রংধনু - পর্ব ১৩ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


আকাশের তারা গুলো ভীষন ভাবে জ্বলছে।বাহির থেকে শনশন করে বয়ে আসছে শীতল বাতাস।বেলা শাড়ীর আঁচলটাকে মোটা করে গায়ে জড়িয়ে নিলো।রুম থেকে বিভানের গুনগুন করে গান করার আওয়াজ আসছে।লোকটা কি ডাকবেও না?কেমন সে?বেলা সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো।হঠাৎ বিভানের গান অফ হয়ে গেলো।কোন সাড়াশব্দ নেই তার।কিছুক্ষন পার হতেই বেলা খেয়াল করলো রুমের আলো নিভে গেছে।লোকটাকি চাইছে ও এখানে থাকুক?ডাকছেনা কেন?বেলা রেগে থাকার চেষ্টা করে ও থাকতে পারেনা।রুমে উঁকি দিতেই ওর বাহু টেনে রুমে ঢুকিয়ে নেয় বিভান।বেলা কিছু টা ভয় পেয়ে যায়।কিন্ত বিভান কে দেখে নিজেকে সামলে বলল,

''ঘুমাননি?ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছেন।"

বেলাকে কাছে এনে ওর শাড়ীর আঁচল ঠিক করে দিতে দিতে বিভান বলল,

''আমার বৌ বাহিরে দাঁড়িয়ে আর আমি ঘুমাবো কি করে বলো?"
''তাহলে ডাকছিলেননা যে?"
''দেখতে চাইছিলাম কতক্ষন থাকতে পারো?"

বেলা মাথা নিচু করে বিভান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানায় এসে বসে।শোয়ার জন্য বালিশ ঠিক করছে।বিভান বুঝতে পেলো তখন ওর প্রেমের কথায় বেলার খারাপ লাগছে।বেলার পাশে খাটে এসে বসলো।তারপর বালিশ বেলার হাত থেকে নিয়ে বলল,

''মন খারাপ?"
''না ঘুমাবো। "

বিভান বেলাকে এবার জোর করে ধরে।তারপর মোটা গলায় বলল,

''কথা শুনো আমার।ভালো মতো শুনো।পুরো কথা না শুনে ব্যালকনিতে গেলা।এটা কেমন কথা?"

বেলার চোখ কুঁচকে আসে।ভীত গলায় বলল,

''বিভান এমন করছেন কেন?এভাবে কেন কথা বলছেন?"
''তাহলে কিভাবে বলবো?ভাবলাম তুমি আমার কাছে আসবে।পুরোটা কথা শুনবে।কিন্তু তুমি আসলেনা।জেদ করে দাঁড়িয়ে থাকলে।তোমাকে টেনে নিয়ে আসলাম।রুমে এসে ও কথা বলছোনা।"

বেলার খারাপ লাগছে।বিয়ের এতোটা দিনে লোকটা এভাবে কথা বলেনি কখনো।বেলা কিছু বলছেনা দেখে বিভান ওকে ছেড়ে দিলো রাগ হয়ে তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে উল্টো পাশ ফিরে বসে।বেলা ডাকতে গিয়ে ও পারেনা।চোখে অশ্রু এসে জমা হয়েছে।কান্নার দমক সামলে শুয়ে পড়ে।বিভান তখন ধুমপানে ব্যাস্ত।বেলা পিছনে আড় চোখে বিভান কে একবার দেখে নেয়।লোকটা বসে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে।বেলা চোখ মুছে নিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে।কিন্তু ঘুম আসছেনা।পাশ থেকে ধুমপানের বিশ্রী গন্ধ নাকে  আসতেই বমি আসতে চায়।বেলা নাকে কাথা চেঁপে চোখ বুজে শুয়ে থাকে।অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো।বেলার চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে কাউকেই পেলোনা।রুমে সবজায়গায় চোখ বুলিয়ে নিলো ও।লোকটা গেলো কই?বেলার চিন্তা হচ্ছে।শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ে বেলা।মানুষটা গেলো কই?এদিকে হোটেলের ছাদে উঠে দাড়িয়ে আছে বিভান।দুতিনটে সিগারেট শেষ করেই কিরনকে কল দেয়।কিরনের নম্বর প্রথম দুবার ওয়েটিং পেয়ে রেখে দেয়।কিছুসময় পর কল এলো কিরনের নম্বর থেকে।বিভান ভ্রু কুঁচকে নম্বর দেখে বিড়বিড় করে রামছাগলের তাহলে প্রেম করা শেষ হয়েছে।কল রিসিভ করে কানে ধরে বিভান।অপরপাশ থেকে কিরন বলল,

''কি গো ভাই বিভান অমন রোমাঞ্চকর রাতে আমাকে কল দিচ্ছো।বিবিজান কি ঘুমে?"
''শুনো একদম উল্টাপাল্টা বকবেনা।তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?"
''বিন্তীর সাথে।ওদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো তাই খুঁটিনাটি বুঝাচ্ছিলো।"
''ওহ।ভালো।"
''হুম।তা তোমার চারপাশের পরিবেশ এতো নিরব কেন?মনে হচ্ছে একদম একা?"
''আমি একাই।"
''কেন বেলা কই?"
''রুমে।আমি ছাদে।"
''কি নিরামিশ লোক তুমি।ছিঃ ছিঃ!"
''এখানে ছিঃ ছিঃ এর কি হলো?"
''সব কি বুঝিয়ে দিবো আমি?তোমার মাথা মন্ডু কিছু নেই নাকি?আস্তা গন্ডার তুমি।"

অপরপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠে কিরন।বিভান বুঝতে পারেনা কিরনের রেগে যাওয়ার কারন।ও দ্বিগুন রেগে বলল,

''এসব কি ধরনের শব্দ ব্যাবহার করছো?যা বলার সরাসরি বলো।"
''ওহহো কি নিশ্পাপ আমাদের বিভান শেখ।যাইহোক বললাম বৌয়ের সাথে একটু আনন্দ তো নিতে পারো অতো রাত বিরাত ছাদে না কাঁটিয়ে।"
''আমি রুমে যাবো বাট দেরি করে।"

বলেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে বিভান।কিরন বিভানের কন্ঠে অভিমানের আভাস পায়।ও বলল,

''কিরে রাগ করে এলা নাকি?"
''না তেমন কিছুনা।জাস্ট ভাল লাগছেনা।।"
''বিভান একটা কথা বলি তোমাদের বিয়ে বেলা ভাবির পরিবার মেনে নিতে পারেনি।তো বুঝতেই পারছো ভাবির মানসিক অবস্থা। বেচারী রুমে একা।তুমি এখানে ীচলে এসেছো।এখন প্রত্যেকটা সময় তোমার সাপোর্ট লাগবে ওনার।কাল ইন্ডিয়া যাওয়ার পর আন্টি ওনাকে মেনে না নিলে বুঝতে পারছো কতোটা হেল্পলেস থাকবেন ওনি?একমাত্র তুমি আপন ওনার।আর কেউ নেই।আমার মনে হয়না এর বেশি কিছু বলতে হবে।"
''কিরন তোমাকে জুয়েনার কথা বলেছিলাম মনে আছে?"
''হ্যা আছে।কেন?"
''বেলা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো আগে কোন প্রেম ছিলো নাকি আমার?আমি বলে দেই। এরপর ও ব্যালকনিতে চলে যায় আর ফিরে আসেনা।আমি রুমে নিয়ে এলাম।জিজ্ঞেস করার পর ও ত্যাড়া উত্তর দিচ্ছে।"
''তাই বলে তুমি রেগে এসে গেছো?"
''জি।"
''সিরিয়াসলি বিভান।কেমন করে পারলা?বিভান জুয়েনা তোমার অতীত সেটা কিন্তু অতীতই রয়ে যাবে।কখনো মিথ্যা হবে না।ভাবি তোমার বর্তমান ভবিষ্যৎ।কোন স্ত্রীই কিন্তু তার স্বামীর অতীতের কোন প্রেমিকাকে মেনে নিতে পারেনা।ঠিক ভাবি ও সেম।ওনার জীবনে তুমিই প্রথম।বিভান দেরি করোনা রুমে যাও।দেখো কি করছেন ভাবি?আর এভাবে রাগ করোনা।"
''হুম।"
_________________________________________
বিভান কল কেঁটে দিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে।কিরন যা বলছিলো ভুল বলেনি।বেলার সাথে এমন টা করা ঠিক হয়নি।যতোটা সম্ভব মনে হয়না মা ওকে মানবে।বিভানের ওর সাথে থাকা উচিৎ সাপোর্ট দেয়া উচিৎ রেগে থাকা নয়। 
ফোন টা পকেটে রেখে নিচে আসে বিভান।রুমে ঢুকে দেখলো বেলা বসে আছে।কাঁদছে মেয়েটা।বিভান প্রথমে বুঝতে না পেরে বলল,

''ঘুমাওনি?"

বিভানের কথার জবাব না দিয়ে ক্রন্দনরত  বেলা বলল,

''রাতে অন্ধকারে একা ভয় লাগে আমার।"

বিভান জুতা খুলে বলল,

''আ'ম সরি বেলা।এভাবে রেখে যাওয়া ভুল ছিলো আমার।"

বেলা কিছু বললনা।নীরবে কাঁদছে ও।বিভান এসে ওর পাশে বসে বেলার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,

''আর হবেনা বেলা।তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলে তারওপর জানতে ও চাচ্ছিলেনা পুরোটুকু্।রুমে এসে কথা ও বলছিলেনা তাই রাগ হয়েছিলো আমার।"

বেলা নাক টানতে টানতে বলল,

''আপনি কই ছিলেন?"
''ছাদে।"
''ওহ।"

বিভান কিছু না বলে বেলার গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।বেলা মৃদু হাসে।বিভান বেলাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে।জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে লাগিয়ে রাখে।পরদিন সকালে আদনান আর সাঁঝ কল দিয়ে জানায় ওরা আসবে।বেলা আর বিভান নিজেদের বাকি কিছু কাজ সেড়ে নেয়।বিকেলে সাঁঝ আর আদনানকে আসতে দেখা গেলো।লাঞ্চ সেড়ে বেলা আর বিভান রেস্ট নিচ্ছিলো।সাত টায় বেরিয়ে পড়বে ওরা।তাই এখন রেস্ট করা দরকার 
তখনই আদনানের নক পড়ে দরজায়।বেলা উঠে দরজা খুলে ভাইবোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো।সাঁঝ স্কুলের জামা পড়ে আছে।দুটো বেনী ঝুলছে মাথায়।
বেলার কাছে আসার সময় সাঁঝ আদনান দুজনের কান্না পাচ্ছিলো।বেলার জড়ায় ধরায় ওদের কান্না আটকাতে চায়না।সাঁঝ কেঁদে দিলো।আদনান কোনমতে সরে আসে চোখ মুছে।বিভানের সাথে কোলাকুলি করে নেয়।

''ভালো আছো আদনান?"
''আলহামদুলিল্লাহ আপনি?"
''আলহামদুলিল্লাহ। সবাই ভালো?"
''এইতো।আম্মা কান্না করে সারাদিন।ভাই কিছুই বলেনা।আব্বা ও আগের মতোই।"
''ওহ।যথাসম্ভব বুঝানোর চেষ্টা করো আদনান।"
''ভাই আব্বা আর ভাইয়া কি পরিমানে রেগে আছে।বাসায় টোটালি কথা বলেনা দুজন।"

আদনানের কথায় বেলার ভীষন খারাপ লাগে।বেলা বলল,

''তোরা বস।"

আদনান আর সাঁঝ বসে পড়লো।বেলা ওদের সাথে বসে কথা বলছে।বিভান ইন্টারকমে কল দিয়ে খাওয়া পাঠাতে বলল।আদনান আর সাঁঝ বেশি সময় কাঁটাতে পারেনি।কারন দেরি হলে নিশাদের সন্দেহ হবে।তাই ওরা বেরিয়ে পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।বেলার ইচ্ছে হচ্ছিলোনা বিদায় দিতে।কিন্তু নিশাদ জানলে খবর আছে।ওদের বেরুনোর সময় বেলা ওদের ধরে খুব কান্না করে। সবার খেয়াল রাখতে অনুরোধ করে।বোনকে বুঝিয়ে বেরিয়ে গেলো ওরা। 
বিভান বেলাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা সাতটায় রুম ভাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ে বেলা বিভান।এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে।বেলা বিভানকে বলল,

''আপনার মা জানে?"
''হুম।"
''আমার সাথে কথা বলেনি বা বলতে চায়নি?"

গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বিভান বলল,

''বেলা স্বাভাবিক ভাবে মা ও রেগে আছে।তবে চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।"
''বিভান সব আমার দোষ।আমার কারনে দুটো পরিবার রেগে।"

বিভান মাথা ঘুরিয়ে বেলার দিকে তাকায়।তারপর বলল,

''বেলা দোষ তোমার কখনোই না।ভাগ্যে যা ছিলো হয়েছে।এখনো যা হবে সবই ভাগ্য।সুতরাং নিজেকে বারবার দোষারোপ করোনা।"

বেলা বিভানের হাত ছুঁয়ে দেয় আস্তে করে।বিভান একটু হাসে আড় চোখে বেলাকে দেখে।চল্লিশ মিনিটের বিমান পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতায়।প্রায় চারঘন্টা পঞ্চাশ মিনিটের বিমান পথ পাড়ি দিয়ে ওরা দিল্লি পৌছে গেলো।সেখানে বিভানের গাড়ি এসে পৌছোয় ঘন্টা খানেক পর।এয়ারপোর্টের সকল কার্যরম শেষ করে বেরিয়ে আসতেই একজন লোক দৌড়ে এসে বিভান কে জড়িয়ে ধরে।বিভান হেসে লোকটাকে জড়িয়ে আছে।লোকটা নিজেদের ভাষায় বলল,

''বহত দিন রুকে হো বাংলাদেশ মে।তো কেয়া লায়ে হো?"
''বিবি।নিকাহ কারলি হ্যায় ম্যায়েনে।"
''সাচ???কেয়া বাত হ্যায় বিভান সাহাব?বাংলাদেশ গায়ে থে ঘুমনে কেলিয়ে নিকাহ কারলি?লাভ হ্যা ইয়া এ্যারেঞ্জ?"
''লাভ হ্যা।"

মুচকি হাসে বিভান।বেলা ভ্রু কুঁচকে দেখছে দুজনকে। লোকটা আবার বলল,

''কাহা পার হে ভাবিজি?"

বিভান বেলার দিকে চেয়ে বলল,

''বেলা ও আমার বন্ধু সামীর হুসাইন।"

বেলা ধীরে সালাম দিলো।সালামের উত্তর দিয়ে 
সামীর বিভানকে বলল,

''আচ্ছি হ্যায় ভাবি জি।খুবসুরত হ্যায়।পার উনকে রং থোরি শামলা হ্যায়।"
''মুঝে ফারাক নেহি পারতা ইসসে।"

বলে বেলার হাত চেঁপে ধরে।সামীর হেসে বলল,

''হাম তুমহারে আম্মিকি বাত  ক্যাহে রাহে থে।"

বিভান হেসে সামীরের কাঁধে হাত রেখে বলল,

''মানা লেঙ্গে। "

লোকটা হেসে বিদায় নেয়।বেলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিভান নেহরু রোডের উদ্দেশ্যে।বেলা গাড়িতে বিভানকে জিজ্ঞেস করে,

''আপনার বন্ধু কি বলছিলো?"
''তেমন কিছুনা বেলা।হায় হ্যালো।"
''বিভান মা কি খুব রেগে আছে?"
''একটু বেলা।"
 
বেলার মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে।কি করে সামলাবে ও সব?নেহরু রোডের সাদা বাড়িটির সামনে থামলো ওরা।আশেপাশে অসংখ্য মুসলিম ভারতীয় লোকের বাস।বেলা নেমে আশেপাশে দেখতে থাকে।জায়গাটা একদম নীরব।সামনে বেশ ঘনবসতি ছিলো কিন্তু এই জায়গা একদম সুনসান।

!!!!

সরু সাদা রাস্তাটা ধরে বেলা হেঁটে চলেছে বাড়িটির দিকে।বিভান বেলার হাত ধরে আছে।অনুভব করছে বেলার হাতটা ভীষন কাঁপছে বিভানের হাতের মাঝে।বিভান অবাক হয়ে বেলাকে দেখে।ওর কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে আছে।চোখের কোনে অশ্রু আটকে রেখেছে।বিভান বেলাকে টেনে কাছে নিয়ে এলো।বেলার কাঁধে হাত রেখে  বলল,

''একদম ভয় পেওনা।আমি জানি তুমি সব মানিয়ে নিতে পারবে।তাছাড়া আমি আছি বেলা।"

বেলার গলা ধরে আসে।চোখের পানি ছেড়ে দেয় ও।কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,

''ওনি খুব রেগে আছেন।"

বিভানের মুখে ফুঁটে উঠে একটু হাসি।বেলার ঠোঁট কাঁপছে।বিভান বেলার কাছে এগিয়ে এলো।দুহাতে ওর গাল জড়িয়ে ধরে বলল,

''আগে ও বলেছি এখনো বলছি।রেগে থাকা স্বাভাবিক।কিন্তু আমরা চেষ্টা করবো।তোমার সাথে আছি আমি।কিছু হবেনা।"

বেলার ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি।চোখজোড়া অনেকটা উজ্জ্বল হয়ে এসেছে।বিভান মৃদুহেসে বেলার ঠোঁটের কোনে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয় কিন্তু ভালবাসার ছোঁয়া এঁকে দেয়নি।পরক্ষনেই বেলার হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে।ঘরের ডোরবেল বাজিয়ে বেলার দিকে একটু হাসে বিভান।নবেলা মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়।বিভানের হাসিতে ও মোটে ও হাসতে পারছেনা ও।গলা শুকিয়ে কাঠ। বেলা মনে মনে সূরা আওড়াচ্ছে।ভিতর থেকে কারোর কথার শব্দ আসছে।কাউকে যেন ডাকছে কেউ।বিভানের মুখে চাঁপা হাসি।বেলা দরজার দিকে একবার তাকায় পরক্ষনে মাথা নামিয়ে নেয়।কিছুক্ষন পর দরজা খোলার শব্দ হলো।দরজার হাতল ঘুরিয়ে কেউ যেন দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ায়।বেলা সামনে দেখলো সাদা শাড়ী পরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।তার পা দেখা যাচ্ছে শুধু।পাশ থেকে বিভান (হিন্দিতে)বলল,

''মা কই?"

সামনের মহিলা কন্ঠে সৌজন্যতা রেখে ধীরে বলল,

''স্যার ম্যাম বাহিরে গেছেন।কিছুক্ষন পরেই চলে আসবেন।"
''ওকে।"

বিভান বেলার দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে বলল,

''বেলা চলো।"

বেলা কেঁপে উঠে।এতক্ষন চেঁপে রেখেছিলো নিজেকে।বিভানের পানে তাকায় ও।বিভান বেলার তাকানো দেখে বলল,

''মা বাসায় নেই এখন।চলো।"
''নেই কেন?"
''কাজে গেছে হয়ত। চলো।"

বেলা কে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে বিভান।ওদের লাগেজ ব্যাগ ড্রাইভার আর দারোয়ান নিয়ে আসে।বেলা পুরো বাড়িটা দেখে নিচ্ছে।সুন্দর করে গোছানো বাড়ি।আধুনিক আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো।বেলা ঘরটাকে দেখে বিভানের সাথে সিড়ি বেয়ে উঠে যেতে থাকে।বিভান বেলাকে এটা ওটা বলছে।বেলা হু হা করে উত্তর করছে।বিভান হঠাৎ থেমে গেলো।বেলা বলল,

''কি হলো থেমে গেলেন যে?"

বিভান পিছনে ফিরে বেলার দিকে তাকায়।তারপর বলল,

''একটা কাজ বাকি।"
''সেটা কি?"

বিভান মৃদু হেসে বেলার দিকে এগিয়ে আসে।বেলা দাঁড়িয়ে দেখছে কি করতে চায় লোকটা?বিভান এসেই বেলাকে কোলে তুলে নেয়।বেলা এমনটা চিন্তাই করেনি।এসব হয় শুধু সিনেমাতে।বাস্তব জীবনে এমন হয় কখনো ভাবেনি।বিভান কোলে নিয়ে বলল,

''আজ তোমার প্রথম প্রবেশ আমার ঘরে।তাই কোলে নিয়ে আমাদের রুমে যাবে।তুমি চাইলে আজ থেকে এভাবে প্রত্যেক দিন নিতে পারি।"

বেলার মুখ লজ্জায় লাল।ও বলতে লাগলো,

''নামিয়ে দিন।ঘরে সার্ভেন্টস রা আছে।"
''তো কি হয়েছে?আমার নিজের পার্সোনাল বৌ।আর কারো বৌ তো নও।চলো রুমে।"

বেলাকে নিয়ে হেঁটে রুমে আসে বিভান।বেলা দেখলো বেশ বড় রুমটি।জানালা গুলো সাদা পর্দায় ঢাকা।ফ্লোরের ওপর সাদা পশমি পাপোশ বিছানো।বিছানার চাদরটাও সাদা।বেলাকে নিচে নামিয়ে দেয় বিভান।বেলা রুমে হেঁটে বিছানার চাদর আলতো করে স্পর্শ করে।পিছন থেকে বিভান বলল,

''আমাদের রুম বেলা।"

বেলার মুখে লজ্জা মাখা হাসি।ও বলল,

''খুব সুন্দর গুছানো আপনার রুম।"
''হুম।তবে আমি কিন্তু বেশ অগোছালো।"

স্বামীর দিকে চেয়ে হাসে বেলা।ও বলল,

''সমস্যা নেই এসে গেছি আমি।গুছিয়ে দিবো এখন থেকে।"

বিভান হেসে বেলার পাশে এসে বসে।এদিকে সন্ধ্যায় বন্দনা আখতারকে আসতে দেখা গেলো।বেলা বিকেলে নিচে নেমে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো।বিভান তখন ও ঘুমিয়ে।সারাদিনের জার্নির পর দুজন খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।বিকেলে ঘুম ভেঙ্গে বেলা উঠে দেখলো লোকটা ঘুমিয়ে আছে।
বেলা স্বামীর দিকে একটু হেসে বেরিয়ে পড়ে নিচে যাওয়ার জন্য।বেলা নিচে এলে কাজের লোকগুলো ওকে ইশারায় সালাম জানিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসতে দেয়।কিন্তু বেলা বসে নি পুরো বাড়ি ঘুরে দেখার ইচ্ছে হলো ওর।হেঁটে হেঁটে সব কিছু দেখছিলো বেলা তখনই একজন মহিলা ঘরে ঢুকতে দেখে। তার গায়ে সাদা সিল্কের শাড়ী।মাথায় আধপাকা চুল চোখে গোল্ডেন কালারের গোলফ্রেমের চশমা।মহিলা হেঁটে হেঁটে বেলার দিকে আসছে।বেলা দাঁড়িয়ে গেলো।ওনি কি বিভানের মা নন তো?বেলা কি করতে নেমে ছিলো।বিভানই তো পরিচয় করাতে পারতো।বেলার পুরো শরীর কাঁপছে।মাথা ঘুরছে।মহিলাটি যতো এগিয়ে আসছে তার চোখ মুছে আক্রোশের ছায়া ততো গাঢ় হচ্ছে। বেলা মাথায় ঘোমটা টেনে নিচে তাকায়।ততক্ষনে মহিলা ওর কাছে এসে দাঁড়ায়।বেলার চোখজোড়ায় অশ্রু ভারি হয়ে আসছে ক্রমশ।মহিলা চোখ থেকে চশমা একটু খুলে হিন্দিতে বলল,

''কি করছিস এখানে?কে তুই?"

বেলা কিছুই বুঝতে পারছেনা।
________________________________________
ওর কান্না পাচ্ছে। ও কি করবে এখন?মহিলা আবার বলল, 

''কি পরে আছো?এতো বিশ্রী শাড়ী পরে ঘরে কেউ হাঁটেনা।ছিঃ"

বেলার ভয়ে যেন ওর সব শুকিয়ে আছে।কাঁপা গলায় একটা কথাই বলল,

''বিভান!!"

মহিলা রেগে গেলো।চেঁচিয়ে বলল, 

''আমার ছেলের নামধরে ডাকছিস কে তুই?"

বেলা কিছুই বলতে পারছেনা।মহিলা এবার বলতে লাগলো,

''অবশ্য তোকে চিনতে আমার সমস্যা হয়নি।তুই আমার ছেলের মাথা খেয়েছিস।ছোট লোক একটা।আমার ছেলের মতো সুন্দর ধনী লোক পেয়ে ভেবেছিস বিয়ে করে এখানে এসে শান্তিতে দিন কাঁটিয়ে দিবি।আমার ছেলেটাও কি?বেকুবের হদ্দ হয়েছে।এমন মেয়ের প্ররোচনায় কেমনে পড়ে গেলো? তোরা বাঙ্গালীরা অশিক্ষিত অসুন্দর আনকালচারড।"

বেলা বাঙ্গালী কথাটি শুনে ঠিকই বুঝতে পেলো।ওনার এক্সপ্রেশন দেখে ঠিকই বুঝতে পেলো খুব রেগে গেছেন ওনি।ওকে পছন্দ করেননি।বেলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

''প্লিজ মাফ করে দিন।কিছুই করেনি আমি।"

মহিলা বেলার চুল টেনে ধরে বলল,

''তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।তবে ন্যাকা কান্না একদম করবিনা।আমার ছেলে কে শেষ করতে এসেছিস।"

এদিকে নিচে হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙ্গে বিভানের।পাশে বেলাকে না পেয়ে বিভান উঠে বসে পড়ে খাটে।ভাবতে থাকে বেলা কই।কাঁদছে কেন ও?মা আসেনি তো?বিভান গায়ে শার্ট জড়িয়ে নিচে নেমে আসার জন্য প্রস্তুত হয়।বেলা কে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন বন্দনা আখতার।ছেলে কে নামতে দেখে বেলার চুল ছেড়ে দিলেন।বিভান নিচে এসে বলল,

''সব ঠিক আছে?"

বিভান কে দেখে বন্দনা আখতার বলেন,

''কিছুই ঠিক নেই।"

বেলা কাঁদছে।বিভান বেলার কাঁধ ধরে বলল,

''মা ও আমার স্ত্রী বেলা।আমার কারনই ও এখানে।"

বন্দনা আখতার ছেলের কথায় প্রচন্ড রেগে বললেন,

''থাক বৌ নিয়ে।"

বলেই ওনি সে জায়গা প্রস্থান করলেন।বেলা কাঁদতে থাকে।বিভান মায়ের যাওয়ার দিকে বেলাকে নিয়ে রুমে চলে আসে।ওকে খাটে বসিয়ে পাশে বসে পড়ে বিভান।বেলার হাতজোড়া দুহাতে জড়িয়ে বলল,

''মাফ করো বেলা।আমি তোমার সাথে ছিলাম না।"
''না ঠিক আছে বিভান।ওনি মা।রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক তাইনা?"
''হুম।"

বেলাকে বুকে টেনে নেয় বিভান।ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

''বেলা তোমাকে আমি সবসময় ভালোবাসি।যেকোন পরিস্থিতিতে তোমাকে ভালবাসি।কখনো মনে এনোনা কারো কথায় তোমাকে ছেড়ে দেবো।"

বেলা বিভানকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। রাতে বিভান মায়ের রুমে সে।ছেলেকে আসতে দেখে বন্দনা আখতার মুখ ফিরিয়ে বসেন।বিভান মায়ের পাশে বসে বলল,

''মা বেলা আমার স্ত্রী। আমি ওকে ভালবাসি মা।খুব ভালবাসি।মা বেলাকে যা ভাবছিলে ও একদমই ওরকম না। খুব শান্ত সহজ সরল ও।ও আসতে রাজি হয়নি।আমি ওকে ভালবাসিয়েছি মা।আমার জন্যই এসেছে ও এখানে।ওর এখানে আমরা ছাড়া কেউ নেই।ও খুব ভালো মা।আমাদের ভাষা পারেনা।মা তুমি ওকে ভালবাসলে খুব ভালো বৌ পাবে ওর মাঝে।"

বন্দনা আখতার কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন।বিভান ভেবেছিলো মা হয়ত কয়েকদিন রেগে থাকবেন তারপর রাজি হয়ে যাবে।ওনার রেগে থাকার দিন পেরিয়ে যেতে থাকে।অনেকদিন চলে যায়।বন্দনা আখতার বিভানের সাথে ও তেমন কথা বলেননি।রুম থেকে ও বের হতেননা।এদিকে নিশাদের মন কিছুটা নরম হয়েছে।তবে পুরোপুরি নয়।
সাঁঝ ভাবছে ভাইকে বুঝাবে ও।ভাই যেন আপার সাথে কথা বলে।একয়দিন নিশাদ একটু আধটু কথা বলেছে সাঁঝের সাথে।তাই সাঁঝ সেই সুযোগটাই নেবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন