হঠাৎ মনে হলো দুজন ছেলে তার পিছু নিয়েছে। অন্না সেদিকে যাচ্ছে ছেলেদুটো সেদিকে যাচ্ছে। ছেলেদুটো অন্নার খুব কাছে চলে আসলেই অন্না হাটার গতি বাড়ায়। কিন্তু মরার শাড়ি পড়ে দ্রুত হাটাও যাচ্ছে না। এদিকে ছেলেগুলো ও নিজেদের গতি বাড়ায়। অন্নার বুকে একরাশ ভয় ভিড় করে। আরো দ্রুত হাটতে গেলে শাড়িতে পা টা আটকে যায়। আর অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে নেয় অন্না। ভেবেছিলো নাক মুখ বোধহয় গেলো, কিন্তু তখনই একজোড়া বলিষ্ট হাত থাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। সেকেন্ড পনেরো ব্যাথার অনুভূতি না হলে চোখ পিটপিট করে খোলে অন্না। না হাত মুখ কিছুই ভাঙ্গে নি, বরং খানিকটা শূন্যে ভেসে রয়েছে সে। মাথাটা তুলতেই মনে শীতল প্রবাহ বয়ে যায় অন্নার। আকাশের শুভ্র চাঁদ হাতে পাবার মতো আনন্দ হচ্ছিলো অন্নার। তার মনমন্দিরের ভগবান যেনো পায়ে হেটে তার কাছে এসেছে। এই একটা সপ্তাহ মানুষটাকে একনজর দেখার জন্য মনটা ঝুকে ছিলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নয় বরং তার একান্ত প্রিয় ব্যাক্তি, অর্জুন দা। কালো একটি টিশার্ট, কালো থ্রি- কোয়ার্টার প্যান্ট এবং পায়ে বার্মিজের চটি পড়ে রয়েছে সে। হয়তো পাড়ায় কোনো কাজে বেড়িয়েছিলো। চুল গুলো কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। অন্য সময় বেশ কায়দা করে চুলগুলো গুছিয়ে রাখে সে। কিন্তু আজ বড্ড এলোমেলো হয়ে রয়েছে চুল, অবশ্য তাতেও যে কারোর বুকের স্পন্দন বাড়াতে যথেষ্ট। অর্জুন পেছনের উপস্থিত ছেলেগুলোর দিকে কড়া অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করলো। এই দৃষ্টিটি অর্জুনদার ব্রহ্মাশ্র। যে কেউ দেখলেই গলা শুকিয়ে ফেলবে। ছেলেগুলোর ও একই অবস্থা হলো। ভো দৌড় দিলো তারা। এতক্ষণ অন্না তার বাহুর আলিঙ্গনে ছিলো। ছেলেগুলো চলে যাবার পর খানিকটা ধাক্কা দিয়েই অন্নাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। যেনো কোনো আবর্জনা তার গায়ে লেপ্টে আছে। খুব বিতৃষ্ণার দৃষ্টি প্রয়োগ করে গটগট করে হাটা দেয়। অন্নার মনটা যত তাড়াতাড়ি উচ্ছ্বাসিত হয়েছিলো তত তাড়াতাড়ি মিয়ে গেলো। লোকটা এমন ব্যাবহারটুকু না করলেও পারতো। অন্না তো তার অপরিচিত মানুষ নয়। নিজের উপর ও বেশ রাগ হলো অন্নার। এতো বেহায়া কেনো সে! যে মানুষটার তার অস্তিত্বে কিছুই যায় আসে না। সেই মানুষটাকে নিয়ে সে কাতর হয় কেনো? কেনো এতো ব্যাকুল হয়ে উঠে তার একদর্শনের জন্য! অর্জুন হঠাৎ থেমে ঘাড়টা কাত করে মলিন কন্ঠে বলে,
- নৌকাডুবিতে কবি রমেশের জন্য হেমনলিনীকে অপেক্ষারত রেখেছিলেন। কমলার সাথে বিয়োগের পর ও হেমনলিনীকে রমেশ পেয়েছিলো। কিন্তু আমার জন্য ভগবাণ কোনো হেমনলিনীকে বরাদ্ধ রাখেন নি! তাই আমার যন্ত্রণা কমবার নয়।
বলেই গটগট করে হাটা দেয় অর্জুন। অর্জুনের কথাটা শুনে অন্নার একটা কথাই বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো,
"হেমনলিনী এখনো অপেক্ষারত রয়েছে। কিন্তু আফসোস রমেশের সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই"
চোখগুলো জ্বলছে অন্নার। বোকা মনটা কাঁদতে চাইছে, কেনো! এতো কিসের কষ্ট তার। সে তো আগ থেকেই জানতো এই মানুষটাকে যতই পুজো করো, মানুষটার মনে তার কোনো ঠায় হবে না। তাহলে কেনো! অন্না করুণ চোখে অর্জুনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ তার অবয়ব দেখা যায় ততক্ষণ। ঐ যে বেহায়া মন!!!
পার্কের বেঞ্চিতে বসে রয়েছে কৃষ্ণা এবং দেবব্রত। পড়ন্ত বিকেলের মৃদু কিরণ আছড়ে পড়ছে কৃষ্ণার মুখে। এই সময়টাকে গোধুলি বলে আক্ষ্যায়িত করা হয়। এই কিরণে সামান্য ধুলিকণাকেও নাকি কাচের কণার মতো লাগে। দেবব্রতের পাশে তো জীবন্ত প্রতিমা বসা। তাকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগছে না। আজকাল দেবব্রতের শুধু কৃষ্ণাকে দেখতে মন চায়। যতই দেখুক না কেনো আরোও দেখতে মনে চায়। কৃষ্ণা আগ্রহী চোখে সামনের উপস্থিত বাচ্চাদের খেলা দেখছে। তার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। আর দেবব্রতের চোখ শুধু কৃষ্ণার দিকে। হঠাৎ একটা ছোট মেয়ে এসে বলে,
- সাহেব মালা নিবেন? বেলীফুলের মালা, অনেক গন্ধ
- না নিবো না।
- নেন না সাহেব
দেবব্রত খানিকটা বিরক্ত হলো। তার ফুলের গন্ধে এলার্জি। একদম নিতে পারে না। একটু কড়া কন্ঠে বললো,
- আমাদের লাগবে না, বললাম তো
মেয়েটির মুখটা কালো হয়ে গেলো। কৃষ্ণারও খুব ইচ্ছে ছিলো বেলীফুলের মালা কেনার। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
- একটা মালা কিনে নিবেন?
- তোর ভালো লাগে মালাটালা?
- হ্যা, বেলীফুলের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।
কৃষ্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না দেবব্রত। মেয়েটির হাতে একশত টাকার একখানা নোট ধরিয়ে একটা মালা কিনলো সে। কৃষ্ণা মালাটা হাতে নিয়ে পরম আনন্দে তার গন্ধ নিলো। তার খুব ইচ্ছে ছিলো দেবব্রতের হাতে খোপায় মালাটা পড়বে। কিন্তু তার আগেই দেবব্রত বললো,
- কৃষ্ণা, মালাটা কি ব্যাগে রাখবি একটু। আমার মাথা ব্যাথা করছে। আসলে আমার ফুলের গন্ধে এলার্জি।
দেবব্রতের চোখ লাল হয়ে এসেছে। তার যে খারাপ লাগছে এটা বুঝতে দেরি হলো না কৃষ্ণার। তাই মনের সাধ থাকা স্বত্তেও কোনো কথা বলতে পারে নি সে। মনের কোথাও না কোথাও একটা খারাপ লাগা কাজ করতে লাগলো। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না কৃষ্ণা। কৃষ্ণার এই একটা গুণ যা তাকে অনেকের কাছ থেকে তাকে আলাদা করেছে। সে কখনোই নিজের মনের অনুভূতি মুখে প্রকাশ হতে দেয় না। তাই দেবব্রত পাশে থাকা স্বত্তেও বুঝলো না তার কিশোরী বউ এর মনে অজান্তেই খানিকটা চির ধরিয়েছে। জানবেই বা কি করে, এর আগে কখনো প্রেমিকার জন্য বেলীফুলের মালা কিংবা রেশমি চুড়ি কেনা পড়ে নি তার। সৌদামিনীর চাহিদাগুলো এতোটা সাধারণ ছিলো না, এটাই হয়তো ব্যাক্তি বিশেষের পার্থক্য। সূর্যাস্ত হচ্ছে, লাল রক্তিম সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। দেবব্রতের হাতের মুঠোয় কৃষ্ণার ছোট্ট হাতটি। দেবব্রত আগলে রেখেছে হাতটা। কৃষ্ণার ঠোঁটে মায়াবী হাসি। এই হাসি যেনো দেবব্রতের হৃদয়ের তীরের মতো যেয়ে লাগে। সময়টা থেমে গেলে হয়তো মন্দ হতো না।
রাত ৮টা,
ভট্টাচার্য মঞ্জিল,
নারায়ন বাবু তার কাজের টেবিলে বসে রয়েছে। তিনি বেশ বিরক্তির সাথে কাগজ পত্র ঘাটছেন। আজকাল বাসায় সোমনাথের মেয়েকে যে আদিক্ষেতা শুরু হয়েছে সেটা তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু তিনি বলবেন ই বা কাকে! নিজের স্ত্রীকে, বাবাকে নাকি নিজের ছেলেকে। সে তো আবার সেই মেয়েকে সমাজের সামনে দ্বিতীয়বার মেয়েটিকে বিয়ে করবে। তার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বন্ধুদের সামনে নিজের বড়াই করার জায়গাটুকু তিনি খোয়াতে বসেছেন। কি বলবেন তার ছেলের বউ এর না আছে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা আর না আছে কোনো অভিজাত্য বংশ পরিচয়। তিনি তাই আজ ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন। দেবব্রতের সাথে সামনাসামনি কথা বলাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ দরজায় কড়া পড়লে ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে নারায়ন বাবুর। তখন শুনতে পান
- বাবা আসবো?
দেবব্রতের প্রশ্নে গলা খাকারি দিয়ে তিনি বলেন,
- আসো, বসো
- আমাকে ডেকেছিলেন? খুব জরুরি কিছু কি?
- শুনলাম তুমি নাকি কৃষ্ণাকে পুনরায় বিয়ে করবে?
- জ্বী ঠিক শুনেছেন। এক বছর পর ও অনার্সে ভর্তি হবে। ভেবেছি এর পর ই বিয়ের আয়োজনটা করবো।
- তুমি কি মেয়েটাকে নিজ স্ত্রী হিসেবে মেনে নিচ্ছো?
নারায়ন বাবুর কথায় খানিকটা নড়ে চড়ে বসে দেব। তার বুঝতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে বাবার কথার অন্তমর্ম। তাই নম্র কন্ঠে বলে,
- বাবা একটু খোলসা করবেন কি?
- আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিবে কি? একটা গেয়ো মেয়ে কি সত্যি তোমার পাশে যায় দেবব্রত? যদি কেউ কখনো তার বংশ পরিচয় কিংবা বাবা-মার পরিচয় বিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর দিতে পারবে তো? এই প্রশ্নের সম্মুখীন তোমাকে বহুবার হতে হবে। তোমার মতো উচ্চশিক্ষিত ছেলের সাথে বা আমাদের পরিবারের সাথে মেয়েটা কি আদৌ ও যায়?
নারায়ন বাবুর প্রশ্নে দেবব্রতের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে যায়। তারপর......
.
.
.
চলবে.............................