জীবন খায় নি বলে স্পৃহাও কিছু খেলো না। সে ঘরের কাজ করছে। কয়েকদিন ধরেই ভার্সিটিতে যায় না। আজও আর যাওয়া হবে না। বারোটার দিকে জীবনের ঘুম ভাঙলে সে উঠে কিচেনে চলে আসে। যা কিছুই হোক খিদে তো লাগবেই। পেট তো আর বুঝবে না সে কত বড় সমস্যায় আছে। স্পৃহা জীবনের শব্দ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
'আমি রান্না করে রেখেছি। '
জীবন তার দিকে তাকিয়ে বলল,
'ওহ।'
'আপনি ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসুন আমি খাবার দিচ্ছি।'
জীবনের সামনে খাবার দিয়ে স্পৃহা কিচেনের দিকে যাচ্ছিল। জীবন তার হাত ধরে বলল,
'তুমি খেয়েছ?'
'আমি পরে খাব।'
'পরে কখন খাবে? সকাল থেকে তো না খেয়েই আছো। এখনো ক্ষিদে পায়নি? এখন কোথাও না গিয়ে চুপচাপ আমার সামনে বসো।'
স্পৃহা খেতে খেতে কয়েকবার জীবনের দিকে তাকিয়েছে। হঠাৎ যেন সে আগের জীবনকে দেখতে পাচ্ছে। কেনই যেন স্পৃহার চোখ ভিজে আসছে। জীবন পুরো সময়টাই স্পৃহাকে দেখেছে শুধু। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে স্পৃহাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে।
রায়হানের কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে জীবন বাইরে বেরিয়ে যায়। স্পৃহা যেন জীবনকে ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না।
'আমি কিছুতেই উনাকে বুঝে উঠতে পারছি না। এই হঠাৎ উনি আমাকে কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার পরক্ষণেই নিজের সাথে বসে খেতে বলছেন। গত দু'দিন তো উনাকে একদম চিনতে পারিনি। আজও আবার উনাকে নতুন করে চিনতে পারছি না। আমার জীবন কি কখনোই স্বাভাবিক হবে না? আমরা কি কোনোদিন স্বামী স্ত্রীর মত থাকবো না? কখনো আমাদের সংসার সাজিয়ে তোলা হবে না? '
'রায়হান আজ আমি অফিসে আসবো না।'
'...
'হ্যাঁ ঐ মিটিংটা আজ করতে পারবো না।'
'...
'আচ্ছা। আপনি ওদিকের সবকিছু সামলে নিবেন একটু। '
রায়হানের সাথে কথা বলে জীবন নতুন একটা ভাবনায় পড়ে গেল।
'নূপুর তো এই ছেলেটার সাথেও অন্যায় করছে। রায়হান ছেলেটা তো কিছুই জানে না। মনে হয় নূপুর ওকে কিছু জানায় নি। স্পৃহার যেমন কোনো দোষ নেই। তেমন তো এসবে রায়হানেরও কোনো দোষ নেই। ওরা দু'জনই তো নূপুরের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই সম্পর্কে আটকা পড়েছে।'
নূপুরের উপর জীবনের রাগ লাগছে।
'সব দোষ তোমার নূপুর। তুমি সত্যটা এখন আমাকে না জানিয়ে, আগে জানালেই পারতে। তখন কেন তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে ভয় পেয়ে রায়হানের সাথে এনগেজমেন্ট করে নিলে। এনগেজমেন্টের পরও তো আমি তোমার কাছে গিয়েছিলাম। সেদিনও তুমি আমাকে কিছুই জানাও নি। উল্টো আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আর আমিও রাগের মাথায় বোকার মতো গিয়ে স্পৃহাকে বিয়ে করে নিলাম। এনগেজমেন্ট ভাঙা গেলেও বিয়ে ভাঙা যায় না। সেখানে স্পৃহা কিছু জানেই না সেখানে কীভাবে আমি তোমার জন্য ওকে ছেড়ে দিব? স্পৃহার পরিবার, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড জয় ওদের খুশিও তো আমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। স্পৃহাকে সবাই খুব ভালোবাসে। স্পৃহা কষ্ট পেলে কেউ ভালো থাকতে পারবে না। আমি স্পৃহাকে ছাড়তে পারবো না। তুমি রায়হানকে বিয়ে করো বা না করো তা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি স্পৃহাকেই ভালোবাসি। আর বাকি জীবনটা ওর সাথেই থাকতে চাই। তুমি নিজের ভুলের জন্য আমাকে হারিয়েছ।'
জীবন কথাগুলো বলে সাথে সাথে নূপুরকে কল করলো। এক্ষুনি নূপুরকে এই কথাগুলো বলতে হবে। যেভাবেই হোক আর যে পরিস্থিতিতেই হোক, এখন স্পৃহা তার ওয়াইফ। নূপুর না চাইলেও এটা তাকে মেনে নিতে হবে।
নূপুর ফোন তুলছে না। জীবনের ফোন বাজলো।
'হ্যা ভাইয়া বলো।'
'কোথায় তুই? '
'এইতো আছি। কেন? '
'সকালে ওভাবে বেরিয়ে গেলি। তারপর আর কোনো খোঁজ খবর নাই। ঠিক আছিস তো? '
'হুম। '
'তোর সাথে দেখা করতে পারবো? আজ একটু পরেই।'
'হুম আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। '
'না। অন্য কোথাও বসবো।'
'আচ্ছা।'
রামিম আর জীবন মুখোমুখি বসে আছে। রামিম জানতে পেরেছে নূপুর আবার জীবনের কাছে ফিরে আসতে চাইছে। তাই সে জীবনের সাথে দেখা করতে এসেছে।
'আমি জানতাম এসবের পেছনে কোনো না কোনো ভাবে আমার বাবা জড়িত থাকবেই। এই লোকটা কারো ভালো দেখতে পারে না। বিশেষ করে ওর নিজের মানুষদের। কাছের মানুষ গুলো ভালো থাকলে ওর অস্থির হয়। এই লোকটা কেন এমন করে আমি বুঝতে পারি না।'
'ওর কথা বাদ দাও। নিজের বাবার আপন ভাই আর বড় আম্মুর হাজবেন্ড হয় বলে ওকে কিচ্ছু বলতে পারি না। নইলে
'মা কীভাবে সারাটা জীবন ঐ লোকটাকে সহ্য করে যাচ্ছে আল্লাহ জানে। আচ্ছা শোন যার জন্য এসেছি। তুই এখন কী করবি? ভেবেছিস কিছু? '
'জানি না ভাইয়া। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। '
'এখানে বোঝাবুঝির কি আছে? তুই কি নূপুর মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিবি? ওর জন্য স্পৃহাকে ছেড়ে দিবি?'
'আরে নাহ। পাগল নাকি তুমি? '
'তাহলে কি করবি? নূপুরকে সোজাসুজি বলে দে এখন আর কিছুই হবার নেই। যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে। এখন তোদের সবাইকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।'
'আমিও সেটাই ভাবছিলাম।'
'জীবন শোন ভাই। মানছি নূপুর তোর প্রথম প্রেম। কিন্তু এখন তো স্পৃহা তোর বৌ। তুই নিশ্চয়ই নির্দোষ একটা মেয়ের সাথে অন্যায় কিছু করবি না? ধর তুই বিয়ে করিস নি। কিন্তু নূপুরের বিয়ে হয়ে গেছে তখন কি সে ফিরে আসলে তুই তাকে মেনে নিতি? তুই নিশ্চয়ই অন্য একটা ছেলের সংসার নষ্ট হতে দিতি না। তেমনই নূপুরেরও তোর কাছে ফিরে আসার আগে স্পৃহার কথা ভাবা উচিত ছিল। সে নিজে একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সংসার ভাঙবে?'
জীবন চুপ করে রামিমের কথা শুনছে।
'দেখ নূপুর প্রথমে তোকে কিছু না জানিয়ে এনগেজমেন্ট করে নিলো। মানলাম আমার বাবা তাকে ভয় দেখিয়েছে। তাই বলে সে ভয় পেয়ে তোর থেকে সব লুকাবে? যেখানে ভালোবাসার মানুষটা পাশে আছে সেখানে ভয় কিসের? আমার বাবা কি প্রভার পরিবারকে কম ভয় দেখিয়েছে। কই প্রভা তো কখনো আমার হাত ছাড়েনি। বরং সে সব ভয় ছুড়ে ফেলে আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। নূপুর বরাবরই তোর থেকে তার ভাইদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। পরিবারের বদনাম করে সে তোর সাথে আসবে না এটাও অনেক বার বলেছে। তাহলে এখন কেন এনগেজমেন্ট হয়ে যাবার পর পরিবার ভাইদের সম্মানের কথা ভুলে গিয়ে তোর কাছে আসতে চাইছে। তখন তুই শুধু তাকেই ভালোবাসতি এটা জেনেও নূপুর তোর সাথে আসেনি। এখন তুই বিবাহিত এটা জেনেও কান্নাকাটি করে ফিরে আসতে চাইছে?'
'আমি কি করবো বলো? নূপুরকে আমি এখনো পুরোপুরি ভুলতে পারিনি। আবার স্পৃহার সাথে থাকতে থাকতে কখন ওর মায়ায় জড়িয়ে গেছি, কখন ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছি তাও জানি না। '
'জীবন লাথি খাবি তুই। তুই কি এখন ক্যারেক্টারলেস পুরুষ মানুষের মত ঘরে একজন আর বাইরে আরেকজনকে রাখবি? একজনকে না একজনকে তো তোর বেছে নিতেই হবে। দু'জনকেই কষ্ট না দিতে গিয়ে তুই শেষে কাউকেই সুখে রাখতে পারবি না। স্পৃহা এখনো কিছু জানে না। তাই বলছি এখানেই সব শেষ করে দে। পরে কিন্তু স্পৃহা নূপুরের কথা জানলে সেও কষ্ট পাবে। স্পৃহা যা ইমোশনাল মেয়ে হয়তো সেও নূপুরের কথা ভেবে তোকেই ছেড়ে দিলো।'
জীবন রামিমের সাথে কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল। সে এখন কি করবে তা তার কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেছে। সত্যিই স্পৃহা এসবের কিছু জানার আগেই জীবনকে কিছু একটা করতে হবে।
জীবন বাসায় ফিরে যাবার সময় নূপুরকে ফোনে অনেকবার ট্রাই করেও পেল না। সে বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামার সময় ঐদিন স্পৃহার জন্য কিনে রাখা শাড়ি আর গহনার বক্স হাতে করে নিয়ে নিলো। নিজের রুমে এসে কাভার্ডে শাড়ি রেখে গয়না রাখতে যাবে এমন সময়ই স্পৃহার রুম থেকে কী একটা শব্দ পেল। জীবন বক্স হাতেই দৌঁড়ে স্পৃহার রুমে গেল। গিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে দেখে ফুলদানি পড়ে তিন খন্ড হয়ে ভেঙে আছে। স্পৃহা নিচে বসে ফুলদানির ভাঙা টুকরো গুলো হাতে নিচ্ছে। মনে হচ্ছে স্পৃহা মাত্র শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এসেছে। তার মাথায় সাদা তোয়ালে পেচানো। জীবন বলল,
'রেখে দাও ওগুলো। হাত কেটে যাবে।'
স্পৃহা জীবনের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। জীবন এই প্রথম স্পৃহাকে ভেঁজা চুলে দেখছে। কতটা স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে। সে চেষ্টা করেও স্পৃহার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না। স্পৃহা মাথা থেকে তোয়ালে খুলে নিলে তার লম্বা চুলগুলো জীবনের চোখ ধাধিয়ে কোমরের কাছে নেমে এলো। ভেজা চুল থেকে বিন্দু বিন্দু পানি পড়ছে। স্পৃহা চুল মুছতে মুছতে বলল,
'আপনি কখন এসেছেন? '
জীবন স্পৃহার কথা কানে না নিয়ে একপা একপা করে স্পৃহার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্পৃহা পিছনে যেতে নিলে জীবন তার আগেই স্পৃহার কোমর টেনে ধরে। স্পৃহার পেছনে গিয়ে পিঠ থেকে চুল সরিয়ে সামনে নিয়ে আসে। নেকলেস বের করে ওর গলায় পরিয়ে দেয়। এক এক করে চুড়ি, রিং,নোসপিনটাও নিজের হাতে পরিয়ে দেয়। স্পৃহা কিছু বুঝতে পারছে না। তার হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। তোতলাতে তোতলাতে স্পৃহা বলল,
'এসব
স্পৃহা বেশি কিছু বলতে পারলো না। জীবন তার আগেই বলল,
'সুস্। এগুলো আমি নিজে তোমার জন্য নিয়েছি। পছন্দ হয়েছে তোমার? '
স্পৃহা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখে শুধু মাথা নাড়ালো। জীবন স্পৃহার ভেজা চুলে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট করে বলল,
'আমি তোমাকে নিজের মত করে সাজাতে চেয়েছিলাম। আমাদের বিয়েটা এমন পরিস্থিতিতে হয়েছে যার জন্য আমরা কখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। স্পৃহা আমি তোমাকে অনেক কিছু বলতে চাই। তোমাকে জানানোর মত অনেক কথা জমা হয়েছে।'
স্পৃহার হার্ট ধুকপুক করে যেন ফেটে যাচ্ছে। সমানে ঘামছে সে। স্পৃহা আর সহ্য করতে না পেরে পেছন ফিরে শক্ত করে জীবনকে জড়িয়ে ধরলো। স্পৃহার এই কান্ডে জীবন হেসে ফেললো। ঠিক এমন সময় জীবনের ফোন বেজে উঠলো। বিরক্তিতে জীবন মুখ কুঁচকে মনে মনে বলল,
'এই অসময়ে আবার কে বিরক্ত করছে? দুমিনিট বৌয়ের সাথে সময় কাটাতে দিবে না এরা?'
জীবনের ফোন রিং হলে স্পৃহা তাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। জীবন ফোন রিসিভ করে কানে নিলো।
'হ্যাঁ। '
'
'কি?'
'
'আচ্ছা আমি এক্ষুনি আসছি।'
'
'এইতো বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব।'
জীবন এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে স্পৃহাকে কিছু না বলেই আবার বেরিয়ে গেল। স্পৃহা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
'কার ফোন এসেছিল? একটু আগেই তো বাসায় ফিরলেন। এখন আবার কোথায় বেরিয়ে গেলেন? কে কথা বলছিল আর কি এমন বললো যার জন্য উনি এতো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন।'
নূপুর জীবনের গাড়িতে উঠে বসলো। জীবন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নূপুর বলল,
'আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি '
জীবন বুঝতে না পেরে বলল,
'হ্যা? '
'আমি আমার পরিবারের সবাইকে ছেড়ে একেবারের জন্য তোমার কাছে চলে এসেছি।'
'মানে কি এসবের? '
'তুমি জানো না। ওবাড়িতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব। কেউ আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে না। তারা শুধু তাদের সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারে। কেউ আমার সুখের কথা ভাবে না।'
এবার নূপুরের উপর জীবনের সত্যি সত্যিই রাগ লাগছে।
'এই কথাগুলো আমি আগেও তোমাকে অনেকবার বলেছিলাম নূপুর। কিন্তু তখন তুমি আমার কথা শোনো নি। তখন পরিবারের জন্য তুমি বিষও খেতে পারতে। তাহলে এখন কেন এসব বলছো? '
নূপুর মুখ কালো করে বলল,
'তোমার কাছে চলে আসাতে তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?'
'আমি এখন তোমাকে কোথায় রাখব?'
'চিন্তা করো না। আমি তোমার বাসায় যেতে চাইব না। আমি জানি ওখানে তোমার বৌ আছে।'
'নূপুর তুমি এখন কেন এসব পাগলামি করছো? আমরা তো নিজেদের লাইফে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছি।'
'তুমি এগিয়ে গেছ তা দেখতে পারছি। কিন্তু আমি এগোতে পারিনি।'
'রায়হান খুব ভালো ছেলে ও তোমাকে সুখে রাখবে।'
নূপুর রাগ করে বলল,
'তুমি আমাকে ফিরে যেতে বলছো তাই তো? তুমি এখন আর আমাকে ভালোবাসো না। তোমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল। আর তাইতো এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে গিয়ে তুমি বিয়ে করেছো। সংসার করছো।'
নূপুর চলতি গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলে জীবন গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল,
'কি পাগলামি করছো তুমি? '
'পাগলামি আমি করছি না। পাগলামি তুমি করেছো। তুমি একবার ভেবে দেখেছো তুমি কতটা স্বার্থপরের মত আচরণ করছো। এইতো কিছুদিন আগেও তুমি আমার জন্য পাগল ছিলে। আর আজ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ।'
'তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি কারণ এখন আর কিছুই আগের মত নেই। স্পৃহার জীবন আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। স্পৃহা আমার স্ত্রী। ওকে আমি কোনোভাবেই কষ্ট দিতে পারবো না।'
'জীবন তুমি শুধু ঐ মেয়ের কথাটাই ভাববে? আচ্ছা তুমি যে আমাকে ভালোবাসতে তার কি হলো? আমাকে ভালোবেসে ঐ মেয়ে সাথে সারাজীবন কাটাবে কি করে? '
নূপুরের কথা শুনে কেনই যেন জীবনের হাসি পেল।
'স্পৃহাকে আমি ভালো না বাসলেও ওর মায়ায় আটকে ওর সাথে বাকি জীবন পার করে দিতে পারবো। মেয়েটা সত্যিই মনে হয় জাদু জানে। কীভাবে ও তোমার জায়গা নিয়ে নিছে সেটা ও-ই জানে। '
নূপুর গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলো। জীবন ওর দিকে তাকিয়ে দেখলো যেকোনো মুহূর্তে একটা গাড়ি এসে ওকে উড়িয়ে দিয়ে যেতে পারে। জীবন দৌঁড়ে গিয়ে নূপুরের হাত ধরে বলল,
'কি করছো তুমি?'
নূপুর চিৎকার করে বলল,
'আর কি করতে পারবো আমি? এখন নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আমার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে এসেছি। এখন তুমিও আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ। তাহলে এখন আমি কোথায় যাব? আমি মরে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তোমার বৌকে নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারবে। আমি না থাকলে তখন আর কেউ তোমাদের মাঝে আসবে না।'
নূপুর জীবনের থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিলে জীবন আবার তাকে ধরে ফেলে গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
'তুমি কবে থেকে সুইসাইড করার কথা ভাবো? আগে তো তুমিও বলতে মানুষের জীবন অনেক দামী। সেটাকে কোনো ভাবে শেষ করে দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। আজ তুমি নিজেই সুইসাইড করার কথা বলছো।'
'সময় আর পরিস্থিতি মানুষের সব কিছু করাতে পারে। যা আমরা কখনো করতে চাই না তা করাতেও বাধ্য করে। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি সত্যি সত্যিই সুইসাইড করবো জীবন। '
জীবন ভেবে পাচ্ছে না সে এখন কি করবে। নূপুর তো পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। সে এখন সত্যি সত্যিই নিজের সাথে কিছু একটা করে বসবে। জীবন বলল,
'তুমি এখন আপাতত কয়টা দিন কোনো হোটেলে থাকতে পারবে? '
'হুম। '
'আমি সব ব্যবস্থা করে দিব। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। '
'জীবন সবকিছু আগের মত ঠিক হয়ে যাবে তো? আমি কিন্তু এখনও তোমাকে সেই আগের মতই ভালোবাসি। তুমি আমার সাথে এমনটা করো না।'
জীবনের এখন নিজের উপরই রাগ লাগছে। সে যদি নূপুরকে জেলাস ফিল করানোর জন্য স্পৃহাকে নিয়ে নূপুরের সামনে না যেত। তাহলে নূপুর ঠিকই এতদিনে রায়হানকে বিয়ে করে নিত। সব দোষ জীবনেরই। সে-ই নূপুরকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে স্পৃহাকে নিয়ে ঘুরেছে। নূপুর চোখের সামনে জীবনকে অন্য কারো সাথে দেখেই এতটা দুর্বল হয়ে গেছে।
স্পৃহা দেখতে পারছে জীবন আজকাল ভীষণ চিন্তিত থাকে। সব সময় কেমন ছটফট করে। মাঝে মাঝে কারো ফোন এলে সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। স্পৃহাকেও যেন কিছু বলতে চায় জীবন।
'আপনার অফিসে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? '
'না তো। কেন? '
'কিছুদিন ধরে আপনাকে চিন্তিত লাগছে।'
জীবন ল্যাপটপ রেখে উঠে এসে স্পৃহার কাছে দাঁড়াল। বলল,
'স্পৃহা আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। তুমি আমার কথা শুনবে? '
'হুম। বলুন। '
'তার আগে বলো তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না।'
'আপনাকে ভুল বুঝবো কেন? '
'না। আমার মনে হলো যদি তুমি আমাকে ভুল বুঝো। সত্যি বলছি স্পৃহা আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে।'
'কি হয়েছে বলুন।'
জীবন স্পৃহার হাত তার হাতে নিয়ে বলল,
'তুমি হয়তো জানো না। আমি নূপুর নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। কিন্তু বিশ্বাস করো ওর সাথে এখন আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। বিয়ের আগেই আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছিল। নূপুরের কথা আমি আগেও অনেক বার তোমাকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু বলতে পারিনি।'
স্পৃহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। জীবন আবার বলল,
'নূপুরের সাথে যা কিছু ছিল তা বিয়ের আগে ছিল। এখন ওর প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। স্পৃহা আমি তোমাকে নিয়ে আমার জীবন সাজাতে চাই। বাকিটা জীবন তোমার সাথেই কাটাতে চাই।'
রান্নাঘরে প্রেশার কুকারে সিটি বাজলে স্পৃহা ছুটে সেখানে গেল। জীবন রেগে গিয়ে বলল,
'আমার জীবনে কোনো কিছু ঠিক ভাবে হতে পারবে না। যখনই স্পৃহার কাছাকাছি যাই তখন ফোন বেজে ওঠে। আজ স্পৃহাকে বলতে যাব আমি ওকে ভালোবাসি। এমন সময় শালার কুকার বাধা দিল। মানে আমি আর স্পৃহা একসাথে হলে কিছু না কিছু হবেই হবে। কপাল আমার।'
পরের দিন জয় জীবনের অফিসে এসে সোজা জীবনের ক্যাবিনে চলে এলো। জীবন জয়কে দেখে বলল,
'আরে তুই! হঠাৎ আমার অফিসে। কি ভাগ্য আমার! '
জয় এসে জীবনের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
'কি শুনছি এসব? '
জীবন জয়ের এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেল।
'কি হয়েছে জয়? তুই এতো রেগে আছিস কেন? '
'রাগবো না? তোকে চুমাব? নূপুরের সাথে তোর আবার কী শুরু হয়েছে? '
'মানে? '
'না বোঝার ভান করলে প্রচুর মার খাবি। নূপুর বাড়ি ছেড়ে তোর কাছে চলে আসেনি?'
'তোকে এসব কে বলেছে? '
'কে বলেছে তা তোর জানার প্রয়োজন নেই। তুই বল নূপুরকে তুই কোথায় রেখেছিস? আমার সহজসরল বোনকে তুই ধোঁকা দিচ্ছিস। আমি তোকে মেরেই ফেলবো।'
জয় রাগের মাথায় সত্যি সত্যিই জীবনের মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। জীবন গালে হাত দিয়ে বলল,
'আহ। সত্যি সত্যি তুই আমাকে মারছিস!'
'তোকে আরো মারবো। শালা হারামি লুচ্চা বৌ থাকতে তুই এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে
জয় বেশি কিছু বলার আগে জীবন জয়কে উল্টো ঘুষি দিয়ে বলল,
'দেখ কেমন লাগে। আর হ্যা তুই আমাকে শালা বলছিস কেন হুম? আমার বোনকে তুই বিয়ে করেছিস? নাকি তোর বোনকে আমি বিয়ে করেছি? বন্ধুত্বের কথা নাহয় বাদই দিলাম। আমি তোর বোনকে হাজবেন্ড। তুই আমার গায়ে হাত তুললি? লজ্জা করলো না তোর? '
'লজ্জা আমার কেন করবে? লজ্জা তো তোর করা উচিত। তুই তো আগে এতটা ক্যারেক্টারলেস ছিলি না।'
'আরে দূর কিসের পেচাল পারছিস! আমি শুধু স্পৃহাকে ভালোবাসি। নূপুর তো জোর করে আমার কাছে চলে এসেছে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বলে গাড়ির নিচে পড়তে যাচ্ছিল। ও আমাকে এটাও বলেছে আমি ওকে ফিরিয়ে দিলে ও নাকি সুইসাইড করবে। তুই-ই বল এখন আমি কি করবো? ঐ মেয়েটাতো মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওকে একা কীভাবে ছাড়বো?'
জয় চোখ কপালে তুলে বলল,
'বলিস কি!'
'যা শুনেছিস।'
'সত্যি বলছিস তো? '
জীবন কপাল কুঁচকে বললো,
'বিশ্বাস হচ্ছে না? গড প্রমিজ সত্যি বলছি।'
'তাহলে তো তুই প্যাচে পড়ে গেলি। আমি তো ভেবেছিলাম আজ তোকে মেরেই ফেলব। আমার ভেবলির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিস।'
'আমি এমন অবস্থায় আছি। এখন না পারছি কারো সাথে নিজের অবস্থার কথা শেয়ার করতে। আর না পারছি সবকিছু একা সামলাতে।'
'কিন্তু দোষ তো তোরই। বিয়ের আগে এমন দু'চারটা প্রেম করলে বিয়ের পড়ে অবস্থা তো ডাল খিচুড়ি হবেই।'
'তোর পাছায় লাথি দিব শালা। কোথায় আমাকে হেল্প করবি তা না তুই খোঁচা দিচ্ছিস।'
'ভেবলি জানে এসব? '
'নূপুরের সাথে আগে রিলেশনে ছিলাম এটা বলেছি। কিন্তু এখন নূপুর আবার ফিরে আসতে চাচ্ছে তা বলিনি। '
'ভালো করেছিস। ভুলেও এই কথা স্পৃহাকে বলিস না। ভেবলি জনদরদী আবার অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। দেখবি নূপুরের কথা ভেবে তোকে ছেড়ে দিবে।'
'ছেড়ে দিবে? এতো সহজে কীভাবে ছেড়ে দিবে? স্পৃহা আমাকে ভালোবাসে না? ছেড়ে দিবে বললেই হলো নাকি? '
'তুইও তো নূপুরকে ভালোবাসতি তাকে কীভাবে ছেড়ে দিয়েছিস?'
'জয় তুই সত্যিই এবার লাথি খাবি। আমার অতীত নিয়ে টান দিচ্ছিস কেন? বোনের সংসারে সুখ চাস তো বর্তমান নিয়ে ভাব। আর আমাকে বল আমি এখন কি করবো?'
'নূপুরকে ভালো করে বোঝা। সবকিছু খুলে বল।'
'নূপুর এখন কোনো কিছু বোঝার মত সিচুয়েশানে নেই। বললাম না ও মানসিক ভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছে।'
'তাহলে এখন কি করা যায়?'
'হ্যালো স্পৃহা? '
হঠাৎ আরশি স্পৃহাকে কল রেখেছে দেখে স্পৃহা একটু অবাক হলো। তার সাথে তো আরশির কোনো কথা থাকার কথা না। তবুও আজ আরশি তাকে কল করেছে।
'স্পৃহা? '
'হ্যা আরশি বলো।'
'তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। '
'বলো কি কথা।'
আরশি যা বললো তা শুনে স্পৃহা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই কথাগুলো শোনার জন্য স্পৃহা প্রস্তুত ছিল না। স্পৃহা কথা বলছে না দেখে আরশি বলল,
'হ্যালো স্পৃহা শুনতে পারছো? আচ্ছা আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। এখন তাহলে আমি রাখি। পরে কথা হবে।'
স্পৃহা ফোন হাতে নিয়ে বেডে বসে পড়লো। আরশির কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। জীবন তো কাল তাকে অন্য কিছুই বলেছে। তাহলে আজ আরশি এসব কেন বলল? আরশি মিথ্যা বলছে? নাকি জীবন তার কাছে মিথ্যা বলেছে?