নিবিড় এগিয়ে গিয়ে, টেবিলের উপর থেকে পেপার গুলো নিয়ে প্রিয়তার সাইন দেখে মুচকি হেসে মাথা নাড়ে,কাঁদলে আপনাকে অনেক সুন্দর দেখায় আপনি হয়তো জানান না প্রিয়তা।নিবিড় খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে প্রিয়তার নাচের মাঝে তোলা তখনকার ছবি গুলো দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।মেয়েটা সত্যিই অদ্ভুত এক মায়াবী। কিন্তু এই মায়ার জালে জড়িয়ে পড়তে আমি চাই না।কালো রঙটা আমি পছন্দ করি না ঠিক এই শাড়িটা ওকে অসম্ভব সুন্দর লেগেছে।ভুল করেও যদি এসে থাকে,ও না পরলে বুজতেই পারতাম না কালো রঙেও মানুষকে এতোটা অপরুপ লাগতে পারে।
নিবিড় পেপারগুলো একটা ফাইলে রেখে আলমারিতে তুলে রাখলো।
প্রিয়তা ছাদের কিনারায় রেলিং এর হাতল ধরে দাঁড়িয়ে কান্না করছে আর বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।
রাতের অন্ধকারে হালকা বাতাসে প্রিয়তার চুলগুলো উড়ছে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে বার বার চোখগুলো মুছে নিচ্ছে
সালমা বেগম টেবিলে খাবার দিয়ে প্রিয়তাকে ডাকলো কয়েকবার।
মোশারফ হোসেন আর জুহিও এসে বসলো।
নিবিড় এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে পিছনে ফিরে রান্নাঘরে দিকে তাকিয়ে প্রিয়তাকে না দেখতে পেয়ে সালমা বেগমকে জিজ্ঞেস করতে যেতেই সালমা বেগম বললো,কিরে নিবিড় প্রিয়তা খাবে না?মেয়েটা সেই দুপুরে আশ্রমে অল্প কিছু খেয়েছে আর এখনো কিছু খায়নি।জুহি যা তো তোর ভাবীকে ডেকে নিয়ে।সকাল সকাল আবার কলেজে যাবে।
জুহি উঠে যেতেই নিবিড় বললো,জুহি তুই বস।তোর ভাবী খাবে না।ও ঘুমিয়ে পড়েছে।পরে উঠে খেয়ে নিবে।
-কি বলছিস! মেয়েটা না খেয়ে থাকবে?
নিবিড় গম্ভীর গলায় বললো, মা বললাম না,পরে খাবে।
সালমা বেগম আর কিছু বললেন না।সবাই চুপচাপ খেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
নিবিড় রুমে এসে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলো।মেয়েটা কোথায় গেলো? ছাদে?
নিবিড় উঠে গিয়ে ছাদের সিঁড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে আর চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছে।
শাড়ির আঁচলটাও উড়ে বেড়াছে।
নিবিড় ধীরে ধীরে প্রিয়তার পিছনে দাঁড়াতেই শাড়ির আঁচল গায়ে মুখে এসে পড়তেই নিবিড় আঁচলটা মুখের উপর থেকে সরিয়ে, পাশে দাঁড়িয়ে, আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকবেন?
প্রিয়তা সামনের দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবিড় আবার বললো,আপনি সারারাত ছাদে কাটিয়ে দেওয়ার চিন্তা করলেন নাকি?
প্রিয়তা তখনও নিশ্চুপ।
-দেখুন প্রিয়তা আমি বেশি কথা বলা একদম পছন্দ করি না।কিন্তু তবুও আমি আপনার জন্য বকবক করে যাচ্ছি আর আপনি কোনো কথা বলছেন না।
প্রিয়তা কিছু না বলে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিবিড় হাত ধরে ফেললো।
প্রিয়তা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ করে।
আপনি কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন প্রিয়তা,এই দেড় বছর আমি যা বলবো আপনাকে তাই করতে হবে।বসে থাকতে বললে বসে দাঁড়িয়ে থাকতে বললে দাঁড়িয়ে।
প্রিয়তা এইবার নিবিড়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে, আমি কিচ্ছু ভুলিনি মিস্টার নিবিড়। আমার সব মনে আছে।কিন্তু প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন।তবে কথা দিচ্ছি দেড় বছরের একদিনও বেশি হবে না আমার এই বাড়িতে।প্রিয়তা কথাগুলো বলে নিবিড়ের থেকে হাতটা অন্য হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিচে চলে এলো।
প্রিয়তা কালো রঙের শাড়িটা খুলে অন্য একটা শাড়ি পরে খাটে এসে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো।
নিবিড় এসে প্রিয়তাকে শুয়ে থাকতে দেখে,উঠুন।
প্রিয়তা নিবিড় আসছে বুজতে পেরে আগেই চোখ বন্ধ করে ছিলো।
-আমি খাবার এনেছি খায়ে নিন
কথাটা শুনে প্রিয়তা অবাক হয়ে মনে মনে, কিহ্ হনুমানটা আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে?
-আমি জানি আপনি ঘুমাননি,শুধু শুধু ন্যাকামি না করে উঠে খেয়ে নিন।আমার সকালে অফিস আছে।রাত জেগে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তারপরও প্রিয়তা উঠছে না দেখে নিবিড় হাত টেনে একঝাটকায় উঠিয়ে, খেয়ে নিন।আমার কথার অবাধ্য হবেন না প্লিজ।
-আমার খেতে ইচ্ছে করেছে না।আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।সকাল বেলা তো আপনি অফিসে যাবেন আর আমি মাঠে।
প্রিয়তার কথা শুনে নিবিড় নিজের মনের কোনে হাসি ফুটিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, আমার দিকে তাকান।
নিবিড় প্রিয়তার সামনে বসে প্রিয়তার মুখের সামনে ভাতের লোকমা এগিয়ে নিয়ে, হা করুন।
প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে।
নিবিড় সত্যিই তাকে খাইয়ে দিতে চাইছে? কিন্তু সন্ধ্যায় যে মানুষটাকে দেখলাম নিজের চোখের সামনে এখন সেই মানুষটা অন্য রূপ নিয়ে আমার সামনে?
-হা করুন।
প্রিয়তা টলমল চোখে হা করে ভাত মুখে নিয়ে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,শেষ কবে কেউ তাকে এমন করে খাইয়ে দিয়েছে তার মনে নেই।।বাবা ছোটো বেলায় খাইয়ে দিতো।কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর আজ অব্দি কেউ তাঁর খাওয়া নিয়ে জোর করেনি খাইয়ে দাওয়াতো দূরের কথা।
প্রিয়তার চোখে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পানি এসে জমিয়ে জমিয়ে নিচে পড়ছে।
এই মানুষটা চায়টা কি? আমাকে ভালোও বাসেন না।আবার আমাকে না খাইয়ে রাখতেও চান না।
অদ্ভুত একটা রাক্ষস।
-এইসব ন্যাকামি কান্নাকাটি থামিয়ে খাওয়াটা শেষ করুন, আমার ঘুম পাচ্ছে।
সকাল সকাল প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে রুমে এসে নিবিড়ের অফিসে যাওয়ার জন্য ড্রেস বের করে খাটের উপর রেখে নিজে রেডি হয়ে কলেজে চলে গেলো।
কলেজে এসে অফিসে ইশাক কে দেখে,প্রিয়তা মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিলো।
ইশাক এগিয়ে এসে প্রিয়তার সামনের চেয়ারে বসে,কেমন আছো প্রিয়তা?
প্রিয়তা মুচকি হেসে, এইতো ইশাক ভাই চলছে।আপনার কী অবস্থা?
-মোটামোটি।তোমার হ্যাজবেন্ডকে কিন্তু এখনো দেখালে না।
কথাটা শুনে প্রিয়তা হাসি মুখটা মেঘের মতো কালো করে,অন্য একদিন ইশাক ভাই আসলে ওনি তো ব্যস্ত থাকে তেমন সময় বের করতে পারেন না।সময় হলে একদিন নিয়ে আসবো।
নিবিড় জুহিকে নিয়ে কলেজে এসে নামিয়ে দিয়ে, গাড়ি থেকে নিজেও নেমে,জুহি!
-হু ভাইয়া।কিছু বলবে?
-তোর ভাবীর অফিসটা কোন দিকে?এসেছি যখন একবার দেখা করে যাই।
জুহি ভ্রু নাচিয়ে, বুজি বুজি।ওই যে সোজা গিয়ে ডান দিকে।কথাটা বলেই জুহি ক্লাসের দিকে চলে গেলো।
-কিন্তু প্রিয়তা তোমার হ্যাজবেন্ড নাকি বিখ্যাত বিজনেসম্যান?
-ধুর ইশাক ভাই আপনি কি যে বলেন না।আমার হ্যাজবেন্ড তো এইট পাশ করেছে।
নিবিড় দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে,কিহ্ আমি এইট পাশ?ও মাই গড।
-কি বলো প্রিয়তা তুমি এতো উচ্চশিক্ষিত হয়ে কিনা এইট পাশ একটা ছেলেকে বিয়ে করলে?
প্রিয়তা মুচকি হেসে, ইশাক ভাই কপালে ছিলো।কপালের লিখন কী খণ্ডানো যায়?
-তা ঠিক, কিন্তু তোমার হ্যাজবেন্ড তাহলে কি করে?
- মুদি দোকানদার।ওদের এলাকায় ছোট্ট একটা মুদি দোকান নিয়ে বসেছে।
নিবিড় চোখ থেকে চশমা খুলে,এই মেয়ে তো পাগল হয়ে গেছে।আরে আমি এতো বড় বিজনেসম্যান ওই মেয়ে বলে কিনা আমি ছোট্ট মুদি দোকানী।
-প্রিয়তা তাহলে তো তোমার টাকায় সংসার চলে। আহারে তুমি নিজের ফ্যামিলির জন্যও কষ্ট করেছো এখন শ্বশুর বাড়িতে গিয়েও একি অবস্থা। আসলে মানুষের কপাল।কিন্তু প্রিয়তা তোমার হ্যাজবেন্ড তোমাকে ভালোবাসে?
-কি বলেন ইশাক ভাই এইটা কোনো কথা বললেন?
এইযে সকালে আসার সময়এ আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো,বউ সাবধানে যেও।পথে ঘাটে এক্সিডেন্ট বাড়ছে তোমার কিছু হয়ে গেলে তো আমিও কচু গাছের সাতে ফাঁসি দিয়ে ঝুলে পড়বো।
ইশাক বকার মতো প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে, কচু গাছটা কত বড়?
-অনেক বড়। ওনার থেকে বড় তো তাই বলছেন আরকি।
কথাটা শুনেই নিবিড় কাশতে শুরু করলো।
শেষে কিনা কচু গাছ!
প্রিয়তা দরজার দিকে তাকিয়ে নিবিড়কে দেখে,ইন্না-লিল্লাহ রাক্ষসটা এইখানে কী করছে?
আমি যা বলেছি শুনে ফেললো না তো?কিন্তু ওনি এইখানে কী করছেন?
ইশাক নিবিড়কে দেখে দাঁড়িয়ে, আরে মিস্টার নিবিড় কেমন আছেন?
নিবিড় নিজেকে একটু সামলিয়ে এগিয়ে এসে,জ্বি ভালো।
ইশাক প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে, প্রিয়তা ওনি হচ্ছেন এই শহরের বিখ্যাত বিজনেসম্যান মিস্টার নিবিড়। ওনার আরেকটা পরিচয় হচ্ছে তোমার প্রিয় ছাত্রীর বড় ভাই।
প্রিয়তা অনিচ্ছায় মুখে হাসি ফুটিয়ে সালম দিয়ে কেমন আছেন?
-জ্বি ম্যাডাম ভালো।এতোক্ষণ শুনলাম আপনি নাকি ক্লাস এইট পাশ ছেলেকে বিয়ে করেছেন? এইটা কি ঠিক করলেন? আহারে আপনি এতোটাই অপদার্থ যে নিজের এতো সুন্দর একটা কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে দিলেন?
প্রিয়তার কপাল বেয়ে বেয়ে ঘাম ঝরছে।ওহ্ এই লোকটা এইখানে কী করছে? প্রিয়তা কিছু না বলে টেবিল থেকে ফাইলটা নিয়ে, আমার ক্লাশ আছে বলে তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো।
নিবিড় অফিসে না গিয়ে বাড়ি এসে হাতের ফাইল গুলো খাটের উপর ছুড়ে ফেলে,কোট খুলে অন্য দিকে ছুড়ে,আমি এইট পাশ? আমি মুদি দোকানী, আজ বাসায় আসুক বুজাবো মজা।কত বড় সাহস আমাকে বলে মুদি দোকানী, অশিক্ষিত। ওর টাকায় আমাদের সংসার চলে?
নিবিড় পায়চারী করেই যাচ্ছে।
প্রিয়তা প্রথম ক্লাসটা করে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
সালমা বেগম প্রিয়তাকে দেখে নিবিড়ের রুমের দিকেও তাকাচ্ছে আবার প্রিয়তার দিকেও তাকাচ্ছে।
প্রিয়তা সালমা বেগম কে কিছু না বলে রুমের দিকে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
রুমে গিয়ে নিবিড়কে দেখেই প্রিয়তা চমকে,আ,,আ,আপনি অফিসে যাননি?
নিবিড় প্রিয়তাকে কিছু না বলে রাগন্বিত টকটকে লাল চোখে তাকিয়ে প্রিয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়তা এক পা এক পা করে পিছিয়ে, আপনিই তো বললেন আপনার পরিচয়টা যেনো আমি কাউকে না বলি।আপনিই তো বললেন আমি আপনার পরিচয় দিলে আপনার সম্মান থাকবে না। তাহলে এখন কেনো আমার উপর,,,,
প্রিয়তা পায়ের সাথে কিছু একটা লেগে পড়ে যেতেই নিবিড় জড়িয়ে ধরে ফেললো।
প্রিয়তা চোখ খুলে নিবিড়কে দেখে, করুন গলায় বললো,বিশ্বাস করুন আমি আপনার কথাগুলো ভেবেই বলছি আর কিছু না।
নিবিড় প্রিয়তাকে দাঁড় করিয়ে, সকালে আপনাকে আমি কী করেছি?
-কই কিছু তো করেন নি।
-এখুনি ভুলে গেলেন।আপনাকে না আমি কপালে চুমু দিয়ে জ্ঞানের বানী গিলিয়েছি।আর এখন বলছেন কিছুই বলিনি?
আসুন সকালেরটা এখুনি সেরে ফেলি।বানিয়ে বলার ছেয়ে সত্যিই হয়ে যাক।
কথাটা বলেই নিবিড় প্রিয়তাকে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনতেই প্রিয়তা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের চোখের দিকে।আর নিবিড় আস্তে আস্তে প্রিয়তার মুখের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।