নীল বর্নের পাঞ্জাবীটির কলারের বোতাম লাগাতে লাগাতে বিভান খেয়াল করলো বেলার চেহারায় ঘন কালো মেঘ জমেছে।কিছু সময় পরই অঝোর ধারায় বর্ষন হতে পারে।বিভান বেলার চেহারাটা ভালভাবে পর্যবেক্ষন করছে।বেলা গায়ে শাড়ীর আঁচল নিয়ে সেটাকে সেফটি পিন দিয়ে ভালোমতো লাগায় ব্লাউজের সাথে।ভীষন ভয় হচ্ছে।কিভাবে মুখোমুখি হবে সবার?বাবাকে কিভাবে মুখ দেখাবে ও?হঠাৎ বেলা সোফায় ধপ করে বসে হতাশ ভাবে বলল,
''আমার দ্বারা হবেনা বিভান।"
বিভান ভ্রু কুঁচকে গায়ে একটু সুগন্ধি মেখে নিয়ে বেলার পাশে বসে ওর হাত ধরে বলল,
''কি হবেনা?"
বেলা বিভানের দিকে চায় অসহায় মুখে।তারপর বলল,
''আমি কিভাবে যাবো?কিভাবে দাঁড়াবো সবার সামনে?আমার ভয় করছে খুব।"
বিভান বেলার হাত ওর হাতের ওপর রেখে বেলাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
''বেলা একটা জিনিস ভেবে দেখো যা করেছো সেটার কারনে ওনাদের কতো লজ্জা পেতে হয়েছে।বড় মেয়ে তুমি।তোমার কাছ থেকে ওনি কখনো হয়ত আশাই করেনি।ওনার মেনে নিতে কষ্ট হবে তারপর কিন্তু ঠিকই মেনে নিবে।কেন জানো?ওনি তোমাকে ভালবাসে তোমার বাবা ওনি।তুমি ভয় পেয়ে লুকিয়ে থাকলে চলবেনা বেলা।বুঝাতে হবে ওনাদের।"
বেলা বিভানের হাত জোর করে ধরে বলল,
''বিভান ভয়টা হলো বাবা ভারতীয়দের পছন্দ করেননা।কারন দাদা ভারতে বিজনেস করতো।ওখানে ওনাকে খুন করে মারা হয়েছিলো।তাই বাবা ভারতীয়দের সহ্য করতে পারেনা।"
বেলার কথায় বিভানকে অনেকটাই চিন্তিত লাগছে।বেলা ও চুপ হয়ে গেলো।বিভান বেলার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়।বেলার মনে হচ্ছিলো হয়ত সে যাবেনা।হয়ত কাপড় পাল্টাবে।কিন্তু বেলা কে অবাক করে দিয়ে বিভান বলল,
''উঠো।বের হতে হবে।"
''আপনি যাবেন?"
''দেখো বেলা তুমি ঠিক থাকলে সারা দুনিয়াকে বুঝাতে পারবো।"
বেশ গম্ভীর ভাবে কথা বলে পায়ে জুতা চাঁপে।বেলা অবাক দৃষ্টিতে বিভানকে দেখছে।লোকটা কেমন যেন?খুব বেশি ভালো? বেলার ভয় হয় মাঝে মাঝে।বিভান কে হারিয়ে ফেলবে না তো?বিভান বেলার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে বলল,
''চলো।"
বেলা উঠে দাঁড়ায়।এদিকে সাঁঝের পুরো গা কাঁপছে সকাল থেকে।যখন আপা আর ভাইয়া আসবে ঘরে কেয়ামত শুরু হবে।আব্বা আর ভাইয়া দুজনেই আছে।সকাল থেকেই বেশ অস্থিরতা কাজ করছে সাঁঝের।এদিকে ওদের আসার কথায় জুলেখা বানু একটু রান্না বান্না ও করেছেন।যদি ওনার বড় মেয়েকে মেনে নেয় তাহলে কিছু খাওয়াতে হবে নতুন জামাইকে।সকাল থেকে ইকরাম রাহমান কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন এতো ভালো রান্না কেন হচ্ছে?বড় মেয়ে চলে যাওয়ার খুশিতে নাকি?তিনি এমনটা ও বলেছিলেন,
''মাইয়া লজ্জা দিয়া গেছে গা।আর তোমার ভালো ভালো রানতে মন চাইতেছে।"
জবাবে কিছু বলতে পারেনি জুলেখা বানু।পাকঘরে দাঁড়িয়ে কান্না করতে থাকেন খুব।এমন কেন হলো ওদের সাথে?পোলা পাইনগুলারে খারাপ শিক্ষা তো দেয় নাই।তাহলে বেলা কেন চইলা গেলো?না জানায় কেন গেলো?ঘরে জানাইলে পারতো।আদনানের বাহিরে ফুটবল খেলা আছে।ও অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলো।সাঁঝ বারবার মেইন দরজার সামনে হাঁটছে।কি হবে বাসায় আজ?বাবা কি আপা আর ভাইয়াকে খুব অপমান করবে?আপা কে কি ঘর থেকে বের করে দিবে?আপাকে যদি মেনে নেয় খুব ভালো হবে।অন্তত আপা খুশি থাকবে সাথে বাসার সবাই।জুলেখা বানু সাঁঝ কে এসে ফিসফিসিয়ে বললোন,
''আহে নাই?"
''না আম্মা।"
''আইচ্ছা।"
টলতে টলতে আবার ও পাকঘরে চলে যান জুলেখা বানু।হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠে।সাঁঝ দরজার ছিদ্রে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় বেলাকে।সাথে বিভান ও আছে।সাঁঝ দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছে।কারন একটু পর ঘরে কি হতে পারে সেটা ওর ধারনার ও বাহিরে।সাঁঝ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তখনই ইকরাম রাহমান এসে দাঁড়ান।ওনি রেগে আছেন।তারপর চিৎকার করে বলেন,
''জুলেখা কে আইছে দরজা খুলেনা কেন?"
পাকঘর থেকে মা দৌড়ে এসে বললেন,
''কিরে সাঁঝ খুল।কে আইছে?"
সাঁঝ ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে।ইকরাম রাহমান সামনে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেননা। বেলা ভিতরে প্রবেশ করে সাথে বিভান ও তবে বেলার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।বেলা সবাইকে দেখছে জ্বলজ্বলে চোখে।ইকরাম রাহমান কে খুব বেশি রাগান্বিত দেখাচ্ছে।জুলেখা বানু এসেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন।বেলা ও কাঁদছে মাকে ধরে।মায়ের কান্নার শব্দে ভিতর থেকে নিশাদ হুমায়রা আসে।হুমায়রা বেলা কে দেখে খুশি হয়ে চিৎকার করে বলল,
''আপা!!"
বিভান সেদিকে তাকিয়ে নিশাদ আর দুটো বাচ্চাকে দেখে একটু হাসে।নিশাদ রেগে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।বেলা মায়ের থেকে সরে এসে বাবার পায়ের কাছে বসতেই সরে যান ওনি।বেলা উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
''আব্বা মাফ করে দেন আমাকে।আমি খুব লজ্জিত।আব্বা কিছু বলেন।সত্যি আমার ভীষন খারাপ লাগছে আপনাদের অপমান করে।আপনাদের বেলাকে আপনি চিনেন।"
পাশ থেকে নিশাদ বলল,
''সব কিছুতে সরি বললে হয়না।আপনি যেটা করেছেন অপরাধ ঘোর অপরাধ হয়েছে।"
বেলা অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে চেয়ে বলল,
_________________________________________
''এভাবে কথা বলছিস তুই নিশাদ?"
''তো কিভাবে বলবো?আপনি চলে যান।এখানে আপনি কেন এসেছেন জানিনা তবে লাভ নেই।"
এরইমাঝে আদনান ঘরে ঢুকে বিভানকে দেখে বলল,
''ভালো আছেন?"
বলেই সামনে তাকায় আদনান।নিশাদের কথায় খারাপ লাগে ওর।তবে কিছু বলেনি।বিভান একটু হেসে বলল,
''ভালো।তোমরা?"
''এইতো।"
বলে ভিতরে ঢুকে আদনান।বেলার চোখের পানি ভারি হচ্ছে ক্রমশ। ও বলল,
''নিশাদ তুই আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝিস।এভাবে কেন বলছিস?"
''আগে জানতাম।তখন আমার বোন ছিলেন।এখন আপনি আমাদের জন্য মিঃ বিভান শেখের স্ত্রী যার সাথে আমাদের পরিচয় নেই।"
বেলা কিছু বলতে গিয়ে বাবার পানে চায়।ওনি কিছুই বলছেননা শুধু একদিকে তাকিয়ে আছেন।ওদের কথায় বিভানের মনে হলো ওরা বেলাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলছে।বিভান কি বলবে বুঝতে পারছেনা।একে তো বাংলা পারেনা তার ওপর বেলার বাবা নাকি ভারতীয়দের ঘৃনা করেন।বিভানের চুপ থাকা টাই ভালো মনে হলো।বেলা কেঁদে কেঁদে বাবাকে বলল,
''বাবা আমরা তোমার সন্তান।তুমি আমাদের ভুল হলে মাফ করে সেটাকে শুধরে দিবে।বাবা তুমি কিছু বলো প্লিজ।"
জুলেখা বানু কান্নার স্বরে স্বামীকে বললেন,
''কিছু কওনা কেন?মাইয়াডারে কষ্ট দিওনা।ছুডো মানুষ বুঝবার পারে নাই।"
ইকরাম রাহমান এতক্ষনে মুখ খুললেন।ওনি বললেন,
''কিছুই কওনের নাই আমার।তেইশ বছর যাবৎ খাওয়ায় পড়ায় বড় করার যদি এই ফলাফল হয় তাহলে কিছুই কওনের নাই।হে নিজের পছন্দের বেডারে বিয়া করছে।নিজের খেয়াল খুশি মতো করছে।নিজের রাস্তা নিজেই বাইচ্ছা লইছে।অহন মাফ চাইতে আইছে কেন?আমি ভাইবাই লইছিলাম আমার মাইয়া মইরা গেছে।সেদিন যেদিন চইলা গেছে আমার কপালে জুতার বাড়ি দিয়া।যে দেশ আমার বাপরে কাইড়া নিয়া গেছে হেই দেশের বেডারে বিয়া করছে।কিছুই কমুনা।এখন খালি জানি আমার ছয় পোলাপাইন।"
জুলেখা বানু কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
''এমন কইওনা।আমাগোরই মাইয়া।বড় জামাইরে আদর যত্ন করবা আর তুমি খারাপ কতা কইতাছো।"
''যেখানে আমার মাইয়াই নাই সেহানে জামাই কিসের?আর একবার যদি এহানে এই মাইয়ার নাম উডে মনে করবি আমি মইরা গেছি।"
কথা টা বলে ইকরাম রাহমান যেতে চাইলে বেলা গিয়ে বাবার পা চেঁপে কাঁদতে শুরু করে।
''আব্বা প্লিজ এমন করবেননা।আমাকে মাফ করে দেন আব্বা। ভুল হয়ে গেছে আমার।আমি তো আপনার মেয়ে আব্বা। বিভান অনেক ভালো।দাদার মৃত্যুর পিছে ওনি দায়ী নন।আব্বা প্লিজ বুঝার চেষ্টা করেন।"
ইকরাম রাহমান কিছু না বলে বেলাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বেরিয়ে যান।বেলা পড়ে যেতে দেখে বিভান আর জুলেখানু এগিয়ে আসেন।বিভান ওকে তোলার সময় নিশাদ বলল,
''মিঃ বিভান আপনাকে দেখে প্রথমে বুঝে যাওয়া উচিৎ ছিলো আমাদের সংসার নষ্ট করতে আসছেন।দুই বোনের মাথা খারাপ করে দিলেন।"
বিভান মুচকি হেসে বেলাকে দাঁড় করিয়ে বলল,
''ভালবাসা যদি অপরাধ তাহলে সেই অপরাধী হতে সমস্যা নেই আমার।আর কখনো ভেবে আসিনি বেলার মতো জীবনসঙ্গীনি পাবো।তবে আমি ধন্য বেলাকে পেয়েছি।"
নিশাদ রেগে বলল,
''এত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে আসবেননা মিঃ বিভান।"
''মিষ্টি কথা বলছিনা যা সত্যি তাই বললাম।"
নিশাদ আবার কিছু বলতে গেলে বেলা বলল,
''নিশাদ কিছু বলবি না ওনাকে।আমি বেরিয়েছি নিজের ইচ্ছায় ওনি জানতোনা।আর তুই যাকে এভাবে বলছিস সে আমার হাজবেন্ড।"
নিশাদ বলল,
''সেটা আপনার আমাদের কিছু নয়।আর এখানে অতিরিক্ত সময় নষ্ট না করে চলে যান আপনার এই হাজবেন্ড কে নিয়ে।"
ছেলের এমন আচরন মেনে নিতে পারছেননা জুলেখা বানু।রেগে বললেন,
''এতো বেয়াদবী করতেছোস কেন নিশাদ?তোর আপার লগে এভাবে কথা কস কেন?"
জবাবে নিশাদ বলল,
''এটা ওনাদেরই তৈরি করা।"
বলে ভিতরে ঢুকে যায় নিশাদ।আদনান ও চলে গেলো।সাঁঝ কেঁদে ফেলেছে।বিভান কে বলল,
''ভাইয়ার কথায় কিছু মনে করবেননা। ভাইয়া মন থেকে বলেনি।আপনি আপা কে ভালো রাখবেন।কখনো আমাদের অভাব বুঝতে দিয়েননা।"
বিভানের চোখে পানি। ও বলল,
''সাঁঝ কেঁদোনা তোমার বোন ভালো থাকবে।"
বেলা সাঁঝকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে।বিভান মা কে পা ধরে সালাম দিলে জুলেখা বানু বললেন,
''আব্বা আমার কথা বুঝবানা জানি।কিন্তু তাও কইতাছি মাইয়াডারে ভালো রাইখো।কষ্ট দিওনা আব্বা।আমার মাইয়াডা খুব ভালা।"
বিভান কিছু বলতে পারেনি জবাবে।শেষে বেলাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে বিভান।পুরো গাড়িতে কেঁদেছে বেলা।চিৎকার করে কেঁদেছে সারাদিন।বিভান বুঝতে পারছে বেলার কতোটা খারাপ লাগছে।বিভানের বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে।এসবের জন্য কি ওই দায়ী?রাতে বেলা একটু শান্ত হয় তবে কিছুই যায়নি ওর পেটে।চোখের কোনা ভিজে আছে।চোখজোড়া খুব ফুলে গেছে।বিভান বেলার পাশে বসে ওকে বসিয়ে বলল,
''বেলা খেয়ে নাও।শরীর খারাপ করবে।"
বেলার চোখ নিথর হয়ে আছে।প্রান নেই সেই চোখজোড়ায়।কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
''সব হারিয়ে ফেলেছি বিভান।ভালবাসা পেতে গিয়ে বাবা মা ভাইবোন হারিয়ে ফেললাম।"
বিভান বেলার কথায় কিছু বলতে পারেনি।বেলা আবার ও বলল,
''আপনি খেয়ে নিন।আর যত দ্রুত পারেন আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যান।যতোদিন থাকবো ধুকে ধুকে মরবো।সবাইকে দেখতে হবে।আমাকে দেখলে ওনাদের কষ্ট হবে।আমি সেটা চাইনা বিভান।"
!!!!
সারারাত ঘুমাতে পারেনি বেলা।বুকটা ভার হয়েছিলো কেমন যেন।সারারাত এপাশওপাশ করতে করতে পাশের ঘড়িটা চেক করে বেলা।গভীর রাত এখন।বাহিরে কুকুরের ভয়ানক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।বেলা পাশে তাকিয়ে বিভানকে দেখতে পায়।বেঘোরে ঘুমুচ্ছে সে।বেলা ঘুমুতে চেষ্টা করে।কিন্তু বারংবার বাবা আর নিশাদের বলা কথা গুলো মনে পড়ছে।আসলে কি সব হারিয়ে ফেলেছে ও?এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে আজ বাবা ভাই ও পরিচয় দিতে চায়না।একটা সময় এই মানুষ গুলো কতোটা অাপন ছিলো।ওর দুনিয়া বলতে এই মানুষ গুলোই ছিলো কিন্তু সব পাল্টে গেছে।বেলা বিভানের দিকে ফিরে শোয়।লোকটাকে ও কথা শুনতে হয়েছে ওর কারনে।সে তো ভুল করেনি। তাহলে তাকে কেন অপমানিত হতে হলো?বিভানকে কিছুসময় দেখে বেলা উঠে বসে।চোখজোড়া ভিজে আসে বেলার।মানুষগুলোর দেখা আর পাবে কি?নাকি দূরে সরে যেতে হবে।আজ নিশাদ আর বাবার রাগ অভিমান দেখতে পেয়েছিলো বেলা।সবাইকে খুব লজ্জা দিয়েছে ও।খুব অপমান হয়েছিলো বাবার ওর কারনে।ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে।হয়ত পরিবারকে জানালে কিছু হতে ও পারতো।হয়ত ওদের বিয়েটায় সবাই খুশি থাকতো।কিন্তু ও সব শেষ করে এসেছে।নিজের নির্বুদ্ধিতায় পরিবারকে হারিয়ে ফেলেছে।গুঁমড়ে কেঁদে উঠে বেলা।অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।চোখ গুলো কেমন ভার হয়ে আছে।চোখের নিচটা চিটচিটে হয়ে আছে।চোখে পানি দিয়ে এলে মন্দ হয়না।বেলা খাট থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দেয়।চোখদুটো অস্বাভাবিক রকমের লাল হয়ে আছে।আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছে বেলা।সবার শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে ও।নিজের ওপর রাগ লাগে বেলার।চটজলদি বেরিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ওর পেটের ওপর বিভান নিজের এক হাত রাখে আর বেলার কাঁধের ওপর মুখ নিয়ে ওর ঘাড়ে নাক রেখে লম্বা নিশ্বাস নিতে থাকে।বেলার শ্বাস প্রশ্বাস ভারি হয়ে আসতে থাকে।অজান্তেই ওর পেটের ওপর রাখা বিভানের হাতটাকে খাঁমচে ধরে বেলা।বিভান বেলার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।বেলা অপর হাতে বিভানের গায়ের শার্ট খাঁমচে ধরে।বিভান বেলার গলায় ঠোঁট ছুয়ে দিতে থাকে।বেলা যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে গেছে।অনুভূতির জগতে।বিভান বেলার গলায় চুমু খেতে খেতেই বলল,
''বেলা এ কেমন মিষ্টি ঘ্রান তোমার ঘর্মাক্ত শরীরে?পাগল হয়ে যাচ্ছি।"
বেলার নিশ্বাস খুব দ্রুত পড়ছে।বিভানের বলা কথাটি কানে আসতেই বেলার মুখ লাল হয়ে আসে লজ্জায়।বিভান মুখ উঠিয়ে বেলার গালে চুমু দিয়ে আবার ওর গলায় মুখ নামিয়ে আনে।বেলার ভয় লাগছে কেমন যেন।এর আগে ও ওরা কাছাকাছি এসেছিলো তবে আজকের ছোঁয়াটা একদম নেশাজড়ানো।বেলা নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা।বিভানের প্রত্যেকটা ছোঁয়া ওকে পাগল করে তুলছে।
বেলার পেট থেকে বিভানের হাতটা উপরে উঠতে থাকে।একসময় বেলার ব্লাউজের ছোঁয়া পেয়ে হাত টি থেমে যায়।একপর্যায়ে সরে যায় হাতটি।বিভান সরেনি এখনো।তবে ঘুমন্ত কন্ঠে বলল,
''বলেছিলাম সময় দিবো।"
বেলার চোখজোড়া খুলেনি তবে বিভসনের ছোঁয়াগুলো থেমে যাওয়ায় কিছুটা রাগ হয় ওর।নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চায় বেলা।ওর গলা কাঁপছে।বিভানের শার্ট থেকে বেলার মুঠ করা হাতটি খুলে আসে।বেলা কাঁপুনে কন্ঠে বলল,
''সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনার।"
''বেলা আমি আমাদের দুজনকে সময় দিতে চাই।"
''এভাবে পাগল করে সরে যাবেন কেন?আপনার স্ত্রী আমি।কিসের সময়ের কথা বলছেন বুঝতে পারছিনা। "
বিভানের মুখে হাসি।বেলার ঠোঁটে আলতো করে বুড়ো আগুল ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
''বেলা এখন আমরা স্বামী স্ত্রী হওয়া সত্বেও একে অপরের কাছে সম্পূর্ণ পরিচিত হতে পারিনি।তুমি আমাকে পরিপূর্ণ ভাবে বুঝো আমি ও তোমাকে বুঝতে চাই।তারপরই সব হবে।"
বেলা বিভানকে নিজের দিকে টেনে আনে।তারপর অস্থির কন্ঠে বলল,
''এখানে বুঝাবুঝির কি হলো?আমি আপনার স্ত্রী।বিভান প্লিজ সরে যাবেননা।"
''বেলা বুঝাবুঝির প্রয়োজন আছে।এই মিলন টা শুধু আমাদের শরীর না মনকে ও এক করবে।যেখানে আমরা একে অপরের মন কে বুঝবোনা সেখানে আমাদের মন কিভাবে এক হবে বলো?"
বেলা অবাক দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখতে থাকে।খুব সুন্দর করে বোঝায় সে।তবে বেলার কিছুই বুঝতে মন চাইছেনা এখন।এমুহূর্তটায় লোকটাকে চায় ও নিজের করে।বেলা এগিয়ে আসে বিভানের দিকে।বিভানের গালে চুমু খেয়ে ওর সামনে আসে।বিভান বেলার গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলল,
''জানো কতো সুন্দর লাগছে তোমাকে।পূর্নিমার চাঁদ তার সম্পূর্ন আলোয় তোমাকে ভরিয়ে রেখেছে বেলা।"
''এতকিছু বলছেন তবু ও ভালবাসছেননা।"
বিভান একটু হাসে তারপর আদরে গলায় বলল,
''বেলা তোমাকে একটু আগে ও বলেছি এখনো বলছি।শরীর থেকে মনের মিলটাই দরকার।"
''আমার তো এখন আপনার ভালবাসার দরকার।"
বিভান বেলার কোমড়ে হাত রেখে বেলার চোখজোড়ায় তাকিয়ে বলল,
''ভালবাসা লাগবে?"
''হুম।"
বিভান বেলাকে টেনে বুকে নিয়ে নেয়।তারপর বলল,
''বেলা আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো।তোমাকে ভালবাসি বেলা আর ভালবাসতে ও চাই তবে এভাবে নয়।"
বেলা বিভানের শার্টের বোতাম নিয়ে খেলতে খেলতে সুধায়,
''কিভাবে?"
''একদম নিজের মতো করে।যেখানে তুমি আমার ডাকে সাড়া দেবে ঠিক আমার মতো করে।আমার ভালবাসায় নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে উজার করে দিবে ঠিক সেভাবেই।
_________________________________________
বেলার মাথায় হাত বুলাতে থাকে বিভান।বেলা একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে সাথে বিভান ও।পরদিন সকালে বেলা উঠে দেখতে পায় বিভান বসে আছে সোফায়।গায়ে শার্ট নেই একটা পাতলা গেঞ্জি জড়ানো।বেলা উঠে বসতেই বিভান বলল,
''গুডমর্নিং মিসেস।"
''গুড মর্নিং।"
কথাটা বেশ অাস্তে বলল বেলা।কেন যেন ভীষন লজ্জা হচ্ছে ওর।গতরাতের বেহায়াপনায় নিজেই বেশ লজ্জিত।ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে বেলা।তারপর ওয়াশরুমে চলে যায়।এরই মাঝে বিভানদের রুমের ইন্টারকমে কল আসে রিসিপশন থেকে।বিভান কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে কেউ বলল,
''দুজন এসেছেন আপনাদের খোঁজে।আপনি মিঃ বিভান রাইট?"
''ইয়েস।বাট কে খুঁজছে আমাদের?"
''একজন ছেলে আর একজন মেয়ে এসেছেন।নাম বলল সাঁঝ আর আদনান।"
''পাঠিয়ে দিন এক্ষুনি।"
বেলা বেরিয়ে আসে।বিভাম হেসে বলল,
''বেলা তুমি চুল আঁচড়ে নাও।জলদি।"
''জি তবে।এখানে জলদির কি হলো?"
বিভান কিছু না বলে গায়ে শার্ট জড়িয়ে নেয়।তখনই দরজায় নক পড়ে বেলা এগিয়ে যায় দরজার কাছে।বিভানের দিকে চেয়ে বলল,
''নাস্তা এসেছে বোধহয়।"
''খুলেই দেখো।"
''হুম।"
বেলা দরজা খুলে দেখলো আদনান আর সাঁঝ দাঁড়ানো।বেলা হতবাক।ও কি সত্যিই দেখছে।বেলা এবার বাহিরে তাকায়।বাবা আর নিশাদ ও এসেছে হয়ত।মা ও আসতে পারে।বেলা পিছে দেখতে দেখতে বলল,
''আর কেউ আসেনি?"
আদনান বলল,
''না আপা আমরা লুকিয়ে এসেছি।"
বেলার কান্না চলে আসে।বিভান হেসে বলল,
''কেমন আছো তোমরা?"
''জি ভাই ভালো।"
সাঁঝ হাত থেকে টিফিন বক্সটা টেবিলে রেখে বেলা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।বেলাও কাঁদছে।বিভান আর আদনান গল্প করতে থাকে।সাঁঝ সরে আসে বেলা ও চোখ মুছে নেয়।সাঁঝ কাঁদো গলায় বলল,
''আম্মা কাল অনেক আশা করে রান্না করছিলো।ভাবছে তো সব ঠিক হয়ে যাবে।বড় জামাইরে আদর করে খাওয়াবে।"
বেলা এখন ও কাঁদছে।সেভাবেই বলল,
''দোষ আমারই।না বলে এসে সব শেষ করে দিয়েছি।মাফ করে দিস পারলে।"
আদনান বলল,
''সাঁঝ আমাকে বুঝিয়েছে।আপা একদিক থেকে তোর দোষ নাই।তুই দেরি করে বুঝতে পারছোস যে বিভান ভাইকে তুই ভালবাসিস।সময়টাই ঠিক ছিলো না আপা।এখন ভাইয়া আর আব্বা একটু রাগ।এ রাগ চলে যাবে।ভাইয়া তো বাসায় তেমন কথাই বলেনা।সারাক্ষন চুপ ছিলো কাল।হুমায়রা আর কুঞ্জন কে শুধু শুধু ধমকেছে।রাগ বেশি দিন থাকবেনা। তুই চিন্তা করিসনা।আল্লাহর নাম নিয়ে ইন্ডিয়ায় যা।দোয়া করবি।"
বেলা কাঁদতে থাকে কিছুই বলতে পারেনা।আদনান এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে।ওর চোখে ও পানি।বিভানকে জিজ্ঞেস করলো
''কবে যাচ্ছেন?"
''বেলার ভিসাটা হয়ে যাক।টিকিট কনফার্ম হয়ে গেলে দেরি হবেনা।"
''আপনার কাছে তো সাঁঝের নম্বর আছে।জানিয়ে দিয়েন।এভাবেই চলে আসবো আবার।"
''অবশ্যই আসবে।"
মৃদু হাসে বিভান।আদনান আর সাঁঝ কিছুক্ষন পর বেরিয়ে যায়।যাওয়ার আগে বেলা দুজনকে ধরে খুব কাঁদে।
প্রায় সাতদিন পেরিয়ে যায় হোটেলে।এই সাতদিন ওরা একে অপরকে খুব ভালভাবে বুঝতে শুরু করেছিলো আর যতোটাই বুঝতে পারছিলো বেলা বিভান একে অপরকে যেন অনেকটা বেশিই ভালবাসতে শুরু করে।এমন কি বেলা দু তিনটে হিন্দি ভাাষা ও শিখেছিলো।এরই মাঝে বেলার ভিসা রেডি হয়ে যায় টিকিট সমেত।
পরদিন রাত নয়টায় ফ্লাইট।সাঁঝকে তা জানানো হলে সাঁঝ জানায় পরদিন স্কুল থেকে ওদের হোটেল হয়ে ঘরে ফিরবে।রাতে বেলা আর বিভান লাগেজ গোছাতে থাকে।বেলা কাপড় ভাজ করে নিচ্ছে বিভান ওর সামনে বসে নিজের কাপড় গুলো এক করছে।বেলা বিভান কে দেখে একটু হাসে তারপর আস্তে করে ডাকলো।বিভান কাপড় ঠিক করতে করতে বলল,
''এতো ধীরে ডাকছো কেন?কি হয়েছে?"
''আপনার মা আমাকে মেনে নিবে?"
বিভান কাপড় গুছানো রেখে বেলার দিকে তাকায় তারপর বলল,
''বেলা সময় লাগবে একটু।কিন্তু আমি আছি টেনশন করোনা।"
''ওনার একমাত্র ছেলে না বলে বিয়ে করেছে খুব খারাপ লাগবে ওনার।"
বিভান কিছু না বলে কাপড় গুলো লাগেজে ঢুকিয়ে নেয়।বেলা আবার ও বলল,
''একটা প্রশ্ন করি?"
''শিওর।"
''আগে কাউকে ভালবেসেছিলেন?"
বিভান চুপ হয়ে যায়। কিছুটা সময় ধরে বেলার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিল।বেলার কেমন ভয় লাগছে লোকটার তাকানোয়।লোকটা কিছু বলছেনা কেন?এতো রহস্য করার মানে কি?কিছু কি আছে সে লুকোচ্ছে।বেলা আর সহ্য করতে না পেরে বিভানের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
''কি হলো?"
বেলা অবাক করে দিয়ে হঠাৎ বিভান জোরে হাসতে শুরু করে।প্রচন্ড শব্দ হাসছিলো বিভান।একদম বিছানায় শুয়ে পড়ে।বেলার খুব রাগ হয়।এভাবে হাসার কি হলো।বেলা আবার বলল,
''কি হলো হাসছেন কেন এভাবে?"
বিভসন হাসি থামাতে পারছেনা তবে বেলার কন্ঠে ঝাঁঝ অনুভব করে নিজেকে থামাতে চেষ্টা করছিলো।বেলা আবার ও বলল,
''দেখুন হাসবেননা একদম।এমন হাসির কোন কথা আমি বলিনি।"
বিভান কোনমতে হাসি থামিয়ে উঠে বসে।এখন ও হাসি পাচ্ছে ওর।ঠোঁট চেঁপে হাসি আটকাতে চেষ্টা করছে।একটা সময় হাসি থামিয়ে তারপর মুখ খুলে বিভান।ও বলল,
''বেলা কখনো ভাবতেই পারিনি আমার জীবনে ভালোবাসা আসবে কিনা।হ্যা একজনকে ভালো লাগতো কিন্তু কখনো বলতে পারিনি।"
বেলার মুখ চুপসে গেলো।মলিন কন্ঠে সুধায়?
''কেন বলতে পারেননি?"
''সি গট ম্যারিড।"
''ওহ।"
বিভান একটু হাসে। বেলা বিভানের দিকে তাকিয়ে আছে।লোকটাকি কষ্ট পাচ্ছে সেই মেয়ের কথা মনে পড়ে?বেলার ভয় লাগছে।বিভান নিজের কাজ করেই যাচ্ছে।বেলা উঠে বারান্দায় চলে এলো।লোকটা এখন ওকে ভালবাসে আর কাউকে না।বেলার ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নেয়া উচিৎ।বেলা চোখ বন্ধ করে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়ায়।