রংধনু - পর্ব ০৭ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


বিস্ময়ের চরম শিখরে বেলা।লোকটা এমন কিছু বলবে কখনো আশা করেনি ও। লোকটার জন্য মায়া কাজ করছিলো ওর।সেটা হয়ত ক্ষনিকের জন্য।যা খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে।হয়ত কালই।কিন্তু ভালবাসা এই চিন্তাটা কখনোই ভাবনায় আসেনি।বেলার পুরো শরীর জমে গেছে।অসুস্থতা টা যেন ভুলেই গেছে।বুঝতেই পারছেনা ওর খারাপ লাগছে।কিছুটা অচল হয়ে পড়লো ওর চিন্তাধারা।বেলার চোখজোড়া বেয়ে অঝোর গতিতে অশ্রু গড়াচ্ছে যা বৃষ্টির পানিতে মিলে যাচ্ছে।বেলাকে চুপ দেখে বিভানের যেন সব আশার আলো যেন নিভে যাচ্ছে। বুকের কোনে চিন চিনে ব্যাথা অনূভব হচ্ছে।শ্যামবতীর উত্তর কি হতে পারে?সেটা জানার জন্য ওর মন বড্ড আঁকুপাঁকু করছিলো।আজ যখন শ্যামবতী ওর সামনে আর মনের কথা টাও জেনে গেছে বিভান এক আসামীর মতোই বেলার সামনে দাঁড়িয়ে।বেলার অনুভূতি ওর চেহারায় পড়তে পারছেনা বিভান।কারন চেহারা পড়া শুধু মাত্র বইয়ের পাতায়েই নিবদ্ধ।সেটা চাইলে ও পারা যায়না।বিভান চাইছে বেলাকে যেকোন মূল্যে।কারন ও ভালবাসে খুব ভালবাসে শ্যামবতীকে।অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে বিভান।কিছু বলছেনা কেন ওর শ্যামবতী?ও কি কিছু বলবে?সেটাকি ভাল দেখা যাবে।আবেগ আর বিবেকের কাছে পরাজিত বিভান।কোনটা দিয়ে ভাববে।দুটোই মনে হচ্ছে প্রানহীন।
বেলা কিছু বলছে ও না শুধু দাঁড়িয়ে পলকহীন ভাবে বিভানকে দেখে যাচ্ছে।আর না পেরে বিভান বলতে শুরু করলো,
''আমি সত্যিই আপনাকে চাই বেলা।বুঝুন আমাকে।আপনি তো এতটা হৃদয়হীনা না। আজ আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি একটু ভালবাসার জন্য বেলা।প্লিজ আমাকে খালি হাতে ফিরে যেতে দেবেননা।"
বেলা কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।এ মুহূর্তে ওর মাথা কোন রকমের সাড়া দিচ্ছেনা।বিভান এবার ও বেলার উত্তর না পেয়ে ওকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নেয়।বেলার হাতজোড়া বিভানকে জড়িয়ে ধরছেনা।কেমন নিথর হয়ে আছে হাত জোড়া।বিভান বেলাকে সামনে এনে ওর কপালে চুমু খেতেই বেলা সরে বিভানের কাছ থেকে।রাগান্বিত দৃষ্টি ছুড়ে দেয় বিভানের দিকে।কঠিন গলায় বলল,
''আপনি যা চাইছেন তা কখনো হওয়ার মতো নয়।আমি কখনো আপনাকে ভালবাসার কথা ভাবতে ও পারিনা।আপনার দেশ আপনার সমাজ আমার সমাজ কখনো মেনে নেবেনা আপনাকে আমাকে।আপনি চলে যান।নিজের দেশে কাউকে বিয়ে করে নিবেন।আর কখনোই আমার সামনে আসবেননা।বেলা কখনো আপনার জন্য ছিল না সেটা মনে রাখবেন।"
কথা গুলো বলে পিছে ফিরে চলে আসতে থাকে বেলা। পিছে ফিরে তাকানোর সাহস টুকু ছিলো না ওর।দুহাতে চোখ মুছে ঘরের কাছে আসতেই সাঁঝকে দেখতে পায় ও।বিভান যেন নিজের নিজত্বটাকে হারিয়ে ফেলেছে।চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে।ওর চাওয়াটাকি খুব বেশি ছিলো।ও তো চেয়েছিলো ওর শ্যামবতীকে।তাহলে কি কখনোই পাবেনা বেলাকে?হারিয়ে ফেলবে?এদিকে কিরন বিভানকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।কই গেলো এই লোক?বাজারের ডিসপেনসারিতে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে কিরন।এই মুহূর্তে এক গ্লাস পানির খুব দরকার।হঠাৎ কারোর ডাকে পিছন ফিরে তাকায় কিরন।বিভান হেঁটে ওর দিকে আসছে।কিরন এবার দৌড়ে বিভানের কাছে এলো।বিভান এতোটুকুই বলল,
''ঘরে চলো কিরন।কাল ঢাকায় ফিরবো আমি।ব্যাবস্থা করো।"
''কি বলছো তুমি?এই বৃষ্টিতে বাহিরে কেন?কই গিয়েছিলে?ফোন অফ কেন?"
''কিছু শুনতে চাইনা কিরন।আমি খুব জলদিই চলে যেতে চাই।"
কিরন এবার বলল,
''ঘরে এসো।রেস্ট করো।তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে।"
বিভানকে নিয়ে গেস্ট হাউজে চলে আসে কিরন।বিভান কাপড় পাল্টে বসে আছে ব্যালকনিতে।কিরন এসে বসলো বিভানের সামনে।বিভানকে দেখে বুঝা যাচ্ছে কেঁদেছিলে ও।কিছু নিয়ে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে।কিরন সুধালো,
''কি হয়েছে বলবে আমাকে?"
বিভান কিছুই বলছেনা।শুধু একদিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখজোড়া সায়রের মতো জ্বলজ্বলে।কিরন কিছুটা চিন্তিত এই বিদেশী বন্ধুকে নিয়ে।তাই আবার ও জানতে চাইলো,
''কি হয়েছে বলবে?কাঁদছো কেন?"
''কিরন আমি মিস বেলাকে ভালবাসি।"
কিরন কথাটা শুনে হেসে বলল,
''খুব ভালো।তা তোমার মন খারাপ কেন?"
''বেলা বলেছে সে আমার জন্য নয়।কখনোই আমাকে ভসলবাসতে পারবেনা।"
''এজন্য এমন করছো?তুমি এতো সহজে হাল ছেড়ে দেবে।এতোটা নরম হলে চলে না।নিজের ভালবাসাকে পাওয়ার চেষ্টা করতে শিখো বিভান।এভাবে হাল ছেড়ে দিলে নিজে পস্তাবে।"
''জানি না কি করবো আমি?বুঝতে পারছিনা।বেলাকে সত্যিই ভালবেসে ফেলেছি।"
''বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু তোমাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে বিভান।"
''এখন কিছু ভাবতে পারছিনা।মাথাটা প্রচন্ড ভারি হয়ে আছে।"
বিভানের কাঁধে হাত রেখে কিরন বলল,
''ঘুমিয়ে যাও।চিন্তা করোনা।"
বিভান কিরনের দিকে চেয়ে রইলো অর্থহীন দৃষ্টি দিয়ে।বেলা ঘরে ঢুকেই রুমে চলে যায়।সাঁঝ ওর পিছু নেয়না।সব কিছুই শুনেছে ও দেখেছে।বিভান বেলাকে ভালবাসে সেটা সমস্যা না সমস্যা ওর পরিবার।সেরাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে বেলার।নিশাদ টিকিট বাতিল করতে চাইলে বেলা নিষেধ করে।এখানে আর থাকতে চাইছে না ও।কারন সে মানুষটাকে দেখতে হবে ওর।সেটা ও চায়না।সকালে বিন্তী আর ঋতু জেদ করছিলো বেলারা চলে যাবার আগে ওরা ঘুরবে।কিন্তু বেলা না করে দিয়েছিলো যখন শুনেছিলো বিভান আর কিরন ও যাবে।বেলার শরীর ভালো না থাকায় ওকো কেউ জোর করেনি বের হতে।
________________________________________
সাঁঝ কে নিয়ে বেরিয়ে যায় ওরা।ঋতু, বিন্তী সাঁঝ কিরন বিভান সবাই পাশ্ববর্তি এক চা বাগানে এলো।বিভান আসতে চাইছিলো না কিন্তু জোর করে নিয়ে এসেছে কিরন।হয়ত বাহিরের বাতাসটা ভালো লাগবে ওর।বিন্তী আর কিরন একে অপরের সাথে গল্প করছিলো তখন সাঁঝ বিভানের পাশে এসে দাঁড়ায়।সাঁঝকে দেখে ম্লান হাসে বিভান।সাঁঝ বলল,
''কি সুন্দর না চা বাগান?"
''খুব।খুব সুন্দর।"
''আপনি আপাকে ভালবাসেন তাইনা?"
''হুম অনেক।তবে তোমার আপাতো আমাকে ভালবাসেনা।"
''দেখেন আমার আব্বা আম্মা প্রেমের বিয়ে পছন্দ করেননা।আর সত্যি কথা বলতে আব্বা ভারতকে খুব অপছন্দ করেন এর কারন হলো আমার দাদা ইডিয়ায় গিয়ে খুন হয়েছিলো।ওনার লাশ পাইনি আমরা।তারপর থেকে আব্বা ভারতকে অপছন্দ করেন।"
মন টা খারাপ হয়ে যায় বিভানের। কিছু মানুষের জন্য একটা জাতি খারাপ হয়ে যায়।সাঁঝ আবার বলল,
''আমি চাই আপাকে আপনি পান।"
''সেটা কেন চাও?"
''আপনার কথা শুনে মনে হয়েছিলো আমার আপা আপনার কাছে ভাল থাকবে।"
বিভান অনুনয়ের সুরে বলল,
''আমার সাধ্যমতো তোমার বোনকে ভাল রাখার চেষ্টা করবো।শুধু ওকে লাগবে আমার।"
সাঁঝ এবার নিজের ফোন বের করে বলল,
''আপনি দেশে যাবেন কবে?"
''এই মাসের শেষে।"
''আমার নম্বরটা রাখুন।ঢাকায় গিয়ে যোগাযোগ করবেন।"
বিভান ফোন বের করে সাঁঝের নম্বর লিখে নেয়।সেদিন বিভান ঢাকায় ফিরতে পারেনি।শুনেছিলো বেলা চলে গেছে।বিভানের খুব কষ্ট হচ্ছিলো কিছু করার নেই এটাই হয়ত অদৃষ্টে লেখা ছিলো।
এদিকে ট্রেনে বেলা একদম চুপ ছিলো।কিছুই বলেনি ও।মলিনতা যেন ওর চেহারাকে গ্রাস করে ফেলেছে।নিশাদ আদনান সাঁঝ অনেক প্রশ্ন করার পর ও বেলার উত্তর পায়নি।সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌছে যায় বেলারা।ইকরাম রহমান অনেক আগেই রেলস্টেশনে ছিলেন।সাথে এসেছিলো কুঞ্জন। বেলা বাবা আর ভাইকে দেখে হেসে দেয়।কুঞ্জন বাবার কোল থেকে নেমে দৌড়ে ভাইবোনের কাছে চলে আসে।নিশাদ কোলে তুলে নেয় কুঞ্জন কে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দেয় ওর গাল।বেলা বাবার কাছে এসে ওনাকে জড়িয়ে ধরে।ইকরাম রাহমান জিজ্ঞেস করেন,
''কেমন আছিস তোরা?"
বাবাকে জড়িয়েই বেলা বলল,
''আলহামদুলিল্লাহ আব্বা।আপনি কেমন আছেন?"
''এই তো আম্মা আলহামদুলিল্লাহ। সাঁঝ কেমন আছিস আম্মু?"
''জি আব্বা ভালো।আম্মা আর তুমি কেমন আছো?"
''ভালো।লাবনী কান্না করে তোদের জন্য।তোরা আসোছনা।তোর আম্মার হাতে খাইতে চায়না।খালি তোদের খোঁজে।"
সাঁঝ হেসে ফেলে।আদনান বলল,
''আব্বা বাসায় চলেন।আপার শরীর ভালো না।"
ইকরাম রাহমান চিন্তিত হয়ে বলেন,
''কি হয়েছে তোর বেলা?"
ভাইয়ের দিকে রাগী ভাবে তাকিয়ে বেলা বলল,
''আব্বা জ্বর করেছিলো।এখন ঠিক আছি।"
''জ্বর কিভাবে এলো?"
নিশাদ বাবার কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
''আসলে ঘুরতে গিয়েছিলাম জাফলং এ।সেখানে আপা ঝড়নায় ভিজেছিলো।তাই জ্বর এসে গেছে।"
ইকরাম রাহমান রেগে বললেন,
''তুই জানিস তোর কোল্ড এলার্জি আছে তাও কেন ভিজতে গেলি।"
নিশাদ আবার বলল, 
''আপার দোষ নেই।আমিই জোর করেছিলাম।"
ইকরাম রাহমান রাগী চোখে ছেলে মেয়েদের দেখে বললেন,
''চল বাসায়।তোদের আম্মা অপেক্ষা করছে।"
সবাই বেরিয়ে পড়ে ঘরের পানে।আবার ও যান্ত্রিক জীবন শুরু হয়ে যায় ওদের। বেলার চাকরী ভার্সিটি সব যেন ওর কাঁধে চেঁপে বসে। সাঁঝের ও ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে এসেছে।সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলে আবার ও মনযোগী হয়ে উঠলো।এদিকে বেলা ভালো নেই।ও শত চেষ্টা করে ও ভাল থাকতে পারছেনা।কি যেন ওর হৃদয়টাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।ডুকরে কেঁদে উঠে ভিতরটা।কোন কিছু তেই মন বসাতে পারছেনা। পরিবারের কেউ বুঝতে না পারলে ও নিশাদ ঠিকই খেয়াল করলো।বোনকে আগে কখনোই এমন টা দেখেনি।নিশাদ বুঝতে পারেনা বেলার এমন অস্থিরতার কারন।এরই মাঝে ঘটে এমন কিছু যা বেলাকে পুরোপুরি ভাবে নাড়িয়ে দিলো।

!!!!

ব্যাগ গুছিয়ে উড়না সুন্দর করে গায়ে জড়ালো বেলা তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে আসে।মেইন দরজা খুলতে যাবে তখনই ডাক পড়ে জুলেখা বানুর।বেলা পিছে তাকাতেই জুলেখা বানু আবার বললেন,
''কুঞ্জনক স্কুলে দিয়া আয়।নিশাদ ভার্সিটি গেছে গিয়া।"
বেলা হেসে বলল, 
''আচ্ছা আম্মা।কুঞ্জু চল স্কুলে দিয়ে আসি।"
বোনের ডাকে দৌড়ে চলে আসে কুঞ্জন।বেলা ভাইয়ের ছোট হাত ধরে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
''আসি আম্মা।"
''আচ্ছা যা।জলদি চইলা আসিছ।"
''ক্লাশ শেষে নাচের ক্লাশে যাইতে হবে।তোমার কিছু লাগলে বলো।"
''কিছু লাগবো না।তুই চইলা আসিছ।"
''আচ্ছা।"
ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে আসে বেলা।কুঞ্জন বের হলেই বায়না শুরু হয়ে যায়।আজ ও তার ব্যাতিক্রম হলো না।দোকানে ঝুলানো চিপস গুলো নজরে পড়তেই কান্না শুরু হয়ে গেলো ওর।ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,
''আপা কিনে দাও।"
''টিফিন দিছি তো।"
''আপা প্লিজ।"
''কুঞ্জু!!"
চোখ রাঙ্গায় বেলা।কুঞ্জন এবার রাস্তায় বসে বলল,
''কিনে দাও নাহলে শুয়ে পড়বো রাস্তায়।"
বেলা ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে রেগে  বলল,
''চল।পেট টা খারাপ হোক মাইর একটা ও মাটিতে পড়বেনা।"
''আচ্ছা।"
ভাইকে নিয়ে দোকানে চলে আসে বেলা তারপর পটেটো ক্র্যাকার্স কিনে দিল।কুঞ্জন কে স্কুলে দিয়ে বেলা ভার্সিটি চলে আসে।আজ টিউব লাইট আইবো না ক্লাশ নিতে মামা!!!শাহরিয়ারের কথায় হাসি চলে আসে বেলার।ছেলে গুলো স্যারদের আজব আজব নাম দিতে থাকে।মুশফিক স্যারকে টিউব লাইট বলার কারন হল ওনি বেশ বোকা স্বভাবের।মুখে কথা আটকায় একটু।তবে বেশ ভালো বুঝান ওনি।তবে একটু বেশিই রাগী।বেলার পাশে নিতু এসে বসে।বেলা বেশ অবাক নিতুকে দেখে।কারন নিতু ওর পাশে কখনো বসেইনা।তার কারন প্রচন্ড হিংসা।নিতু বেলাকে কখনই দেখতে পারেনি।কখনো কথা ও বলেনা তবে ওর পিছে ঠিকই বদনাম করতে থাকে।তবে প্রফেসররা বেলাকে পছন্দ করে বেশ। নিতু আজ বসে প্রথম কথা বলল,
''এতোদিন আসোনি যে?"
বেলা অবাক।নিতু কথা বলছে ওর সাথে।কি করে সম্ভব?বেলা নিজেকে সামলে বলল,
''সিলেটে গিয়েছিলাম। একটা বিয়ের দাওয়াত ছিলো।"
নিতু কিছুটা চোখ উল্টে বলল,
''ওহ।তোমার সমস্যা হচ্ছে নাতো তোমার পাশে বসলাম দেখে।"
''একদম না।তুমি বসো।"
বেলা অস্ফুট হেসে খাতায় মন দিলো।ক্লাশ শেষে নাচের ক্লাশে যাবার জন্য রওনা হয় বেলা। রিক্সার হুড তুলে ঠিক হয়ে বসলো।আজ কাল একদমই ভালো লাগেনা ওর।সব কেমন যেন অপূর্ন লাগে।নিজেকে বড্ড অচেনা মনে হয়।বিভান লোকটাকি কি এখন সিলেটে?নাকি ঢাকায় চলে এসেছে।কিছুদিন পর নিজ দেশে ফিরে যাবে।শেষ হয়ে যাবে বেলার জন্য জন্মানো ক্ষুদ্র ভালবাসার অনুভূতি।কেমন অদ্ভুত এ অনুভূতি।না যায় বলা না যায় দেখানো।বেলার কখনো কাউকে মন দেয়নি।নিজেকে স্থির রেখেছে বাবার পছন্দে বিয়ে করবে।চোখ জোড়া বুজে নেয় বেলা।গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু।সেদিন ইকরাম রহমানের বাসায় উপস্থিত হয় রাফসান।ইহসানের ছোট ছেলে সে।রাফসানকে দেখে সাঁঝ প্রচুর বিরক্ত হয় তারপর ও সেটাকে চেঁপে দরজা খুলে ঢুকতে দিলো ভিতরে।রাফসান ঢুকেই বলল,
''যা পানি নিয়ে আয়।"
''এসেই এভাবে অর্ডার করছেন যেন আপনার চাকর আমি।"
''শোন তোরা থার্ড ক্লাশ মেয়েরা চাকরের সমতুল্য। যা নিয়ে আয়।আর তোর বাবাকে ডাক।"
সাঁঝের মন চাইলো কষে চড় দিতে কিন্তু পারেনি ইকরাম রহমানের এসে যাওয়ায়।মেয়েকে পাঠিয়ে ইকরাম রাহমান রাফসানের সামনে এসে বসলো।রাফসান বলতে শুরু করলো,
''পুকুরের মধ্যে মাছ চাষ করতেছে আব্বা।আপনারে জানাইতে বলল।"
ইকরাম রাহমান স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
''চাষ করার আগে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেনি তোমার আব্বা এখন কেন জিজ্ঞেস করতাছে?"
''শুনেন আপনাদের ভাইদের সমস্যা আপনারা জানেন একটা বায়োডাটা আনছি।বেলার জন্য ভাল হবে।"
কথাটা বলে একটা কাগজ ইকরাম রাহমানের দিকে ধরলো রাফসান।ইকরাম রাহমান সেটা বের করে পড়তে শুরু করেন।ছেলের নাম সজীব।বয়স পয়ত্রিশ লেখা কিন্তু চেহারা দেখে মনে হচ্ছে চল্লিশের মতো হবে।তারওপর ইন্টার পাশ ছেলে বাবা কেরানী।ইকরাম রাহমানের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়।তারপর ও চুপ করে বসে রইলেন।ভিতর থেকে নিশাদ আসতেই রাফসান বলল,
''ভালো আছিস?"
রাফসানকে দেখে ভালো লাগেনি নিশাদের।তারপর ভদ্রতার খাতিরেই বলল,
''জি।আপনি?"
''এইতো।কাকা বায়োডাটা নিশাদরে দেন।"
নিশাদ অবাক হয়ে বায়োডাটা হাতে নেয় বাবার হাত থেকে।রাফসান বলল,
''পোলা কিন্তু ভালো বেলার সাথে মানাবে।"
নিশাদের প্রচন্ড রাগ লাগে।এই লোকের সাহস কি করে হয় ওর বোনের জন্য সম্বন্ধ আনার যার বয়স কম হলে ও চল্লিশের ওপর।তারওপর আবার গ্রামে থাকে।নিশাদ রাগী কন্ঠে বলল,
''ইস্মিতারে করাইতে পারবি?ইস্মিতা থেকে আমার আপা দ্বিগুন ভালো।যা তোর বোনরে করা।এসব নিয়ে সাবধান এখানে আসবিনা।পা ভেঙ্গে হাতে ধরায় দিবো শুয়োরের জাত।"
রাফসান কিছুটা ভয় পেয়ে উঠে বলল,
''বড়দের সাথে কথা বলতে শিখিস নাই তোরা।বেয়াদব ছেলে।"
নিশাদ এবার ছুঁটে এলো রাফসানের দিকে।রাফসান দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।নিশাদ জোরে চিৎকার করে বলল,
''বাসার ধারে কাছে আসিস জিন্দা কবরে দিমু হারামি।"
ইকরাম রাহমান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
''নিশাদ যা রুমে যা।"
_________________________________________

'আব্বা আপনি কিছু বলেননা কেন?এই লোকের সাহস হয় কেমনে আপার জন্য আধবুড়ো লোক ঠিক করার?"
ইকরাম রাহমান ধরা গলায় বলেন,
''ওরা এমনই।কিন্তু তোদের এমন শিক্ষা দেইনি আমি।"
''আব্বা এমন শিক্ষার নাম নিয়েননা যে শিক্ষা প্রতিবাদ করতে শেখায়না।এমন শিক্ষার ফলাফল পাইছেনা তো?বড় ভাই হয়ে কি সম্মান পাইছেন?সারাটাজীবন এগুলা কথা শুনায় আসছে আপনার চুপ থাকার কারনে।আমি তো চুপ থাকবোনা। জবাব দিবো এগুলারে।হারামির বাচ্চা সাঁঝ কে বলে থার্ড ক্লাশ!!এরা কোন ক্লাশ সেটা জানা আছে।বেশ্যা পল্লীতে দিন রাত পড়ে থাকে।তাদের আবার বড় কথা।বাধাইম্মা বাপের লুইচ্চা পোলা।এগুলা এতো বড় কথা কয় কেমনে লজ্জা লাগেনা?"
ইকরাম রাহমান ছেলের কথায় অবাক।গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করছিলো নিশাদ।ওর চিৎকারে জুলেখা বানু ড্রয়িং রুমে চলে আসেন।তারপর কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন,
''আব্বার সাথে কিভাবে কথা বলতেছোস নিশাদ?"
''আম্মা তুমি ওনারে বুঝাও যেন বোবা হয়ে না থাকে ভাই আর ভাইয়ের ছেলেদের সামনে।"
কথা গুলো বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে যায় নিশাদ।ইকরাম রাহমান সোফায় বসে পড়েন।আসলেই খুব ভুল করেছিলো সারাজীবন।ওনার চুপ থাকাটাই পদে পদে আজ কাঁটার মতো বিঁধছে।সেদিন বেলা ঘরে আসার পর সাঁঝ পুরোটা বলে দেয়।বেলার মন খুব বেশি খারাপ হয়ে যায়।বাবার সাথে এভাবে কথা বলার উচিৎ একে বারেই হয়নি নিশাদের।বেলা উঠে ভাইয়ের রুমে চলে আসে।নিশাদ বই নিয়ে বসে আছে।বেলা ওর পাশে এসে বসলো।তারপর হেসে বলল,
''কিরে পড়াশুনা কেমন যাচ্ছে?"
''যা বলার জন্য আসছিস সেটা বল।মেজাজ খারাপ আছে।"
''সেটা জানি।ওরা আমাদের মতো না। যতোটাই ধনী ওদের মন মানসিকতা ততোটাই নিচ।সেটা তুই ও জানিস।দাদা মারা যাওয়ার পর আব্বা চাচা কে দেখে আসছে।আব্বা চাচা কে আদর করে সেটা ও জানিস।আব্বা এরকমই সেটা তোকে মানতে হবে নিশাদ।রাফসান যাই বলছে তুই ও ওরে কথা শুনাইছোস কিন্তু আব্বারে এত গুলা কথা শুনানো উচিৎ হয়নি তোর।যাই করছিলো পরিবারের জন্য।আব্বা চুপ ছিলো ওই বেটার সম্বন্ধতে হ্যা তো বলে দেয়নি।"
''আপা আব্বা কখনোই বলেনা কিছু।সেজন্যই ওরা সুযোগ পায় সবসময়।সাঁঝ কে বলে থার্ড ক্লাশ।"
''শোন ওরা কখনোই আমাদের মানুষ মনে করেনি।আব্বা রে সবসময় এরকম দেখে আসছি আমরা।এখন তো পরিবর্তন করতে পারবো না তাইনা?"
নিশাদ চুপ হয়ে গেলো।বেলা ভুল বলছে না।খারাপ লাগছে নিশাদের।বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
''এখন কি করবো আপা?"
''যা কথা বল আব্বার সাথে মাফ চেয়ে নে।"
নিশাদ উঠে ইকরাম রাহমানের রুমে গিয়ে ওনাকে উঠায় খেতে নিয়ে আসে।নিজ হাতে ওনার প্লেটে তরকারি তুলে দেয়।ইকরাম রাহমান জানালেন খুব ভালো ছেলে দেখে বেলা কে বিয়ে দিয়ে দেখাবেন নিজের ভাইয়ের পরিবারকে।
বাবার কথায় বেলার পুরো শরীর কেমন কেঁপে উঠে।মাথা ঘুরে উঠে।কিছুসময়ের জন্য মনে হতে থাকে সব শেষ।
কিছুদিন পার হয়ে গেলো।বেলা নিজের ভার্সিটি ড্যান্স ক্লাশ, কোচিং সব কিছুতে নিজেকে সচল রেখেছে।তখনই ওর নম্বরে খুব অচেনা নম্বর থেকে কল আসে। বেলা ফোন রিসিভ করেনি।সেদিনের মতো কল আসেনি আর।কিন্তু পর দিন কলেজে যাওয়ার পথে বিভানের সাথে দেখা হয় ওর হঠাৎ করেই।সাদা শার্ট গায়ে জড়িয়ে আছে বিভান।নীল জিন্সপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে বেলার সামনে।
বেলা পিছনে ফিরে চলে যাচ্ছিলো।তখন বিভান ওর পিছু নিতে নিতে বলল,
''বেলা একটু দাঁড়ান কথা আছে।"
বেলা হাঁটছে। বিভান বারবার থামতে বলছে কিন্তু বেলা চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।ও ভাবছে বিভান এখানে কেন এলো?কি করে?বিভান ওর পিছু ছাড়ছেইনা।বিরক্ত হচ্ছে বেলা।লোকটা থেকে সরে আসতে চায় ও।তারপর ও কেন তার সামনে আসতে হয়?বেলা এবার সামনে ফিরে বলল,
''জানেন আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন তা কিছু মানুষের মনে হতে পারে ইভটিজিং করছেন আমাকে।এর ফলাফল ভালো হয়না আমাদের ঢাকায়।সো প্লিজ লিভ মি।"
বিভান বলল,
''বেলা আমি জানিনা কে কি ভাবে?আমি সত্যিই আপনার মায়ায় জড়িয়ে গেছি বেলা।আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।বুঝাতে চাই আপনাকে।"
''কিছু শুনতে কিংবা বুঝতে ও চাইনা।আপনি চলো যান।"
''বেলা প্লিজ। "
''মিঃ বিভান শেখ বুঝতে পারছেননা কেন?আপনাকে ভালবাসা সম্ভব না।সেটা আপনি আশা ও করবেননা।"
বিভান চুপ হয়ে যায়।বেলা এবার সামনে হাঁটতে শুরু করলে পিছন থেকে বিভান চিৎকার করে বলতে থাকলো,
''বিভান শেখ দেশে ফিরে গেলে আপনাকে নিয়েই ফিরবে।আপনি যাই বলুননা কেন?আপনার পিছু ততক্ষন ছাড়বোনা যতক্ষন না পর্যন্ত আমাকে ভালবাসেন আপনি।"
বেলা রেগে বিভানের দিকে তাকায়।বিভান হেসে গাড়িতে উঠে বসে।বেলার চোখজোড়া ভিজে আসে। সেদিন কলেজে যায়নি ও।ঘরে আসতেই জুলেখা বানু বললেন,
''কিরে চলে আসলি যে?"
''আম্মা ভালো লাগছেনা আমার।"
''ভালো হলো আসছিস।তোকে কল করতাম আমি।"
''কেন?"
''তোর আব্বা ভাল সম্বন্ধ আনছে।ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে একটু শ্যামলা তবে বেশ ভদ্র।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন