিয়তা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে জুহিকে দেখে মুচকি হেসে, জুহি?

-জ্বি ম্যাডাম আমি।মা বলেছে আপনাকে শাড়িটা পরে নাশতা করতে যেতে।কাল থেকে তো একি শাড়ি পরে আছেন।আব্বু কিছুক্ষণ পর গিয়ে আপনার জন্য জামা কাপড় নিয়ে আসবে।

প্রিয়তা হাত বাড়িয়ে শাড়িটা নিয়ে,আমি কী তোমার এখনো ম্যাডাম জুহি?

জুহি আমতা আমতা করতেই প্রিয়তা আবার বললো,তুমি আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছো ম্যাডাম ডাকার জন্য?
প্রিয়তা কথাটা বলতেই জুহি প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে, আমি আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি ম্যাডাম।এই দুইটা দিন আপনার কষ্ট দেখে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কেঁদেছি।আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা যার কাছে প্রতিনিয়ত শিখার আছে।

-অনেক হয়েছে,এখন থেকে কোনো ম্যাডাম নয়,ভাবী বলবা।আর তুমি করে বলবা।আমার বোনেরা যেখানে আমায় তুই করে বলে সেখানে তুমি আমাকে তুমি করে বললে কোনো ক্ষতি হবে না।
তবে কলেজে ম্যাডাম বলেই ডাকবে।কেউ যেনো না জানে আমাদের সম্পর্কের কথা।
কথাটা বলেই প্রিয়তা গলাটা ভারি হয়ে এলো।
জুহি আমি চাইনা তোমার ভাইয়া যা বলেছে সেগুলোর অবাধ্য হতে। কথাটা মনে মনে ভেবেই মুচকি হাসলো প্রিয়তা।

জুহি আর প্রিয়তা এসেছে ড্রইংরুমে। মোশারফ হোসেন প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে, মাশাল্লাহ!  সালমা, ছেলের বউকে কতটা লক্ষ্মী দেখাচ্ছে?
বসো মা।নিবিড়ের পাশে গিয়ে বসো।
সালমা বেগম চুপ করে প্রিয়তার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন।

কথাটা বলতেই নিবিড় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে, আসো প্রিয়তা বাবা তোমাকে বলেছেন না বসতে? নাশতা করে নাও।
নিবিড় দম বন্ধ করে কথাগুলো বলতেই, প্রিয়তা নাক মুখ কুঁচকে ঘাবড়ে গেলো।হঠাৎ এতোটাই পরিবর্তন? 
প্রিয়তার ভোর রাতের কথা মনে পড়তেই হুস ফিরে এলো।
প্রিয়তা আস্তে আস্তে গিয়ে নিবিড়ের পাশে বসে পড়লো।

-বাবা আমার মনে হয় প্রিয়তা কাল থেকেই কলেজে যাওয়াটা ভালো হবে।
মোশারফ হোসেন ভ্রু কুঁচকে, কলকে যাবে মানে? বিয়ে হলো না দুইদিন এখন কলেজে যাবে? তুইও এখন অফিস ছুটি নিয়ে নে।এরচেয়ে ভালো দুজনে কোথাও গিয়ে ঘুরে আয়।

নিবিড় হতভম্ব হয়ে, বাবা আপনি কী বলছেন? আমি এখন অফিস মিস করতে পারবো না।আর আমি চাই প্রিয়তাও এখন কলেজ মিস না করুক।কিছুদিন পর না হয়ে দুজনেই ঘুরতে যাবো।

নিবিড় কথাটা শেষ করেই রুমে গিয়ে রেডি হয়ে এসে, মা আমি যাচ্ছি।প্রিয়তা আমি যাচ্ছি।মায়ের সাথে সাথে থাকবে বুজেছো?
প্রিয়তা নিবিড়কে যত দেখছে বিস্ময়ের মাত্রা যেনো বেড়েই চলেছে।এতোটা নিখুঁত অভিনয় মানুষ বাস্তব জীবনেও পারে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন