মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ০৫)


স্পৃহা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে তাকে যেন জীবনের সামনে পরতে না হয়। তবুও বারবার ঘুরেফিরে জীবনের সামনেই এসে যায়। পরের দিন থেকে বিয়ে বাড়ির আয়োজন শুরু করে গেছে। ডেকোরেটরের লোকেরা এসে বাড়ি সাজাচ্ছে। হলুদের স্টেজ ছাঁদে হচ্ছে। পুরো বাড়িতে লাইটিং করা হচ্ছে। জয়ের সাথে সাথেও জীবনও অনেক কাজ করছে। কেউ দেখে বলবে না এটা ওর বন্ধুর বোনের বিয়ে। জীবন এভাবে সবটা গুছিয়ে নিয়েছে যেন এটা ওর নিজের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান। মারিয়াদের বাড়িটা দোতলা। এটা মারিয়ার দাদার বানানো বাড়ি। একটু পুরোনো আমলের। স্পৃহা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। মারিয়া এসে তার পেছনে দাঁড়াল। 
'এই স্পৃহা জীবন কি এর মাঝে তোর সাথে কথা বলেছে? '
মারিয়ার প্রশ্ন শুনে স্পৃহা মারিয়ার দিকে ঘুরে বলল,
'না আপু।'
'একবার কথা বলার চেষ্টাও করেনি? '
'উহু। '
মারিয়া অবাক হয়ে বলল,
'কি বলছিস? ছেলেটা তো তোকে আমাকে আগে থেকেই চেনে। বিশেষ করে তোকে। তোর জন্যই তো একটা ছেলের সাথে মারামারি করেছে। সেদিনের পর এখানে হঠাৎ তোর সাথে দেখা হলো। আর জীবন তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো না? আজব তো! '
'উনি তো তোমাকে আর আমাকে দেখে এমন ভাব করছেন, যেন আমাদেরকে কখনো দেখেই নি। হয়তো উনি বুঝে গেছেন ঐদিনের ঘটনা বাড়িতে জানাজানি হলে আমাদের সমস্যা হবে। আর তাই জয় ভাইয়ার সামনে এমন করছে। '
'হতে পারে। ছেলেটাকে আমার কাছে ভালোই লাগছে। দেখ সবার সাথে কেমন মিশে গেছে। কেউ দেখে বলবে ছেলেটা যে কি পরিমান বড়লোক।'
এটুকু বলেই নিচে থেকে মারিয়ার ডাক পরেছে। মারিয়া বলল,
'নিচে যাবি এখন? '
'না। আর কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়াব। ঠান্ডা বাতাস ভালো লাগছে।'
'আচ্ছা তুই তাহলে পরে আয়। আমি নিচে যাচ্ছি। '
'হুম। '
মারিয়া চলে গেলে স্পৃহা একা দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ গেল গেটের কাছে। জয় আর জীবন মিলে গেট সাজাচ্ছে। জীবন কি নিয়ে যেন অনেক হাসছে। হাসবে না বা কেন? সাথে জয় আছে তো। জয় যার সাথে থাকে তাকেই হাসায়। স্পৃহা মুগ্ধ হয়ে ছেলে দু'টোর হাসি দেখছে। ছেলেরাও এতো সুন্দর করে হাসতে পারে? স্পৃহার চোখ যেন জীবনের উপর আটকে গেল। সে চেষ্টা করেও জীবনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না। 

দুপুরে গোসল সেরে স্পৃহা চুল মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়েই জীবনের মুখোমুখি হয়ে গেল। জীবন জয়ের রুমে জয়ের সাথেই থাকে। স্পৃহা রাতে একা থাকতে পারে না বলে সব সময়ই মারিয়ার সাথে থাকে। জয় আর মারিয়ার রুম পাশাপাশি হওয়ায়, যাওয়া আসার পথে জীবনের সাথে স্পৃহার দেখা হয়ে যায়। যেমন এখন হয়েছে। তাছাড়া প্রতি বার খাবার টেবিলে তো দেখা হয়ই। স্পৃহা তোয়ালে হাতে নিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন একবার স্পৃহার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে, একটুও দেরি না করে চলে গেল। জীবন চলে যাওয়ার পরই স্পৃহা ওউফ বলে জোরে শ্বাস ফেললো। 
'না চাইতেও বারবার সামনে পড়ে যাই। ধুর ছাতা। '
বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। মারিয়ার বিয়ে উপলক্ষে কাছের দূরের সকল আত্মীয়রা চলে এসেছে। তোহার পরীক্ষা শেষ করে আজ সন্ধ্যায় স্পৃহার বাবা মা স্পৃহার দাদীকে নিয়ে চলে এসেছে। কাল গায়ে হলুদ। দু'দিন আগ থেকেই ছোট বড় সবাই রাত জাগতে শুরু করেছে। মারিয়াকে পাশে বসিয়ে সবাই কতই না গল্প জুড়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ গল্প হচ্ছে মারিয়ার ছেলেবেলা নিয়ে। বংশের প্রথম মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এটা যেন কারো বিশ্বাসই হচ্ছে না। স্পৃহা বেশিক্ষণ এসবের মাঝে বসে থাকতে পারে না। তাই সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বারান্দায় এসে একটু ঠান্ডা বাতাস গায়ে মাখিয়ে নিবে। সবাই যেভাবে গল্প করতে বসেছে তাতে মনে হচ্ছে না ভোর হবার আগে মারিয়া ছাড়া পাবে। স্পৃহা বারান্দায় রাখা বেতের মোড়ায় বসে ছিল। এখানে বেশি আলো হওয়ার তার ভালো লাগছে না। স্পৃহা উঠে হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার শেষ মাথায় অন্ধকারে চলে গেল। সেখানে গিয়ে স্পৃহা যা দেখলো তা দেখে সে চিৎকার না দিয়ে পারলো না। 
জীবন মাত্র রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। জীবন সিগারেট তেমন একটা খায় না। তবুও মাঝে মাঝে এক দুই টা হয়ে যায়। আজ জয়ের রুমে একটা পেয়েছে আর বারান্দায় এসে তাই জ্বালিয়ে নিলো। এই সময় এপাশটায় কেউ আসবে না। আর আসলেও অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। সে নিশ্চিন্তে সিগারেট ফুঁকছিল হঠাৎ করে কেউ যে এখানে এসে যাবে তা জীবনও বুঝতে পারেনি। 
স্পৃহা খেয়াল করলো অন্ধকারে আগুনের ছোট ফুলকি উঠানামা করছে। আর তা দেখেই তার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। স্পৃহা ভূত টূত ভেবে বসে দিলো এক চিৎকার। সাথে সাথে কারো একজোড়া হাত এসে তার মুখ চেপে ধরলো। আর তার সাথে কেমন একটা গন্ধ নাকে বাজলো। জীবন বলল,
'এই চুপ চুপ। চিৎকার করবে না প্লিজ। এটা আমি। জীবন। ভয় পেও না।'
জীবন স্পৃহার মুখ চেপে ধরেই কথাটা বললো। স্পৃহার ভয় এখনো কাটেনি। সে ঘেমে টেমে একাকার হয়ে গেছে। কপাল ও গলা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পরছে। 
'অবশ্য তুমি যে এক চিৎকার দিয়েছ। এর পরে আর চিৎকারের প্রয়োজন পরবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন চলে আসবে। কেউ এখানে এসে আমাদের একসাথে দেখে নিলে নানান কাহিনী বানিয়ে ফেলবে।'
জীবন স্পৃহাকে নিয়ে ছাঁদের সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে চলে গেল। সেখানে গিয়ে সে স্পৃহাকে ছেড়ে দিল। স্পৃহা জীবনের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। জীবন বলল,
'তুমি আমাকে দেখে ওভাবে চিৎকার দিয়েছিলে কেন?'
স্পৃহা বুকভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
'আমি ওখানে আপনাকে দেখিনি। অন্ধকারে আগুনের ফুলকি উঠানামা করছিল। তা দেখে ভয় পেয়েছি। '
জীবন মনে মনে বলল,
'শীট! অবশেষে কিনা এই মেয়েটার সামনে নিজের ইজ্জত খোয়ালাম? ও কি আমাকে স্মোক করতে দেখে নিয়েছে? কেন যে এখানে এমন একটা কাজ করতে গেলাম? সব দোষ জয়ের।'
স্পৃহা এবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে জীবনকে জিজ্ঞেস করলো,
'আপনি ওখানে অন্ধকারে কি করছিলেন? '
স্পৃহার প্রশ্ন শুনে জীবন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এবাড়িতে আসার পর এই তিন চার দিনে আজ প্রথম স্পৃহা জীবনের সাথে কথা বলেছে। মুখ খুলেই সোজা এমন একটা প্রশ্ন। জীবন আমতা আমতা করে বলল,
'রুমে ভালো লাগছিল না। তাই বারান্দায় ফ্রেশ হাওয়া নিতে এসেছিলাম। আলো চোখে লাগছিল তাই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিলাম।'
'ওহ।'
স্পৃহা আর কিছু বলার আগে জীবন বলল,
'চলো এবার নিচে চলে যাই। তোমাকে অনেকক্ষণ দেখতে না পেলে সবাই আবার খোঁজা খুঁজি শুধু করে দিবে।'
জীবন কথাটা বলেই আগে আগে নিচে নেমে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিরবির করে বলল,
'উফ বাঁচা গেল বাবা। মেয়েটা কিছুই দেখেনি। এই যাত্রায় জোর বাঁচা বাঁচলাম। ও কিছু দেখে ফেললে বন্ধুর বাড়িতে কেলেঙ্কারির শেষ থাকতো না।' 

স্পৃহা রুমে এলে মারিয়া বলল,
'কোথায় গিয়েছিলি তুই? আমি সেই কখন রুমে এসে বিছানা গুছিয়ে রেখেছি।'
'বারান্দায় ছিলাম।'
'বারান্দায় ছিলি? কিন্ত বারান্দা থেকে তো কারো চিৎকার শুনতে পেয়ে আমরা গিয়ে ওখানে কাউকে পেলাম না। তোকেও তো দেখিনি।'
'আমি কোনার দিকে ছিলাম। উফ আপু তুমি এতো প্রশ্ন করো না!'
'আচ্ছা আর প্রশ্ন করবো না। এখন শুতে আয়। অনেক রাত হয়েছে রে।'
'আচ্ছা। '
স্পৃহা শুলে মারিয়ার লাইট অফ করে দিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। স্পৃহার গা থেকে যেন কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছে মারিয়া।
'এই স্পৃহা তোর গা থেকে এটা কিসের গন্ধ আসছে রে?'
'গন্ধ? কই কিসের গন্ধ? '
'কেমন যেন একটা বাজে গন্ধ পাচ্ছি। এদিকে আয় তো তুই ভালো করে শুঁকে বলি এটা কিসের গন্ধ। '
মারিয়া উঠে বসে বেড সাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে স্পৃহা দিকে ঝুঁকে এসে নাক কুঁচকিয়ে বলল,
'যা ভেবেছিলাম তা। সিগারেটের গন্ধ। এই তোর গা থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে কেন? তুই এসব কবে থেকে ধরেছিস? আমাকে তো কিছু জানালি না। '
স্পৃহা সামান্য রাগ করে বলল,
'ধুর আপু তুমি কিসব বাজে কথা বলো না। আমার গা থেকে সিগারেটের গন্ধ আসবে কোত্থেকে? আমি কি ওসব খাই? নাকি এবাড়ির কেউ খায়?'
'কেউ খায় না ঠিক। কিন্তু আমি স্পষ্ট গন্ধটা পাচ্ছি বিশ্বাস কর।'
'কচু বিশ্বাস করবো তোমার কথায়। বিয়ের চিন্তা করতে করতে তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ। এখন ঘুমাও তো। নয়তো তোমাকে পাগলা গারদে পাঠাতে হবে। তখন আর তোমার বিয়ে হবে না। '
'তুই তো আমার কথা বিশ্বাস করছিস না। আমি বলছি তো তোর গা থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। আমার নাকে লাগছে।'

জীবন রুমে এসে দেখে জয় কিছু একটা খুজছে। জীবন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলল,
'কিরে কি খুঁজছিস? '
জয় আলমারির কাপড় উল্টাপাল্টা করতে করতে বলল,
'আমার জিনিসটা। এখানেই তো রেখেছিলাম। কোথায় গেল? বাড়ির কারো হাতে পড়ে যায়নি তো? কারো হাতে পরলে আজই এই বাড়িতে আমার শেষ দিন।'
'তুই বাসায় এসব নিয়ে আসিস! জয় তুই না ভালো ছেলে। বাসায় বাবা মা বোন আছে তাদের আড়ালে তুই এসব করিস!'
জীবন মুচকি হাসছে দেখে জয় তার দিকে ফিরে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে বলল,
'শালা তুমি আমার জিনিস নিয়ে এখন আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ। আমি তো সবার আড়ালে এসব করি। আর তুই যে আমার জিনিস চুরি করে বাইরে থেকে খেয়ে আসলি। বন্ধুর বাসায় যে তার বাবা মা বোন আত্মীয় স্বজন চৌদ্দ গোষ্ঠী আছে সেটা মনে ছিল না?'
জীবন হাসতে হাসতে বলল,
'অনেক দিন পরে পেয়েছি। তাও তোর থেকে তাই একটু চোর হয়ে গেলাম আরকি।'
'চোর হয়েছিস ভালো কথা। কেউ দেখেনি তো?'
'না।'
জীবন মুখে না বললেও মনে মনে তার চিন্তা হচ্ছে স্পৃহা তো তাকে দেখেছে। কিন্তু কিছু বুঝতে পেরেছে কি? গন্ধ টন্ধ পায়নি তো?
অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে স্পৃহা মনে মনে জীবনকে হাজার কথা শোনাচ্ছে। 
'বাইরে থেকে দেখে সবাই তো উনাকে ফেরেশতা ভেবে নিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তাদের ফেরেশতা এতটা শয়তান তা কি কেউ জানে? বন্ধুর বোনের বিয়েতে এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এসব কাজ করে? আমি তো আগুন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি যে এসব করছেন তা জানতাম নাকি? তাই তো তখন কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। সবার কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে আমার মুখ চেপে ধরে ছাঁদে নিয়ে গেল। অসভ্য লোক একটা। জয় ভাইয়াকে বলার দরকার ওর বন্ধু কেমন ছেলে। সামনে থেকে দেখে তো মনে হয় উনার মত ভালো, ভদ্র ছেলে পৃথিবীতে আর দু'টা হয় না। মারিয়াপু না বললে আমি তো বুঝতেই পারতাম না ওটা কিসের গন্ধ ছিল।'

 
সকাল থেকে পুরোদমে হলুদের আয়োজন চলছে। ছাঁদে স্টেজ বাঁধা হয়েছে। বাচ্চারা সেখানে ছুটাছুটি করে খেলা করছে। মারিয়ার দাদীর নির্দেশ অনুযায়ী নিচে কয়েকজন মহিলা হলুদ বাটতে বসেছে। সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সবার আনন্দ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। জয় আর জীবন হলুদের স্টেজে লাইটিং করছে। রাতে যেন অন্ধকারে কোনো অসুবিধা হয় না। বাইরের গেট থেকে ভেতর বাড়ি পর্যন্ত মরিচ বাতি লাগানো হয়েছে। দক্ষিণের বারান্দার শেষ মাথা থেকে একতলা
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ছাঁদ পর্যন্ত মরিচ বাতির আলোয় ঝলমল করছে। লাল,হলুদ,সবুজ হরেক রকমের আলোয় চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে আছে। তোহা ছাঁদ থেকে এসে দৌঁড়ে মারিয়ার রুমে যাবার সময় মেহেরুনের সাথে ধাক্কা খেলো। তোহা না থেকে ছুটতে ছুটতেই বলল,
'সরি খালামণি।'
'তুই এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন তোহা? আস্তে যা পড়ে গেলে হাত পা আস্ত থাকবে না।'
'পড়বো না।'
তোহা চলে গেলে মেহেরুন বললেন, 
'পাগলী মেয়ে। কত বড় হয়ে গেছে এখনো ওর বাচ্চামি গেল না।'
তোহা মারিয়ার রুমে এসে বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলো। স্পৃহা তোহাকে দেখে বলল,
'পাগলা কুকুরের তাড়া খেয়েছিস নাকি? এভাবে দৌঁড়ে এসে এখন হাঁপাচ্ছিস কেন?'
'পাগলা কুকুর না রে আপু। রুপকথার রাজপুত্তুর দেখে দৌঁড়ে এসেছি।'
স্পৃহা সরু চোখে তাকিয়ে টেনে টেনে বলল,
'রাজ-পুত্তুর! '
'আরে হ্যা রে হ্যা।'
এবার মারিয়া বলল,
'কার কথা বলছিস রে তুই? কোন দেশের রাজপুত্র? কিসের কি বলছিস, কিছুই বুঝতে পারছি না।'
'ছাঁদে ঐ ছেলেটা কে গো আপু?'
স্পৃহা বলল,
'কোন ছেলে?'
'আরে জয় ভাইয়ার সাথে সব সময় থাকে। দেখলাম ওদের দু'জনের অনেক ভাব।'
মারিয়া আলমারি থেকে কাপড় বের করতে করতে বলল,
'ওহ এবার বুঝেছি তুই জীবনের কথা বলছিস। তা বন্ধুর সাথে বন্ধুর ভাব থাকবে না। তো কি তোর সাথে থাকবে?'
'ওরা দু'জন ফ্রেন্ড? '
'হুম।'
তোহার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সে আস্তে করে বলল,
'তাহলে তো আমার রাস্তা পরিষ্কার।'
তোহা কথাটা আস্তে বললেও স্পৃহা ঠিকই শুনেছে। স্পৃহা বলল,
'কি বললি তুই? কিসের রাস্তা পরিষ্কার? তোর মাথায় কি চলছে তোহা?'
তোহা কিছু বলার আগেই মারিয়া বলল,
'তুই এতো গাধী কেন রে স্পৃহা? তোহার এই কথাটাও বুঝতে পারছিস না। তোহা জীবনের সাথে লাইন মারার কথা ভাবছে।'
স্পৃহা চোখ বড় করে তোহার দিকে তাকিয়ে জোরে বলে উঠলো,
'কিই! এই তুই জানিস উনি তোর থেকে কম করে হলেও দশ বারো বছরের বড় হবে। আর উনি বিয়ে করলে এতদিনে তোর মত একটা মেয়ে থাকতো। আর তুই কিনা উনার সাথে... ছি ছি এসব ভাবতে লজ্জা করে না তোর।'
তোহা বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে রিলাক্স মুডে বলল,
'লজ্জা করার কি আছে আপু? ক্লাস সিক্স এর মেয়েরা ইন্টারের ছেলেদের সাথে প্রেম করতে পারে। তাহলে আমি ক্লাস টেনের মেয়ে কেন উনার সাথে লাইন মারার কথা ভাবতে পারবো না? হোয়াট?'
তোহার কথা শুনে স্পৃহা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে মারিয়া তোহার কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওদের দু'জনের অবস্থা দেখে তোহার কোনো ভাবান্তর হলো না। সে ঠিক আগের মত করেই বলছে,
'দেখিস না আজকাল ত্রিশ, চল্লিশ বছরের বুড়ো লোক গুলো ষোল সতের বছরের বাচ্চা মেয়েদের বিয়ে করে। মারিয়াপু ভাগ্য করে সোম ভাইয়াকে পেয়ে গেছে। কিন্তু তোর আমার কপালে কি আছে তা একবার ভেবে দেখেছিস? হয়তো তোর বরও বুড়ো হবে। তোর থেকে দশ বারো বছরের বড়। তাইতো আমি ওসব ভেবে আগে থেকেই আমার থেকে দশ বারো বছরের বড় ছেলের সাথে লাইন মারতে চাই। যাতে এনিয়ে পরে আর কান্নাকাটি না করতে হয়।'
স্পৃহা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
'তোহা চুপ করবি তুই? ভাইয়ের বন্ধু মানে ভাই-ই হয়। তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা ভাবা ঠিক না।'
'কচু! দুনিয়াতে প্রত্যেকটা ছেলের তাদের বন্ধুর বোনের সাথে লাইন মারার জন্মগত অধিকার আছে বুঝলি। ৯৯% ছেলেরাই বন্ধুর খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুপাতো বোনের সাথে প্রেম করে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।'
'তোহা তুই এক্ষুনি এই রুম থেকে না গেলে আমি তোকে কি করবো তা আমিও জানি না।'
মারিয়া হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে নিচে বসে পড়েছে। তোহা স্পৃহার চেঁচানো শুনে একটু ভয় পেয়েছে। তোহা বলল,
'আমি আসি হ্যা? খালামণি আমাকে একটা কাজ দিয়েছিস।'
বলেই তোহা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মারিয়াকে হাসতে দেখে স্পৃহার আরো রাগ হচ্ছে। স্পৃহা বলল,
'তুমি ওর অতি পাকনা কথাগুলো শুনে হাসছো আপু?'
মারিয়া অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
'হাসবো না? দেখলি না তোহা কি বলল। আমার মনে হয় তোহাই ঠিক করছে। আগে থেকেই সব সেট করে রাখা ভালো।'
মারিয়া আবার হাসছে। স্পৃহা রেগে মারিয়ার রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিরবির করে বলল,
'তোহাটা অনেক বেড়েছে। অন্য একজনের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে কিনা কি ভাবছে। এইটুকু বয়সে এসব কথা তোহার মুখ দিয়ে আসে কীভাবে? লজ্জা লাগে না? মা'কে সব বলবো। ও তো ভাবছে ছেলেটা হয়তো সাধু। অবশ্য দেখেও তেমনই মনে হয়। কিন্তু কাল রাতে আমি তো দেখলাম উনি কেমন সাধু। অন্ধকারে চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে নাক মুখ দিয়ে ছোঁয়া ছাড়ছিল।'
স্পৃহা জয়ের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে সামলে নিলো। জয় স্পৃহার মাথায় হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলল,
'কোন দিকে তাকিয়ে হাঁটিস হ্যা? আস্ত একটা মানুষ সামনে দিয়ে আসছে তুই তা না দেখে আমার সাথে ধাক্কা খাচ্ছিলি। চোখ খুলে হাতে নিয়ে চলাফেরা করিস নাকি?'
জয়ের কথার উত্তরে স্পৃহা চুপ করে রইলো। জয় জোরে শ্বাস ফেলে বলল,
'কাকে কি বলি আমি! তোকে তো হাজার কথা বললেও একটার উত্তর দিবি না। তুই তো আর তোহা না যে,কথার বদলে চটাং চটাং করে কথা বলবি। এখন বল কোথায় যাচ্ছিলি?'
'কোথাও না।'
'হাতে কোনো কাজ আছে? '
'না।'
'তাহলে আমার রুমের ড্রয়ার থেকে স্কচটেপ নিয়ে ছাঁদে গিয়ে জীবনকে দিয়ে আয় তো। ও ওখানে কাজ করছে। আমিই নিতে এসেছিলাম। কিন্তু বাবা এখন আমায় অন্য কাজ ধরিয়ে দিলো। তুই তাড়াতাড়ি ওকে দিয়ে আয়।'
স্পৃহা জয়ের কথা শুনে মনে মনে বলল,
'এখন আমাকে ঐ ছেলেটার কাছে যেতে হবে? '
স্পৃহা রাতের ঘটনা একবার মনে করলো। স্পৃহার ইচ্ছে করছে জয়কে বলে দিতে "আমি এখন ছাঁদে যেতে পারব না ভাইয়া। তুমি অন্য কাউকে বলো"। কিন্তু সে বলতে পারছে না। কারো মুখের উপর না বলার ক্ষমতা স্পৃহার নেই। তোহা অনায়াসে সবার মুখে মুখে কথা বলতে পারে। কিন্তু স্পৃহা তা পারে না। সে সবার কথা মেনে চলতে অভ্যস্ত।

স্পৃহা স্কচটেপ নিয়ে ছাঁদে এসে দেখে জীবন একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। হলুদের স্টেজে যেন কিসের তার লাগাচ্ছে। হয়তো লাইট লাগানোর ব্যবস্থা করছে। রাতে তো এখানেই আড্ডা হবে। জীবন কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পেছনে না তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
'সামান্য একটা কাজ করতে তোর এতো সময় লাগে? কখন নিচে পাঠিয়েছি, তুই এখন এলি। দে স্কচটেপটা তাড়াতাড়ি দে।'
স্পৃহা কোনো কথা না বলে স্কচটেপ জীবনের হাতে দিলো। জীবন সেটা নেবার সময় স্পৃহার হাতে ছোঁয়া লাগলে পেছন ফিরে তাকালো। এখানে স্পৃহাকে দেখে জীবন টুল থেকে নেমে এসে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
'সরি। আসলে আমি ভেবেছিলাম জয় এসেছে। তুমি এসেছ সেটা আমি বুঝতে পারিনি।'
এই মুহূর্তে স্পৃহাও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। তবে এই প্রথম কোনো ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখে স্পৃহার খানিকটা হাসি পেল। সে যতটা না লজ্জা পেয়েছে তার থেকে বেশি লজ্জা তো এই ছেলে পাচ্ছে। কোনো ছেলে যে একটা মেয়ের সামনে এতটা নাজেহাল অবস্থায় পড়তে পারে তা স্পৃহার জানা ছিল না। স্পৃহা মনে মনে বলেই ফেলল,
'রাতে আমার কাছে অমন অবস্থায় হাতেনাতে ধরা খেয়েও তো এতটা লজ্জা পাননি। তাহলে এখন কেন সামান্য আমার হাত ধরায় এতো লজ্জা পাচ্ছেন?'
মনের কথা মনেই চাপা দিয়ে স্পৃহা বলল, 
'জয় ভাইয়া অন্য একটা কাজ করছে। তাই আমাকে পাঠালো।'
'আচ্ছা। '
জীবন আর একবারও স্পৃহার দিকে না তাকিয়ে আগের মত কাজে লেগে গেল।

তানিয়া মারিয়াকে তাড়া দিচ্ছেন। কারণ মারিয়া এখনও রেডি হয়নি। 
'কি করছিস মারিয়া রেডি হবি কখন? '
'উফ খালামণি! হলুদ তো আর এখন লাগানো হবে না। হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হবে রাতে। ওবাড়ি থেকেও তো কেউ আসবে না। তাহলে তুমি শুধু শুধু এতো তাড়া দিচ্ছ কেন বলো তো?'
'শোনো মেয়ের কথা। হলুদ অনুষ্ঠান রাতে শুরু হবে তাই বলে তুই এখন এই অবস্থায় বসে থাকবি। গোসল করে ভালো একটা শাড়ি তো পরতে পারিস নাকি? '
'আচ্ছা তুমি যাও। আমি গোসল করে ভালো শাড়ি পড়ে নিব।'
'ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। তুই এখন আবার ফোন নিয়ে বসে পরিস না।'
'হুম। '
বিকেলে সবাই হলুদের শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে গেছে। মেয়েরা সাদা ব্লাউজের সাথে হলুদ রঙের শাড়ি। খোঁপা করা চুল। ছেলেরা সাদা পাজামার সাথে হলুদ পাঞ্জাবি। সবাই একই রকম ভাবে সেজেছে। কিন্তু এসবের মাঝে মাঝখান থেকে স্পৃহা বেঁকে বসেছে। সে ঐদিনের পর আর কখনও শাড়ি পরবে না বলে কথা দিয়েছিল। যে মেয়ে ঠিকমত শাড়ি সামলাতে পারে না। তার শাড়ি পরার কোনো অধিকার নেই। শুধু শুধু মানুষের সামনে ছোট হওয়ার তো কোনো মানে নেই। মারিয়া বিরক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়ে বলল,
'স্পৃহা তুই কী চাস? না আজ স্পষ্ট করে বল। তুই চাস তোর জন্য আমার হলুদ অনুষ্ঠানটা ভেস্তে যাক তাই না? '
'আপু এমন কেন বলছো? তুমি তো ভালো করেই জানো আমি কেন শাড়ি পরতে চাচ্ছি না।'
'জানি। তাই বলে ঐদিন এমনটা হয়েছে বলে প্রতিদিন তো আর হবে না। এবাড়িতে তো কোনো বখাটে ছেলে নেই যে,আজ তোর সাথে অসভ্যতা করবে।'
তোহা মুখ গোমড়া করে বলল,
' আপু তুই প্লিজ আর না করিস না। একটা দিন একটু কষ্ট করে ম্যানেজ করে নে না। দেখ আমরা সবাই শাড়ি পরেছি। তুই মাঝ থেকে বেঁকে বসলি। এমন করলে কেমন লাগে বলতো? '
মারিয়া তোহাকে ধমক দিয়ে বলল,
'এতো জোড়াজুড়ি করছিস কেন হ্যা? কারো ইচ্ছে হলে শাড়ি পরবে,ইচ্ছে না হলে পরবে না। কাউকে জোর করার তো কিচ্ছু নেই। আমাকে কেউ আপন ভাবলে ঠিকই আমার কথা রাখতো।'
স্পৃহার এবার কান্না পাচ্ছে। তার জন্য আজকের মত স্পেশাল একটা দিনে মারিয়াপুও মন খারাপ করছে। স্পৃহা বলল,
'আচ্ছা আমি শাড়ি পরবো। কিন্তু একটা শর্তে। আমাকে মারিয়াপু নিজের হাতে শাড়ি পরিয়ে দিবে। কি শর্তে রাজি তো?'
মারিয়া হেসে ফেলে লাফিয়ে উঠে বলল,
'একশোবার রাজি। হাজার বার রাজি। শুধু শাড়ি কেন আমি নিজে তোকে সাজিয়ে দিব।'
মারিয়া স্পৃহাকে নিয়ে জয়ের রুমে চলে গেল। কারণ মারিয়ার রুমে তার দুই ফুপু বসে কথা বলছেন। স্পৃহা তো আর উনাদের সামনে শাড়ি পরতে রাজি হবে না। আর তাছাড়া এখন জয়ের রুমটাও খালিই আছে। মারিয়া পেছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সোমের সাথে ফোনে কথা বলছে। তোহাকে মা ডেকেছে তাই সে নিচে গেছে। স্পৃহা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মারিয়াকে ডাকলো, 
'আপু এদিকে আসো না প্লিজ। ব্লাউজের ফিতা বাঁধতে পারছি না। পেছন দিকে হাত যাচ্ছে না।'
'একটু দাঁড়া বোন প্লিজ। এইতো আর দুই মিনিট।'
'আপু কাল বিয়ে। বিয়ের পরে তো সারাজীবন একসাথে থাকবে। তখন মন ভরে কথা বলে নিও। এখন আমাকে একটু হেল্প করো।'
'আসছি স্পৃহু। ময়না টিয়া একটু ওয়েট কর।'
স্পৃহা আর মারিয়াকে কিছু বললো না। স্পৃহা হাসছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে মারিয়াপু এতো কি কথা বলছে তা ভাবছে। স্পৃহা তো ফোনে কারো সাথে দুমিনিট ভালো করে কথা বলতে পারে না।" আসসালামু আলাইকুম" "কেমন আছেন" "কি করছেন" এসব ছাড়া তো আর কথাই খুঁজে পায় না সে। স্পৃহা ফিতা বাঁধার চেষ্টা করছিল। এমন সময় দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে এসে বলে উঠলো, 
'জয় তুই,,, '

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন