গালে হাত চেপে ফুঁপাচ্ছে সাঁঝ।চুল গুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে।হাতে থাকা ফোনটা বারবার ভোঁতা শব্দ করে কেঁপে উঠছে।জুলেখা বানু টেবিলের কোনায় পড়ে আছেন।হুমায়রা বাবাকে পার করে মার কাছে যেতে পারছেনা।কুঞ্জন বাবার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে আছে।কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা ও।লাবনী সাঁঝের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলো।কিন্তু ইকরাম খানের চিৎকারে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলো।ইকরাম খান বললেন,
''এমন নোংরামী করতে যাস অফিসে?জানোয়ার মাইয়া রাস্তার মাইয়া তুই?বেডাগোর লগে কোলাকুলি খাড়াই থাকোস?নষ্টামী করস রাস্তাত দাঁড়াই।তোগর মতো মাইয়ারে জন্ম দিয়া পাপ হইছে।বড়ডা আকাম কইরা ভাগছে এখন তুই ও বড়ডার পথ ধরছোস।"
জুলেখা বানু কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন,
''আল্লাহর দোহায় চুপ থাকো।এডা কি কইতাছো এতো বড় মাইয়ারে?বড়ডা তো এখানে পর কইরা ফালাইছি।"
ইকরাম রাহমান মেয়ের থেকে চোখ সরিয়ে চিৎকার করে বললেন,
''তুই চুপ থাক।মাইয়াগুলারে নষ্ট করছস অসভ্য মহিলা।"
জুলেখা বানু খব কষ্টে বসা থেকে উঠে দাঁড়ান।মেয়েকে থাপড় থেকে বাঁচাতে গিয়ে ইকরাম রাহমানের ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন।
সাঁঝের ফোনের শব্দ পেয়ে ইকরাম রাহমান ফোন হাত থেকে টেনে নিয়ে চিৎকার করে বললেন,
''এডাই সব নষ্টের মূল এডারেই শেষ করুম।"
বলেই খুব জোরে আঁছাড় মেরে পা দিয়ে পাড়াতে থাকেন।
সাঁঝ আরো জোরে কান্না করতে শুরু করে।মেয়ের কান্নায় জুলেখা বানু ওকে সামলাতে আসলে ইকরাম রাহমান আবার ধাক্কা দিতেই কুঞ্জন মাকে ধরে বলল,
''আব্বা পাগল হইছো।হাত সামলাও তুমি।"
ইকরাম রাহমান কুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
''এই জানোয়ার পোলা।থাবড়ায়া গালের দাঁত ফালায়া দিমু।বেয়াদব কোনহানকার।"
সাঁঝের কান্নায় বিরক্ত হয়ে দৌড়ে মেয়ের কাছে এসে মারতে গেলে সামনে কুঞ্জন এসে দাঁড়িয়ে বলল,
''আপু তুই যা রুমে।"
সাঁঝ দৌড়ে রুমে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।ইকরাম রাহমান আরো গালিগালাজ করতে থাকেন মেয়েকে।বলছিলেন,
''চাকরী করা বাইর করুম।বুড়ি মাইয়া সরম লাগেনা?বেডাগোর লগে লাগালাগি করোস নির্লজ্জ বেশরম মাইয়া!!!!"
তখনই ভ্রু কুঁচকে ঘরে প্রবেশ করে নিশাদ। ক্লান্ত শরীর আর ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে প্রায় সাড়ে আটটায় ঘরের দরজার সামনে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে টাইপ করছিল নিশাদ ইদ্রির নম্বরে
"এতদিন কেন জানি তাড়া ছিলোনা অফিস থেকে বাসায় ফেরার ।। কিন্তু আজও প্রতিদিনের মতো ক্লান্ত শরীর নিয়ে জ্যাম ঠেলে বাসায় আসার প্রচন্ড তাড়া কাজ করছিলো।।। মনে হচ্ছিলো ফোনের অপর পাশে কেউ আমার নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে।।
আচ্ছা সে কি সত্যি সারাদিন আমার অপেক্ষা করেছে আজ ? তার কি আমাকে মনে পড়েনা আর ? না কি আমাকে আর ভালো লাগে না? আগের মতো পাগলামি করতে ইচ্ছা করে না আমার সাথে? আমি যে খুব মিস করছি সেই মুহূর্তগুলো।।।।বাহির থেকে বোনের কান্না বাবার গালিগালাজ শুনে মাথা অর্ধেক বিগড়ে যায় নিশাদের।ঘরে প্রবেশ করতেই ইকরাম রাহমান বললেন,
''লাই দিয়া দিয়া মাথাত উঠাইছোস তো।এহন তোর বোইন বেডার লগে কোলাকুলি কইরা দাঁড়ায় থাহে।বড়ডার মতো এডাও শুরু করছে।"
নিশাদ রাগী দৃষ্টিতে সাঁঝের রুমের দিকে তাকায়।
..................................আজ সবুজ শাড়ীতে আচ্ছাদিত প্রিয়াশা।খোপায় সাদা ফুলের মালা জড়িয়েছে।আজ অবশ্য হাফ ডিউটি ওর।মন্দিরে যাবে প্রিয়াশা।তাই এমন সাজ।লাঞ্চের পর বের হবে ও।আদনান আড়ালে প্রিয়াশাকে দেখছিলো।প্রিয়াশা আদনানকে দেখলে কি যেন বলার চেষ্টা করে ও বলতে পারেনা।আদনান প্রিয়াশার এখন কথা হয়না বললেই চলে।অফিশিয়ালি কথা বার্তা বলার সময়ে যেন দুজনের মাঝে কেমন বাঁধা কাজ করে।আদনান কোটটা কাঁধে ঝুলিয়ে ক্যান্টিনে এসে দাঁড়ালো।চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে প্রিয়াশাকে খুঁজার চেষ্টা করতে করতে কফি মেশিনের সামনে এসে দাঁড়ায়।তারপর একটা মগ নিয়ে কফি মেশিন অন করে।হঠাৎ পিছন থেকে প্রিয়াশার কথা শুনতে পায় আদনান।মগ ভর্তি কফি নিয়ে পিছে ফিরে দেখলো প্রিয়াশা আর সৃষ্টি কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে।আদনানের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুঁটে উঠে।প্রিয়াশা বেশ লম্বা।সৃষ্টিকে ওর পাশে অদ্ভুত লাগছে।প্রিয়াশা সবুজ শাড়ী আর কালো ব্লাউজের মাঝে সাদা ঢেউ খেলানো কোমড় দৃষ্টি কাড়ছে আদনানের।ওর পায়ের থেকে আসা মৃদু ধ্বনি তুলছে রুপোর নুপুর।
আদনানকে দেখে সৃষ্টি হেসে বলল,
''ভালো আছেন স্যার?
আদনান একটু হাসলো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে।মেয়েটা নতুন এসেছে।এসেই আদনানের সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা করছে।কিছুটা যেন ইম্প্রেস ও করতে চায় সেটা বুঝে ও না বোঝার ভান করে থাকে আদনান।সৃষ্টি প্রিয়াশার থেকে সরে এসে আদনানের পাশে দাঁড়ায় অনেকটা কাছে এসে। তারপর বলতে লাগলো,
''স্যার আপনি অনেক ভালো।নিউ কামার্সদের অনেক বুঝেন।"
আদনান হেসে বলল,
''বুঝবোনা কেন বলো?তোমরা আমার কলিগ বুঝতে হবে।কপোরেটিভ মাইন্ডেড হতে হবে তাইনা?"
