পরাণ প্রিয়া - পর্ব ০৮ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


নিবিড় একটা বেঞ্চে বসে তনুসার নিয়ে আসা ফাইল গুলো দেখছে।
-তনু দাঁড়িয়ে না থেকে বসো।
তনুসা ধপাস করে বসে,তোমার বউ কি বাচ্চা নাকি?
নিবিড় সাইন করতে করতে বললো, কেনো?
-ওই দেখো বাচ্চাদের সাথে কি করছে।মনে হয় জীবনেও বাচ্চা দেখেনি।
কথাটা বলতেই নিবিড় কলম চালানো বন্ধ করে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে, তনু, সবাই সব কিছুতে খুশি হতে পারে না।আবার সবার ভালো লাগাও এক না।
ও এখানে আসার পর আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, মেয়েটা অল্পতেই খুশি।সাধারণের মাঝে অসাধারণ একটা ব্যাপার আছে ওর মাঝে।যা সবার মাঝে থাকে না।এই বাচ্চাগুলোকে কত সহজে আপন করে নিয়েছে।দেখলেই মনে হয়ে যুগযুগ ধরে এদের কত চেনা। স্বার্থহীন ভালোবাসাগুলোই এমন।
তনুসা কথাটা শুনে গম্ভীর হয়ে,তুমি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছো তাই না? তুমি ওর প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছো আমি বুজতে পারছি।

-তনু তুমি ভুল বুজছো।আমি ওনাকে শ্রদ্ধা করি।

মোশারফ হোসেন দূর থেকে তাকিয়ে, এই মেয়েটা পিছন ছাড়লো না ঠিক এই জাগায়ও এসে পৌঁছে গেলো।

সালমা বেগম বললেন,থাকনা।নিবিড় তো আর খারাপ কিছু করছে না।এখন বউ হয়েছে।বউকে কত ভালোবাসে তুমি দেখেছো?

-দেখার কি আছে?বউকে ভালোবাসবে না তো পাশে বাসার কাজের মেয়ে জরিনাকে ভালোবাসবে?
আমি এতো কথা বুজি না।সামনের বছর ঘরটাকে পরিপূর্ণ চাই।নাতি হোক বা নাতনি আমার তাতে সমস্যা নাই।
সালমা বেগম মুচকি হেসে,বিকেল তো গড়িয়ে যাচ্ছে বাড়ি যেতে হবে না? জুহিকে ডাকো। 

আশ্রম থেকে সবাই বিদায় নিয়ে আসার সময় বাচ্চারা প্রিয়তার জন্য কান্নাকাটি করছিলো।প্রিয়তা তাদের কথা দিয়েছে সাপ্তাহিক ছুটির দিন তাদের সাথে কাটাবে।
নিবিড় তনুসাকে নিয়ে অন্য গাড়িতে করে অফিসের দিকে গেলো।প্রিয়তা সবার সাথেই বাসায় ফিরে এলো।
ফ্রেশ হয়ে এসে কালো রঙের একটা শাড়ি পরে সবার জন্য চা বানিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে আসলো।
মোশারফ হোসেন মুচকি হেসে,তোকে তো বেশ মানিয়েছে শাড়িটা,কী বলো সালমা?
-হু,মেয়েটা কার দেখতে হবে না।
ভাবী,জানো ভাইয়া আজ তোমায় দেখলে চোখ ফিরাতে পারবে না।কথাটা শুনে প্রিয়তা লজ্জায় লাল হয়ে গলাটা একটু কেশে,জুহি তোমার পড়া নেই?
আমি আসার পর থেকে দেখছি কোনো পড়াশোনা নেই তোমার।
জুহি মুখ ভার করে,ম্যাডাম কাল থেকে পড়ে নিবো।কিন্তু আজ আমার একটা কথা রাখবে?
-কী?
-তুমি নাকি ভালো নাচতে পারো।একটু নাচ আমাদের সবাইকে দেখাও না।
মোশারফ হোসেন উৎকণ্ঠে বললো,সত্যি নাকি প্রিয়তা?
প্রিয়তা জুহির দিকে দাঁত খিচিয়ে, আসলে বাবা অনেক আগে একটু একটু করতাম।এখন কয়েকবছর থেকেই করি না।
সালমা বেগম আহ্লাদী গলায় বললো,তাহলে আমাদের একটু খানি দেখা।জুহি একটা গান চালিয়ে দে।

-কিন্তু মা, এখন কীভাবে নাচবো? 

-কোনো কথা নয়।আমি তোর নাচ দেখবো।

মোশারফ হোসেন সালমা বেগমের সাথে একমত হয়ে,হ্যাঁ আমিও দেখবো।
প্রিয়তা নিরুপায় হয়ে, আচ্ছা ঠিক আছে।কিন্তু তোমাদের ছেলে যদি এখন এসে পড়ে?

-আরে ও এখন আসবে না।তুই নাচ তো।এতো চিন্তা করিস না আমরা আছি তো। 

প্রিয়তা মুচকি এসে জুহিকে একটা গান বাজাতে বলে কোমরের শাড়ির আঁচল গুজে নিয়ে,একটু খানি দাঁড়িয়ে তারপর নাচতে শুরু করলো।
নাচতে নাচতে কখন যে নিবিড় দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে কেউ খেয়াল করলো না।সবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে আর উপভোগ করছে। প্রিয়তা নাচতে নাচতে নিবিড়ের সামনে এসে পড়তেই নিবিড় হাত ধরে থামিয়ে ফেলে।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে,আ,,,আ আপনি?
নিবিড় রাগন্বিত চোখে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। 
মোশারফ হোসেন আর সালমা বেগম নিবিড়কে দেখে আস্তে আস্তে উঠে পালিয়ে গেলো।পিছন পিছন জুহিও দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে এক পা এক পা করে পিছনে এসে, বা,,বা,,বাবা।
কোনো সাড়া না পেয়ে পিছনে ফিরে, বাবা! মা! জুহি! 
প্রিয়তা বিড়বিড় কিরে,দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করলো।নিবিড় আস্তে আস্তে এগিয়ে প্রিয়তার একদম সামনা সামনি দাঁড়িয়ে, এসব কী?
প্রিয়তা শাড়ির আঁচল কোমর থেকে খুলে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে মনে মনে বলতে লাগলো,আল্লাহ আপনি আমায় এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দিন।জীবনেও আর নাচবো না।আমার দাদার বাপে বললেও না।
 প্রিয়তা কোনো কথা বলছে না দেখে,আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি?
প্রিয়তা এবারও নিশ্চুপ। 
নিবিড় ধমকিয়ে,আপনার লজ্জা করছে না এইসব করছেন? আমি বাড়ি না থাকলে আপনি এই সব করেন?
প্রিয়তা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,বাবা বলেছে তাই,,,,
-জাস্ট শাটাপ। আপনি বাচ্চা? যে যা বলবে তাই শুনে নাচানাচি শুরু করবেন?আর এইটা কী শাড়ি পরেছেন আপনি? 

মোশারফ হোসেন আর সালমা বেগম দরজায় উঁকি দিয়ে দেখছেন।সালমা বেগম আস্তে করে বললো,তুমি গিয়ে ওকে শান্ত করো।মেয়েটাকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে।

-সালমা তুমি চুপ করো।ওকে এইভাবে নিবিড়ের সাথে লড়তে হবে।চুপচাপ থাকলে নিবিড় ওকে দূরে সরিয়ে রাখবে।তুমি কী মনে করো তোমার ছেলে আমাদের সামনে ওর সাথে ভালো ব্যবহার দেখায় বলে ও বউকে ভালোবাসে? মোটেও না।ও শুধু আমাদের দেখায়।ওকে এসব শুনেই শক্ত হয়েই নিবিড়ের সাথে লড়তে হবে।আজ হোক কাল হোক মেয়েটা একদিন ঠিক সফল হবে।

-আনসার মি,,কোথায় পেলেন?
আমি আপনার জন্য এতো শপিং করে আনলাম আপনার সেইগুলো পছন্দ হয়নি?
প্রিয়তা চোখ মুছতে মুছতে, আপনিই তো এইটা নিয়ে আসলেন।তাই তো আমি পরলাম।
-কিন্তু আমি তো কালো রঙের শাড়ি নিয়ে আসিনি।কথাটা বলতেই হঠাৎ নিবিড়ের তনুসার কথা মনে পড়লো।সেদিন শপিং করার সময় তনু ছিলো আমার সাথে।সে কি ইচ্ছে করে এইটা করলো নাকি?
নিবিড় নিজেকে সংযত করে,ওকে,,এই শাড়িটা পরে আমার সামনে আর আসবেন না।আমার কালো রঙ একদম পছন্দ না।

কথাটা বলেই নিবিড় নিজের রুমে চলে গেলো।
প্রিয়তা সোফায় নিরব স্থির হয়ে বসে,এই মানুষটা কী কোনো দিন আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে না? বয়সটা কী মানুষের সব?
আমি না হয় ওনার তিন মাসের বড়,এইটা কী অনেক বেশি? প্রিয়াতা হঠাৎ তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে,তবে একটা জিনিস ভালো হয়েছে।দশ জনের কথা শুনার থেকে একজনের শুনা অনেক ভালো।বাবা মা তো আমায় অনেক ভালোবাসে।ওনিও হয়তো একদিন না একদিন সব ভুল বুজতে পেরে আমায় কাছে টেনে নিবেন।

প্রিয়তা, প্রিয়তা এইদিকে আসো।
প্রিয়তা নিজের রুমের দিকে তাকিয়ে,বাহ্  অভিনয় আবার শুরু করে দিয়েছে।রাক্ষুস একটা।মায়া দরদ বলতে কিচ্ছু নেই মনে।
কথাটা বলেই প্রিয়তা রুমে গিয়ে,আমায় ডেকেছেন?
নিবিড় কিছু না বলে দরজাটা আটকিয়ে দিলো।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে,আল্লাহ এইবার কী আমাকে মাইর দিবে নাকি?কিন্তু লাঠি তো আশে পাশে দেখতে পাচ্ছিনা।নিবিড় সামনে দাঁড়িয়ে তুড়ি মেরে, ওইদিকে কী দেখছেন?
প্রিয়তা চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে, হে হ্যাঁ। 
নিবিড় গম্ভীর গলায় দাঁতের সাথে দাঁত লাগিয়ে,আপনার এইসব দেখলে আমার বিরক্ত লাগে।
 প্রিয়তার সামনে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে, যাইহোক  এইটা পড়ে সাইন করে দিন।
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে দিতেই,আরে ধরুন তো।এতো ন্যাকামি দেখাবেন না।

-কিসের পেপার এইটা? 
-ভয় নেই এইটা ডিভোর্স পেপার নয়,অবে কন্টাক্ট পেপার।
প্রিয়তা এইবার গলা ছেড়ে,কিসের জন্য?

-আপনার আর আমার সম্পর্কের।আমি আগেই বলেছি আপনি এই বাড়িতে বউ হয়েছেন তবে সেটা আমার স্ত্রী হয়ে নয়।আমার বাবার ছেলের বউ।
তাই এই পেপারে লেখা আছে আপনাকে আমি দেড় বছরের সময় দিবো।এই দেড় বছর আমাদের বাড়িতে থাকেন সমস্যা নেই।তবে দেড় বছর পর আপনি এইবাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।

-কী বলছেন আপনি এই সব?
-উহু ম,, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।মিসেস প্রিয়তা।এই দেড় বছর আপনাকে আমার বাবা মা মাকে বুজাতে হবে আপনি এই বাড়ির যোগ্য বউ নয়। আপনি অক্ষম। এই বাড়ির যোগ্য বউ তনুসা।আপনি আমার বাবাকে বুজাবেন তনুসাই আমার সাথে ভালো মানাবে।আপনার মতো বয়স্ক একজন নারী নয়।
প্রিয়তা কথাটা শুনেই পিছিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে।তারমানে তনুসাকে নিয়ে ভাবাটা তাঁর মোটেও ভুল নয়।সে ঠিকি ভেবেছিলো।
নিবিড় আবার বললো,আপনি এই রুমে থাকবেন।আমার বাবা কিংবা মা কাউকে বুজতে দিবেন না।
আপনি চিন্তা করবেন না।আপনি যখন এই বাড়ি চেড়ে চলে যাবেন আমি আপনাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিবো।নিবিড় এতোটাও পাষাণ নয়।একটা মানুষকে খালি হাতে বের করে দিবো।নিবিড় কাউকে কখনো খালি হাতে ফিরায় না।অবশ্য আপনি পেপারটা পড়েন তাহলেই বুজতে পারবেন।আপনার সুবিধা অনুযায়ী কিন্তু আমি পেপার করে এনেছি।তবে দেড় বছর পর আপনাকে ডিভোর্স দিতেই হবে।
প্রিয়তা কান্নাক্লান্ত চোখ নিয়ে হাত উঠিয়ে নিবিড়কে থামিয়ে, পেপারটা খুলে হাত বাড়িয়ে নিবিড়ের থেকে কলম নিয়ে, টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে পেপারটা উপর কলম বসাতেই,নিবিড় বললো,মিসেস প্রিয়তা, পেপারটা কিন্তু পড়ে দেখতে পারেন।যদি আবার টাকার অংকটা কম হয়ে যায় বা কোনো কিছু আপনার মানতে অসুবিধা হয়।

-মিস্টার নিবিড়!  আমি ছোটো বেলা থেকে যে পরিস্থিতিতে বড় হয়েছি, যে কষ্ট করে বড় হয়েছি,যে বাস্তবতা চোখে দেখেছি আপনি সারাজীবনেও তা করেননি।আপনি সোনার চামচ জন্মেছেন।কিন্তু আমি তা নয়।আমি প্রিয়তা ঠেকতে ঠেকতে আজ এইখানে এসেছি।আপনার টাকার আমার প্রয়োজন নেই নিবিড় সাহেব।টাকা আমিও ইনকাম করি।টাকার লোভ আমায় দেখাবেন না।
কথাটা বলেই প্রিয়তা সাইন করে দিয়ে একমুহূর্তের জন্য দাঁড়ালো না।দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন