মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ২১)


জীবন নূপুরকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু নূপুর বুঝতেই চাইছে না। তার একটাই কথা জীবন তাকে ফিরিয়ে দিলে সে আর বেঁচে থাকবে না। জীবনও এখন নূপুরের উপর বিরক্ত হয়ে গেছে। এদিকে কিছুদিন ধরে স্পৃহাও যেন কেমন আচরণ করছে। 
স্পৃহা তার ঘরে ছিল। জীবন স্পৃহাকে ডাকতে ডাকতে স্পৃহা ঘরে চলে এলো।
'কখন থেকে ডাকছি। কি করছো তুমি? '
'কিছু না। একটু পরেই আপনার জন্য চা নিয়ে যেতাম।'
'শোনো স্পৃহা চলো কয়েক দিনের জন্য আমরা তোমাদের বাসা থেকে ঘুরে আসি। তুমিও তো কতদিন ধরে বাবা মা'র সাথে দেখা করোনি।'
'হুম। '
স্পৃহা বেরিয়ে যেতে নিলে জীবন পেছন থেকে তার হাত ধরে বলল,
'একটা কথা জিজ্ঞেস করলে সত্যি করে উত্তর দিবে? '
স্পৃহা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। জীবন বলল,
'তুমি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?'
হঠাৎ জীবনের এই প্রশ্নের স্পৃহা কি উত্তর দিবে? সে তো জীবনে একজকেই ভালোবেসেছে। আর সে অন্য কেউ না, জীবন। জীবন অধীর আগ্রহে স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছে। 
স্পৃহা জীবনের দিকে না তাকিয়ে বলল,
'না।'
স্পৃহার মুখে না কথাটা শুনে জীবনের কেনই যেন কষ্ট হতে লাগলো। সে ভেবেছিল স্পৃহা হয়তো তাকে ভালোবাসে। স্পৃহাকে জিজ্ঞেস করলে স্পৃহা বলে দিবে। জীবন মুখ কালো করে বলল,
'ওহ।'
স্পৃহা রান্নাঘরে চলে গেল। চুলায় চা বসানো ছিল। জীবন একটু আগে তার কাছে চা চেয়েছিল। স্পৃহা চলে গেলে জীবন কিছুক্ষণ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
'আচ্ছা সমস্যা নেই। কখনো কাউকে ভালোবাসো নি। এটা আমার জন্যই ভালো। আমাকে ভালোবাসতে এখন আর তোমার কোনো বাধা থাকবে না। তুমি আগে কাউকে ভালোবাসলে দেখা যেত সেও এসে নূপুরের মত প্যাচ করছে। এমনিতেই যা প্যাচ লেগে আছে!'
রান্নাঘর থেকে শব্দ এলে জীবন দৌঁড়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে স্পৃহা হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন ছুটে গিয়ে স্পৃহার হাত ধরে বলল,
'কি হয়েছে? '
স্পৃহার কিছু বলতে হলো না। নিচে চায়ের ভাঙা কাপ। আর চা পড়ে থাকতে দেখে জীবন বুঝে গেল।
'গরম চা হাতে ফেলে দিলে কীভাবে? একটু সাবধানে কাজ করবে তো।'
জীবন বেসিনে নিয়ে স্পৃহার হাতে পানি দিলো। ফ্রিজ থেকে বরফ করে করে পুড়ে যাওয়া জায়গায় ধরে রাখলো। রুমে এসে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
'অনেক জ্বালা করছে? '
স্পৃহার সত্যিই অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু জীবনকে এতটা ব্যস্ত হতে দেখে তার ব্যথা যেন কমে গেল। 
'তুমি যে কি করো! নিজের প্রতি তোমার একটুও যত্ন নেই। সব কাজে তাড়াহুড়ো করে। দেখলে তো হাত পুড়িয়ে বসে আছো। কার কষ্ট হচ্ছে এখন?'
মলম লাগানোর সময় একটু একটু জ্বালা করছিল। স্পৃহা কিড়মিড় খেয়ে তা সহ্য করলো। 
'আমি কালই জয়কে বলবো তোমাকে ওখানে নিয়ে যেতে। এখানে থাকলে তুমি রান্না করে করে হাত পা সব পুড়িয়ে বসে থাকবে। একদিন দেখা যাবে শরীরে আগুন লেগে গেছে। যা কেয়ারলেস তুমি।' 
স্পৃহা জীবনের সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও সেদিন আরশির বলা কথাগুলো ভেতরে ভেতরে বড্ড জ্বালাচ্ছে। জীবনের মাঝে কিছু পরিবর্তনও সে লক্ষ করেছে। তবে এখন জীবনকে দেখে মনে হচ্ছে, জীবন সত্যিই স্পৃহার খেয়াল রাখে।

'আমি কি করবো বল? কেমন যেন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছি। এসবকিছু থেকে বেরই হতে পারছি না। যতই চেষ্টা করছি সবকিছু থেকে পিছু ছাড়ানোর ততই যেন আরো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলছি। জীবনটা সেই এক জায়গায় থেমে আছে। এক পা এগোতে চাইলে দু'পা পিছিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব।'
'তুই এতো চিন্তা করছিস কেন? বলেছি তো আমরা কোনো একটা রাস্তা বের করে ফেলবো।'
'তুই বুঝতে পারছিস না জয়। যতই দিন যাচ্ছে আমি এসবে ততই ফেঁসে যাচ্ছি। নূপুর কিছু বুঝতেই চাইছে না। ঐ দিকে স্পৃহাকেও জানাতে পারছি না।'
'এক কাজ করলে কেমন হয়। নূপুরের ভাইদের বল ওরা এসে যেন নূপুরকে নিয়ে যায়। তাদের বোনকে নিয়ে গিয়ে তারা যা ইচ্ছা তা করুক। আমার বোন আর তুই ওর থেকে মুক্তি পাবি এটাই বড় কথা।'
'নূপুর ওদের সাথে যেতে রাজি হবে? '
'রাজি না হলে জোর করে নিয়ে যাবে। সেলফিশ মেয়ে একটা। নিজের মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের সংসার ভাঙার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আগে তার ভালোবাসা কোথায় ছিল?'
'জানি না কিছু। আমার মাথা হ্যাং হয়ে আছে। স্পৃহাকে বিয়ে করার পর থেকে এক জায়গায় আটকে আছি। সবকিছু ঠিক থাকলে এতদিনে এক বাচ্চার বাপ হয়ে যেতাম। কিন্তু আফসোস আজ পর্যন্ত বা
জীবন থেমে গেলে জয় উৎসুক কন্ঠে বলল,
'বাচ্চার বাপ হতি। তারপর? তারপর কি বল না।'
'চুপ কর শালা। সব কথা তোকে বলতে হবে নাকি? '
'আগে তো বলতি।'
'হুম কিন্তু এখন বলা যাবে না। আমি আজ পর্যন্ত স্পৃহাকে প্রপোজই করতে পারলাম না। ঐ দিন সবকিছু অ্যারেঞ্জ করেও শেষমেশ আমার সব প্ল্যান জলে ভেসে গেল। এখন আমি কিছু জানি না। আমি স্পৃহাকে নিয়ে কাল পরশুই হানিমুনে যাব। কোথায় যাব, কীভাবে যাব তুই সব ব্যবস্থা কর। এখানে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব। এসব প্যরা আর দিতে পারছি না।'
'হানিমুন?'
'হুম।'
'বিয়ের ছয় সাত মাস পর? '
'হুম। তোর কোনো সমস্যা? '
'না আমার সমস্যা থাকবে কেন?'
'তাহলে তুই ব্যবস্থা কর। এক মাসের জন্য যাব। পারলে এক বছরের জন্য চলে যাই। হানিমুন থেকে একেবারে বাচ্চা কোলে করে ফিরি।'
জয় হাসতে হাসতে বলল,
'জীবন তুই পাগল হয়ে গেছিস।'
'পাগল না হয়ে আর উপায় আছে?'
স্পৃহার হাত পুড়ে গেছে। কোনো কাজ করতে পারে না।তাই জীবন স্পৃহাকে রেখে এ কয়দিন কোথাও বের হয়নি। নূপুরের সাথেও দেখা করতে যায়নি। আজ ওরা বাইরে যাবে। স্পৃহা এখনো জানে না ওরা কোথায় যাচ্ছে। জীবন একা একাই ব্যাগ গুছিয়েছে। স্পৃহা জীবনের রুমে বসে আছে। মারিয়া কল করলে স্পৃহা ফোন রিসিভ করে বলল,
'হ্যা আপু বলো।'
'কিরে শুনলাম তোরা নাকি হানিমুনে যাচ্ছিস। আমাকে তো জানালি না।'
স্পৃহা অবাক হয়ে বলল,
'আমি নিজেই তো জানি না কিছু। তোমাকে কে বলেছে? '
'জানিস না? ইস জীবন হয়তো তোকে সারপ্রাইজ দিবে ভেবেছিল। আমিই তাহলে গাধীর মত আগে তোকে জানিয়ে দিলাম।'
'উনি তো বলেছেন। আমার বেড়াতে যাচ্ছি।'
'আরে বেড়াতে যাওয়ার বাহানা দিয়েছে। জীবন বলতে লজ্জা পাচ্ছিল হয়তো। তাই হানিমুনের কথা বলেনি।'
স্পৃহা ভাবছে সত্যিই কি তারা হানিমুনে যাচ্ছে! মারিয়া বলল,
'এই ভেবলি শোন। হানিমুন থেকে খুশির খবর নিয়ে ফিরবি। আমি কিন্তু খালামণি হতে চাই।'
'আপু!'
'কিসের আপু হ্যা? যা বলেছি তা যেন হয়। এখন রাখি তুই রেডি হ। জয় একটু পরেই তোদের ওখানে যাবে।'
জীবন ওয়াশরুমে ছিল। জীবনের ফোন বাজলে সে ভেতর থেকে বলল,
'স্পৃহা দেখো তো কে কল করেছে।'
স্পৃহা ফোন কানে নেওয়ার সাথে সাথে ওপাশ থেকে নূপুর বলল,
'জীবন কোথায় তুমি? তিন দিন হয়ে গেল তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো না। তুমি কি আমাকে ভুলে যাচ্ছ জীবন? আমি কিন্তু সত্যিই তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তুমি বলেছিলে সবকিছু ঠিক করে দিবে। তুমি ঐ মেয়েটাকে এখনো ডিভোর্স দিচ্ছ না কেন? আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তুমি কি তা বুঝো না। আমি ফিরে এসেছি এবার তুমি ওকে ছেড়ে দাও। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে দেখা করতে আসো।'
স্পৃহা হতভম্ব হয়ে নূপুরের কথাগুলো শুনলো। তার চোখ ছলছল করছে। নূপুরের সাথে জীবনের এখনো যোগাযোগ আছে। তার মানে জীবন ঐদিন মিথ্যা বলেছে। জীবন বলেছিল এখন আর নূপুরের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে আরশি ঠিক বলেছিল। জীবন স্পৃহার আড়ালে নূপুরের সাথে দেখা করে। জীবন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
'কার কল ছিল?'
স্পৃহা ভাঙা গলায় বলল,
'জানি না। কথা বোঝা যায়নি। আপনি আবার কল করে দেখুন।'
ফোন হাতে নিয়ে নূপুরের নাম্বার দেখে জীবনের মুখ শুকিয়ে গেল। সে একনজর স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
'অফিসের কল। আমি বাইরে থেকে কথা বলে আসি।' 
জীবন চলে গেলে স্পৃহা মুখ চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেলল। জীবন তার কাছে এখনো মিথ্যা বলছে। 
দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে জীবন বলল,
'কি হয়েছে তোমার? সমস্যা কি? বারবার ফোন দাও কেন? '
'তুমি আমাকে এখানে রেখে গেছ আজ তিনদিন হয়েছে। তার মধ্যে তুমি একবারো আমাকে দেখতে আসো নি। ফোনও দাও নি। আমি ফোন দিলে তুমি ফোন তুলো না। তুমি আমাকে ইগনোর করছো জীবন।'
রাগে জীবনের মাথা ফেটে যাচ্ছে। আজ সে সত্যি সত্যিই নূপুরকে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিবে। 
'আমার অনেক কাজ আছে নূপুর। সব কাজ ফেলে তো আমি তোমার কাছে গিয়ে বসে থাকতে পারবো না। আর দিনে হাজার বার ফোন করে তোমার খোঁজ নেওয়ারও কোনো মানে নেই। আমি জানি তুমি ঠিক আছ।'
'তুমি এভাবে আমার সাথে কথা বলছো কেন?'
'এর থেকে ভালো ভাবে এখন কথা বলতে পারছি না সরি।'
'জীবন তুমি যদি এক্ষুনি আমার কাছে না আসো তাহলে আমি কিন্তু ছুরি দিয়ে হাত কেটে ফেলব। নিজেকে শেষ করে দিব আমি।'
'এই এক ভয় কত দেখাবে নূপুর? তোমার লাইফ তুমি রাখবে না শেষ করে দিবে তা তোমার ব্যাপার। আমি আর তোমার এসব বাজে কথায় ভয় পাই না।'
'বাজে কথা না জীবন। আমি সত্যি কথাই বলছি।'
'তোমার যা ইচ্ছা করো। প্লিজ এসবের মধ্যে আমাকে আর জড়াবে না। তুমি তোমার ভাইদের কাছে ফিরে যাও। আমি আর এসব নিতে পারছি না।'
'আচ্ছা ঠিক আছে।'
নূপুর ফোন রেখে দিলে জীবন কতক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে শান্ত করে নিলো। 
'এই পাগল মেয়ে সত্যি সত্যিই সুইসাইড করলে তখন আবার অন্য ঝামেলা হবে। ওকে বোঝাতে হবে। ভালো কথায় না বুঝলে ওর ভাইদের খবর দিব। বোনকে এসে নিয়ে যাক। আর আমাকেও শান্তিতে বাঁচতে দিক। বিরক্ত হয়ে গেছি ওর জ্বালায়। একবার যাই ওর কাছে। আজ সবকিছুর একটা বিহিত করে তবেই ফিরব।'
জীবন রুমে গেল। শার্ট গায়ে দিয়ে স্পৃহাকে বলল,
'স্পৃহা আমি এক্ষুনি আসছি। তুমি রেডি হয়ে থেকো। রাত দশটায় আমাদের ফ্লাইট। একটু পরে জয় আসবে। যদিও আমার দেরি হবে না। তবু যদি দেরি হয় তাহলে তুমি জয়ের সাথে এয়ারপোর্টে চলে যেও।'
স্পৃহা হ্যা না কিচ্ছু বলল না। কারণ সে জানে জীবন এখন কোথায় যাচ্ছে। 

জীবন বেরিয়ে যাবার একটু পরেই আরশি এলো। 
'স্পৃহা চলো।'
'আমি এখন কোথাও যাব না আরশি।'
'আরে তোমার ভালোর জন্যই বলছি চলো তো।'
জীবনের পেছন পেছন আরশি স্পৃহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। জীবন হোটেলে পৌঁছে দেখে নূপুরের হাতে সত্যিই একটা ছুরি। নূপুর জীবনকে দেখে বলল,
'তোমার বিশ্বাস হচ্ছিল না তো? এই দেখো আমার হাতে এটা কি।'
জীবন নূপুরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
'নূপুর ওটা ফেলে দাও। পাগলামি করবে না একদম। আমি এক্ষুনি তোমার ভাইদের বলছি উনারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।'
নূপুর হাসতে হাসতে বলল,
'ঘাড় থেকে বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চাইছ? আমি তোমাকে আগেও বলেছি, আমি সবাইকে ছেড়ে চলে এসেছি। উনাদের স্পষ্ট জানিয়ে এসেছি আমি তোমার কাছে চলে আসছি। তোমার কি মনে হয় ভাইয়ারা এতদিনেও আমাকে নিতে আসতো না? আমি কোনদিন ওবাড়িতে ফিরবো না। আর ভাইয়ারাও আমাকে নিতে আসবে না।'
'আচ্ছা তুমি ওখানে না ফিরো তবুও হাত থেকে ছুরিটা ফেলো। লেগে যাবে তোমার।'
'লাগুক। মরতে চাই আমি। আমি মরে গেলে তুমি মুক্তি পাবে।'
'নূপুর তুমি যা পাগলামি করছো এতে শুধু তোমারই ক্ষতি হবে। এমন করো না প্লিজ। তুমি চাইলেই ভালো থাকতে পারবে। বাসায় ফিরে গিয়ে তুমি রায়হানকে বিয়ে করো। ও তোমাকে সুখে রাখবে।'
জীবনের কথা শুনে নূপুর অস্বাভাবিক ভাবে হাসতে লাগলো। জীবন তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। জীবন ছুটে এসে নূপুরের হাত থেকে ছুরি নিয়ে নিলো। নূপুরের গালে চড় মেরে বলল,
'পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছ তুমি? কি করছো এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার? '
জীবন রুমাল বের করে হাতে বেধে দিয়ে নূপুরকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়িতে উঠতে গেলে নূপুর থেকে দাঁড়াল।
আরশি স্পৃহাকে নিয়ে হোটেলে ঢুকতে যাবে এমন সময়ই ওরা বেরিয়ে এলো। আরশি স্পৃহার হাত ধরে টেনে আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। আরশি বলল,
'দেখলে তো জীবন এখনো এই মেয়ের সাথে দেখা করে। এই নূপুরের জন্য জীবন কখনো আমাকে পাত্তা দেয় নি। নূপুরের সামনে ওর কাছে আর কেউ গুরুত্ব রাখে না। এই মেয়ের জন্য জীবন তোমাকেও ধোঁকা দিচ্ছে। নিজের চোখেই দেখে নাও এবার। ঐদিন আমার কথা তো তুমি বিশ্বাস করো নি।'
স্পৃহা অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। সে আজ যা দেখছে সবই যেন দুঃস্বপ্ন। 
হঠাৎ নূপুর হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জীবনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
'তুমি সত্যিই আমাকে আর ভালোবাসো না জীবন? '
জীবন কি বলতে বুঝতে পারছে না। সত্যি বললে হয়তো নূপুর আরো পাগলামি করবে। জীবন বলল,
'এখন এসব কথা কেন? '
'বলো না। তুমি আমাকে চাও না? আচ্ছা তুমি এটা চাও আমি তোমাদের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাই?'
'না চাই না।'
'তুমি আমার জন্য তোমার বৌকে ছাড়তে পারবে? '
জীবন চুপ করে আছে। নূপুর আবার বলল,
'বলো না জীবন। পারবে স্পৃহাকে ছেড়ে দিতে।'
'হু। '
স্পৃহা এটুকু শুনেই এখানে আর দাঁড়াতে পারলো না। সে আরশিকে বলল,
'আমাকে প্লিজ বাসায় দিয়ে এসো আরশি। আমি আর এখানে দাঁড়াতে পারবো না।'
আরশি স্পৃহাকে নিয়ে চলে আসার একটু পরই নূপুর জীবনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
'মিথ্যা বলছো তুমি। তুমি একটা মিথ্যাবাদী। তোমার মুখ এই কথা বললেও তোমার চোখ অন্য কিছু বলছে। তুমি কখনোই স্পৃহাকে ছাড়তে পারবে না। তুমি অনেক আগেই আমার জায়গা স্পৃহাকে দিয়ে দিয়েছ জীবন। আমি ফিরে আসায় তুমি একটুও খুশি হওনি। প্রথম দিনই আমি এটা বুঝে গিয়েছিলাম। তবুও আমি তোমার কাছে আসার জন্য জোর করেছি। কিন্তু আমি প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারছি তুমি এখন আমাকে না স্পৃহাকে ভালোবাসো। আমার উপর দয়া দেখিয়ে তুমি সত্যটা বলতে পারছিলে না। তুমি ভেবেছিলে তুমি স্পৃহাকে ভালোবাসো এটা শুনলে আমি কষ্ট পাব। হ্যাঁ জীবন সত্যিই আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। তোমার মনে আমার জন্য একটুও জায়গা নেই। অবশ্য সেই জায়গা আমিই হারিয়েছি। আমি নিজের দোষে তোমাকে পেলাম না জীবন।'
'নূপুর তুমি কষ্ট পাবে। তাই তোমাকে বলিনি। আমি সত্যিই স্পৃহার মায়ায় জড়িয়ে গেছি। এখন আমি ওকে ছাড়তে পারবো না।'
'জানি জীবন। তুমি না বললেও তোমার চোখ দেখে আমি সব বুঝতে পারি। ভুল আমারই। আমিই তোমাদের মাঝে আসতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু না। আমি ভুল ছিলাম। তুমি আর কখনো আমার কাছে ফিরে আসবে না।'
'নূপুর এসব কথা পরে হবে তোমার হাত অনেকটা কেটে গেছে।'
'যাক। হাত কেটে শরীরের সব রক্ত ঝরে যাক। তুমি আমাকে বাসায় দিয়ে আসবে জীবন? আমি আর তোমাদের মাঝে থাকতে চাই না। ভাইয়ারা আমাকে ক্ষমা না করলেও আমি ঠিক ওদের বুঝিয়ে নিব। তুমি তোমার বৌয়ের কাছে ফিরে যাও। আমাকে নিয়ে টেনশন করবে না। আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো। হ্যা কয়দিন একটু পাগলামি করেছি। আমার স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। তবুও বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আমাদের পথ অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছে।' 
'নূপুর তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।'
'ছি ছি! তুমি ক্ষমা চাইছ কেন? যা হয়েছে তা আমাদের ভাগ্যে লিখা ছিল। ক্ষমা তো আমার তোমার কাছে চাওয়া উচিত। এই কয়দিন তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি। তুমিও মুখ বুঝে আমার সব অন্যায় আবদার সহ্য করেছ।'
জীবন নূপুরকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। আজ তার আর স্পৃহার মধ্যে কেউ নেই। এবার সে স্পৃহা কে নিজের ভালোবাসার কথা বলতে পারবে। স্পৃহাকে নিজের করে নিতে পারবে। জীবনের আর কোনো ভয় নেই। নেই কোনো পিছুটান। নূপুর নিজে থেকেই ওদের জীবন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। জীবন ঘড়ি দেখল। দশটা বাজতে এখনো অনেক দেরি। এই সময়ে বাসায় গিয়ে স্পৃহাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যেতে পারবে। জীবনের সত্যিই আজ খুশি লাগছে। স্পৃহাকে নিয়ে নতুন একটা জায়গায় গিয়ে সে নতুন করে পথ চলা শুরু করবে। 
'এই রাস্তা এখনো শেষ হচ্ছে না কেন? কখন আমি স্পৃহার কাছে যাব? উফ এই জ্যাম আমার জীবন নিয়ে ছাড়বে। স্পৃহার কাছে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে।'
স্পৃহা জীবনের দেওয়া নীল শাড়ি পড়ে বসে আছে। স্পৃহা আজ তার জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিয়েছে। এতক্ষণ কাঁদলেও সে এখন আর কাঁদছে না। জীবন ফিরে এসে সোজা স্পৃহার কাছে চলে আসে। তার দেওয়া শাড়িতে স্পৃহাকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বলে,
'স্পৃহা তুমি রেডি হয়ে গেছ? জয় এখনো আসেনি? '
স্পৃহা চুপ করে আছে। জীবন আবার বলল,
'সবকিছু নেওয়া হয়েছে? তোমার কোনো জিনিস বাদ পড়েনি তো?'
এবারও স্পৃহা চুপ করে আছে। জীবন স্পৃহার কাছ এসে তার হাত ধরে বলে,
'তোমাকে আজ আমি অনেক কথা বলবো স্পৃহা। আমি তোমাকে ভাল
স্পৃহা জীবনের হাত ছাড়িয়ে বলল,
'নূপুর এখন কেমন আছে? এতো সহজে ও আপনাকে আসতে দিয়েছে? '
জীবন বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বলল,
'হ্যা? '
'আপনি তো নূপুরের কাছে গিয়েছিলেন।'
'স্পৃহা তুমি 
জীবনের কোনো কথা স্পৃহা শুনছে না। সে নিজে নিজেই বলছে, 
'জানেন আমাদের বিয়ের আজ কয় মাস হয়েছে? সাত মাস চার দিন। এই সাত মাসে আমরা কখনো স্বামী স্ত্রীর মত থেকেছি? বিয়ের আগেই আমি জানতাম আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে। আপনি যখন আমার বাবা মা'র কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তখন এই কথাটা আমাকে ভেতরে ভেতরে খাচ্ছিলো। কেন আপনি গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বত্বেও আমাকে বিয়ে করছেন? আপনি আমাকে বিয়ে করলেন ঠিকই। কিন্তু আমার সাথে কখনো স্বাভাবিক হতে পারেন নি। আপনার অতীত সম্পর্কেও আমাকে কিছু জানান নি। সাতটা মাস ধরে আমরা আলাদা রুমে আছি। বিয়ের পরও যে স্বামী স্ত্রী আলাদা রুমে থাকে তা আমার জানা ছিল না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আমি ভাবতাম লোকটা আমাকে ভালোবাসে না তো কি হয়েছে। আমার খেয়াল রাখে। আমাকে সম্মান করে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম আপনি আমার খেয়ালও রাখেন না। শুধুমাত্র নূপুরকে দেখানোর জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। নূপুরকে ফিরে পাবার জন্য আমাকে ব্যবহার করেছেন।'
'তুমি আমাকে ভুল বুঝছো স্পৃহা। '
স্পৃহার চোখ বেয়ে পানি পরছে। সে বলল,
'এতদিন ভুল বুঝে এসেছি। আজ আর ভুল বুঝছি না। আচ্ছা এই সাত মাসে কি আপনার মনে আমার জন্য একটুও অনুভূতি তৈরি হয়নি। আজ নূপুরের কাছে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলার সময় আপনার একটুও কষ্ট হয়নি? কীভাবে বলতে পারলেন আপনি? '
জীবন বুঝতে পারছে স্পৃহা কোনো ভাবে ওর আর নূপুরের কথা শুনেছে। তবে অর্ধেক কথা শুনেছে স্পৃহা। পুরো কথা শুনেছি। 
'জানি না তুমি এসব কার কাছ থেকে শুনেছ। আমি শুধু একটা কথাই বলবো। তুমি পরের কথাগুলো শোনো নি।'
'আর কি শোনার বাকি ছিল? নিজের চোখে দেখেছি নূপুর আপনার বুকে ছিল। নিজের কানে শুনেছি আপনি নূপুরকে বলেছেন আমাকে আপনি ছাড়তে পারবেন। আমি কি আপনার কাছে এতটাই ফেলনা? আপনার জীবনে আমার কোনো মূল্য নেই?'
'স্পৃহা প্লিজ একবার আমার কথা শোনো।'
'আর কিছুই শোনার নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি আর আপনার সাথে থাকবো না। যার মনে আমার জন্য ভালোবাসাই নেই শুধু শুধু তার সাথে কেন থাকব? আমাদের এই সম্পর্কের কোনো মানে হয় না। কাগজে সই করে একটা সম্পর্কে আটকা থাকার মানে নেই। আমি নিজেই আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি নূপুরকে নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে পারেন। আমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিলে আমি সাইন করে দিব। আমাদের আলাদা হয়ে যাবার কারণ কাউকে কিচ্ছু বলবো না।'
জীবন স্পৃহার হাত ধরে বলল,
'তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আমি তোমাকে যেতে দিব না। তুমি আমার সাথেই থাকবে।'
স্পৃহা জীবনের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
'কেন আটকাবেন আমাকে? কোন অধিকারে? কিসের জন্য থাকবো আপনার সাথে? আমাদের দু'জনের জন্য এটাই ভালো হবে আমরা আলাদা হয়ে যাই।'
স্পৃহা অনেক কাঁদছে। কাঁদছে কাঁদছে সে হঠাৎ জীবনকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে গিয়ে বলল,
'আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না এটা জেনেও আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। আপনি কখনো আমার ভালোবাসা বুঝেন নি। কখনো আমাকেও বুঝতে চেষ্টা করেন নি। আজ চলে যাবার আগে আপনার কাছে একটাই অনুরোধ। আজকের পর আপনি আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। আমি আপনাকে দেখতে চাই না। হয়তো আপনাকে দেখলে আমি নিজেকে শক্ত রাখতে পারবো না। আপনার কাছে চলে আসতে ইচ্ছে করবে। বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই আর আপনার সাথে থাকতে চাই না। এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই আমি। মিথ্যে একটা সম্পর্কে থেকে সব সময় কষ্ট পাওয়ার চেয়ে। আলাদা হয়ে একেবারে কষ্ট পাই। দেখা যাবে কয়েক মাস বা কয়েক বছর পর নিজেকে সামলে নিতে পারবো। যে কথাটা কখনো কাউকে বলিনি, যাবার আগে আজ শেষ বার তা আপনাকে বলছি। অনেক ভালোবাসি আপনাকে। আমি কোথায় আছি, কীভাবে আছি তা কখনো জানার চেষ্টা করবেন না। আমার কসম।'
স্পৃহা জীবনকে ছেড়ে দিয়ে দৌঁড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। স্পৃহা চলে গেলে জীবন হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়লো। স্পৃহা কি বললো এসব? স্পৃহাও জীবনকে ভালোবাসে! কিন্তু জীবন তো কখনো বুঝতে পারেনি। আর স্পৃহাও বুঝতে দেয়নি। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন