ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ কোত্থেকে একটা ছেল এসে শাড়ির আঁচলের ফাঁক দিয়ে স্পৃহার পেটে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে চোখের পলকে আবার ভীড়ের মধ্যেই মিলিয়ে গেল। দুমিনিটের মধ্যে স্পৃহার সাথে কী হয়ে গেল তা সে বুঝতেই পারলো না। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটনা গুলো ঘটে গেল। এমন নোংরা একটা দৃশ্যের কথা মনে করতেই স্পৃহার গা গুলাতে লাগলো। তার চোখ ছলছল করছে। কখনো তাকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। স্পৃহা আজই প্রথম শাড়ি পরেছে। সেটাও তার কাজিন মারিয়ার জোরাজুরিতে। আর আজকেই তার সাথে এমন একটা নোংরা ঘটনা ঘটে গেল। স্পৃহার কান্না পাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সে কান্না চেপে রাখতে পারলো না। তার চোখ থেকে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। এমন সময় একটা ছেলে অন্য একটা ছেলের শার্টের কলার চেপে ধরে নিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে বলল,
'এই জানোয়ারটাই একটু আগে আপনার সাথে অসভ্যতা করেছে। ও ভেবেছিল ভীড়ের মধ্যে কেউ হয়তো ওকে দেখেনি।'
স্পৃহা মাথা উচু করে ছেলেটার দিকে তাকাল। রাগে ঘৃণায় তার শরীর রি রি করছে। ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে। ঐ ছেলেটা আবার বলল,
' বদমাশটার গালে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চড় লাগান'
স্পৃহা এই ছেলেটার কথার মানে বুঝতে না পেরে চোখ কুঁচকে ওর দিকে তাকালো। সে আবার বলল,
' ও আপনার সাথে যা করেছে তার জন্য ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবেন? ওকে ওর অন্যায়ের যথাযোগ্য শাস্তি দিবেন না? আজ আপনার সাথে এমনটা করেছে। এখন আপনি ওকে হাতের কাছে পেয়েও যদি শাস্তি না দেন। তাহলে কাল অন্য কারো সাথে এমনটা করার সাহস পাবে। আপনি কি চান, আপনি আজ যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কাল আপনার ছোট বোন বা অন্য কোনো মেয়ে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক? যদি চান তাহলে ওকে ছেড়ে দিব। কিছুই বলব না। আর যদি না চান তাহলে আমি যা বলেছি তা করুন। একদম ভয় পাবেন না। এর পরে যা হবে তা আমি বুঝে নিব।'
ছেলেটার কথায় স্পৃহা অনেকটা সাহস পেল। সে কিছু না ভেবে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঐ ছেলেটার গালে চড় বসিয়ে দিল। হঠাৎ এমন কিছু হবে তা আশেপাশের লোকজন হয়তো ভাবেনি। এতক্ষণ সবাই নিজেদের মত ব্যস্ত থাকলেও এখন সবাই ওদের দিকে তাকিয়েছে। উৎসুক নজরে কি হচ্ছে তা দেখছে।
.
.
অনেকক্ষণ ধরে দু'টা ছেলে খুব লোভী দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু'জন কি যেন বলাবলি করছে। একজন কি যেন বললো আর তা শুনে অন্যজন খুব বিশ্রী ভাবে হাসলো। ওর হাসি দেখেই মনে হচ্ছে, যে কথা বলছে সে নোংরা ধরনের কিছু বলছে। দু'জনের চোখই চকচক করছে। তাদের দৃষ্টি এমন(দৃষ্টি দিয়ে দূর থেকে কাউকে গিলে খাওয়ার মত)।
জীবন ছেলে দু'টোর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে নূপুরের জন্য অপেক্ষা করছে। নূপুর এখনো আসছে না দেখে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে ওকে খুঁজছিল। হয়তো নূপুর এসে তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ দু'টো ছেলের উপর চোখ চলে যায়। এতক্ষণ সে ওদের কথায় কান না দিলেও এখন শোনার চেষ্টা করলো ওরা কি বলছে।
লম্বা ছেলেটা বলল,
' মামা দেখ চোখের সামনে কী মাল দাঁড়িয়ে আছে অথচ আমরা তাকে ধরতে পারছি না।কাছে যেতে পারছি না। দূর থেকে শুধু চোখ দিয়েই দেখে যেতে হচ্ছে। এমন আগুন মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। ফিগারটা দেখ মামা।'
কালো ছেলেটা তার থেকেও খারাপ ভাবে বলল,
' শালী হয়তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে আসছে। আজ বয়ফ্রেন্ডের সাথে হোটেলে যাবে। দেখস না কী সাজটাই না দিয়েছে। লাল শাড়ি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক,খোঁপায় লাল গোলাপ। শালী আসছে বয়ফ্রেন্ডের জ্বালা মিটাতে কিন্তু পেট দেখিয়ে আমাদের মত চার পাঁচটার অন্তরে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে গেল।'
' আমার তো ওর ঠোঁটে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করতেছে।'
' তোর তো চুমু। আমার তো ওর সুন্দর, চিকন পাতলা কোমরটা ধরতে ইচ্ছে করতেছে।'
কথাগুলো বলেই দু'জনই হাসতে লাগলো।
ওদের দু'জনের কথা শুনে জীবনের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। একটা মেয়েকে নিয়ে এতো খারাপ খারাপ কথা ওরা কীভাবে বলতে পারছে? মন তো চাইছে ওদের এক্ষুনি সাত হাত মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে। কিন্তু সে কিছু করতে পারছে না। এক ওরা তাকে কিছু বলে নি। বিনা কারণে সে কাউকে মারতে পারবে না। দুই এখানে অনেক মানুষ সবার সামনে ওদের মারলে সবাই কারণ জানতে চাইবে। তখন মেয়েটার অসম্মান হবে।
জীবন রাগ নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো। আজকের দিনে এখানে কেউ একা আসবে না। মেয়েটা হয়তো কারো সাথে এসেছে। আর নয়তো তার মতই কারো জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সুন্দর একটা মেয়ের উপর থেকে চোখ সরানো সত্যিই কঠিন কাজ। এই মেয়ে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলার মত মেয়ে। এই ধরনের মেয়েদের জন্য ছেলেরা প্রথম দেখাতেই পাগল হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটা এতোটা বেখেয়ালি কেন? কখন থেকে শাড়ি আঁচল সরে গিয়ে পেট দেখা যাচ্ছে সে দিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। সে ব্যস্ত দৃষ্টিতে শুধু চারপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। কালো ছেলেটা আবার বলল,
' দোস্ত চল আজ একটা বাজি ধরা যাক। দেখি তোর কত সাহস। তুই যদি সত্যি সত্যিই ঐ মেয়েটার পেটে হাত দিতে পারিস তাহলে আমি তোকে এক হাজার টাকা দিব।'
' মাত্র এক হাজার টাকা? এক হাজার টাকার জন্য এতো লোকের সামনে এই রিস্ক নিতে পারব না। টাকার পরিমান বাড়া।'
' আচ্ছা যা দুই হাজার। এর থেকে বেশি পারব না। রাতে মাল খাওয়ার জন্য আমার কাছে এতই ছিল।'
' আচ্ছা যা দুই হাজারই চলবে। বাজিতে আমি রাজি। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, গিয়ে মেয়েটার পেট ধরে আসব। তুই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখ তোর বন্ধুর সাহস কতটুকু।'
.
.
স্পৃহা চড় মারার পর জীবন ছেলেটিকে ইচ্ছে মত মারতে লাগলো। মেরে মেরে ওর নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। ভয়ে কেউ তাকে আটকাতে আসছে না। সাথের ছেলেটা সেই কখন পালিয়ে গেছে। এতো হৈচৈ শুনে সামনে থেকে ভীড় ঠেলে মারিয়া এগিয়ে এল। স্পৃহাকে কাঁদতে দেখে বলল,
' স্পৃহা তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস তো?'
স্পৃহা মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
' মারিয়াপু তুমি আমাকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলে?'
' আমি তো সোমের সাথে সামনেই ছিলাম। তুই কাঁদছিস কেন?' মারিয়া জীবনের দিকে তাকিয়ে বলল,
' আর এই ছেলেটা পাগলের মত ঐ ছেলেটাকে মারছে কেন? কি হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।'
জীবন মারতে মারতে ছেলেটাকে বলল,
' কোনো মেয়েকে একা পেয়ে গেলেই তোদের চুলকানি শুধু হয়ে যায় তাই না? তোদের কাছে মেয়েদের মাল মনে হয়? তোদের চোখ সব সময় ওদের ফিগার মাপে। কুত্তার বাচ্চা তোরা মানুষ হবি না। কি যেন বলছিলি? শাড়ি পরলে মেয়েরা মাল মনে হয়? তোর মা'ও তো হয়তো শাড়ি পড়ে তোর চোখে কি তিনিও মাল? মেয়েদের সম্মান দিতে পারিস না ঠিক আছে। কিন্তু তাদেরকে নোংরা চোখে দেখার থেকে তো বিরত থাকতে পারিস। এই মেয়েকে নাহয় তুই চিনিস না তাই ওর সাথে অসভ্যতামি করছিস। কিন্তু যাদের চিনিস(তোর মা,বোন,ভাবী)অন্তত ওদের কথা ভেবে তো মেয়েদের উত্যক্ত করিস না। তোরা অন্য মেয়েদের সাথে যা করে বেড়াচ্ছিস। তা হয়তো তোর মত অন্য কেউ তোর বোনের সাথে করছে।'
জীবন এবার থামলো। আরো মারলে ছেলেটা এখানেই মারা যাবে। সে মানিব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকা বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল,
' এই কয়টা টাকার জন্যই তো একটা মেয়েকে অসম্মান করলি। এই নে টাকা। যা এগুলো দিয়ে নিজের চিকিৎসা করিয়ে নিস। আর হ্যাঁ, একটা কথা। আজকের পর থেকে ভালো হয়ে যাস। আর কখনো অন্য কোনো মেয়েকে অসম্মান করার আগে আজকের এই মারের কথা মনে করে নিবি।'
ছেলেটা টাকা নিয়ে কোনোরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জীবন নিয়ে পালালো। জীবন স্পৃহার দিকে তাকালো। ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল,
' আর হ্যা মিস দোষ যে একার শুধু ঐ ছেলেটার ছিল তা না। দোষ আপনারও সমানই ছিল। কিন্তু ও আপনার সাথে অসভ্যতা করেছে তাই মার খেয়েছে। আপনি কেমন মেয়ে হ্যা? ভ্যালেন্টাইন ডেতে এভাবে সেজেগুজে শাড়ি পড়ে পেট দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন।'
জীবনের কথা শুনে স্পৃহা নিজের দিকে তাকিয়ে তাৎক্ষনাত শাড়ির আঁচল টেনে পেট ঢাকল। সে আজকের আগে আর কোনোদিন শাড়ি পরেনি। শাড়ির অভ্যাস তার নেই। তাই ঠিকমত সামলাতেও পারে না। জীবন বলল,
' আপনি নিজে যদি এমন ড্রেসআপ করেন তাহলে কিছু অমানুষ তো আপনার দিকে খারাপ নজর দিবেই। আগে আপনি নিজের শাড়ি সামলাতে শিখুন। তারপর নাহয় শাড়ি পড়ে বাইরে বের হবেন। আজ আপনার সাথে এর থেকেও খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো। মনে রাখবেন সমাজের চোখে কিন্তু ছেলেদের দোষ পড়ে না। আর সমাজের মানুষ ছেলেদের কলঙ্ক বেশিদিন মনে রাখে না। তারা কিন্তু মেয়েদেরকেই দোষী করে। তাদের বাঁচাটাই অসম্ভব করে দেয়। আপনি একজন মেয়ে, আপনাকেই নিজের সম্মান রক্ষা করে চলতে হবে।'
স্পৃহা চুপ করে ছেলেটার কথাগুলো শুনছে। এই ছেলে নিশ্চয়ই তাকে খারাপ ভাবছে। কিন্তু সে তো আর পাঁচটা মেয়ের মতন শাড়ি পড়ে পেট দেখিয়ে বাসা থেকে বের হয়না।
জীবন আস্তে করে বলল,
' পাঁচ ফুট লম্বা মেয়ে বারো তেরো হাত লম্বা শাড়ি পড়েছে তবুও পেট দেখা যাচ্ছে। আজকালকার মেয়েরা আর তাদের ফ্যাশান দু'টোই জাস্ট অসহ্য।'
জীবন কথাটা আস্তে বললেও স্পৃহা ঠিকই শুনতে পেরেছে। জীবন আর কথা না বাড়িয়ে বাইক নিয়ে চলে গেল। মারিয়া ছেলেটার কথা শুনে ঘটনা আন্দাজ করতে পেরেছে। সে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
' আমার জন্য আজ তোর সাথে এমনটা হলো। না আমি জোর করে তোকে শাড়ি পড়াতাম। না তুই আমার সাথে আসতি। আর না এসবকিছু হতো। সরি স্পৃহা।'
' মারিয়াপু আমি বাসায় যাব। আমাকে বাসায় নিয়ে চলো।'
' হ্যা চল।'
.
.
' ছেলেটা এতো লোকের ভীড়ে তোর পেটে হাত রাখলো। সাহস দেখেছিস? ভাগ্য ভালো ঐ ছেলেটা সাহস করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। ঐ লাফাঙ্গার টাকে যা মার মেরেছে না। জীবনে আর এমন কাজ করার সাহস পাবে না।'
স্পৃহা সিএনজিতে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে। এই মূহুর্তে মারিয়ার কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না। সে বারবার ঐ ছেলের বলা কথা গুলো মনে করতে লাগলো। ঐ ছেলের কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে।
' আর হ্যা মিস দোষ যে একার শুধু ঐ ছেলেটার ছিল তা না। দোষ আপনারও সমানই ছিল। কিন্তু ও আপনার সাথে অসভ্যতা করেছে তাই মার খেয়েছে। আপনি কেমন মেয়ে হ্যা? ভেলেনটাইসডেতে এভাবে সেজেগুজে শাড়ি পড়ে পেট দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। আপনি নিজে যদি এমন ড্রেসআপ করেন তাহলে কিছু অমানুষ তো আপনার দিকে খারাপ নজর দিবেই। আগে আপনি নিজের শাড়ি সামলাতে শিখুন। তারপর নাহয় শাড়ি পড়ে বাইরে বের হবেন। আজ আপনার সাথে এর থেকেও খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো।'
স্পৃহা কথাগুলো মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মারিয়া এখনো কথা বলে যাচ্ছে,
' তোর সাথে এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে এটা জানলে আমি কখনোই তোকে আমার সাথে আসার জন্য জোরাজুরি করতাম না। বিশ্বাস কর স্পৃহা তোর জন্য আমার অনেক খারাপ লাগছে। তুই বাড়িতে গিয়ে আবার এসব কথা কাউকে বলিস না। মা শুনলে আমাকে আস্ত রাখবে না। জয় তো কতবার করে বলেছে,
' আপু আজকের দিনে এই ভেবলিকে নিয়ে বের হইয়ো না।' আমি কারো কথা না শুনে জোর করে তোকে নিয়ে এলাম। কে জানতো বাজে ছেলে গুলো তোর সাথে এমন করবে।'
স্পৃহা মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
' আপু আমি কাউকে কিছুই বলবো না। তুমি চিন্তা করো না।'
' বাঁচালি স্পৃহা। তুই তো জানিস বাবা, মা, জয় তোকে নিয়ে কতটা টেনশন করে। সবাই তোর বিষয়ে কতটা সেনসিটিভ।'
ওরা গলির সামনে এসে সিএনজি ছেড়ে দিল। স্পৃহা সিএনজি থেকে নেমেই বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। মারিয়া ভাড়া মিটিয়ে স্পৃহার পেছন পেছন তাকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে আসছে।
' এই স্পৃহা দাঁড়া না। এই শোন।'
স্পৃহা দাঁড়াল। মারিয়া ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল,
' তুই মুখ এমন বাংলার পাঁচের মত করে বাসায় ঢুকলে সবাই সব বুঝে যাবে। তোকে কিছু বলতেও হবে না। এমন মনমরা হয়ে না থেকে একটু হাসার চেষ্টা কর। মুখ থেকে এই কালো মেঘগুলো সরিয়ে একটু রোদ আন।'
ওরা বাড়িতে ঢুকলে মেহেরুন স্পৃহাকে দেখে বলল,
' চলে এসেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম তোদের অনেক দেরি হবে। মারিয়ার সাথে গিয়েছিস, সে তো একবার বাসা থেকে বের হতে পারলে আর সহজে ফিরতে চায় না।'
পেছন থেকে মারিয়া বলল,
' এটা কী বললে মা? আমি কোন দিন একঘন্টার বেশি বাড়ির বাইরে থেকেছি? বের হওয়ার বিশ মিনিটের মধ্যেই তো কল করে মাথা ধরিয়ে দাও। তোমার জন্য ফ্রেন্ডদের সামনে আমাকে লজ্জায় পড়তে হয়। ওরা কী বলে জানো?
' এতো বড় হয়ে গেছিস এখনো তোর মা তোকে চোখে চোখে রাখে। সারাক্ষণ শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে রাখতে চায়।'
' তো বলুক। বন্ধুরা কী বললো না বললো তা নিয়ে তোর যাবে আসবে কেন? তোকে নিয়ে আমার চিন্তা হয়। তাই এমন করি। শখে তো আর করি না।'
' এতো চিন্তা করতে কে বলেছে তোমাকে? জয়কে নিয়ে তো এতো চিন্তা করো না।'
' জয় ছেলে। তুই মেয়ে।'
' ওহ,মেয়ে হয়ে অপরাধ করে ফেলেছি। একা কিছু করতে পারব না। একা কোথাও যেতে পারব না। এমনকি নিজের পছন্দের কোনো ড্রেসও পড়তে পারবো না। মেয়েদের সময় এমনটা কেন? ছেলেদের ক্ষেত্রে তো কোনো বাধা নেই।'
মা মেয়ের মধ্যে আবার কথা কাটাকাটি আবার শুরু হয়ে গেছে। স্পৃহা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। আর বিকেলের কথাটা মনে পড়তে গা গুলিয়ে বমি আসছে। স্পৃহা রুমে চলে গেল। কাঁধ থেকে ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। পরনে শাড়ি নিয়েই ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। নিঃসন্দেহে আজকের দিনটা তার জীবনের সবথেকে খারাপ দিন। পেটের যেই অংশে ছেলেটা ছুঁয়েছে স্পৃহা সেখানে খুব জোরে ঘষতে লাগলো। পেটটাই কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আর নয়তো এই অংশের চামড়া তুলে ফেলতে পারলে ভালো হতো। স্পৃহা সামনের দিকে আয়নায় তাকোলে হঠাৎ যেন আয়নায় কাউকে দেখতে পেল। একটা ছেলের মুখ আয়নায় ভেসে উঠেছে সে স্পৃহাকে কিছু বলছে,
' এইযে মিস এতো সুন্দর পেট বের করে রাখেন কেন? আপনি জানেন আপনার পেট কতটা সুন্দর?'
আয়নার ছেলেটাকে চিনতে তার দুমিনিট সময় লাগলো না। এটা আজকের বিকেলের ঐ ছেলেটা। স্পৃহা কথাটা শুনে কেঁপে উঠলো। পানি লেগে ঝাপসা হয়ে থাকা আয়নাটা হাত দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। আর সাথে সাথেই ছেলেটাও চলে গেল। লজ্জায় স্পৃহার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সে নিজে একবার তার পেটের দিকে তাকালো। পরক্ষণেই মনে মনে কথা দিল, আজকের পর থেকে সে আর কোনদিন শাড়ি পড়বে না। কোনোদিনও না। অনেক সময় নিয়ে স্পৃহা গোসল সেরে বের হলো। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে গেল। মেহেরুন স্পৃহাকে দেখে বলল,
' মারিয়া বলেছিল তোর নাকি মাথা ব্যথা করছে। এখন ঠিক আছিস তো?'
' হুম '
'আয় তাহলে খেতে বোস।'
মারিয়া স্পৃহার দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করে জেনে নিলো সে ঠিক আছে কিনা। স্পৃহাও মাথা দুলিয়ে জানালো সে ঠিক আছে।
স্পৃহা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
' আঙ্কেল কোথায় খালামণি? এখনো আসেনি?'
' এলে তো দেখতেই পেতিস। দেখ না আজকের দিনটাতেও তার যত কাজ। কোথায় আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাসায় চলে আসবে। তা না...'
' মা আজ যদি বাবা বাসায় ফেরার সময় তোমার জন্য লাল গোলাপ না নিয়ে আসে তাহলে কিন্তু কড়া একটা ঝগড়া হবে।'
' তা আর বলতে? আজ গোলাপ না পেলে আমি মেহেরুন রাতে তাকে খেতে দিব না। না খাইয়ে রাখব দেখে রাখিস তোরা।'
মারিয়া মা'কে বাবার বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিচ্ছে আর মজা নিচ্ছে। স্পৃহা মারিয়ার কানে কানে বলল,
' মারিয়াপু এটা কিন্তু তুমি ঠিক করছো না। বেচারা আঙ্কেলের ভালোবাসা দিবসের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ। এখন যদি আঙ্কেল ভুলেও ফুল না নিয়ে বাসায় ফিরে তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ তো। খালামণি কিন্তু ঠিকই উনার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলবে।'
মারিয়া স্পৃহার কথা শুনে হাসলো। মা'কে আরেকটু জ্বালানোর জন্য জিজ্ঞেস করল,
' মা তোমার গুণধর ছেলে কোথায়? সেও কি আজ বাসায় নেই? আমার জানামতে তো ভ্যালেন্টাইন ডেতে ওসব ছেলেরাই রাতে বাড়ির বাইরে থাকে যাদের গার্লফ্রেন্ড আছে। তোমার ছেলেরও তেমন কেউ আছে নাকি? দেখা গেল কাল সকালে নিউজপেপারে তোমার ছেলের ছবি এসেছে। গার্লফ্রেন্ডের সাথে পার্কে ঘুরতে গিয়ে পুলিশের হাতে গার্লফ্রেন্ড সহ ধরা খেয়েছে এক তরুণ। তরুণটির নাম জোহান আহমেদ... '
মারিয়া কথা শেষ করার আগেই মেহেরুন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
' মারিয়া জয় কোথায়? ওকে এক্ষুনি বাসায় আসতে বল। স্পৃহা তুই জয়কে ফোন দিয়ে বল,আমি ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছি। তাকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বল।'
স্পৃহা মারিয়াকে চিমটি কেটে বলল,
' আপু এটা কি করলে তুমি? আঙ্কেলের পেছনে লাগলে তো লাগলে। এখন জয় ভাইয়ার পেছনেও পড়েছ?'
মারিয়া ফিসফিস করে বলল,
' আমরা মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি বলে ঘরে আটকা থাকবো। আর ওরা ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছে বলে সকাল নেই, বিকেল নেই, রাত নেই, দুপুর নেই সেসময় ইচ্ছে হবে সেসময়ই বাইরে থাকতে পারবে? নো নেভার। এমনটা আমি বেঁচে থাকতে হতে দিব না। তুই দেখ বিশ মিনিটে ভেতরে জয়কে বাসায় আসতে হবে।'
দেখা গেল সত্যিই বিশ মিনিটের মধ্যেই জয় বাসায় চলে এসেছে। এসে মা'কে সুস্থ দেখে সেও চিৎকার চেচাঁমেচি শুরু করে দিয়েছে,
' মা তোমার কিছু হয়নি তাহলে তুমি মিথ্যা বলে আমাকে বাসায় আনালে কেন? আমার সব বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছিল। সবাইকে রেখে আমি তোমার পা ভাঙার খবর পেয়ে দৌঁড়ে ছুটে এসেছি। তুমি আমার সাথে কেন এমন করলে মা?'
' বন্ধুদের সাথে এতো আড্ডা দিতে হবে না। আজ তুই বাসায় থাকবি।'
' মানে? অসম্ভব। আমি এক্ষুনি আবার বের হচ্ছি।'
' আমার কথা অমান্য করে এখন বাড়ি থেকে এক পা বের হলে আমি তোর পা'ই ভেঙে দিব। বেশি বড় হয়ে গেছিস না? মায়ের কথা অমান্য করার সাহস দেখাস।'
জয় অসহায় মুখ করে স্পৃহার দিকে তাকালো। স্পৃহা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
' আজ আমার হাতেও কিছু করার নেই ভাইয়া।'
জীবন রাত করে বাসায় ফিরলো। দুপুরের আগে বের হয়েছিল নূপুরের সাথে দেখা করার জন্য। সারাদিন বাইরে কাটিয়েছে। নূপুর যেখানে আসবে বলেছিল সেখানে না এলে ওদের বাড়ির সামনে গিয়েও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জীবন। সেখানেও নূপুরের দেখা পেল না। কাল রাতেই তো তার সাথে কথা হয়েছে। আজ সকাল থেকে কোথায় উধাও হয়ে গেল মেয়েটা। না দেখা করেছে। আর না ফোন তুলছে। কী হলো ওর? জীবন ওর রুমের দিকে যাচ্ছিল ফরিদা পেছন থেকে ডেকে বলল,
' জীবন! এই বুঝি তোর ফেরার সময় হলো? রাত কটা বাজে সেদিকে খেয়াল আছে তোর? আমি যে তোর জন্য না খেয়ে বসে আছি তাতে তো তোর কিছু যায় আসে না, তাই না?'
' বড় আম্মু তুমি সব সময় এমন করো। আমি তো বলেছি আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকবে না। তুমি খেয়ে নিবে। আমার ফিরতে মাঝে মাঝে অনেক রাত হয়ে যায়। আবার কোনোদিন আমি বন্ধুর বাসা থেকে খেয়ে আসি।'
' হুম। তুই আমাকে নিয়ে চিন্তা না করলেও আমি ঠিকই তোকে নিয়ে চিন্তা করি। তুই কোথায় আছিস,কী করছিস, খেয়েছিস কিনা।'
' আচ্ছা বাবা হয়েছে। বেশি ইমোশনাল হতে হবে না। এখন খাবো চলো। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি তুমি খাবার দাও।'
' আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়।'
জীবন ফরিদার সাথে বসে খেয়ে নিজের রুমে গেল। শুধুমাত্র বড় আম্মুর জন্যই সে এই বাড়িতে আছে। নয়তো কোনোদিন এবাড়িতে পা রাখতো না। বড় আম্মু তাকে কতটা ভালোবাসে এটা জীবন জানে। তাই সে এই মানুষটাকে কষ্ট দিতে চায় না। জীবন ফোনটা হাতে নিয়ে আজকের জন্য শেষ বারের মত নূপুরকে কল করলো। রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন তুলছে না। জীবন একটা ম্যাসেজ দিয়ে ফোনটা পাশে রেখে চোখ বন্ধ করে মাথার নিচে দু'হাত রেখে শুয়ে পারলো।
' কোথায় তুমি নূপুর? তুমি ঠিক আছো তো? কেন আমার সাথে এমন করছো? প্লিজ একটা বার আমার সাথে দেখা করো।'
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর আজকের শাড়ি পড়া ঐ মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। আর মেয়েটার কথা মনে হবার সাথে সাথেই চোখের সামনে মেয়েটার ভয় আর লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ভেসে উঠলো। কতটা অস্বস্তি নিয়েই না মেয়েটা শাড়ির আঁচল ঠিক করছিল। ঐ মেয়ের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল আজকের আগে সে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।
জীবন চোখ খুলে উঠে বসল,
' আমি হঠাৎ এই মেয়ের কথা ভাবছি কেন? আর ওর মুখটা এতো স্পষ্ট করে আমার চোখের সামনে ভাসছে কেন? মেয়েটাও দোষ ছিল। শাড়ি সামলাতে পারে না তাহলে কেন শাড়ি পড়ে। এতো সুন্দর পেট দেখলে যেকোনো ছেলেই সেদিকে তাকাবে। ছেলেটা তো শুধু পেটে হাত দিয়েছে। যদি এতোগুলো লোকের সামনে শাড়ির আঁচল টান দিয়ে খুলে ফেলতো তখন। তখন কেমন হতো? মেয়েরা যে কেন একা একা বাইরে বের হয়। নিজেকে রক্ষা করতে জানে না অথচ সব জায়গাতে তাদের ছেলেদের সমান অধিকার চায়।'
জীবন আবার স্পৃহার চেহারা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।