কথাটা বলেই আদনান প্রিয়াশার দিকে আড় চোখে তাকায়।প্রিয়াশা নিশ্চুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আদনান আর সৃষ্টির দিকে।তবে ওর দৃষ্টি ছিলো তীক্ষ। চিকন ঠোঁটজোড়া চেঁপে দাঁড়িয়ে আছে।আদনান সৃষ্টির দিকে একটু চেঁপে বলল,
''তোমার জামার কালারটা বেশ।খুব মানিয়েছে।এমন কালার পরোনা মানুষের বদনজর লাগবে।"
সৃষ্টি আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল,
''স্যার কি সুইট আপনি।তবে এতোটাও সুন্দর না আমি।"
আদনান হেসে বলল,
''কি যে বলো।যাই হোক চলো একসাথে লাঞ্চ করি।"
কথাটা বলে আদনান ফের প্রিয়াশার দিকে তাকায়।প্রিয়াশা যেন ফোঁসফোঁস করছে রাগে।এদিকে আদনানের কথায় আবেগে পাগল হয়ে সৃষ্টি পাগল হয়ে বলল,
''স্যার সত্যি?"
''হুম।"
আদনান আবার ও প্রিয়াশাকে দেখতেই খেয়াল করলো প্রিয়াশা দৌড়ে যাচ্ছে লিফটের দিকে।আদনান কিছু না বলে প্রিয়াশার পিছু নিলো।প্রিয়াশা লিফটে ঢুকে দরজা বন্ধ হওয়ার বাটনে চাঁপ দিতেই আদনান আটকালো।বাঁকা হেসে লিফটে প্রিয়াশার থেকে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ায়।লিফটের দরজা বন্ধ হতেই প্রিয়াশা বিড়বিড় করে বলল,
''কিছু কিছু মানুষের কলিগের সাথে লাগালাগি করতে ও লজ্জা করেনা।নিজের পোস্ট ও ভুলে যায়।"
আদনান মৃদু হেসে নিজে নিজে বলতে লাগলো,
''উফ সৃষ্টির শরীরের মিষ্টি ঘ্রান নাকে লাগছে।ইচ্ছপ হচ্ছিলো আরো একটু ঘ্রান নিয়ে আসতে।তবে কাজের চাঁপে পারলাম না।কি পারফিউম দেয় ও জানতে হবে।"
আদনানের কথায় প্রিয়াশা বলল,
''না করেছিলো কে?বড় পোস্টই তো ভয় পাওয়ার কথা না।ঘ্রান নিতে নিতে তো কোলেই উঠে যাচ্ছিলো।"
''কোলে নিতে পারলে ওকে কোলেই নিতাম।তবে কলিজা পোড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে যেন।"
বলেই নাক টানার শব্দ করতে থাকে আদনান।
আদনানের কথায় কিছুটা নিজেকে আঁচ করতে পেরে লজ্জা পেয়ে যায় প্রিয়াশা।মাথা নিচু করে দুহাত দিয়ে শাড়ি খাঁমচে রাগ নিয়ন্ত্রন করতে থাকে প্রিয়াশা।আদনান আড়চোখে প্রিয়াশাকে দেখে মৃদু হেসে সামনে তাকায়।
..............................নাস্তা বানিয়ে মেয়েকে ঘুম থেকে উঠায় বেলা। বিভান কিছুক্ষন আগে উঠে শাওয়ার নিতে গেলো।বেলা পূর্নাকে কোলে নিয়ে ব্রাশ করিয়ে দিতে থাকে।ঘুমু ঘুম চোখে পূর্না ব্রাশ করছিলো।মেয়ের অবস্থা দেখে বেলা হেসে ফেললো।মেয়ের গালে আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল,
''কিরে আম্মু ঘুম ভাঙ্গেনা?"
পূর্না মৃদু চোখ খুলে মাকে দেখে কোলে উঠতে চাইলো।বেলা বলল,
''আগে ব্রাশ করো বাবা।তারপর কোলে নিচ্ছি।"
এদিকে বিভানের ডাক শুনতে পায় বেলা।বিভান কিঋুটা জোরে বলছিলো,
''বেলা ব্রেকফাস্ট কোথায়?বের হবো তো।"
বাথরুম থেকে বেলা জোরে বলল,
''এইতো আসছি আপনি বসুন।"
বেলা মেয়েকে ব্রাশ করিয়ে কোলে নিয়ে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়ায়।বিভান নিউজপেপার হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে।মেয়ের মুখ ধুইয়ে বেলা বেরিয়ে আসে।ডাইনিংরুমে এসে থামে।পূর্নাকে কোল থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসিয়ে বলল,
''বসো আম্মু।নাস্তা নিয়ে আসছি।"
পূর্না চেয়ারে বসে পা নাড়তে শুরু করে।বেলা পাকঘরে চলে গেলো।বিভান সংবাদপত্রের কোনা দিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়।মেয়ের মুখে হাসি।বিভান উঠে এসে একটু নিচু হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ওর গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আমার আম্মুটা রাতে এতো কান্না করেছো কেন?"
পূর্না মুখ ফুলিয়ে আধোমুখে বলল,
''তোমলা লেতে তলে এতেতিলা।আমাল বয় লাদতে।"
বিভান হেসে মেয়েকে কোলে উঠিয়ে দুগালে শব্দ করে চুমু দিয়ে বলল,
''আর হবেনা মা।"
বেলা নাস্তা নিয়ে টেবিলে রেখে বলল,
''বিভান আপনি বসুন।নাস্তা দিচ্ছি।"
বিভান মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে পড়লো নাস্তা খেতে। বেলা মেয়েকে কোলে নিতে নিতে বলল,
''ওকে নিয়ে বসলে খেতে পারবেননা।আপনি খেয়ে নিন।ওকে খাওয়াচ্ছি আমি।"
বিভান বেলাকে থামায়নি।বেলা পূর্না কে কোলে নিয়ে বিভানের পাশের চেয়ারে বসে খাওয়তে নিলে পূর্না বেলার কোল থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেলো ড্রয়িংরুমে। বেলা নাস্তার প্লেট হাতে দৌড়ে গেলো মেয়ের পিছনে।বিভান সেদিকে তাকিয়ে আবার খেতে থাকে।
!!!!
সাঁঝের রুম থেকে চোখ সরিয়ে প্রচন্ড রাগী দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায় নিশাদ।প্রচন্ড রাগ লাগছে পিতার ওপর।নিশাদ জানে ইকরাম রাহমানের কথাকে বাড়িয়ে বলার অভ্যাস আছে।এখনও এমনটাই করছেন ওনি।নিশাদ নিজ থেকে ও ভাইবোনকে অনেকটাই বেশি বিশ্বাস করে।ওর বিশ্বাস সাঁঝ এমন মেয়ে নয়।তবে অদ্ভুত লাগছিলো বাবা নিজের মেয়ে সম্পর্কে এভাবে কেন বলছে?নিশাদ চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো মা কাঁদছেন দাঁড়িয়ে।ওনার পায়ে হাত বুলাচ্ছেন।নিশাদ সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে কুঞ্জন এগিয়ে এলো ওর দিকে।পিতার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
''ভাইয়া আপুর চুল টেনে থাপড়েছিলো আব্বা।আম্মা ধরতে গেছিলো আম্মাকে ও ধাক্কা দিছে।নানু ও পর্যন্ত ভয়ে রুমে চলে গেছে।"
ভাইয়ের দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়েছিলো নিশাদ।এখন বাবার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক রাগ অভিমান মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
''আব্বা মানে বুঝলাম না এগুলা কি ধরনের কথা বার্তা?এটা তো ভদ্রলোকের বাসা বস্তিখানা না।এমন তো আগে কখনো করতে দেখি নাই আপনারে।এগুলা কি করতেছেন?আপনি আপার সাথে অনেক করছেন।কিছু বলিনি কিন্তু আপনি এখন যা করতেছেন খুবই নোংরা লাগতেছে।আপনি আম্মার গায়ে হাত দিলেন কেন?আম্মার গায়ে হাত দেয়ার মতো বাজে কাজ কেমনে করলেন?রিক্সাওয়ালারা বৌদের গায়ে হাত তোলে কোন ভদ্র ঘরের মানুষ না।সাঁঝ কিন্তু আপনার নিজের মেয়ে।কিন্তু আপনি এমন সব শব্দ ইউজ করছেন সেটা ভালো ঘরের মানুষ করেনা।এগুলারে কিন্তু খুব কষ্ট করে বড় করছি।আপনি অবসর নিছেন আট দশ বছর হয়ে গেছে।এগুলা আমার সন্তান।এর পর থেকে যদি আর এমন কিছু শুনি আমি সহ্য করবোনা।এগুলা আমার কলিজার টুকরা।কোন কথা বলবেন না এদের ব্যাপারে।এগুলার দায়িত্ব আমার।ওদের সব সিদ্ধান্ত আমার।আপনার বয়স হইছে নামাজ আদায় করেন এসব ছেড়ে দেন।"
আর অপেক্ষা করেনা নিশাদ দ্রুতপদে সাঁঝের রুমে প্রবেশ করে নিশাদ।সাঁঝ খাটে বসে পিছন ফিরে কাঁদছে।চুল গুলো একদম আউলানো।পিঠ ঘেমে ভিজে গেছে।নিশাদের চোখের কোনা ভরে আসে।গলা ভারি হয়ে আসে।সাঁঝর রুমে আসতেই হাঁটতে পারেনা আর।কলিজা ফেঁটে যাচ্ছিলো।মেয়েটা অনেক দায়িত্ববান সাংসারিক।এমন কাজ করতে পারেনা ওর ছোট কলিজাটা।নিশাদ ধীর পায়ে বোনের পিছে এসে দাঁড়িয়ে সাঁঝের চুল ঠিক করে দিতে দিতে কম্পিত কন্ঠে বলল,
''কি হইছে সাঁঝ?কই মারছে আব্বা?"
সাঁঝ আর সহ্য করতে পারেনা।আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে নিশাদের পা জড়িয়ে ধরে।কান্নার মাঝে বলছিলো ''ভাই আব্বা যা বলছিলো এমন কিছু করিনি বিশ্বাস কর।আমি এমন কিছু করিনি।খোদার কসম ভাই আমি এমন মেয়ে না।"
নিশাদ বোনকে একটু সরিয়ে ওর পাশে বসে সাঁঝের চোখ মুছে দিতে গিয়ে দেখলো গাল লাল হয়ে আছে।চোখ মুছে নিশাদ বলল,
''কান্না বন্ধ কর।ভাইয়ারে বল কি হইছে?"
সাঁঝ ভাইয়ের কথায় সাহস পাচ্ছে তবুও কোথাও যেন ভয় কাজ করছিলো।সাঁঝ কাঁদছিলো কিছু বলার চেষ্টা করে ও পারছেনা।নিশাদ বলল,
''বল ভাইয়াকে।কিছু বলবনা ভাইয়া।"
'কান্না জড়িত কন্ঠে সাঁঝ বলল,
''ঐদিন লিফ্টে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর টিউশান থেকে একটা ছেলে নিয়ে এসেছিলো না?"
নিশাদ কিছুটা মনে করতে পেরে বলল,
''ঐ ছেলেটা কি করছে বল ভাইয়াকে?কি করছে বল?"
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে সাঁঝের।ও বলতে লাগলো,
''ঐ ছেলেটাকে আমি ভালবাসি।ওনার সাথে আমার কয়েকমাস যাবৎ সম্পর্ক চলছে।ওনি আমাকে অনেক সম্মান করেন।ওনি খুব ভালো।খুব ভালবাসেন আমাকে।ওনার সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে কফি খেতে গেছিলাম ভাইয়া।আর কিছু হয়নি প্রমিজ।আমি কিছু করিনি আর ভাইয়া।ওনি এমন ছেলেই না।"
বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিশাদ বলল,
''কি নাম ওর? কি করে সে?"
সাঁঝ সাইমন সম্পর্কে নিশাদকে সব টা খুলে বলে।
বোনের সব কথা শোনার পর নিশাদ মৃদু হেসে ফিরে আসে নিজের রুমে।তারপর ফোন বের করে সেটা অন করতে দেখলো নতুন বার্তা এসে আছে।হুমড়ি খেয়ে সেটা ওপেন করতেই দেখলো ইদ্রির মেসেজ।মৃদু হাসে নিশাদ মেসেজটি পড়ে।সেখানে লেখা ছিলো,
"পাগলামি করতে গিয়ে থাপ্পড় খাওয়ার ইতিহাস আছে।। আমি থাপ্পড় ভয় পাই"
নিশাদ হাসতে নিলে ওর মনে আসে একজনের কথা সে ছিলো ইমতিয়াজ।সেদিন ছাদে ইদ্রিকে আরো নোংরা কথা বলেছিলো স্বয়ং নিশাদ।ও এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে সেদিন রাতে ইমতিয়াজ কে কতোট কষ্ট পেতে হয়েছিলো শুধু মাত্র ওর নিজের কারনে।আর যেদিন ইদ্রিকে ওর হাতে তুলে দিয়েছিলো সেদিন ইমতিয়াজ কে কতোটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পেরুতে হয়েছিলো।ও যতোই বেস্টফ্রেন্ড হোকনা কেন?কথাটা ছিলো ইদ্রি ব্যাপারে।ওর ভবিষ্যতের ব্যাপারে।যেটা ওকে সারাজীবন বহন করে যেতে হতো।তারপরও সেদিন বুকে পাথর বেঁধে পরীর মতো বোন কে বেস্টফ্রেন্ডের হাতে তুলে দিয়েছিলো বিশ্বাসের জোরে।কথাগুলো ভাবতেই নিশাদের শরীর হিম হয়ে আসে।নিশাদ ইমতিয়াজের নম্বর ডায়াল করে।দুটো রিং হতেই ইমতিয়াজ কল রিসিভ করেই বলল,
"কি রে আমার বোনকে সহি সালামতে রাখছিস তো ?"
"তোকে কি অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছিলাম সেদিন ?? সত্যি করে বল তো? ছাদে অনেক অপমান করেছিলাম তোর কলিজার টুকরা বোনকে।।। আজ মনে হচ্ছে সেইম ঘটনা আর বাড়িতে ঘটেছে আর আমি নীরব সাক্ষী "
নিশাদের মুখে এমন কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো ইমতিয়াজের।। সাঁঝের কথা বলছে না তো নিশাদ।। ভয়টাকে সামলে প্রশ্ন করলো ইমতিয়াজ
"কেন রে ? কি হয়েছে ??এসব বলছিস কেন?"
প্রত্যুত্তরে একটু আগের সব ঘটনা খুলে বললো নিশাদ।।। সব শুনার সময় ইমতিয়াজের পায়ের নিচের মাটি মনে হয় কাঁপছিলো।। সাঁঝের উপর দিয়ে কি ঝড়টা যাচ্ছে সেটা ভেবে ওর মনে চাইলো নিজে ছুটে আসে ওকে একঝলক দেখতে।।। তবু আবেগ সামলে বাস্তবতাকে সামনে রেখে ইমতিয়াজ জিজ্ঞেস করলো
"ছেলেটা কে ? সাঁঝের কাছ থেকে সমস্ত ডিটেইলস জেনে নে।। খোঁজ খবর নে তার ব্যাপারে।। ঘরের মেয়ে বড় হলে বাবা মায়ের টেনশন বাড়ে।। সেই টেনশন তারা সবসময় প্রকাশ করতে পারেনা।।। কিন্তু তাদের দুশ্চিন্তা রাগ হয়ে মুখে ঝরে।। আঙ্কেলের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।। তুই ছেলেটার ডিটেলস জেনে আমাকে দে।। আমি খোঁজ নিবো প্রয়োজনে।। এটুক ভরসা রাখতে পারিস যার হাতে নিজের বোনকে তুলে দিয়েছি তার বোনের ক্ষতি আমি করবো না "
এতক্ষন ইমতিয়াজের কথা শুনে বুকের পাথর অনেকখানি নেমে গেলো নিশাদের।। মনে হলো পৃথিবীতে এই একটা জায়গায় সে আশ্রয় পায় পিঠে দেয়াল ঠেকলে।। অশ্রুভেজা চোখে উত্তর দিলো
"তোর ঋণ শোধ এমনিতেও করতে পারবোনা দোস্ত।। আবারো ঋণ বাড়িয়ে দিলি।। ঠিক আছে আমি সব ডিটেইলস দিচ্ছি। একটু দেখ তুই। আমাকে জানাস সব জেনে। "
"ভরসা রাখ আমার উপরে। "
বলে ওপর পাশে আরো এক জোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ বন্ধ করে কল কাটলো ইমতিয়াজ।। সৃষ্টিকর্তা আর কত পরীক্ষা নেবেন ওর?? চাপা তীক্ষ একটা আতর্নাদের ঝড় ওর হৃদয়টাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিলো আরো একবার।। মনে হলো এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে সাঁঝকে জড়িয়ে ধরে বলতে
"কিছু হবে না।। আমি আছি তো।। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট আমি পেয়েছি।। তুমি পাবে না সাঁঝ। "
কিন্তু সেই অধিকার নেই আর সুযোগও নেই।। প্রচন্ড কষ্টে ফেটে পড়ার আগে মুহূর্তে ফোনটা হাতে নিয়ে তমার নাম্বার ডায়াল করে বসলো ইমতিয়াজ
তমা কল রিসিভ করতেই বলে উঠলো
"তুই কোথায়?"
অবাক হয়ে ও প্রান্ত থেকে উত্তর আসলো
"কেন বাসায় ?? কি হয়েছে তোর ? এমন শুনাচ্ছে কেন গলা?"
" আমি আসছি।। অপেক্ষা কর"
বলেই চাবি হাতে নিয়ে ঝড়ের গতিতে গাড়ির দিকে ছুটলো ইমতিয়াজ । এত রাতে ওকে বের হতে বাসার কেউ দেখলো না।
তমার বাসার সামনে এসে বেল বাজাতেই এক হাতে পপকর্ন আরেক হাতে টিভির রিমোট নিয়ে এলোমেলো চুলে ঝুটি দেয়া হেয়ারব্যান্ড পড়া অবস্থায় দরজা খুললো তমা।। প্রচন্ড রকমের বিস্ময় নিয়ে ইমতিয়াজের রক্তলাল চোখ আর ক্লান্ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সেই সাথে মনটা অজান্তে কেঁপে উঠলো।। কিছু বুঝে উঠার আগেই তমাকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইমতিয়াজ।ভোঁতা শব্দ করে কেঁদে উঠে ও।বাচ্চাদের মতো কাঁদছিলো সে।
হাতের বাটি আর রিমোট দুইটাই পরে গেলো তমার।। ইমতিয়াজ বলে উঠলো
"আমি আর পারছি না রে।। আমি সত্যি আর পারছি না।। আমার সব শেষ "
ডায়লগটা শুনে তমার প্রায় অনেক বছর আগে কলেজের একটা ঘটনা মনে পরে গেলো
ইমতিয়াজ সেদিন ফাস্ট সেমিস্টারে দুটো সাবজেক্টে খারাপ নম্বর পাওয়ার দরুন বাবা আলতাফ খানের কাছে প্রচন্ড বকা শুনে।ওনি এমনটাও বলেছিলেন ওকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে।এমন ছেলে চান না ওনি। ষসেদিন প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে ঠিক এভাবেই ওকে জড়িয়ে ধরে গুমরে কেঁদে উঠেছিল। ঠিক সেদিনের মতো আজো
তমার মনটা প্রচন্ড কেঁপে উঠে ঠিক একই কম্পনে প্রকম্পিত হচ্ছে তমার মন যা ষোল বছর আগে ঘটেছিলো।ও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে সেদিনকার হৃদয়ের চিনচিনে ব্যাথাটা।। আজও।। একই ভাবে।। কিন্তু কেন?
..................................এদিকে বেলা মেয়েকে নিয়ে বাকি সময় টা ছাদে কাঁটিয়ে দিয়েছিলো।সেখানে এসেছিলো পূজার মা অপর্না বৌদিও।ওনি ভীষন ভালো মানুষ।ওরা নতুন এ ফ্ল্যাটে তাই পূর্নার ব্যাপারে জানেনা।পুজা আর পূর্না খেলছে।দুজনকে খুব খুশি দেখাচ্ছে।দুমা ওদের চোখ ভরে দেখছে।হঠাৎ অপর্না বলল,
''ভাবি আপনার পূর্না তো একাই তাইনা?"
বেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
''জি বৌদি।"
''আরো নিতে পারতেন।মানে ও একাইতো।পূজা কে আর কতোটা সময় পায় বলেন?"
বেলা ম্লান হেসে বলল,
''ওনি চেয়েছেন পূর্নাকে খুব যত্নে বড় করতে?ওর বড় হওয়ায় যেন কোন ঘাটতি না থাকে।"
''বুঝেছি কিন্তু আরেকটা বাবু হলে ভালো হতো।আমি ভাবছি আপনার দাদাকে বলবো।আমার পুজাও তো একা।"
বেলা কিছু না বলে একটু হাসলো।হঠাৎ পূর্না খেলা ছেড়ে এসে বেলার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে আদুরে গলায় বলল,
''মা বাতায় দাবো।বাত্তুম কব্বো।"
বেলা যেন একটু খুশিই হলো মেয়ের কথায়।অন্তত এসব টপিক এড়িয়ে যাওয়া যাবে।বেলা মেয়েকে কোলে নিতে নিতে বলল,
''চল মা।"
পূর্নাকে কোলে নিয়ে নিচে চলে এলো।এদিকে সেদিন রাতে বিভান প্রচন্ড রেগে ঘরে ফেরে।বেলা মেয়েকে খাওয়ানোর চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে উঠে যায়।ভেবেছিলো পূর্নার আরোএকটু খিদে পেলে খাওয়াবে।ভেবে বেলা উঠে যায়।বিভানকে দেখে বেলা কিছুটা অবাক হলো।লোকটাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?বিভান বেলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে চলে গেলো।রুম কিছুটা অগোছালো দেখে মেজাজ আরো বেশি খারাপ হতে থাকে।তবুও রাগকে নিয়ন্ত্রনে রেখে বাথরুমে চলে গেলো।বিভানকে দেখেই বেলা দৌড়ে খাবার গরম করতে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে রুম একইরকম দেখে বিভান রেগে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।বেলা টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছিলো।পূর্না দৌড়ে বাবার কাছে আসতেই বিভান মেয়েকে ধরে বলল,
''খেয়েছো মা?"
পূর্না মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
''না বাবা।"
বিভান প্রচন্ড রেগে বেলার দিকে তাকায়।চড়া গলায় বলতে লাগলো,
''এসব কি বেলা?একটা বাচ্চা সামলাতে না পারলে কিসের মা হয়েছো তুমি?এমনতো না যে ঘর পরিষ্কার করেছো।সারাদিন কি কাজ করো?খাওয়া ঘুম বাদে কিছু পারো না তাইনা?কোন কাজ হয়না?ও এখনো খায়নি কেন?বাচ্চা যদি এতোই ভালো লাগে একটা বাচ্চাকে ঠিকমতো দেখে রাখতে পারোনা?দাও ওর প্লেট দাও।আমার মেয়ে কে আমিই খাওয়াবো।ও রাখতে না পারলে বইলো।"
কথা গুলো বলে দ্রুত প্লেটে খাবার বেড়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যায় দ্রুত পদে।স্বামীর এমন আচরনে বেলা প্রচন্ড অবাক।এ কি বলল ওনি?ও নিজের বাচ্চার খেয়াল রাখতে পারেনা?সারাদিন শুয়ে বসে খায়?বিভান কি বললেন আপনি?বেলার হাত পা ভেঙ্গে আসতে চায়।চোখজোড়া ভরে আসে ওর।
দৌড়ে পাকঘরে চলে যায় বেলা।