স্বপ্নচুড়া এলাকার রংধনু নিবাস বাড়িটির মালিক ছিলেন ইদহান রহমান।রক্ত ঘামে গড়েছিলেন এই শান্তির নিবাস। দু পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক হয়েছিলেন।মৃত্যুর আগে সম্পূর্ন সম্পদ ছেলে মেয়েদের দিয়ে যান যেন ওনার মৃত্যুর পরবর্তি সময়ে কোন দ্বন্ধ সংঘাতের সৃষ্টি না হয়।কিন্তু যখন সত্তুর বছর বয়সে মারা গেলেন তখনই প্রচন্ড লোভ উৎরে উঠলো ছোট পুত্র ইহসান রহমানের ভেতর।ইদহান রংধনু নিবাস পাঁচ কাঠা জমি আর পুকুরটা লেখে দিয়েছিলেন বড় সন্তান ইকরামের নামে।কিন্তু ইহসান রহমান মেনে নিতে পারেননা।যেখানে তাকে সম্পত্তি কোন অংশে কম দেয়া হয়নি।বড় ভাইয়ের আগে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন ইহসান রহমান।বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে ফারিদা খানমকে বিয়ে করে নেন।একমাত্র কন্য হবার সুবাদে ফারিদা প্রচুর সম্পত্তি পান পিতার কাছ থেকে।কিন্তু ইহসান রহমান এতো সম্পত্তির পর ও কোনভাবেই ভাইয়ের সম্পত্তি থেকে নজর সরাতে পারেননা।
ইকরাম রহমান ছিলেন বেশ সরল মনের কম শিক্ষিত এবং ভাই বোনের প্রতি দূর্বল।ওনার স্ত্রী জুলেখা বানু দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন।ইহসান রহমান সেদিন ভাইয়ের গৃহে চলে আসেন উকিল সমেত।চেয়ে বসেন পুরো পাঁচকাঠা জমি।ইকরাম রহমানের মাথায় বাজ পড়ে।কিন্তু ওনাকে অনেকটাই অবাক করে দিয়ে ইহসান রহমান বলেছিলেন,
''এত সম্পত্তি দিয়ে কি করবে?আমাকে দিয়ে দাও।নাহলে এই বাড়ি খালি করবে।আমি বিক্রী করবো ।"
ইকরাম ভেঙ্গে পড়েন।ছোট ভাইকে অনুনয় করে বলেন,
''এ বাড়ি বাবার হাতের।এমনটা করিস না।"
''এতো কথা বলিও না।সব তোমার চাল বুঝি তো।বাবার ঘরটাকে তুমি হাতানোর ধান্দা করছো মনে করছো কিছু জানিনা আমি তাইনা?"
ইকরাম প্রচন্ড অবাক হন।এ লোক তার ভাই হতে পারেনা।কিভাবে কথা বলছে সে?ভাইকে অবিশ্বাস করছে।ইহসান নিজের সিদ্ধান্তে অটল।অনেক জোরাজুরি করে বাড়িটা আর এককাঠা জমি বাঁচালো ইকরাম রহমান।
এরপর অনেক সময় পেরিয়ে যায়।বৃদ্ধি পেতে থাকে ইদহান রহমানের বংশধর ও।
ধূসর বর্নের শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে নিশাদ।ডাইনিং টেবিলে বসে রুটির অকোনা ছিড়ে ঝোলে লাগিয়ে মুখে পুরে উঠে দাঁড়ায়।তারপর হাত ধুয়ে মেইনডোরের দিকে এগিয়ে আসে।সোফায় বসে ইকরাম রহমান পেপার পড়ছেন।ছেলেকে বেরুতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
''কই যাস?"
''অফিসে।কিছু লাগবে?"
''না লাগবেনা।জলদি ফিরে আসবি।"
''জি আব্বা।"
বেরিয়ে আসে নিশাদ।ট্যাক্সির জন্য দাঁড়ায়।হঠাৎ পিছন থেকে কেউ দৌড়ে এসে নিশাদের পিছনে দাঁড়ায়।নিশাদ পিছে তাকিয়ে দেখে হুমায়রা।কপালের ঘাম মুছে উড়না ঠিক করে নিয়ে হুমায়রা বলল,
''ভাই সরি তোকে বলা হয়নি বেতনের কথা।আজকে লাস্ট ডেট।দিতে না পারলে রেজিষ্ট্রেশন করা যাবেনা।"
নিশাদ রেগে বলল,
'',পড়াশুনস করিস তুই।তোর কি সংসার দেখতে হয় না কাজ করতে হয়?আগে কেন বলতে পারিসনা?"
হুমায়রা আমতাআমতা করে বলল,
''বললামই তো মনে নেই।আর হবেনা।"
নিজের রাগকে সামলে নেয় নিশাদ।তারপর পকেট থেকে কড়কড়ে দুহাজার টাকা বের করে দিয়ে বলল,
''এখন বেতন টা দে।রেজিষ্ট্রেশনের টাকাটা পরে দিয়ে দিবো।"
''ওকে।"
''কয়দিন আছে রেজিষ্ট্রেশনের?"
''দুদিন আছে আর।আজই বেতনের লাস্ট ডেট ছিলো।"
''ওহ।পেয়ে যাবি।টেনসন নিবিনা।"
বলে বোনের মাথায় হাতবুলিয়ে দেয় নিশাদ হুমায়রা ভাইয়ের দিকে একটু হাসে।নিশাদ এবার একটা সিএনজি ডেকে নেয়।গাড়ি ওদের কাছে আসতেই নিশাদ বলল,
''খিলগাও যাবা?"
''হ যামু।"
''কতো নিবা?"
''১২০ টাহা দিয়েন।"
''আচ্ছা।হুমায়রা উঠ যাওয়ার সময় তোর কলেজ সামনে পড়বে।নেমে যাস।"
''জি ভাইয়া।"
হুমায়রা উঠে বসে সিএনজিতে।ওর পাশে এসে বসলো নিশাদ।অসিএনজি চলতে শুরু করে।নিশাদ ইকরাম রহমানের বড় ছেলে আর একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি।একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে জব করে।২০ হাজার টাকা বেতন পায় মাসে।তা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খেতে হয় ওকে।হুমায়রার কলেজ চলে আসে।বোনকে নামিয়ে দিয়ে অফিসের পথে রওনা হয় নিশাদ।উজ্জ্বল শ্যামলা আর গালে গালে খোঁচা দাঁড়ি আছে নিশাদের। বয়স তেত্রিশ হয়ে এলো কিন্তু চেহারায় তা ফুঁটে উঠেনি।চোখজোড়া ছোট আর বেশ জ্বলজ্বলে।উচ্চতা বডি ফিটনেস সব কিছুতে একদম পার্ফেক্ট।
খিলগাঁও এ ওর অফিসের সামনে এসে থামলো সিএনজি।ড্রাইভারের ভাড়া চুকিয়ে ভিতরে এসে লিফটের বোতাম চাঁপলো।ওর বস বোরহান মাহবুবের এ্যাসিস্ট্যানটের এ্যাসিস্ট্যান্ট ও।
চাকরিটা পেয়েছিলো এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে।
আজকাল টাকা ছাড়া কোন কিছুই পাওয়া যায়না।সেখানে আপনার রেজাল্ট আপনার পারদর্শিতা কোন কাজে আসেনা।টাকা থাকলেই জব হয়ে যাবে।
তিনতলায় আসতেই নেমে এলো নিশাদ।তারপর নিজের ডেস্কে এসেই জানতে পারলো বস ডেকেছে।ওর অবশ্য এমনিতেই বসকে লাগতো।এখন যেহেতু ডেকেছে তাহলে কথা বলা যাবে।
বসের কেবিনের সামনে এসে নক করলো নিশাদ।ভিতর থেকে মোটা গলায় কেউ বলল,
''আসুন।"
নিশাদ ভিতরে এসে দাঁড়ায়।বোরহসন মাহবুব দাঁড়িয়ে টাই ঠিক করতে করতে বলেন,
আপনি জানেন প্রত্যেক মাসে আমাদের দরিদ্র তহবিলে কিছু টাকা জমা করতে হয়।"
''জি স্যার।"
''তো আপনাকে ১০০০০ টাকা দিতে হবে।"
''আগের স্যার কখনোই আমার থেকে নিতেননা।আর আমার নিজের ও কিছু প্রবলেম আছে আর্থিক।বেতন ও পাইনি।"
''তো সেটা আপনার প্রবলেম মিঃ নিশাদ রহমান।আমাকে বলছেন কেন?আর আগের বস কি করতো না করতো সেটা তার ব্যাপার আমার না।"
''স্যার এমাউন্টটা একটু কমানো যায়না?"
''কেন?"
''আমার ছোট বোনের ইন্টার ফাইনালের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।দুদিন মাত্র সময়।বেতনটাও দরকার।"
''আচ্ছা ছয় হাজার টাকা দাও তোমার বেতন থেকে।আর কোন তর্ক চাইনা।"
নিশাদ আর কিছু বলতে পারেনা।বোরহান মাহবুব আবার ও বলেন,
''কি হলো যাও।তোমার এ্যাকাউন্টে টাকা পৌছে যাবে কাল।"
''জি স্যার।"
বেরিয়ে আসে নিশাদ।কপালের ঘামের পাশাপাশি চোখের পানিটা ও মুছে নেয়।তবে ও নিজেকে কখনোই ভেঙ্গে পড়তে দিবেনা।নিজের পরিবারের জন্য হলে ও শক্ত থাকবে ও।ডেস্কে এসে বসতেই বসের এ্যাসিস্ট্যান্ট ফারুজ খান বললেন,
''আজ কিন্তু তুমি লাঞ্চ করাবে।"
চমকে উঠে নিশাদ।তারপর অবাক করা কন্ঠে বলল,
''স্যার পরশুদিন ও লাঞ্চ করিয়েছিলাম।"
''তো কি হয়েছে আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট তুমি।আমার কথামতোই চলতে হবে।তোমাকে খাওয়াতে হবে।"
নিশাদ পকেট থেকে একশটাকার নোট বের করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আজ হয়ত পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে হবে।
একশটাকা দিয়ে মাঝারি সাইজের বিরিয়ানির প্যাকেট পাওয়া যেতে পারে।
এদিকে ক্লাশ শেষ করে বেরিয়ে এলো সাঁঝ।দুটো টিউশানি করে ঘরে ফিরবে ও।বাসের জন্য দাঁড়িয়ে কাকে যেন কল করলো ও।দুবার রিং হতেই কল রিসিভ করলেন জুলেখা বানু।
কানে ফোন রেখে সাঁঝ বলল,
''আম্মা আমি ক্লাশ থেকে বের হলাম।এখন টিউশানি করাতে যাবো।কিছু লাগবে তোমার?"
''প্রেশারের ঔষধ শেষ হয়ে গেছে।নিশাদ ও বাহির হয়ে গেল।"
''সমস্যা নাই আম্মা। আজকে বেতন দিবে।তো নিয়ে আসবো।"
''আচ্ছা।"
সাঁঝ কল কেঁটে বাসে উঠে যায়।আজ বসার জায়গা নেই একদমই।অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকতে হলো ওকে।সাঁঝ বেশ ফর্সা আর গোলগাল চেহারার অধিকারি।ছাত্রী হিসেবে ও খুব ভালো।দুটো টিউশানি করছে তবে বেতন থেকে নিশাদকে হেল্প করতে পারেনা ও কারন ওর যাতায়তেই সব খরচ হয়ে যায়।মাঝে মাঝে ভাইটার জন্য কষ্ট হয় ওর।ও যদি ভালো বেতন পেতো তাহলো নিশাদকে এতো কষ্ট করে ঘর চালাতে হতো না।রিদ্ধিকে পড়াতে এসেছে ফাহমিনাকে পড়িয়ে।রিদ্ধি সাঁঝের কানে কানে বলল,
''আপু আমার সাদেক মামা এসেছে সৌদি আরব থেকে।"
''ওহ।ভালো। "
রিদ্ধি পড়তে শুরু করে।সাঁঝ ওর খাতা চেক করছে।তখনই পাশের রুম থেকে একজন লোক বেরিয়ে আসে।তাকে চেনে না সাঁঝ।লোকটা এসে বলল,
''রিদ্ধি ওনি তোর টিচার?"
''জি মামা ওনার নাম সাঁঝ।"
সাঁঝ লোকটাকে ধীরে সালাম জানায়।লোকটা হেসে উত্তর দেয়।নিশাদ লাঞ্চ টাইমে বেরিয়ে আসে এ্যাসিস্ট্যান্ট কে নিয়ে।একটা বিরিয়ানী দোকানের সামনে দাঁড়ায় ওরা।ফুল বিরিয়ানী হলো একশত বিশ আর মাঝারি সাইজটা হলো ১০০।নিশাদ মাঝারি প্যাকেটটা অর্ডার করতেই পাশ থেকে ফারুজ বললেন,
''মাঝারি প্যকেট দিয়ে কি হয় বলোতো?"
নিশাদ বলল,
''স্যার এটাই একা খেতে পারবেননা আপনি।"
''তুমি ও ভাগ বসাতে চাইছো আমার বিরিয়ানীতে?"
''না স্যার সেটা না।"
''তো?"
নিশাদের রাগ লাগছে।লোকটা কেন এমন করছে?ওনাকে প্রায়ই খাওয়ায় ও।তারপর ও এতো লোভ।অবশ্য চাকরিটা দেয়ার আগে ওকে বলা হয়েছিলো রেগে গেলে চাকরিটা থাকবেনা।
!!!!
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার, শুধু দুজনের |
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণও এ দুটি প্রাণের কুহু কুজনের |
এই রাত তোমার আমার।।
তুমি আছো আমি আছি তাই,
অনুভবে তোমারে যে পাই, শুধু দুজনের |
এই রাত তোমার আমার ||
..................
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত বেলা। সারাদিনের কাজ সেড়ে রুমে এলো ও।লোকটা এখনো আসেনি।সে কই আছে কে জানে?অবশ্য কাজে থাকলে কল ধরেনা সে।তবে বেলা জানে দিন শেষে তো লোকটা তার কাছে ফিরে আসবে। বড্ড ভালবাসে যে তাকে।হঠাৎ গান শুনে চমকে উঠে বেলা।বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে না।লোকটা অপেক্ষা করায় সে ও করাবে।মুচকি হেসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বেলা।হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দ পেলো ও।পর্দা দিয়ে রুমে উঁকি মেরে দেখলো আলো বন্ধ রুমের।শাড়ীর আঁচল টাকে অপর কাঁধ থেকে ফেলে শুধু এক কাঁধে জড়িয়ে নিয়েছে।বৃষ্টি হচ্ছিলো। বেশ ভালো লাগছিলো।তবে দিল্লিতে বৃষ্টি হলে খুব শীত লাগে বেলার।ব্যাপারটা ওর সাথেই ঘটে আর কারোর সাথেইনা।বহিরাগত বলে কথা!!!নিচ থেকে বিভানের কথা শুনতে পেলো ও।
ঘরে এসে স্ত্রীকে রুমে না পেয়ে নিচে চলে যায় বিভান শেখ।ছেলেকে এমন অস্থির হতে দেখে বন্দনা আখতার ছেলের কাছে এগিয়ে আসেন।ঘরের দরজা জানালা আটকে রুমে আসছিলেন ওনি।তারপর ছেলেকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন।বিভান মাকে দেখে কিছু টা চমকে উঠে বলল,
''মা তুমি ঘুমাও নি?"
''কেমনে ঘুমাবো বল?তুই আসবি।খেয়েছিস কিনা সেটাও বলতে পারবোনা।"
'মা বেলা থাকতে এতো টেনশন করো কেন?"
''বেলা কি করবে বল?সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকে।ছাদে গিয়ে ফোনে কথা বলে জানিস?কেমনে থাকিস এই মেয়ের সাথে?"
একটু হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে বিভান।তারপর বলল,
''মা তেমন কিছুনা।যাও ঘুমাও।"
''তোর চোখে লাগবেইনা তোর বৌয়ের দোষ।যাই হোক কি খুঁজছিলি?"
''কিছুনা মা।গিয়ে ঘুমাও তুমি।"
এদিকে নিচে শাশুড়ীর কথা শুনে ভীষন খারাপ লাগে বেলার।এতোটা বছর পার হয়ে গেছে ওকে দেখতে পারেনা বন্দনা আখতার।চোখে অশ্রু আসতে চাইলে ও ঠোঁট কামড়ে সেটাকে দমিয়ে রাখে।খাটে বসে নখ কাঁটতে শুরু করে।এরই মাঝে রুমে বিভানের আগমন।স্ত্রীকে দেখে স্বাভাবিক সুরে বলল,
''কই ছিলে?"
''বারান্দায় ছিলাম।সেটা খেয়াল করেননি আপনি?"
''রুম অন্ধকার ছিলো তাই হয়ত।"
''হুম।"
বিভান খাটে এসে বসে বেলার পাশ ঘেঁষে।তারপর ওর কাঁধে নাক বুলিয়ে বলল,
''গানটা কেমন হচ্ছিলো?"
''বেশ ভালো।খেয়েছেন?"
''হুম।তুমি?"
''খেয়েছিলাম বিকেলে।এখন খিদে নেই।"
রেগে গেলো বিভান। উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
''এটা কেমন কথা বেলা?তুমি জানো তোমার শরীর ভালো নেই।কেন করছো এমন?কোন জাতের নাটক করো প্রত্যেকদিন? "
বেলা ভয় পেয়ে গেলো।নিচে কেউ শুনলে বিপদ হবে।তাই মিনতির স্বরে বলল,
''প্লিজ একটু আস্তে কথা বলুন।সবাই কি ভাববে?"
''সবার ভাবার এতো ভাবনা থাকলে খাওনা কেন?"
আগের রাগী স্বরেই বলল বিভান।বেলা কেঁদে দিলো।তারপর বলল,
''প্লিজ চিৎকার করবেননা।আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।এক্ষুনি খেয়ে নিবো।এমন করবেননা।"
বিভান স্বর কমিয়ে আনে তারপর ও গলায় রাগের আভাস রেখেই বলল,
''কতোদিন মানা করেছি অপেক্ষা করতে না আমার।কিন্তু কোন কথাই তো শুনোনা।যাও খেয়ে নাও।"
বেলা নিচে নেমে আসে।পাকঘরে এসে প্লেটে খাবার বেড়ে নিতেই হাতের মাঝে গরম পাতিল লাগতে প্রচন্ড ভাবে জ্বলে উঠে হাত।চিৎকার করতে গিয়ে ও স্বর আটকে আসে।হাতের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখতে পায় কুনুইয়ের ওপর থেকে পোড়া দাগ।সেটা একদম নতুন।প্লেট রেখে হাতে মলম লাগিয়ে নেয় ও।তারপর খেতে শুরু করে।অপরদিকে সেদিন অফিস টাইম শেষে হাঁটতে শুরু করে নিশাদ।হাতে একটা টাকা ও নেই বললেই চলে।অনেকটা পথ পাড়ি দেয়ার পর পাশের একটা বেঞ্চে বসে পড়ে ও।তারপর একটা সিগারেট বের করে ফুঁক দিতে শুরু করে।সেটার ধোয়া গুলো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ তখন আদনান নিশাদ কে দেখে কিছুটা অবাক হয়।এসময়ে এখানে কেন? গাড়িতে থাকার কথা ছিলো।বন্ধুর ছেলের জন্মদিনের দাওয়াত খেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো কোন টঙ্গে।নিশাদ কে দেখে বন্ধুদের অপেক্ষা করতে বলে ভাইয়ের কাছে ছুটে আসে আদনান।নিশাদ সিগারেটে ফুঁক দেয়ার মাঝে ভাইকে দেখতে পেয়ে একটু হাসে।আদনান এসে ওর পাশে বসে বলল,
''ভাই বাসায় যাসনি?"
''উহুম।তুই কি করিস? তোর না দাওয়াত ছিলো?"
''হ্যা ওখান থেকে ফিরলাম।তা এখানে বসে আছিস যে?"
''এমনি।তুই যা আড্ডা দে।"
''ওয়েট আমি আসছি।"
আদনান বন্ধুদের কাছে চলে গেলো।ওদের বিদায় জানিয়ে একটা সিএনজি ঠিক করে।তারপর নিশাদকে এসে বলল,
''চল বাসায় যাই।রাত কম হলোনা।"
''হুম।"
নিশাদ ভাইয়ের সাথে সিএনজিতে উঠে যায়।সিএনজি চলতে শুরু করে।আদনান কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,
''কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু কেউ ডাকছেনা।"
ভাইয়ের দিকে তাকায় নিশাদ।তারপর গম্ভীর আওয়াজে বলল,
''ভালোমতো খবর নিয়েছিস?"
''হ্যা ভাই।ওরা প্রথমে জানিয়েছিলো অগ্রিম দুলাখ দেয়া লাগবে।"
''দুই লাখ!!জানোয়ারের বাচ্চারা ডাকাতি করছে দেখি।"
রেগে কটমটে গলায় বলে নিশাদ।আদনান বলল,
''ভাই আমি আরো খুঁজবো।তুই চিন্তা করিসনা প্লিজ।"
''হুম।"
দুজনে চুপ হয়ে গেলো।নিশাদ জিজ্ঞেস করলো,
''কুঞ্জনের খবর জানিস কিছু?ঘরে ফেরে কখন কিছুই তো টের পাইনা।"
আদনান বলল,
''আমাকে বলছিলো লাবনীকে নিয়ে চাচ্চুর বাসায় যাবে।আমি বললাম তোকে বলতে।ও বলে তোর সাথে ফেস করতে পারবেনা তাই যেন আমি বলে দেই?"
''ফেস কেন করতে পারবেনা?"
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে নিশাদ।আদনান হেসে বলল,
''ভয় পাওয়ার যতো এক্টিং করুকনা কেন ও কখনো সত্যিকারের ভয় পায়না। বন্ধুদের সামনে বীর পুরুষ সাজে।"
নিশাদ একটু হেসে বলল,
''আর মানুষ পেলোনা ঘুরতে যাওয়ার জন্য?চাচ্চুর বাসা সিরিয়াসলি?"
''ভাই লাবনী জেদ করছিলো বাহিরে যাওয়ার জন্য।সাঁঝ কলেজে ছিলো,হুমায়রা ও তো কলেজে ছিলো।তাই ওদের বলেছি কিছুক্ষনের জন্য গিয়ে ঘুরে আসতে।"
''হুম।"
ঘরে ফিরে দেখলো মা ভাতের প্লেট সাজাচ্ছে টেবিলে।নিশাদ কে দেখে বলল,
''তোর আব্বার প্রেশার লো হয়ে গেছে।তোরে কতো বার কল করছি কই ছিলি?"
নিশাদ ফোন বের করে দেখলো সুইচ অফ।তারপর বলল,
''আম্মা ফোনের ব্যাটারি শেষ।কই আব্বা?"
''রুমে যায়া দেখ।"
নিশাদ আর আদনান দৌড়ে রুমে আসে।সাঁঝ মাথায় পানি ঢালছে হুমায়রা পা টিপছে আর লাবনী কাছে বসে কুরআন শরীফ পড়ছে।নিশাদ কে দেখে সাঁঝ সরে এলো।নিশাদ বাবার মাথার কাছে বসে বলল,
''আব্বা কিছু হবেনা আপনার।সাঁঝ ডাক্তার ডেকেছিলি?"
সাঁঝ বলল,
''জি ভাইয়া।ডাক্তার ঔষধ দিয়ে গেলো।"
আদনান বলল,
''তোরা বের হ রুম থেকে।লাবনী তুই কুরআন শরীফ পড়ে বের হবি।"
লাবনী মাথা ঝাঁকিয়ে সুরা ইয়াসীন পড়তে থাকে।জুলেখা বানু টেবিলে খাবার সাজিয়ে ছেলে মেয়েদের ডাকতে শুরু করেন তবে আগে একটা নাম মুখে আসতেই চুপ হয়ে যান।ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠে ওনার।তখনই কুঞ্জন ভিতরে এলো মেডিসিন নিয়ে।এসেই টেবিলের ওপর ঔষধ রেখে বলল,
''আব্বার কি খবর আম্মা?"
''অজ্ঞান হয়ে আছে।কিছু কয়না।"
''টেনশন কইরোনা তো কিছু হইবোনা।ভাইয়ারা আসছে?"
''হুম।তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয়।সব গুলা একসাথে বইসা খাইস।তোগরে একসাথে দেখলে পরানডা জুড়ায়া যায়।"
কুঞ্জন হেসে বলল,
''আম্মা তোমার পরান জুড়াইতে জুড়াইতে কখন যে ফাঁইটা যায় আমি ভেবে অস্থির।"
পিছন থেকে জুলেখা বানু রেগে বললেন,
''জানোয়ার বাপ হইলে বুঝবি পোলাপাইনের লাইগা কেমন লাগে?"
কুঞ্জন কিছু না বলে রুমে চলে গেলো।কিছুক্ষন পর সবাই খেতে বসে।টেবিলের চেয়ার চারটা।তাই টেবিলে বসলো নিশাদ মা আদনান আর লাবনী।আর সোফায় বসেছে সাঁঝ হুমায়রা আর কুঞ্জন খাটের ওপর দুপা তুলে খাচ্ছে।খাওয়ার মাঝে সাঁঝ লাবনীকে জিজ্ঞেস করলো,
''চাচী কি খাইয়েছে?"
''চা আর বিস্কিট দিছে।চা টা পুরো পানি পানি। কেমন গন্ধ ছিলো।"
ছোট বোনের মুখে কথা শুনে কষ্ট লাগে নিশাদের।রুম থেকে কুঞ্জন রসিকতা করে বলল,
''আর যেন না যাস সেজন্যই এমন করেছে।"
লাবনী ক্ষোভ নিয়ে বলল,
''কসম কাঁটলাম আর যাবোনা।আপু আর ভাইয়া কেমন করছিলো কথাই বলেনি।"
নিশাদ রেগে বলল,
''ওদের সম্বন্ধে ভালো করেই জানিস।তারপর ও কেন গেলি অপমান হতে?"
লাবনীর মুখ চুপসে গেলো ভয়ে।তারপর মলিন কন্ঠে বলল,
''কুরবানীর পরে কোথাও যাইনি তাই গিয়েছিলাম ঘুরতে।সরি ভাইয়া আর যাবোনা।"
জুলেখা বানু উঠে এসে লাবনীর দিকে ধমকের স্বরে বললেন,
''ওরা কুরবানী দিয়েছে জানিস?কিন্তু বড় ভাইয়ের বাসায় এক টুকরা মাংস ও পাঠাইলোনা।হেরা কি জানেনা তোদের আব্বা কুরবানী দিতে ফারেনা।অমানুষ কেমন দেখলি।তুই মাইয়া কথাই হুনোস না।কতোবার কইলাম না যাইতে।কিন্তু তুই তেড়া জানোয়ার যাবিই।"
নিশাদ জিজ্ঞেস করে,
''কেমনে জানলা আম্মা?"
''হুন আব্বা হাছা কথা লুকাইয়া থাকেনা।পাঁচ লাখ দিয়া গরু কিনছে।চিন্তা কর কতো বড় খাসি ওয়ালা গরু।"
নিশাদ বলল,
''আম্মা এসব বইলোনা।সামনের বছর আমরাও দিবো।"