রংধনু - পর্ব ০৪ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


লাল চন্দ্রিমা একটি সন্ধ্যার অবসান ঘটে হিমেল হাওয়ায় পরিপূর্ন রাত নেমে এলো উঁচু পাহাড় আর সাদা তুলোর মতো বিশাল আকাশের গা বেয়ে।ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।রাফিজ সাহেবের গেস্ট হাউজ দুটো একটা বাজারের সাথে আরেকটা ওনাদের বাড়ির পাশেই । বাজারে হেঁটে গেলে পনের মিনিটের মতো লাগে আর রিক্সায় গেলে আরো দেরি কারন রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। একেতো পাথুরে তারওপর ভাঙ্গা চুরা আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।মানুষ পিছলে পড়ে ও হাত পা কেঁটে ফেলেছে এমন ও তথ্য আছে।একবার তো সরেশ বাগচী হেঁটে যাচ্ছিলেন বাজারের পথে।এলাকার নামকরা মাস্তান ছিলো সে।অবশ্য বছর পাঁচেক আগে মরে গিয়েছিলো ব্যামো বেঁধে।যাই হোক একবার গোরস্থান থেকে লাশ চুরি করে সেটার বিভিন্ন অঙ্গ বেঁচে মদ কিনেছিলো।সেটা এলাকায় রাম নামে পরিচিত।প্রচন্ড বাতাস হচ্ছিলো।বেচারা লুঙ্গী খুব কষ্টে সামলে নিয়েছিলো কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি।লুঙ্গি উড়ে যায় একসময় আর বেচারাও পাশে নর্দমায় পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকে।পাশের ঘরের কিছু সাঁওতাল ছেলে মেয়ে সরেশ বাগচীকে দেখে হেসে কুঁটি কুঁটি।বেচারা কোনমতে সেদিন নর্দমায় পড়ে থাকে কারন মদের নেশা এতোটাই চড়েছিলো যে জ্ঞান হারিয়েছিলো সে।
রাস্তা ধরে হাঁটছিলো কিরন আর বিভান।বিভানের পরনে সাদা পাঞ্জবী আর পায়জামা তবে সেটা কালো।ওর পাঞ্জাবীর কলারে ও কালো ও পাইপেন লাগানো আর খুব সুন্দর কাজ করা।এশার নামাজ পড়তে বেরিয়েছিলো ওরা।মসজিদ থেকে ফিরে গেস্ট হাউজের পথে পা বাঁড়ায়।মসজিদে থাকা কালীন ওরা বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেয়েছিলো। দীর্ঘ একঘন্টা বৃষ্টি হয়ে আস্তে আস্তে কমে তারপর থেমে যেতেই দুজনে বেরিয়ে আসে।
বাজারে কিছু মহিলা আটকা পড়েছিলো।বৃষ্টির কারনে বেরুতে পারেনি তারা।এখানকার প্রায় বেশির ভাগ মানুষ কালো নয়তো শ্যামলা আর না হয় উজ্জ্বল শ্যামলা।এই এলাকায় বিভানের মতো গোরা বর্ন আর কেউই নেই।তাই হঠাৎ বিভান কে মসজিদ থেকে বেরুতে দেখে সবার চোখ কপালে।বিভানের মা পাকিস্তানী আর বাবা ভারতীয়।মামাদের মতো হওয়াতেই বেশ লম্বা ফর্সা হয়েছে।চেহারায় আছে প্রচুর নুরানী ভাব।মহিলা গুলো ওকে দেখে হেসে যাচ্ছিলো আর উঠতি বয়সী তরুনীরা একে অপরের কানে ফিসফিসিয়ে যাচ্ছিলো।হঠাৎ কি যেন হলো পাশ থেকে এক বৃদ্ধা ছুটে এসে বলল,
''কিরিন্না এডা কেরে?"
কিরন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
''তুমি জাইনা কি করবা বুড়ি?যাও বাড়ি যাও বুড়ায় অপেক্ষা করতেছে।"
''আমার তো এনারে লাগবে।"
''বুড়িরে কালনাগীনি যাও।"
বলেই বিভানকে নিয়ে সামনে এগুতে থাকে কিরন।বিভান বলল,
''কি বলল ওনি?"
''কে?"
অবাক হয়ে জানতে চয় কিরন।বিভান বলল ''আরেহ ঐযে বয়স্ক ভদ্র মহিলা।"
''ওহ।তোমাকে বিয়ে করতে চাইলো।বললাম তুমি বিয়ে করেছো পাঁচ সন্তানের জনক।তাই বুড়ি ভয়ে চলে গেলো।"
বিভান চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই কিরন বলল,
''মজা করছি অতো রাগছো কেন?"
বিভান স্বাভাবিক সুরেই বলল,
''একদম রাগছিনা বরং ভাবছি কাল তোমার বাড়ি গিয়ে আন্টিকে বলবো এ্যাসাইলামের সিট বুকিং দিতে।"
''কেন? "
অবাক হওয়ার ভান করে কিরন।বিভান সেই একই সুরে বলল,
''তার একমাত্র ছেলের নাতিপুতি দেখার আগেই পাগল হয়ে গেছে বদ্ধ পাগল।"
হো হো কে করে হেসে উঠে কিরন।হঠাৎ কিরন অাবিষ্কার করলো কাঁদায় মুখ থুবরে পড়ে গেছে বিভান।কিরন হাসি থামাতে চেষ্টা করতে করতে বিভানের পাশে এসে একটু উঁবু হয়ে ওকে বলল,
''ঠিক আছো বিভান বাবু?"
বিভান রেগে বলল,
''এমন হাঁদারাম ওয়ালা প্রশ্ন না করে তুলো আমাকে।"
কিরন এবার হাসতে শুরু করে দেয়। বিভান রেগে কিরনের লুঙ্গি ধরে টান দিতেই সেটা একটু খুলে এলে ও পুরো খুলে না।কিরন হাসি থামিয়ে বলল,
''হ্যারে বিভান ইজ্জত কেড়ে নেবে নাকি?তুলছি তো।"
কিরন লুঙ্গিতে শক্ত করে গিট দিয়ে বিভানকে উঠিয়ে দাঁড় করায়।বেচারার মুখ পাথরের ওপর পড়েছিলো।ততোটা জোরে পড়েনি কিন্তু গাল কেঁটে গেছে কয়েক জায়গায়।কিরন বলল,
''ইসস জ্বলছে খুব?"
''তাতো জ্বলছেই ব্যাবস্থা করো ব্যাথা কমানোর।"
''হ্যা হ্যা করছি।"
বিভানকে ধরে রেখেই ডাক্তার সোলেমান মোক্তালিবকে কল দিয়ে কানে রাখে ফোনকে কিরন।অপরপাশ থেকে ডাক্তার মোক্তালিব বলল,
''কি কিরন ভাই ঘুমাতে ও দেবেনা?"
''আরে হালা ঘুম রাখ।রাফিজ আঙ্কেলের গেস্ট হাউজে আহো।কাজ আছে।"
''অহন?বড় শীত করতাছে।রাস্তাও পিচ্ছিল।"
''আরে বেডা তুমিতো বড় খারাপ।ডাক্তার নাকি পশু।তোমার পেশেন্ট মরতাছে তুমি দেখবা না তো কে দেখবো?"
''কি হাফিজ্জার পোয়াতি বৌ মইরা গেছে?"
গলায় উচ্ছাসের সুর মোক্তালিবের।কিরন রেগে বলল,
''আরে তুমি তো মানুষ ভালা না।এত প্রশ্ন করো কেন?আহো জলদি। নইলে চেয়ারম্যানরে কয়া দিমু।"
''আরে না আইতাছি।"
কিরন ফোন রেখে বলল,
''শালা কুত্তার জাত।"
বিভান অবাক হয়ে বলল,
''এটা কি?"
''বিভান বাপ এডা তোমার না জানলে ও চলবে।চলো এখন বাড়িতে।তোমার গোসল লাগবে ডাক্তার আসার আগে।"
ওরা গেস্ট হাউজে চলে গেলো।"
সেদিন ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে যায়।রাতে জ্বর আসে বিভানের। সেই জ্বর রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো।
_________________________________________
পরদিন সকাল গোয়ালা থংচী বুড়া রাফিজের বাড়িতে দুধ নিয়ে আসে।বাড়ির উঠানে বেলা, সাঁঝ বিন্তী আর ঋতু গল্প করছে।তখনই থংচী গোয়ালা আসে।লোকটা চাকমা। বেশ বয়স্ক সে।আশি বছরের মতোই হবে।উঠানে রাফিজ সাহেব কে দেখে বললেন,
''দুধ আনছি।"
''আমারে কি এমনেই খাওয়ায় দিবা।যাও বাড়িত দিয়া আহো।"
''যাইতাছি।"
লোকটা ভিতরে চলে গেলো।নিশাদ আর আদনান রবিনের সাথে বাজারে গেছে ঘুরে ঘুরে দেখবে বলে।বাড়িতে দুধ দিয়ে বেরিয়ে আসে থংচী গোয়ালা।তাকে চলে যেতে দেখলে বিন্তী ডাক দিলো,
''গোয়ালা দাদু এখানে আসেন।"
''কি মনা কও।"
''কোন নতুন খবর আছে?তুমি তো সব খবরই রাখো।"
লোকটা একগাল হেসে বলল,
''গরম খবর।"
''কি?"
''কিরনের বন্ধু আইছে না বিদাশ তাইক্কা?"
''হু আইছে তো?"
''হে বেডায় কাইল রাইত প্যাকের মধ্যে পইড়া গেছে উৎ হইয়া।"
কথা শুনে বিন্তী আর ঋতু সেই শব্দে হাসতে লাগলো।বেলার কেমন যেন লাগলো।ও বলল,
''খারাপ কিছু হয়নি তো?"
''মুখ তো কাইট্টা গেছে অবশ্যই।দাঁত ও ফড়বার ফারে।যে পাথর ওয়ালা রাস্তা।"
''ইসস।"
বেলার মুখে কষ্টের ছাপ।রাতে কিরনকে বলেছিলো বিভানকে নিয়ে সকালে এসে নাস্তা আর দুপুরের খাওয়ার খেতে।কিন্তু ওরা না আসায় চিন্তিত সবাই।রবিন কিরন কে ফোন দিয়ে জানতে পেলো বিভান অসুস্থ।জ্বর নেই তবে দূর্বল।রবিন নাস্তা নিয়ে গেলো গেস্ট হাউজের উদ্দেশ্যে।সাথে ছিলো বাড়ির অর্ধেক লোক শুধু মাত্র বেলা সাঁঝ বিন্তী আর ঋতু ছাড়া।এদিকে নিশাদ বিভানকে দেখে কিছুটা চিনতে পারলেও পুরো চিনতে পারছেনা।মুখের অবস্থা ভালো না।বিশ্রী ভাবে কাঁটা দাগ বসে গেছে।আদনান নিশাদের কানে বলল,
''ভাই ট্রেনের লোকটা না?"
''মনে হয় আবার হচ্ছে ও না।"
বিভানকে দেখে ফিরে আসে সবাই।বিকেলে বিন্তীর কাজিনরা ও চলে আসে।রাতে বার্বি কিউ তাই অনেক কাজ আছে।কেউ কয়লা এনেছে তো কেউ বার্বি কাউ সস।মুরগী আর চুলা বিন্তীদের বাসা থেকে দিচ্ছে।চারটা মুরগী দিয়ে বার্বি কিউ করা হবে।রবিন বসে আগুনে বাতাস দিচ্ছে।বিন্তী ঋতু সাঁঝ আর অন্যান্যরা গান গাইছে জোরে।এখানে গান গাইলে সমস্যা নেই কারন বাড়ি থেকে দূরে আছে ওরা।এদিকে রুমকিকে আসতে দেখা গেলো।রবিনের মনে গান বাজতে লাগে।কাউকে এ কাজে লাগিয়ে দেয়া যায় কিনা খুঁজতে লাগলো।রুমকি এসে বলল,
''কালো হয়ে যাবেন আগুনের সামনে বসে আছেন এভাবে।"
নিজেকে সহজ করার চেষ্টা করলো রবিন।হেসে বলল,
''করতে তো হবেই।তবে কাউকে হ্যান্ডওভার করে দেয়া যায় কিনা ভাবছি।"
রুমকি বলল,
''করুননা আপনিই। ভালই তো লাগছে।"
''সত্যিই?কিন্তু তোমাকে সময় দিতে চাইছিলাম।"
''সময় দেয়ার লোকের অভাব নেই।বরং আমি ওখানে গিয়ে সবার সাথে গল্প করি।"
রবিনের মাথায় হাত। ভাবছিলো হবু বৌয়ের সাথে গল্প করবে কিন্তু কাজ তো আটকে দিলো ওকে।কান্না পায় রবিনের।এদিকে খানিক দূর থেকে সাঁঝ দের গান শোনা যাচ্ছে।চিৎকার করে গান করছে ওরা। রবিন মনের কষ্টে বলতে লাগলো,
''গা ভালো করে গা।আমার বারোটা বাজিয়ে গান গাওয়া হচ্ছে।ওরে কিরিন্না কই রে তুই?"
আদনান এসে বলল,
''কি ভাই কোন সমস্যা?"
''না ভাই কপালের সমস্যা। যান মজা করেন।"
আদনান হেসে প্রস্থান করলো।হঠাৎ কিরন আর বিভানকে আসতে দেখা গেলো।বিভানের একটু ভাল লাগছিলো তাই আসা।কিরনকে দেখে রবিন সেই খুশি।কিরন কাছে আসতেই রবিন বলল,
''তুই একাজ টা কর।তোর ভাবি আসছে ওকে সময় দিতে হবে।"
''আরে বেটা বিভান আছে আমার সাথে।"
''প্লিজ বন্ধু না।বিভান কে আমি নিয়ে যাচ্ছি তুমি করো।"
''ওকে।"
বিভানকে রবিন বলল,
''আসেন ভাই আমার হবু বৌয়ের সাথে দেখা করাই।"
বিভান হেসে বলল,
''চলুন।"
রুমকির সাথে দেখা করে সরে আসে বিভান।কেমন একা পড়ে গেলো ও।তখনই নিশাদ ওর পাশে এসে বলল,
''একা কি করছেন?"
''কিরন ওখানে কাজ করছে,রবিন ওর বৌ কে নিয়ে ব্যাস্ত।"
''ওহ।আপনি আমার সাথে আসুন।ব্যাথা কমেছে?"
''একটু।"
বিভান নিশাদের সাথে হাঁটতে থাকে।হঠাৎ নিশাদ বলল,
''একটু দাঁড়ান আমি একটু ওদিকটা থেকে আসছি।ইমার্জেন্সি!! "
'"শিওর।"
বিভান একা হয়ে যায় আবার ও।ভিনদেশী তাই সবার সাথে তেমন মিশতে ও পারছেনা।আর কাল যেভাবে পড়লো লজ্জায় সে রাস্তা দিয়ে আসতে ও ইচ্ছে হচ্ছিলো না কিন্তু কিরন জোর করে নিয়ে এলো।আসার সমশয় মনে হচ্ছিলো ওকে গাছ পাতা সব মানুষ বলছে,
''বেকুব কোথাকার কাল কিভাবে পড়ে গিয়েছিলি?"
হাঁটছিলো বিভান।হঠাৎ কারো পায়ে পাড়া দিয়ে বসলো।চিৎকার করে উঠলো বেলা।
''আহ।আরে দেখেননা?"
বিভান ভয় পেয়ে যায়।তবে অনুভব করলো পরিচিত একটা কন্ঠস্বর।কিন্তু মনে করতে পারলোনা কই শুনেছিলো।বিভান ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে বেলার মুখে মারতেই দুজনে স্তব্ধ।বেলা বলল,
''আপনি?এখানে ও?"
''জি?"
বেলা ইংরেজিতে রেগে বলল,
''কিছুনা।দেখে হাঁটতে পারেননা?"
''সরি এতো আঁধার খেয়াল করিনি।আর আপনার তো ব্যাথা লাগবারই কথা না।"
বেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
''কেন?"
''আপনি তো পজেসড তাইনা?আমি যতোটুকু জানি ভূতদের ব্যাথা লাগেনা।"
''কে বলল পজেসড আমি?ভূত আপনি। মামদো ভুত আপনি বুঝলেন?অদ্ভুত লোক।"
বেলা সরে যায়।বিভান পিছনে ফিরে বেলার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা উজ্জ্বল শ্যামবর্নের।কিন্তু কি এক মোহনীয়তা ওর চেহারায় বুঝানো যাবেনা।

!!!!

হিমশীতল আর ঘন কালো আঁধারের মাঝে কাঠ গুলো কে পুড়িয়ে শূন্যতায় বেয়ে উপরে উঠে যাওয়া আগুন পুরো মুহূর্তের আনন্দকে আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।বার্বিকিউ করা মুরগী গুলো প্লেটে সাজানো শেষ।এখন আহারের কার্যক্রম শুরু হবে।আদনানের ভীষন পছন্দ। ও তো অপেক্ষা করতে পারছেনা আর। বার্বিকিউয়ের ঘ্রান ওকে আরো ক্ষুধার্ত করে তুলছে।নিশাদের ও খুব পছন্দ।ও নিজে ও কলেজ শেষে বন্ধুদের নিয়ে খেতে যায়।তবে নিজেদের কখনো করা হয়ে উঠেনি।ওদের অবাক করে কিরন বলল,
''এত সুন্দর একটা পরিবেশ।সেটাকে আরো সুন্দর করা উচিৎ তাইনা?আর এখানে যেহেতু নব যুগল আছে তাই পরিবেশটাকে আরো সুন্দর বানানো উচিৎ কি বলো সবাই?"
রবিন রেগে বলল,
''এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে কি বলতে চাস সেটা বল।"
''আরে বেটা একটা গান ছাড়তাম।স্পিকার আনছিলাম।"
গানের কথায় সাঁঝ নড়েচড়ে বসলো।গান ছাড়লে ও নিজেও গুনগুন করে গেতে শুরু করে।ও নিজেকে থামাতে পারেনা এই কাজটা থেকে।বসা থেকে উঠে স্পীকারটাকে সেট করে নেয় কিরন।তারপর বলল,
''কার মোবাইলে ভালো গান আছে?"
কেউই হাত তুলল না।কিরন বলল,
''নিরামিশ সব গুলা।বিভান তোমার সেলটা দাও।"
বিভান এতক্ষন ওদের কথা বুঝছিলোনা।বিভানকে বুঝানোর জন্য কিরন বলল,
''বিভান ইওর সেল প্লিজ।"
এবার বুঝে বিভান নিজের ফোনটাকে কিরনের হাতে তুলে দিলো।কিরন বলল,
''আরে মিয়া এতো পাতলা ফোন!!!"
বিভান অবাক হয়ে তাকায় আছে কিরনের দিকে।কিরন বলল,
''সুন্দর তোমার সেলটা।দাঁড়াও গান ছাড়ি।"
কিরন গান ছেড়ে পাল্টাতে থাকে।প্রায় দশহাজারের মতো গান।কিছু উর্দু হিন্দী কিছু ইংরেজি গান ও আছে।শেষ পর্যন্ত একটা গান পেলো কিরন সেটাকে ছেড়ে এসে বসলো।ওস্তাদ সুলতান খানের পিয়া বাসান্তী গানটা চলছে,
Piya basnti re kaahe sataae aja Jaane kya jaadu kiya Pyaar ki dhun chhede jiya O... kaahe sataae aja Baadal ne angadaai li jo kabhi Laharaaya dharati ka anchal Ye patta patta, ye buta buta Chhede hai kaisi ye halachal Manawa ye dole, jaane kya bole Maanega na mera jiya Tere hain ham tere piya O... kaahe sataae aja............ 
নিশাদ মাংসের টুকরায় কামড় বসানোর মাঝে খেয়াল করলো বিভান বেলাকে দেখছে।ওর চোখ যতোবার বিভানের দিকে গিয়েছিলো ততোবার দেখেছে।আগুনের সোনালী আভায় বেশ লাগছে মেয়েটাকে।মাংস খাওয়ার মাঝে সাঁঝের সাথে কথা বলছে বেলা।বেলার সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিকটা ওর চুল।ঘন কালো লম্বা চুলগুলো।একদম সোজা নয়।হালকা কোকড়ানো চুল গুলো।।বেলার চোখ গুলো একদম টানাটানা। বিভান আগে যেদিন দেখেছিলো সেদিন ও বেলা চোখে কাজল দিয়েছিলো।আর আজো চোখের নিচে মোটা করে কাজল দেয়া।এছাড়া আর কোন প্রসাধনী নেই।বিভান বেলাকে দেখতে দেখতে মুরগীতে কামড় বসায়।কিরন বলল,
''বিভান তোমার খেতে খারাপ লাগছে না তো?"
কিরনের ডাকে হুঁশ হয় বিভানের। ও মাথা নেড়ে বলল,
''একদম না।বেশ ভালো লাগছে।পরিবেশটা ও খুব ভালো।"
''হুম।সিলেট টা হলো বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর পর্যটন এলাকা।"
''সেটা বুঝলাম এ কয়দিনে।খুব সুন্দর।"
''চা খাও তুমি বিভান?"
হাড় ফেলতে ফেলতে বিভান বলল,
''তেমন একটা না তবে কফিটা বেশি খাওয়া হয়।"
''আমাদের এখানকার চাপাতা ভালো।নিতে পারো।"
বিভান একটু হেসে বলল,
''এনে দিও টেস্ট করে নিবো।"
''ওকে।"
বার্বিকিউ শেষে সবাই উঠে গেলো।সব কিছু গুছিয়ে নেয়া হচ্ছে।বিভান উঠে একপাশে দাঁড়ায়।ওর থেকে একটু দুরত্বে বেলা দাঁড়িয়ে। কাল রবিনের হলুদ।তাই জলদি ঘরে পৌছাতে হবে সবাইকে।সকালে খুব কাজ আছে ওদের।সবাই প্রস্থান করলো সে জায়গা থেকে।বিভানের জন্য একটা গাড়ির ব্যাবস্থা হয়েছে।বেলা রুমে এসে ফোন চার্জে দিলো।হঠাৎ দেখলো মায়ের কল।চটজলদি মাকে কল লাগায় বেলা।
কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করেন জুলেখা বানু।ফোন ধরেই বললেন,
''কই ছিলিরে?"
''মা বাহিরে ছিলাম।ফোন অফ হয়ে গেছিলো।তোমরা কেমন আছো?"
''ভালা আছি।নিশাদ কই।ঐডা কল ধরেনা কেন?"
''আমরা সবাই বাহিরে ছিলাম।এক্ষুনি ঘরে এলাম।"
''ওহ।আইবি কবে?"
''বিয়ে বিশ তারিখে।বৌ ভাতের অপেক্ষা করবো না চলে আসবো।"
''আইচ্ছা।তোরা ভালো আছোস?"
''হুম।মামী কেমন আছে?"
''ভালা নাইরে দূর্বল হইয়া ফড়ছে।"
''ওহ।আব্বা কই?"
''নামাজ পইড়া হুচ্ছে।কথা কইবি নি?"
''আম্মা কাল ফোন দিবো।ঘুমাক।সকালে কাজ আছে।"
''আইচ্ছা হুইতা পড়।"
বেলা ফোন রেখে নিশাদের রুমে গেলো।নিশাদ বসে পানি খাচ্ছে।আর আদনান কাঁথা চেঁপে শুয়ে আছে।বেলা নিশাদের পাশে এসে বসলো,
''আম্মা কল দিয়েছিলো ধরিসনি কেন?"
''আপা ফোন কখন বাজছে শুনি নাই।এখন কল দিচ্ছিলাম দেখি ওয়েটিং।"
''চিন্তা করিসনা আমি কথা বলেছি।"
''কি বলল?"
''তেমন কিছুনা।খবর নেয়ার জন্যই।"
''ওহ।"
বেলা ভাইয়ের সাথে অনেকটাসময় গল্প করে রুমে আসার সময় ঋতুদের রুমে এলো।সাঁঝ ঘুমিয়ে গেছে।বোনের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় বেলা।পুরো বাবুর মতো লাগছে বোনটাকে।সাঁঝের কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায় বেলা।তারপর রুমে চলে আসে।এসেই শুনতে পেলো কার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে বিন্তী।বেলা বুঝতে পেলোনা।ও বুঝেনা এত আস্তে কথা বললে অপরপাশে থাকা মানুষটা কি করে বুঝে।
________________________________________
বেলা শুয়ে পড়লো।ঘুম আসছে না ওর।কাথাটাকে ভালো মতো জড়িয়ে নিলো বুকে।ওদিকে বিন্তী কথা শেষ করে বেলার পাশে এসে শুয়ে বলল,
''কাল সকালে নাচ প্র্যাকটিস করতে হবে।"
''নাচের কথা রাখ। কার সাথে কথা বলছিলি?"
বেলার কথায় মুখটা লাজ রাঙ্গা হয়ে এলো বিন্তীর।ফোন ঘুরিয়ে বেলার দিকে ধরলো।নাম দেখে অবাক বেলা। কিরন ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলো বিন্তী।বেলা হেসে বলল,
''কতদিন ধরে চলছে?"
''পাঁচ বছর হয়ে গেলো।"
''পাঁচ বছর বাবাহ!!!রবিন ভাই জানেনা?"
''না রে।ভয় লাগে আমার।বুঝতে পারছিনা ঘরে বিয়ের কথা কিভাবে বলবো?"
বেলা সিরিয়াস ভাবে বলল,
''বাসায় কি তোর বিয়ের কথা চলছে?"
''প্রস্তাব আসে রে।কিন্তু কতো না করা যায় বলতো?এনিয়ে পাঁচবার বিয়ে ভাঙ্গলাম।
বেলা বলল,
''কিরন ভাই কিছু করছে না?
''করছে ও নিজের মতো।বাবাকে তো জানিস কতো রাগি।"
বেলা হেসে বলল,
''আঙ্কেল যতো রাগই হোক না কেন?তোকে অনেক ভালবাসে।রাজি করা হয়ে যাবে।"
''হুম।"
বিন্তী হেসে বলল,
''তোর জনের কথা শুনি।"
''উফ তেমন কেউ নেই।ওসবে কখনো মন আসেনি।"
''লুকাবি না।বল আমাকে।"
''আরে বাবা থাকলে তো বলবো।তেমন কেউই নেই।"
''এখানে অনেক সুন্দর ছেলে আছে।একটা খুঁজে দেই?"
বেলা চোখ ছোট করে বিন্তীর দিকে তাকায়।বিন্তী আবার বলল,
''আজকে গোয়ালা থংচি বুড়ো আসছিলো মনে আছে তোর?ওনাকে কেমন লাগলো তোর?"
বেলা বলল,
''কেমন লাগলো মানে কি?"
''মানে হলো বর হিসেবে কেমন লাগবে?"
''কার বর?"
''আরে বাবা তোর।"
বেলা বিন্তীকে মারতে শুরু করলো।বিন্তী হাসছে।বেলা ওকে মেরে শুয়ে পড়ে।তারপর বলল,
''তোর সাথে বেস্ট লাগবে।"
''আমার তো কিরন আছে।আচ্ছা বিভান ভাইয়া ও খারাপ না কিন্তু।"
''ওনার ভালো খারাপ দিয়ে আমি কি করবো?এমনিতেই আমাকে দেখে বলে আমি পজেসড।"
''তোদের কখন কথা হলো আবার?"
''ট্রেনে।"
''হোয়াট?পুরোটা বলতো। "
বেলা ওর আর বিভানের পুরো কাহিনী বলতেই বিন্তী হাসতে থাকে।বেলা নিজে ও হাসছে।পরদিন সকালে নাস্তা শেষ করে নিচের হলঘরে চলে গেলো মেয়েরা।নাচের প্র্যাক্টিস শুরু করলো।বেলা গ্রুপে নাচবে আবার একা ও একটা গানে নাচবে।
এদিকে এক ঘটনা ঘটে গেলো।দুপুরে নাচের কস্টিউম চলে আসার কথা ছিলো।বিন্তী দর্জি কে ফোন করে।তারপর লোকটা যা বলল ওর মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়।দর্জি ওয়ালা গ্রামে গেছে।বাকি লোকেরা ছুটিতে।বিন্তী লোকটাকে গালি দিলো ঘন্টা খানেক তারপর ফোন রেখে বসে পড়লো।কি করবে এখন ওরা?বেলা আর সাঁঝ ও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো।রবিন শুনে বলল,
''আমি তো জামাই আমি যেতে পারবোনা।একটা কাজ কর কাউকে যেতে বল রেডিমেট লেহেঙ্গা পাওয়া যাবে।"
কথা হলো কে যাবে সবাই ব্যাস্ত কাজে।কিরন বিভান নিশাদ আদনান লাঞ্চ করতে বসেছে।ফারজানা বললেন,
''নাচার পরিকল্পনা বাদ দে।"
বিন্তীর মন ভীষন খারাপ হয়ে গেলো।একমাত্র ভাইয়ের হলুদ কিন্তু নাচতে পারবে না ও।কিরন বিন্তীর কষ্ট বুঝতে পারলো। এমন হলে ওর নিজের ও বিন্তীর নাচ দেখার সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাবে।কিরন লাঞ্চ সেড়ে বিভানকে বলল,
''চলো বাহিরে যাবো।"
বিভান খাওয়া শেষ করে বসেছে মাত্র। তখনই কিরন বাহিরে যাওয়ার কথা বলল।বিভান অবাক হয়ে বলল,
''কই যাবে?"
''শপিং করতে।চলো।"
''আমি কেন যাবো?"
''আমার সাথে আছো সে জন্য আমি যেখানে যাবো তুমি ও যাবা।কথা বাড়ি ও না চলো।"
বিভান কথা না বাড়িয়ে উঠে গেলো।যাওয়ার সময় বিন্তীর থেকে সবার গায়ের মাপ লিখে বেরিয়ে পড়লো কিরন।বিভান আর কিরন হেঁটে হেঁটে সবার জামা কিনে নিলো।আসার সময় একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে কিরন।এখান থেকে দুশো টাকা ভাড়া রাফিজ সাহেবের বাসা।
রবিন কে হলুদ পাঞ্জাবী পরানো হয়েছে।হাতে জরির ফুল বাঁধা।গলায় একটা মালা আছে।রবিনের নিজেকে গরু মনে হচ্ছে মালাটার কারনে।রাফিজ সাহেবের বাসার সামনে স্টেজ সাজানো হয়েছে।ভিতরে হলুদ লাগানো হবে আর বাহিরে নাচ হবে।রান্না বাহির থেকে করিয়ে আনা হয়েছে।
বিভান রাফিজ সাহেবের বাসায় হেঁটে হেঁটে দেখছে সবাই কাজে ব্যাস্ত।হঠাৎ পাশের একটি রুমের ভিতর থেকে বেলা কে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো।সাঁঝকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়েছে বেলা।বিভান খেয়াল করলো একটা লেহেঙ্গা ওর বেশ পছন্দ হয়েছিলো তবে সেটা কার জন্য কেনা হয়েছিলো জানা ছিলো না ওর। তবে বেলাকে খুব মানিয়েছে।কমলা লেহেঙ্গা আর সোনালী পাড় দেয়া স্কার্ট টা।টপসটায় ও সোনালী সুতার কাজ।লেহেঙ্গার স্কার্টের নিচের দিকটা ফুলানো।বিভান একদৃষ্টে বেলাকে দেখছে কেন দেখছে সেটা ও জানেনা।বেলা বিভানকে খেয়াল করেনি।সাঁঝকে পেয়ে সেদিকে চলে গেলো।রবিনের হলুদ দেয়া শেষ হলো।এখন নাচ হবে।বাহিরে বসার জন্য প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা হয়েছে।সবাই গিয়ে বসে পড়লো সেখানে।আগে গ্রুপ নাচ টা হবে।সবাই স্টেজে এসে উপস্থিত।বেলা সবার মাঝে।নাচ শুরু হলো।নিশাদ বিভানকে আজ ও আবার খেয়াল করছে। লোকটা শুধু ওর বোনকে দেখছে।তবে ব্যাপারটা ওর কাছে ভালো লাগছে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন