নূপুর এতক্ষণ অবাক হয়ে জীবনকে দেখছিল। জীবন বিয়ে করে ফেলেছে এটা সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। নূপুর একবার স্পৃহার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার জীবনের দিকে তাকাচ্ছে। জীবন কীভাবে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারলো। বৌ নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে। আসার সময় জীবন মেয়েটার হাত ধরে রেখেছিল। নূপুরের চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। সত্যিই কি জীবন এতটা পাল্টে গেছে? তার সামনে থেকেও একবার তার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। জীবন বসেও স্পৃহার ডান হাত ওর দু'হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে। টেবিলের দিকে তাকিয়ে জীবন বলল,
'আপনার সাথে ইনি কে রায়হান সাহেব? পরিচয় করালেন না তো।'
'স্যার ও হচ্ছে নূপুর। আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে যাচ্ছি।'
'ওহ কনগ্রেচুলেশন।'
'থ্যাঙ্কিউ স্যার।
রায়হানের মুখে নূপুর নামটা শুনে ছলছল চোখে স্পৃহা নূপুরের দিকে তাকালো। তাহলে এই মেয়েটাই নূপুর। জীবন একেই ভালোবাসে। কিন্তু এই মেয়েটা তাহলে এই ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছে কেন? কেনই বা জীবন ওকে না চেনার ভান করছে। দু'জন সামনাসামনি থেকেও একজন আরেক জনের দিকে তাকাচ্ছে না। কথা বলছে না। দু'জনই এমন করছে যেন কেউ কাউকে চিনে না। রায়হান নূপুরকে বলল,
'নূপুর ইনি হচ্ছেন আমার অফিসের বস।'
নূপুর এবার জীবনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলল,
'ওহ।'
জীবন বেশ ভাবসাব নিয়ে বলল,
'হ্যালো মিসেস নূপুর। নতুন জীবনের জন্য কনগ্রেস।'
নূপুর কিছু বললো না। স্পৃহা এবার সবটা বুঝতে পারছে। নূপুর অন্য কাউকে বিয়ে করছে বলেই হয়তো জীবনও জেদ করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চেয়েছে। তখন স্পৃহা অবস্থা দেখে জীবন নিজের জেদ পূরণ করার জন্য আর সমাজের থেকে স্পৃহা বাঁচানোর জন্য তাকে বিয়ে করে নিয়েছে। স্পৃহা চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না। সে জীবনের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। জীবন আজ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে নূপুরকে দেখানোর জন্য। শুধু নূপুরকে কষ্ট দেয়ার জন্য জীবন স্পৃহাকে বিয়ে করেছে।
খেতে খেতে পুরোটা সময় জীবন আর রায়হান নিজেদের মধ্যে কথা বলেছে। জীবন মাঝে মাঝে কয়েক কথায় নূপুরকে টেনে এনেছে। তবুও নূপুর কথা না বলে চুপ করে থেকেছে। নূপুর কিছু খাচ্ছে না দেখে রায়হান বলল,
'নূপুর তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না। এখানের খাবার ভালো লাগছে না?'
'তেমন কিছু না।'
জীবনও এবার ওদের দেখিয়ে স্পৃহার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,
'তুমিও তো কিছু খাচ্ছ না স্পৃহা। এমন করলে কীভাবে হবে বলো? খাওয়া দাওয়ার প্রতি তোমার একদম খেয়াল নেই। নিজের হাতে ভালো করে খেতেও পারো না। এই নাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি। চুপচাপ খেয়ে নাও।'
স্পৃহা খাবার মুখে নিতে পারছে না। জীবন এখন যা করছে সব কিছুই নূপুরকে দেখানোর জন্য করছে। নূপুর ওদের দেখছে আর মনে মনে বলছে,
'আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য তুমি এসব করছো জীবন। তুমি আমার উপর রাগ করে বিয়ে করে নিলে। এখন আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য এই মেয়েটার হাত ধরে রাখছো। ওকে আমার সামনে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছ। কীভাবে পারছো তুমি এমনটা করতে? আমি তোমাকে কেন ছেড়েছি তা জানলে তুমি এমনটা করতে পারতে না। কিন্তু আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারবো না। তুমি আমাকে দেখিয়ে যা-ই করো না কেন সত্যিটা আমি তোমাকে জানাতে পারবো না।'
জীবন আড়চোখে নূপুরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
'দেখো নূপুর নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে দেখলে কেমন লাগে। কেমন লাগে যখন তোমার ভালোবাসার মানুষ অন্য কারো হয়ে যায়। তুমিও আমাকে এই কষ্টটাই দিয়েছো। আর তাইতো আমি স্পৃহাকে তোমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলাম। এবার দেখি তুমি আমাকে অন্য কারো সাথে মেনে নিতে পারো কিনা।'
স্পৃহা নূপুরের দিকে খেয়াল করছে নূপুরের চোখে একরাশ কষ্ট নিয়ে জীবনের দিকে তাকাচ্ছে। জীবন এসব করে মনে মনে আনন্দ পাচ্ছে। স্পৃহা আর ওদের সামনে বসে থাকতে পারছে না। স্পৃহা মাথা ব্যথার বাহানা দিয়ে উঠে গেছে। জীবনও স্পৃহার মাথা ব্যথার কথা শুনে ওখানে আর বসলো না। জীবন কার ড্রাইভ করছে। স্পৃহা তার পাশের সীটেই বসে আছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা জীবনের চোখের আড়ালে লুকিয়ে কাঁদছে। জীবন ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে কয়েকবার স্পৃহাকে দেখলো। বলল,
'অনেক মাথা ব্যথা করছে? '
স্পৃহা 'হুম' তে উত্তর দিল। জীবন স্পৃহার কন্ঠ শুনে বলল,
'স্পৃহা তুমি কাঁদছো? '
'উঁহু।'
জীবন রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল,
'মিথ্যে বলছো কেন আমার সাথে? তুমি কাঁদছো। তাকাও আমার দিকে। এদিকে ফেরো।'
স্পৃহা জীবনের দিকে না তাকিয়েই বলল,
'ছোট থেকেই আমি মাথা ব্যথা সহ্য করতে পারি না। একটু ব্যথা করলেই কাঁদতে শুরু করে দেই। আপনি চিন্তা করবেন না। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলেই হবে। একটু ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। '
জীবন কথা না বাড়িয়ে ফুল স্পিডে কার ড্রাইভ করে বাসায় চলে এলো। স্পৃহা আগে আগে লিফটে এসে দাঁড়াল। ভেতরে গিয়েও দরজা খোলার সাথে সাথে স্পৃহা নিজের রুমে চলে এলো। রুমের লাইট অন না করেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। অন্ধকারে বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে স্পৃহা। এই জন্যই জীবন কখনো তাকে মেনে নিতে পারেনি। স্বামী স্ত্রী হয়েও দু'জন আলাদা থাকে। সবার সামনে ওরা স্বামী স্ত্রী হয়ে থাকলেও তাদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক এখনো তৈরি হয়ে উঠেনি। হঠাৎ স্পৃহা কি হয়ে গেল এটা ভেবে জীবনও বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।
'একটু আগে তো মেয়েটা ঠিকই ছিল। ওখানে যাওয়ার পর ওর সাথে কি হলো?'
জীবন স্পৃহার রুমে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ভেতরে অন্ধকার। জীবন ওখান থেকে চলে এলো। ডাইনিং থেকে একগ্লাস পানি আর মেডিসিন এর বক্সটা নিয়ে স্পৃহার রুমে গেল। ভেতরে ঢুকে লাইট অন করে বলল,
'স্পৃহা একটু উঠে বসো। মেডিসিন না নিলে তো ব্যথা সারবে না। কষ্ট করে একটু ওঠো প্লিজ। পেইনকিলার নিলে একটু পরেই দেখবে তুমি ঠিক হয়ে যাবে।'
জীবন স্পৃহাকে তুলে পেইনকিলার ওর হাতে দিলো। পানির গ্লাস স্পৃহা মুখে তুলে দিলে স্পৃহা জীবনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো। জীবন কিছু বুঝতে না পেরে হাত থেকে পানির গ্লাস রেখে স্পৃহাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। স্পৃহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
'খুব কষ্ট হচ্ছে? ডক্টরের কাছে যাবে চলো। হঠাৎ করে কি হয়ে গেল তোমার? এভাবে বসে থাকা ঠিক হবে না। আসার সময় ডক্টরের কাছে থেকে হয়ে আসা দরকার ছিল।'
স্পৃহা কান্না চাপা গলায় বলল,
'কোথায় যেতে হবে না। আমি এমনিতেই ঠিক হয়ে যাব।'
'এমনিতে ঠিক হবে কীভাবে? তুমি কাঁদছো স্পৃহা। তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমি তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবো না। চলো তুমি আমার সাথে।'
'বললাম তো কোথাও যেতে হবে না।' স্পৃহা কথাটা একটু জোরেই বলল। জীবন বলল,
'আচ্ছা ঠিক আছে। যেতে হবে না। তাহলে তুমি শুয়ে থাকো। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।'
'আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন।'
এবার জীবন ধমক দিয়ে বলল,
'চুপ। একদম জেদ করবে না। আমি যা বলছি তা করো।'
রুম অন্ধকার করে দিয়ে জীবন স্পৃহাকে শুইয়ে দিয়ে ওর পাশে আধশোয়া হয়ে বসে স্পৃহার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জীবন আস্তে করে বলল,
'এখনো কষ্ট হচ্ছে স্পৃহা?'
স্পৃহা উত্তর দিল না। সে মনে মনে বলল,
'আমার এই কষ্ট আপনি বুঝতে পারবেন না। ডক্টরের কাছে গেলে শত মেডিসিন নিলেও এই কষ্ট কমবে না। কেউ এই কষ্ট দূর করতে পারবে না। আপনি কেন আমার সাথে এমনটা করলেন? নূপুরকে ভালোবাসা স্বত্বেও আমাকে কেন বিয়ে করলেন? আমার বাবা মা কেউই তো আপনার সাথে আমার বিয়ে দিতে চান নি। আপনিই সবাইকে রাজি করালেন। শুধু কি নূপুরের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার সাথে এতো বড় অন্যায় করলেন? একটা বারও ভাবলেন না যাকে ভালোবাসেন না তার সাথে কীভাবে সারাটা জীবন কাটাবেন? নাকি জীবন নামের এই রাস্তার মাঝপথে এসে আপনি আমাকে ছেড়ে দিবেন?'
স্পৃহা আর ভাবতে পারছে না। যত ভাবছে মাথাটা ততই ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে। স্পৃহার চুলে বিলি কাটতে কাটতে জীবন মনে মনে বলল,
'স্পৃহাকে আজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়াই উচিত হয়নি। আমার বোঝা উচিত ছিল স্পৃহা বাসা থেকে বের হলে কমফোর্টেবল ফিল করে না। তার উপর কতক্ষণ ওখানে থাকলাম।'
স্পৃহা ঘুমিয়ে পড়েছে। জীবন অন্য রুমে না গিয়ে স্পৃহার পাশেই বসে রইলো। একসময় সেও ঘুমিয়ে গেছে।
সে রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে রায়হান নূপুরকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়। নূপুর বাড়িতে ঢুকেই কাউকে কিছু না বলে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে নূপুর। তার জন্যই জীবন এসব করছে। নূপুর সেদিন জীবনকে ফিরিয়ে না দিলে জীবন অন্য কারো হতো না। একটানে বিছানার চাঁদর তুলে নিচে ফেলে দিলো নূপুর। ঘরের সব জিনিস উলটপালট করে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো।
'আমি তোমাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারি না জীবন। এটা তুমি খুব ভাল করেই জানো। তবুও আজ তুমি এমনটা করলে। আমাকে কষ্ট দেবার জন্য ঐ মেয়েটাকে আমার সামনে খাইয়ে দিলে। আমি নাহয় কথা রাখিনি। কিন্তু তুমিও তো তোমার কথা রাখো নি। তুমি সেদিন বলেছিলে কোনো মেয়ের দিকে তুমি তাকাবে না।'
নূপুর জীবনের সাথে কাটানো আগের কিছু কথা মনে করছে। জীবন সেদিন প্রথম নূপুরকে ওর ভার্সিটি থেকে আনতে গিয়েছিল। গেট থেকে বের হয়ে নূপুর সামনে জীবনকে দেখে খুশি হয়ে ওর কাছে ছুটে এলো৷ কিন্তু জীবন তখন অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। তাই নূপুরকে দেখতে পায়নি। নূপুর জীবনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
'ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছো তুমি? আমিও দেখি তুমি এতো মনোযোগ দিয়ে ওদিকে তাকিয়ে আছো কেন?'
নূপুরের কথায় জীবন ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
'আরে তুমি কখন বের হলে? '
'যখন তুমি হা করে ঐ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলে।'
'সত্যিই মেয়েটা খুব সুন্দর। '
'জীবন! '
'আরে চিৎকার করছো কেন? আমি শুধু একটু মজা করছিলাম। তুমি আসছিলে এটা দেখেই ওদিকে তাকিয়ে ছিলাম।'
'মিথ্যা বলার আর জায়গা পাও না? আমি জানি ঐ মেয়েটাকে তোমার ভাল লেগেছে।'
'নাউজুবিল্লাহ বলো কি এসব! তোমাকে ছাড়া আমার আর কোনো মেয়েকে ভাল লাগতে পারে? '
'অবশ্যই পারে। এইতো হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম।'
'বাজে কথা রেখে বাইকে উঠে বসো তো। আজ অনেকক্ষণ ঘুরবো।'
'আমি তোমার সাথে কোথাও যাব না।' বলেই নূপুর হাঁটা শুরু করলো। জীবন বাইক থেকে নেমে এসে নূপুরের হাত ধরে বলল,
'একটুতেই তুমি এতো রেগে যাও কেন? আমি তো বলছি, আমি জাস্ট মজা করছিলাম। প্লিজ আর রাগ করো না। আমি সব কাজটাজ ফেলে তোমার কাছে ছুটে এসেছি।'
নূপুর দাঁড়িয়ে বলল,
'সত্যি তুমি শুধু মজাই করছিলে? অন্য কোনো ব্যাপার না তো?'
'আরে নাহ। গড প্রমিজ।'
'আচ্ছা মানলাম। কিন্তু একটা শর্তে আমি তোমার সাথে যেতে রাজি হবো।'
'তোমার সব শর্তই আমি মাথা পেতে মেনে নিব। এখন বলো শর্তটা কি?'
'আমাকে ছাড়া তুমি আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকাবে না। বলো তুমি রাজি?'
জীবন একটু ভেবে বলল,
'উম,বড় আম্মু আর আরশির দিকেও তাকাতে পারবো না? ওরাও তো মেয়ে।'
নূপুর তেড়ে এসে বলল,
'জীবন! তুমি আমার কথার মানে বুঝতে পেরেও এমন বলছো। আমি কিন্তু তোমার সাথে আর কথাই বলবো না।'
জীবন নূপুরের হাত ধরে একটানে ওর নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
'রাজি। আমি তোমাকে ছাড়া আর অন্য কোনো মেয়ে দিকে তাকাবো না।'
কথাটা মনে হতেই নূপুর ফুলদানিটা হাতে নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় ছুড়ে মারলো। ফ্লোরে শুয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
'তুমিও তোমার কথা রাখো নি। আমরা কেউই আমাদের কথা রাখতে পারিনি। তুমিও আমার মতই বেইমান। আমি তোমার ভালোর জন্যে তোমাকে ছেড়েছি। কিন্তু তুমি সবটা না জেনে বিয়ে করে নিলে।'
রাতে নূপুর এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি। সারারাত সে জেগে ছিল। জীবনের সাথে কাটানো মুহূর্তের স্মৃতি গুলো তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না।
ন'টা বা সাড়ে ন'টার দিকে জীবনের চোখ খুললো। কখন সকাল হয়েছে সে বুঝতে পারে নি। কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। ফজরের আজানের একটু আগে আগে চোখটা লেগে এসেছে। জীবন চোখ খুলে দেখে সে স্পৃহার মাথার পাশে শুয়ে আছে। স্পৃহা তার ডান হাত জড়িয়ে ধরে রেখেছে। জীবন স্পৃহার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। ঘুমের মধ্যে কতই না মায়াবী লাগছে। যতদিন যাচ্ছে জীবন ততই যেন স্পৃহার মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে। কাল যখন স্পৃহা মাথা ব্যথায় কাঁদছিল তখন জীবনের কাছে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছিল। জীবন এতদিনে বুঝতে পেরেছে সে স্পৃহার চোখে পানি সহ্য করতে পারে না। জীবন ওঠার চেষ্টা করলে স্পৃহা একটু নড়ে উঠলো। স্পৃহাকে নড়তে দেখে জীবন আর উঠলো না। আরো কিছুক্ষণ স্পৃহার পাশেই শুয়ে রইলো। স্পৃহা ঘুমের মধ্যেই তার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলো। জীবন হেসে ফেললো। বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
' ন'টা বেজে গেল! এতো বেলা কখন হলো? '
জীবন আস্তে করে স্পৃহাকে ডাকলো,
'স্পৃহা! এই স্পৃহা! '
জীবনের ডাক শুনে স্পৃহা নড়েচড়ে আবার ঘুমুচ্ছে। জীবন আর তাকে ডাকলো না। খুব সাবধানে স্পৃহার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওঠে গেল।
'রাতে মেয়েটা একটুও ঘুমাতে পারে নি। হঠাৎ করে মাথা ব্যথা এতো কাবু করে ফেললো কীভাবে? আজ একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।'
জীবন ফ্রেশ হয়ে কিচেনের দিকে গেল। আজ আর তার অফিসে যাওয়া হবে না। স্পৃহাকে একা ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। জীবন ফ্রিজে দেখলো কী কী আছে। স্পৃহার জন্য আজ জীবন নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট বানাবে।
'কী বানানো যায় ওর জন্য? প্রতিদিন তো ও-ই রান্না করে। আমিও কতটা গবেট। একাই মেয়েটা সব কাজ করে। আমি নিজে একটু হেল্প করবো তো দূর। একটা কাজের লোকও রাখলাম না।'
জীবন হাত চালাতে চালাতে বলল,
'স্পৃহার ঘুম ভাঙার আগে সবকিছু রেডি করে ফেলতে হবে। জীবন বাবা তাড়াতাড়ি হাত চালা।'
স্পৃহা মিটমিট করে চোখ খুলে উঠে বসলো। এখনো চোখ থেকে ঘুম যায় নি। চোখ ডলতে ডলতে কয়েকবার হাই তুললো সে।
'কয়টা বাজে এখন? উনি অফিসে চলে গেলেন নাকি?'
আড়মোড়া ভেঙ্গে স্পৃহা বিছানা ছেড়ে উঠতে নিচ্ছিল। ঠিক তখনই জীবন ট্রেতে করে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
'উঠে গেছো? ঘুম কেমন হয়েছে? মাথা ব্যথা এখনো আছে নাকি?'
জীবনকে দেখে স্পৃহার চোখ থেকে সব ঘুম চলে গেল। সে আবারো চোখ কচলিয়ে জীবনের দিকে ভালো করে তাকালো। ততক্ষনে জীবন খাবারের ট্রে টেবিলের উপর রেখে স্পৃহার পাশে বসতে বসতে বলল,
'আজ আমি নিজে তোমার জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এসো তো। আমারো অনেক খিদে পেয়েছে। কত সকালে উঠেছি খবর আছে?'
জীবন স্পৃহার হাত ধরে টেনে তুলে তাকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলো। স্পৃহা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই জীবন তাকে ধরে নিয়ে আবার বিছানায় বসিয়ে দিলো। খাবার ট্রে স্পৃহার সামনে রেখে বলল,
'নাও শুরু করো।'
স্পৃহা ট্রের উপর একবার চোখ বোলালো। জুস, টোস্ট, অমলেট, চা আর কিছু ফল। একটা ছেলে মানুষ যা যা বানাতে পারে আরকি। স্পৃহা মনে মনে বলল,
'বাহ! উনি দেখছি রান্নাও করতে জানেন। অনেক কিছুই বানিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ উনি অফিসে না গিয়ে এসব করতে গেলেন কেন?'
জীবন নিজে একটা টোস্ট মুখে নিলো। স্পৃহা চুপ করে বসে আছে দেখে জীবন কাটা চামচ দিয়ে অমলেটের একটু অংশ স্পৃহার মুখের দিকে এগিয়ে দিলো। স্পৃহাও ভদ্র মেয়ের মত জীবনের হাতে খেয়ে নিলো। খেতে খেতে তার কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। জীবন কাল রাতেও নূপুরের সামনে তাকে খাইয়ে দিতে চাচ্ছিল। সেটা জীবন নূপুরকে দেখানোর জন্যই করেছিল। তাকে ভালোবাসে বলে বা তার খেয়াল রাখে বলে না। ভাবতে ভাবতে নূপুর বিষম খেলে জীবন তাকে পানি খাইয়ে বলল,
'খাবার সময় কি এতো ভাবো তুমি? শরীর ঠিক আছে তো? আজ একবার তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব।'
'কোথাও যেতে হবে না। আজ আপনি অফিসে গেলেন না কেন?'
'তোমাকে এই অবস্থায় একা রেখে আমি অফিসে যাব?'
'আপনার কাজ
জীবন স্পৃহার মুখে জুসের গ্লাস তুলে দিয়ে বলল,
'অফিস আর কাজ যাক জাহান্নামে। আমি অফিসে জয়েন করার আগেও ওসব কাজ হতো। একদিন আমি অফিসে না গেলে আমার জন্য কোনো কাজ আটকে থাকবে না। আর সবথেকে বড় কথা, আমার কাছে ওসব কাজের থেকে তুমি বেশি ইম্পর্টেন্ট।'
জীবনের কথা শুনে স্পৃহা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। জীবন নিজেও কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। স্পৃহা ভাবছে,
'কাজের থেকে আমি বেশি ইম্পর্টেন্ট! কিন্তু নূপুর আর আমার মাঝে আপনার কাছে কে বেশি ইম্পর্টেন্ট? নিশ্চয়ই আমি না।'
জীবন কথা ঘুরিয়ে স্পৃহাকে খাইয়ে উঠে গেল। জোর করে স্পৃহাকে আবার শুইয়ে দিলো। স্পৃহা উঠতে নিলে বলল,
'উঁহু। একদম উঠবে না। আজ সারাদিন তুমি রেস্ট করবে। আর বাসার সব কাজ আমি করবো। প্রতিদিন তো তুমিই করো। আজ নাহয় ছুটি নাও।'
'হ্যা ভাইয়া বলো।'
'কি করছিস?'
'কিচেন ক্লীন করছি।'
রামিম জীবনের কথা শুনে শব্দ করে হেসে বলল,
'হোয়াট! '
'এতো অবাক হওয়ার কি আছে? তুমি বাসায় ভাবীকে হেল্প করো না নাকি? '
'ওহ এই কথা। হেল্প করছিস। আমি তো ভেবেছিলাম তোর বৌ তোকে দিয়েই সব কাজ করায়।'
'মজা নিচ্ছ, না?'
'আর নাহ। আচ্ছা আজ তাহলে তুই সারাদিন বাসায় থাকবি?'
'হুম। '
'অন্য কোনো প্ল্যান আছে? ঘুরতে যাওয়া বা অন্য কিছু? '
'না। তেমন কোনো প্ল্যান নেই।'
'তাহলে এক কাজ কর। আজ আমার বাসায় চলে আয়। তোর ভাবীও খুশি হবে। আর নূপুরের সাথেও দেখা হবে। এখনো তোর বৌকে দেখতে পারেনি বলে মন খারাপ করছিল।'
নূপুরের নামটা শুনে জীবনের মুড টাই খারাপ হয়ে গেল। এখনো রামিম ভাইয়াকে জানানো হয়নি সে নূপুরকে না স্পৃহাকে বিয়ে করেছে।
'ভাইয়া তোমার সাথে খুব জরুরি একটা কথা আছে।'
'কি কথা? আচ্ছা তুই তো আসছিসই। বাসায় আয় রাতে দু'ভাই ছাঁদে বসে অনেক আড্ডা দিব।'
'ওকে। আসছি তাহলে। রাতে দেখা হবে।'
'হুম তুই কাজ শেষ কর। রাখছি এখন।'
রামিম ফোন রেখে দিলে জীবন স্পৃহার ঘরে উঁকি দিলো। দরজায় নক করে ডাকলো,
'স্পৃহা! '
স্পৃহা উঠে বসে বলল,
'আসুন।'
জীবন স্পৃহার পাশে বসে বলল,
'আজ বিকেলে আমরা এক জায়গায় যাব। রেডি হয়ে নিও।'
'কোথায়? '
'রামিম ভাইয়ার বাসায়।'
স্পৃহা সামান্য কপাল কুঁচকে বলল,
'রামিম ভাইয়া কে?'
'আমার কাজিন। বড় আম্মুর একমাত্র ছেলে।'
স্পৃহা শুনে অবাকই হলো। কারণ সে জানতো না বড় আম্মুর ছেলেও আছে। বাসায় তো শুধু আরশিকেই দেখেছে। রামিম ভাইয়া কোথায় তাহলে? উনি কি বাবা মা'র সাথে থাকেন না? স্পৃহা এবাড়ির কাহিনী কিছুই বুঝতে পারছে না। জীবন জেঠা জেঠির সাথে থাকে না। জেঠি মা'র ছেলেও উনাদের সাথে থাকেন না। বাসায় আছে আরশি। আরশি আর জীবনের মধ্যেও কিছু ঠিক নেই। স্পৃহা আনমনে বলে ফেললো,
'রামিম ভাইয়া কি ওবাসায় থাকে না? জেঠা জেঠি মা'র সাথে কি উনার বনিবনা হয় না? ঐ দিন পার্টিতেও উনি আসেন নি।'
'হুম ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে আলাদা থাকে। বড় আব্বুর সাথে ওর সম্পর্ক তেমন ভালো না।'
'কেন? '
'সে অনেক কথা। আরেক দিন বলবো। আজ অনেক কাজ আছে।'
জীবন উঠে দাঁড়ালে স্পৃহা তার হাত ধরে ফেলে বলল,
'বলুন না। কাজ পরেও করা যাবে।'
জীবনের কাছে মনে হলো এই প্রথম স্পৃহা নিজে থেকে তার হাত ধরেছে। কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল জীবনের।
'প্লিজ বলুন।'
জীবন আবার বসে বলল,
'রামিম ভাইয়া প্রভা মানে যে এখন ওর বৌ, তাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। মানে লাভ ম্যারেজ। সমাজে আমাদের মত প্রভাদের স্ট্যাটাস অতটা উঁচুতে না। তাই বড় আব্বু ওদের বিয়ে মেনে নেয় নি। প্রভার পরিবারকে নাকি বড় আব্বু ভয়টয় দেখিয়েছে। আমি শিওর জানি না। তবে রামিম ভাইয়া এমনটাই বলেছে। সে থেকে ভাইয়া প্রভাকে নিয়ে আলাদা থাকে। তবে শুধু এটাই কারণ না। ও আলাদা থাকার পেছনে আর বড় আব্বুকে এতটা ঘৃণা করার পেছনে অন্য একটা কারণ আছে। যা ভাইয়া আমাকে বলতে চায় না। অনেক বার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু সে কিছুই বলে না। এবার শুনেছ তো সবটা? এখন আমি উঠি।'
জীবন চলে গেলে স্পৃহা বিরবির করে বলল,
'এই বাড়ির মানুষ গুলোর অনেক রূপ আছে। কাউকে দেখেই বোঝা যায় না সে কেমন। যেমন উনিই, বড় আব্বুর সাথে কেমন বাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু বড় আম্মু যেন উনার জীবন। আরশি উনার বোন। অথচ উনি আরশিকে দুচোখে দেখতে পারেন না। এতদিনে এখন শুনছি বড় আম্মুর একটা ছেলেও আছে। সে আবার ভালোবাসার মানুষের জন্য বাবা মা'কে ছেড়ে আছেন। এদিকে উনি আবার নূপুর মেয়েটাকে ভালোবাসেন। কিন্তু আমার প্রতি উনার এমন এমন আচরণ দেখে মনে হয় উনি আমাকে ভালোবাসেন। আমার জন্য পাগল। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। এদের সাথে পড়ে আমি মনে হচ্ছে পাগলই হয়ে যাব।'
সন্ধ্যায় জীবন স্পৃহাকে নিয়ে রামিম ভাইয়ার বাসায় পৌঁছে গেল। দু'বার কলিং বেল বাজার পর রামিম ভাইয়া এসে দরজা খুলে দিলো।
'তুই সত্যিই এসেছিস জীবন? আমি ভেবেছিলাম তুই প্রতিবারের মত এবারও ডপ মারছিস। আসবি আসবি বলেও শেষে আসবি না।'
'এবার তো সত্যিই চলে এলাম। দেখো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।'
'ভেতরে আয়। বৌ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি?'
রামিম স্পৃহার দিকে তাকিয়ে নূপুর বলার আগে জীবন বলে ফেলল,
'ভাইয়া ও স্পৃহা। আমার ওয়াইফ।'
রামিম বিস্ফোরিত চোখে জীবনের দিকে তাকালো। তার এই তাকানোর মানে জীবন বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে চোখ ইশারা করলো। রামিম নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল,
'এসো স্পৃহা। দাঁড়িয়ে আছো কেন?'
ভেতরে আসার সময় রামিম জীবনের কানেকানে বলল,
'তুই না নূপুর নামের কাউকে ভালোবাসিস। তাহলে এই মেয়ে স্পৃহা তোর বৌ হলো কীভাবে?'
'সব বলবো। কিন্তু এখন না।'
'ওহ। এটাই তাহলে তোর সেই জরুরি কথা?'
'হুম। '
বাইরে ওদের শব্দ শুনে প্রভা ভেতর থেকে বের হতে হতে বলল,
'জীবন এসেছে নাকি? কতদিন পর এলে মনে আছে তো? বিয়ে করলে অথচ আমরা জানলামও না। এতটা পর ভাবো আমাদের? নূপুরকে সাথে এনেছ তো?'
জীবন রামিমকে সামলে নিলেও প্রভা ঠিকই স্পৃহার সামনে নূপুরের নাম নিয়ে ফেলেছে। জীবনের আগেই উচিত ছিল ওদের সবটা বলে দেয়া। তাহলে এখন আর স্পৃহার সামনে এই কান্ড ঘটতো না। না জানি স্পৃহা নূপুরের কথা জানে কিনা? জীবন একবার স্পৃহার মুখের দিকে তাকালো।