কুয়াশা বিড়বিড় করতে করতে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই আজমল হোসেন আড় চোখে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আবার পেপারে মনোযোগ দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।হালকা কাশি দিয়ে বললেন,কী হয়েছে আমার মায়ের? কেউ কী বকেছে?
কুয়াশা জুতা খুলে এইদিক সেদিক ছুড়ে ফেলে,কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।কিছুক্ষণ পায়চারি করতে করতে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।দৌড়ে হাতে ফোনটা নিয়ে নিবিড়ের ফোনে এসএমএস করলো,
-hi.
নিবিড় ভাইয়া,এইবার দেখি আমার হাত থেকে তুমি কীভাবে বাঁচো? এই কুয়াশার প্রেমে তো তোমাকে ডুবতেই হবে। কুয়াশা অপেক্ষা করতে লাগলো পরবর্তী এসএমএসের।
নিবিড় কিছুক্ষণ পর রুমে এসে শুভ ফোন করতেই ফোন রিসিভ করে,কেমন আছিস?
-এইতো চলছে।ঢাকায় আসবি কবে?
-ছুটি নেই আপাতত। তুই চলে আয়।
-ঠিক আছে তাহলে সামনের সাপ্তাহে আসছি।অনেক দিন তোর সাথে আড্ডা দেওয়া হয় না।
-ঠিক আছে চলে আয়।
নিবিড় শুভর সাথে কথা বলে ফোন সামনে এনে একটু অবাক হলো।অচেনা নাম্বার থেকে এসএমএস।আনসার দিবে নাকি দিবে না! কিছুক্ষণ নিজেই চিন্তা করে মনকে ঘুরিয়ে এসএমএস করলো,
-k apni?
এসএমএস এর টুং-টুং শব্দ শুনেই কুয়াশা লাফিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে এসএমএসটা দেখেই মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
-apnar khub kacher keu.
নিবিড় এইবার একটু অবাক হলো তারপর লিখলো,
-amar life a maa,baba,bon chara keu apon nei.apni meye naki chele?
কুয়াশা ভাবতে লাগলো কী বলা যায়।তারপর ভেবে বললো,
-mone koren aj thekei ami apnar apon keu.
-proyojon nei.apni je apon hote caichen oi jaygata moteo khali nei.plz r sms korben na.
কথাটা শুনেই কুয়াশা কষ্ট পেলো।সত্যিই কী খালি নেই নাকি আমাকে শোনাচ্ছে। কুয়াশা আবার এসএমএস করলো,
-ami dekhte kintu onek sundor, jemon onek lomba,abar motasotao.
নিবিড় এসএমএসটা পড়েই বুজে ফেলেছে এইটা আর কেউ নয় কুয়াশা। সকাল বেলা কথাটা আমি তাকে মজা করে বলেছি আর পাগলীটা কী যা তা শুরু করলো।নিবিড় মুচকি হেসে লিখলো,
-upore uthe aso.kotota mota tui ektu dekhi.
কুয়াশা এসএমএসটা পড়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো,এই যাহ্ একটু মজাও করতে পারলাম না।এইভাবে কেটে গেলো সাপ্তাহ খানিক,শুভ এসেছে নিবিড়ের বাড়ি।শুভকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই কুয়াশা সামনে পড়লো।
শুভ নিবিড়ের কাঁধে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, আরে মামা এইটা কে?
নিবিড় একটু ভারী গলায় বললো,আমার কাজিন।
চল এইবার।
শুভ বাসায় ঢুকতে ঢুকতে, তোর কাজিন তো অনেক সুন্দর। জোশ মামা,, মাম্মা আমায় একটু লাইন করে দেনা?
-শুভ প্লিজ ও অনেক ছোটো। মাত্র কলেজে পড়ে।তুই এখানে থাকতে এসেছিস ভালোভাবে থাক ঘুর ফির এইটাই ভালো হবে তোর জন্য।
নিবিড়ের কথা শুনে শুভ আর কিছু বললো না।
নিবিড়ের মা বোনের সাথে দেখা মরে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রাতে একসাথে খেতে বসতেই কুয়াশা এসে, জেঠি মা, তোমরা আমায় ছাড়া খেয়ে নিচ্ছো?
নিবিড় কুয়াশাকে দেখেই মুখটা গম্ভীর করে,তুই এখন কেনো এখানে এসেছিস? রাতের বেলাও কি তোর মানুষের বাসায় হাঁটতে ইচ্ছে করে?
নিবিড় কথাগুলো বলতেই কুয়াশা মন খারাপ করে,ভাইয়া আমি শুধু,,,
-চুপ কর তুই।যখনতখন যেখানে সেখানে তোর এখন যাওয়া উচিত না।তুই এখনো ছোট নয় বড় হয়েছিস।
নিবিড়ের মা নিবিড়ের এমন রাগ দেখে হতভম্ব হয়ে আছে।ছেলেটার কী এমন হলো হঠাৎ এমন রেগে গেলো।কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিচে চলে যেতেই রহিমা বেগম নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে,কী হয়েছে বলতো? মেয়েটাকে এইভাবে বকছিস কেনো?
-মা প্লিজ,রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।কাকী সারাদিন জায়নামাজেই পড়ে থাকে।থাকে ভালো কথা ইসলাম শুধু নামাজ আর কুরআন পড়তে বলেনি।বলেছে নিজের ঘরকেও হেফাজতে রাখতে।
ও এখন বড় হয়েছে যখনতখন এভাবে চলা ঠিক না।
নিবিড়ের মা আর কিচ্ছু বললো না।চুপচাপ সবাইকে খেতে দিলো।
নিবিড়ের বাবা বাহিরে থেকে এসে সবাইকে চুপচাপ দেখে, কী হলো সবাই এতো চুপ কেনো?
-বাবা খেতে বসো।
-আমি খেয়ে এসেছি।আজ অফিসের এক কলিংএর মেয়ের বিয়ে ছিলো।তোর মাকে যেতে বলেছি যাবে না।তাই আমি একাই গেলাম।
-ওহ্।
-বাবা ও শুভ,আমার ফ্রেন্ড। ঢাকায় একসাথেই ছিলাম।
-হাই ইয়াংমেন, কেমন আছো?
শুভ কাঁধের দিকে তাকিয়ে নিবিড়ের বাবার হাত দেখে মুচকি হেসে,মাথা নাড়িয়ে জ্বি আংকেল ভালো। আপনি কেমন আছেন?
-এইযে সবাইকে নিয়ে খুব ভালো।
নিবিড়ের মা, ছেলেটার প্লেট তো পুরোই খালি,আরও কয়েক টুকরো খাসির মাংস দাও।
-আরে না না আংকেল।আমি অনেক খেয়েছি আর খেতে পারবো না।
-আরে লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়,
নিজেই চামচ দিয়ে শুভর প্লেটে মাংস দিয়ে,তোমাদের বয়সে থাকতে অনেক খেতাম।অবশ্য এখনো কিন্তু তোমার আন্টি রান্না করলে পুরো খাসি একটা আমিই খেতে পারি।
নিবিড় বাবার দিকে তাকিয়ে,বাবা অনেক চাপা মারা হয়েছে।এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
-চিনলি না চিনলি না।আসল সোনাই চিনলি না।
-বাবা প্লিজ যাও তো।মা চিনলেই হলো।
শুভ আর নিবিড় খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে আসলো।
শুভ শার্ট চেইঞ্জ করতে করতে, নিবিড় তুই তখন মেয়েটার উপর এইভাবে ক্ষেপে গেলি কেন?
-শুভ এই নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।তুই শুয়ে পড়।
-তুই কোথায় যাচ্ছিস?
-একটু নিচে যাবো।
-এতো রাতে?
-আসলে আমার ফোনে রিসার্চ করতে হবে।তুই ঘুমা আমি এখুনি আসছি।
শুভ আর কথা বাড়ালো না।নিবিড় শুভকে রেখে নিচে গেলো।
কুয়াশা বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো।খাওয়াদাওয়া কিচ্ছু করেনি।মাকে কোনো একটা বাহানা দিয়ে রুমে আছে।
হঠাৎ ফোনে কল আসতেই কুয়াশা চোখ মুছে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে নিবিড়ের নাম্বার দেখে অবাক হলো।অভিমান করে কল কেটে দিয়ে গাল ফুলিয়ে আছে।ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে আবার কখন কল দিবে।
একটু পর আবার কল দিতেই তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে চুপ করে আছে কুয়াশা।
ফোনের ওপাশ থেকে একটা কথা ভেসে আসলো,ছাদে আয়!
কুয়াশা অভিমানের স্বরে বললো, এতো রাতে মেয়েরা বাহিরে যেতে নাই।
-আমি তোকে বলছি।
-না যাবো না।
-আমি আছি তো।
-না।
-ঠিক আছে আমিই তোদের বাসায় আসছি।
-এই না না আমিই আসছি।
-তাড়াতাড়ি!
নিবিড় দাঁড়িয়ে আছে চাঁদের আলোই খুব ভালো লাগছে।শীত ধেয়ে আসছে, উত্তরের হাওয়াটা বেশ গায়ে লাগছে।কিন্তু তবুও এই রাতে কুয়াশার অভিমান ভাঙ্গানোটা আগে জরুরী।
কুয়াশা এসে দাঁড়াতেই, নিবিড় পিছনে ফিরে, এতোক্ষণ লাগে?
কুয়াশা নিচু গলায় বললো, বাসা থেকে না বলে এসেছি।সময় তো লাগবেই।
-নিচের দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকা।
কুয়াশা তাকাতেই নিবিড় আইসক্রিম সামনে ধরে, খাওয়া শুরু কর,তবে একটা।অনেক ঠান্ডা পড়েছে বেশি খেলে গলা বসে যাবে।
কুয়াশা প্রথমে খুশি হলেও অভিমানে স্বরে বললো, আমি খাবো না।
-মাইর খাবি?
কুয়াশা নিচের ঠোঁট বের করে কপাল কুঁচকে ডানে বামে মাথা নাড়তে থাকলো।
-তাহলে হাতে নে, গলে যাচ্ছে তো।
কুয়াশা হাতে নিতেই, তখনকার জন্য স্যরি।
আসলে আমি চাইনি তুই অচেনা কারো সামনে ঘুরঘুর করিস।শুভ আমার ফ্রেন্ড হতেই পারে তাই বলে সারাক্ষণ সামনে আসার দরকার নেই।
কুয়াশা আইসক্রিম খেতে খেতে বললো,তোমার এতো জ্বলে কেন? জ্বলবে তো আমার বরের।তুমি কি আমার বর?
কথাটা বলেই কুয়াশা জিহ্বা কামড় দিয়ে আছে।
নিবিড় মুচকি হেসে পকেট থেকে কাগজে মোড়ানো কাঁচের লাল রঙের অনেকগুলো চুড়ি বের করে,এই নে এইটা তোর জন্য।
-চুড়ি?
-হু,
কুয়াশা অবাক হয়ে,আমার জন্য তুমি এনেছো?
-না আমার প্রেমিকার জন্য কিনেছিলাম। ওকে দিতে ভুলে গেছি তাই তকে দিলাম।
কুয়াশা একটুও মন খারাপ করেনি কথাটা শুনে।আইসক্রিম নিবিড়ের হাতে দিয়ে সাথে সাথেই চুড়িগুলো পরে নিয়ে,তোমার প্রেমিকা আর আমার হাতের মাপ দেখছি পুরোই এক।কথাটা বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো।আর নিবিড় সেই হাসি মন্ত্র মুগ্ধের মতো তাকিয়ে নিজেকে ডুবাতে চাইছে।মেয়েটা এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলো।জীবনে কত মেয়েই দেখলাম, কিন্তু বারবার তোর কথা ভেবেই নিজেকে আটকিয়েছি হাজারো বারংবার।
কেটে গেলো কয়েকটা মাস।
কুয়াশার দুই ভাই বিদেশ থেকে ফিরে আসছে।বাড়িতে আনন্দের একটা আমেজ থাকলেও কুয়াশা খুব ভয়েই আছে।ভাইয়ারা আসলে তো নিবিড় ভাইয়ার সাথে তেমন ভাবে মিশতেও পারবো না।কিন্তু নিবিড় ভাইয়াকে না দেখে আমি তো থাকতে পারবো না।
শাহানাজ বেগম রান্নায় ব্যস্ত।বারবার কুয়াশাকে এইটা সেটার ফরমায়েশ করেই যাচ্ছে।কুয়াশা নিবিড়কে এক নজর দেখার জন্য মন খুব চটপট করতে লাগলো।অনেকবার দরজা খুলে দেখেছে নিবিড় ভার্সিটি থেকে আসলো কিনা।আবার ভিতরে এসে মায়ের সাথে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।আজমল হোসেন দুই ছেলেকে নিয়ে উপরে উঠে এলো।নিবিড়ের পরিবার সবাই আজ একসাথে হয়েছে।কুয়াশার চোখ বারবার নিবিড়ের দিকে।এই মানুষটা নিরামিষ তরকারির মতো।কখনো আমার মন বুজেনি।আসার পর থেকে একবারও তাকালো না আমার দিকে।চায়ের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুয়াশার বড় ভাই জুয়েল বললো,তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সবাইকে চা দিয়ে দে।
কুয়াশা মাথা নাড়িয়ে সবাইকে চা দিয়ে নিবিড়ের কাছে যেতেই নিবিড় ফিসফিস করে বললো,চোখের কাজলটা একটু লেপ্টে গেছে ঠিক কর।
কথাটা শুনেই কুয়াশা হতভম্ব।যে মানুষটা আমার দিকে একবারও তাকালো না সেই মানুষটা কী করে জানলো আমার কাজল লেপ্টে গেছে?
শাহানাজ বেগম ডাকতেই কুয়াশা চমকে উঠে,মা আসছি!
রুপন্তির ডাকে নিবিড়ের ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো।ভাইয়া তুই ছাদে?
-তুই?
-তোকে খুঁজতেই মা পাঠিয়েছে।
-রুপন্তি দেখ কুয়াশার বাগানটা কেমন কান্না করছে।
কথাটা শুনে রুপন্তি থমকে দাঁড়লো।
নিবিড় আবার বললো, জানিস ওকে আজ বড্ড মিস করছি।আচ্ছা ওই বাড়িতে ও কী করছে? আমার কথা নিশ্চয়ই আর ভাববে না তাই না? আমি তো ওকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারিনি।আচ্ছা রুপন্তি তুই বল আমার কী পালানোর বয়স?
যেখানে আমিই হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়ে থাকি সে জাগায় আমি নিজেই এতোবড় একটা অন্যায় করবো?
রুপন্তি এসে নিবিড়কে জড়িয়ে, ভাইয়া তুই আর কতটা সহ্য করবি?তুই কান্না করতে পারিস না? এইভাবে সব কষ্ট মনে জমিয়ে তুই তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিস।
নিবিড় রুপন্তির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিচে চল।আমার আবার বেরুতে হবে।