পরদিন লাবনীকে স্কুলে দিয়ে নিশাদ অফিসে চলে যায়।দুপুর একটা বাজে নিশাদের নম্বরে একটা কল আসে।তবে নম্বরটা চিনতে পারেনি ও। নম্বরটা কিছুক্ষন দেখে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে নিশাদ তবে মনে পড়লোইনা।অগত্যা কল রিসিভ করে কানে রাখতেই অপরপাশ থেকে একজন লোক বলল,
''কুরিয়ার অফিস থেকে বলছি।আপনি নিশাদ রাহমান নন?দিল্লি থেকে দুটো ফোন এসেছিলো আপনার নামে।বেলা নামে কেউ পাঠিয়েছেন।"
''আমিই নিশাদ।আমি অফিসে আছি তো সাতটায় নিতে আসবো। থ্যাংক ইউ ইনফর্ম করার জন্য। "
''এটা আমাদের দায়িত্ব।আপনি চলে আসবেন।"
''অবশ্যই।"
নিশাদ ফোন কেঁটে কাজ করতে থাকে।
....................আজ অফিসে আদনানের প্রথম দিন।স্টাফ কলিগ সবার ব্যাবহার মোটামুটি ভালোই।আদনান উঠে নিজের রুমটা হেঁটে দেখতে থাকে।তখনই হঠাৎ দরজায় নক পড়ে।আদনান দৌড়ে চেয়ারে বসে বলল,
''আসুন।"
আদনান ফোন দেখছিলো।তখনই দরজা খোলার শব্দ হয়।আদনান মাথা উঠায় দরজা খোলার শব্দে।রুমে প্রবেশ করলো প্রিয়াশা মিত্র।আদনান একপলকে পুরোটাই দেখে নিলো প্রিয়াশা কে। কোকড়ানো চুল গুলো খোপা করা।চুল গুলো ঢেউ খেলানো।চোখে বেশ বড় আর মোটা ফ্রেমের চশমা।গায়ে সাদা নীল রং এর সূতির শাড়ী। হাতে সাদা নীল রং এর দুটো কাঁচের চুড়ি।গাল গুলো চকচক করছে ঘামে।বেশ লাগছে মেয়েটাকে।প্রিয়াশা ভেতরে ঢুকে আদনানকে দেখে চশমা টা একটু ঠিক করে নিয়ে বলল,
''আপনি?"
আদনান মাথা ঝাঁকায়।প্রিয়াশ বলল,
''আপনি একাউন্ট অফিসার?"
আদনান মৃদু হেসে বলল,
''জি।অন্য কাউকে আশা করেছিলেন?"
''আরে নাহ।মানে........."
প্রিয়াশার কপালে চিন্তার রেখা ফুঁটে উঠে।আদনান ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।প্রিয়াশা হঠাৎ গলা ঝেড়ে বলল,
''না আসলে তেমন কিছুনা।আসলে স্যার পাঠিয়েছিলেন আপনার কাছে।"
''ওহ।আচ্ছা।তো কি কাজ?"
''স্যার বললেন আপনার সাথে পরিচিত হতে।আসলে অফিসে যা সকল খরচের কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে তো।"
আদনান বড় নিশ্বাস ফেলে বলল,
''জি।তা আপনি কোন পোস্টে?"
''ডিরেক্টর স্যারের সেক্রেটারি। "
''ওহ।ভালো।শুনলাম কিছু মাল পত্র শুনলাম কেনা হবে।সেটার হিসাব গুলো পাঠানোর ব্যাবস্থা করে দিয়েন।"
''জি।"
আদনান প্রিয়াশার চোখগুলো দেখছিলো।সুন্দর ওর চোখজোড়া।প্রিয়াশা আদনানের এভাবে তাকানোয় কিছুটা বিব্রত বোধ করে।গলা ঝেড়ে বলল,
''আমি আসি তাহলে।"
আদনান কিছুটা চমকে উঠে চোখ সরিয়ে বলল,
''ওকে।"
প্রিয়াশা বেরিয়ে গেলো।আদনান একটু হাসলো প্রিয়াশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় খুব ভয় পায় ভীষন সহজ সরল।আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেয়।দুদিন পর ভাইয়ের জন্মদিন।কিছু গিফট করবে ভাইকে। ভালো কিছু।আদনান ভাবতে থাকে ভাইকে এবার কি দিবে ও?আপা আর ভাইয়ের জন্মদিন একই মাসের দশ আর সাতাশ তারিখে।কিভাবে যে মিলে গেলো?
......................... এদিকে বিভান সকাল উঠে রেডি হচ্ছিলো।বেলার চোখজোড়া ভরে আসে।লোকটা আজ ও কথা বলছেনা। ও তো না বুঝেই লোকটাকে ভীষন কষ্ট দিলো।বেলার ভীষন দোষী মনে হচ্ছে নিজেকে।বেলা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।বিভান টাই লাগিয়ে গায়ে কোট জড়িয়ে নিচ্ছিলো।বেলা মুখে ম্লান হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
''বিভান আদনানের জব হয়েছে।আজ ওর জয়েনিনং ডেট।"
বিভান চুপচাপ টেবিলে বসে পাউরুটিতে কামড় বসায়।বেলা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
''শুনেন কিছু বাজার লাগবে।কোন ডাল নেই বাসায়।আপনার তো ডাল পছন্দ।পারলে মাংস ও কিনে দিয়েন।"
বিভান কোন কথাই বলছেনা।শুধু চুপ করে বসে খাচ্ছে।বেলা আবার বলল,
''শুনেন আজকে একটু জলদি আসবেন।আমার না খুব একা লাগে।ভয় হয় এই বাসায়।"
বিভান চুপচাপ পানি খেয়ে উঠে যেতেই বেলা ওর হাত চেঁপে ধরে বলল,
''সরি আপনার চা আনতে ভুলে গেছি।আপনি বসুন চা নিয়ে আসি।"
বিভান চুপচাপ বসে পড়লো।বেলা পাকঘরে চলে গেলো।বলতে লাগলো,
''অনেক দিন ফুচকা খাওয়া হয়না।ভাবছিলাম আজ দুজন একসাথে পার্কে গিয়ে ফুচকা খাবো আর গল্প করবো।"
ডাইনিং আর পাকঘর পাশাপাশি বলেই বেলা কথা বলছিলো।বিভানের কোন উত্তর না পেয়ে বেলার গলা ভারি হয়ে নিশ্বাস আটকে যেতে চায়।লোকটা কতোদিন এমন করবে?কেন ওকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে?বেলার ভুল হয়েছে এভাবে এত বছর তাকে অন্ধকারে রেখে যার প্রায়শ্চিত্ত ওকে এভাবে করতে হচ্ছে।চায়ে চামচ চালিয়ে বেলা ডাইনিংরুমে আসতে আসতে বলছিলো,
''চায়ে চিনি মনে হয় বেশি পড়ে গেছে।একটু কষ্ট করে খেয়ে নিবেন।"
ডাইনিং রুমে এসে বেলা খেয়াল করলো বিভান সেখানে নেই। চায়ের কাপ নিয়েই বেলা ড্রয়িং রুমে চলে গেলো। সেখানে ও নেই বিভান।বেলা বেডরুমে ও এসে খুঁজলো আসলে সে নেই।চা না খেয়েই চলে গেলো।বেলার ভীষন খারাপ লাগছে।সে বসে ছিলো। আরেকটু অপেক্ষা কি করতে পারতোনা?
চায়ের কাপটা রেখে বেলা খাটে বসে পড়ে।চোখজোড়ায় অশ্রু আর বাঁধা মানতে চায়না।গুঁমড়ে কেঁদে উঠে বেলা।বিভান এসে গাড়িতে বসে ফোন হাতে নেয়।আদনানকে কল দেয়া উচিৎ।ছেলেটা কতো কষ্টের পর জব পেলো।অভিনন্দন জানাতে হয়।বিভান আদনানের নম্বরে কল দেয়। কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হয়।অপরপাশ থেকে আদনান সালাম দিয়ে উঠে।বিভান বলল,
''ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো ভাই?"
''আলহামদুলিল্লাহ। নতুন জব কেমন যাচ্ছে?এখন তো মনে হয় অফিসে তাইনা?"
''সরি ভাই আসলে তাড়াহুড়ো করে আপনাকে বলা হয়নি।আমি অফিসে আছি।"
''সরি বলতে হবেনা।এমন হয়ই।তা কেমন লাগছে?"
''আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।একটু ভীতি কাজ করছে।আশা করি সময়ের সাথে সাথে ঠিক হবে।"
''ইনশাল্লাহ। তা কোন পোস্ট?"
''চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট।"
''ওহ ভালো।মন লাগিয়ে কাজ করো।অনেক কষ্টের এই জবটা।অনেক অপেক্ষার ফল।"
''জি ভাইয়া দোয়া করবেন।আপনারা ভালো আছেন?আপা কি করে?"
''আমি অফিসে যাচ্ছি।তোমার বোন বাসায়।"
''ওহ।আচ্ছা ভাইয়া ডিরেক্টর স্যার ডাকছে পরে কথা বলি?"
''শিওর।যাও তুমি।"
বিভান কল কেঁটে ল্যাপটপ অন করে বসে।ভালো লাগছেনা।আসলে দুটো দিন যাবৎ কিছুই ভালো লাগছেনা।বেলা কি বুঝেনা ওকে ছাড়া বিভানের কতো কষ্ট হয়?বেলার সাথে কথা না বলে কতো কষ্ট হয় বিভানের।বুকে কতো যন্ত্রনা হয়।কিছু ভাল লাগেনা।কিন্তু বেলা তো ওকে মিথ্যে বলেছিলো তেরটা বছর যাবৎ।বিভানকে কষ্ট দিয়েছিলো এত গুলো বছর ওর অজান্তেই।
বেলাকে অবহেলা করতে ভালো লাগছেনা ওর।তবে বেলা কে বুঝতে হবে।স্বামী স্ত্রীর মাঝে কথা লুকানো ঠিক না তাও আবার যখন কথা গুলো নিজের সন্তানের ওপর এসে পড়ে।বিভান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কাজ করতে থাকে।চা টা না খেয়ে কি খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বেলাকে?বেলাতো ওকে বসিয়ে চা করতে গিয়েছিলো।বিভান আর ভাবতে চায়না।বেলাকে বুঝতে হবে ওদের সম্পর্কের ব্যাপার পুরোপুরি বুঝতে হবে।
........................সেদিন বিকেলে সাইমনের সাথে ঘরে ফিরছিলো সাঁঝ।সবে রিদ্ধিকে পড়িয়ে এসেছে ও।সাইমন নিচে অপেক্ষা করছিলো।সাইমন গাড়ি চালানোর মাঝেই সাঁঝকে একপলক দেখে বলল,
''চুপচাপ কেন ম্যাম?"
''ভালো লাগছেনা।"
সাইমন হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বলল,
''শরীর খারাপ করলো নাকি?কি হয়েছে?"
''আরে নাহ সেটা না।আমার ছোট বোন লাবনী।ও ক্লাশ টেনে পড়ে।সামনে ম্যাট্রিক।সভাপতি শফিকউল্লাহর ছেলে ওকে নাকি বিরক্ত করেছে ওর গায়ে স্পর্শ করেছে।আমরাকি কোথাও সেফ না?বলুন।ও ছোট মানুষ। ওর সাথে কেন হলো এমন?"
সাইমন বলল,
''এমন নিচু মানসিকতার লোকগুলো নোংরামো করতে কারোর বয়স দেখেনা।জানো বাড়ির পাশেই একবছরের একটা মেয়ে বাবু রেপ হয়েছে।এখন কি বলবা?"
সাঁঝ প্রচন্ড অবাক।একবছরের বাবু কিইবা বুঝে?সে তো এখনো অবুঝ।সাঁঝ বলল,
''এ্যারেস্ট করেনি রেপিস্ট কে? "
''সাঁঝ যখন রেপিস্ট মন্ত্রির ছেলে তখন কি বলবে?কে শাস্তি দিবে তাকে।এ্যারেস্ট করলে ও জামিন হবে।কিন্তু বাচ্চাটার পরিবার!!!ওনাদের কি হবে?বাচ্চাটা তো মরে ও বেঁচে গেলো কিন্তু ওর আব্বু আম্মুর কেমন লাগছে বুঝতে পারছো?"
