স্পৃহা পপকর্ন হাতে নিয়ে মুখে দিবে এমন সময় জীবন এসে তার সামনে দাঁড়াল। জীবনকে দেখে স্পৃহা কেশে উঠলো। হাত থেকে পপকর্ন পড়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে নিলে কোল থেকে পপকর্নের বাটি নিচে পড়ে গেল। জীবন স্পৃহার কান্ড দেখে না হেসে পারলো না। সে হেসে ফেলল। পেছন থেকে তোহা এসে বলল,
'পপকর্ন গুলো ফেলে দিলি আপু? তুই খাবি না ভালো কথা ফেলে দিলি কেন? আমি খেতাম তো।'
তোহার কোনো কথাই স্পৃহা বুঝতে পারছে না। সে ভূত দেখার মত করে জীবনের দিকে তাকিয়ে আছে। তানিয়া শব্দ শুনে বসার ঘরে এসে দেখে জীবন দাঁড়িয়ে আছে। জীবনকে দেখে ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন,
'বাবা তুমি! স্পৃহা তো বলেছিল তুমি দু'দিন পরে আসবে। তোমার নাকি অফিসে কী কাজ আছে।'
জীবন একবার স্পৃহাকে দেখে শাশুড়িকে সালাম দিয়ে বলল,
'কাজ ছিল। কিন্তু আমি সেটা ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। স্পৃহাকে একা পাঠিয়ে ভালো লাগছিল না। আপনাদের কথাও মনে পড়ছিল অনেক। তাই দু'দিন আগেই চলে এলাম।'
'ভালো করেছ বাবা। স্পৃহা জীবনকে রুমে নিয়ে যা। জার্নি করে এসেছে। ফ্রেশ হয়ে নিক।'
স্পৃহা হ্যা না কিছুই বলছে না। তোহা মিটমিট করে হাসছে। জীবনও স্পৃহার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কতদিন পর যেন স্পৃহাকে দেখলো। জীবন মনে মনে বলল,
'স্পৃহা তাহলে কাউকে কিছু জানায় নি? যাক ভালোই করেছে। এখন ওকে ফিরিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না।'
তানিয়া স্পৃহার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন,
'কি হলো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জীবন বাবা তুমি রুমে যাও।'
এই বলে তানিয়া রান্নাঘরে চলে গেল। স্পৃহা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন ভেবে আবার বসে পড়লো। তোহাকে বলল,
'সামনে থেকে সর। আমি এখন টিভি দেখব।'
তোহা কিন্তু তার পাশেই বসে ছিল। টিভির সামনে জীবন দাঁড়িয়ে আছে। স্পৃহা জীবনকে না বলে তোহাকে বলেছে। তোহা বলল,
'কানা ভালো করে দেখ। আমি তোর পাশেই বসে আছি। তুই আমাকে সামনে থেকে সরতে বলছিস কেন?'
জীবন স্পৃহার রাগ বুঝতে পারছে। সে বলল,
'আচ্ছা তাহলে আমিও টিভি দেখি একটু। তোহা আমাকে একটু বসার জায়গা দিবে? '
তোহা সাথে সাথে লাফিয়ে স্পৃহার পাশ থেকে সরে গিয়ে জীবনকে বসার জায়গা করে দিয়ে বলল,
'আপনি এখানে বসুন ভাইয়া। আপুর পাশে।'
বলেই তোহা চোখ টিপ দিলো। জীবনও হেসে মাথা নাড়ালো। জীবন স্পৃহার পাশে বসে আছে। স্পৃহার কেমন অস্বস্তি লাগছে। জীবন টিভির দিকে না তাকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতে অস্বস্তি আরো বেড়ে যাচ্ছে। অবশেষে স্পৃহা উঠে দাঁড়িয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে রুমের দিকে যেতে লাগলো। জীবনও দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
'তোমার বোন চলে গেছে। আমি আর টিভি দেখে কি করবো? তুমি দেখো। আমি রুমে যাই।'
তোহা ওদের দু'জনের মান অভিমান দেখে হেসে মরছে। হাসতে হাসতে বলল,
'আচ্ছা যান। বৌয়ের পেছনেই তো যাবেন।'
স্পৃহা রুমে এসে মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে ছিল। জীবন রুমে এসে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর স্পৃহাই নিজে থেকে বলল,
'আপনি এখানে কেন এসেছেন?'
জীবন স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
'শ্বশুরবাড়িতে লোকে কেন আসে? অফকোর্স বেড়াতে এসেছি।'
'আপনাকে আমি না করেছিলাম আমার পেছনে আসার জন্য। তবুও আপনি এখানে চলে এলেন।'
স্পৃহা উঠে দাঁড়িয়েছে। জীবন একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। স্পৃহার রাগ এখনো এতটুকুও কমে নি। স্পৃহা বলল,
'শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। বেড়ানো শেষ হলে চলে যাবেন। আমাদের মধ্যে কি হয়েছে না হয়েছে তা কাউকে জানানোর দরকার নেই।'
স্পৃহা চলে গেলে জীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
'বৌ আমার উপর অনেক রেগে আছে। রেগে থাকারই কথা। বাবা জীবন তুমি কাজই এমন করেছ। বৌ তো রাগ করবেই। আচ্ছা এখন ফ্রেশ হয়ে নাও তারপর নাহয় বৌয়ের রাগ ভাঙানোর মিশনে নেমে পড়বে।'
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসে। পলাশ জীবনের সাথে টুকটাক কথা বলছে। স্পৃহা চুপ করে তাদের কথা শুনছে। মনে মনে বলছে,
'এই লোকটা কি চায় হ্যা? আমার বাবার বাসায় এসে সবার সাথে এমন আচরণ করছে যেন আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। বাবা মা'র সাথে এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে কীভাবে? বাবা মা তো আর জানেন না এই লোকটা তাদের মেয়েকে কতটা কষ্ট দিয়েছে। আর তোহা বাদুড়নিটা সব জেনেও ভাইয়া ভাইয়া করে জীবন দিচ্ছে। কিসের ভাইয়া রে? তোর ভাইয়া তোর বোনকে রেখে অন্য মেয়ে সাথে চক্কর চালায়। এখন এখানে এসে ভালোবাসা দেখাচ্ছে। ঢং যতসব।'
স্পৃহা তার পায়ে কারো স্পর্শ অনুভব করলো। পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে জীবনের দিকে তাকালো। জীবন মিটমিট করে হাসছে।
'তার মানে এই কাজ উনারই। এই লোকটা তো আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। এখন এসব করার মানে কি? আমি তো উনাকে ছেড়ে একেবারের জন্য চলেই এসেছি। আর ফিরবো না উনার সাথে। কখনো ফিরবো না।'
স্পৃহা চেয়ারে পা তুলে বসলো। জীবন মুচকি হেসে খাওয়ায় মন দিলো।
'কী রে স্পৃহা ওখানে গেছে? '
'হুম। আমি এসে দেখি স্পৃহা আগে থেকেই এখানে।'
'তা ওখানের অবস্থা কেমন? '
'ভালো না রে ভাই। স্পৃহা অনেক রেগে আছে। কাউকে কিছু জানায় নি। তবে আমার সাথেও কথা বলছে না।'
'রেগে থাকাটা স্বাভাবিক নয় কি?'
'হুম। আল্লাহ জানে ওর রাগ ভাঙতে কতদিন লাগবে।'
'দেখ কত দিনে রাগ ভাঙাতে পারিস। স্পৃহা তো শুধু রাগ করে চলে গেছে। অন্য মেয়ে হলে তোকে খুন করতো। শালা লুচ্চা।'
'দেখ বারবার তুই আমাকে লুচ্চা বলবি না। আমি যেমনই হই তোর বোনের হাজবেন্ড তো।'
'আচ্ছা এখন রাখি। তুই স্পৃহার কাছে যা। আমার কোনো হেল্প লাগলে বলিস।'
জীবন জয়ের সাথে কথা বলে রুমে এসে দেখে স্পৃহা শুয়ে পড়েছে। লাইট অফ করা। ঘর অন্ধকার। জীবন লাইট জ্বালিয়ে বলল,
'স্পৃহা! '
জীবন ভেবেছে স্পৃহা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে
সে আবার ডাকলো,
'স্পৃহা ঘুমিয়ে গেছ?'
স্পৃহা এবার উঠে বসে বলল,
'কি হয়েছে? শান্তিতে ঘুমাতেও দিবেন না নাকি? '
'আমি কোথায় শুবো?'
'আমি কি জানি। আপনি এখানে এসেছেন কেন? '
'এসেছি বলে তুমি আমাকে বিছানায় জায়গা দিবে না? এটা কিন্তু অন্যায়।'
জীবন গিয়ে স্পৃহার পাশে শুতে নিলে স্পৃহা লাফিয়ে উঠে বলল,
'কি করছেন হুম? '
'কি করছি মানে? রাত হয়েছে ঘুমাবো না?'
'আমি আপনার সাথে আমার বেড শেয়ার করব না। আপনি অন্য কোথাও ঘুমান।'
জীবন কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্পৃহার বেডেই শুয়ে পড়লো। স্পৃহা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
'আপনি এমন করছেন কেন বলুন তো।'
'আমার বাসায় তোমাকে পুরো একটা রুম দিয়েছি। আর তুমি তোমার বেডে আমাকে একটু জায়গা দিবে না?'
'নাহ।'
'তাহলে কীভাবে হবে? '
'বড় আব্বুর বাসায় থাকতে আপনি সোফায় ঘুমাতেন। নিজের বাসায় গিয়ে অন্য রুমে ঘুমাতেন। এখানে আমার রুমে সোফা নেই। অন্য রুমে থাকার পরিস্থিতিও নেই।'
'তাহলে আমি সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবো? নাকি নিচে ঘুমাবো?'
স্পৃহা ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে বলল,
'আইডিয়া খারাপ না।'
বলেই স্পৃহা উঠে গেল। আলমারি থেকে দু'টা চাঁদর আর কম্বল বের করলো। কম্বলটা নিচে পাতলো। বেড থেকে বালিশ নিয়ে জীবনের দিকে চাঁদর এগিয়ে দিয়ে বলল,
'এই নিন শুয়ে পড়ুন। '
জীবন ড্যাবড্যাব করে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো? তাকে নিচে শুতে বলছে!
'আমি তোমার হাজবেন্ড হয়ে নিচে শুবো। আর তুমি ওয়াইফ হয়ে উপরে শুবে! আল্লাহ পাপ দিবে না তোমাকে? '
স্পৃহা বিরক্ত হয়ে বলল,
'বিছানা খালি আছে। তাহলে আপনি উপরে ঘুমান।'
'তুমি ওয়াইফ হয়ে নিচে শুবে, আমি বেডে আরাম করে ঘুমালে আল্লাহ আমাকে পাপ দিবে না?'
'তাহলে আর কি চান আপনি? '
জীবন দাঁত বের করে হেসে বলল,
'বেডে শুলে আমরা দু'জন একসাথে শুবো। আর নিচে শুলেও আমরা দু'জন একসাথেই শুবো।'
কথা বলে জীবনও নিচে নেমে এলো। স্পৃহা ভেবে পাচ্ছে না জীবন কেন তাকে এতো জ্বালাচ্ছে।
'আপনাকে তো বেড দিলেই দিলাম তবুও এমন করছেন কেন? আপনি বেডে শান্তিতে ঘুমান না। আর আমাকেও নিচে শান্তিতে ঘুমাতে দিন।'
'উঁহু! তা হবে না। একজন নিচে একজন উপরে এভাবে ঘুমানো যাবে হয়। হয় দু'জনেই উপরে। আর নাহয় দু'জনই নিচে।'
জীবন শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
'তুমি যদি ভাবো বেডে চলে যাবে, তাহলে আমিও তোমার সাথে আসছি। আর যদি নিচে থাকতে চাও তাহলে এই নাও আমি ঘুমাতে গেলাম। গুড নাইট। '
স্পৃহা রাগ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে সেও জীবনের পাশে শুয়ে পড়লো। জীবন এখনো জেগে আছে। সে ঘুমের ভান করে স্পৃহার উপর হাত তুলে দিলো। স্পৃহা জীবনের হাত সরিয়ে দিলে জীবন এবার হাত পা দু'টোই তুলে দিলো। স্পৃহা উঠে বসতে নিলে জীবন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
স্পৃহার সাথে খুনসুটিতে জীবনের সময় বেশ কেটে যাচ্ছে। স্পৃহার রাগ ভাঙাতে গিয়ে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই আরো রাগিয়ে দিচ্ছে জীবন। তোহাও পুরোদমে জীবনকে সাপোর্ট করছে। স্পৃহা জীবনের কর্ম কান্ডে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জীবনের এসব পাগলামি দেখে হাসিও পাচ্ছে। জীবন যা কিছুই করুক স্পৃহা এবার এতো সহজে জীবনের কাছে ধরা দিবে না। এতদিন সে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এবার একটু জীবন তার পেছনে ঘুরুক। দেখুক বৌয়ের রাগ ভাঙানো কতো কষ্টের কাজ।
জীবন তোহার সাথে বাইরে বের হয়েছিল। আসার পর থেকে বের হয়নি। এদিকটা জীবন চেনেও না। তোহা তাকে আশেপাশে ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে গেছিল। বাসায় ফিরে জীবন অনেক বড় একটা ধাক্কা খেল। স্পৃহা একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। কে এই ছেলে? এই বাড়িতে কোনো ছেলের কি কাজ? আর স্পৃহাই বা কেন ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে? জীবন তোহার দিকে প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে তাকালো। তোহা জীবনের তাকানোর মানে বুঝতে পেরে ঠোঁট উলটে বলল,
'ও নাফিজ। '
জীবন কপাল কুঁচকে বললো,
'নাফিজ?'
তোহা জীবনের সাথে কথা শেষ করার আগেই রাহেলা মানে নাফিজের মা তোহাকে ডাকলো। তোহা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বিরবির করে বলল,
'পালাও ভাইয়া। এই মহিলা মাথা খারাপ করে দিবে। এতো কথা বলতে পারে আল্লাহ গো আল্লাহ। আমাকে দেখলেই পড়াশোনা নিয়ে আলাপ শুরু করে দিবে। গেলাম আমি এর সামনে পড়ার থেকে গাড়ির নিচে চাপা পড়া অনেক ভালো। মরলেও শান্তিতে মরতে পারবো। কিন্তু এই মহিলার পেচাল শুনে পাগল হতে পারবো না।'
তোহা কেটে পড়লো। জীবন কিছুই বুঝতে পারছে না। এই মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে এখানে কি করে। জীবন ভেতরে গেল। ডাইনিং টেবিলে থেকে পানির গ্লাস নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। পানি খেতে খেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলো। রাহেলা তানিয়াকে বলছে,
'মেয়ের বিয়ে তো অন্য জায়গায় দিয়েছেন। জামাই কোথায়? দেখি জামাই কোন দিক দিয়ে আমার ছেলের থেকে ভালো ছিল।'
জীবন বেশি কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারলো এখানে তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। জীবন গ্লাস রেখে উঠে গিয়ে হাসি মুখে বলল,
'এইতো আন্টি জামাই হাজির।'
তানিয়া জীবনকে দেখে বললেন,
'এইতো জীবন এসে গেছে। তোহার সাথে ঘুরতে বের হয়েছিল। জীবন ইনি স্পৃহার রাহেলা ফুপু।'
'আসসালামু আলাইকুম ফুপু। কেমন আছেন আপনি?'
জীবন খুব বিনয়ের সাথে উনার সাথে কথা বলছেন। ওদিকে নাফিজ স্পৃহার সাথে কথা বলছে। স্পৃহা না পারছে নাফিজের সামনে থেকে চলে যেতে। আর না পারছে এখানে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বলতে।
'বিয়ে করে ঢাকা চলে গেলি। আমাদের কথা মনে পড়ে না তোর? '
'মনে পড়বে না কেন ভাইয়া। সবার কথাই মনে পড়ে।'
'শুনেছি তোর হাজবেন্ডের নাকি অনেক বড় বিজনেস আছে।'
'ওর বিজনেসের ব্যাপারে আমি তেমন কিছু জানি না।'
'হুম। উনি এখন কোথায়? যাবার আগে দেখা হলে ভালো হতো।'
এতক্ষণে জীবন রাহেলা ফুপুর কাছ থেকে ছুটে ওদের কাছে চলে এসেছে।
'এইতো ছোট ভাই আমি এখানেই। নাও এবার দেখা করে নাও।'
নাফিজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জীবনকে দেখছে। জীবন এসে স্পৃহা পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।
'আপনিই স্পৃহার হাজবেন্ড? '
'জি আমিই তোমার দুলাভাই।'
স্পৃহা ভেবে পাচ্ছে না জীবন কি নাফিজকে দেখে জেলাস ফিল করছে? তা নাহলে এভাবে কথা বলছে কেন? নিশ্চয়ই জেলাস হচ্ছে। স্পৃহার মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি কাজ করলো।
'মিস্টার হাজবেন্ড আপনিও আমার সামনে নূপুরকে নিয়ে আদিখ্যেতা করেছিলেন। এবার দেখুন মজা। চোখের সামনে বৌ অন্যকারো সাথে কথা বললে কেমন লাগে।'
স্পৃহা মনে মনে হেসে বলল,
'নাফিজ ভাইয়া তোমরা রাতে খেয়ে যাবে তো? '
'না রে চলে যাব।'
'সে কী? না খেয়ে তো তোমাদের যেতে দিব না। দাঁড়াও আমি আন্টিকে রাজি করিয়ে আসছি। '
এটা বলেই স্পৃহা চলে গেল। জীবন হা করে তাকিয়ে আছে।
'এই মেয়ে করছে টা কি? চলে যেতে চাইছে যাক না। ওকে আটকাচ্ছে কেন? শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ আছে। যেতে দিলেই তো হতো।'
স্পৃহার কথায় রাহেলা ফুপু রাতে খাওয়া দাওয়া করে যেতে রাজি হলো। জীবন তোহার সাথে বসে টিভি দেখছে। আসলে জীবন ঠিক টিভি দেখছে না। সে আগুন চোখ করে স্পৃহাকে দেখছে। সেই কখন থেকে স্পৃহা যেন নাফিজের সাথে কি কথা বলছে। জীবন তার সামনে বসে আছে এটা পাত্তাই দিচ্ছে না। সে হেসে হেসে সুন্দর করে গল্প করেই যাচ্ছে। জীবনের হাত নিসপিস করছে। ইচ্ছে করছে ঘুষি মেরে ছেলেটার নাক বোঁচা করে দিতে। তোহা জীবনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
'এটাই সেই নাফিজ। ক্লাস নাইন থেকে আপুকে পছন্দ করে। আপুর জন্য কত কাহিনী করেছে। হাত টাত কেটে বিশ্রী অবস্থা। আপুর জন্য জয় ভাইয়ার হাতে মারও খেয়েছে। এর জন্যই জয় ভাইয়া আপুকে এখানে রাখতে দিত না। মা তো এর সাথে আপুর বিয়ে দিতেও রাজি হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালে তুমি এসে আপুকে বিয়ে করে নিলে। নইলে এই চোর আমার দুলাভাই হতো। ইয়াক।'
জীবন হা করে স্পৃহার কথা শুনছে। তোহা আবার বলতে লাগলো,
'আপু তো একে কখনও পছন্দ করতো না। ভালো করে এর সাথে কথাও বলতো। কথা বলবে কি? এর সামনে যেত নাকি। কিন্তু আজ আপুর কি হয়েছে আল্লাহই জানেন। এর সাথে রসের আলাপ জুড়ে দিয়েছে।
কীভাবে হেসে হেসে কথা বলছে। আমার তো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। '
জীবনেরও রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। নাফিজ স্পৃহাকে পছন্দ করে এটা জেনেও স্পৃহা ওর সাথে এভাবে কথা বলছে। এই ছেলের সাথে স্পৃহার বিয়ে ঠিক হচ্ছিল। জীবন আর এখানে বসে থাকতে পারলো না। আর কিছুক্ষন ওদেরকে চোখের সামলে দেখলে নিজেকে সে আর কন্ট্রোল করে রাখতে পারবে না। শ্বশুরবাড়িতে মারপিট করা শোভা পাবে না। জীবন রুমে চলে এলো। জীবন চলে গেলে স্পৃহা হেসে ফেলল। এতক্ষণ সে জীবনকে দেখানোর জন্যই ইচ্ছে করে নাফিজের সাথে বসে গল্প করছিল। জীবন রুমে এসে দেয়ালে দু'টা ঘুষি মেরে বলল,
'আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে তুমি এমন করছো তো স্পৃহা? আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও তোমাকে দেখে নিব। তোমার কত বড় সাহস আমার সামনে তুমি ঐ ছেলের সাথে গল্প করতে বসেছ। দাঁড়াও তোমাকে এক্ষুনি এর মজা বুঝাচ্ছি।'
জীবন ভাবছে সবার সামনে থেকে স্পৃহাকে কি বলে রুমে ডেকে আনবে। মুহূর্তেই তার মাথায় বুদ্ধি এলো। পকেট থেকে ফোন বের করে স্পৃহার নাম ধরে জোরে ডাকলো,
'স্পৃহা! স্পৃহা এদিকে এসো। বড় আম্মু তোমার সাথে কথা বলবে। '
জীবনের ডাক শুনে স্পৃহা ভেবেছে সত্যিই হয়তো বড় আম্মু ফোন করেছে। স্পৃহা নাফিজের কাছ থেকে উঠে এলো।
'ভাইয়া আমার জেঠি শাশুড়ি কল করেছে। আমি আসছি। '
রুমে ঢোকার সাথে সাথেই জীবন স্পৃহার হাত ধরে টেনে তাকে দেয়ালের সাথে নিয়ে আটকে দাঁড়াল।
'কি হচ্ছে কি? কি করছেন আপনি? '
'তার আগে বলো তুমি কি করছিলে?'
'আমি আবার কখন কি করছিলাম? '
'তুমি ঐ ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলে কেন? '
'এখন কি আমি কারো সাথে কথাও বলতে পারবো না?'
'না। পারবে না। '
'উনি আমার ভাইয়া হন।'
জীবন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
'জানি তো কেমন ভাইয়া হন। ভাইয়া হলে ও তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? তোমার জন্য হাত কাটে কেন? তোমাকে উল্টাপাল্টা প্রপোজাল দেয় কেন? জয় তোমার ভাই ওর সাথে তুমি সারাদিন কথা বললেও আমি না করব না। কিন্তু তুমি এই ছেলের সাথে কথা বলবে না। '
'কেন বলবো না? '
'কেন বলবে না মানে? আমি না করছি তাই বলবে না।'
'আমি তো বলবো। আপনার না আমি শুনবো কেন? '
'স্পৃহা আমার রাগ তোলার চেষ্টা করো না। আমি রেগে গেলে কিন্তু তোমার জন্য ভালো হবে না। যা বলছি তা শোনো। আমি তোমার হাজবেন্ড। আমি বলছি তুমি এই ছেলের সাথে কথা বলবে না। মানে বলবে না। সিম্পল। এতো কথা বলার তো কোনো মানে হয় না।'
'আপনি যা বলবেন আমাকে সব শুনতে হবে? '
'অফকোর্স শুনতে হবে।'
'কেন? '
'আমি তোমার হাজবেন্ড। তোমার সবকিছুর উপর আমার অধিকার। তাই আমি যা বলবো তোমাকে তাই করতে হবে। আমি যদি বলি তুমি ওখানে যাবে না। তাহলে তুমি যাবে না। আমি যদি বলি তুমি এখানে বসে থাকো। তাহলে তুমি বসে থাকবে।'
'আপনার হুকুম মান্য করতে বয়ে গেছে আমার। '
স্পৃহা ছুটে যাবার জন্য জোড়াজুড়ি করতে লাগলে জীবনের রাগ উঠে গেল। জীবন স্পৃহার কোমর ধরে টেনে নিয়ে স্পৃহার সাথে যা করলো তার জন্য স্পৃহা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। স্পৃহাকে জীবন কিছুক্ষণ নিজের সাথে আটকে রাখলো। স্পৃহা চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। বাইরে থেকে স্পৃহার মা ডেকে উঠলে জীবন স্পৃহাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এটিটিউড নিয়ে বলল,
'দেখলে তো আমার কথা না শুনলে কি হয়। নেক্সট টাইম থেকে আমার কথা না শুনলে তোমার সাথে এর থেকে বেশি কিছু হবে। তখন কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবে না। আমি আগে থেকেই বলে রেখেছি। এখন বাইরে যাও। মা ডাকছেন। দু'জন একসাথে অনেক সময় ধরে রুমে আছি। এখন তুমি না গেলে লোকে আবার অন্য কিছু ভেবে বসে থাকবে। আমি চাই না তুমি সবার সামনে বিনা কারণে লজ্জায় পড়ো। আর হ্যা চুল ঠিক করে বাইরে যেও। নয়তো সবাই এমনি মাইন্ড করবে।'
স্পৃহা রোবটের মত চুল ঠিক করে গটগট করে বেরিয়ে চলে গেল। জীবন স্পৃহাকে এভাবে দেখে হাসছে। অনেক কষ্টে এতক্ষণ হাসি চেপে রাখলেও স্পৃহা চলে যাবার পর আর ঠিক থাকতে পারলো না। বেডে বসে পেটে হাত দিয়ে জীবন হাসতে হাসতে ফেটে পড়ছে। তোহা স্পৃহাকে দেখে বলল,
'কিরে আপু তোর আবার কি হয়েছে? '
স্পৃহা মুখে কিছু না বলে। মাথা নাড়িয়ে জানালো তার কিছুই হয়নি।
'মাথা দোলাচ্ছিস কেন? মুখে কথা বলতে পারিস না? এমন পাথর হয়ে আছিস কেন?'
স্পৃহা তোহার সাথে তর্ক না করে চুপ করে বসে রইলো।
রাতে খাওয়ার সময় জীবন স্পৃহার পাশের বসলো। অন্য পাশে নাফিজ বসতে নিলে জীবন তোহাকে চোখে ইশারা করে। নাফিজ বসার আগেই তোহা সেখান বসে পড়ে। সবাই কথা বলছে কিন্তু স্পৃহা একেবারে চুপ করে আছে। খাওয়া শুরু করার আগে জীবন টেবিলের নিচ দিয়ে স্পৃহার ডান হাত ধরে ফেললো। স্পৃহা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
'কি করছেন আপনি? '
'আমি আবার কি করলাম? '
'কি করেছেন জানেন না? আপনি আমার হাত ধরে রাখছেন কেন? আমি খাবো কীভাবে? '
'ওহ তুমি খাবে। আচ্ছা এদিকে আসো আমি তোমাকে খাইয়ে দেই।'
'দরকার নেই আমি নিজের হাত দিয়ে খেতে পারি।'
'তাহলে খাও।'
'আজব তো। হাতটা তো আপনি ধরে রেখেছেন। আমি খাবো কীভাবে? '
'আমি হাত ছাড়বো না। তুমি অন্য হাতে খাও।'
'বাঁ হাতে খাব আমি? '
'তোমার সমস্যা না থাকলে খাও। আর যদি সমস্যা হয় তাহলে বললামই তো আমি খাইয়ে দিই।'
'আপনি আসলেই একটা,,,
'তোমার যা ইচ্ছা বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। তবুও আমি তোমার হাত ছাড়বো না। কতবার বলেছি আমি খাইয়ে দিই। কিন্তু তুমি নাকি নিজে নিজে খেতে পারবে।'
নাফিজ চলে যাবার সময় স্পৃহার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্পৃহা তার সাথে দেখা করতে আসেনি। জীবন আগেই বলে রেখেছে।
'আর একবার যদি ভুলেও নাফিজের সাথে কথা বলো তাহলে কিন্তু তখন যা করেছি সেটাই আবার করবো। আর তখন কিন্তু এতো সহজে ছাড়বো না।'
স্পৃহা এই ভয়ে নাফিজ যাবার সময় রুম থেকেই বের হয় নি। জীবন দরজার সামনে এসে ওদের বিদায় জানিয়েছে।