তৃষ্ণা - পর্ব ৩৩ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


অংশীর প্রেমে নতুন করে পড়ে গেলো মাহিব। অংশীর কোনো খোঁজ না পেয়ে আরো বেশি করে ওর প্রতি টান বেড়ে গেলো। যত সময় এগিয়ে যেতে লাগলো, ততই অংশীকে দেখার তৃষ্ণা বেড়ে যেতে লাগলো। মেয়েটা কোথায় আছে কে জানে! সবকিছু ছাড়িয়ে এই একটা কষ্টই ভেতরে জেঁকে বসলো। 

খেতে ভালো লাগে না, ঘুমাতে ভালো লাগে না, কোনো কিছুই মনে ধরে না মাহিবের। অংশী কেমন আছে, কোথায় আছে তা জানার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। অংশী বিয়ে করেনি এটা নিশ্চিত। কারণ প্রীতম ওকে সবটা খুলে বলেছে। প্রীতমকে ফিরিয়ে দিয়েও যে মেয়েটা মাহিবের কাছে ছুটে এসেছে, সে যে আর কারো হতে পারে না, এ মাহিব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। 
"গ্রামে সহজ সরল বোকা বোকা কিছু মেয়ে থাকে, যাদের জ্ঞানের বহর স্বল্প অথচ ভালোবাসবার প্রচন্ড ক্ষমতা এদের শিরা উপশিরায় মিশে আছে।"
 কিন্তু অংশী কোথায় আছে তা কিভাবে খুঁজে বের করবে?

তাকে দেখার জন্য চোখ জ্বলে আজকাল। দেখার জন্য আবার চোখ জ্বলে নাকি? হু জ্বলে। এ জ্বলুনি কেবল অন্তর টের পায়। কাউকে দেখবার জন্য বুকের ভেতর যে ব্যকুলতা জেগে ওঠে, সে অস্থিরতার বীজ দেহ মন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।   চোখ দুটো কেমন যেন করে।     মনে পড়ে যায় কয়েক বছর আগের সেই দিনগুলো। পাহাড়ের ভাঁজে একসাথে পা ফেলা, জংগলে একসাথে নেচে বেড়ানোর দিনগুলো। অংশী মাহিবকে ঘুরেঘুরে সবকিছু দেখাতো, কিন্তু পুরোটা সময় মাহিব কেবল অংশীর দিকেই চেয়ে থাকত। অংশীর মায়া মায়া দুটো চোখ ক্রমশ ব্যকুল করে তুলতো মাহিবকে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত, কেউ কারো চোখের দিকে তাকাতে পারতো না।  সে দিনগুলোকে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে। কত আবেগ ছিলো অংশীর, সে ভালোবাসায় কোনো খাঁদ ছিলো না। 

আবার যদি সেই সময় ফিরে আসতো। উচ্ছল মেয়েটা দূরন্তপনায় মেতে উঠতো। আগে আগে ছুটতো ও, মাহিব ছুটত ওর পিছনে। বনের মাঝখানে অংশীর সেই প্রিয় জায়গাটায় দুজনে বসে থাকতো আর হাসি গল্পে মেতে উঠতো। কতই না সুন্দর ছিলো দিনগুলি!

দুজনের একটা সুখী সংসার হতে পারতো!  ছোট্ট সোনামণিকে নিয়ে দুষ্টুমি করে দিনের সূচনা হতে পারতো। একসাথে সূর্যোদয় দর্শনও হয়তো স্বপ্নের মত লাগতো।   মাঝেমাঝে কাঁধে  মাথা রেখে আকাশ দেখা কিংবা জড়িয়ে ধরে  আলতো করে স্পর্শ করা।   খুব বেশি সুন্দর হতো রাতগুলো। একে অপরকে লতার মত পেঁচিয়ে জড়াজড়ি করে ঘুমানো।  সবটাই আজ-  "হতে পারতো!" এই দুটো শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর একটা চাপা  দীর্ঘশ্বাস।
মাহিবের কষ্ট হতে লাগলো, ভীষণ কষ্ট। অংশীকে দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো ও। আর দেরি না করে রাতের বাসে ছুটে এলো অংশীর গ্রামে। 

আমির আলী আচমকা মাহিবকে দেখে অবাক হলেন। মাহিবের চেহারার হাল দেখে ওনার অবাক হওয়া ছাড়া কিছু বাকি নেই। মাহিব ছুটে গিয়ে আমির আলীকে জাপটে ধরলো। উনি অবাক হয়ে বললেন, 'সাহেব আপনে!'

মাহিবের চোখে পানি চলে এলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো, 'অংশী কোথায়?'

আমির আলী এবার আরো বেশি অবাক হলেন। এত বছর পর অংশীর খোঁজে এসেছে তাও মাহিব! অংশী বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কেউই তো ওর খোঁজ পায় নি। উনি চোখের পলক ফেলতে পারলেন না। 

মাহিব বললো, 'অংশী গ্রামে আসে নি?'

আমির আলী যন্ত্রের মত মাথা দুদিকে নেড়ে বললেন, 'না।'

- 'ওর কোনো খোঁজ আপনি জানেন?'

- 'না।'

- 'অংশী কারো সাথে যোগাযোগ করেনি?'

- 'না।'

মাহিব মাটিতে বসে পড়লো। মনের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় বইছে। একটা অচেনা কষ্টের বৃত্ত ঘিরে ফেললো ওকে। জীবনে কত যন্ত্রণাই তো সয়েছে, কিন্তু এর মত যন্ত্রণা হয়তো কখনো টের পায় নি। রক্তে রক্তে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। হারনোর ব্যথা যে কি কঠিন!   
কিন্তু অংশী গ্রামেও আসেনি, তবে কোথায় আছে!

মাহিবকে চিন্তিত মুখে দেখে আমির আলী বললেন, 'আপনে হঠাৎ অংশীরে খুঁজতাছেন ক্যান?'

মাহিব আমির আলীর হাত চেপে ধরে বললো, 'আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি কিছু বলতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করবেন।'

মাহিব ছুটে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। গেটের বাইরে এসে অংশীর মায়ের মুখোমুখি হলো। মায়ের চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। উনি বললেন, 'আমার মেয়ে কই?'

মাহিব কোনো কথা বলতে পারলো না। উনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, 'আমার মেয়েরে কই রাখছেন?'

মাহিব কিছু না বলে দ্রুতপদে হেঁটে চলে এলো সেখান থেকে। কিইবা বলার থাকতে পারে। অংশীর মা দূর থেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমির আলী এসে জানতে চাইলেন, 'অংশীর খোঁজ তুমি সাহেবরে জিগাও ক্যান?'

- 'অংশী সাহেবের জন্যেই বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছিল।'

- 'এতদিন আমারে কও নাই ক্যান?'

আর্তনাদ করে উঠলেন আমির আলী। ওনার স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে কাঁপতে লাগলেন ক্রমাগত। উনি বললেন, 'মাহিব সাহেব কি কইলেন আপনারে?'

আমির আলী মাটিতে বসে পড়লেন। এতদিন পর মেয়ের খোঁজ পেয়েছেন উনি। কিন্তু মেয়ের খোঁজ পেয়েও যেন পেলেন না। সবকিছু ধোঁয়ার মত মনে হতে লাগলো। চোখের সামনের সমস্ত কিছু ধীরেধীরে ঝাঁপসা হয়ে এলো। 

মাহিব বেরিয়ে এসে সোজা নদীর ঘাট থেকে নৌকা বেয়ে নদীর মাঝখানে চলে এলো। এই নদীতে কতবার একসাথে নৌকায় ভেসেছে দুজনে। কত সুখ দুঃখের কথা বলেছে। আজকাল একটা প্রশ্নই মনে ঘুরপাক খেতে থাকে-    "প্রেমটা তো সত্যি ছিলো, তবে মিথ্যে ছিলো কোনটা?" কেন ওরকম নিষ্ঠুরতা করলো মাহিব! সব ভেবে নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাতে লাগলো।

জংগলের ভেতর প্রবেশ করে দেখে সবকিছু আগের মতই আছে। চেনা জায়গাটা নতুন করে বুকে আঘাত করলো। এখানকার সবকিছুতে অংশীর স্পর্শ লেগে আছে যেন। কতবার এ পথে হেঁটেছে একসাথে। সবকিছু আজ স্মৃতি!  অংশী তুমি কোথায়?

জংগলের মাটিতে বসে অংশীর স্মৃতি আওড়াতে লাগলো মাহিব। প্রত্যেকটা গাছে অংশীর স্পর্শ খুঁজে বেড়াচ্ছে ও। মনেমনে প্রার্থনা করছে যেন অংশীর সাথে একবার দেখা হয়ে যায়, যেন অংশীর খোঁজ পেয়ে যায়। 

পাগলের মত আর্তনাদ করতে লাগলো মাহিব। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো অংশীর নাম ধরে। অংশীর সেই প্রিয় জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো। সবকিছু আগের মতই আছে। শুধু আগের চেয়ে বেশি পাতার স্তর পড়েছে মাটিতে। জায়গাটায় অনেকদিন কেউ আসে না। মাহিব অংশীর পায়ের ছাপ খুঁজতে লাগলো সবখানে। গাছগুলোকে জাপটে ধরে নখ দিয়ে গাছের চামড়া ছিলে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, 'অংশী কোথায় তোমরা জানো? জানো? আমার জানটা কোথায় আছে?আমার কলিজাটা কোথায়?'

মাহিবের কেন যেন মনে হতে লাগলো গাছগুলো ওকে অভিসম্পাত করছে। এই দিনটা দেখার জন্যই হয়তো গাছগুলো আগের মতই আছে। ওরা অপেক্ষা করে ছিলো মাহিবের জন্য। প্রকৃতি কাউকে শাস্তি দিতে ভোলে না। মাহিব মাটিতে বসে কষ্টে চিৎকার করতে লাগলো। এই চিৎকার কি অংশীর কানে পৌঁছবে?

পাহাড়ে, জংগলে সারাদিন ঘুরে ঘুরে রাত্রিবেলা জংগলেই ঘুমিয়ে পড়ে মাহিব। সারা রাত মশা ও পোকা মাকড়ের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ওর মনে পড়ে যায় অংশীর কথা। অংশী কি ওকে ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে এইভাবেই কষ্ট পেয়েছিলো! অংশীকে ফেলে আসার পর ওর মুহুর্ত গুলোও কি একইভাবে কেটেছে?

মাহিব কল্পনায় দেখতে পায় নোংরা বস্তিতে মেঝেতে শুয়ে ছটফট করছে অংশী। থেকে থেকে আর্তনাদ করছে মাহিবের নাম ধরে। হয়ত ক্ষুধার জ্বালায় কত রাত ঘুমায় নি, হয়ত মাহিবকে হারানোর বেদনায় কত অশ্রু ফেলেছে। সেসব ভেবে   মাহিব সারারাত জংগলে বসে ছটফট করলো। রাগে নিজের বুকের উপর খামচি দিয়ে দাগ করে ফেললো। তারপর ক্রমাগত আর্তনাদ করতে লাগলো অংশীর নাম ধরে। 

বিখ্যাত ফিল্ম মেকার আজ পরিত্যক্ত জংগলে পাগলামো করছে এ যেন অবিশ্বাস্য এক দৃশ্যপট। মানুষের জীবনে কখন কোন সময় আসে কেউ জানে না। জংগলে বসে ঝিঁঝিঁর ডাকে অংশীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে মাহিব। গায়ে মাটি লেগে আছে। চুল, দাঁড়ি অনেকদিন কাটা হয় না। পুরো দেবদাস বনে গেছে মাহিব আহসান। নিজের দিকে তাকাতে নিজেরই ঘৃণা জাগছে আজ। জীবনের স্রোত আজ মাহিবকে এখানে বয়ে এনেছে। যে জংগলে আর কখনো আসার কথা ছিলো না, সেখানে আজ রাত্রিবেলা পড়ে আছে একলা। বিষন্নতার চাদর ঘিরে রেখেছে বেশ ভালো করে। 

ভালোবাসা আগুন বাড়িয়ে দিয়েছে আজ। অংশীকে কষ্ট দেয়ার অপরাধে ছেলেটা নিজেই নিজেকে পোড়াচ্ছে। 

সেখান থেকে ফিরে এসে মাহিব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার, ওষুধপত্র, সেবাযত্ন অনেক কিছুর পর ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। ওকে ধরে বেঁধে চুল দাঁড়ি কেটে দেয়া হয়। মাহিবের মা সময় নিয়ে ছেলেকে পরিপাটি করে তুললেন। আবারও আগের জীবনে ফিরে এলো মাহিব। কিন্তু এখনো বুকের ভেতর বেদনার বীজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে কোনো শান্তি নেই। 

নতুন করে একটা নাটকের কাজ শুরু করতে গিয়েও করতে পারলো না। ভালো লাগে না কাজ করতে। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কেবল সিনেমা নিয়েই পড়ে থাকতে চাইলো মাহিব। সে চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। কাজে মন বসে না। 

বেশ কয়েক বছর পাহাড়ে জংগলে ঘুরে বেড়াতে লাগলো ছন্নছাড়া হয়ে। পাহাড়ের বিভিন্ন রিসোর্টে গিয়ে সারাদিন বই পড়ে আর বিকেলবেলা পাহাড়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে। রাত হলে আলো জ্বালিয়ে দু একটা গল্প লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই চলে মাহিবের একলা জীবন।

মাহিবের দুচোখে বড্ড তৃষ্ণা। এ তৃষ্ণা কাউকে দেখবার,  কাউকে কাছে পাবার, কাউকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করার। অংশীকে দেখার জন্য বুকের মাঝে কিছু একটা ঢিপঢিপ করে, কেমন উথাল পাথাল করে। সবকিছু এলোমেলো লাগে মাহিবের। কতগুলো দিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেই কেটে গেলো। দুচোখ যাকে দেখার জন্য জ্বলে যায় তাকে একটিবারের জন্যও দেখা হলো না। এরচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কি আছে!
সময় বয়ে যাচ্ছে, জীবন চলে   যাচ্ছে। শুধু বুকভরা তৃষ্ণা নিয়ে রাজ্যের সমস্ত বেদনা জড়ো করে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায় একটি মানুষ। কেউ জানে না তার বুকের ভেতর কি চলছে!  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন