মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ১৮)


জীবনের ফোন বাজছে। সে ফোনও খুঁজে পাচ্ছে না। 
'আল্লাহ! এখন আবার এই ফোন কোথায় রাখলাম? আমার এরকম অবস্থার জন্য তুমি দায়ী স্পৃহা। সব দোষ তোমার।'
জীবন বিছানা থেকে বালিশ গুলো ছুড়ে ফেলে বালিশের নিচে ফোন পেল। 
'হ্যা ভাইয়া বলো।'
'তুই এতক্ষণ কি করছিলি। টানা তিনবার রিং হয়ে কেটে গেছে। ফোন তুলছিলি না কেন?'
'আরে ফোন কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি মনে হচ্ছে পাগল হয়ে গেছি ভাইয়া। সবকিছু উলটপালট লাগছে। মনে হচ্ছে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।'
'কি হয়েছে তোর? স্পৃহা কোথায়? '
'সে তার খালামণির বাসায় বেড়াচ্ছে।'
'ওহ তাই তোর এই অবস্থা। বৌ বাড়িতে না থাকলে পাগল পাগলই লাগে রে ভাই।'
জীবন শুনতে পারছে রামিম হাসছে। আজ তারও হাসি পাচ্ছে। জীবন এতদিন বুঝতেই পারেনি সে স্পৃহাকে কতটা মিস করে। তার স্পৃহাকে কতটা দরকার। 
'ভাইয়া তুমি ঠিকই বলেছিলে।'
'কি ঠিক বলেছিলাম? '
'আমি মনে হয় সত্যিই স্পৃহাকে ভালোবেসে ফেলেছি। স্পৃহাকে ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগে না। সারাক্ষণ স্পৃহাকে আমার পাশে পেতে চাই। ওর কথা মনে হলে কোনো কাজেই মন লাগাতে পারি না।'
'ওরে গাধা ভাই আমার। এই সামান্য কথাটা বুঝতে তোর এতদিন সময় লাগলো? নিজের ভালোবাসা উপলব্ধি করতে এতো দেরি করলি?'
জীবন মাথা চুলকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
'তখন আমি ভাবতাম আমি শুধু একজনকেই ভালোবেসেছি। আর হয়তো কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কিন্তু স্পৃহা মেয়েটা কখন যে আমার মনের ঘরে ঢুকে বসে আছে তা আমিও জানতে পারিনি।'
'আমি সেদিনই বলেছিলাম। কিন্তু তুই-ই মানতে চাইলি না। এখন দেখলি তো আমার কথাই সত্যি হলো।'
'কিন্তু ভাইয়া সবকিছু বুঝতে যে আমি বড্ড দেরি করে ফেলেছি। একটা মানুষের সাথে থাকতে থাকতে কখন যে ওর প্রতি মায়া তৈরি হয়ে যায়। তা কেউ বুঝতে পারে না। আর এই মায়া জিনিসটা থেকে চাইলেও বের হওয়া যায় না। অনেক সময় এই মায়া কাটানোটা শুধু মুশকিল না অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমিও স্পৃহার মায়ায় পড়ে গেছি। এখন আমি স্পৃহাকেই চাই।'
রামিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
'ভাই আমার! কিচ্ছু দেরি হয়নি। সামনে এখনো অনেক সময় বাকি আছে। নূপুর নামের মেয়েটাকে পুরোপুরি ভুলে যা। এতদিন তুই হারাম ভালোবাসার পেছনে ছুটেছিস। অথচ তোর সামনেই স্পৃহার হালাল ভালোবাসা ছিল। তুই স্পৃহার ভালোবাসা উপেক্ষা করেছিস। বাইরের একটা মেয়ের জন্য স্বামী স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ককে অবহেলা করেছিস।'
'এখন আমি কি করবো? '
'তুই কি সত্যিই গাধা? না। গাধা না তুই। তোকে গাধা বললে বেচারা গাধা জাতিকে অসম্মান করা হবে। তুই একটা রামছাগল। আমাকে জিজ্ঞেস করছিস এখন কি করবি। আরে ছাগল তুই ফোন রেখে এক্ষুনি স্পৃহাকে আনতে যাবি। ওকে সব খুলে বলবি। নূপুরের সাথে একসময় তোর সম্পর্ক ছিল এটাও বলবি। আর এখন তুই ওর জন্য কি ফিল করিস তাও বলবি। পুরোনো কথা সব ভুলে গিয়ে স্পৃহাকে নিয়ে নতুন করে পথ চলা শুরু করবি। তোরা সংসার শুধু করবি।'
'আচ্ছা তাহলে আমি এক্ষুনি স্পৃহার কাছে যাচ্ছি। ওকে সব বলবো। আমি স্পৃহাকে বলবো, আমি ওকে ভালোবাসি। নূপুর আমার অতীত ছিল। কিন্তু সে আমার বর্তমান। ভবিষ্যতেও আমি স্পৃহাকে নিয়েই থাকতে চাই। আমরা দু'জন মিলে আবার সবকিছু প্রথম থেকে শুরু করতে চাই।'
জীবন রামিমের আর কোনো কথা না শুনে ফোন রেখে দিলো। গাড়ির চাবি নিয়ে জয়দের বাসার উদেশ্যে বেরিয়ে গেল।

এখানে আসার পর থেকে রাতে স্পৃহার একদম ঘুম হয় না। সারা রাত এপাশ ওপাশ থেকে করে ছটফট করে। আগে তো খালামণির বাসায়ই থাকতো তখন তো স্পৃহার এমন লাগে নি। এখন কেন তার এখানে থাকতে ভাল লাগছে না। জীবনের জন্য চিন্তা হচ্ছে। মানুষটা একা একা কীভাবে থাকে? নিজে কি রান্না করে কে জানে? জীবন হয়তো একা একা সামলে নিতে পারছে না। তাইতো বারবার তাকে কল করছে। আজ স্পৃহার ঘুম ভাঙতে দেরি হচ্ছে। রাতে একটুও ঘুম আসেনি। সারারাত জেগে থেকে সকালে ঘুমিয়েছে। কলিং বেল বাজলে জয় এসে দরজা খুলে দিয়ে বলল,
'তুই?রাতে কথা বলার সময় তো বলিস নি তুই সকালে আসবি।'
জীবন ভেতরে আসতে আসতে বলল,
'বলিনি বলে কি আসতে পারবো না? '
'আমি তা বলেছি? '
'না। এখন তাহলে সামনে থেকে সর। স্পৃহা কোথায়? '
'ঘুমাচ্ছে। '
'এখনো ঘুম থেকে উঠে নি?'
'না। তুই বোস আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। '
'তোর ডেকে দিতে হবে কেন? আমার বৌকে আমি ডেকে নিতে পারবো।'
আজ জয়ের কাছে জীবনের সবকিছুই অচেনা লাগছে। জীবন সক্কাল সক্কাল চলে এসেছে। এখন আবার কীভাবে কথা বলছে। পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি?
'হা করে দাঁড়িয়ে না থেকে সরে দাঁড়া গাধা। বোনের হাজবেন্ড এসেছে। কোথায় আপ্যায়ন করবি। তা না। তুই তো হাজার প্রশ্ন করছিস।'
স্পৃহা তাকাতে পারছে না। জানালা দিয়ে আলো এসে চোখে লাগছে। স্পৃহা চোখ পিটপিট করে খুলে সামনে তাকিয়েই ধড়মড় করে উঠে বসলো। মুহূর্তেই তার সব ঘুম কেটে গেছে। এ কাকে দেখছে সে! এই সকালবেলায় জীবন এখানে কোত্থেকে আসবে? আর কেনই বা আসবে? স্পৃহা ভাবছে সে ঘুমের ঘোরে ভুল দেখছে। তাই চোখ কচলিয়ে আবার তাকালো। না। সে সত্যিই দেখছে তার সামনে জীবন বসে আছে। স্পৃহাকে জাগতে দেখে জীবন মিষ্টি করে একটু হেসে বলল,
'ঘুম ভেঙেছে? এখানে এসে তুমি এতো ঘুমাও! বাসায় থাকতে তো সকাল সকাল উঠে যেতে।'
জীবনের কথায় স্পৃহা ভেবাচেকা খেয়ে বলল,
'আপনি এখানে? '
'হুম। তুমি তো আসতে বলো না। তাই নিজে থেকেই চলে এলাম। এখন ওঠো তো। অনেক সকাল হয়েছে।'
সারাটা দিন স্পৃহা জীবনের কান্ড কাহিনী দেখে থ হয়ে রইলো। আজ জীবনের কি হয়েছে? জীবন তো কখনো এমন ছিল না। স্পৃহার সাথে কেমনই যে বিহেইভ করছে। যা আগে কখনো করে নি। আজ অফিসেও যায় নি। বাসায় থেকে জয় আর মারিয়ার সাথে আড্ডা দিয়েছে। খালামণি একটু পরপর স্পৃহাকে দিয়ে জীবনের জন্য এটা সেটা পাঠাচ্ছে। স্পৃহা সামনে গেলেই জীবন যেন মুচকি হাসছে। বিকেলে বসার ঘরে সবাই বসে টিভি দেখতে দেখতে গল্প করছে। স্পৃহা ওদেরকে পকোড়া দিয়ে চলে যাচ্ছিল। মারিয়া স্পৃহার হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলল,
'কোথায় যাচ্ছিস তুই? বোস এখানে। আমাদের সাথে এই মুভিটা দেখ। জোশ একটা মুভি।'
স্পৃহা সবার সাথে বসলো ঠিকই কিন্তু সে জীবনকেই লক্ষ করে যাচ্ছে। ফানি সিন দেখে জয় হাসতে হাসতে মারিয়ার উপর পড়ে যাচ্ছে। মারিয়া বিরক্ত হয়ে জয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
'সামান্য একটুকুতে এভাবে ছাগলের মত হাসছিস কেন গাধা? এখানে আহামরি তেমন কিছু হয়নি যে, তুই হাসতে হাসতে কাপড় নষ্ট করে ফেলবি। আমরাও তো দেখছি। কই কেউ তো তোর মত হেসে মাটিতে পড়ে যাচ্ছি না।'
মুভির সিন দেখে জীবনের হাসি না পেলেও মারিয়ার কথা শুনে ঠিকই হাসি পাচ্ছে। জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে এবার হেসেই ফেলল। স্পৃহা কপাল কুঁচকে মনে মনে বলল,
'নিশ্চয়ই লোকটা পাগল হয়ে গেছে। নয়তো জ্বীনে ভর করেছে। একা একা বাসায় ছিল পাগল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নইলে সেদিন পর্যন্ত কেমন গম্ভীর প্রকৃতির ছিল। এখন হঠাৎ করে এমন মিশুক প্রকৃতির হয়ে গেল কীভাবে? '
জীবন সারাদিনে একবারও স্পৃহাকে একা পায়নি। তাই কথাও বলতে পারেনি। সন্ধ্যার পর এখন স্পৃহাকে রুমে পেল। জীবন স্পৃহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার পথ আটকে বলল,
'সারাদিনে তুমি একবারো আমার কাছে আসো নি কেন? '
স্পৃহা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। 
'কি হলো বলো।'
'কাজ করছিলাম।'
'আমাকে রেখে কি এতো কাজ তোমার?'
'অ্যা!'
'অ্যা না। একটু পরেই আমরা বাসায় যাব। ডিনার শেষ হলেই।'
'না। '
'কি না? আমি বলেছি যাবে। মানে তুমি যাবেই। '
'আমি বলেছি তো কয়টা দিন এখানে থাকবো।'
'তিন দিন তো থেকেছ। আর কয়দিন থাকতে চাও?'
জয় জীবনকে ডাকার জন্য রুমে এসে দেখে ওরা কথা কাটাকাটি করছে। জয় আবার চলে যেতে নিয়ে বলল,
'তোরা ঝগড়া কর। আমি ডিস্টার্ব করব না।'
জীবন জয়কে ডেকে বলল,
'এদিকে আয় তুই।'
জয় এসে দাঁড়ালে জীবন বলল,
'তোর বোনকে একটু বোঝা তো।'
'কি বোঝাব? '
'ও আমার সাথে যেতে চাইছে না। তিন দিন তো থেকেছ। এখন বলছে আরো থাকবে। তুই তো জানিস তোদের বাসা থেকে আমার অফিস কতটা দূরে। অফিস না থাকলে আমিই এখানে থেকে যেতাম। স্পৃহাকে ছাড়া বাসায়ও একা একা ভাল লাগে না। তুই স্পৃহা বল আমার সাথে যেন আজ ফিরে যায়।'
জয় অবাক হয়ে বলল,
'অ্যা?'
'আরে গাধা অ্যা না বল হ্যাঁ।'
জীবন স্পৃহার সামনে জয়ের কাছে এসব কি বলছে। তাকে ছাড়া থাকতে ভাল লাগে না মানে? লজ্জার আর কিছু বাকি রইল না। অন্য সময় হলে জয় জীবনকে অনেক খেপাতো। কিন্তু এখন স্পৃহার সামনে তেমন কিছু বলতে পারছে না। জয় হাসি চেপে বলল,
'স্পৃহা বোন আমার। এইবার নাহয় তুই জীবনের সাথে চলে যা। কিছুদিন পর আবার এসে থেকে যাবি। দেখছিস না আমার বন্ধু বেচারার তোকে ছাড়া একা একা থাকতে ভাল লাগে না।' 
জয়ের কথার ধরণ বুঝতে পেরে জীবন ভ্রু কুঁচকে জয়কে দেখলো। জয় এবার মুচকি হাসছে। স্পৃহা ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে সে এটা জানে, আজ কোনোমতেই জীবনের সাথে ফিরবে না। স্পৃহা কাউকে কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
'আসছি খালামণি।'
স্পৃহা চলে গেলো জীবন বলল,
'খালামণি ওকে কখন ডাকলো? '
জীবনের ছেলেমানুষি দেখে জয় এবার হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়ল। 
'দোস্ত তুই তো দেখছি ভেবলিকে ছাড়া চোখে পথ দেখিস না। ওরে তোর এই অবস্থা দেখে আমার সত্যিই তোর জন্য মায়া হচ্ছে। ভেবলি গাধীটা তোর এই অবস্থা দেখতে পারছে না। সে এটাও বুঝতে পারছে না তুই ওর জন্য কতটা পাগল।'
জীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়ের পাশে বসে বলল,
'সত্যিই তোর বোনটা অনেক বড় গাধী। সকাল থেকে তাকে কত ইশারা ইঙ্গিতে ডাকছি একটু কথা বলার জন্য। সে আমার কাছে আসবে তো দূর উল্টো আরো দূরে দূরে থাকছে।'
'আমি যখন তোকে ভেবলিকে বিয়ে করতে বলেছিলাম তখন তুই কি বলেছিলি মনে আছে? '
'মনে থাকবে না কেন?'
জয় পেটে হাত ধরে হাসছে। 
'একটা সত্য কথা বলি হ্যা? নূপুরের জন্যেও আমি কোনোদিন তোকে এমন অস্থির হতে দেখিনি। নূপুর তো ওর ভাইদের ভয়ে সপ্তাহে, মাসে দু'তিন দিন দেখা করতো। তখন কিন্তু তুই ঠিকই ওকে না দেখে থাকতে পারতি। এখন স্পৃহাকে তিনদিন চোখের সামনে না দেখে তুই তো পুরো পাগল হয়ে গেছিস।'
'তুই আমার কেমন শালারে? শালা, বোনের হাজবেন্ডকে তার এক্স গার্লফ্রেন্ড এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিস। লজ্জা নাই তোর?'
'এক্স গার্লফ্রেন্ড? ওরে তুই সত্যিই একটা মাল। শালা লুচ্চা। বিয়ের আগে গার্লফ্রেন্ড আর বিয়ের পর বৌ। বলি তোর এতো ভালোবাসা আসে কোত্থেকে? এতো এতো ভালোবাসা কোথায় রাখিস?'
জয়ের কথা শেষ হবার আগেই জীবন জয়কে শুইয়ে দিয়ে ওর উপর উঠে বসে ওকে মারতে লাগলো। 
রাতেও যখন স্পৃহা যেতে রাজি হচ্ছিল না। তখন জীবন স্পৃহাকে কোলে তুলে নিয়ে সবার সামনে দিয়ে বেরিয়ে এলো৷ স্পৃহা হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বলল,
'কী করছেন আপনি? আল্লাহ! সবাই দেখছে তো। নামান আমাকে। প্লিজ নামান বলছি।'
'ভালো করে আমার সাথে যেতে বলেছি। তখন তুমি রাজি হও নি। তাই এখন এভাবেই যেতে হবে। সবাই দেখলেও কিছু করার নেই। আমি তোমাকে কোল থেকে নামাবো না।'
'আপনি সত্যিই অনেক পাজি লোক। সবার সামনে এমন করতে লজ্জা করছে না আপনার? '
'লজ্জা কিসের? আমি অন্য বেটার বৌকে কোলে নিয়েছি নাকি? আমি নিজের বিয়ে করা বৌকে কোলে নিয়েছি। তাই আমার বা তোমার লজ্জা পাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না।'
জীবন জোর করে স্পৃহাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। সবাই জীবনের এই কান্ড হা করে শুধু দেখেছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি। মারিয়া জয় হেসে হেসে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। সবার সামনে ওভাবে নিয়ে আসায় স্পৃহার যা লজ্জা লাগছিল। তার উপর মারিয়া আর জয় তাকে দেখে কীভাবে হাসছিল। এই লোকটার সত্যিই লজ্জা সরম বলতে কিচ্ছু নেই। স্পৃহা মনে মনে বলছে, 
'আর কোনোদিন খালামণির বাসায় আসবো না। আজ এই অসভ্য লোকটা সবার সামনে যা লজ্জা দিলো।'
জীবন এক হাত ড্রাইভ করছে আরেক হাতে স্পৃহার হাত ধরে রেখেছে। রাগে স্পৃহা জীবনের দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু এতে জীবনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। 

বাসায় এসে জীবন বলল,
'নামো।'
স্পৃহা মুখ অন্য পাশে ঘুরিয়ে বসে আছে। জীবন আবার বলল,
'নামবে না তো? বুঝেছি তোমার আবার কোলে উঠতে ইচ্ছে হয়েছে। আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যা চাও আমি তা-ই করছি।'
জীবন ঝুঁকে স্পৃহার দিকে এগিয়ে এলে,স্পৃহা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেই নেমে গেল। জীবন হেসে বলল,
'এইতো নিজে নিজে নেমে এলে।'
দারোয়ানের কাছ থেকে জানতে পারলো আজ সকালে জীবন বের হবার পরপরই লিফট নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো ঠিক হয়নি। কাজ চলছে। জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
'আমরা এখন ফ্ল্যাটে যাব কীভাবে? '
স্পৃহা কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। জীবন স্পৃহার কান্ড দেখে হেসে বলল,
'ম্যাডাম আপনার রাগ বেশিক্ষণ থাকবে না। ছ'তলায় উঠতে উঠতে রাগ উড়ে যাবে। আর পায়ের অবস্থাও বেহাল হয়ে পড়বে। তখন আমাকেই কাজে লাগবে।'
জীবনও স্পৃহার পেছন পেছন গেল। চার তলা পর্যন্ত উঠেই স্পৃহার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। সে আর হাঁটতে না পেরে সিঁড়িতেই বসে পড়লো। পা আর চলছে না। মনে হচ্ছে পা নিজের সাথে নেই। গরমও লাগছে। ঘেমে স্পৃহা একাকার হয়ে গেছে। স্পৃহা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জীবনের দিকে একবার তাকালো। জীবন স্পৃহাকে দেখে হাসছে। স্পৃহা আবার মুখ ফিরিয়ে নিলে জীবন বলল,
'এটুকু এসেই বসে পারলে হবে? আরো দুই তলা বাকি আছে। রুমে যেতে হলে আরো হাঁটতে হবে। এখানে বসে থাকা যাবে না।'
স্পৃহার রাগ লাগছে। আজ যদি জীবন তাকে জোর করে না নিয়ে আসবো তাহলে কি এতটা হাঁটা লাগতো? সব দোষ জীবনের। 
'আমি আর হাঁটতে পারবো না। আপনি রুমে চলে যান। আমি এখানেই বসে থাকবো।'
'রাতে এখানেই থাকবে নাকি? '
'হুম। আর এক পা চলার মত শক্তি আমার নেই। পা দু'টো পাথর হয়ে আছে।'
জীবন চুপ করে দাঁড়িয়ে একটু ভাবলো। তারপর স্পৃহাকে কিছু বোঝার সময় না দিয়ে হুট করে স্পৃহাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। 
স্পৃহা চোখ বড় বড় করে বলল,
'কি করছেন আপনি? নামান আমাকে? এসব কি হচ্ছে? '
'চুপ কোনো কথা না। আমার বৌ এখানে বসে থাকবে আর আমি চলে যাব? এতটাও অপদার্থ আমি না। বৌকে কোলে তুলে নিয়ে যাবার মত শক্তি সামর্থ্য আমার দু'টোই আছে। তাই বেশি নড়াচড়া না করে চুপ করে থাকো।'
জীবন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। স্পৃহা দু'হাতে জীবনের কাঁধে ধরে রেখেছে। জীবনও স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একেবারে ওদের এপার্টমেন্টের সামনে এসে স্পৃহাকে নামিয়ে দিলো। তালা খুলে ভেতরে গিয়ে জীবন কোমরে ধরে দাঁড়িয়ে একটু শ্বাস নিলো। পরনের কালো শার্টটা ঘামে চটচটা হয়ে শরীরের সাথে লেগে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জীবন যেন একটু হাঁপাচ্ছেও। স্পৃহা ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে গ্লাসে করে জীবনের সামনে ধরে বলল,
'পানি খান।'
জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা নিলো। ওর দিকে তাকিয়েই পানিও শেষ করলো। স্পৃহা গ্লাস নিয়ে চলে যেতে নিলে জীবন তার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
'কেমন বৌ তুমি? তোমার হাজবেন্ড এতো কষ্ট করলো। তোমাকে কোলে নিয়ে এতটা হাটলো আর তুমি কি করছো। এক গ্লাস পানি খাইয়ে চলে যাচ্ছ। দেখছো আমি ঘেমে গেছি। তুমি তো পারতে শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিতে।'
স্পৃহা হা হয়ে জীবনের দিকে চেয়ে আছে। জীবন নিজেই স্পৃহার শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলো। স্পৃহা কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
'এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকো না। তাহলে যে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখতে পারবো না। কিছু করে বসলে তখন তুমি আরো লজ্জায় পড়ে যাবে। তুমি কি চাও আমি তোমার সাথে 
জীবন কথা শেষ করার আগেই স্পৃহা তাকে এক ধাক্কা দিয়ে দৌঁড়ে রুমে চলে গেল। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে স্পৃহা দরজায় হেলান দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। জীবন এখানে দাঁড়িয়ে হাসছে। বুকে হাত রেখে স্পৃহা বলল,
'সত্যিই এই লোক পাগল হয়ে গেছে। উনার মাথায় কিছু একটা তো হয়েছে। আল্লাহ! কি বলছিস এসব? এতো জোরে জোরে ধুকপুক করছে মনে হচ্ছে হার্ট ফেটে যাবে।'

আগে জীবন অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হবার সময় স্পৃহা আশেপাশেই থাকতো। আজ স্পৃহা জীবনের রুমে আসছে না। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে স্পৃহাকে দেখতে না পেয়ে জীবনের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসলো। সে স্পৃহাকে ডাকতে লাগলো, 
'স্পৃহা! স্পৃহা! স্পৃহা আমার রুমে এসো একবার।'
স্পৃহা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
'বলুন। '
জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
'ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কীভাবে বলবো? ভেতরে আসবে তো।'
জীবন শুধু টাওয়েল পড়ে খালি গায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। স্পৃহা তার জন্যই ভেতরে আসছে না। সে আগে কখনো এভাবে খালি গায়ে জীবনকে দেখে নি। 
'কি হলো? ওখানে দাঁড়িয়ে আমার শার্ট খুঁজে দিতে পারবে নাকি? সাদা শার্টটা পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছিলে একটু দেখো তো।'
স্পৃহা এসে কাভার্ড থেকে শার্ট বের করে দিলো। জীবন স্পৃহার হাত থেকে শার্ট নিয়ে তার সামনেই পরলো। প্যান্টও চেঞ্জ করে নিলো। স্পৃহা চলে যেতে নিলে জীবন বলল,
'কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও এখানে।'
স্পৃহা দাঁড়াল। জীবন টাই হাতে নিয়ে স্পৃহার সামনে এসে বলল,
'টাই বেঁধে দিবে কে?'
স্পৃহা প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে তাকালো। 
'সবার বৌ নাকি অফিসে যাবার সময় টাই বেঁধে দেয়। আমারও তো বৌ আছে। কিন্তু আমার বৌ তো একটা দিনও টাই বেঁধে দিলো না।'
স্পৃহাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে জীবনের হাসি পাচ্ছে। সে হাসি চেপে বলল,
'নাও টাই টা বেঁধে দাও তো।'
'আমি টাই বাঁধতে পারি না। '
'ওকে। সমস্যা নেই। আজ আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। এরপর থেকে তুমি নিজে নিজে করবে। '
জীবন স্পৃহার হাত তার হাতে নিয়ে স্পৃহাকে টাই বাঁধা শিখাচ্ছে। জীবনের এমন অদ্ভুত আচরণে স্পৃহা ভেবাচেকা খেয়ে গেছে। জীবন কি করছে, কি চাইছে স্পৃহা কিছুই বুঝতে পারছে না। টাই বাঁধা শেষে এক এক করে ঘড়ি ওয়ালেট স্পৃহার হাত থেকেই নিলো। বেরিয়ে যাবার আগে স্পৃহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গালে আলতো করে চুমু দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
'এখন আসছি। রাতে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। রেডি হয়ে থেকো।'
থ মেরে স্পৃহা দাঁড়িয়ে আছে। জীবন ওকে এভাবে রেখেই বেরিয়ে গেল। জীবন কিসের সারপ্রাইজের কথা বলল,হঠাৎ করে কেন এমন আচরণ করলো স্পৃহা তা ভেবে পাচ্ছে না। 

অফিসে বসে প্রথম জীবন রামিমকে কল করলো,
'হ্যারে বল।'
'ভাইয়া আমি ভাবছিলাম আজ স্পৃহাকে সব বলে দিব। আমার অতীতে কী কী ঘটেছে। নূপুরের সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পর কীভাবে আমি ওকে বিয়ে করেছি। আর এখন আমি ওকে ভালোবাসি সবকিছু বলবো আজ।'
'এতদিনে তুই একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। যত তাড়াতাড়ি বলবি ততই ভালো। স্পৃহাকে আরো আগেই সব বলে দেয়া উচিত ছিল।'
'তখন বুঝিনি ভাইয়া। তবে এখন বুঝতে পারছি স্পৃহাকে আমি কতটা চাই। আমার লাইফে ওকে কতটা দরকার। ওকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারবো না। স্পৃহা এখন আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।'
'অল দ্যা বেস্ট আমার ছাগল ভাই। আশাকরি এবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।'
'হুম। '
রামিমের সাথে কথা শেষ করে জীবন জয়কে কল করলো,
'স্পৃহা কোন ফুল সবচে বেশি পছন্দ করে?'
'ভেবলির পছন্দের ফুল?'
'হ্যা। '
'ভেবলি তো সব ফুলই পছন্দ করে। তার মধ্য থেকে বকুল, শিউলি, বেলি এগুলো একটু বেশিই পছন্দ করে। কেন বল তো?'
'গাধা আমি কি এখন সাদা কালারের এই ছোট্ট ছোট্ট ফুল নিয়ে ওকে প্রপোজ করতে যাব?'
'ওহ প্রপোজ করবি? তাহলে তো লাল গোলাপই বেস্ট। সব মেয়েরাই প্রপোজের ক্ষেত্রে লাল গোলাপই পছন্দ করে।'
'আর ফেভারিট চকলেট? '
জয় হেসে বলল,
'আমাদের ভেবলি চকলেট খায় না।'
'তাহলে? '
'ভেবলি ঝাল জাতীয় খাবার পছন্দ করে। মিষ্টি জাতীয় তেমন কিছুই খায় না। এখন কী নিবি তা তুই বোঝ।'
জীবন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। জয় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
'এখন যদি তুই আমাকে এটা জিজ্ঞেস করিস,ভেবলির পছন্দের রঙ কি? তাহলে আমি এক্ষুনি তোর অফিসে গিয়ে তোকে কেলিয়ে আসবো। দুই তিন মাস ধরে একসাথে থাকছিস এটুকু না জানলে তুই সত্যিই আমার হাতে ভীষণ মার খাবি।'
'আরে ছাগল আমি এটা জানি। তোর বোন নীল রঙ অনেক পছন্দ করে। সাদা রঙও তার অনেক পছন্দ। তোর কাছে আর কিছু জানতে চাই নি। আমি নিজের জন্য একটু হেল্প চাইতাম আরকি। '
'ওহ তাহলে বল।'
'স্পৃহাকে কী গিফট দেয়া যায় বল তো। ডায়মন্ডের নেকলেস? রিং? চুড়ি নাকি অন্য কিছু? '
'গাধা তোর বৌকে তোর যা ইচ্ছা তা দে। ইচ্ছে হলে সব কিছুই দিয়ে দে। ইচ্ছে না হলে কিছুই দিস না।'

জীবন অফিসে বসে থেকে আর দেরি করলো না। স্পৃহার জন্য নেকলেস, রিং,চুড়ি আর ডায়মন্ডের ছোট্ট একটা নোসপিন কিনলো। হোটেলে রুম বুক করে নিলো। রুমটা লাল গোলাপ দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে বলেছে। ফ্লাওয়ার শপে গিয়ে লাল গোলাপের অনেক গুলো বুকেট নিয়ে নিলো। বিকেলে জীবন বাসায় ফিরে যাচ্ছে। পেছনের সীটে গোলাপের বুকেট রাখা হয়েছে। জীবনের পাশের সীটেই রাখা স্পৃহার জন্য কেনা নীল শাড়ি আর গহনার বক্স। জীবন খুশি খুশি মনে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। আজ সে স্পৃহাকে নিয়ে নতুন করে পথ চলা শুরু করবে। আগের সবকিছু ভুলে গিয়ে স্পৃহাকে আপন করে নিবে। তার ভালোবাসার কথা স্পৃহাকে জানাবে। 
'স্পৃহা তোমার ভালোবাসায় নিজেকে রাঙিয়ে নিতে আমি আসছি। আমাদের আগামী দিনগুলো একসাথে মিলে দু'জন সুন্দর করে সাজিয়ে নিব। আমাদের সংসার নিজেদের মত করে গুছিয়ে নিব। এখন আমার সবটুকু ভালোবাসা শুধু তোমাকেই দিব। তোমাকে নিজের থেকে আর দূরে সরিয়ে রাখবো না। আজ আমি তোমাকে আমার করে নিব।'
জীবনের ফোন বেজে উঠলে সে ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনের নাম্বার টার দিকে তাকিয়ে জীবনের ভ্রু কুঁচকে উঠলো। বিরক্তিতে মুখ কালো করে সে কল কেটে দিল। পরপর কয়েকবার রিং হলেও জীবন ফোন তুললো না। শেষে একটা ম্যাসেজ আসলে জীবন তা দেখে হঠাৎ মাঝ রাস্তায় গাড়ি ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়লো। ম্যাসেজের কথাগুলো পড়ে জীবনের ঠোঁট কাঁপছে। হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। সাথে সাথে জীবন গাড়ি ব্যাক করে উল্টো দিকে যেতে লাগলো। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন