রংধনু - পর্ব ১৭ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


বন্দনা আখতার বোন আর ভাগনীকে এয়ারপোর্টে দিতে গেছেন।বেলার ভয় লাগছে ওনি আবার এসে কি করেন?তবে ভালো লাগছে অনেক বেশি।কারন বিভান সবসময়কার মতো ওর সাথে আছে।কিছুসময়ের জন্য মনে হলো সে ভুল বুঝেনি তো?কিন্তু সে বেলাকে ভুল প্রমানিত করে ওর সাপোর্ট করেছে।বেলা আসলেই খুব ভাগ্যবতী।বিভানের মতো স্বামী পাওয়া সবার ভাগ্যে হয়না।বেলা পেয়েছে তার বিভানকে।লোকটার প্রতি আজ ভালবাসা শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেছে।এ বাসায় যতোই কষ্ট হোক না কেন বেলা সেগুলো হাসি মুখে মেনে নিতে পারে শুধুমাত্র ওর লোকটার জন্য।ভালবাসে লোকটাকে।রুমে আসে বেলা।সিডি প্লেয়ারে একটা গান ছেড়ে দিলো বেলা।বিভানের ছবির সামনে এসে দাঁড়ায়।লোকটাকে কাছে পেতে মন চাইছে।ছবিটাকে কাছে নিয়ে সেখানে অসংখ্য চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।লোকটা কাল কথা বলতে চেয়েছিলো ও বলেনি।বেলার ভীষন রাগ লাগছে নিজের ওপর। লোকটাকে কষ্ট দিলো ও।মুহূর্তে মন ভীষন খারাপ হয়ে যায় বেলার।ফোন হাতে নিয়ে খাটের ওপর এসে বসলো।তারপর কি মনে করে বিভানের সেক্রেটারি মিজবাহ কে কল দেয় বেলা।ইন্টারভিউয়ের জন্য বসে আছে আদনান।ওর পাশে একজন লোক বসে আছে।ওর মতোই একজন প্রার্থী।আদনান আড়চোখে লোকটার সিভি দেখে।তার রেজাল্ট বেশ ভালো।লোকটা কার সাথে যেন কথা বলছে।আদনান কিছুক্ষন পরপরই পানি খাচ্ছে।বেশ ভয় লাগছে ওর।চাকরীটা হয়ে গেলে ওদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যেতো।বেতন ও পর্যাপ্ত পরিমানের।অন্তত ভাইয়ার সাহায্য হবে।ওর পানি খাওয়া দেখে পাশের লোকটা বলল,

''প্রথম ইন্টারভিউ? "

লোকটার কথা শুনে ম্লান হাসে আদনান।মাথা নেড়ে জানায়,

''না।আসলে জবটা খুব দরকার আমার।"
''বুঝতে পারি ভাই।সবাই দরকারে জব করতে আসে।"
''জি।"

আদনানের এ মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।ভীষন অস্থির লাগছে ওর।লোকটা ওর অস্থিরতা দেখে বলল,

''রিল্যাক্স থাকেন।ভাগ্যে থাকলে জবটা হয়ে যাবে।"

আদনান কিছু না বলে একটু হাসলো।কিছুক্ষন পর সবার ডাক পড়লো।যতো মানুষ কমে আসছে।ভয় বেড়ে যাচ্ছে ওর।অবেশেষে আদনানের ও ডাক পড়ে যায়।উঠে ইন্টারভিউয়ের রুমে প্রবেশ করে।তিনজন লোক বসা সেখানে কালো সুট পরে আছে তারা।যেখানে আদনানের গায়ে সাদা কালো চেক শার্ট।তাদের সালাম দিয়ে চেয়ারটায় বসলো ও।
ওকে প্রশ্ন করা শুরু হলো।বেশ ভালই গেলো ইন্টারভিউ।ওর জানালো কিছুদিনের মাঝে কল আসবে ওর নম্বরে।আজ তারা ডিসাইড করবে।তারপর কয়েকজন কে সিলেক্ট করে একমাসের ট্রেনিং নিবে।তারপর সেখান থেকে চারজন বাছাই করা হবে।
আদনান বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।হাঁটতে শুরু করে ঘরের উদ্দেশ্যে।বাসা বেশি দূরে নয় তাই কষ্ট হবার ও কথা নয়।টং থেকে দুটো সিগারেট কিনে একটায় আগুন দিয়ে টানতে থাকে আদনান।এই দেশে চাকরীতে খুব বেশি প্রতিযোগিতা। অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছিলো কিন্তু কোথাও জব হয়নি।টাকার খেলা সব জায়গায়।অফিসে এসে কাজে মন দেয় নিশাদ।হঠাৎ রাফিজ সাহেব এসে একশত টাকা দিয়ে বলেন,

''এই নাও তোমার টাকা।বস ডেকেছেন তোমাকে।"

নিশাদ টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে বসের রুমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।লোকটা ওকে দেখে বলল,

''ইদানীং কাজে খুব বেশি অমনোযোগী হয়ে পড়েছো।কারন কি?"

নিশাদ অনেকটা অবাক।কি বলে এই লোক।ওর মতে ও কখনো গা ছাড়া ভাবে কাজ করেনি অফিসে।বাসায় গিয়ে ও তো ফ্রী থাকতে পারেনা। অফিসের কাজ ঘরে ও করতে হয়।নিশাদ বলল,

''স্যার আমি এক্টিভ থাকার চেষ্টা করবো আরো বেশি।"
''হুম।কাল কুমিল্লা চলে যাও।সেখানে আমাদের ব্রাঞ্চটায় শফিক সাহেব থেকে একটা ফাইল আনবে।"

নিশাদ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

''স্যার আমি যাবো?"
''জি তুমি।"

নিশাদ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো। কাজটা ওর না।দপ্তরীর কাজ এগুলো তারওপর এগুলো ইমেইলে পাঠিয়ে ও দেয়া যায়।নিশাদ বলল,

''স্যার কখন বের হতে হবে?"
''কাল আটটায় বের হবে?"
''ওকে।"

নিশাদ বেরিয়ে আসতেই একজন এসে বলল,

''শুনলাম রাফিজ নিজের শালারে তোমার জায়গায় আনতে চাইতেছে।তুমি সাবধানে থাইকো ভাই।"

নিশাদ অবাক হয়ে বলল,

''বুঝলামনা।"
''রাফিজ তোমারে জব থেকে বের করতে চায় শালার জন্য।"

নিশাদ স্তব্ধ। কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।এ লোকটা কেন ওর পিছনে পড়লো?কি করবে ও?জবটা চলে গেলে ও শেষ হয়ে যাবে।বেরিয়ে আসে নিশাদ।নিজের কেবিনের কাছে আসতেই দেখলো রাফিজ সাহেবকে। ওনি নিশাদকে দেখে বলল,

''কি হলো দাঁড়িয়ে কেন?বসো।"

নিশাদ ডেস্কে এসে বসে বলল,

''কুমিল্লা যেতে হবে।"
''ওহ ভালো।তা একাই যাচ্ছো?নাকি সাথে কেউ আছে?"
''হ্যা আছে।"

বলেই তাকালো রাফিজ সাহেবের দিকে।রাফিজ সাহেব নোংরা হেসে বললেন,

''কে সে গার্লফ্রেন্ড? "
''না।আমার স্বপ্ন।"

বলেই কাজে মন দেয় নিশাদ। রাফিজ সাহেব কিছু না বলে কাকে যেন কল দিলো। নিশাদের ভিতরে বিভিন্ন চিন্তা আসছে।জবটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভরে আছে ওর মন।নিজের জন্য না।ওর মা বাবা ভাইবোনের জন্য।মুহূর্তের জন্য বুক ভারি হয়ে আসে ওর। চাকরীটা কোন ভাবেই হাত ছাড়া করতে চায়না ও।
_________________________________________
মিজবাহর সাথে কথা বলার পর রান্না শুরু করে বেলা।আজ লোকটার জন্য তার পছন্দের খাবার বানাবে ও।রান্না শেষে ফ্রেশ হতে চলে গেলো বেলা।গায়ে জড়িয়ে নিলো হালকা বেগুনী বর্নের একটি তাঁতের শাড়ী।লম্বা চুল গুলো খোপায় আটকে নিয়ে রান্না গুলো বক্সে ভরে নিয়ে বেরিয়ে এলো।দারোয়ানকে বলল বন্দনা আখতার আসলে বলতে বেলা চলে আসবে কিছুক্ষনের মধ্যে। 
বিভানের অফিসটা ওদের বাসা থেকে দেড় ঘন্টার দুরুত্বে।তাই লাঞ্চের বেশ আগে বেরিয়ে পড়েছে ও।রাস্তায় ভালোই জ্যাম পড়ে।রোদ ও পড়েছে অনেক টা।বেলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে থাকে।
ঘন্টাখানিক পর অফিসে এসে থামলো বেলা। লাঞ্চটাইম সবে শুরু।খাবার নিয়ে বিভানের রুমের পথে রওনা হলো।লিফ্টে মিজবাহ এর সাথে দেখা হলো বেলার।মিজবাহ বলল,

