রংধনু - পর্ব ২৭ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


ইদ্রিদের বাসার কলিংবেল বেজে উঠতেই রানু খালা গিয়ে দরজা খুলতেই নিশাদকে দেখে দৌড়ে এলেন ইদ্রির রুমে।নিশাদ ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে।রানু খালা এসে বললেন,
''ছোড আম্মু তোমার পছন্দের মানুষ আইছে।"
ভাগ্যিস নিশাদ নিচে ছিলো।ইদ্রির রুম দোতলায়।তারপর ও ইদ্রি শোয়া থেকে উঠে বসে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল,
''শশশ খালা আস্তে।ওনি শুনলে খবর আছে।"
রাানু খালা নিজের বোকামি বুঝতে পেরে মাথায় হাত দিয়ে বাড়ি মেরে বলল,
''বুঝতেই ফারিনাই।তুমি উইড্ডা বিছানা গুছাই লও।স্যাররে ফাডাইতাছি।"
ইদ্রি খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে বলল,
''তুমি যাও আমি ঠিক করি।"
রানু খালা চলে গেলেন।ইদ্রি খাট গুছিয়ে শর্ট প্যান্টের ওপর একটা ট্রাউজার পরে নেয়।আজ কাল বেশ গরম লাগছে।তাই এভাবেই শুয়ে থাকে ও।সাথে টিশার্ট ও আছে।কিছু সময় পর নিশাদ রুমে প্রবেশ করে।ইদ্রি টেবিলে বসে ল্যাপটপ অন করছিলো।নিশাদ ভিতরে ঢুকতেই ইদ্রি পাশে তাকিয়ে ওকে দেখে হেসে বলল,
''ভালো আছেন?"
নিশাদ ম্লান হেসে মাথা ঝাঁকায়।ইদ্রির পাশের চেয়ারটা ঠিক করে দিলো নিশাদের জন্য।চেয়ারে বসে নিশাদ বলল,
''সব করেছিলে যা যা দিয়ে গেছিলাম?"
ইদ্রি কিছুটা বিরক্ত হয়।লোকটা এসে পড়ার কথা বলছে।ভালো কথা বলতে পারেনা?ইদ্রির রাগ হচ্ছে তবে রাগ দেখাতে পারবেনা।ইদ্রি হেসে বলল,
''জি পড়েছি।আপনার শরীর কেমন এখন?"
''এই আছি ভালোই।"
ইদ্রি যেন সন্তুষ্ট হলো না।তবে কি করার?মেনে নিতেই হবে।ও চুপচাপ কম্পিউটারের কাজ দেখাতে থাকে নিশাদকে।এরই মাঝে ইদ্রির মা সৈয়দা বেগমের প্রবেশ ঘটে।ইমিতিয়াজ বলেছিকো নিশাদ কেমন?মেয়েদের প্রতির ওর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?তবুও তার সন্দেহের শেষ নেই।একটা মাত্র মেয়ে তারওপর আবার নিশাদ অবিবাহিত।নানান চিন্তায় জর্জরিত হয়েই মেয়ের রুমে আসেন সৈয়দা বেগম।নিশাদ ওনাকে দেখে দাঁড়িয়ে বলল,
''আসসালামু আলাইকুম আন্টি ভালো আছেন?"
''হ্যা বাবা।তোমার নাকি শরীর ভালো ছিলো না।এখন জেমন আছো?"
''এই আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।"
''হুম।তা ইদ্রি কেমন শিখতেছে?"
''ভালো ইম্প্রুভ করেছে।"
''ওহ।"
ওনাকে কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে।নিশাদ ওনাকে দেখে মন হলো ওকে কিছু বলতে চান।নিশাদ জিজ্ঞেস করলো,
''কিছু বলবেন?"
''জি বাবা তুমি বিয়ে করছো না কেন?"
''আসলে আমি এখন জবটা নিয়ে ব্যাস্ত আছি।ওসব নিয়ে ভাবাও হচ্ছেনা।তবে আমার পরের বোনটার বিয়ে দিয়ে আমি চিন্তা করবো।"
''ওহ।বুঝোনা দিন দুনিয়া ভালো না।তোমার আঙ্কেল রাগ করে ওকে কোচিং এপাঠানোর জন্য।কোচিং এর স্যার নাকি আনমেরিড।তাই মেয়েরে পাঠাতে ভয় পায়।"
নিশাদের মনে হলো কোন না কোন ভাবে কথাটা ওকে বলা হয়েছে।এদিকে ইদ্রি ও মায়ের ওপর বিরক্ত।ও বারবার ইশারা করছে যেতে কিন্তু ওনি কথা বলছেন।নিশাদের ও কিছু বলতে মন চাইলে ও চুপ করে রইলো ও।সৈয়দা বেগম বললেন,
''তা বোনরে বিয়ে দিবা কবে?"
''মাস্টার্স টা শেষ হলেই দিবো।"
''আচ্ছা।তা কিছু লাগলে বইলো ঠিক আছে?"
''জি আন্টি।"
হালকা হাসপ নিশাদ।ওনি বেরিয়ে যান।ইদ্রি কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে নিশাদের দিকে তাকায়।নিশাদ কিছু বলছেনা।ইদ্রির মনযোগ ওর দিকে দেখে নিশাদ রেগে বলল, 
''আনার মুখে না তাকিয়ে ল্যপটপের দিকে মন দাও।"
ইদ্রি নরম গলায় বলল,
''কিছু মনে করবেননা আম্মুর কথায়।আম্মু এমনই।"
গভীর নিশ্বাস টেনে ইদ্রির দিকে তাকায় নিশাদ।তারপর বলল,
''দেখো আমি কিছু মনে করিনি।কারন ওনারা বাবা মা।চিন্তা করবেন অবশ্যই।আমি তোমার টিচার এবং তোমার ভাইয়ের বন্ধু।তো তোমাকে নিয়ে আমার সেরকম ভাবনা থাকলে আমি অবশ্যই কিছু মনে করতাম।"
''কিছুই ভাবেননা আমাকে?"
''না কি ভাববো?তুমি আমার ছোট বোনের মতো।"
ইদ্রির বেশ খারাপ লাগে।আর কোন কথা বলে নি ও।চুপচাপ ল্যাপটপ দেখেছে ও।নিশাদ আজ নতুন অনেক কিছু শিখিয়ে ছিলো।ইদ্রির পড়াশেষে নিশাদ বেরিয়ে যাচ্ছিলো।ইদ্রি কিছু বলেনি।চুপচাপ নিশাদের যাওয়ার দিকে চেয়েছিলো।নিশাদ চলে যেতেই রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।নিশাদ বেরিয়ে এসে বাসের জন্য হাঁটতে শুরু করে।ওর শরীর কেমন যেন করছে।ইদানীং মনটা কেমন যেন করে তবে নিশাদ বলতে পারেনা।ইদ্রির মন খারাপ হয় সেটা ও বুঝে।তবে ওর ও কি ভালো লাগে?ও কি ইদ্রিকে দেখতে চায়না।আজ শরীরটা পুরোপুরি ভালো না হলে ও কোথা ও যাওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলোনা।মোহাম্মদ পুর থেকে আসার পর খুব দূর্বল লাগছিলো।তারপর ও এসেছিল পড়াতে।হয়ত ইদ্রিকে একপলক দেখার আশায়।ছিঃ নিশাদ এসব মাথায় আনা ঠিক না।ইদ্রি ছোট বোনের মতো।কেন ওকে নিয়ে ভাববো?এটা অন্যায় চিন্তা।নিশাদ পসশের একটা টং থেকে সিগারেট কিনে আগুন ধরিয়ে ফুঁক দেয়।ইদ্রিকে নিয়ে চিন্তা করলে ও এতোটা ভাবেনি আজ আন্টির কথায় নিশাদ ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।ও আসলে ও ভাবে খুব করে ভাবে।যেদিন  ওরা একসাথে ঘুরতে গিয়েছিলো সেদিন থেকে ভাবে।তবে ও চায়না ভাবতে।কারন ওর বড় দায়িত্ব  ওর পুরো পরিবার।
.................সাঁঝকে নামিয়ে দিয়ে নিজে ও নেমে আসে সাইমন।সাঁঝ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেসে বলল,
''আসি।"
সাঁঝ গেটের দিকে এগুতেই সাইমন ওর হাত ধরে বাঁধা দেয়।সাঁঝ পিছনে তাকিয়ে ওদের হাতের দিকে তাকিয়ে আশেপাশে তাকায়।সাঁঝ ঢোক গিলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু সাইমন ছাড়েনা।সাঁঝ বলল,
''কি হলো ছাড়েন হাত।"
''এভাবে কথা বলছো যেন পর কেউ?"
''আমাদের বাসার সামনে এটা।ভাইয়ারা যেকোন মুহূর্তে আসবে প্লিজ।"
সাইমন ওর হাত ছেড়ে একটু এগিয়ে এলে সাঁঝের দিকে।ও আড় চোখে তাকায় সাইমনের চোখে।সাইমন  বলল, 
''কাল ছয়টায় গ্রীন লাউঞ্জে প্রেম করবো আমরা।"
''কি বলেন এসব?"
সাঁঝ লজ্জা পেয়ে সরে আসে।সাইমন আবার ও এগিয়ে এসে বলল,
''কাল রিদ্ধিকে পড়াবে তাইনা?"
''জি।"
''আমার অপেক্ষা করো।ঠিক সময়ে বাসায় পৌছে যাবে।"
সাঁঝ মাথা নিচু করে।সাইমন ওর কপালের চুল ঠিক করে বলল,
''উড়না ঠিক মতো পরবে সবসময়।"
সাঁঝ উপরে তাকায় অবাক হয়ে। লোকটা ওকে এভাবে দেখে। ভাবতেই শরীর জুড়ে লজ্ৃা আর রাগে ফেঁটে পড়ছে।ও রেগে সাইমনের বুকে আঘাত করে বলল,
''লুচ্চা কোথাকার।"
বলেই গেট দিয়ে ঢুকে চলে গেলো।সাইমন হঠাৎ তব্ধ হয়ে গেলে ও সাঁঝ রেগে গেছে বুঝেই হাসতে শুরু করে।
সাঁঝ ঘরে ঢুকেই রেগে রুমে এসে দরজা লক করে আলমারির আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়।আজকের সারাদিনের ব্যাপার গুলো ওর মনে পড়ছে।বিশেষ করে সাইমনের সেই কথা গুলো।ওকে জড়িয়ে ধরে যা বলছিলো।পুরো টা ওর ভেতর টাকে নাড়া দেয়।সাঁঝ অজান্তেই হেসে ফেললে ও সাইমনের উড়নার কথাটা মনে আসতেই আবার ও রেগে যায় ও।
..................ঘরে ফিরে আসে বিভান।রুমে এসে দেখলো বেলা কাপড় ভাজ করে রাখছে খাটের ওপর।বিভান পিছন থেকে কোমড় জড়িয়ে বলল,
''সরি বেলা।প্লিজ রেগে থেকোনা।আমি এমনটা করতে চাইনি তুমি ও জানো তারপর ও কথা বলছোনা।"
বেলা বিভানকে সরিয়ে দিয়ে কাপড় আলমারিতে রাখার জন্য এগিয়ে যায়।বিভান ওর পাশে এসে বলল,
''বেলা প্লিজ।তুমি রেগে থাকলে আমার দিনটা ভালো যায়না। কেন বুঝেনা।প্লিজ কথা বলো।"
বেলা কাপড় রেখে ওর দিকে না তাকিয়ে বলল,
''কি বলবো?কিছু বলার নেই।ফ্রেশ হয়ে নিন খাবার দিচ্ছি।"
বিভান ওকে আলমারিতে চেঁপে ধরে রেগে বলল,
''বেলা মাফ করো আমাকে করতে হবে।আমি ইচ্ছে করে করিনি বললাম তো।"
বেলা কিছু না বলে বিভানকে সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে যায়।বিভান বেলার  যাওয়ার পানে তাকিয়ে সজোরে পাশের কাঁচের বাঘের শোপিজ টাকে আছড়ে ভেঙ্গে দেয়।এদিকে বেলা নিচে যাচ্ছিলো।কাঁচভাঙ্গার শব্দে কেঁপে উঠে ওপরে তাকায়।তারপর চটজলদি নিচে এসে কাজের লোককে পাঠায় রুমের কাঁচ পরিষ্কার করার জন্য।কিন্তু কাজের লোকটা কিছু বলার আগে বন্দনা আখতার তাকে ডেকে রুমে নিয়ে যায়।বেলা চা আর পাকোড়া নিয়ে রুমে চলে আসে।বিভান খাটে বসে মাথা নিচু করে আছে।বেলা কে দেখে মাথা উঠিয়ে আবার নিচে তাকায়।বেলা খাবার গুলো খাটে রেখে কাঁচ পরিষ্কার করতে থাকে।বেলা কে পরিষ্কার করতে দেখে বিভান সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রুম থেকে একটু বেরিয়ে চিৎকার করে কাজের লোকদের ডাকতে থাকে।কিন্তু কারোর পাত্তা নেই।বিভান রুমে ফিরে এলো।বলতে থাকলো,
''জানোয়ার গুলো সব হাওয়া হয়ে গেছে।আসুক খবর আছে।"
বেলা কিছু না বলে কাঁচ গুলো নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বেলা পাকঘরে এসে কাঁচ ফেলে হাত ধুয়ে নেয়।সেদিন রাতে  বিভান বেলার থেকে একটু দূরত্বেই শুয়ে ছিলো।না চাইতে ও বেলার অনেক কষ্ট লাগতে থাকে।বারবার ইচ্ছে হচ্ছিলো লোকটা কে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু ও পারেনা।বাধ্য হয়ে বেলা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যায়।
.....................সেদিন রাতে সাঁঝ শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলো।সাইমনের বারবার কল আসছে।পাশে হুমায়রা আর লাবনী ঘুমে বিভোর।সাঁঝ ফোন দেখে আবার উল্টোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।কিন্তু ফোনের ভাইব্রেশন কানে আসছে।সাঁঝ ফোনটাকে মিউট করে শুয়ে থাকে।হঠাৎ একটা মেসেজ চোখে পড়ে ওর।সেটা ছিলো,
''আমি কিন্তু আশেোশেই আছি।কল রিসিভ না করলে ঘরে চলে আসবো।তোমাদের বাসার সামনে সুপারশপটা আছেনা ডেইলি?সেটার সামনে আমি।বুঝেছো কতো কাছে।সো........"

!!!!

হুমায়রার একেবারেই ঘুম পাচ্ছেনা।বুকের ভেতর কেমন এক অস্থিরতা কাজ করছে ওর।পুরো শরীর জুড়ে কেমন এক স্নিগ্ধ প্রশান্তি।বালিশের নিচ থেকে বাটন ফোনটা হাতে নিয়ে হৃদয় নামক ছেলেটার ছবি একবার দেখে নেয় ও।চোখ যেন সরতেই চায়না ছবিটার ওপর থেকে। ছবিটা দেখে পাশে রেখে দিলো ও।পাশ থেকে লাবনীর ঘুমের কারনে শরীর ওঠানামা করছে তা ওর শরীরে বাড়ি লাগছে।লাবনীর বাম পা ওর পায়ের ওপর।মেয়েটার ঘুমানোর যে ছিরি।দেখলে পিত্তি জ্বলে হুমায়রার।ঘুমের মাঝে আশেপাশের মানুষের কথা হয়ত খেয়াল থাকেনা ওর।যেখানে সেখানে হাত পা উঠিয়ে দেয়।এরই মাঝে হুমায়রার ফোন কেঁপে উঠে।বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে দেখলো হৃদয়ের কল আসছে।হুমায়রা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে লাবনীর পানে চায়।তারপর ফোন রিসিভ করে।অপরপাশ থেকে হৃদয় বলছিলো,
''ঘুমাওনি?"
''এতোরাতে কল দিলে ঘুমাবো কেমনে?"
ফিসফিসিয়ে বলল হুমায়রা।ছেলেটা হেসে উঠলো।পরক্ষনে বলল,
''কালকের জন্য অপেক্ষা করতে পারছিনা।"
''তাহলে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকুন এক্ষুনি।কাল বিকেলে তো এমনিই দেখা হচ্ছে।"
''মজা নিও না।তুমি কি ভুলে গেছো আমরা কই দেখা করছি কাল?"
হুমায়রা মনে করতে চেষ্টা করে।তারপর বলল,
''এই আরকি এই যে আমার কলেজ থেকে একটু দূরে গেলেই............."
রেগে যায় হৃদয়।রাগী গলায় বলতে লাগলো,
''ভুলে গেলে চলবে হুমু?আমাদের প্রথম ডেট আর তুমি ভুলে যাচ্ছো?আমি তোমাকে টেক্সট করে দিচ্ছি।আমার ফোন চার্জে বসাতে হবে।আর বলছিলাম জলদি চলে এসো এ্যাড্রেস অনুযায়ী।"
হুমায়রা কিছু বলতে পারেনা।হৃদয কল কেঁটে দেয়। কিছুসময় পরই মেসেজ আসে ওর নম্বরে।ঢাকার স্টার কাবাব হোটেলে ওকে যেতে বলল কাল বিকেল চারটায়।হুমায়রার সাথে ওর প্রায় পনের দিন যাবৎ কথা হচ্ছিলো।ছেলেটা খুব বেশি কেয়ারিং।ওকে অনেক বুঝে অনেক খেয়াল রাখে।হুমায়রার ও বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে তাকে।অবশ্য সেটা কি ভাল লাগা নাকি ভালবাসা জানে না হুমায়রা। তবে হৃদয়ের সাথে কথা বলার মুহূর্তটা অন্যান্য সময় থেকে একেবারেই আলাদা।পাশে সাঁঝ নেই।অনেক আগেই কই যেন গেলো।তবে হুমায়রার খাট থেকে নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না।কাল কোন পরীক্ষা নেই। পরীক্ষা আছে আবার দুদিন পর।কাল থেকে পড়া শুরু করবে মন দিয়ে হৃদয়ের সাথে দেখা করার পর।
সাঁঝ ব্যালকনিতে বসে বাহিরে বৃষ্টি দেখছে।অপরপাশ থেকে সাইমন বলল,
''চুপ যে?"
''শুনছি তো।বলুন আপনি?"
''বৃষ্টি কেমন লাগে?"
''বেশ লাগে।ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে।"
''থাক ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলবে।সাঁঝ!!"
''জি।"
বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ মনযোগ সাঁঝের। সাইমন বলল,
''গান শুনবে?"
''পারেন?"
''খুব ভালো পারি।শুনবে কিনা সেটা বলো।"
''শুনালেই শুনবো।"
''ওকে তাহলে শুরু করছি।"
''জি।"
সাইমন গলা পরিষ্কার করতেই সাঁঝ বলল,
''মনে হয় খুব জোরে সোরে শুরু করবেন?"
''তা তোমাকে কি যেমন তেমন করে শুনাতে পারি বলো।"
''হুম।ভালোই ফ্লার্ট করতে পারেন।গাইতে শুরু করেন।"
''ফ্লার্ট কেন করবো?তোমাকে আমি চাই।আর যাকে চাইবো তার সাথে ফ্লার্ট করার মানে হয়না।তার জন্য মনের গহীন থেকে আসা কথা গুলো এনাফ।"
সাঁঝের ভেতর ঝড় শুরু হয়ে গেলো।লোকটার মুখে ওকে চাই কথাটা শুনে সাঁঝের প্রচুর লজ্জা লাগতে শুরু করে।কান থেকে ফোনটা সরিয়ে বুকে হাত রেখে চোখ বুজে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ে তারপর আবার কানে ফোন রেখে কিছু বলতে যাবে কিন্তু তখনই  সাইমন বলল,
''তোমার লজ্জিত মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।সামনে থাকলে শেষ হয়ে যেতে।"
সাঁঝ আরো এক দফা প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে বলল,
''রাখেন আপনার অসভ্য কথা বার্তা।গান শুনালে শুনান নাহলে আমি গেলাম।"
সাইমন চটজলদি বলল,
''যেওনা গাচ্ছি আমি।"
গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে সাইমন,
তুমি বরুনা হলে আমি সুনীল
তুমি আকাশ হলে হব শঙ্খ চিল
তুমি নদী হলে হব আমি জল
তুমি শ্রাবণ হলে হব শ্রাবণ ঢল

তুমি পাহাড় হলে হব আমি সবুজ
তুমি শাষণ করলে হব আমি অবুঝ
তুমি অরণ্য হও হব পাখি
তুমি অশ্রু হও হয়ে যাব আঁখি

তুমি বরুনা হলে আমি সুনীল
তুমি আকাশ হলে হব শঙ্খ চিল
তুমি নদী হলে হব আমি জল
তুমি শ্রাবণ হলে হব শ্রাবণ ঢল
তুমি জীবন হলে হয়ে যাব আমি প্রেম
তুমি নকশী কাঁথা হলে হব কারু হেম........
.................বেলা পাশ ফিরে তাকায়। লোকটা একটা বার ও ওর দিকে তাকায়নি।বাহিরে খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে।ভীষন কষ্ট হচ্ছে ওর।লোকটা র সাথে কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলছে।তার সমস্ত ভালো দিক গুলো কে কি একটা খারাপ দিক দিয়ে বিবেচনা করছে ও?বেলা কথা বলতে চায় কিন্তু কিভাবে?হঠাৎ কিভাবে কথা শুরু করবে ও?তেরবছরের সংসারে ওদের মাঝে কখনোই এমন দিন কাঁটেনি।এই প্রথম ওরা দুটো দিন কাঁটাচ্ছে কথা না বলে।বেলা পাশ ফিরে শোয়।চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুগুলো হাতের কোনা দিয়ে মুছে নেয়।কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো জানেনা বেলা।হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গে ওর।বাহিরে এখনো বৃটি হচ্ছে।বেলা ঘড়ি দেখলো তিনটা বাজে রাত।পাশ ফিরতেই চমকে উঠে বেলা।লোকটা নেই পাশে।বাথরুমের আলো নেভানো।কই যেতে পারে সে?বেলা খাট থেকে নেমে ব্যালকনিতে আসে।সে নেই।কি করবে ও?কই গেলো সে?বেলা নিচে আসে কোথাও নেই বিভান।সবগুলো রুম ঘুরে দেখলো সে নেই।বেলা এবার ছাদের দিকে পা বাড়ালো।ছাদে থাকার কথা না কারন বৃষ্টি হচ্ছে তারপর ও একবার দেখে আসা যায়।ভেবেই বেলা ছাদে চলে আসে।দুরে আকাশের পানে ফিরে দাঁড়ানো বিভানকে দেখতে পায় বেলা।সে একা কি করছে এখানে।এই বৃষ্টিতে ছাদে এসেছে!!আজব।বেলা একপা দুপা এগুতে থাকে।একপর্যায়ে বিভানের পাশে এসে দাঁড়ায়।সোজা হযে দাঁড়িয়ে আছে সে।বেলা কি করবে বুঝতে পারছেনা।বিভানের কাঁধে আলতো করে হাত রাখে ও।আস্তে করে বলল,
''বিভান কি করছেন এখানে?"
বেলার কথায় আৎকে উঠে বিভান।মুখমুছে পাশে তাকায় ও।বেলা ওরদিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে।বিভান শান্ত স্বরে বলল,
''এখানে কেন এসেছো?"
''আপনি কেন এসেছেন?"
বেলার কথার জবাব না দিয়ে বিভান বলল,
''জানো জন্মের পর বাবাকে আবছা দেখেছিলাম।ঠিকমতো মনে ও পড়েনা।আমার যখন চারবছর বয়স বাবা মাকে ছেড়ে চলে যায়।কই যায় বলতে পারিনি।মাঝে মাঝে শুনতাম খুব ঝগড়া হতো।আমার ভয় লাগতো।দরজা আটকে বসে থাকতাম চুপচাপ।একে অপরকে বাজে ভাষায় গালি গালাজ করতো।যখন ধীরে ধীরে বড় হই বুঝতে পারি তাদের মাঝে বিশ্বাস, মিউচুয়াল আন্ডার্স্ট্যান্ডিং এর বড় অভাব ছিলো।এমন অনেক বিয়ে আছে যেন অনেক বছর একসাথে কাঁটিয়ে দেয়ার পর ও একে অপরকে ঠিকমতো বুঝতে পারেনা।প্রেয়সীর মনের খবর রাখতে পারেনা।"
এবার বিভান বেলার দিকে ফিরে তাকায়।বিভানের চোখের পানি বৃষ্টির পানিতে মিশে যাচ্ছে।বেলার দুকাঁধ শক্ত করে ধরে বলল,
''বেলা কেন মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে বুঝতে পারিনা?কেন মনে হয় তোমার মনের সব খবর রাখতে পারিনা?বেলা তোমাকে তো খুব ভালবাসি।তাহলে কেন পারিনা বলো?স্বামী হিসেবে কি এটাই আমার ব্যার্থতা?আমি কেন আমার স্ত্রীর মনের খবর রাখতে পারিনা?বেলা তুমি বলো তোমার ভিতর কি কি কষ্ট আছে বলো।সব ঠিক করে দিবো প্রমিজ।"
বেলার চোখজোড়া ভারি হয়ে আসে।ভাঙ্গা গলায় বলল,
''কখন বলেছিলাম কষ্ট হয় আমার?আপনার কারনে আমার এই অস্তিত্ব বিভান।আপনার কারনেই বেঁচে আছি।কষ্ট পাবেননা আপনি।আমি ভাল আছি সত্যি।"
''প্রমিজ করলাম বেস্ট হাসবেন্ড হয়ে দেখাবো।"
বেলা বিভানকে জড়িয়ে ধরে।বিভান বেলার পিঠে দুহাত আড়াআড়ি ভাবে রাখে।অনেকটা সময় কেঁটে যায়।বিভান সরে এসে বেলার কপালে দুচোখের পাতায় গালে এরপর ওর ওষ্ঠযুগল শুষো নিতে থাকে।দীর্ঘচুম্বনের পর কিছুটা সরে আসে ওরা।বেলার চোখজোড়া বন্ধ।বিভান ফিসফিস করে বলল,
''ভালবাসি বেলা রানী আমার।"
বেলার কি যেন হয়ে গেলো বিভানের অধর যুগল শুষে নিতে থাকে।বেলাকে কোলে তুলে রুমে চলে আসে ওরা।ভেজা শরীরে বেলাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর পাশে বসে বিভান।ভেজা শাড়ী বেলার গায়ে লেগে আছে যার কারনে শরীরের প্রত্যেকটা ভাজ দেখা যাচ্ছে।বিভান আলতো হাতে বেলার পেট উন্মুক্ত করে সেখানে মুখ ডুবিয়ে দেয়।বেলার নিশ্বাস ভারি হয়ে আসতে থাকে।বিভান এবার উপরে এসে বেলার গলায় মুখ ডুবিয়ে শাড়ীর আঁচল পাশে ফেলে দেয়।দুজনেই উন্মুক্ত একে অপরের মাঝে জড়িয়ে গেছে পুরোপুরি ভাবে।
..............নিশাদ সেই রাত একবারের জন্য ও চোখ লাগাতে পারেনি।সৈয়দা বেগমের কথা গুলো মনে পড়তেই খারাপ লাগতে থাকে ওর।খারাপ লাগার একমাত্র কারন ইদ্রির প্রতি ওর অকস্মাৎ অনুভূতির জন্ম।নিশাদ বুঝতে পারেনা এই অনুভূতির কারন।কেন ইদ্রিকে নিয়ে ভাবছে ও?এমনটা তো হওয়ার ছিলোনা।ওপাশ ফিরে ফোনটা হাতে নেয় ও।ইদ্রির অনেক গুকো কল এসে আছে।তবে নিশাদ রিসিভ করতে পারেনি।মেয়েটার নৈকট্য ওকে দূর্বল করে দেবে।কিন্তু ও দূর্বল হবেনা।ওর যে অনেক দায়িত্ব বাকি রয়ে গেছে।সেখানে প্রেম ভালবাসা কোন কিছুরই জায়গা নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন