কৃষ্ণাবতী - পর্ব ১১ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা৷ অন্নার একটি সাদা সালোয়ার কামিজ তার পরণে। অন্নার খুব সুন্দর করে তার চুল বেধে দিয়েছে। তাতে সিঁদুর রাঙানো সিঁথি ও দেখা যাচ্ছে না। অন্নার সাথেই হেটে ক্লাসে যাচ্ছিলো। তখনই কিছু ছেলেমেয়ে তাদের পথ আটকায়। কৃষ্ণা বেশ ভয় পেয়ে যায়। এই পরিস্থিতিগুলো তার জন্য নতুন। গ্রামের কলেজে এসব কিছুই তার সাথে হয় নি। ভয়ে অন্নার হাতটা চেপে ধরে সে। অন্না ধীর কন্ঠে বলে,
- এরা আমাদের অনার্সের ভাইয়া, আপুরা। তুই নতুন তো তাই ওকে আটকেছে, ভয় পাস না
- আমাকে বকবে?
- আরে না, নাম টাম জিজ্ঞেস করবে

তখনই একটা ছেলে বলে উঠে,
- এতো ফিসফিসানির কি আছে? এদিক তাকাও। অন্না এই নতুন মেয়ে কে রে?
- ভাই ও আমার দূর সম্পর্কের মাসতুতো বোন। গ্রাম থেকে এই কলেজে ভর্তি হয়েছে

অন্না স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কথাটা বলে। অন্নাকে দেখে কৃষ্ণা একটু সাহস পায়৷ তার দিকে ছেলেমেয়েগুলো বিদ্রুপের চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ একটা মেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
- নাম কি তোমার? 
- কৃষ্ণাবতী সাহা
- কৃষ্ণাবতী সাহা, মনে হচ্ছে কোনো উপন্যাসের ক্যারেক্টর উঠে এসেছে। ছোট কোনো নাম নেই? 

নিজের নামের এমন ব্যঙ্গাত্মক উক্তি শুনে খানিকটা রাগ হলো কৃষ্ণার। যতই হোক তার বাবা এই নামটা রেখেছিলো। এই নাম নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ একেবারেই সহ্য হলো না তার। খানিকটা শক্ত কন্ঠে নির্ভীকভাবে সে বলে,
- কারোর নাম নিয়ে ফাযলামি করাটা হয়তো আপনাদের মতো শিক্ষিত মানুষের মানায় না। আমার বাবা নামটা রেখেছে। সেটা নিয়ে ফাযলামি করবেন না দয়া করে। 

কৃষ্ণার দৃষ্টি স্থির। কন্ঠে জড়তা নেই। উদ্যম কন্ঠেই কথাটা বলে সে। উপস্থিত সিনিয়ররা খানিকটা হলেই হতবাক হয়ে যায়। আজ অবধি এভাবে কেউই তাদের সাথে কথা বলে নি। একটা ছেলের অবশ্য বেশ অপমানিত বোধ হলো। জুনিয়রের চোখে কোনো ভয়ের ছাপ না দেখতে পেরে তাদের সিনিয়রত্বের উপর যেনো হানি এসেছে। কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে,
- আমাদের মুখের উপর কথা বলার বেশ সাহস আছে দেখছি তোমার? জানো আমরা কে? সিনিয়র তোমার। সিনিয়রদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলতে হয়। 
- জানি, আপনারা আমার গুরুজন। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। আপনাদের আচারণ দেখে আমি সন্দীহান আপনাদের থেকে আমি নতুন কি কিছু আদৌ শিখতে পারবো?
- কৃষ্ণা অফ যা, এরা সিনিয়র। কেনো এদের থেকে পাঙ্গা নিচ্ছিস?

কৃষ্ণার কথা শুনে অন্নার মাথায় হাত। এই র‍্যাগিং করা সিনিয়ররা সব পলিটিক্সের সাথে জড়িত। এদের সাথে পাঙ্গা নেওয়া অর্থাৎ নিজের পায়েই কুড়াল দেওয়া। খুব চেষ্টা করে কৃষ্ণাকে থামানোর। কিন্তু কৃষ্ণা তো কৃষ্ণা। সে কি কারোর বারণ শুনে! 
- আমি তো ভুল কিছুই বলি নি অন্না। কেনো অফ যাবো? 

ছেলেটা কৃষ্ণার নির্ভীক কথাটা শুনে তার দিকে এগিয়ে আছে। ছেলেটার এগিয়ে আসার ভঙ্গিমায় কৃষ্ণার একটু নড়েচড়ে উঠে। হঠাৎ একটা মৃদু ভারী কন্ঠে কানে ভেসে আসে কৃষ্ণার।
- এখানে কি হচ্ছে?

ডানে তাকাতেই দেখে সাদা শার্ট, গাড় নেভি ব্লু প্যান্ট পরিহিত একজন শ্যাম বর্ণের পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। চুল গুলো বেশ কায়দা করে কপালে ফেলিয়ে রেখেছে। চোখে রিমলেস চশমা। লম্বা মাষ্টারমশাই এর থেকে খানিকটা বেশি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কৃষ্ণাকে দেখছে সে। ছেলেটার আগমনে উপস্থিত সিনিয়রগুলো বেশ ভয়ে শিটিয়ে গেলো। ছেলেটা কৃষ্ণা এবং সিনিয়র ছেলে মেয়েদের মাঝ বরাবর দাঁড়ালো। ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
- কি হচ্ছে এখানে? 
- কিছু না অর্জুন দা। আসলে নতুন তো পরিচিত হচ্ছিলাম।
- তোমাদের অনার্স ফার্স্ট ইয়ার কে র‍্যাগিং এর পারমিশন দেওয়া হয়েছে। সেটাও যাতে মজার ছলেই হয়। কোনো ভয়-ভীতি তৈরি করতে মানা করা হয়েছে। তোমরা তো দেখছি ইন্টারদের ও র‍্যাগিং এ নেমে গেছো। 
- সরি দা, আর হবে না। 
- মনে থাকে যেনো 

এবার ছেলেটা কৃষ্ণার দিকে তাকায়। অন্না একটু সাহস নিয়ে বলে,
- আসলে অর্জুন দা, কৃষ্ণার নাম নিয়ে কেউ ফাযলামি করুক তার সেটা পছন্দ নয়। এমনিতে ও বেয়াদব নয়। 

অর্জুন নামের ছেলেটা সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কৃষ্ণাকে কিছুক্ষণ অবলোকন করে। টানাটানা চোখ, সিগ্ধ মায়াবী মুখখানি, মাজা অবধি লম্বা বেণুনী। ঠিক যেনো কোনো দূর্গা প্রতিমা। মাথা থেকে পা অবধি দেখে মৃদুস্বরে কৃষ্ণাকে বললো,
- ক্লাসের দেরি হচ্ছে, ক্লাসে যাও। 

অর্জুনের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে অন্না যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কৃষ্ণা মাথা কাত করে, ক্লাসের দিকে হাটা দিলো। পেছন থেকে তখন অর্জুন "কৃষ্ণাবতী" বলে ডাক দিলে সে পেছনে ফিরে। অর্জুন তখন ঠোঁটে হাসি একে বলে,
- নামটা সুন্দর। 

কৃষ্ণার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোলো না। সে আবার ফিরে অন্নার সাথে হাটা শুরু করলো। অর্জুন তখন ও কৃষ্ণার যাবার পথে এক মনে তাকিয়ে ছিলো, যতদূর কৃষ্ণাকে দেখা যায়। কৃষ্ণার সাদা ওরণাটা যখন মিলিয়ে গেলো তখন একটা ছেলে বলে উঠলো,
- অর্জুন দা আবহাওয়া তো ভালো ঠেকছে না। বিপদ সংকেত দেখা যাচ্ছে যে। 
- চব্বিশ বছরের জীবনে এই প্রথম বিপদ সংকেতের আভাস পেলাম। খবরদার, যদি কেউ এই সাগরে নৌকা বাইতে যাস! এই নেশার সাগরে শুধু আমি ডুব দিবো বলে দিচ্ছি। 

অর্জুনের উত্তর শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠে। অর্জুনের ঠোঁটে অন্য রকম হাসি। গুনগুন করে গাণ ধরে সে,

"প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে-- বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও।

ভুলিব ভাবনা, পিছনে চাব না,-- পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥

      প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল, হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল--

পাগল হে নাবিক, ভুলাও দিগ্‌বিদিক,-- পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥"

হঠাৎ করেই কৃষ্ণার হাতে অন্না চিমটি কাটে। কৃষ্ণা "উহহ" করে উঠতেই বেশি তেজী স্বরে বললো সে,
- কি দরকার ছিলো এতো দাপট দেখানোর?
- আমি কি কিছু ভুল বলেছি? আমার নাম নিয়ে কি বিদ্রুপটাই না করছিলো তারা। 
- আরে ভাই সিনিয়র, এদের সাথে লাগতে হয় না। তোর জন্য আমার দিকেও তারা ক্ষিপ্ত দৃষ্টি দিলো।
- অহ

কৃষ্ণার অনুতাপ হতে লাগলো। এভাবে তর্ক না করলেও হয়তো হতো। মাষ্টারমশাই দেখলে হয়তো ভাববে সে বেয়াদব। কিন্তু তখন হুট করেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। কৃষ্ণার নিভু মুখটা দেখে অন্না একটু নরম স্বরে বললো,
- ঠিক আছে, আর প্যাঁচার মতো মুখ বানাস নে। অর্জুন দা এসে তো বাঁচিয়েই দিলেন। 
- আচ্ছা এই অর্জুন দা টা কে?
- উনি আমাদের কলেজের মাস্টার্সের স্টুডেন্ট। পলিটিকাল নেতাদের একজন। এই কলেজের সবাই তাকে ভয় পায়। কেউ উচ্চবাচ্য করতে পারে না তার উপর। শুধু একটা মানুষকে অর্জুন দা ভয় পায়। তা হলো তোমার মাষ্টারমশাই। আর এক কথায় বলতে গেলে সব হিন্দু জুনিয়রদের ক্রাশ সে। একটা মানুষ এতো সুন্দর হবার সাথে সাথে এতো গুণবান এটা যেনো ভাবাই যায় না। 
- তুই তো দেখছি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। 
- মানুষটাই এমন। তুই ক্রাশ খাশ নি?
- ক্রাশ আবার কি? খায় কিভাবে তা?
- বাদ দে, বইন। চল ক্লাসেই যাই। 

অন্নার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে কৃষ্ণা। মেয়েটার হাসিতেও যেনো অন্যরকম মাদকতা আছে। দূর থেকে কেউ মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখতে ব্যস্ত_______

!!০৮!!

নিজের রুমে এসে কিছু কাগজ পত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করা শুরু করে দেবব্রত। গোটা দেড় মাস পর এসেছে কলেজে সে। বেশ কাজ জমে গেছে তার। আজ তিনটে এক্সট্রা ক্লাস ও নিতে হয়েছে তাকে। খুব ক্লান্ত লাগছে। দুপুর ঘনিয়ে বিকেল হতে চললো। এখনো দুটো দানাও পেটে পড়ে নি তার। হঠাৎ টেবিলে কিছু রাখার শব্দ পেলে মাথা তুলে তাকায় দেবব্রত। তার সামনে হলুদ শাড়ি পরিহিতা সৌদামিনী দাঁড়িয়ে আছে। মায়াবন বিহারিনী শব্দটা যেনো তার জন্যই প্রযোজ্য। কি দারুণ লাগছে মেয়েটাকে। শ্যামলা বরণে হলুদ রঙটা যেনো মিশে আছে। কোকড়া চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে সে। সেদিনের দামিনী আর আজকের দামিনী যেনো রাত আর দিনে পার্থক্য। হঠাৎ হৃদয় হুহু করে উঠে দেবব্রতের। আলতো করে ছুয়ে দিতে পারছে না সে তার রাইকে। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠে,
- হঠাৎ আমার পানে আসা?
- তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। খাওয়া তো হয় নি নিশ্চয়ই
- তুই জানলি কি করে? 
- যে কাজ পাগল ছেলে তুই! এটা জানতে বিবিসি চ্যানেলের প্রয়োজন হয় না। তোর পছন্দের পোস্ত নিয়ে ইলিশ রেধেছি

আজ যেনো দামিনীকে দেড় মাস আগের দামিনী লাগছে। যে তার পছন্দ অপছন্দের খুটি নাটি জানে। কিন্তু সে তো দেড় মাস আগের দেব হতে পারছে না। তার যে কাধে তার বাবার দেনা রয়েছে। মলিন হাসি হেসে বলে,
- আমার পছন্দের খেয়াল এখনো রাখছিস তুই? আর মায়ায় জড়াস নে দামিনী। আমি যে তখন অথৈ সাগরে পড়ে যাবো। 
- প্রেমিকা নয়, বন্ধু হিসেবে তো এটুকু করাই যায়। দেখ এখন দুঃখ বিলাস করতে আসি নি। আমার ও কিন্তু খাওয়া হয় নি। 

বলেই প্লেট বের করতে লাগতো সৌদামিনী। দেবব্রত ফাইলটা বন্ধ করে সৌদামিনীর কাছে গেলো। মেয়েটা স্বাভাবিক হতে চাইছে, থাক না সে তার মতো। পুরোনো কাসন্দি ঘেটে কি লাভ! 
- কি হলো? কি দেখছিস?
- কিছু না, চল খেয়ে নি। 

সৌদামিনী নিপুনভাবে দেবব্রতকে খাবার বেড়ে দিলো। খেতে খেতে দেবব্রত বলে উঠলো,
- দিহান বলছিলো, তুই নাকি বিদেশ চলে যাচ্ছিস? 
- ভেবেছিলাম চলে যাবো। দম বন্ধ লাগছিলো। হুট করে মনে হলো পালিয়ে যাবার মানেই হয় না। দেখি না হাওয়ার সাথে টিকে থাকতে

সৌদামিনীর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে যায় দেবব্রতের। দেবব্রতের মলিন মুখটা দেখে স্মিত হাসি দিয়ে বলে দামিনী,
- হয়েছে আর মুখ কালো করতে হবে না। আমি ঠিক মানিয়ে নিয়েছি। রান্নাটা কেমন হয়েছে সেটা বল
- আমাকে পুরস্কার হিসেবে কি দিবি তাই বল?
- কেনো? 
- বারে কি কষ্ট করে গিলতে হচ্ছে জানিস? ভয় হচ্ছে পেট না খারাপ হয়

দেবব্রতের কথাশুনে মুখ ফুলিয়ে তার হাতের প্লেটটা কেড়ে নেয় দামিনী। 
- খেতে হবে না তোর। 
- না না মজা করছিলাম৷ দে দে। ক্ষুধা লেগে রে

দুজনের খুনশুটির যেনো অন্ত নেই। তখন.....
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন