বুকের বাঁ পাশে - পর্ব ০৬ - নূরজাহান আক্তার আলো - ধারাবাহিক গল্প


আজকে প্রিয়ম আর তুয়া ঘুরতে বের হয়েছে। এটা ওদের প্রতি সপ্তাহের রুটিন। প্রিয়ম আর তুয়া দু'জন দুজনকে খুব ভালবাসে। তবে এই কথা তেমন ভাবে কেউ জানে না। সবার চোখের আড়ালেই ওরা বুনে চলেছে ওদের খুনশুটি ভালবাসার গল্প। 

তুয়ার মনটা আজকে খুব ভালো তাই কোচিং মিস দিয়ে প্রিয়মের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে বাইক নিয়ে! তুয়া কালো জিন্সের সাথে লাল একটা কামিজ পড়েছে আর সাথে কালো ওড়না। চুল গুলো সাইডে সিঁথি করে কিছু চুল নিয়ে একটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো। প্রিয়মও প্রতিবারের মত আজকেও হিরো লুকে এসেছে। প্রিয়ম এ্যাশ কালার শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স আর ব্ল্যাক সানগ্লাস। এক হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ আর একসাথে অনেকগুলো ব্রেসলেট। সাথে সেই ভুবন ভুলানো হাসি তো আছেই। তুয়াও বেড়াতে আসবে বলে একটু সাজুগুজু করেছে।

 ওরা বেড়াতে এসেছে ঠিকই। কিন্তু প্রিয়মের ফ্যানরা প্রিয়মকে দেখে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে! আর তুয়া চোখ মুখ খিঁচে এক কোণে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।বেশ কিছুক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকার পর তুয়া আর কোন কিছু না ভেবে প্রিয়মের বাইকের কাছে গিয়ে বসে বাইক স্টার্ট দেয়। সেটা দেখে প্রিয়ম কোন রকম ছুটে এসে বাইকে বসে। তুয়া বাইক স্টার্ট দিয়েই ছুটে চলছে অজানা পথে। এখন যদি প্রিয়ম না আসতো তাহলে তুয়া প্রিয়ম কে রেখেই চলে যেত, এটা প্রিয়মেরও অজানা নয়। তুয়া বাইক চালাতে পারে; তুরাগের থেকে তুয়া বাইক চালানো শিখেছে। বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে তুয়া খুব পছন্দ করে। সে কারণে নিজে শিখেছে! তুয়া চুপচাপ বাইক চালাচ্ছে, আর প্রিয়ম পেছনে বসে আছে।হঠাৎ প্রিয়ম তুয়ার গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো,

--"আমার পিচ্চি টুপা রাগ করে না কলিজা।"
--(তুয়া চুপ করে আছে)
-- "ওরা ঘিরে ধরলে আমি কি করবো বলো তো? প্লিজ জানপাখি রাগ করে থেকো না আমার সোনাপাখিটা।আমার কলিজাটা আমার সাথে কথা না বললে আমার যে বড্ড কষ্ট হয়। সে কি এটা বুঝে না, হুম?"
--"আমি কারো কলিজা না।" (দাঁতে দাঁত চেপে)
--"হুম জানি তো তুমি আমার কলিজা না। তুমি তো আমার হার্ট!" (জড়িয়ে ধরে)
--"পাম কম পারো প্রিয়ম! আর তুমি আমার কাছে আসলে কেন? যাও তোমার ফ্যানদের কাছে যাও! ওদের বলো তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে নাচতে! না না তুমিই বরং যাও আর ওদের কোলে উঠে বসে থাকো। (রেগে নাক ফুলিয়ে )
--"ওরে বাবা রে এতো রাগ! এতো রাগ করলে ধলা মুখটা তো কালা হয়ে যাবে কলিজা।" (তুয়ার নাক টেনে)
--(সাইলেন্ট) 
--"কি গো কথা বলছো না কেন? আর রাগ করে না জানপাখি। ও বাবুর আম্মু! ওই কলিজা!ওই হার্টবিট!আমার সোনাপাখি টা কথা বলো রে।"

প্রিয়ম এত কিছু বলেও  যখন দেখল কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, তখন প্রিয়মও আর কোনো কথা বললো না!বরং তুয়ার দুই হাতের উপর হাত রেখে বাইক ড্রাইভ করতে লাগলো। তুয়া তখন ওর হাত ছুটিয়ে নিতে গেলে, প্রিয়ম আরো জোরে হাত চেপে ধরলো! আর বাইকের স্প্রিড আরো বাড়িয়ে দিলো। বাইকের গতির সাথে অনবরত উড়ছে তুয়ার অবাধ্য চুল গুলো। তারা যেন মুক্ত বাতাসে উড়ে উড়ে উন্মুক্ত এক খেলায় মেতেছে।আর প্রিয়ম তুয়ার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে ড্রাইভে করছে।এখন প্রিয়মকে দেখে মনে হচ্ছে যে, এখন ওর কাছে এটাই হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও খুব গুরুত্বপূর্ন কাজ। আর এখন এই কাজে মনোযোগী না হলে পৃথিবীটাই উল্টে যাবে।

একটুপর প্রিয়ম আর তুয়া একটা নদীর পাড়ে এসে বাইক থামালো। দুজনেই পানিতে পা ঢুবিয়ে বসলো।প্রিয়ম পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো সূর্যটা ডুবে যাওয়া জন্য তার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। কাক গুলো কা কা শব্দ করে ওদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচে অনেকগুলো ফুল পড়ে আছে। অনেক পথচারী হেটে যাচ্ছে সেই ফুটপাত দিয়ে আর তাদের পায়ের নিচে ফুল গুলো পড়ে থেতলে যাচ্ছে। যদিও এখান থেকেও একটা শিক্ষা নেওয়া যায় যেমনঃ-

ফুলকে আমরা বলি সৌন্দর্যের প্রতীক। এই লাল রঙ্গা কৃষ্ণচুড়া গুলো দেখতেও খুব সুন্দর। কিন্তু এগুলো সবার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তাই কারো কাছেই  এগুলোর মুল্য নেই। তাই এই ফুল গুলোকে পায়ের নিচে জায়গা দেওয়া হয়। তেমনি বাস্তব জীবনেও যখন যাকে প্রয়োজন তখন তাকে ব্যবহার করে। আর যাকে অপ্রয়োজন তাকে অবহেলা করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে তোর প্রয়োজন নেই। তুই এবার যেতে পারিস। যদিও এটা কেউ মুখে বলে না। কিন্তু কাজে আর ব্যবহারে ঠিকই  বুঝিয়ে দেয়।

তুয়া আপন মনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর পানির দিকে। মাঝে মাঝে নদীর পানিগুলো কলকল শব্দ তুলছে আবার শান্ত হয়ে বয়ে যাচ্ছে। একটুপর ছোট ছোট স্রোতের সাথে কচুরিপানা গুলোও ভেসে যাচ্ছে। কচুরিপানা গুলোরও জানা নেই ওরা ভেসে ভেসে ঠিক কোথায় গিয়ে থামবে। তবু ওরা অজানা এক গন্তব্যে ভেসে চলেছে। তুয়া চুপচাপ বসে আছে আর পরিবেশটাকে উপভোগ করছে। সাথে হালকা মৃদ্যু বাতাস এসে যেন শরীর আর মন দুটোই ঠান্ডা করে দিচ্ছে। প্রিয়ম মুচকি হেসে তুয়ার দিকে তাকিয়ে হুট করে তুয়ার মাথাতে ওড়না তুলে দিলো। সাথে তুয়াকে হালকা করে মৃদ্যু একটা ধাক্কা দিয়ে বললো,

                    যদি প্রিয়মের বউ সাজো গো
                             আরো সুন্দর লাগবে গো!
        শোনো শোনো আরোও শোনো,
                             লাগবে  মন্দ নয়, জীবনের এই স্বপ্ন 
            ওগো সত্যি যেনো হয়।

প্রিয়মের এই গান শুনে তুয়া মনে মনে হাসলো। ব
কিন্তু কিছু বললো না। তাছাড়া তুয়াও রেগে নেই প্রিয়মের উপরে। যদিও তুয়া কখনোই প্রিয়মের উপরে রাগ করে থাকতে পারে না। শুধু শুধু রাগের অভিনয় করে এই আর কি। প্রিয়ম তুয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে। তুয়া চুপচাপ পানি হাতে নিয়ে একমনে খেলছে। তুয়া ঠিকই বুঝতে পারছে প্রিয়ম ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তবু চুপ করে আছে। কারণ প্রিয়ম কি করে সেটা দেখার জন্য। প্রিয়মও এবার ওর ঠোটের কোণে দুষ্টু হাসি রেখে টেনে বললো,

                       ও বউ কথা কও! 
                                এই বউ আমার কথা শুনছো নি
            আমি কবে হইবো পোলার বাপ?
                                 আমার কানে কানে কইয়া যাও!

এই গান শুনে তুয়া না হেসে পারলো না। প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। তুয়ার হাসি দেখে প্রিয়মের বুকের উপর থেকে যেনো কয়েক টনের পাথর নেমে গেল। প্রিয়ম তুয়ার দিকে তাকিয়ে ওর বুকের বা পাশে হাত বুলিয়ে বললো,
--"এভাবে হাসিস না রে জান! তোর এই হাসিটা আমার এই বুকের বা পাশটাকে একেবারে ঘায়েল করে ছাড়ে।মনে হয় তোর হাসিটা সহ তোকেই টুপ করে গিলে ফেলি।" (প্রিয়ম)

প্রিয়মের কথা শুনে তুয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। তুয়ার লজ্জা দেখে প্রিয়ম হো হো হেসে দিলো। তারপর দুজন মিলে আর একটু ঘুরাঘুরি করে টুকটাক খাওয়া দাওয়া করে বাইকে বসলো। তুয়া বাইকে বসার পর প্রিয়ম বাইক স্টার্ট দিলো। প্রিয়ম তুয়াকে বললো,
--"এই যে আমার কলিজাটা একটা কথা শুনুন! কালকে দুপুর ৩ থেকে ৬ পর্যন্ত আমার ফোন বন্ধ থাকবে।"
--"কেন? কি এমন রাজকার্য করতে যাচ্ছেন আপনি?"
--"কালকে আমাকে মডেলিং এর জন্য যেতে হবে বুঝলেন? তাই আগেই বলে দিলাম, নাহলে পরে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবেন। আর তখন আমার ফাটবে।"
--"তা আপনার কি ফাটবে শুনি?" (তুয়া) 
--"কি আবার বুক। (হেসে দিয়ে)
--"ওহ বুঝলাম!"
--"আর আপনার তো সামনে পরীক্ষা! মন দিয়ে পড়াশোনা করুন। আমি কিন্তু ফেলটুস বউ চাই না আগেই বলে দিলাম হু!"
--"তাই না!" (প্রিয়মের পিঠে একটা কিল বসিয়ে)
--"আহ্! আল্লাহ আমার কপালেই কেন এমন ডাকাত মেয়ে জুটালো? আমার মত ভদ্র ছেলে পেয়ে যখন তখন অত্যাচার করে এই ডাকাত রাণীটা!"
তারপর প্রিয়ম ওর  মনের দুঃখ কমাতে আবার গান ধরলো..!

      ওরে কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো?
                                      আমি বুক চিড়িয়া,
                    অন্তরে জ্বলে রে আগুন 
                                        টুপার কিল খাইয়া।

প্রিয়মের এই গান শুনে তুয়া আবার আরেকটা কিল বসিয়ে দিলো প্রিয়মের পিঠে। পরের কিল খেয়ে প্রিয়ম আর কিছু বলেনি। কারণ এখন কিছু বললেই কিলের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এই সব নিয়ম প্রিয়মের মুখস্থ! তাই প্রিয়ম এখন ভুলেও টু শব্দ করবে না। কারণ যুগ হিসেবে এটাকে বলে প্রেমিক নির্যাতন।

তারপর প্রিয়ম তুয়াকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল! তুয়া প্রত্যয়ের আম্মুর সাথে দেখা করে তারপর ওর বাসায় গেল! তুয়া আর আগ বাড়িয়ে প্রত্যয়ের কথা জিজ্ঞাসা করে না। প্রত্যয়ও এখন  তুয়ার কথা কাউকে জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা বোধ করে। তুয়া বাসায় গিয়ে দেখলো ওর কলিজার বেস্টু তিন্নি এসেছে।ড্রয়িং রুমে সোফাতে বসে বসে আচার গিলছে। তুয়া সোফাতে বসতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। তুয়া দরজা খুলে দেখলো তুরাগ এসেছে। তুরাগ সোফাতে বসতেই  তুয়া বললো।
--"ওই টুনির মা আচার পরে গিলিস। এখন চল আমার রুমে চল।" (তুয়া)
--"ভাইয়া সামনে আমার নামটা একটু সুন্দর ভাবে তো উচ্চারণ করতে পারিস।" (ফিসফিস করে)
--"কেন রে? তুই কি আমার ভাইয়ার হবু বউ নাকি যে আমার ভাইয়ের সামনে তোর নামটা সুন্দর করে উচ্চারণ করতে হবে?" (তুরাগকে শুনিয়ে)
--"ম মা নে!ই ইয়ে... " (দিলো! দিলো রে আমার জানটুশের সামনেই এই ছেমড়ি আমারে আইক্কা ওয়ালা বাঁশটা দিয়া দিলো! ইস কি লজ্জা! কি লজ্জা! মরি যাই! মরি যাই! তিন্নি মনে মনে)

তুয়ার আর তিন্নির কথা শুনে তুরাগ ওর সু আর মোজা খুলতে খুলতে একবার ওদের দিকে তাকালো। তারপর তুরাগ আবার ওর কাজে মনোযোগী হলো। তিন্নি আর টু শব্দ না করে তুয়ার রুমের দিকে ভৌ দৌড় দিলো। তিন্নি এমনিতেই তুরাগকে কেন জানি খুব ভয় পায়। আর তুয়া কুত্তিটা তুরাগের সামনে ওরে এই বাঁশটা দিলো। তুয়া একটু পর গরম গরম মোগলাইয়ের প্লেট নিয়ে ওর রুমে ঢুকলো। তুরাগ এনেছে তাই তুয়া ওর আর তিন্নির ভাগেরটা একসাথেই এনেছে। তুয়া খাচ্ছে আর তিন্নি চোখ কটমট করে তুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

আজকে প্রত্যয়রা তিনজন মিলে ঘুরতে বের হয়েছে।  প্যারিস শহরটা সেন নদীর তীরে অবস্থিত। সেই নদীটাই ওরা দেখতে এসেছে। সেন নদীর উপরে যে ব্রিজ আছে সেখানে কোটি কোটি তালা ঝুলানো আছে! এত গুলো তালা ঝুলানো দেখে সাদ বলে উঠলো,
--"কি রে ভাই, এত গুলো তালা ঝুলানো কেন এখানে?আগে জানলে ডাক্তার না হয়ে চাবি বানানোর কারিগরি হতাম! আর এই তালা গুলো চুরি করে তালার বিজনেস শুরু করতাম।" (সাদ)
--"সাদ তুই যে বাংলাদেশের মানুষ এটাই তার প্রমান বুঝলি! এত তালা এখানে কেন ঝুলানো সেটা জানতে না চেয়ে সে বিজনেসের চিন্তা করছে! কুত্তা তুই আসলেই একটা লোভী পোলা! যা ভাগ ফইন্না।" (পৃথা) 
--"তুই চুপ কর কুওী! আমি চুরি করলে তোর বাপের কি?" (সাদ)
--"আমার বাপের কিছু না! কিন্তু তোমার বাপের অনেক কিছু! কারণ এখানকার মানুষ জন যদি তোমার ভাষা বুঝতো! তাহলে বাটাম দিয়ে তোমার পেছন পার্টে নকশা করে দিতো। আর তোমার বাপ বাংলাদেশে বসে কপাল চাপড়াতো।" (পৃথা)

প্রত্যয় এতোক্ষণ চুপই ছিলো বাট পৃথার আর সাদের কথা শুনে প্রত্যয় হেসে দিলো। সাদ আর পৃথার সাথে থাকলে না হেসে পারা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন