অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলো সাঁঝ।সারাদিনের কর্মব্যাস্ততায় শরীরটা বড্ড ঝিঁমিয়ে পড়েছে।চোখজোড়া মেলে তাকায় সাঁঝ।কিছুক্ষন যাবৎ একজোড়া খয়েরীবর্নের চোখ ওকে দেখে যাচ্ছিলো বিস্মিত নয়নে।চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছিলোনা সাঁঝের কিন্তু পিঠে ছোট্ট নরম হাতের ছোঁয়ায় চোখ খুলতে হলো ওকে।চোখ খুলতেই দেখতে পেলো খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট পূর্না।ঠোঁটজোড়ায় কিছুটা কৌতুহলতার ছোঁয়া আর চোখজোড়ায় আদুরে ভাব।সাঁঝের চোখ খোলা দেখে পূর্না ঠোঁট নেড়ে বলল,
''তুমি কি তাদ আন্তি?"
সাঁঝের ঠোঁটজোড়া প্রশ্বস্ত হয়ে হাসি ফুঁটে উঠে।ঘুমন্ত কন্ঠে পূর্নার গাল স্পর্শ করে বলল,
''জি আম্মু আমি তোমার সাঁঝ খালামনি।কিছু বলবে?"
পূর্না তার ছোট্ট হাত জোড়া দিয়ে সাঁঝের হাত টান দেয়ার বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলছিলো,
''মা দাকতে কালামনি।উতো উতো!!"
সাঁঝ উঠে বসে ভাগনীকে কোলে টেনে নিয়ে দুগালে চুমু দিয়ে বলল,
''মা ডাকছে সোনা?"
পূর্না নেমে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলতে লাগলো,
''হ্যা দেকেতে।আতো বল মামা বতে আতে।তোমাল দন্য অপেক্কা কলে।"
ভাগনীর মুখে এত কথা শুনে সাঁঝ হেসে ফেলে।তারপর ওকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
''আসেন আমরা যাই। আপনার আম্মু অপেক্ষা করছে তো। "
সাঁঝ পূর্নাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে আসে।সেখানে লাবনী বেলা বিভান নিশাদ আদনান কুঞ্জন হুমায়রা সবাই বসে।কুঞ্জনের হাতে মুড়ির প্যাকেট।লাবনীর হাতে পেয়াজ মরিচ আর বড় বোল।আর বেলার হাতে একটা বাটি আর মাদুর।বিভান পাঞ্জাবীর হাতা গুঁটিয়ে সাঁঝের দিকে চেয়ে বলল,
''সাঁঝ তোমার আপা মুড়ি মাখাবে ছাদে চলো যাই।"
সাঁঝের ভীষন ভালো লাগতে শুরু করে।আজ আপার হাতের মুড়ি খাবে ওরা।সেই পুরোনো স্বাদ সেই পুরোনো হাতের ছোঁয়া।সাঁঝ পূর্নাকে কোলে নিয়ে ওদের সাথে ছাদে চলে আসে।পূর্না ছাদে এসেই হাঁটছিলো এদিক ওদিক।এদিকে নিশাদ টাঙ্কির পাশে দাঁড়িয়ে মেসেজ বক্সে গিয়ে সেখানে টাইপ করছিলো,
''ছাদে আলো ছড়ানো চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত অষ্টাদশী রমনীকে স্ত্রী করে পাওয়ার আশায় মনটা বড্ড বেহায়া হয়ে গেছে।কিন্তু হায়!!! কি করা রমনী যে এখনো ছোট।"সেন্ড বাটনে ক্লিক করে নিশাদ পাশে তাকিয়ে দেখলো ছোট্ট পূর্না আশেপাশে তাকিয়ে হাঁটছে। নিশাদ মৃদু হেসে আদুরে কন্ঠে বলল,
''আম্মু এখানে কেন তুমি?অন্ধকারতো পড়ে যাবে।"
পূর্না ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,
''তাঁদ দেকবো।আমাকে দেকাবে?"
নিশাদ বলে উঠলো,
''আসো আমার কাছে।"
পূর্না ধীর পায়ে শঙ্কিত দৃষ্টিতে নিশাদের কাছে এসে দাঁড়ায়।নিশাদ ওকে কোলে নিয়ে চাঁদের সামনে নিয়ে এলো।বলে উঠলো,
''চাঁদ দেখো মা।"
পূর্না চাঁদ দেখায় ব্যাস্ত।হঠাৎ চাঁদের দিকে চেয়ে বলল,
''তোমলা আমাদেল তাতে তাকোনা কেন?দানো আমাল না এতা এতা বালো লাগেনা।"
নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
''এই তো একসাথে আছি মা।"
হঠাৎ মামা ভাগনীর কথার মাঝে ফাঁটল ধরালো লাবনী।এসে বলতে লাগলো,
''ভাই আপার মুড়ি মাখানো শেষ।তোকে বলছে পূর্নাকে নিয়ে যাইতে।"
নিশাদ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
''যা তুই।"
লাবনী চলে গেলো। পিছু পিছু নিশাদ ও ভাগনীকে নিয়ে সেখানে চলে গেলো।বিভান আর আদনান একসাথে বসে গল্প করছে।নিশাদ পূর্নাকে কোলে নিয়ে বেলার পাশে বসে।অপর পাশে কুঞ্জন বসে আছে।বেচারা কে দেখে বুঝা যাচ্ছে অনেকক্ষন যাবৎ লোল গিলছে।বেলা এবার এক লোকমা নিয়ে নিশাদের মুখের সামনে ধরে।নিশাদ কি বলবে খুঁজে পেলোনা।আজ আপার হাতের মুড়ি মাখানো অনেক বছর পর খাচ্ছে।অজান্তে চোখের কোনা ভরে আসে নিশাদের।মুড়ি মুখে নিয়ে নেয় ও।এদিকে পূর্না বলে উঠে,
''মা তুমি বলো মামা কাইয়ে দিত্তো কেন?মা বলো অয়েতে না?"
মেয়ের মুখে দুটো বাদাম দিয়ে বেলা বলল,
''পূর্না ওরা আমার কাছে এখনো ছোট আম্মু।তাই খাইয়ে দিচ্ছি।"
পর পর ভাইবোনকে খাওয়াতে থাকে বেলা।বিভান নিজেই খাচ্ছিলো। শালা শালীদের সাথে গল্পের মাঝে স্ত্রীকে দেখার সুযোগ ছাড়ছিলোনা।বেলাকে ভীষন খুশি দেখাচ্ছে আজ। অনেক বছর পর বেলাকে এমনটা দেখাচ্ছে।হঠাৎ বিভান বলে উঠে আচ্ছা তোমরা শুনো আমাদের শপিং করা বাকি।সাইমনের জন্য কাপড় চোপড় কিনতে হবে।এক্ষেত্রে বেলা আমি আর নিশাদ যাবো শপিংমল। আদনান তুমি কার্ডের ব্যাপারটা দেখো ঠিক আছে।আর হ্যা গেস্টের লিস্টটাও তো বানাতে হবে।সেটা তোমরা সবাই মিলে করে নাও।সবাই রাজি হয়ে যায় বিভানের কথায়।
ছাদ থেকে নেমে এসে বিভান সবাই কে জড়ো করে লাগেজ নিয়ে বসে।কালকে কাউকে গিফট গুলো দেয়া হয়নি।আজ না হয় দেয়া হোক।লাগেজ থেকে বিভিন্ন ছোট ছোট গিফট বের করতে থাকে বিভান।ইকরাম রাহমান সুযোগ পেয়ে আবার ও কোলে নিয়ে বসেন পূর্নাকে তবে পূর্না আজ আর বিরক্ত হচ্ছেনা বরং চুপচাপ নানার কোলে বসে আছে। বিভান একটা পাঞ্জাবী, ঘড়ি আর দামী আতর নিয়ে ইকরাম রাহমানকে দিয়ে বলল,
''অল্প কয়েকদিনে বেশি কিছু কিনতে পারিনি।এগুলো আপনার জন্য।"
ইকরাম রাহমান লজ্জিত হাতে ধীরে সেগুলো নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
''ধন্যবাদ।"
বিভান হেসে সেখান থেকে চলে আসে।সবার জন্যই কিছুনা কিছু এনেছে ওরা।সাঁঝের জন্য কিছু গয়না আর জামা ও এনেছে। গিফট দেয়ার মাঝেই আড্ডায় জমে উঠে সেই সময়টা।রাতের আঁধার নেমে আসতে থাকে।সেই সাথে চারিদিক নিরিবিলি হয়ে আসে।বেলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।একটুপর রাতের খাবার খাবে ওরা।ভাত চড়িয়ে বারান্দায় আসতেই বেলার মনে হলো হুমায়রা কারোর সাথে কথা বলছিলো।বেলা বলল,
''কার সাথে কথা বলছিলি হুমু?"
কিছুটা কেঁপে উঠে হুমায়রা বোনের আগমনে।বলতে লাগলো,
''আপা আমি বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম।লাগতো কিছু?"
''উহুম,লাগত না।একটু তো গল্প করতে পারিস।"
হুমায়রার কেমন অস্বস্তি লাগতে থাকে।ধীর কন্ঠে বলল,
''আপা পড়া নিয়ে একটু ব্যাস্ত থাকি।"
''ওহ বারান্দায় বসে পড়ার কথা বলার কি হলো?রুমে ও তো বলতে পারিস।"
হুমায়রা কিছু না বলে বেলাকে পার করে রুমে চলে গেলো।ব্যাপারটা বেলার ভালো লাগেনি।
বেলা চুপচাপ বারান্দা থেকে চলে আসে।এদিকে নিশাদ আর আদনান পূর্নাকে নিয়ে খেলছে।পূর্নাও ওদের সাথে বেশ মিলেছে।তখনই নিশাদের নম্বরে মেসেজ টোন বেজে উঠে।ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইদ্রির ম্যাসেজ।সেটা ছিলো,
''সেদিন ঘাসের ওপর আদর করার সময় মনে হয়নি সামনে থাকা মেয়েটি এখনো ছোট?"
নিশাদ ফের মেসেজ টাইপ করতে থাকে।
''বুঝেছিলাম।কিন্তু সময়টা আমাকে ভাবতে দেয়নি।"
রাতের খাবার শেষে বেলা ফোন নিয়ে এসে বসে।সাঁঝ বাথরুমে গেছে ফ্রেশ হবার জন্য।বেলা ফোন চালাচ্ছিলো হঠাৎ অনূভব করলো পাশেই সাঁঝের ফোন কেঁপে কেঁপে উঠছে।বেলা হাতে নিয়ে দেখলো সাইমন কল করছে।কি করবে বুঝতে পারেনা বেলা।রিসিভ না করলে বেচারা চিন্তা করবে।এর চেয়ে ভালো তাকে জানানো হোক সাঁঝ ওয়াশরুমে।ভেবেই কল রিসিভ করে বেলা।ওকে কিছু বলতে না দিয়ে সাইমন বলল,
''হায় ড্রিম গার্ল কই তুমি?বড্ড মিস করছি?সাতটাদিন শেষ হতে চাচ্ছেনা।"
বেলার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছিলো।হাসি আটকে বলল,
''ওহ।আসলে আমি সাঁঝের বড় বোন বেলা।ও একটু কাজে আছে।"
''আপু সরি।আসসালামু আলাইকুম ভালো আছেন?"
থতমত খেয়ে উঠে সাইমন।কি বলছিলো ও এতক্ষন আপুকে?বেলা বলল,
''ইটস ওকে।ওয়ালাইকুম আসসালাম,আলহামদুলিল্লাহ। দাদু কেমন আছেন?"ভালো আপু।আপনারা সবাই ভালো আছেন?দুলাভাই পূর্না।"
''আলহামদুলিল্লাহ। সাঁঝ বের হলে বলবো কল ব্যাক করতে।"
''ওকে আপু আসসালামু আলাইকুম। "
''ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া।"
বেলা কল কেঁটে খাটে রাখতেই সাঁঝ বেরিয়ে এলো।বেলা হেসে বলল,
''সাইমন কল করেছিলো।"
সাঁঝ কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
''কি বলল ওনি?"
''তেমন কিছুনা।নে কল দে।"
সাঁঝ কিছুটা লজ্জা পেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে খাটের অপরপাশে গিয়ে বসলো।
.........................অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে রুমে আসে ইমতিয়াজ।গাড়ি চলাকালীন বাবার বন্ধু আলতাফ আঙ্কেলের অনেক গুলো কল এসেছিলো।কিন্তু ধরতে পারেনি ও।ঘরে ফিরে খাটে শুতেই আবার ও কল আসে আঙ্কেলের নম্বর থেকে। ইমতিয়াজ কল রিসিভ করতেই আলতাফ বলতে লাগলো,
''ইমতিয়াজ কই তুমি?"
''জি আমি ঘরেই আছি।কেন আঙ্কেল?"
''তোমার বাবা অনেক অসুস্থ ইমতিয়াজ।ডাক্তার দেখিয়েছিলাম ওনি বললো তোমার বাবার ফুসফুসে পানি জমে গেছে।ভীষন অসুস্থ।তুমি কথা বলো তোমার বাবার সাথে।"
ইমতিয়াজের শরীরটা কেঁপে উঠে।বুকটা কেমন ভারি হয়ে আসে ওর।বাবা ঠিক আছে তো?কিঋুক্ষনের মাঝে অসুস্থ কন্ঠে কথা বলে উঠে বাবা।বলতে লাগলেন,
''ইমতু বাবা কেমন আছিস?"
''এই তো বাবা।তোমার এ অবস্থা আর একবারো জানালেনা?"
''তুই এমনিতেই চিন্তায় থাকিস।তাই আর জানাতে পারিনি।"
ইমতিয়াজের চোখের কোনা ভিজে আসে।ধরা গলায় বলতে লাগলো,
''বাবা কি বলছো এসব?"
''সবাই মরে যাবে একদিন ইমতু।তোর মা আর ইদ্রির খেয়াল রাখিসরে।ভালো একটা ছেলে দেখে ইদ্রির বিয়ে দিস।আর বাবাকে ক্ষমা করে দিস ইমতু।ভালো থাকিস।!"
সাথে সাথে শোনা গেলো জোরে কাশির শব্দ। ইমতিয়াজ চিৎকার করে বলল,
''বাবা।"
তখনই আলতাফ আঙ্কেলের কথা শুনা গেলো।ওনি বললেন,
''ওকে ঔষধ দিবো। তোমার সাথে পরে কথা হবে ইমতিয়াজ। "
''আঙ্কেল আমি কল দিবো।প্লিজ বিরক্ত হবেননা।"
''না বাবা কিছু হবেনা।রাখি ইমতিয়াজ।"
''জি আঙ্কেল।বাবার খেয়াল রাখবেন।"
''নিশ্চয়ই।"
!!!!
পরদিন সকালে নাস্তা করেই নিশাদ কে নিয়ে বিভান আর বেলা বেরিয়ে পড়ে শপিংয়ের জন্য।সাইমনের জন্য হলুদের পাঞ্জাবি বিয়ের শেরওয়ানি আর কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনবে আজ।সারাদিনে রাজধানীর একটি মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে শপিং করে ফেললো ওরা।পাশাপাশি সাইমনের জন্য একটু নতুন আংটি ও কিনে ফেললো।দুপুরে তিনজনে পাশ্ববর্তী একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে এলো।ছোট্ট পূর্না জুলেখা বানুর কাছে।নিশাদ আজ অফিসে যায়নি শপিং এর জন্য।সুপে চামচ চালাতে চালাতে বিভান বলল,
''আমাদের সাইমনের দাদির সাথে একবার কথা বলা উচিৎ।ওনারা হলুদ করবেন তো সেই হিসেবে আমাদের ও আগাতে হবে।"
নিশাদ মাথা নেড়ে বলল,
''জি ভাই।সেটা করা উচিৎ। আপনি না হয় ফোনে কথা বলে নিয়েন।"
বিভান মাথা ঝাঁকিয়ে সুপের চামচে চুমুক দিলো।হঠাৎ বেলার ফোন বেজে উঠে।সুপের চামচ রেখে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বেলা।জুলেখা বানুর নম্বর দেখে চিন্তায় পড়ে যায় ও।পূর্না ঠিক আছে তো?মেয়েটার সাথে অনেকক্ষন যাবৎ দেখা নেই।চটজলদি কল রিসিভ করে বেলা।শুনতে পেলো পূর্নার গলা ফাঁটা কান্নার আওয়াজ।জুলেখা বানু বলতে লাগলেন,
''বেলা তোর মাইয়া কিছু খাইতাছেনা। খালি কাইনতাছে।তোরা কতক্কনে আইবি?"
বেলা চিন্তিত হয়ে উঠে।ও বলল,
''এই যে চলে আসবো।বেশিক্ষন লাগবেনা।"
''জলদি আয়।"
বেলা ফোন রেখে নিশাদকে বলল,
''জলদি বাসায় চল।পূর্না কান্না করছে কিছু খায়না নাকি।"
বিভান উঠে দাঁড়িয়ে ওয়েটার কে ডেকে বলল খাবার গুলো প্যাকেট করে দিতে।তারপর বিল মিটিয়ে দিয়ে তিনজনে বেরিয়ে আসে।ঘরে ফিরতেই পূর্না বেলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলছিলো,
''তোমলা পতা। আমাকে এতা এতা লেকে তলে গেতিলা।বাবা মামা দুদনেই পতা।"
নিশাদ হেসে ফেললো।বিভান মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল,
''না আম্মু।তোমার সাঁঝ খালামনির জন্য একটু শপিং করলাম। কান্না করোনা।খেয়েছো তুমি?"
পূর্না মাথা নেড়ে কাঁদো স্বরে বলে উঠলো,
''কাবোনা।লাগি নানা কাল কোলে নেয়।"
বেলা গিয়ে মেয়ের খাবার তৈরি করতে থাকে।বিভান বলল,
''এভাবে বলেনা পূর্না।ওনি তোমার নানা আম্মু।ওনি কষ্ট পাবেন শুনলে।তুমি লক্ষী মেয়ে আমার।"
নিশাদ বলল,
''ভাই আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।লাবু কলিজা পূর্নাকে নিয়ে যা আপার কাছে।"
কোথা থেকে লাবনী দৌড়ে এসে পূর্নাকে কোলে নিয়ে বলল,
''চলো আম্মু মার কাছে যাই। "
পূর্না খালার কাঁধে মাথা রাখলো।লাবনী ভাগনীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।"
........................এদিকে প্রিয়াশাকে আজকাল দেখা যায়না।আদনামন কাজে ব্যাস্ত থাকার মাঝে ও বারবার আশেপাশে তাকিয়ে প্রিয়াশাকে খুঁজতে থাকে।বিকেলে আদনান কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে ডিরেক্টরের কেবিনের উদ্দেশ্যে।সেখানে যেতেই প্রিয়াশাকে দেখতে পেলো ডিরেক্টর ফজল শেখের পাশে দাঁড়িয়ে কি যেন বুঝার চেষ্টা করছে।আদনান সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ডিরেক্টর স্যার ফজল শেখ একটা ফাইল আদনানের দিকে এগিয়ে বলল,
''খন্দকার গ্রুপের সাথে একটা মিটিং আছে আমাদের।সেখানে আমার যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমি বের হবো।তাই তুমি আর প্রিয়াশা চলে যাও সেখানে।ওনারা আমার খিলক্ষেতের রেস্ট হাউজে আসবেন।তোমরা এখনই বেরিয়ে যাও।"
''জি স্যার।"
বলেই প্রিয়াশার দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকায় আদনান।প্রিয়াশা ওকে একপলক দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়।ডিরেক্টরের কথা মতো ওরা বেরিয়ে পড়ে। স্যারের কেবিন থেকে বেরুতেই সৃষ্টি এসে বলল,
''স্যার আপনি আজ ফ্রি আছেন?ডিনার করতাম একসাথে।"
প্রিয়াশার দিকে চেয়ে মিটমিট করে হেসে আদনান বলল,
''আজ নয়।একদিন অবশ্যই যাবো ফ্রি হয়ে।"
সৃষ্টি কিছুটা মন খারাপ করে বলল,
''ঠিক আছে স্যার।"
আদনান প্রিয়াশার দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো প্রিয়াশা সেখানে নেই কিছুটা বিচলিত হয়ে আদনান আশেপাশে খুঁজতে থাকে।হঠাৎ দেখলো প্রিয়াশা অফিসের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সেদিকে চলে আসে আদনান।আদনান আসতেই প্রিয়াশা গাড়িতে ঢুকে বসে পড়ে।আদনান কিছু না বলে ওর পাশে বসে।প্রিয়াশা জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে।আদনান বলল,
''প্রিয়াশা আপনি আমার সাথে কথা বলেননা কেন?"
প্রিয়াশা ওর দিকে না তাকিয়ে বলল,
''বলিনা কোথায় স্যার?এই যে বলছি।কাজের সময়েতো কথা হয়ই আমাদের।"
''সেই কথা না প্রিয়াশা।তুমি আমাকে ইগনোর করছো।কেন জানতে পারি?"
''স্যার আমি স্বল্প বেতনে জব করি।আমার তো যোগ্যতা নেই আপনার মতো বড় অফিসারকে ইগনোর করা তাইনা?আর সেখানে আমি আপনার কিছু হইনা।আমাদের ধর্ম ও আলাদা।সো সেখানে ইগনোর করার ব্যাপারটা আসেনা। "
আদনান বলল,
''দেখো প্রিয়াশা!!!"
''প্লিজ স্যার আমি কোন কথা বলতে চাইছিনা।আর আপনি ফজল স্যার কে বলতেন আপনি আসবেননা।সৃষ্টির সাথে ডিনার করতে যেতে পারতেন।"
আদনান কিছুটা রেগে বলল,
''এতক্ষন যা বলার বললেন।এর পর সৃষ্টির কথা বলে কি বুঝাতে চাইছেন আপনি জ্বলেন সৃষ্টির সাথে আমাকে দেখলে!!!!"
জবাবে প্রিয়াশা আর কিছুই বলতে পারেনা।চুপ হয়ে যায়।সেদিন ওদের মাঝে কোন কথা হয়নি।
প্রিয়াশা সেদিন ঘরে ফিরে রুমের দরজা লক করে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।ওর জীবন টা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেছে যেদিন এই নকল চাচা চাচীর কাছে বিক্রি হয়ে গেছিলো।সেদিন থেকে ওর জীবিত হয়ে ও মরে গেছে।ওর শরীরের একেকটা আঘাতের চিহ্ন ওর গত তেইশ বছরের যন্ত্রনায় জর্জরিত জীবনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।প্রিয়াশা কান্না জড়িত গলায় বলতে লাগলো,
''আদনান আপনাকে কিভাবে নিজের এই অভিশপ্ত জীবনে জড়াতে পারি বলেন?ঠিক বলেছিলেন আমার খুব জ্বলে।কারোর পাশে আপনাকে দেখলে আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়।কিন্তু কি করবো বলেন আমার হাত বাঁধা।আপনার কাছে আসার সাহস নেই।সবচেয়ে বড় বাঁধা আমাদের মাঝে আজ আমাদের ধর্ম।এটা কেন হলো আদনান?আমার প্রথম ভালোবাসা কি পাবো না আমি?"
হঠাৎ দরজায় নকের শব্দ পেয়ে প্রিয়াশা চোখ মুছে সেদিকে তাকায়।
.........................অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেই সাঁঝের সামনে এসে দাঁড়ায় সাইমন।সাইমনকে এভাবে আসতেই দেখেই কিছুটা লজ্জা পায় সাঁঝ।বলতে লাগলো,
''আপনি এখানে?"
সাইমন সাঁঝের হাত ছুঁয়ে বলল,
''হবু বৌটাকে দেখতে বড় ইচ্ছে হচ্ছিলো।"
সাঁঝ লজ্জা মাখা হেসে বলল,
''কিছুদিন পর তো আসছিই আপনার ঘরে।"
''সেটা ঠিক আছে।তবে আরো পাঁচদিন বাকি।কিভাবে যে কাঁটবে এতগুলো দিন।আচ্ছা চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।গাড়িতে কথা হবে।"
সাইমনের কথা মতো ওরা গাড়িতে এসে বসে। সাঁঝের হাত সাইমন এক হাতে ধরে রেখে অপর হাতে ড্রাইভ করছে।হঠাৎ সাইমন বলে উঠে,
''তোমার দুলাভাই দাদীকে কল দিয়েছিলো হলুদের জন্য।"
''ওহ।তা কবে ফিক্স হলো?"
''উনত্রিশ তারিখ তোমারটা। কারন হলুদের কাপড় কিনতে হবে।"
''হুম।"
সাঁঝের হাতের পিঠে চুমু দেয় সাইমন।তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
''বিশ্বাস হচ্ছেনা এতো সহজে তোমাকে পেয়ে যাবো।জানো সব কিছু স্বপ্নের মতো লাগছে সাঁঝ।"
''আমার ও।অবশ্য ভাইয়ার ওপর বিশ্বাস ছিলো।বাবা যাই বলুক ভাইয়া আমার ব্যাপারটা চিন্তা করবেই।"
''হুম। "
সাঁঝ এগিয়ে এসে৷ সাইমনের কাঁধে মাথা রেখে মৃদু হাসতে থাকে।সাইমন সাঁঝের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
''জানো তোমাকে কাছে পেলে ইচ্ছে হয় একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেই।একদম তোমার মাঝো হারিয়ে যাই।শুধু বিয়েটা আমাকে আগাতে দেয়না।"
সাঁঝ লজ্জা পেয়ে সরে এসে সাইমনের বুকে হালকা ঘুঁষি দিয়ে বলল,
''অসভ্য লোক আপনি।"
সাইমন সশব্দে হাসতে লাগলো শরীর কাঁপিয়ে।
............................এদিকে আগের দিন রাতে বাবার চিন্তায় সারাটারাত চোখ লাগাতে পারেনি ইমতিয়াজ।রাতটা প্রচন্ড অস্থিরতায় কেঁটে যায় ওর।না পারছে কাউকে বলতে না পারছে কিছু করতে।বাবার একমাত্র ছেলে হয়ে ও কিছু করতে পারছেনা।আজ সকালে আলতাফ আঙ্কেলের সাথে কয়েকবার কথা হয়েছিলো ওর।কিন্তু কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছেনা।যতোবারই আঙ্কেলের সাথে কথা হয়েছিলো একটাবার ও বাবার সম্পর্কে ভালো কোন খবর পায়নি ইমতিয়াজ।রাতে ঘরে ফিরে খেতে বসে ইমতিয়াজ। হঠাৎ ফোনে আলতাফ আঙ্কেলের কল দেখে বুক কেঁপে উঠে ইমতিয়াজের।সৈয়দা বেগম চেয়ারে বসে আপেল কাঁটছেন।ইমতিয়াজ সেখান থেকে সরে বারান্দা এসে দাঁড়ায়।তারপর কল রিসিভ করতেই আলতাফ আঙ্কেল বলতে লাগলেন,
''বাবা তোমাকে কিছু কথা বলবো।প্লিজ শান্ত থেকো।কারন তুমি শান্ত না থাকলে ইদ্রি আর ভাবিকে শক্ত রাখতে পারবেনা। সো তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।"
ইমতিয়াজ কিছু বুঝতে পারছেনা।হঠাৎ আঙ্কেল কেন বলছেন এসব?ওকে কেন শক্ত থাকতে হবে?বাবা ঠিক আছে তো?প্রচন্ড চিন্তায় বুক কাঁপতে থাকে ইমতিয়াজের।প্রবল ঠান্ডা বাতাসে ও শরীর ঘেমে শেষ।কাঁপানো কন্ঠে ইমতিয়াজ বলে উঠে,
''আঙ্কেল কি বলছেন এসব?বাবা কই?কেমন আছে আমার বাবা?"
''ইমতিয়াজ তোমার বাবা আর নেই।ওনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।"