মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ১১)


মেহেরুন স্পৃহাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
'ভালো থাকিস মা। নিজের খেয়াল রাখিস।'
'হুম। '
বেরুতে বেরুতে তানিয়া বললেন, 
'আসি আপা। সময় পেলে মাঝে মধ্যে আমাদের খোঁজ নিতে যাস।'
'যেতে তো হবেই। স্পৃহা তো ওখানেই থাকবে। কেন এমন করছিস তানিয়া। রেখে যা না মেয়েটাকে।'
'না আপা। যা করছি তা জরুরি। স্পৃহার আর এখানে থাকতে হবে না। আসি এখন। ভালো থাকিস তোরা।'
তানিয়া বেরিয়ে গেল। মারিয়া তোহার হাত ধরে রেখেছিল। সে বলল,
'তোহা তুই স্পৃহার খেয়াল রাখিস। ও তো তোর মত স্ট্রং না। আর নিজেও সাবধানে থাকিস।'
'আচ্ছা আপু।'
তোহা খালামণির থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জয় স্পৃহার মাথায় হাত রেখে বলল,
'যা হয়েছে তা ভুলে যাস। ওসব কথা মনে রাখতে হবে না। এর পর থেকে সাবধানে থাকিস। আর খালামণি, আপু,ভাইকে ভুলে যাস না। খালামণি তো তোকে আর এখানে আসতে দিবে না।'
স্পৃহা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
'তুমি আমাকে দেখতে যাবে না ভাইয়া? '
'যাবো না কেন? তোকে না দেখে আমরা থাকতে পারবো?'
ওরা সিএনজিতে উঠে গেল। এখান থেকে গিয়ে বাস ধরবে। এখানের মানুষ স্পৃহার নামে বদনাম তুলার আগেই তানিয়া তার মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তারা সবাই জানে স্পৃহার সাথে কি ঘটেছে। কিন্তু বাইরের মানুষ গুলোকে কীভাবে বিশ্বাস করাবে। সমাজের মানুষ গুলো একটা মেয়ের নামে বদনাম তোলার আগে একবারও ভাববে না,তারা যা বলছে তা কতটুকু সত্য। সত্য মিথ্যার যাচাই না করেই তারা মেয়েটার জীবন বিষিয়ে তুলবে। মেহেরুনও চায় না স্পৃহার সাথে এমন কিছু হোক। তাই সে জোর করে স্পৃহাকে এখানে রাখেনি। 

জীবন সেদিন নূপুরের বাসা থেকে বের হয়ে কার ড্রাইভ করে যাচ্ছিল। কিছু দূর এসে তার গাড়ি একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়। সেই অ্যাক্সিডেন্টে জীবন মাথায় বেশ ব্যথা পায়। হঠাৎ করে সামনে ঝুঁকে পড়ায় স্টিয়ারিং এর সাথে লেগে কপাল কেটে যায়। সেন্সলেস হয়ে গেলে সেখানের মানুষজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে জীবন বেশিক্ষণ থাকেনি। কপাল ব্যান্ডেজ করে নিজে ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। 
জীবন রুম অন্ধকার করে বসে আছে। একটার পর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ায় পুরো ঘর গুমগুম করছে। জীবন বিরবির করে বলছে, 
'তুমি কেন এমনটা করলে? কেন নূপুর? তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো না? তাহলে এতদিনে কেন আমার সাথে মিথ্যে নাটক করেছো? কেন?'
জীবনের চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। ধোঁয়ায় জীবন কাশতে লাগলো। উঠে দাঁড়িয়ে এক ঘুষি মেরে ড্রেসিংটেবিলের আয়নাটা ভেঙে ফেলল। কাঁচের টুকরো পুরো ফ্লোরে ছড়িয়ে গেছে। জীবনের হাত কেটে ফ্লোরের মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পরছে। সে চিৎকার করে বলল,
'আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যে বলেছ।'
জীবন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল। চোখ বন্ধ করে দুমিনিট চুপ করে থেকে শান্ত কন্ঠে বলল,
'আমাকে তোমার থেকে সত্যিটা জানতেই হবে। তোমার ভাইদের ভয় পেয়ে এসব করছো তুমি তাই না? ওকে, নো পবলেম। আমি তোমার ভাইদের কাছ থেকে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আর সেটা যেভাবেই হোক। 

জীবনের অনেক অনুরোধে নূপুর তার সাথে দেখা করতে এসেছে। নূপুর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন তার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
'সত্য কি তা আমার কাছে বলো নূপুর। কাকে ভয় পেয়ে তুমি এসব করছো? তোমার ভাইয়েরা তোমাকে কিছু বলেছে? '
'কেউ আমাকে কিছু বলে নি। আর আমি কাউকে ভয় পেয়ে এসব করছি না। যা করছি তা আমি নিজে থেকে করছি।'
নূপুরের একথা শুনেও জীবন শান্ত রইলো। নরম গলায় বলল,
'তুমি নিজে থেকে এসব করছো?'
'হুম। '
'তাহলে তুমি বলছো তুমি আমাকে ভালোবাসো না?'
'না।'
'এতদিন আমাদের মাঝে যা ছিল তা কিছুই না? কোনো নাম নেই এই সম্পর্কের?'
'না।'
'বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার সাথে দেখা করা,ঘুরতে যাওয়া, আমাকে এতো এতো কথা দেওয়া তা কি ছিল?'
'কিছুই না। '
'তুমি সত্যিই চাও আমি তোমার থেকে দূরে সরে যাই?'
'চাই। '
'নূপুর ভেবে বলো। আমি জানি না তুমি কেন এমন করছো। এসবের পিছনে কি কারণ আছে। কেউ নিশ্চয়ই তোমাকে কিছু বলেছে। আমি তোমার থেকে সত্য জানতে এসেছি। তুমি আমার থেকে কিছু লুকাবে না প্লিজ। আমি জানি তুমি কেন তোমার ভাইদের এতো ভয় পাও। তোমার বড় আপু নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে। তোমার ভাইয়েরা কেউ রাজি ছিল না। বছর ঘুরতেই উনার স্বামী উনাকে মারধর করতে শুরু করে। তোমার ভাই বোনের স্বামীর মাথা ফাটিয়ে দুই মাস জেল খেটে আসে। তারপর থেকে বড় আপুর সাথে আর তোমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার বড় বোন সবাইকে যেভাবে কষ্ট দিয়েছে। তুমি চাও না তাদেরকে তুমিও সেরকম কষ্ট দাও। আর তাই তুমি এমন করছো।'
নূপুর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন আবার বলল,
'তুমি কি সত্যিই অন্য কাউকে বিয়ে করবে? আমাকে তুমি চাও না? তোমার এক কথার উত্তরের উপর আমাদের দু'জনের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। তুমি যদি বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো,তাহলে আজ এক্ষুনি আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবো। সারাজীবনের জন্য দু'জন এক হয়ে যাব। আর তুমি যদি বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো না,তাহলে আজ এটাই হবে আমাদের শেষ দেখা। এর পর থেকে তুমি আর কখনো আমাকে দেখবে না। সারাজীবনের জন্য আমরা আলাদা হয়ে যাব। ভেবে বলো নূপুর তুমি কি চাও।'
নূপুর চোখ বন্ধ করে বলল,
'আমি তোমাকে চাই না। তুমি আমার জীবন থেকে চলে যাও। আর কখনো আসবে না আমার সামনে। চাই না আমি তোমাকে।'
নূপুর কাঁদছে। জীবন নূপুরের কথা শুনে নীরব হয়ে কিছুক্ষণ শুধু নূপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। 
'ঠিক আছে। তুমি যা চাইবে তাই হবে। তুমি আমাকে চাও না এটাই ফাইনাল। আমিও আর তোমার সামনে আসবো না। তবে মনে রেখো আজ আমি তোমাকে নিতে এসেছিলাম। সবকিছু বলার সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকের পর তুমি এই সুযোগ আর কখনো পাবে না। কখনো যদি আমার কাছে ফিরে আসতে চাও, সত্য কি তা বলতে চাও সেদিন আমি তোমার কথা শুনবো না। আমার কাছে ফিরে আসার সুযোগ আর দিব না। ভালো থেকো। দোয়া করি নতুন জীবনে সুখী হও। গুড বাই।'
জীবন নূপুরের সামনে থেকে চলে আসলো। গাড়ি নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। নূপুর দুই হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে,
'আজ আমি তোমাকে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি জীবন। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি কি করবো? এটা ছাড়া আমার কাছেও কোনো পথ খোলা ছিল না। তোমার জন্যই আমাকে তোমায় ছাড়তে হয়েছে। আমি নিজের জন্য তোমার ক্ষতি হতে দিতে পারবো না। আমাদের নিয়তিই আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। এক হওয়া আমাদের ভাগ্যে লিখা নেই।'
নূপুর জানে জীবন একবার যা বলে তাই করে। আজ জীবন বলেছে তাকে ছেড়ে যাবে। তার মানে জীবন সত্যিই এটা করবে। এতে তার নিজের যতই কষ্ট হোক।

দুই দিন পর,
'কি? স্পৃহার বিয়ে! মানে কি এসবের? খালামণি কি পাগল হয়ে গেছে?'
জয় ফোন কানে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল কথাটা। ওপাশ থেকে তোহা বলল,
'হ্যাঁ ভাইয়া। মা মনে হয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। তা নাহলে আপুর বিয়ে দিতে যাবে কেন?'
'কিসের বিয়ে? কি বলছিস তুই এসব? দুই দিনই তো হলো তোরা বাড়িতে গেছিস। এর মধ্যে খালামণি পাত্র পেলো কোথায়?'
'পাত্রের অভাব আছে নাকি? ঐ কুত্তাটা তো আগে থেকেই আপুকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এখন একটা ছুতা পেয়েছে শুধু।'
'ঐ নাফিজ আবার শুরু করেছে? আর একটা কথা,ও কি এই ঘটনা জানে?'
'জানে হয়তো। না জানলে আমরা ফিরে আসার পরপরই ও বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো কেন? এতদিন তো মা না করে দিতো। এখন মা'ও কেমন রাজি হয়ে যাচ্ছে।'
'আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, খালামণি এমন পাগলামি কেন করছে।'
'তোমার খালামণি পাগল হয়ে গেছে তাই পাগলামি করছে। এখন তুমি আমার পাগল মায়ের হাত থেকে আমার আপুকে বাঁচাও।'
'স্পৃহা কোথায়? ও কি বলে? স্পৃহা বিয়ে করতে রাজি?'
'আপুকে তুমি চেনো না? ও কি বলবে? ও কিছু বললে ভালো মেয়ে, গুড গার্লের(ব্যঙ্গ করে)উপাধিটা নষ্ট হয়ে যাবে না। বাবা মা যা বলবে ও তাই করবে। যাকে বিয়ে করতে বলবে, পছন্দ না হলেও তাকেই বিয়ে করবে। আমি মা আর আপুর এসব ন্যামাকি জাস্ট সহ্য করতে পারছি না। এখন শুধু তুমিই পারবে কিছু একটা করতে। পারলে তুমি আজই আমাদের বাসায় চলে এসো। আর হ্যা, হাতের কাছে কোনো ভালো ছেলে থাকলে ধরে নিয়ে এসো। মায়ের যখন এতো সখ তাহলে সত্যি সত্যিই আপুর বিয়ে দিয়ে ফেলি। তবে এই ছেলে না অন্য ছেলের সাথে।'
এই টেনশানের সময়ও তোহার কথা শুনে জয়ের হাসি পাচ্ছে। এই মেয়েটা সিরিয়াস মূহুর্তেও এমন এমন সব কথা বলে। না হেসে পারা যায় না। জয় বলল,
'তুই চিন্তা করিস না। আর এখন কাউকে কিছু বলিস না। যা হচ্ছে তা হতে দে। আর ওখানে যা যা হবে তা আমাকে ফোনে জানাতে থাকবি।'
'আচ্ছা এখন রাখি। তুমি কিন্তু কিছু একটা অবশ্যই অবশ্যই করবে। আমি চাই না ঐ বাদাইমার সাথে আপুর বিয়ে হোক। কুত্তাটা যে কেন এভাবে আপুর পিছনে পড়ে আছে।'
ফোন রেখে জয় চিন্তায় পড়ে গেল। খালামণি কি সত্যি সত্যি স্পৃহার বিয়ে দেবার কথা ভাবছে। কিন্তু হঠাৎ করে বিয়ে কেন? এসব যা হয়েছে তার জন্য কি বিয়ের কথা ভাবছে? বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে নাকি? 
জয় চট্টগ্রাম যাচ্ছে শুনে মারিয়া ওকে চেপে ধরলো।
'তুই হঠাৎ চট্টগ্রাম যাচ্ছিস কেন?'
'কাজ আছে।'
'চট্টগ্রাম কিসের কাজ তোর? এই তুই খালামণির বাসায় যাচ্ছিস তাই না? সত্য করে বল। খালামণির বাসায় যাচ্ছিস তো?'
'হ্যা। '
'কেন? '
জয় মারিয়ার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বলেই দিলো।
'আরে খালামণি নাকি স্পৃহার বিয়ে দেবার কথা ভাবছে। ঐ নাফিজ নাকি আবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। আর খালামণি এবার ওকে না করেনি।'
'কি বলছিস তুই!'
'তোহা তো তাই বলল।'
'খালামণির কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? এখনই স্পৃহার বিয়ে? তাও ঐ ছেলেটার সাথে? অসম্ভব হতেই পারে না। তুই আজই খালামণির বাসায় যা আর স্পৃহাকে নিয়ে আয়।'
'স্পৃহাকে আসতে দিলে তো। তোহা তো বললো খালামণি নাকি এবার খুব সিরিয়াস।'
'স্পৃহা কিছু বলে না?'
'কি বলবে? তুই স্পৃহাকে চিনিস না? ওকে খালামণি যা করতে বলবে ও তাই করবে। স্পৃহা তো আমাদের কথাই ফেলে না। ও খালামণির কথা কীভাবে ফেলবে।'
'কিন্তু স্পৃহা তো জীবনকে ভা,,,,
বলতে বলতেই মারিয়া থেমে গেল। জয় জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল,
'জীবনকে? কি জীবনকে? বল আপু। কি বলছিলি তুই।'
'কিছু না।'

শেষবার জীবন নূপুরের সাথে দেখা করে আসার পর থেকে সে খুব স্বাভাবিক আছে। আগের মতই অফিসে যাচ্ছে। কাজ করছে। সারাদিন অফিস শেষ করে বড় আম্মুর কাছে ফিরে যাচ্ছে। রাতে বড় আম্মুর সাথে খাওয়া দাওয়া করে ঠিক টাইমে ঘুমুতে যাচ্ছে। পরের দিন আবার অফিস করছে। নূপুরের কথা একবারের জন্যও মনে করছে না। ছোট থেকেই জীবনের রাগটা যে অনেক বেশি। নূপুরের কথা মনে না করলেও মনে মনে নূপুরের প্রতি তার একটা চাপা রাগ তৈরি হচ্ছে। নূপুর কেন তার সাথে এমনটা করেছে তা জানার ইচ্ছে হচ্ছে। জয় আজ জীবনের সাথে দেখা করবে বলেছে। আর তাই জীবন অফিসে এসে একটু পরপরই বেরিয়ে গেছে। জয় জীবনকে আজ ফর্মাল লুকে দেখে পুরো টাস্কি খেয়ে গেছে। কালো প্যান্ট,নীল শার্টের উপর কালো স্যুট। গলায় টাই,হাতে ঘড়ি, চোখে কালো সানগ্লাস। জয়কে হা করে থাকতে দেখে জীবন বলল,
'মুখ বন্ধ কর গাধা। নয়তো মুখে মাছি ঢুকে যাবে।'
জয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
'বাহ্! তোকে তো দারুণ দেখাচ্ছে। পুরো বলিউডের হিরো হিরো লাগছে।'
'আরে ধুর চাপাবাজি বন্ধ কর। অফিস গিয়েছিলাম তাই এভাবেই চলে এসেছি।'
'তোরই ভালো। মাস্টার্স শেষ করে সোজা বাপের অফিস জয়েন করে নিলি। কষ্ট করে আর চাকরি বাকরি খুঁজে হলো না। আমার শালার কপাল। এখনো একটা চাকরি পাওয়ার নাম নেই। শুধু ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছি আর দিয়েই যাচ্ছি। বাপেরও তো নিজের ব্যবসা টেবসা নেই যে সেখানে লেগে যাব।'
জীবন ভ্রু কুঁচকে বলল,
'চাকরি নিয়ে তোর চিন্তা? হাসালি দোস্ত। আমার থেকে তোর রেজাল্ট অনেক অনেক ভালো। তুই চাইলেই যেকোন কোম্পানিতে জব নিতে পারবি। তুই জব নিতে না চাইলেও ওরা তোর সার্টিফিকেট দেখে তোকে টেনেটুনে নিয়ে নিবে।'
জয় হেসে বলল,
'এবার কিন্তু তুই চাপা মারছিস।'
'হ্যা মারছি তো। আচ্ছা যা আমি তোর চাকরির চিন্তা দূর করে দিলাম। তোকে আমার কোম্পানিতে নিয়ে নিব। তুই চাইলে আমরা ৫০% শেয়ারে নতুন বিজনেস শুরু করতে পারি। এখন বল আমাকে কেন ডাকলি? কি নাকি বলবি তুই।' 
জয়ের মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো। জয় ইতস্তত করছে দেখে জীবন জয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
'কিরে বল।'
'তোর সাথে কতকিছু হয়ে গেল। আর আমি আজ তোকে এমন একটা কথার বলার জন্য ডেকেছি,যা তোকে বলা উচিত কিনা তা আমি বুঝতে পারছি না। নূপুর,,, 
নূপুরের কথা উঠতেই জীবন জয়কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
'ওই মেয়ের কথা শুনতে চাচ্ছি না। তুই তোর কথা বল।'
'তুই স্পৃহাকে বিয়ে করবি জীবন? '
'হ্যা? '
'আমি জানি তুই নূপুরকে ভালোবাসিস। স্পৃহাকে ভালোবাসিস না। ভালো করে ওর ব্যাপারে কিছু জানিসও না। তবুও আমি তোকে এই রিকোয়েস্ট করছি। তুই স্পৃহাকে বিয়ে করে নে। নূপুর এখন আর তোর জীবনে নেই। তুই নিজের লাইফে কাউকে না কাউকে তো আসতে দিবি।তোর বন্ধু হয়ে আমি তোকে অনুরোধ করছি। তুই স্পৃহাকে বিয়ে কর।'
'জয় তুই কি বলছিস তা বুঝতে পারছিস তো? মানে আমি কীভাবে স্পৃহাকে বিয়ে করবো? আমি যেমন স্পৃহাকে ভালোবাসি না। তেমন স্পৃহাও আমাকে ভালোবাসে না। আমি ওকে বিয়ে করতে চাইলেও স্পৃহা কেন আমাকে বিয়ে করবে?'
জয় জীবনের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না। সে মনে মনে বলল,
'স্পৃহা তোকে ভালোবাসে জীবন। তুই সেটা জানিস না। স্পৃহা কোনোদিন তোকে জানাবেও না। আমার সাদাসিধে বোনটা যে কখন তোকে ভালোবেসে ফেলেছে তা হয়তো সেও জানে না। স্পৃহা কখনো নিজের চাওয়া পাওয়ার কথা কাউকে জানতে দিবে না। ওকে যা দেওয়া হবে তাতেই সে খুশি থাকতে চাইবে। স্পৃহার জীবনে তুই ওর প্রথম ভালোবাসা। লোকে বলে প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলা যায় না। স্পৃহাও হয়তো তোকে ভুলতে পারবে না। অন্য কারো সাথে বিয়ে হলে স্পৃহা তাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবে না। কারণ ভালোবাসা তো জীবনে একবারই আসে। মন একবারই দেয়া যায়।'
মারিয়া জয়কে সব বলে দিয়েছে। স্পৃহা জীবনকে ভালোবাসে। কিন্তু জীবনের গার্লফ্রেন্ড আছে, আর তাই স্পৃহা নিজের ভালোবাসা স্বীকার করতে চায় না। চাপা স্বভাবের মেয়েটা মুখ ফোটে কিছুই বলতে পারে না। জীবন জয়কে ধাক্কা দিয়ে বলল,
'কোথায় হারিয়ে গেলি?'
'হ্যা, বল।'
'আমি কি বলবো? বলছিলি তো তুই। হঠাৎ থেমে গলি।'
'স্পৃ,,,'
জীবন জয়কে থামিয়ে দিলো। সে বলল,
'স্পৃহা খুব ভালো মেয়ে। ও আমার থেকে অনেক ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে। তুইতো জানিসই আমি একজনকে মন দিয়ে ধোঁকা খেয়েছি। এখন আমি স্পৃহাকে বিয়ে করলেও ওকে ভালোবাসতে পারবো না। সুখী করতে পারবো না। তুই নিশ্চয়ই এটা চাস না বিয়ের পর তোর বোন অসুখী হোক। স্পৃহা আমার কারণে দুঃখ পেলে তুই আমাকে আস্ত ছাড়বি না। তখন আমাদের বন্ধুত্বও শেষ হয়ে যেতে পারে। আমি চাই না এসব কিছু হোক। আমার জন্য স্পৃহা বা তুই কেউই কষ্ট পাস।'
জয় মনে মনে বলল,
'স্পৃহা তোকে তার ভালোবাসা দিয়ে ঠিকই জয় করে নিবে। এই ক্ষমতা স্পৃহার আছে। নিজের ভালোবাসা দিয়ে তোর সব কষ্ট দূর করে দিতে পারবে। তোর জন্যও এই বিয়েটা জরুরি। আমি তোর বন্ধু। আমি তো জানি নূপুর চলে যাওয়ায় তুই কতটা কষ্ট পাচ্ছিস। তোদের দু'জনের জন্যই তোদের এক হতে হবে। হয়তো এটাই তোদের ভাগ্যে লিখা আছে। নিয়তি এভাবেই তোদের দু'জনকে কাছে আনার ফন্দি এঁটেছে।'
জীবন জয়ের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। জয় হঠাৎ করে কেন এসব বলছে। স্পৃহাকে তো জয় অনেক ভালোবাসে,ওকে ভালো রাখার চেষ্টা করে, সুখী দেখতে চায় সব সময়। পরেও কেন জীবনের সাথে স্পৃহার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। জয় কি বুঝতে পারছে না জীবনের সাথে বিয়ে হলে স্পৃহা কখনও সুখী হবে না। জয় বলল,
'স্পৃহা সুখী হবে নাকি হবে না আমরা কেউই আগে থেকে বলতে পারবো না। হতে পারে স্পৃহা তোর সাথেই সবথেকে বেশি সুখী হবে।'
জীবন হেসে বলল,
'কীভাবে হবে বল তো? ভালোবাসা ছাড়া কি কোনো সম্পর্কেই কেউ সুখী হতে পারে? আজ পর্যন্ত কেউ পেরেছে?'
'আমি ভবিষ্যতের কথা ভাবছি না জীবন। আমি বর্তমানের কথা ভেবে বলছি। খালামণি স্পৃহা বিয়ে দিতে চাইছে। হতে পারে দু'চার দিনের ভেতর বিয়ে হয়েও যেতে পারে। এই ঘটনার পর স্পৃহাকে নিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের কথা বলছে। এইজন্য খালামণি ওকে চট্টগ্রাম নিয়ে গেছে। এখন শুনছি ছেলেও দেখছে। জীবন তুই যেভাবে স্পৃহাকে বাঁচালি, ওর কথা ভাবলি। তাতে আমার মনে হয় স্পৃহার জন্য তোর থেকে ভালো আর কেউ হতে পারে না।'
জয়ের কথা শুনে জীবন অনেক হাসছে। হাসতে হাসতেই বলল,
'ভবিষ্যত ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় দোস্ত। শুধু বর্তমান ভেবে যদি কোনো কাজ করো, কোনো সিদ্ধান্ত নাও তাহলে অবস্থা আমার মত হবে। ফলাফল শেষে গোল আলু মিলবে। দেখছিস না নূপুর কি করলো। ও প্রথমেই বলেছিল ভাইদের জন্য আমাকে ছেড়ে দিতে পারবে। আমি তখন ভেবেছি ওসব পরে ভাবা যাবে। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে। এখন বুঝতে পারছি তো। স্পৃহা সহজসরল একটা মেয়ে আমি তাকে কষ্ট দিতে চাই না। তাই আমি তোর এই অনুরোধ রাখতে পারছি না। বিয়ে দিতে হলে ভালো একটা ছেলে খুঁজে ওর বিয়ে দিয়ে দে।' 
জীবন চলে গেল। জয় এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এই মূহুর্তে তার কি করার আছে তা সে ভেবে পাচ্ছে না। জীবনের সব কথাই সত্য। জীবন যা বলছে তা ফেলে দেয়া যায় না। স্পৃহা যে জীবনের সাথে সুখী হবেই এটা জয় শিওর দিতে পারছে না। জীবন শক্ত ধাঁচের ছেলে, তাই সে নূপুরের দেয়া কষ্ট সহ্য করতে পারছে। কিন্তু স্পৃহা নরম মনের, সে ভালোবাসায় পাওয়া কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। কিন্ত জীবনকে না পেলেও যে স্পৃহা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাবে। 
জীবন আর অফিসে গেল না। বড় আব্বুর বাসায়ও গেল না। নিজের ফ্ল্যাটে চলে আসলো। জয়ের পাগলামি দেখে তার হাসি পাচ্ছে। জয় সবকিছু জেনে এই কথা কীভাবে ভাবতে পারলো। জীবন চেঞ্জ করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। দুপুরের কড়া রোদে চারদিক খা খা করছে। জয়ের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ স্পৃহার মুখটা চোখের সামনে ভেবে উঠল। স্পৃহা তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। সেই ঘুমন্ত মুখ। জীবন শক্ত করে চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুললো। স্পৃহার চেহারা মনে হতে মূহুর্তে তার সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। জীবন বিরবির করে বলতে লাগলো, 
'স্পৃহাকে তার বাবা মা নিয়ে গেছে? বিয়ে দিতে চাইছে ওর? কিন্তু কেন? এই মেয়েকে এখনই কেন বিয়ে দিচ্ছে? '
জীবন রুমে চলে এলো। রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে একটা সিগারেট ধরালো। ইদানিং সে এই জিনিসটার প্রতি একটু বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। একটু টেনশন হলেই সিগারেট জ্বালিয়ে নেয়। আগে কিন্তু এই অভ্যাস ছিল না। বন্ধুদের সাথে পড়ে সপ্তাহে বা মাসে এক দু'টা খেত। 
জীবন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
'না জানি কেমন ছেলের সাথে মেয়েটার বিয়ে দিবে। ঐ ছেলে একে আগলে রাখতে পারবে তো? নাকি ওকে কষ্ট দিবে। ভীতু বোকা মেয়েটা যেন কোনোদিনও কষ্ট না পায়।'
জীবন নিজেও বুঝতে পারছে না সে কেন স্পৃহার জন্য টেনশন করছে। কেন ভাবছে এসব কথা। যার সাথেই স্পৃহার বিয়ে হোক এটা ওর ভাবার বিষয় না। ঐ গুদামঘর থেকে পালিয়ে, জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে ঐ ছেলে গুলোর হাত থেকে জীবন যেভাবে স্পৃহাকে বাঁচিয়েছে, এভাবে কি অন্য কেউ স্পৃহাকে আগলে রাখতে পারবে? 

জয় ভেবেছিল সে আজ একা খালামণির বাসায় যাবে। কিন্তু বাড়ি এসে দেখে মারিয়া স্পৃহার বিয়ের কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। আর মেহেরুনও সেখানে যাবার জন্য তৈরি হয়ে আছে। মা আর জয় যাবে দেখে মারিয়াও ওদের সাথে যাবে। বিকেলে ওরা বের হয়ে গেল। গাড়িতে ওঠার একটু আগে জয়ের ফোন বাজলো। জয় এখন ফোন তুললো না। পরেও ফোন বেজেই যাচ্ছে। গাড়িতে বসে জয় ফোন তুললো। জীবনের কল। ফোন রিসিভ হবার সাথে সাথেই জীবনের গলা পাওয়া গেল।
'কতক্ষণ ধরে কল করছি। কোথায় ছিলি তুই? ফোন তুলছিলি না কেন?'
'গাড়িতে আছি। তুই কি বলবি বল।'
'তোর বোনকে বিয়ে করবো।'
জয় জীবনের কথা বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করলো, 
'কি? কি বললি তুই?'
'গাধা! বলেছি আমি তোর বোনকে বিয়ে করবো। স্পৃহাকে বিয়ে করতে আমি রাজি।'
জয় সত্যিই জীবনের কথা বুঝতে পারছে না। জীবন তো দুপুরে না করে দিলো। এখন আবার হ্যা বলছে। এই দুই তিন ঘন্টার মাঝে কী এমন হলো যার জন্য জীবন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জয় অবিশ্বাসী সুরে বলল,
'তুই আমার সাথে মজা করছিস না তো?'
'বিয়ের বিষয় নিয়ে কেউ মজা করে? আমি ভীষণ সিরিয়াস। সত্যিই আমি স্পৃহাকে বিয়ে করবো।'
'হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কি বুঝে নিলি? মানে দুপুরে তো না করে দিয়েছিলি। তখন আবার হ্যা বলছিস। আর তুই-ই তো বলেছিলি। তুই স্পৃহাকে ভালোবাসতে পারবি না। তোর সাথে বিয়ে হলে স্পৃহা সুখী হবে না। এখন তাহলে,,,?'
জয়ের এতো প্রশ্ন শুনে জীবনের রাগ লাগছে। 
'ধুর শালা। এতো কথা বলছিস কেন? তখন না বলেছি। কিন্তু এখন তো হ্যাঁ বলছি। বিয়ে করতে চাই নি। তখনো কথা শুনিয়েছিস। এখন রাজি হচ্ছি এখনো কথা শোনাচ্ছিস। তুই কি চাস আমি আবার মত পরিবর্তন করি?'
'আরে না না। তা বলেছি নাকি? হঠাৎ করে বিয়ে করতে রাজি হলি কেন সেই কারণটা জানতে চাইছি। '
'কারণ আর কি? গার্লফ্রেন্ড ধোঁকা দিয়েছে। নতুন করে প্রেম করার বয়সও পার হয়ে গেছে। অফিসেও যাচ্ছি। দুদিন পর বড় আম্মুও বিয়ের জন্য চাপ দিবে। আরো দু'তিন বছর পরে হলেও বিয়ে তো করতেই হবে। তাই ভাবলাম হাতের কাছে যখন ভালো মেয়ে আছে। তার উপর নিজের বন্ধুর বোন। তাহলে বিয়েটা করেই নিই। এখন বল তুই কোথায় আছিস? আমাকে লোকেশন সেন্ড কর আমি আসছি।'
'আসছি মানে? কোথায় আসবি তুই?'
'তোর সাথে শ্বশুরবাড়ি যাব। জয় শোন, প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি মিষ্টি টিস্টি নিয়ে যেতে হবে নাকি? '
জীবনের কথা জয়ের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। জয় থতমত খেয়ে বলল,
'তুই আজই বিয়ে করতে যাবি নাকি?'
'বিয়ে যখন করবো তাহলে দুদিন পরে করে লাভ কি? শুধু শুধু শুভ কাজে দেরি না করে আজই করে ফেলি। তুই ওদিকে সব ম্যানেজ করে নিস।'
'কিন্তু তুই একা গিয়ে বিয়ে করবি বললেই তো হবে না। কোনো মা বাবাই শুধু ছেলে দেখে বিয়ে দেবার জন্য রাজি হবে না। ওরা তোর পরিবার দেখতে চাইবে। তুই তোর বড় আব্বু, বড় আম্মুকে নিয়ে আয়।'
'আমার কেউ নেই তা তুই জানিস। বড় আব্বুকে আমি আমার গার্জিয়ান মানি না। যদি কথা আসে পরিবারের তাহলে বড় আম্মু আর তোরাই আমার পরিবার। বড় আব্বুর পারমিশন নিয়ে আমি কোনো কাজ করি না। বিয়ে হয়ে গেলে বড় আম্মুকে আমি বুঝিয়ে নিব। ওসব নিয়ে তোকে টেনশন নিতে হবে না।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন