রহিমা বেগমের শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে,,নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায় না।আমার নিজের ছেলে হয়ে ও এইসব মন-মানসিকতা নিয়ে থাকে এইটা ভাবতেই পারছেন না। নিবিড় মাকে দেখেই কুয়াশাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কুয়াশা দাঁড়িয়ে রহিমা বেগমের দিকে চোখ পড়তেই নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। নিবিড় তড়িৎ গতিতে মায়ের কাছে এসে,মা কি হয়েছে তোমার?
মা কিছু বলছে না দেখে,
মা প্লিজ তুমি আমায় ভুল বুঝ না।আমি,,,,
আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না নিবিড় তার আগেই ঠাস করে শব্দ হয়ে উঠতেই কুয়াশা মাথা তুলে তাকাল।
রহিমা বেগম কাঁদো কাঁদো হয়ে কড়া গলায় বললেন,চুপ,,,,,,একদম চুপ।আজকের এইদিনটা আমার দেখার বাকী ছিল? তুই আমায় বলতি আমি তোদের কথা তোর কাকাকে জানাতাম। তাহলে কেনো এইসব নোংরামি করছিস?
আমার নিবিড়টা কি সব ছেলেদের মতো? কিন্তু আমি তো ভাবতাম আমার নিবিড় আলাদা। ও সব ছেলেদের মতো নয়।ও ব্যাক্তিত্ব সম্পূর্ণ। কিন্তু আজ যা দেখলাম তার পরেও কী,,,,,
নিবিড় পকেটে হাত গুজে মাথাটা উপরে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটের কাছে এসে বসে পড়লো মুখে হাত দিয়ে।
রহিমা বেগম কিছু আর না বলেই নিজের রুমে চলে গেলো।কুয়াশা সেখানে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।ফজরের আজান ভেসে আসতেই নিবিড় আড় চোখে কুয়াশার দিকে তাকালো।
আজান শেষ হতেই নিবিড় তাকিয়ে বললো,কাঁদছিস কেন? এটাই তো তুই ছেয়েছিস।
আজ তোর আশা পূর্ণ হলো।
জানিস কুয়াশা, আমি চাই নি মা-বাবা কখনো আমাকে খারাপ চোখে দেখুক।কখনো কোনো মেয়ের দিকেও খারাপ চোখে তাকাই নি ভুলেও যদি কখনো চোখ পড়তো তখনই ভাবতাম আমার একটা বোন আছে।আমার মা আছে,আমার বউ হবে, আমার মেয়েও হবে।আমি যদি কোনো মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাই আমার এই মানুষগুলোর দিকেও ছেলেরা ঠিক এইভাবে তাকাবে নয়তো আরও খারাপ কিছুও হতে পারে।
বিশ্বাস কর কুয়াশা, আমি চাই নি আমার বোনটার দিকেও কেউ খারাপ নজর দিক।
নিবিড় নিজের বুকের একটা পাশ ধরে, আমি আমার বোনটাকে এখানটায় রাখি ঠিক অন্য একটা মেয়ের ভাই কিংবা বাবাও তো মেয়েটাকে এই ভাবে আগলেই রাখে,রাখে না? রাখে।
এখন যা আমার কিছু ভালো লাগছে না।
কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে নিবিড়ের পায়ের কাছে এসে বসে হাঁটুতে মাথা রেখে,তুমি কী সত্যিই আমায় বুঝতে পারো না আমি কি চাই? আমি তোমাকে জেঠি মায়ের কাছে খারাপ বানাতে চাই নি।চেয়েছি তোমার থেকে একটু ভালোবাসা পেতে।আমার মনে কোনো নোংরামি ছিল না এসেছিলাম তোমাকে দেখেই চলে যাবো।কিন্তু মনে কখন যে তোমাকে পাবার লোভ জন্মেছে বুঝতেই পারি নি।
প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও। কুয়াশা মাথা উঠিয়ে চোখমুখ মুছে, আমি এখুনি গিয়ে জেঠি মাকে সব সত্যি বলে দিচ্ছি।তবুও আমার সাথে তুমি রাগ করে থেকো না।তুমি জানো? প্রতিদিন তোমায় আমি চুরি করে দেখি।তুমি জানো, যেদিন তুমি আমায় প্রথম জড়িয়ে ধরেছিলে, ওইটা ভুলে হয়ে ছিলো তবুও তো তোমার স্পর্শ পেয়েছি তাই না?তোমার ওই স্পর্শ করা জামা আমি আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
কথাটা শুনেই নিবিড় ঘাড় ঘুরিয়ে কুয়াশার দিকে তাকালো অবাক চোখে।
তুমি জানো প্রতিদিন আমি ছাদে যাই ঠিক।বাসায় এসে একটুও ঘুমাতে পারি না।সারাক্ষণ তোমার ছবি চোখের সামনে ভেসে-বেড়ায়।কতটা রাত আমি না ঘুমিয়ে আছি তার কোনো হিসাব নেই।ভালোবাসলে মানুষ সত্যিই কী পাগল হয়ে যায়? হয়তো যায় আমিও পাগল হয়েছি।তবে শুধুই তোমার।
কুয়াশা কথাগুলো শেষ করে, উঠে দাঁড়িয়ে আমি এখুনি জেঠি মায়ের ভুল ভেঙ্গে দিচ্ছি।আমার জন্য তোমার অপবাদ হোক আমি চাই না।
কথাটা বলেই কুয়াশা উঠতেই নিবিড় হাত ধরে,তোর বলতে হবে না।মা আমার উপর রাগ করেছে সেটা আমাদের মা ছেলের ব্যাপার। তুই মাঝখানে একদম আসবি না।
-কিন্তু,,,
-নামাজ পড়ে নে।আমি মসজিদে যাচ্ছি।আর হ্যাঁ কাল তোকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল। ইচ্ছে করেই ওসব উল্টো পাল্টা কথা বলেছিলাম।
তবে প্লিজ আজ একটু কম করে সাজিস।কারণ আমি চাই না তোকে কেউ অন্য চোখে দেখুক।
কুয়াশা কিছু বলছে না। চুপ করেই নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবিড় আবার ওকে হাসানো জন্য ব্যস্ত হয়ে, আমি যখন বিয়ে করবো তখন এগারোটা বাচ্চা নিবো।আর আল্লাহকে বলবো সবগুলো যেন ছেলেই হয়।
কুয়াশা অবাক হয়ে, এগারোটা! কিন্তু কেন?
-ক্রিকেট দল বানাবো,হা হা হা। আমার খুব শখ আমার এগারোটা ছেলে হবে, ও,,,, মনে পড়েছে একটা মেয়েও থাকবে।
কথাটা শুনেই কুয়াশা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,তোমার বউ বাঁচবে তো?
নিবিড় মুচকি হেসে বললো, তাতে আমার কী? আমার বাচ্চা চাই ব্যাস।দরকার হলে আরেকটা বিয়ে করবো।তুই বল ভালো হবে না?
কুয়াশা নিবিড়ের পিঠে কিল-ঘুষি মেরে, একদম না।
মেরে পেলবো তোমাকে।
-আমার বউকে এখুনি বিধবা করতে চাস।দাঁড়া পুলিশকে এখুনি ফোন দিয়ে কেস ফাইল রেডি করতে বলছি কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না।
কুয়াশা ন্যাকা স্বরে বললো, সত্যি বলছি এবার মেরেই ফেলবো আমি তোমাকে।
তোমার আমি থাকতে কোনো বউ আসবে না।
নিবিড় তার জবাবে আর কোনো উত্তর দিলো না। উঠে গিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে মসজিদে।
রহিমা বেগম নিবিড়ের সাথে সকাল থেকে আর একটা কথাও বলেন নি। নিবিড় জুয়েলকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল।সারাদিনে বিয়ের ঝামেলায় ছিল নিবিড়। সন্ধ্যায় বউ নিয়ে বাড়ি এসে সবাইকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে।রাতে সবাই খাওয়া দাওয়া করে নিয়ে জুয়েল আর আসিফাকে বাসরঘরে দিয়ে দিল।
নিবিড়ও স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মায়ের রুমে এলো।
রহিমা বেগম কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে।রুপন্তি পাশে বসে একটা উপন্যাস পড়ছে।
নিবিড় এগিয়ে এসে,তোর পড়া শেষ?
-হু ভাইয়া।
-তাহলে এখান থেকে যা,মায়ের সাথে আলাদা কথা আছে।রুপন্তি মুখে কিছু না বলে উঠে চলে গেলো।
নিবিড় মায়ের পাশে এসে সামনেই বস পড়ল।একটা হাত ধরতেই মা হাত টেনে নিয়ে যাতে চাইছে দেখে নিবিড় শক্ত করে ধরলো।
শান্ত গলায় বলে, তোমার ছেলেকে তুমি কতটা বিশ্বাস কর মা?
রহিমা বেগম মুখে কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উঠে বসলো গম্ভীরমুখে।
নিবিড় আবার করুণার স্বরে বললো, তুমি আমার সাথে কথা বলবে না এটাই ফাইনাল?আচ্ছা ঠিক আছে সকালে আমি এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাবো যেখান থেকে মানুষ আর ফিরে আসা যায় না।যেখানে মায়ের বিশ্বাস সন্তানের উপর নেই সেখানে এই জীবন রেখেই বা লাভ কী?
কথাটা বলতেই রহিমা বেগম টলটলে চোখে ছেলের মুখ চেপে ধরে বুকে টেনে নিল।
-স্যরি মা, আসলে আমি তোমাকে কাল কি হয়েছে তা বলতে পারবো না।কিন্তু আমি শুধু বলবো আমি কুয়াশাকে ভালোবাসি।
নিবিড় মাথা উঠিয়ে, মা আমি জানি তুমিও কুয়াশাকে পছন্দ কর।তুমি তো এইরকমই একটা মেয়ে চেয়েছিলে আমার জীবনে তাই না?
রহিমা বেগম চোখ মুছে, আমি চেয়েছি ঠিক। কিন্তু আমি চাইনি তোদের এইভাবে দেখতে।এতোদিন তোর মুখ থেকে শুনার জন্যই আমি তোর বাবাকে কিছু বলে নি। যাক তবুও এতোদিনে বুঝলাম আমার ছেলের পছন্দ।
- হ্যাঁ আমি নিজেও বুঝেছি আমি কুয়াশাকে ভালোবাসি। কিন্তু মা আমি এখনো ওকে বলিই নি। কারণ আমি সারপ্রাইজ দিতে চাই। সবকিছু ঠিক করে ওকে জানাবো আমি ওকে ভালোবাসি কতটা।
-আচ্ছা ঠিক আছে।এখন গিয়ে ঘুমা।কাল তোর বাবাকে ওদের বাসায় পাঠাবো।
-আরে না,,, এখন না।আরও কয়েকদিন যাক তারপর।
-হু।
চলেও গেলো মাস চারেক। নিবিড়ের বাবা কুয়াশাদের বাসায় গেলো।আজ আজমল হোসেনকে বললে সে কখনো তাকে ফিরাতে পারবে না।এই যে বড় ভাইয়ের আবদার। কুয়াশাদের বাসায় এসে, জুয়েল আর কুয়াশাকে ড্রইংরুমে দেখে,তোর বাবা কোথায়?
জুয়েল বললো, জেঠু বাবা তো বাসায় নেই।কেনো তুমি কিছু বলবে?
কুয়াশার দিকে তাকিয়ে মা তুই ভিতরে যা। আমি জুয়েলের সাথে কিছু কথা বলবো।
কুয়াশা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।
আরে নবাবজাদী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কোন নাগর দেখা হচ্ছে শুনি?
কর্কশ গলায় কথাগুলো শুনেই কুয়াশা চমকে উঠে ভাবনায় ছেঁদ পড়লো।
পিছনে ফিরে ফুফুকে দেখেই, মাথায় কাপড় দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
-আমাদের ছেলেটারে তো খাইতেছিস,এখন আবার কোন নাগরকে নিজের জালে ফাঁসাতে চাইছিস? আমি থাকতে এই বাড়িতে এইসব চলবে না। বুজেছিস?
কুয়াশা চুপ করে আছে।
-এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে?তাড়াতাড়ি গিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার কর।এই বাড়ি কোনো এতিমখানা নয় যে বিনা পরিশ্রমে কাউকে খেতে দেওয়া বা থাকতে দেওয়া হয়।
তিন্নি দৌড়ে এসে,কি হয়েছে ফুফু।ওকে বকছো কেনো?
- আমার কথা তো শুনলে তোদের বকাই মনে হয়।কিন্তু আমি যে সবার ভালোর জন্যই বলি সেদিকে তো কারো খেয়াল নেই।এই মেয়ে,এখন যাও তাড়াতাড়ি গিয়ে কাজগুলো সেরে নাও।
কথাটা বলেই ফুফু চলে গেলো।কুয়াশা আস্তে আস্তে রুম থেকে বেরুতে যাবে তখনি তিন্নি পিছন থেকে বললো,তুমি পারবে এসব করতে?
কুয়াশা তিন্নির দিকে ফিরে মুচকি হেসে, না পারারও কিছু নেই।তবে কেউ একজন বুজিয়ে দিলে ভালো হত।আমি তো জানি না কোথায় কি আছে।
-চল আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
কুয়াশা একা একা দুপুরের আগেই কাজ শেষ করলো হাসপাতালে যাবে বলে।
ফুফু শ্বাশুড়ির রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, ফুফু ভিতরে আসবো?
ফুফু মুখে পান পুরে বললো,কাজ শেষ?
-জ্বি।
-এখন এইখানে চেহারা দেখাইতে আসছো? বাকী যে আরও কাজ আছে সেগুলো কী তোমার বাপ এসে করবে?
-ফুফু আমার একটা কথা ছিল। বলেই চলে যাবো।
ফুফু পিছিত করে পানের পিক ফেলে বললো,কি বলবা তাড়াতাড়ি বলো।আর শুনো এই পানের পিকগুলো পরিষ্কার করে দিবে।
কুয়াশা মাথা নেড়ে বললো,আমি হাসপাতালে যাবো।
কথাটা শুনেই ফুফু পান চিবানো বন্ধ করে,তোমার চেহারাখান মানুষরে দেখাতে যাইবা? কোনো হাসপাতাল যেতে-টেতে হবে না।আজ তোমার কারণে আমাদের পোলাটার মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে গেছে।আর সেই কিনা দেখতে যাবে।যাও এইখান থেকে।কোথাও যেতে হবে না।
কুয়াশা মন খারাপ করেই রুম থেকে ফিরে যেতেই তিন্নি এসে কুয়াশার কাঁধ ধরে ফেলে চোখ দিয়ে আশ্বাস করে, ফুফু বাবা ফোন দিয়েছে।
-কেন?
-বললো ভাবীকে হাসপাতাল পাঠানোর জন্য এবং এই মুহূর্তেই।
-কিন্তু এই মাইয়া গিয়ে কি রাজকার্য করবে?
-জানি না ফুফু, বাবা বললো হাসপাতালে নাকি ডাক্তাররা ভাবীর সাথে কথা বলতে চায়।
-আচ্ছে ঠিক আছে, যেতে বল।
কুয়াশা রুমে এসেই তিন্নিকে জড়িয়ে, আমার জন্য তুমি মিথ্যা বললে?
-হু বললাম।আমি বুঝি তোমার মনের অবস্থা। কিন্তু ফুফু তোমাকে কখনো বুঝবে না।কারণ ফুফু ভাইয়াকে খুব ভালোবাসে। ভাইয়ার এই অবস্থা মেনে নিতে পারছে না।আর এই অবস্থার জন্য তোমাকেই দায়ী করছে ফুফু।এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।তুমি তাড়াতাড়ি যাও।আমি এইদিকটা সামলাবো।
কুয়াশা হাসপাতাল আসতেই তোসাবের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।মা তুই চলে এলি?
-আমি বাড়িতে থাকলে কী উনি সুস্থ হয়ে যাবেন? কখনোই না।আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই।
তোসাবের বাবা অবাক হয়ে, এই মেয়ে তুমি পাগল হয়ে গেছো? আমার ছেলে কথা বলার মতো অবস্থা আছে?
-প্লিজ আমাকে একটা বার দেখার সুযোগ দিন।আমি একটা বার উনাকে দেখতে চাই।
তোসাবের বাবা কিছু বললেন না।চুপ হয়ে অন্য দিকে ফিরে চলে গেলেন।তোসাবের মা চোখের পানি ঝরিয়ে, ঠিক আছে,আমি ডাক্তারকে বলে দেখি। চল আমার সাথে।