''ম্যাম চলে এসেছেন?"
''হুম।স্যারকে বলেননি তো?"
''না ম্যাম।"

বেলা একটু হেসে দাঁড়িয়ে থাকে।বিভানের রুম সাত তলায়।বেলা এসে থামলো সাত তলায়।মিজবাহ বলল,

''আমি এখন স্যারের কেবিনে যাচ্ছিনা।আপনি যান।"
''ওকে।"

বেলা বিভানের রুমের সামনে আসতে দেখলো একজন লোক ভিতরে বসে আছে।বেলা সরে দাঁড়ায়।লোকটা খায়নি এখনো। বেলা অপেক্ষা করতে থাকে লোকটার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। 
কিছুক্ষন পর একজন বেরিয়ে চলে গেলো।বেলা কাপড় ঠিক করে দরজায় নক করে।ভিতর থেকে বিভান বলল,

''কাম ইন।"

বেলা ভিতরে ঢুকে খেয়াল করলো বিভান ল্যাপটপে ভীষন ব্যাস্ত।বেলা বিভানের সামনে এসে বসলো।তার কোন খেয়াল নেই।মাথা অনেকটা এগিয়ে রেখেছে ল্যাপটপের দিকে।বেলা এক লোকমা বিরিয়ানী বিভানের মুখে তুলে দিলো।বিভান খাচ্ছে। বেলা মিটিমিটি হাসছে।বিভান বলল, 

''একদম বাসার রান্না।বেশ ভালো হয়েছে বিরিয়ানীটা।তবে বেলা এসে খাইয়ে দিলে ভালো লাগতো।"

বেলা হেসে আরেক লোকমা তুলে দিলো।এতো টা এ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড কেমন করে হতে পারে সে?বিভান বলল,

''পানি।"

বেলা পানির গ্লাস বিভানের মুখে তুলে দিলো।বিভান পানি খেয়ে বিরবির করে বলল,

''বেলা কে কল করে বলি বিরিয়ানী রান্না করতে। বাসায় গিয়ে সত্যি কারেই খাবো।"

বেলা অবাক।লোকটা কি করছে আসলে?বেলা তার সামনে বসে তাকে খাওয়াচ্ছে আর ওনি কি ভাবছে।বেলা এবার কথা বলে উঠলো,

''বেলা এখানেই।কল করতে হবেনা।"

বিভান সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,

''তুমি কখন এলে?"
''বিভান কি আপনি বলুন তো?এতোসময় খাওয়াচ্ছি।কোন খবর নেই আপনার।"
''সরি কাজ করছিলাম তো।"

বেলা রেগে গিয়ে বলল,

''কাজ করতে করতে খেয়াল নেই কার হাতে খাচ্ছেন আপনি।এখন অন্য কেউ খাইয়ে দিলে ও বুঝবেননা।"
''অন্য কেউ মানে কি?"
''বিভান আপনি এতো টা হারিয়ে যান যে আমি খাওয়াচ্ছি বুঝেন নাই আপনি।এখানে মিজবাহ খাওয়ায় দিকে ও বুঝতেন না। "

বিভান উঠে দাঁড়িয়ে বেলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

''সরি বেলা।সত্যি ব্যাস্ত ছিলাম।মনে হচ্ছিলো স্বপ্নে খাচ্ছি আমি।"
''আজ কাল জেগে ও বিরিয়ানী স্বপ্ন দেখেন?"
''হুম।"

বেলা কিছুটা অভিমান করে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো।বিভান বেলাকো বুকে টেনে ওর চিবুক ধরে মুখ উঠিয়ে বলল,

''বেলা রানী স্বপ্নে শুধু বিরিয়ানী না আপনি ও ছিলেন।"

বেলা হেসে বিভানের দিকে চেয়ে বলল,

''ধন্যবাদ আপনাকে।"
''কেন?"
''বুঝার জন্য আমাকে।"

কথাটি বলার সময় বেলার চোখের কোনে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ভেসে আসে।গলা ধরে আসে।বিভান বেলার কপালে চুমু দিয়ে বলল,

''তোমাকে বুঝি বেলা।ভালবাসি খুব। তোমায় খালার সামনের থেকে রেগে না নিয়ে আসলে ওনারা খুব কথা শুনাতো।"
''জানি।কিন্তু ভয় হচ্ছিলো আমার আর কিছুনা।"

বিভান বেলাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে একদম।বেলা কিছু বলতে গিয়ে অনূভব করলো ওর অধর যুগল বিভানের ওষ্ঠজোড়ায় লেপ্টে আছে।বেলা চোখ বুজে নেয় গভীর আরামে।
এদিকে সেদিন বিকেলে সাঁঝ পড়াতে আসে রিদ্ধিকে। লিফ্টে ঢুকে দেখলো এটি একদম খালি।সাঁঝ লিফ্টের কোনায় তাকায় যে সাইডে সাইমন লোকটা দাঁড়িয়েছিলো।সাঁঝের ঠোঁটের কোনে বিস্তৃত হাসি।রিদ্ধিদের বাসা চলে এলো।সাঁঝ চলে গেলো রিদ্ধিকে পড়াতে। এদিকে নিশাদ অফিস শেষ করে বেরিয়ে ইমতিয়াজের ঘরের উদ্দেশ্য রওনা হয়।ইমতিয়াজ বোনের জন্য নতুন ল্যাপটপ নিয়ে এলো।একমাত্র বোন কম্পিউটার শিখতে চায়।তার এই চাওয়া অপূর্ন রাখবে কি করে।নিশাদ চলে এলো।ইমতিয়াজ নিশাদ কে নিয়ে ইদ্রীর রুমে এলো।নিশাদ দেখলো স্টাডি টেবিলের একটি চেয়ারে বসে আছে ইদ্রী।পাশে আরেকটি চেয়ার খালি।
ইদ্রি নিশাদকে দেখে বলল,

''হ্যালো মিঃ ইঞ্জিনিয়ার।"

নিশাদ মলিন চোখে ইমতিয়াজের দিকে চেয়ে ইদ্রির দিকে চেয়ে বলল,

''হ্যালো।"

ইমতিয়াজ বলল,

''তুই শিখাতে শুরু কর।আমি একটু পর আসছি।"
''জি।"

নিশাদ খাটে বসতে গেলে ইদ্রি বলল,

''কম্পিউটার শিখাতে হলে পাশে বসতে হবে খাটে নয়।"

নিশাদ বলল,

''না ঠিক আছে।"
''ঠিক আছে বললে হবেনা।আমার বুঝতে হবে।"

নিশাদ কোন কথা না বলে পাশে এসে বসে।ইদ্রির ঠোঁট দুষ্টুমি মাখা হাসি।

!!!!

সাঁঝের না আসায় মা ভীষন চিন্তিত।এদিকে নিশাদ টাও ঘরে ফিরেনি।জুলেখা বানু পড়েছেন বিপদে।ওনার স্বামী ইকরাম রাহমান গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী গেছেন বাবা মায়ের কবর জিয়ারত করতে।জুলেখা বানু সাঁঝের জন্য ভয় পাচ্ছেন।মেয়েটা এখনো ঘরে এলো না।কুঞ্জন অনেক বার কল করেছে।আদনান বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।সাঁঝের নম্বর বন্ধ।দুঘন্টা আগে ওর ফেরার কথা।মেয়েটা এখনো এলোনা।নিশাদ ইদ্রিকে কম্পিউটার শিখাচ্ছে।মেয়েটা বাহির থেকে এসেছে বেশ ট্যালেন্টেড।তবে ব্যাসিক কিছু ব্যাপার ধরতে পারছেনা নিশাদ যতোবার দেখাচ্ছে ইদ্রি ভুল করছে।নিশাদ রেগে গেলে ও ভীষন কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে।ইদ্রি আড়চোখে নিশাদকে দেখে।লোকটা একদম বাবুদের মতো।গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো খুব আকর্ষনীয়।গায়ের শার্টটা খুব মানিয়েছে।ইদ্রি খুব ধীরে নিশ্বাস নিয়ে নিশাদের ঘ্রান নেয়ার চেষ্টা করে।মুচকি হাসে মাথা ঘুরিয়ে।লোকটার সাথে থাকতে ভালো লাগছে।ইদ্রি নিশাদকে দেখছে।তার চোখ ঠোঁট দাঁড়ি।ইসস কি সুন্দর সে।ইদ্রি না পারতে বলল,

''মিঃ ইঞ্জিনিয়ার!! "

পাশ ফিরে তাকায় নিশাদ।তারপর বলল,

''সামনে তাকাও।"
''একটা কথা।"

বলার সময় ইদ্রির এক চোখ একটু ছোট হয়ে এলো।মুখে দুষ্টুমি হাসি।ইদ্রি বলল,

''শার্টটা খুব সুন্দর।আপনাকে মানিয়েছে।"

নিশাদ শার্টের দিকে তাকায়।তারপর হেসে বলল,

''এটা খুব স্পেশাল আমার কাছে।"
'',কেন?স্পেশাল মানুষ দিয়েছে বুঝি?"
''জি।আমার ছোট বোন।"

ইদ্রি হেসে বলল, 

''ওনার চয়েজ খুব ভালো বলতে হবে।"
'',হুম প্লিজ এখন কম্পিউটারে মন দাও।"
''আচ্ছা। মিঃ ইঞ্জিনিয়ার!!"
''কি?"
''ছোট একটা প্রশ্ন।"
''কি?"
''আপনারা কয় ভাইবোন?"
''সাত।"
''হোয়াট?"

ইদ্রির চোখ বড় হয়ে গেলো।নিশাদ ওর দিকে তাকায়।মেয়েটার চোখজোড়া বেশ বড়।তবে মায়াবী।ভালো লাগে ওর হাসিটা।ইদ্রি ঠোঁট গোল করে বলল,

''ওহ মাই গড!!এত গুলো?"
''হ্যা তো?"
''না মানে এতো গুলো কখনো দেখিনি।"
''হুম।"
''আপনি কতো নম্বর?"
''তুমি কম্পিউটার শিখো প্লিজ?"

বিনয়ের সুরে বলতে লাগলো ইদ্রি, 

''প্লিজ লাস্ট ওয়ান।"
''বলো।"
''ঐযে আপনি কতো নম্বর?আপনারা ভাই কয়জন?"
''ওয়েল আমি দুনম্বর আমরা তিন ভাই।আমি ভাইদের মধ্যে বড়।আমার বড় বোন আছে। ওকে?"
''আপনার বড় বোন কি করে??"
''তুমি বলেছিলা লাস্ট ওয়ান।"
''প্লিজ মিঃ ইঞ্জিনিয়ার এমন করেন কেন?বলুন।"
''ওকে।আমার আপা।ওনি ইন্ডিয়া থাকেন তার হাসবেন্ড সহ।"
''ওকে।ওনার বেবি আছে?"

নিশাদ ম্লান মুখে মাথা নাড়ায়।ইদ্রি কিছু বললোনা।নিশাদ বলল,

''এবার প্লিজ কম্পিউটার দেখো।"
''জি।"

নিশাদ ওকে শিখাতে থাকে।হঠাৎ কল আসে নিশাদের। বাসার থেকে আদনান কল করেছে।নিশাদ ইদ্রি কে বলল,

''তুমি দেখো।আমি একটু কথা বলি।"
''জি।"

নিশাদ বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।কল রিসিভ করতেই আদনান বলল, 

''ভাইয়া কই তুই?"
''ইমতিয়াজের বাসায় কেন?"
''সাঁঝ ঘরে আসেনি এখনো।"
''হোয়াট?ওকে কল দে।"
''বন্ধ ফোন।"

নিশাদ কিছু বলল না। কল না কেঁটে দৌড়ে রুমে এসে ইদ্রিকে বলল, 

''আমাকে যেতে হবে এক্ষুনি।আজ যা শিখালাম বাসায় দেখে নিবে।"
''কি হয়েছে?"
''দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।"

বলেই বেরিয়ে আসে নিশাদ।ইমতিয়াজ নিশাদ কে বেরিয়ে যেতে দেখে দৌড়ে এসে বলল,

''কিরে কই যাস?"
''পরে বলি।"
''বল কই যাস?"
''কাজ আছে।বায়।"

এদিকে নিশাদের শেষ কথাটা খুব খারাপ লাগে ইদ্রির।না চাইতে ও চোখে পানি চলে আসে ওর।ভাইয়া বাবা মা কখনো এত রুড হয়নি।আজ নিশাদ যতোটা হলো।গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে দিলো বিভান।গ্লাসের গায়ে কুয়াশা জমে গেছে।বিভান বাহিরে দেখার চেষ্টা করে ও কিছু দেখতে পায়নি।পাশে চোখ ফিরিয়ে বেলাকে দেখে।বেলা হাসছে বিভানের দিকে।বিভান গাড়িতে একটা গান ছেড়ে দিয়ে স্টিয়ারিং এ এক হাত রেখে অপর হাত বেলার দিকে বাড়িয়ে ওর গাল স্পর্শ করে।রাত সাড়ে নয়টা বাজে।
বেলা বিভানের হাত টা গাল থেকে সরিয়ে দুহাতের মাঝে রেখে পাশে তাকায় জানালার বাহিরে।বিভান গাড়ি চালাচ্ছে।ও বলল,

''বেলারানী শুনেন।"

পাশে তাকায় বেলা।তারপর হাসি মুখে বলল,

''বলেন বিভান রাজা।"
''আমরা লং ড্রাইভে আছি কি খাবে বলো?গাড়িতে খাবার রাখবো।"
''আমার খিদা নেই।আপনি খেতে চাইলে নিতে পারেন।"

বিভান পাশে তাকায়।ভালো দোকান নেই।ও বলল,

''সামনে মেইন রোড ওখানে খাবার পাওয়া যাবে।"
''আপনি ক্ষুধার্ত? "
''একটু একটু।"

বেলা বলল,

''ঘরে যেতে বললাম।সেখানে খেতে পারতেন।শুধু শুধু বের হয়েছি।বাসায় মা একা।"
''বেলা একটু  রোমান্টিক হও।এতো নিরামিশ কেন?"
''আপনি বেশি রোমান্টিক তাই।"

বিভান হেসে গাড়ি চালানোয় মন দিলো।সামনের একটা দোকান থেকে স্যান্ডুইচ কোক চিপস কিনে নেয় বিভান।তারপর আবার ও জার্নি শুরু।বেলা বিভান কে খাইয়ে দিচ্ছিলো স্যান্ডুইচ।অনেক সময় পার হয়ে গেলো।বেলা বলল,

''কই যাবেন?"
''রিশিকেশ।"
''বিভান ঘরে কখন যাবো?"
''কাল রাত হবে।"
''কি?"
''হুম।আজ হোটেলে থাকবো কাল গীতা ভবনের জন্য বের হবো।ওখানে লঞ্চে ঘুরবো তারপর কিছু শপিং তারপর বাসা।"

বেলা ভয় পেয়ে গেলো।মা খুব রাগ করবেন।ও বলল,

''পাগল আপনি?মা রাগ করবে।"
''কেন করবে?আমার বৌকে নিয়ে ঘুরছি পাশের বাড়ির শ্রুতি ভাবিকে নিয়ে নয়।"
________________________________________
বেলা হাতের ব্যগ দিয়ে বিভানের পিঠে মারলো।তারপর বলতে থাকলো,

''ফালতু লোক কোথাকার।"

মার সামলে বিভান বলল,

''বেলা রানী এখানে ফালতুর কি হলো?আমি আমার বৌকে নিয়ে যেখানে ইচ্ছে যাবো।বৌ আমার একান্ত ব্যাক্তিগত।এখানে কারোর কথা বলার রাইট দেইনি।"

বেলা হেসে বিভানের দিকে তাকায়।তারপর খোঁচা দিয়ে বলল,

''বৌ পার্সোনালই হয় পাবলিক হয়না বিভান।"
''হয় বেলা রানী হয়।"
''সেটা কেমন?"
''সেটা হলো পাবলিক টয়লেটের মতো।সবাই ইউজ করতে পারে।"
''ইস ছি বিভান!!বাজে কথা বন্ধ করুন।"

বিভান সজোরে হাসতে থাকে।এদিকে নিশাদ ঘরের কাছে আসতেই দেখলো কালো একটি গাড়ি থেমেছে ওদের বাসার সামনে।নিশাদ খুব অবাক কারন এখন কারোর গাড়ি নেই।তারপর ও কেউ যদি ভাড়া করে সেটা আলাদা কথা।নিশাদ কে অবাক করে দিয়ে সাঁঝ বেরিয়ে এলো।গাড়ি থেকে পাশে সাইমন।নিশাদ দৌড়ে এলো তার কাছে।সাঁঝের চোখজোড়া খুব দূর্বল।ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছেনা।সাইমন নিশাদকে দেখে সাঁঝের দিকে তাকায়।সাঁঝের চেহারায় ভয়ের আভাস।সাইমন সাঁঝকে কিছু বলতে গেলে নিশাদ বলল,

''তোর এ অবস্থা কেন?কই ছিলি?"

পাশ থেকে সাইমন  বলল,

''এক্চুয়ালি মিস সাঁঝ লিফ্টে আটকা পড়েছিলো এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো।"

নিশাদ সাঁঝকে ধরে সাইমন কে বলল,

''থ্যাংক ইউ আমার বোনকে নিয়ে আসার জন্য।ভিতর আসুন।"
''না থ্যাংকস।কাজ আছে আমার।ওনার জন্য এখানে এলাম।"
''ধন্যবাদ আবারো।আমার বোনটার হাঁপানি আছে।ও বন্ধ ঘরে থাকতে পারেনা।"
''হুম।আচ্ছা আসি।"

সাইমন যাওয়ার মুহূর্তে পিছনে আবার তাকিয়ে সাঁঝকে দেখার চেষ্টা করে।আজ মুহূর্তের জন্য নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলো যখন বন্ধ লিফটে সাঁঝকে দেখতে পায়।নিশাদ বোনকে প্রায় কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে।জুলেখা বানু সাঁঝকে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের কাছে ছুঁটে আসেন। সাঁঝ বলতে চাইলো আমি ঠিক আছি মা।তার আগেই ওকে জড়িয়ে ধরে জুলেখা বানু।কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

''কই গেছিলি আম্মা কতো ভয় পাইছিলাম।তোর ফোন বন্ধ আছিল।"

সাঁঝ কিছু বলতে পারেনা। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে সাঁঝকে দেখছে।হুমায়রা সাঁঝের হাতের পাতা ডলে দিচ্ছে।
নিশাদ ফোন বের করে আদনান কে কল দিয়ে বলল,

''ডাক্তার নিয়ে আয় নিচ থেকে।সাঁঝ বাসায় আসছে।"
''ও কই ছিলো?"
''তুই আগে আয় তারপর বলি। "

নিশাদ ফোন রেখে সাঁঝের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।লাবনী দু গ্লাস পানি এনে নিশাদ কে দিয়ে সাঁঝকে খাইয়ে দেয়।কুঞ্জন দূর থেকে বোনকে দেখে কাছে এসে বলল, 

''আপু কি হইছে তোর?"

পাশ থেকে নিশাদ বলল,

''লিফটে আটকে ছিলো।"
''ওহ।আপুর তো শ্বাস কষ্ট।"

লিফটে আটকানোর কথা শুনে জুলেখা বানু ভীষন ভয় পেয়ে মেয়েকে জড়িয়ে আবার ও কাঁদতে থাকে।এদিকে সাইমন ঘরে ফিরে যায়।তারপর বাসায় ঢুকে সিয়ামকে দেখে বলল,

''ভাই একটু রুমে আসেন কাইন্ডলি।"

টেলিভিশনে খবর দেখছিলো সিয়াম।ভাইকে দেখে চিৎকার করে বলল,

''সব ঠিক আছে তো?"
''কোন কিছু ঠিক নেই।আপনি আসেন।"
''আচ্ছা।কিন্তু এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?"
''ভাই প্লিজ আসেন আপনি।"
''চল।"

সিয়াম উঠে সাইমনের রুমে চলে এলো।সাইমন বলল,

''ভাই লিফট একটা নষ্ট আপনি জানেন।"
''হুম।"
''ঠিক করাননা কেন?"
''তোর ভাবির মাকে চিকিৎসার জন্য টাকা দিবো।"
''ভাই ওনার চারটা দামড়া ছেলে।তারা কি তাদের মায়ের খেয়াল রাখতে পারেনা?আপনি জামাই হিসেবে দিবেন ঠিক আছে।এজন্য নিজেদের বাড়িতে নষ্ট লিফট রাখবা।"
''দেখ সাইমন।এ মুহূর্তে টাকা নেই আমার কাছে।"
''তাহলে আপনার শাশুড়ীকে কোথা থেকে দেবেন?"
''বললাম তো পরে ঠিক করবো।"
''ভাই আজ আপনি আপনার ফেমিলি ভালো আছেন দেখে বলছেন।একজন মরতে মরতে বাঁচলো সেদিকে কোন খেয়াল নেই আপনার।"
''এমন কথা না সাইমন।আর কে আটকেছিলো?"
''চারতলার রিদ্ধির টিচার। ওনার শ্বাস কষ্ট আছে।ঐদিন ও আটকে গেছিলাম ভাবি বলেনি?"
''না।কবে?"
''বলবে কেন?যাই হোক আপনি ঠিক করতে বলেন যা লাগে আমি দিবো।"
''ওকে।"

বেরিয়ে যায় সিয়াম।এদিকে আদনান ডাক্তার নিয়ে আসে।ডাক্তার সাঁঝকে জিজ্ঞেস করে,

'' কি হয়েছিলো আপনার সাথে?"

খুব ধীরে সাঁঝ বলতে শুরু করলো,

''আমি স্টুডেন্ট পড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম।লিফট তিনতলায় আসতেই থেমে গেলো।আমি চিৎকার করি কেউ শুনেনি।এভাবে কতক্ষন ছিলাম জানিনা।লাইট ও ছিলোনা।তারপর নিজেকে ঐ বাসার বাড়িওয়ালার ঘরে পাই।"

সাঁঝের কথায় ডাক্তার নিশাদ কে বলল,

''ওনার বেড রেস্ট দরকার।ভয় পেয়েছেন খুব।কিছু ঔষধ দিয়ে গেলাম।দিয়ে দিবেন সময় মতো।"

নিশাদ মাথা ঝাঁকায়।আদনান ডাক্তার কে নিয়ে বেরিয়ে যায়।নিশাদ সাঁঝের পাশে এসে বসে। বোনকে বলল, 

''কে ছিলো ঐ লোক?"
''বাড়িওয়ালার ছোট ভাই।"
''ওকে।হুমায়রা তোর আপুর জন্য গরম দুধ করে আন। আর আমাকে একটা ব্যাগ বের করে দে।"

সাঁঝ ভাইকে বলল,

''কই যাবি ভাইয়া?"
"কুমিল্লা অফিসের কাজে।"
''ওহ।"

নিশাদ রুমে এসে ব্যাগ গুছাতে থাকে।কাল আটটার বাসে বেরিয়ে যাবে ও।হঠাৎ ওর মনো আসে আসার মুহূর্তে কি ব্যাবহার করেছিলো?নিশাদ ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইমতিয়াজ কল করছে।
নিশাদ কল রিসিভ করে।

''কিরে চলে গেলি যে?"
''সাঁঝ যে বাসায় টিউশানি করে লিফটে আটকে গেছিলো।বাসায় আসছিলোনা বলে আম্মা কান্না কাটি করছিলো।"
''ওহ।"
''জি। আর শুন কাল আসবোনা। আবার কবে আসবো জানাবো।"
''কেন?"
''কুমিল্লা যাবো অফিসের কাজে আবার কাল ফিরে আসবো।"
''ওকে।তুই আল্লাহর নাম নিয়ে বের হ।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন