কুচকুচে কালো কাকটা ছাঁদের ডানপাশের রেলিংয়ের উপর বসে আছে। সকালের মিষ্টি রোদে চোখদুটো কেমন ছলছল করছে। মনে হচ্ছে, সুপ্ত কোনো দুঃখে ভীষণভাবে কাতর সে। চোখ দুটো বোজে নিলেই স্তব্ধতা কাটিয়ে জল গড়াবে। গায়ে লাল সুয়েটার। হাতে-পায়ে মোজা আর মাথায় মস্ত একটা শীত টুপি পরে দুঃখী চোখের কাকটিকেই নিরক্ষণ করছিল কৌতূহলমাখা কচি দুটো চোখ। তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটোতে পাউরুটি আর চিপসের প্যাকেট। চিপসের প্যাকেটটা চাচ্চু দিয়েছে। ভাইয়েরা তাদের চিপসের প্যাকেট সাবাড় করে নিলেও শুভ্রতা খাচ্ছে না। মা বলেছে, সকাল বেলা চিপস খেলে পেট ব্যথা হয় তাই ইচ্ছে থাকলেও চিপস খাওয়া যাচ্ছে না। শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে কাকটাকে ডাকল,
' কা কা আয়...'
কাকটা শুভ্রতার আন্তরিকতাটাকে বোধহয় খুব একটা ভালো চোখে দেখল না। কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে উড়ে এসে শুভ্রতার পাউরুটির ওপর হানা দিলো। ছু মেরে পাউরুটিটা নিয়েই ডানা মেলে উড়ে গেল অদূরে। শুভ্রতা চমকে ওঠে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল। ছাঁদে বামদিকের রেলিংটাতে ঝুলাঝুলি করছিল আদ্র আর রোদ্র। শুভ্রতাকে এমন হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভারি বিরক্ত গলায় বলল রোদ্র,
' তুই খুব বোকা বোন। কাককে কি কেউ পাউরুটি খেতে ডাকে?'
শুভ্রতা বড় বড় বিস্মিত চোখজোড়া মেলে ভাইদের দিকে তাকাল। রেলিং-এর ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে আদ্র। হাতে সাদা রঙের একটা বাক্স। বক্সটা মূলত বড় দিদার। ঔষধ দিয়ে ঠাসা বক্সটা খুব সকালেই বড় দিদার ঘর থেকে সরিয়ে ফেলেছে দুই ভাই। বক্সটাতে ঔষধগুলো অবশিষ্ট নেই তবে অনেকগুলো লাল পিঁপড়া আছে। এই পিঁপড়াগুলো বাগানের কোণা থেকে অনেক খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করেছে তারা। আদ্র গম্ভীর গলায় বলল,
' বড় দিদা বলেছিল বিড়ালের মধ্যে ভূত থাকে। কাকের মধ্যেও ভূত থাকে। কাকের তো দাঁত নেই। ভূত না হলে অতো বড় পাউরুটি খাবে কি করে?'
রোদ্র মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতেই সিঁড়ি ঘর থেকে মায়ের কন্ঠ এলো। সাথে সাথেই রেলিং থেকে নেমে দৌঁড় লাগাল দু'জনে। রোদ্র বোনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
' বোন দৌঁড়া। বোকার মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এখনই মাইর পড়বে।'
শুভ্রতাও চিপসের প্যাকেট ফেলে ভাইদের পেছনে দৌঁড় লাগাল। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। মাঝ সিঁড়িতেই মায়ের হাতে ধরা পড়ে গেল শুভ্রতা।
' আম্মু? বড় দিদার ঔষধের বাক্স নিয়েছ তুমি?'
শুভ্রতা বড় বড় চোখ মেলে তাকায়। আধো আধো গলায় বলে,
' আমি নিই না।'
রোদেলা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মেয়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
' সত্যি?'
' ছত্তি।'
রোদেলা কয়েক সেকেন্ড মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মিষ্টি হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। কচি গালে চুমু দিয়ে বলল,
' তাহলে কে নিলো? তুমি জানো কে নিয়েছে? বড় দিদা ঔষধ না খেলে দিদার কষ্ট হয় তো। গায়ে ব্যথা পায়। বড় দিদা তোমায় কত্ত আদর করে। তুমি জানো? কাউকে ব্যথা দিলে আল্লাহ কত্তো রাগ করে?'
শুভ্রতা ভাবুক গলায় বলল,
' বয়ো দিদা ব্যতা পায়?'
' হুম। অনেক ব্যথা পায়। এখন বলো তো মা। ঔষধের বাক্সটা কে নিলো? ভাইয়ারা?'
রুহি রাগান্বিত গলায় বলল,
' ওকে কি জিগ্যেস করছিস? ওই ফাজিল দুইটা ছাড়া এই কাজ আর কে করতে পারে? আজ এদের হাত-পা ভাঙব আমি।'
শুভ্রতা ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো চোখে মায়ের দিকে তাকাল। বলল,
' মামুনি বাইয়াদেল মাব্বে? ওলা ব্যতা পাবে তো।'
রোদেলা আদুরে গলায় বলল,
' না মা। মামুনি মারবে না কিন্তু আল্লাহ শাস্তি দেবে। তোমাকে বাবা বলেছে না? আল্লাহ সব দেখতে পান। কেউ যদি কাউকে কষ্ট দেয় তাহলে আল্লাহ তাদের শাস্তি দেয়। কাউকে ব্যথা দেওয়া তো খারাপ কাজ, তাই না মা? বড় দিদা যখন ব্যথায় কাঁদবে তখন আল্লাহ তো রাগ করবেন। তারপর খারাপ কাজের জন্য দুষ্টদের শাস্তি দিবেন।'
শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। দুইহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। চোখ পিটপিট করে বলল,
' আল্লা অয়েক মাব্বে?'
' হুম। যারা কাউকে কষ্ট দেয় শুধু তাদের মারবে। ভালোদের তো আল্লাহ অনেক ভালোবাসে। অনেক গিফ্ট দেয়।'
' আমি কস্ত দিব না। তাওলে গিফ্ত পাব?'
' হ্যাঁ পাবে।'
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শুভ্রতা মায়ের গলা ছেঁড়ে দু'হাতে মোনাজাতের ভঙ্গিমা করল। গম্ভীর মুখে বলল,
' আল্লা, তুমি বাইয়াদেল মেলো না। ওলা কুব বালো। ওলা বয়ো দিদাকে আল কস্ত দেবে না। ওসুতের বক্সও নেবে না। ছত্তি।'
রোদেলা আর রুহি হেসে ফেলল। মেয়ের কপালে গভীর চুমু দিয়ে বুকে চেপে ধরল রোদেলা। মেয়েটার মুখটা একদম বাবার কার্বন কপি। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। রোদেলার হঠাৎ করেই খেয়াল হলো তার ভার্সিটির সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে কোল থেকে নামানোই এখন দুষ্কর হয়ে উঠবে। শুভ্র তো সেই সকালেই ভার্সিটি চলে গিয়েছে। রেখে গিয়েছে নিজের মতোই জেদি এক মেয়ে। রোদেলা সন্তপর্ণে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বটগাছের পাতার ফাঁক গেলে আসা মিষ্টি রোদেরা মাটির পাটাতনে অদ্ভুত সব ছবি আঁকছে। ঘাসে ঢাকা মাঠে গোল হয়ে বসে আছে বন্ধু-বান্ধব আর প্রেমিক-প্রেমিকার দল। শীতের সকালের প্রথম আলোয় চারপাশটা সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। সেদিকে তাকিয়েই একের পর এক চালতার টুকরো সাবাড় করছে চিত্রা। মুখের একপাশে রোদের টুকরো এসে পড়ায় ভীষণ অদ্ভুত দেখাচ্ছে তার মুখ। সামনের রাস্তা দিয়ে গোলাপি রঙের গাউন পড়া ছোট-খাটো মিষ্টি একটি মেয়েকে দেখতে পেয়েই হাত উঁচিয়ে ডেকে উঠল চিত্রা,
' এই রোদ? আমি এখানে। এদিকে আয়।'
রোদেলা ফিরে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে চিত্রাকে দেখতে পেয়েই মুখে হাসি ফুটল তার। দ্রুত পায়ে চিত্রার পাশে গিয়ে বসল। গায়ের চাদরটা টেনেটুনে ঠিক করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চিত্রা আচারের টুকরো মুখে দিতে দিতে বলল,
' আমাদের আম্মুটা কই রে?'
' বাসায়।'
' নিয়ে আসলেই পারতি। তোর মেয়েটা কি মিষ্টি।'
রোদ কপাল কুঁচকে বলল,
' পাগল! আমি ভার্সিটিতে এসেছি ক্লাস করব বলে। মেয়েকে এনে কি করব? শুধু শুধু জ্বালাতন করবে।'
' শুভ্র ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিতি। আর জ্বালাতনের কি? কত্তো মিস্টি একটা মেয়ে। মা যা বলে তাই শুনে। তবুও বলছিস জ্বালাতন?'
' তুই ওদের বাপ বেটিকে কতদূর জানিস বইন? দুটোই মারাত্মক রকমের ফাজিল। কাল কি করেছে জানিস? বাগানে গিয়ে লাল পিঁপড়ার কামড় খেয়ে সারা শরীর ফুলিয়ে ফেলেছে। এই আদ্র-রোদ্র ওই পিঁপড়া নিয়ে আবার বাক্সবন্দি করেছে বোনকে কামড় দেওয়ার শাস্তিস্বরূপ। ধরতে গিয়ে ওই দুটোও কামড় খেয়েছে। কান্নাকাটি করে সন্ধ্যায় আবার দিদার সুপারি কাটার সরতা দিয়ে হাত টাত কেটে বিশ্রী অবস্থা করেছে। দিদার লাঠিটাও তিনজনে মিলে ছাঁদ থেকে ফেলে দিয়েছে। ঔষধের বক্স নিয়ে ঔষধ ফেলে এসেছে মালি চাচার ঘরের পাশে। সব মিলিয়ে একদম পাগল হয়ে যাচ্ছি। এদিকে মেয়ের বাবা আমাকে বকাবকি। আমি মেয়েকে সামলে রাখি না। এখনও বাচ্চামো করি। হেনতেন। কেমন লাগে বল?'
চিত্রা খিলখিল করে হেসে উঠল। রোদেলা রাগ নিয়ে বলল,
' একদম হাসবি না। হাসলে ধরে নিয়ে শিশির স্যারের কোলে বসিয়ে দিয়ে আসব। বেয়াদব মাইয়া।'
চিত্রা হাসি থামাল। সামনের একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলল,
' ওই মেয়েটাকে দেখ। এই মেয়েটা সারাদিন শুভ্র ভাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে হয়ত। সেদিন দেখলাম ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে শুভ্র ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।'
এটুকু বলতেই ফুঁসে উঠল রোদেলা। রোদেলার থমথমে মুখ দেখে চুপসে গেল চিত্রা। ভয়ে ভয়ে বলল,
' তোর আবার কি হলো?'
রোদেলা উত্তর দিল না। এমন সময় হাতের মুঠোফোনটা কেঁপে উঠল। রোদেলা কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে ফোন রিসিভ করল। ধারালো কন্ঠে বলল,
' কি সমস্যা?'
ওপাশ থেকে হাসিমাখা কন্ঠে জবাব এলো,
' অনেক সমস্যা।'
' আপনার সমস্যা নিয়ে আপনি বসে থাকুন। আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন? ফোন রাখুন। আমি আপনার সাথে কথা বলব না।'
' ইশ! বউটাকে রাগলে কি কিউট লাগে। রোদপাখি কি খুব রেগে আছে?'
রোদেলা মুখ ঝামটি দিয়ে বলল,
' আমি কারো রোদপাখি নই। এবং কারো ওপর রেগেও নেই। আমাকে রোদপাখি ডাকবেন না।'
শুভ্র অসহায় কন্ঠে বলল,
' কিছুই তো বুঝতে পারছি না। হঠাৎ এতো রাগ কেন? কি করলাম?'
' কিছুই করেন নি। ফোন রাখুন। আমি আজ বাবার বাসায় যাব। বাসায় ফিরব না।'
শুভ্র ব্যস্ত হয়ে বলল,
' আরে কিন্তু রাতে.... '
রোদেলা কল কেটে দিল। চিত্রা অবাক হয়ে বলল,
' এটা কি হলো?'
' তোর মাথা হলো। ক্লাসে যাবি নাকি পাবদা মাছের মতো হা করে এখানেই বসে থাকবি?'
চিত্রা ওঠে দাঁড়াল। চাদর দিয়ে নিজের ফুলে ওঠা পেটটা ডেকে নিয়ে বলল,
' আমাদের জুনিয়র পোলাগুলো হেব্বি কিউট বুঝলি? এগ্লা আমাদের থেকে দুই-তিন ইয়ার বড় হলে কি হতো বল তো? সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে বিয়ে করে বিরাট বড় ভুল করে ফেলছি। নয়তো এসব কিউট কিউট জুনিয়র দেখে বিয়ে করে ফেলতাম আমি।'
রোদেলার বিরক্ত মুখে হাসি ফুটে উঠল। কন্ঠে দুষ্টুমি নিয়ে বলল,
' এক শিশির স্যারকেই সামলাতে পারিস না আবার জুনিয়র। তবে, তুই বললে শিশির স্যারকে ব্যাপারটা জানাতেই পারি আমি। তার বউয়ের যে জুনিয়রের সাথে প্রেম করতে ইচ্ছে করছে তা তো উনার জানা উচিত, তাই না?'
চিত্রা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মুখ ফুলিয়ে বলল,
' তোমাকে এতো মহান হতে হবে না। তার থেকে বরং আরেকটা বেবি নিয়ে ধন্য কর আমায়। আমি একা একা এতো বড় পেট নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিষয়টা আমার ভাল্লাগে না। তুই প্রেগনেন্ট হলে দু'জনে সেইম সেইম। দারুণ হবে না?
রোদেলা প্রত্যুত্তরে কিছু বলবে তার আগেই সামনে এসে দাঁড়াল সাকিব। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
' আসসালামু আলাইকুম, ভাবি।'
' ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া। কেমন আছেন?'
সাকিব বোকা হেসে বলল,
' আলহামদুলিল্লাহ। আসলে একটা কথা বলতে এসেছিলাম ভাবি।'
রোদেলা হেসে বলল,
' কি কথা?'
' ভাই আপনাকে পার্কিং এ যেতে বলল। শুভ্রা মামুনি এসেছে। কান্নাকাটি করছে নাকি। ড্রাইভার দিয়ে গিয়েছে।'
রোদেলা আৎকে উঠে বলল,
' কখন এলো ও? আশ্চর্য! বাড়িতে এতোগুলা মানুষ থাকতেও ওকে এখানে পাঠানোর মানে কি?'
কথাগুলো বলতে বলতেই দ্রুত পায়ে পার্কিং-এর দিকে ছুটে গেল রোদেলা। চিত্রা তার পিছু নিতেই পেছন থেকে ডেকে উঠল সাকিব,
' আরে শাশুড়ী আম্মা। আপনি কোথায় যান? সব জায়গায় উঁকিঝুঁকি দেওয়া তো ঠিক না শাশুড়ী আম্মা। আমার হবু বউয়ের জন্য আমার প্রচুর টেনশন হয়।'
চিত্রা চোখ-মুখ লাল করে বলল,
' আপনি আমাকে শাশুড়ী আম্মা ডাকবেন না তো সাকিব ভাই।'
সাকিব ভারি ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বলল,
' সেকি! বউয়ের মাকে শাশুড়ী আম্মা ডাকব না তো কি ডাকব? আচ্ছা, আজকে থেকে একটু স্মার্ট করে ডাকব। শাশুড়ী আম্মা থেকে শাশু আম্মু। এখন ঠিক আছে না শাশুড়ী আম্মা?'
সাকিবের কথায় রাগী চোখে তাকাল চিত্রা। তার চোখ-মুখের ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে, সাকিব নামক পদার্থটাকে খেয়ে হজম না করতে পারলে তার শান্তি হচ্ছে না। কিছুতেই না।
পার্কিং-এ সারি সারি গাড়ির মধ্যে শুভ্রতার কান্নার শব্দ কানে আসছে না রোদেলার। রোদেলার চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। না-জানি কতক্ষণ ধরে কাঁদছে মেয়েটা। এভাবে কাঁদিয়ে রেখে আসাটাই উচিত হয় নি তার। একদিন ক্লাস না করলেই বা কি হতো? রোদেলার চিন্তার মাঝেই কেউ একজন হ্যাচকা টানে গাড়ির আড়ালে নিয়ে দাঁড় করাল তাকে। আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ রোদেলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভারী কিছুর নিচে চাপা পড়ল। স্তব্ধতা কাটিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই চোখের পাতায় শুভ্রর ফর্সাটে স্নিগ্ধ মুখটি ভেসে উঠল। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি৷ রোদেলা কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে জ্বলে উঠে বলল,
' এসব কোন ধরনের অসভ্যতা? টিচার হয়ে ছাত্রীর সাথে জবরদস্তি! সরে দাঁড়ান বলছি।'
শুভ্রর ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হলো। শরীরের বাদবাকি ভারটাও রোদেলার ওপর ছেড়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
' ছাত্রী যদি টিচারের বুকের ভেতর এমন আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায় তাহলে বেচারা টিচারের কি দোষ?'
' ছিঃ কি সব অশ্লীল কথা। ছাড়ুন আমায়। মেয়ে কোথায়?'
শুভ্র ছাড়ল না। বেশ আঁটসাঁট করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। অস্থির রোদেলা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
' ছাড়ুন। একদম প্রেম দেখাবেন না।'
' সেই মান্ধাতার আমলে বিয়ে করেছি। এক বাচ্চার বাপও হয়ে গিয়েছে কিন্তু তোমার রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি। বিয়ের এতো বছর পর এতো জোরজবরদস্তি ভালো লাগে, বলো?'
রোদেলা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
' এখন আমার কিছুই ভালো লাগবে না আপনার। লাগবেই বা কেনো? ভার্সিটিতে এতো এতো সুন্দরী মেয়ে থাকতে ঘরের বউ ভালো লাগবে কেন? পুরাতন হয়ে গিয়েছে না?'
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকাল। হতভম্ব কন্ঠে বলল,
' আরে বাবা কি হয়েছে সেটা তো বলবে। হঠাৎ এতো জ্বলে উঠার কারণ কি? রাতে বকেছি বলে? নাকি অন্যকিছু? কি করেছি?'
' কিছুই না।'
শুভ্র হাসল। রোদেলার কপালে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু গলায় বলল,
' আচ্ছা সরি। এবার রাগ কি করে ভাঙানো যেতে পারে বলুন ম্যাম। আদর করে?'
কথাটা বলেই রোদেলার দিকে গাঢ় চোখে তাকাল শুভ্র। তারপর আচমকাই ঠোঁট ছোঁয়াল ঠোঁটে। রোদেলার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে এলো। নিজেকে শুভ্রর বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে নিয়েই উল্টো পথে হাঁটা দিল। যেতে যেতে বলল,
' আমার ক্লাস আছে। এসব লুচুগিরি বাদ দিয়ে ভালো হয়ে যান মাস্টারমশাই।'
শুভ্র মাথা চুলকে উঁচু গলায় বলল,
' রাতে যেন বাসায় পাই তোমায়। নয়তো বাপের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসব। তখন আমার দোষ দিতে পারবে না। গট ইট?'
লাজুক রোদেলা পেছন ফিরে মুখ ভেঙাল। সাথে সাথেই বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ্র,
' হায়!'
ঘড়ির কাটা দশটার ঘর অতিক্রম করেছে আরও ঘন্টাখানেক আগে। বিছানার মাঝ বরাবর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে শুভ্রতা। চোখ পিটপিট করে মাঝে মাঝেই মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। তারপর আবারও চোখ খিঁচে পড়ে থাকছে। এটাকে বলে অজ্ঞান অজ্ঞান খেলা। এই মাঝরাতে চোখের ঘুম বিকিয়ে তার অজ্ঞান অজ্ঞান খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে। রাগে-দুঃখে কান্না পাচ্ছে রোদেলার। কাল সকালেই তাকে দু'দুটো এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে অথচ মেয়ের চোখে ঘুম নেই। মেয়ের বাপের খবর নেই। রোদেলা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
' মা? তুমি কি চাচ্ছো আমি তোমাকে বকা দিই?'
শুভ্রতা ভং ধরে শুয়ে থেকেই চোখ পিটপিট করে তাকাল। মাকে চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
' বাবা কোতায়?'
রোদেলার ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েকে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগিয়ে বলে তোর বাবাকে কি আমি কোলে নিয়ে বসে আছি? জানব কি করে? বাপের মতো ফাজিলের হাড্ডি হয়েছে। কিন্তু তেমন কিছুই করল না। মেয়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলা পছন্দ নয় শুভ্রর। মেয়ের গায়ে হাত তোলা তো রীতিমতো মহাপাপ। রোদেলা শান্ত গলায় বলল,
' বাবা চলে আসবে মা। তুমি ঘুমাও। কাল সকালে তোমার সাহেল চাচ্চু আসবে। সাদাফ ভাইয়া আসবে। এখন না ঘুমালে তো সকালে উঠতে পারবে না সোনা। প্রিন্সেসদের জলদি জলদি ঘুমিয়ে পড়তে হয়।'
_______________________
রাস্তার ধারের ঝকঝকে ডুপ্লেক্স বাড়িটির দু'তলায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। গায়ের লাল শাড়ির আঁচলটা পতাকার মতো উড়ছে। চুলগুলো এসে আছড়ে পড়ছে মুখে। চোখদুটো স্বচ্ছ আকাশে নিবদ্ধ।
' মিস.ঝগড়ুটে? ঝগড়া করতে করতে কি টায়ার্ড হয়ে গিয়েছ বেবি?'
মেয়েটা পেছন ফিরে তাকাল। দরজার কাছেই অফিসের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান। চোখে-মুখে ক্লান্তি। হাতে থাকা অফিস ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখেই অদিতির কোমর জড়িয়ে ধরল সে। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
' আজ থেকে সামার ভ্যাকেশন শুরু। আপনার পাগলের ডাক্তার এখন একদম ফ্রি। বলুন হানিমুনে কোথায় যেতে চান? সুইজারল্যান্ড, বালি, প্যারিস, মালদ্বীপ, অস্ট্রোলিয়া অর....'
অদিতি হুট করেই বলল,
' সিলেট। '
অায়ান বেখেয়ালিপনায় বলল,
'ওকে ফাইন। সিলেট।'
মুহূর্তেই কপাল কুঁচকে বলল,
' সিলেট? সিলেট মানে? বাংলাদেশ?'
অদিতি মাথা নাড়ল। আয়ান বিস্ময় নিয়ে বলল,
' মানুষ বাংলাদেশ থেকে বাইরের দেশে আসছে হানিমুন করতে আর তুমি হানিমুনে বাংলাদেশ যেতে চাইছ?'
' জি চাইছি। আমার ছোট থেকেই সিলেটে যাওয়ার খুব শখ। যাব যাব করে আর যাওয়া হয় নি। বিয়ের পর তো ডিরেক্ট আমেরিকা চলে এলাম। হানিমুনে যাওয়ার হলে সিলেটেই যাব নয়ত কোত্থাও না।'
আয়ান সন্দিহান গলায় বলল,
' আর ইউ সিরিয়াস?'
অদিতি কপাল কুঁচকে বলল,
' কেন? আপনার কোনো সমস্যা?'
অদিতির চুলে নাক ডুবিয়ে হাসল আয়ান। ডান চোখটা টিপে দিয়ে বলল,
' একদমই না। আমার তো রোমান্স চললেই হলো। পৃথিবীর কোন কোণায় যাচ্ছি সেটা কোনো ম্যাটার না। মধুচন্দ্রিমায় সিলেট গিয়ে সিলেটি মধু খেয়ে আসা যেতেই পারে। নাথিং টু ওয়ারি।'
অদিতি গরম চোখে তাকিয়ে বলল,
' কি বললেন?'
আয়ান ফিচেল হেসে বলল,
' নাথিং জানু। ডোন্ট বি, ডোন্ট বি।'
.
.
.
চলবে.......................................................................