এখানে অংশীর জীবনকে আরো নতুনভাবে আবিষ্কার করার পালা। নতুন নতুন অজস্র নিয়ম। রুমে ওঠামাত্রই রুমমেট রা অনেক নিয়ম কানুন বলে দিয়েছে। কতকটা অংশীর মনে আছে, কতকটা ভুলে গেছে। কিছু কিছু নিয়ম বুঝতেই পারে নি ও। মেয়েগুলো যেমন কর্কশ তেমনি নিষ্ঠুর। প্রথম দেখেই এইটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না অংশীর।
মুখ ধুতে গিয়ে বাঁধলো আরেক ঝামেলা। বেসিনে হাত মুখ ধুতে হয়, বাইরে জলের বিন্দু যেন না আসে। অংশী বেচারি জানতো না। প্রথমবার মুখ ধুতে গিয়ে বেসিনের চারিদিকে অনেকখানি জায়গা জলে ভিজিয়ে ফেললো। রুমমেটরা দেখেই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে সময় লাগলো অংশীর। ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।
খালাকে টাকা দিয়ে আসতে হয় খাবারের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে খাবার নিয়ে আসতে হয়। বাকি দুই রুমমেটের দেখাদেখি খাবার নিয়ে আসে অংশী। ভাগ্যিস শহুরে মেয়েরা কারো দিকে তাকায় না। নয়তো ওর দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকলে লজ্জায় মুখ তুলতে পারতো না অংশী।
রুমমেট দুজন অংশীকে দেখলে কেমন একটা ভাব করে। ওদের দুজনের মধ্যে বেশ ভাব কিন্তু ওরা অংশীকে পাত্তা দিতে চায় না। নিরীহ অংশী একলা বিছানার উপর বসে থাকে আর মাঝেমাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনেমনে ভাবে এ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে গেলে কি হবে? বাবা মা কি মাহিবের মত একেবারেই পথে ফেলে দেবে? বাবার কথা জানে না, কিন্তু মা কিছুতেই মেনে নেবে না এ জানে অংশী। বাবা সত্যিটা নিশ্চয় জেনে গেছে এতক্ষণে। হয়তো কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। তারচেয়ে বড় কথা এলাকায় বাবার একটা সম্মান আছে। অংশী বাড়ি থেকে চলে আসায় সেই সম্মান খানিকটা নষ্ট হয়ে গেছে নিশ্চয়। এখন বাবার মুখোমুখি হতেও পারবে না অংশী। তাছাড়া এ অবস্থায় এলাকায় ফিরে গেলে সবাই বাবা মাকে ছিঃ ছিঃ করবে। ভুলেও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা মাথায় আনা যাবে না।
রাত নেমে এলে বুকের পাথর আরো ক্রমশ ভারী হতে থাকে। মাহিবের সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো চোখে ভেসে ওঠে। মাহিবকে এক পলক না দেখে কিভাবে থাকবে অংশী? পরিস্থিতি এতটাই কঠিন হয়েছে যে মাহিবকে এক পলক দেখার কোনো সুযোগ এখন নেই। কিভাবে পারবে অংশী?
চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। কষ্টেরা পুরো শরীর অবশ করে দিচ্ছে। দূর্বল শরীর আর বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বিছানায় ছটফট করতে লাগলো অংশী। কাঁদতে কাঁদতে অবশেষে ভোরের দিকে চোখে ঘুম নেমে এলো।
অংশী কখনো টুথ পেস্ট দিয়ে ব্রাশ করে নি। প্রীতম ওকে ব্রাশ কিনে দিয়েছে। সবার দেখাদেখি সকালবেলা অংশীও ব্রাশ করার জন্য বেসিনে এলো। রুমের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকলে মেয়েরা রেগে যাবে এটাই স্বাভাবিক। পাশের রুমের মেয়েরাও অংশীকে দেখলে বাঁকা চোখে তাকায়। ব্রাশ করার সময় অন্যের পেস্ট ব্যবহার করায় একগাদা কথা শুনিয়েছে অংশীকে। বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো অংশী।
কিভাবে কি করতে হয়, কিভাবে চলাফেরা করতে হয়, কিভাবে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়, কিচ্ছু জানে না অংশী। তিনদিনেই হোস্টেল জীবন অসহ্য হয়ে উঠলো। সবাই অংশীকে নিয়ে হাসাহাসি করে। গোসলের জন্য টানা দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ফিরে আসে অংশী। সবাই ওকে ঠেলে ফেলে গোসল করতে যায়। খাবারের সময়ও অংশীকে পিছনে ফেলে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে চলে যায়। সবার শেষে গিয়ে খালারও বকা শোনে অংশী।
রাতে ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে না। মাঝরাতে ডুকরে কান্না আসে। কিন্তু কাঁদতেও পারে না রুমমেট দের কারণে। অন্যের সামনে কাঁদতে লজ্জা লাগে অংশীর। শুধু চোখের নোনা জলে বালিশ সিক্ত হয়ে ওঠে। এ যে কি দুঃসহ কষ্ট!
খাবার খাওয়ার সময় কয়েকবার বমি করতে দেখে রুমমেটরা অন্য মেয়েদেরকে জানায়। পুরো হোস্টেলে জানাজানি হয়ে যায় অংশীর ব্যাপারে। সবার চোখ ভরা কৌতুহল। কেউ কেউ আবার পেঁচিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। কারো সাথে কথাও বলতে পারে না অংশী। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একটা জীবন এমনও ভয়াবহ হতে পারে, তা ভেবে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। যেখানে কেউ নেই, আপনজন নেই, বাবা মা নেই, পরিচিত একটা জনপ্রাণী নেই। সেখানে কিসের জন্য থাকা? কিন্তু আজ কোথাও ফিরে যাওয়ার পথ নেই অংশীর। এভাবেই চলতে হবে বাকিটা জীবন।
রান্নাঘরের বেসিনে ময়লা ফেলার অপরাধে অংশীকে ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে থেকে বড় আপুদের বয়ান শুনতে হলো। মনমরা হয়ে রুমে ফিরে আসতেই রুমমেটরা শব্দ করে হাসা শুরু করলো।
একজন বললো, 'এই মেয়ে, তুমি কোনো নিয়ম কানুন জানোনা তাহলে হোস্টেলে থাকো কেন? কোথায় পড়াশোনা করো?'
অংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। কি জবাব দেবে? ও তো কোথাও পড়াশোনাই করে না।
মেয়েটা বললো, ‘এভাবে বারবার অনিয়ম করলে হোস্টেল সুপার তোমাকে এখানে বেশিদিন থাকতে দেবে না বুঝেছো? সময় থাকতেই সবকিছু শিখে নাও। আর বললে না তো কোথায় পড়ো?'
অংশী এবারও কোনো জবাব দিতে পারলো না। মেয়েটা কাছে এসে কর্কশ কণ্ঠে বললো, 'তুমি তো চরম বেয়াদব। কথা না বলে চুপ করে আছো কেন? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আনসার দিতে হয়।'
অংশীর আবারও বমি বমি ভাব হচ্ছে। ও দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো বমি করতে। সবকটা ওয়াশরুম বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে বারান্দায় বমি করে দিয়েছে। এর জন্য আজ কপালে কি আছে কে জানে!
বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম নেমে এলো। ঘুমের মাঝে কিসব দেখে ঘুমটাও ঠিকমতো হলো না। তারই মাঝে রুমমেট এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে ডেকে তুললো অংশীকে। রাগে গজগজ করতে করতে বললো, 'মেয়ে তোমার বমি আরেকজন পরিষ্কার করে দেবে নাকি? সবাই বলছে তুমি নাকি প্রেগন্যান্ট। তো হোস্টেলে উঠেছো কেন?'
অংশী মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় পানি ঢেলে পরিষ্কার করে দেয়। মনে একটুও সুখ নেই। কষ্টে বুক ছিঁড়ে যায় অংশীর। বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে জীবনটা এমন কেন হলো! একটা ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো। এভাবে আরো কতদিন? হোস্টেলের মেয়েরা তো একেবারেই টিকতে দিচ্ছে না এখানে।
অংশী অশ্রুপাত করছিলো আর ভাবছিলো এসব। একটা মেয়ে এসে জানায় ওর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। তখনই প্রীতমের কথা মনে পড়ে যায়। নিশ্চয় প্রীতম এসেছে। এই শহরে প্রীতম ছাড়া আর কেউ নেই অংশীর। এত কষ্টের ভিড়েও কিছুটা আশায় বুক বাঁধে অংশী।
প্রীতমকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। জীবনটা এখানে কেমন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তার বর্ণনা শুনে প্রীতম শিউরে ওঠে। অংশী অনুনয় করে বলে, 'আমারে বিষ আইনা দেন না, খাইয়া মইরা যাই।'
প্রীতম বললো, 'এমন কথা ভুলেও বলবে না। জিনিসপত্র কিছুই নিতে হবে না, চলো আমার সাথে। এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা চলবে না তোমার।'
২৫!!
প্রীতম অংশীর হাত ধরে বেরিয়ে আসে হোস্টেল থেকে। রাস্তা পেরোবার সময় অংশীর হাত চেপে ধরে। অবাক হয়ে সে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে অংশী। কেমন যেন লাগে, অবাক হয়ে ভাবতে হয়। যে জীবনে সবাই ছেড়ে গেলো, সে জীবনে এ কোন আশার প্রদীপ জ্বেলে প্রীতম এলো।
একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসে দুজনে। খাবার অর্ডার করে প্রীতম অংশীর দিকে তাকায়। চোখমুখ শক্ত করে বলে, ‘তোমাকে এত ভেঙে পড়লে চলবে না। যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছো আমাকে গ্রহণ করবে না, তখন একা বাঁচতে শিখতে হবে। এমন নরম শাখাপ্রশাখা নিয়ে তা সম্ভব না। তেজী হয়ে জ্বলে উঠতে হবে তোমায়। বুঝেছো?'
অংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। প্রীতম বললো, ‘এভাবে হা করে চেয়ে থাকলে চলবে না। কথায় কথায় এত কাঁদলে হবে না। কান্নাকে চিরতরে বিদায় জানাও। একা বাঁচতে গেলে হাজারো মানুষের হাজারো কটুক্তি শুনতে হবে। সন্তান নিয়েও শুনতে হবে শত অপবাদ। সব সহ্য করে যেতে হবে।'
অংশীর প্রীতমের কথায় ভয় পেয়ে বললো, 'ক্যামনে বাঁচুম আমি? আমার মরণ হয়না ক্যান?'
প্রীতম রাগত স্বরে বললো, 'ভুল করেছো তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না? এমন পাগলের প্রলাপ বকো না। এই শহর নিষ্ঠুর নির্মম শহর। কেউ তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে না। তোমার জীবন তোমাকেই বহন করতে হবে। আমি জানি তুমি সেটা পারবে। তোমাকে পারতে হবে।'
প্রীতমের কথায় আশার আলো দেখতে পায় অংশী। চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর। অবাক হয়ে জানতে চায়, 'কি করমু আমি?'
প্রীতম উত্তরে বললো, ‘তোমাকে পথ আমি বলে দেবো। তুমি শুধু সেই পথে হাঁটবে। অনেক ঝড় ঝাঁপটা আসবে জীবনে। সব সহ্য করেই সে পথে হাঁটতে হবে। প্রতি পদে পদে কাঁটায় পা পড়বে। পা দিয়ে রক্ত ঝরবে। তবুও থেমে যাওয়া যাবে না।'
অংশী একটা নতুন জীবনের গন্ধ পাচ্ছে। মনে একটা প্রশান্তির ছায়া নেমে এলো। হ্যাঁ, অংশীকে শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। অংশীকে পারতে হবে, পারতেই হবে।