সাঁঝ মন খারাপ করে বসে থাকে।আসলে কি বলবে ও?দেশটার নৈতিকতা মানবিকতা বলতে আর কিছুই থাকলোনা।সাঁঝকে চুপ থাকতে দেখে সাইমন বলল,
''তোমার বোন লাবনী একা যায় স্কুলে?"
''না আজ বড় ভাইয়া নিয়ে গেলো।"
''ওনার তো অফিস থাকে তাইনা?"
সাঁঝ মাথা ঝাঁকায়। সাইমন আবার বলল,
''তোমাদের এলার্ট থাকতে হবে।এসব ব্যাপার গুলো না খুব বেড়ে গেছে।"
''সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু আসলে কেউই তেমন ফ্রি নেই।মেজ ভাইয়ের ও জব হয়ে গেলো।হুমায়রার ও পরীক্ষা।"
''দেখ সাঁঝ ওকে সেলফ ডিফেন্ডার হতে হবে।নিজের রক্ষা নিজেকে করতে হবে।যাকেই পাঠাও বিপদ বলে আসেনা।"
''হুম।"
সাঁঝ মাথা নিচু করে বসে রইলো।সাইমন বলল,
''সাঁঝ শুনো।"
সাঁঝ মাথা উঠিয়ে সাইমনের দিকে তাকায়।সাইমন বলল,
''কাল ফ্রি আছো?"
''কেন?কি হলো?"
''আগে বলো।রিদ্ধি কে পড়াবে?ভার্সিটি আছে?"
''হুম।রিদ্ধির পড়া নেই কাল। কেন?"
''কাল পুরোদিন টা আমাকে দেবে সন্ধ্যা পর্যন্ত?"
''কেন কি হয়েছে?"
সাঁঝের চেহারায় চিন্তার ভাব।সাইমন বলল,
''কাল আমার মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী। সেদিনটায় আমি খুব একা থাকি।তাই বলছিলাম তুমি আমার সাথে থাকো।আমার ভীষন কষ্ট হয় সেদিনটা।থাকবে তুমি?থাকবেনা?"
সাঁঝ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''থাকবো আমি।"
সাইমনের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুঁটে উঠলো।সাঁঝের মাথার পিছনে হাত রেখে একটু এগিয়ে এসে ওর কপালে চুমু খেলো সাইমন।
সাাইমন সরে যেতেই সাঁঝ লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
''ঘরে চলুন।"
সাইমন হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
!!!!
বিভানের অপেক্ষায় রাত বারোটা।বেলার চোখে ঘুম নেই।ও তো লোকটাকে বলেছিলো জলদি ফিরতে তাহলে সে এখন ও আসেনি কেন?বেলা বিভানের নম্বরে আবার ও কল দেয়।এনিয়ে অনেক বার কল দেয়স হলো সে রিসিভ করছেনা।বেলার চিন্তা হচ্ছিলো বিভানের জন্য।আজ ও আশা করেছিলো লোকটা জলদি ফিরবে কিন্তু আজ সবচেয়ে দেরি হচ্ছে।বেলা খাবার আবার ও গরম করে।হাঁটতে হাঁটতে ড্রয়িংরুমে চলে আসে বেলা।ড্রয়িংরুমে বেশ বড় একটা বারান্দা আছে।বেলা ওখানে গিয়ে দাঁড়ায়।বাহিরে অনেক বাতাস হচ্ছে।বেলা বাহিরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল বিভান এসেছে কিনা।কিন্তু তার দেখা মিলছেনা।অনেকটা সময় পার হয়ে যায়।বিভান আসেনা।বেলা রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।ফোনটা রুমে রেখে এসেছিলো।ডাইনিং রুম পার করে রুমে যাবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠে।বেলা পিছনে ফিরে দ্রুতপদে ড্রয়িংরুমে চলে আসে।তারপর পিপহোলে তাকিয়ে বিভানকে দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠে।সাথে সাথে দরজা খুলে দেয় বেলা।বাহিরে বিভান দাঁড়িয়ে আছে।ওর চেহারায় কোন এক্সপ্রেশন নেই।বেলাকে দেখে আজ ওর মুখে কোন হাসি নেই।বেলার মুখের হাসি ম্লান হতে থাকে। তারপর ও মুখে এতটুকু হাসি রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল,
''এতো দেরি হলো যে?"
বিভান কিছু না বলে বেলাকে পার করে রুমে চলে যায়।বেলার কান্না চলে আসে।কেন এমন হচ্ছে এসব?বিভান কথাই বলছেনা ওর সাথে।অশ্রু ভারি হতে থাকে বেলার চোখে।চোখ মুছে বিভানের পিছু রুমে আসে।বিভান গোসলে ঢুকে গেছে।বেলা টেবিলে খাবার সাজিয়ে নেয়।তারপর রুমে এসে ভালো একটা শাড়ী পরে। চুল গুলো কে আঁচড়ে পিঠের ওপর ছেড়ে দেয়।কপালের মাঝ বরাবর কালো একটা ছোট্ট টিপ পরে নেয়।কিছুসময়ের মাঝে বিভান বেরিয়ে আসে হলুদ ফতুয়া আর সাদা ট্রাউজার পরে।রুমে বেলা নেই।বিভান চোখ ঘুরিয়ে বেলা কে দেখার চেষ্টা করে।কিন্তু বেলা নেই।বিভান চুল মুছে ডাইনিং রুমে এসে চেয়ারে বসে পড়তেই হঠাৎ পাকঘর থেকে বেরিয়ে আসে বেলা।মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বেলা এগিয়ে আসে বিভানের প্লেটে খাবার বাড়তে শুরু করে।বিভান কিছু বলছে না।শুধু চুপচাপ প্লেটের দিকে চেয়ে আছে।খাবার বাড়ার পর বেলা পাশে বসে নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে নেয়।বিভান খাচ্ছে তবে বেলার দিকে তাকাচ্ছেনা।বেলা বলল,
''আজ চা না খেয়ে চলে গেলেন যে?"
বিভান কথাটা শুনে কিছুটা থমকে যায়।কারন বেলার সাথে আগে কখনোই এমনটা করেনি।কিন্তু পরিস্থিতিটা ওকে বাধ্য করছে।বিভান নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে খেতে থাকে।বেলা আবার বলল,
''মাংস টা ভালো হয়েছে?আপনার তো পছন্দ বিফ।"
বিভান মুখ শক্ত করে খাচ্ছে।বেলার চোখ ভিজে আসে।চোখ মুছে বলল,
''আমি তো ভুলেই গেছিলাম খাওয়ার সময় কথা বলা পছন্দ করেননা।রুমে গিয়ে কথা বলবো।আপনি খেয়ে নিন।"
বেলা না খেয়ে উঠে চলে যায়।বেলা যাওয়ার পর বিভান মাথা তুলে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।আজ মাংসটা খুব মজা হয়েছিলো।বিভান পাশে তাকিয়ে বেলার প্লেট দেখতে পায়।বেলা রুটি থেকে একবার ছিড়ে খেয়েছে।আর বাকিটা এমনিতেই পড়ে আছে।বিভান নিজে কোনমতে খেয়ে রুমে চলে আসে।বেলা খাটের এক কোনে শুয়ে আছে।গায়ে সেই আগের শাড়ী। চুল গুলো খোপা করে নিয়েছে ও।বিভান সেদিকে একপলক তাকিয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে দেয়। রাত দেড়টায় বেলা পাশ ফিরে বিভানকে দেখার চেষ্টা করে।বিভান সোজা হয়ে শুয়ে আছে।বেলা একটু এগিয়ে এসে বিভানের বুকে মাথা রেখে কান্না করে দেয়।কান্না জড়িত গলায় ধীরে ধীরে বলছিলো,
''খুব ভুল হয়ে গেছে আমার বিভান।প্লিজ এভাবে আর রাগ করে থাকবেননা। সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।নিতে পারছিনা আমি।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে বিভান।আপনি এখন আর আমার দিকে আগের মতো দেখেননা।বিভান আমি তো আপনার কথা ভেবেই বলিনি।কারন বাবা মা না থাকার যন্ত্রনা আমি বুঝি।আমার তো মা বাবা থেকে ও নেই।আপনার তো মা ই ছিলো শুধু।তাই আমি চাইনি আপনি ওনার থেকে আলাদা হয়ে যান।কিন্তু আমার এই ভুলটা যে এতো বড় শিক্ষা দেবে বুঝতেই পারিনি।"
বেলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু বিভান অন্যদিক ফিরে শুয়ে পড়ে।বেলা মাথা উঠিয়ে নেয়।অশ্রুসজল দৃষ্টিতে বিভানকে দেখতে থাকে বেলা।বেলা শুয়ে বিভানকে দেখতে থাকে।হঠাৎ কি যেন হলো বেলা উঠে।বিভানের হাতের নিচে হাত ঢুকিয়ে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে বিভানের পিঠের সাথে একদম লেগে শুয়ে পড়ে।বিভান কেঁপে উঠে।তখন বেলার কথা গুলো নিতে না পেরে পাশ ফিরে শোয়।এখন বেলা কে সরাতে পারবেনা ও।এতুটুকুয় যদি বেলা শান্তি পায় তাহলে পাক না? কিন্তু বিভান নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবোনা।
............................এদিকে সেদিন ফোন দুটো নিয়ে নিশাদ ইমতিয়াজের বাসার পথে রওনা হয়।নিশাদ পৌছেই দেখলো ইমতিয়াজ সোফায় বসে জুতা পড়ছে।নিশাদকে দেখে ইমতিয়াজ বলল,
''কি খবর?"
''এই আছি।তুই কেমন আছিস?"
''আলহামদুলিল্লাহ।"
নিশাদ কিছুসময় চুপ করে থেকে বলল,
''কি যেন বলবি?"
ইমতিয়াজ ভাবছে ও নিজেকে আর ও কিছুদিন সময় দিয়ে পরে বলবে সাঁঝের কথা।ইমতিয়াজ বলল,
''এখনো সময় আসেনি হয়ত।যা ইদ্রি রুমে আছে।"
''ওকে।"
ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেলো।নিশাদের ইদ্রির রুমে যেতে কেমন যেন লাগতে থাকে।ইদ্রির রুমে একবার দেখে নিশাদ চোখ সরিয়ে নিচে তাকায়।কি করবে ও?ইদ্রির রুমে যেতে ওর কেমন যেন লাগছে।বার বার সৈয়দা আন্টির কথা গুলো কানে লাগছে।নিশাদ দাঁড়িয়ে বারবার ইদ্রির রুমের দিকে তাকিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াতে যাবে তখনই সৈয়দা বেগম এসে বললেন,
''নিশাদ তুমি?"
নিশাদের পা থেমে যায়।ও আগাতে পারেনা আর।পাশে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল,
''জি আন্টি আসসালামু আলাইকুম।"
''ওয়ালাইকুম আসসালাম অনেকদিন পর এলে।"
নিশাদ ম্লান হেসে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।সৈয়দা বেগম বললেন,
''তুমি আর ইমতু একসাথে বড় হইছো।আমাদের হাতের ওপর বড় হইছো।আমার কথা তোমার খারাপ লাগলে মাফ করে দিও।বুঝো তো আমি মা।আমার একটা মেয়ে আছে।তোমার ও তো বোন আছে তাইনা?তোমার মাও হয়ত এমনটা করত।তুমি আমাকে ভুল বুইঝোনা।তুমি অনেক ভালো ছেলে আমি জানি বাবা।"
নিশাদ হেসে বলল,
''আন্টি সরি বলে ছোট করবেননা।আপনার কোন দোষ নেই।আপনি মা আপনিই তো চিন্তা করবেন।বিশ্বাস করতে পারেন আমাকে আন্টি।আপনাদের কষ্ট লাগবে এমন কিছু করবোনা আমি।"
সৈয়দা বেগম হেসে বললেন,
''তুমি সবসময়কার মতোই খুব বুঝদার ছেলে বাবা।যাও ইদ্রির রুমে যাও।"
নিশাদ একটু হেসে বলল,
''জি আন্টি।"
বলেই।সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো নিশাদ।ইদ্রি মুখ ধুয়ে বেরিয়ে তোয়ালে হাতে নিয়ে মুছতে শুরু করে।ইদানীং বেশ ঘাম হচ্ছে ওর।অবশ্য বেশ গরম ও পড়েছে।এসি একটু বাড়িয়ে ইদ্রি খাটে বসে ফোন হাতে নিতেই দরজায় নক পড়ে।ইদ্রি জোরে বলল,
''দরজা খোলা।"
নিশাদ নিঃশব্দে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে।ইদ্রি ফোন থেকে চোখসরিয়ে সামনে তাকিয়ে চটজলদি উড়না বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।ওর চোখ বড় হয়ে গেছে।মুখে হাসি।নিশাদ ঢুকে ইদ্রির দিকে তাকায়।ইদ্রি নিষ্পলক ভাবে নিশাদকে দেখে যাচ্ছে।নিশাদ হেসে বলল,
''কেমন আছো?"
ইদ্রি কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করে খুব কান্না পাচ্ছে ওর।গলা প্রচন্ড ভারি হয়ে আছে।ইদ্রি মাথা ঝাঁকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
''হুম ভালো।"
নিশাদ ওর থেকে চোখ সরিয়ে বলল,
''এসি একটু কমিয়ে দেবে প্লিজ।ঠান্ডা সহ্য হয়না আমার।এলার্জি আছে।"
ইদ্রি চটজলদি এসি একদম কমিয়ে দিলো।নিশাদ এবার বলল,
''এসে বসে পড়ো।অনেকদিন মিস গেছে।"
ইদ্রি ধীর পায়ে নিশাদের পাশে বসে পড়ে।নিশাদ কে আজ খুব হ্যান্ডসাম লাগছে।গায়ে ধূসর বর্নের একটা শার্ট আর নীল জিন্সপ্যান্ট।ইদ্রির ভীষন ভালো লাগছে নিশাদকে দেখে।ওর ইচ্ছে হচ্ছে হাসতে তবে পারছেনা ও।কি করবে?ইদ্রি বারবার কম্পিউটার দেখার মাঝেই নিশাদকে দেখছিলো।নিশাদ ব্যাপারটা খেয়াল করে ও এড়িয়ে যায়।
ইদ্রি নিশাদের পাশের ছোট ব্যাগ দেখে বলল,
''এটা কি?"
নিশাদ পাশে তাকিয়ে বলল,
''এটা আমার বড় বোন পাঠিয়েছে।"
ইদ্রি হেসে বলল,
''দেখি?"
নিশাদ ব্যাগটা ওর দিকে দিয়ে বলল,
''দেখো।"
ইদ্রি দুটো ফোনের বক্স বের করলো।দুটো আইফোন।ইদ্রি বলল,
''দুটো আপনার?"
''না।একটা আমার ভাইয়ের।"
''ওহ।সুন্দর হয়েছে ফোন গুলো।"
''থ্যাংক ইউ।এবার দেখো কম্পিউটার। "
ইদ্রি কম্পিউটারে মন দেয়।তবে ওর মনে চলছে অন্য কিছু আজ তাকে এতো ভালো লাগছে।ইদ্রির ইচ্ছে হচ্ছে ও এই মুহূর্তে এই সৌন্দর্যটাকে ফ্রেমবন্দী করবে।ইদ্রি পাশে তাকিয়ে ফোনটা মিউট করে নিয়ে ক্যামেরা ওপেন করে ও আর নিশাদের দিকে ক্যামেরাটা এনে দুষ্টু হেসে ছবি তুলে নেয়।হঠাৎ নিশাদ বলল,
''ইদ্রি ওদিকে কি?কম্পিউটার দেখো।"
ইদ্রি চটজলদি ফোন সরিয়ে বলল,
''জি দেখছি।"
ইদ্রিকে পড়ানো শেষ করে ঘরে ফিরে যায় নিশাদ।চটজলদি রুমে এসে হাত মুখ ধুয়ে নেয়।জুলেখা বানু তিনবার ওকে ডেকে গেছিলেন ডিনারের জন্য।আজকাল মা কিছু ব্যাপার ভুলে যায়।মনে করায় দিতে হয়।নিশাদ বাথরুমে ফ্রেশ হচ্ছিলো তখনই জুলেখা বানু বারনার এসে ডাকতে থাকেন।নিশাদ বারবার বাথরুম থেকে বলছিলো,
''আম্মা আমি বাথরুমে।"
''ওরে আব্বা তুই গোসল কইরা আয় তাইলে।তোর রুমে এতো আন্ধার ক্যা?ঘুমাস নি?"
জুলেখা বানু এসে খাট হাতিয়ে বলতে লাগলেন,
''কিরে আব্বা কই ঘুমাস তুই?"
নিশাদ আর কিছু বললনা।কারন আম্মা চলে গিয়েছিলো।সেদিন ডিনারের পর সব ভাইবোন কে এক সাথে করে নিশাদ ফোন বের করে আদনানের হাতে দিয়ে বলল,
''আপা পাঠাইছে আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য। "
আদনান নিজের ফোন হাতে নিয়ে দেখতে থাকে।এদিকে নিশাদের ফোন ছিলো লাবনীর হাতে।কুঞ্জন ওর পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে।লাবনী ফোন দেখে সাঁঝের হাতে দিয়ে বলল,
''ভাইয়া এটায় আমাকে গেমস খেলতে দিবি?"
নিশাদ কিছু বলতে গেলে কুঞ্জন বলল,
''একদম না ভাইয়া ও নষ্ট করে ফেলবে।"
লাবনী রেগে কুঞ্জন কে গুতো মেরে বলল,
''আমি কেন নষ্ট করবো?তোর মতো আমি?"
নিশাদ হেসে বলল,
''ঝগড়া করবিনা।খেলিস আমি ঘরে আসলে।"
লাবনী এসে নিশাদকে জড়িয়ে বলল,
''থ্যাংক ইউ ভাইয়া।"
সবাই ঠিক করলো বাবা কে বলবে মেজ খালু ফোন পাঠিয়েছে দুই ভাইয়ের জন্য।আদনান কাল সকালে ওনাকে ফোন দিয়ে সব বুঝিয়ে বলবে।
..................................এদিকে সেদিন বারোটায় সাঁঝ সাইমনের নম্বরে কল দিয়ে রুমে এসে বসে সিগারেট টানছিলো তখনই সাঁঝের কল আসে ওর নম্বরে।সাইমন কল রিসিভ করে কানের সামনে ধরে।আজ ওর মন টা একদম ভালো নেই।মাকে খুব মনে পড়ছে।সাঁঝ বলল,
''কি হলো কথা বলেননা কেন?"
গভীর নিশ্বাস ফেলে সাইমন বলল,
''কি বলবো?"
''মাকে মিস করছেন খুব?"
''অনেক বেশি।"
সাঁঝ নরম গলায় বলল,
''সাইমন আপনি মাকে খুব ভালোবাসেন তাইনা?"
''খুব।"
সাঁঝ মৃদু হেসে চুপ করে রইলো।লোকটার কষ্টটাকে আসলে ও অনুভব করতে পারেনা কারন এর অনুভূতি ওর নেই আর সাঁঝ চায় ও না থাকুক।ও চিন্তাই করতে পারেনা মা বাবাকে হারানোর কথা।হঠাৎ সাইমন বলল,
''সাঁঝ!!!"
''জি।"
''কাল সকালে খুব স্পেশাল একটা জায়গায় নিয়ে যাবো।"
সাঁঝ উচ্ছাস নিয়ে জানতে চাইলো,
''কই?"
''আছে।তুমি রাত জেগোনা সকাল নয়টায় তোমার কলেজের সামনে থাকবো আমি।চলে এসো।"
''ওকে।"
সাইমন কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
''তুমি নাহলে ঘুমাও এখন।কাল তো সারাটাদিন তোমার সাথেই থাকবো।আমার ও অফিসেড কিছু কাজ আছে সেগুলো শেষ করতে হবে।"
''ঠিক আছে জলদি ঘুমিয়ে পড়বেন।রাত জাগবেননা আপনিও।"
সাইমন ফোন রেখে কাজে মন দেয়।