মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ১৪)


স্পৃহার পরনে গাঢ় সবুজ রঙের লং গাউন। গাউনের বুকের পুরোটা অংশ জুড়ে সবুজ রঙের ছোট ছোট স্টোনের গর্জিয়াস কাজ। নিচের দিকের পুরোটা সফট নেটের মধ্যে প্লেইন। গাউনটা স্পৃহার সুন্দরভাবে ফিটিং হয়েছে। স্পৃহার ফর্সা গায়ে সবুজ রঙটা খুব সুন্দর মানিয়েছে। জীবন হা হয়ে চোখ বড় করে স্পৃহাকে দেখছে। জীবনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্পৃহার লজ্জা আরো বেড়ে গেল। স্পৃহা জীবনের সামনে এসে দাঁড়ালে জীবন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
'পছন্দ হয়েছে তোমার?'
স্পৃহা মাথা নাড়িয়ে বলল,
'হুম। '
'তাহলে চলো নিচে যাই।'
জীবন দরজার কাছে চলে গেলেও স্পৃহা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। স্পৃহা নড়ছে না দেখে জীবন বলল,
'কি হলো? পার্টিতে যাবে না?'
স্পৃহা জীবনকে বলতে পারছে না। তার গাউনের পেছনের চেইন খোলা। সে লাগাতে পারছে না। এভাবে কি নিচে যাওয়া যাবে নাকি। জীবন আবার স্পৃহার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
'কি হয়েছে বলো?'
স্পৃহা হাত দিয়ে পিঠের দিকে ইশারা করে বলল,
'চেইন লাগাতে পারছি না।' 
'ওহ। আচ্ছা দাঁড়াও আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।'
স্পৃহা হ্যা না কিছু বলার আগেই জীবন স্পৃহার পেছনে এসে চেইন লাগিয়ে দিলো। চেইন লাগানো শেষে তার চোখ পরলো স্পৃহার ফর্সা পিঠের দিকে। চুল খোপা করা,এই গাউনে পিঠের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। জীবন কিছু না ভেবে স্পৃহার চুল খুলে দিলো। সাথে সাথে একরাশ কালো চুল পিঠ ঢেকে দিয়ে কোমরের কাছে পরলো। জীবন বলল,
'এবার চলো।'
ওরা দু'জন এক সাথে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। সবার চোখ এখন ওদের উপরে। মারিয়া স্পৃহাকে দেখে অবাক হয়ে রইলো। বিরবির করে বলল,
'এই মেয়ে ড্রেস চেঞ্জ করলো কখন? আমি তো ওকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। ওহ তাহলে এই ব্যাপার। জীবন এর জন্যই পরে আসবে বলেছে। পার্টিতে বৌকে নিজের আনা ড্রেস পড়াবে।'
তোহা স্পৃহার দিকে তাকিয়ে থেকেই মারিয়ার কানের কাছে এসে বলল,
'মারিয়াপু আপুকে এই ড্রেস কি তুমি এনে দিয়েছ?'
'না।'
'তাহলে? '
'তোর আপুর বরই ওকে এই ড্রেস এনে দিয়েছে। আর নিজেই ওকে রেডি করিয়ে নিচে নিয়ে এসেছে।'
'সত্যি!'
তোহা একটু জোরেই বলল। মারিয়া তোহাকে চিমটি দিয়ে বলল,
'আমি মিথ্যা বলবো কেন?'
'ওয়াও! জীবন ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতে হবে। আপুকে এই গাউনে যা লাগছে না। পুরো হিরোইন হিরোইন।'
স্পৃহা নিচে নেমে মারিয়া আর তোহার কাছে চলে এলো। মারিয়া স্পৃহার ড্রেসের দিকে ইশারা করে বলল,
'বাহ্! তোদের মধ্যে তো প্রেম ভালোবাসা ভালোই চলছে। বৌয়ের জন্য এতো সুন্দর গিফট। আমার সোমটা তো এখন পর্যন্ত কিছুই দিলো না। আন-রোমান্টিক মানুষ একটা। শুধু নামেই প্রেম করে বিয়ে হয়েছে। জীবনই ভালো বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বিয়ে করে ফেলেছে। এখন কতকিছু করে বৌয়ের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করছে। '
পার্টিতে জীবন সবার সাথে স্পৃহার পরিচয় করিয়ে দিলো। স্পৃহা কখনো এতো মানুষের সামনে যায়নি। আজ এতো মানুষের সাথে কথা বলার সময় তার ভয় লাগছিল। সে সময় জীবন তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। স্পৃহা বুঝতে পারছে না জীবন তাকে ভালোবাসা কিনা। যদি ভালোবাসে তাহলে স্পৃহাকে বলছে না কেন? নিজের বৌয়ের কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করতে তো কোনো বাধা নেই।
আরশি দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। প্রথম থেকেই তার চোখ জীবন আর স্পৃহার উপর ছিল। আরশি রাগে ফুসছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। তার বাবা তাকে কিছু করতে নিষেধ করে দিয়েছে। পার্টির এক পর্যায়ে এসে সবাই ডান্স করছে। হালকা আলোতে স্পৃহা জীবনের কাঁধে হাত রেখে ওর সাথে ডান্স করছে। জয় পাশে থেকে দাঁড়িয়ে জীবন আর নিজের ভেবলি বোনটাকে দেখছে। মনে মনে বলছে, 
'আমি জানতাম জীবন তুই স্পৃহাকে খুশি রাখতে পারবি। আর স্পৃহাও ওর ভালোবাসা দিয়ে তোর অতীত বুলিয়ে দিতে পারবে। তোর কষ্ট গুলো দূর করে দিতে পারবে। আমি জানি তোরা দু'জন অনেক সুখী হবি।'
খাওয়া দাওয়া করে পার্টিতে আসা গেস্টরা এক এক করে চলে যাচ্ছে। তানিয়া পলাশ ওরাও মেহেরুনের বাসায় চলে যাবে বলছে। মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে থেকে যাওয়া উনাদের কাছে ঠিক লাগছে না। জীবন স্পৃহার বাবা মায়ের সাথে ওদিকে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, 
'আজ রাতটা এখানেই থেকে যান না বাবা।'
পলাশ বললেন, 
'তা কিকরে হয় বলো তো বাবা।'
'কেন হয় না। আপনারা এখন চলে গেলে স্পৃহা কষ্ট পাবে। ওর মন খারাপ হয়ে যাবে। তাই আজ রাতটা থাকুন। কাল সকালে নাহয় চলে যাবেন।'
স্পৃহা মারিয়া তোহা বাবা মা'র থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। মারিয়া বলল,
'জীবন দেখছি তোর খুব খেয়াল রাখে। খালামণি আঙ্কেলকে এখানে থাকার জন্য কত জোড়াজুড়ি করছে। ও জানে আমরা চলে গেলে তুই মন খারাপ করবি। ভাগ্য করে একটা বর পেয়েছিস। সবার বর কিন্তু তাদের বৌয়ের জন্য এতটা করে না। তুই সত্যিই লাকি।'
মারিয়ার কথা শুনে স্পৃহা জীবনের দিকে তাকালো। এমন সময় পেছন থেকে কারো সাথে ধাক্কা লেগে স্পৃহা পুলে পড়ে গেল। ওরা পুল সাইটে দাঁড়িয়ে ছিল। আরশি স্পৃহার থেকে প্রতিরোধ নেওয়ার জন্যে ইচ্ছা করে স্পৃহাকে পুলে ফেলে দেয়৷ স্পৃহাকে ফেলে দিয়ে আরশি বলতে লাগলো, 
'সরি আমি দেখে ওকে ধাক্কা দিই নি। আমার ড্রেসের সাথে হোচট খেয়ে ওর সাথে ধাক্কা লাগে। সরি।'
পানির শব্দ পেয়ে জীবন ছুটে এসে দেখে স্পৃহা পুলে পড়ে গেছে। জীবন কিছু না ভেবে নিজেও ঝাপ দিয়ে পুলে নেমে যায়। স্পৃহাকে
উপরে তুলে ওকে কোলে নিয়ে সবার সামনে থেকে রুমে চলে যায়। মুহূর্তের মধ্যে কি ঘটে গেল তা কেউ বুঝতে পারলো না। স্পৃহা সাঁতার জানে না। তাই পানিকে সে সব সময়ই ভয় পায়। স্পৃহা ভয় পেয়ে জীবনের কাঁধে খামচে ধরে রেখেছে। জীবন স্পৃহাকে ওয়াশরুমে এনে নামিয়ে দেয়। ভয় মাখানো স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
'চেঞ্জ করে নাও। আমি বাইরে আছি। ভয় পেও না। কিছু হবে না তোমার।'
স্পৃহা চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসেছে। সবাই স্পৃহাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তানিয়া পলাশ বুঝতে পারলেন জীবন যতক্ষণ স্পৃহার সাথে আছে ততক্ষণ আর স্পৃহার কোনো ভয় নেই। উনারা চোখ বন্ধ করে জীবনের উপর ভরসা করতে পারেন। সবার সামনে জীবন আরশিকে কিছু বললো না। তবে আজকের এই ঘটনার জন্য জীবন আরশিকে ছাড়বে না। অনেক বলার পরেও রাতে সবাই চলে গেল। জীবন নিজের গাড়ি করে ওদের সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। রুমে এসে দেখে স্পৃহা মন খারাপ করে বসে আছে। জীবন স্পৃহার পাশে বেডে বসে বলল,
'মন খারাপ লাগছে?'
স্পৃহা মুখ কালো করে মাথা নাড়ালো। জীবন আবার বলল,
'মন খারাপ করো না। জয় বলেছে ও কাল আবার আসবে। আন্টি আঙ্কেল ফিরে যাবার আগে তুমি একবার খালামণির বাসায় গিয়ে উনাদের সাথে দেখা করে এসো।'
'হুম। '
'রাত অনেক হয়েছে এবার শুয়ে পড়ো।'
'হুম। '
জীবন উঠে দাঁড়ালে স্পৃহা বলল,
'শুনুন। '
জীবন স্পৃহার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
'কিছু বলবে? '
'হুম।'
'বলো কি বলতে চাও।'
স্পৃহা মাথা নিচের দিকে করে বলল,
'ধন্যবাদ। '
জীবন একটু হেসে বলল,
'তোমাকে বাঁচানোর জন্য?'
'হুম। আর বাবা মা'কে এখানে নিয়ে আসার জন্য। আর ঐ ড্রেসটা দেয়ার জন্য।'
'সবকিছুর জন্য মাত্র একটা ধন্যবাদ দিচ্ছ?'
স্পৃহা ফ্যালফ্যাল চোখে জীবনের দিকে তাকালে জীবন বলল,
'এর আগেও কিন্তু তোমাকে ঐ ছেলে গুলোর থেকে বাঁচিয়েছি। তোমার জন্য পুরো একটা রাত জঙ্গলে কাটিয়েছি। তার জন্য কিন্তু তুমি ধন্যবাদ দাও নি। ঐদিক থেকে তোমার কাছে এখনো আমার আরেকটা ধন্যবাদ পাওয়া রয়ে গেল।'
স্পৃহা এখনো একদৃষ্টিতে জীবনের দিকে চেয়ে আছে। সে যেন জীবনের কথা বুঝতে পারছে না। জীবন হঠাৎ হঠাৎ স্পৃহার সাথে এমন ভাবে কথা বলে যেন আর পাঁচজন স্বামী স্ত্রীর মতো তাদের মধ্যেও সবকিছু ঠিকঠাক আছে। জীবন স্পৃহাকে এভাবে দেখে বলল,
'শুয়ে পড়ো।'
জীবন রুম থেকে বেরিয়ে গেল। স্পৃহা ওইভাবেই কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর শুয়ে পড়লো। 

সকালে জীবন অফিসে চলে গেল। আরশি স্পৃহাকে একা পেয়ে এই সুযোগে স্পৃহাকে অনেক কিছু শুনিয়ে দিলো। স্পৃহা তার নিজের রুমেই ছিল। আরশি এসে রুমে ঢুকেই বলতে লাগলো, 
'এই মেয়ে কি চাও তুমি? কোন উদেশ্যে এবাড়িতে এসেছ? জীবন তো তোমাকে ভালোবাসে না। তাহলে ও কেন তোমাকে বিয়ে করলো? কী দেখিয়ে ওকে বুলিয়েছ?'
আরশির কথার উত্তরে স্পৃহা কিছু বলতে পারছে না। 
'কি হলো কথা বলছো না কেন? আমার সামনে একদম মুখে তালা দিয়ে রাখবে না। আর তুমি কাঁদছো কেন? ওসব ন্যাকামি আমার সাথে দেখিয়ে লাভ নেই। আমি তোমাদের মত মেয়েদের খুব ভালো করেই চিনি। ছোট লোকদের একটাই তো স্বপ্ন থাকে। ধনী ঘরের ছেলেকে বুলিয়ে বালিয়ে রাজমহলের রাণী হবে। আমি তোমাকে শেষ বারের মত বলছি তুমি জীবনকে ছেড়ে দাও। ওর লাইফ থেকে দূরে সরে দাও। এটা জীবনের জন্যও ভালো আর তোমার জন্যও।'
স্পৃহা কাঁদতে কাঁদতে অনেক কষ্টে বলল,
'আরশি তুমি এসব কেন বলছো?'
'কেন বলছি তুমি জানো না? জীবনের সাথে বাবা আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জীবন কখনো রাজি হয়নি। ও তখন নূপুর নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। কিন্তু হঠাৎ ও কেন নূপুরকে রেখে তোমাকে বিয়ে করলো? যে মেয়ের জন্য কখনো আমাকে পাত্তা দেয়নি। সেই মেয়েকে ছেড়ে ও তোমাকে বিয়ে করলো। এসব কিছু তুমি করেছো। তুমি জানো জীবন কেন এমন করেছে। সবটা জেনেও তুমি ইনোসেন্ট সাজতে চাইছো।'

জীবন তার চেয়ারে বসে আছে। তার সামনের চেয়ারে বসে আছে অন্য একটা লোক। সেদিন এই লোকটার বায়োডাটাই সে দেখছিল। জীবন লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
'আমার ভুল না হলে আপনার নাম রায়হান রাইট?'
'জি স্যার।'
'আপনি দুই বছর ধরে আমার কোম্পানিতে কাজ করছেন।'
'জি স্যার।'
'আমি আপনার কাজ দেখেছি। আপনি খুব ভালো কাজ করেন। কোম্পানির প্রতি আপনার দায়িত্ববোধ দেখেই আপনাকে ডেকেছি। ভাবলাম সামনে বসে দু'চারটা কথা বলি আপনার সাথে।'
'আমি আমার কাজ সম্পূর্ণ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করি স্যার। কতটুকু পেরে উঠি তা বলতে পারবো না।'
এর মধ্যে চা এসে গেল। জীবন বলল,
'চা নিন। আমি আর একটা কারণে আপনাকে ডেকেছি। ভাবছিলাম আপনাকে এই অফিসের ম্যানেজার করে দিব। এখন আপনি এতো ভালো কাজ করছেন। ম্যানেজোর হলেও নিশ্চয়ই এভাবেই কাজ করবেন। আপনার মত লোক আমার কোম্পানির ভীষণ দরকার।'
জীবনের কথাগুলো যেন লোকটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। কোনো বস এতটা ভালো হতে পারে তা মনে হয় উনার ধারণা ছিল না।
'আপনি আমার উপর বিশ্বাস করেছেন স্যার আমি কখনো আপনার বিশ্বাস ভাঙবো না। বড় স্যার আমাকে এই চাকরিটা দিয়েছিলেন। আমি কোনদিন উনার বিশ্বাস ভাঙ্গি নি। আর ভবিষ্যতেও আপনার বিশ্বাস ভাঙবো না। কোম্পানিকে আমি আমার সাধ্য মত দেওয়ার চেষ্টা করবো।'
খুশিতে লোকটার চোখ ঝলমল করছে। জীবন মনে মনে হাসলো। 
'তাহলে সামনের মাস থেকে আপনি হবেন এই কোম্পানির নতুন ম্যানেজার।'
'ধন্যবাদ স্যার। আপনার বড় আব্বুর মত আপনিও অনেক বড় মনের মানুষ।'
লোকটা চলে গেল জীবন দু'হাত একসাথে মুঠো করে টেবিলের উপর রেখে একটু ঝুঁকে এসে বলল,
'বড় মনের মানুষ?'
জীবন হাসলো। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
'কে বড় মনের মানুষ আর কে ছোট মনের মানুষ তা সামনে দেখা যাবে। সময়ই সবকিছু বলে দিবে। তবে মিস্টার রায়হান শুধু বাহিরটা দেখে কারো সম্পর্কে ভালো খারাপ ধারণা করা ঠিক না। আপনি মানুষ চিনতে ভুল করেছেন। '

আরশির বলা কথাগুলো স্পৃহাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। আরশি তাকে এসব কেন বললো? স্পৃহা রুমে দরজা দিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। জীবন নূপুরের জন্য আরশিকে বিয়ে করে নি। তাহলে নূপুরকে বিয়ে না করে স্পৃহাকে কেন বিয়ে করলো? জীবন দুপুরে অফিস থেকে ফিরে এসে। বাসায় পা রেখেই স্পৃহাকে ডাকলো। জীবন ভেবেছে স্পৃহা হয়তো বড় আম্মুর সাথে রান্নাঘরে আছে। খালা এসে বললেন, 
'স্পৃহা তো আজ নিচে নামে নাই।'
'নিচে নামে নি?'
'না। সকালে খাইতেও আসে নাই। আমি ডাকতে গিয়া দেখি ঘরে দরজা দিয়া রাখছে।'
জীবন চিন্তিত হয়ে বলল,
'আচ্ছা আমি দেখছি।'
জীবন তাড়াহুড়ো করে পা চালিয়ে রুমের দিকে যেতে লাগলো। দরজায় ধাক্কা দিয়ে স্পৃহাকে ডাকছে। 
'স্পৃহা! তুমি ভেতরে? স্পৃহা দরজা খুলো।'
জীবনের ডাক শুনে স্পৃহা চোখ মুছে দরজা খুলে দিলো। জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে তার চোখ মুখ লাল দেখেই বুঝতে পারলো স্পৃহা কান্না করছিল।
'কি হয়েছে স্পৃহা? তুমি কাঁদছিলে কেন?'
ভাঙা গলায় স্পৃহা বলল,
'কিছু হয় নি।'
'মিথ্যা বলছো কেন আমার সাথে? সকালে খাও নি কেন? কিছু না হলে রুমে বসে কাঁদছিলে কেন?'
জীবন ধমকে কথাগুলো বলছে। স্পৃহা ভয় পেয়ে চুপ করে আছে। রাতের কথা মনে করে জীবন বলল,
'নিশ্চয়ই আরশি তোমাকে কিছু বলেছে। রাতেও ও এমন একটা কাজ করেছে। তার জন্য ওকে এখনো কিছু বলিনি। এখন আবার আমার অনুপস্থিতিতে ও তোমার সাথে কিছু একটা করেছে।'
জীবন রাগে কাঁপতে কাঁপতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরশিকে ডাকতে ডাকতে ওর রুমের দিকে এগোতে লাগলো। 
'আরশি কোথায় তুই? আরশি!'
জীবন আরশির রুমে গিয়ে ওকে পেল। আরশিকে এক টানে বেড থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে বলল,
'তোর প্রবলেম কি? স্পৃহার সাথে তোর কিসের শত্রুতা? তুই স্পৃহাকে কি বলেছিস?'
'স্পৃহাকে আমি কিছু বলিনি।'
'তুই আমার মুখের উপর মিথ্যা বলছিস? ভালোই ভালোই বল তুই স্পৃহাকে কি বলেছিস? তুই আমার ভালো রূপটা দেখেছিস আরশি। খারাপ রূপটা দেখাতে আমাকে বাধ্য করিস না। আজকের পর থেকে আমি যেন তোকে স্পৃহার আশেপাশেও না দেখি। আমাদের থেকে দূরে থাকাটাই তোর জন্য ভালো হবে। মনে রাখিস আমার কথাগুলো।'
এতক্ষণে স্পৃহা আরশির রুমে চলে এসেছিল। জীবন যাবার সময় স্পৃহার হাত ধরে বেরিয়ে গেল৷ নিজের রুমে না গিয়ে নিচে চলে আসলো। ফরিদা জীবনের গলা পেয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
'কি হয়েছে জীবন? '
'আমরা চলে যাচ্ছি বড় আম্মু।'
'কোথায় চলে যাচ্ছিস?'
'আমার ফ্ল্যাটে।'
'হঠাৎ এভাবে চলে যাচ্ছিস কেন? তুই তো বলেছিলি কিছু দিন এখানে থাকবি।'
'বলেছিলাম। কিন্তু এখন থাকবো না। তুমি আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি এখন কথা বলার মুডে নেই।'
জীবন স্পৃহাকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। ফরিদা কিছুই বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ কি হলো জীবনের? কেন এতো রাগ করে চলে গেল? পুরো রাস্তা জীবন সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছিল। আর স্পৃহা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ওরে দেখছিল। গাড়ি পার্ক করে জীবন স্পৃহাকে নিয়ে লিফটে উঠে ছয় তলায় নিজের এপার্টমেন্টে চলে গেল। ভেতরে ঢুকে জীবন আগে আগে বেডরুমের দিকে যাচ্ছে। স্পৃহাও তার পেছন পেছন গেল। রুমে এসে স্যুট খুলে রেখে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
'এখন থেকে আমরা এখানেই থাকবো। ধরে নাও এটাই তোমার নিজের বাড়ি।'
স্পৃহা কিছু বলল না। সে খুটিয়ে খুটিয়ে সবকিছু দেখছে। জীবন বলল,
'আমি একটু বের হবো। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে ফিরে আসবো। ততক্ষণ তুমি একা থাকতে পারবে তো? '
'হুম। '
'আচ্ছা আমি তাহলে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়ে যাব।'
স্পৃহা মাথা নাড়ালো। জীবন চলে গেলে স্পৃহা পুরো ঘরটা ভালো করে দেখলো। এখানে একটা ছেলে একা থাকে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। স্পৃহা বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে বাকি রুম আর কিচেনটাও দেখে নিলো। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার জীবন কখন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা স্পৃহাও বুঝতে পারছে না। ভালোই তো ছিল সে। হঠাৎ করে কেন তার সাথে একের পর এক এসব ঘটনা ঘটে গেল। জীবন ফিরে এসেছে। তার হাতে খাবারের ব্যাগ। খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে স্পৃহার পেছনে এসে দাঁড়ালো জীবন।বলল,
'স্পৃহা! '
স্পৃহা জীবনের দিকে ফিরে তাকালো। 
'খাবে চলো। খালা বলেছিল তুমি সকালেও কিছু খাও নি।'
স্পৃহা জীবনের সামনে বসে আছে। জীবন জানতো স্পৃহা খায় নি। আর তাই সে স্পৃহার জন্য খাবার আনতে গিয়েছিল। খেতে খেতে স্পৃহা জীবনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, 
'কেন আপনি আমার এতো খেয়াল রাখছেন? আমাকে ভালোবাসেন না তাহলে আমার প্রতি আপনার কিসের দায়িত্ব? কেন বারবার আমার বিপদে আপনি আমাকে বাঁচানোর জন্য চলে আসেন? সবই কি আমার প্রতি আপনার করুণা। আমাকে আপনি দয়া দেখাচ্ছেন?'
জীবন মাথা নামিয়ে খেতে খেতেই বলল,
'দুপুরে আমরা জয়দের বাসায় যাব। আন্টি আঙ্কেল বিকেলে চলে যাবে।'
'হুম।'
জীবন স্পৃহাকে নিয়ে জয়দের বাসায় গিয়েছে। সেখানে স্পৃহার বাবা মা'কে বিদায় জানিয়ে ওরাও চলে এসেছে। ফেরার সময় জীবন স্পৃহাকে গিয়ে শপিংমলে চলে যায়। সেখান থেকে স্পৃহার জন্য শপিং করে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে রাতে বাসায় ফিরে আসে। ডিনার শেষে স্পৃহা বেডরুমে চলে আসে। জীবন একটু পরে রুমে আসে। স্পৃহা বিছানা গোছাচ্ছিল জীবন ইতস্তত করে বলল,
'তুমি এই রুমে থাকো। আমি পাশের রুমে আছি। ভয় পেলে আমাকে ডাকবে।'
জীবন আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল। স্পৃহা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন তাকে বিয়ে করেছে। ওরা হাজবেন্ড ওয়াইফ। তাহলে কেন জীবন আলাদা রুমে থাকবে বলছে। পৃথিবীতে কোনো হাজবেন্ড ওয়াইফ কি আলাদা রুমে থাকে? স্পৃহা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে এসব কার সাথে শেয়ার করবে? এভাবে দু'টা মানুষ এক সাথে কতদিন থাকতে পারবে? আধোও কি জীবন আর স্পৃহার সংসার টিকে থাকবে?
দেখতে দেখতে কয়েক দিন কেটে গেল। স্পৃহা সারাদিন বাসায়ই থাকে। ঘরের টুকটাক কাজ করে। আর মাঝে মাঝে রান্না করে। জীবন বেশি সময়ই বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে। অফিসে যাবার জন্য জীবন রেডি হচ্ছে। স্পৃহা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। টাই বাঁধতে বাঁধতে আয়নার দিকে তাকিয়ে জীবন বলল,
'স্পৃহা তুমি ভার্সিটিতে যাও না?'
'ঐ দিনের পর থেকে আর যাওয়া হয়নি।'
'যাবে না আর? স্টাডি কন্টিনিউ করবে না?'
'আপনি যেতে বলছেন? '
'হুম। পড়াশোনা অফ করার তো কোনো মানে দেখছি না। তুমি এমনিতেও সারাদিন বাসায় একা থেকে বোর হও। তার থেকে ভালো ভার্সিটিতে যাওয়া আসা করো। এতে তোমার সময়ও কেটে যাবে।'
'আচ্ছা।'
'এখান থেকে ভার্সিটি তেমন দূরে না। যাবার সময় আমি নিয়ে যাব। আর আসার সময় নাহয় জয়কে নিয়ে আসতে বলবো।'
'ভাইয়াকে বলতে হবে না। আমি একাই আসতে পারবো।'
'উঁহু একা আসার দরকার নেই। ঐ ছেলে গুলোর মধ্য থেকে পুলিশ মাত্র দু'জনকে ধরতে পেরেছে। বাকিরা এখনো বাইরে আছে। সবাইকে পুলিশের আন্ডারে না নেয়া পর্যন্ত আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারবো না।'
পরের দিন থেকে স্পৃহা ভার্সিটিতে যেতে শুরু করেছে। সকালে জীবনের সাথে ভার্সিটিতে চলে যায়। ফিরে এসে ঘরের কাজ রান্নাবান্না করে। এভাবেই ওদের দিন কাটছে। 
ছুটির দিন বিকেলে জীবন স্পৃহাকে বলল,
'আজ বাসায় রান্না করতে হবে না।'
'রান্না না করলে আমরা খাবো কি?'
এই কয়দিনে স্পৃহা এখন জীবনের সাথে বেশ ভালো ভাবেই কথা বলে। প্রথম প্রথম খুব দরকারি কোনো কথা ছাড়া স্পৃহা তেমন কথাই বলতো না। জীবন কিছু জিজ্ঞেস করলে যত কম কথায় সম্ভব উত্তর দিতো। কিন্তু এখন ওরা বেশ খোলামেলা ভাবেই কথা বলে।
'ভাবছিলাম আজ তোমায় নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার সেরে আসবো।'
'ওহ।'
'রাতে তুমি রেডি হয়ে থেকো। আমি এসে দু'জন বের হবো।'
'আপনি কি এখন কোথাও যাচ্ছেন? '
'হুম। জয়ের সাথে একটু দেখা করবো।'
'আচ্ছা।'
জীবন রাতে ফিরে এসে দেখে স্পৃহা এখনো রেডি হয়নি। 
'কি হলো স্পৃহা তুমি এখনো রেডি হও নি কেন? '
কথাটা বলে জীবন ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এলো। স্পৃহা বলল,
'কি পরবো তা-ই তো বুঝতে পারছিলাম না।'
জীবন দাঁড়িয়ে স্পৃহার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
'কি পরবে তা ঠিক করতে পারছো না? আরে বাবা যেটা ইচ্ছা সেটাই পড়ে নিতে। তাহলে এখন আর লেট হতো না।'
জীবন আলমারি থেকে এক এক করে স্পৃহার ড্রেস বের করে দেখে বেডে রাখছে। ওদের বিয়ের প্রায় এক মাস হয়ে যাচ্ছে। এতদিনে স্পৃহা জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। জীবন তাকে না ভালোবাসলেও তার অনেক খেয়াল রাখে। এটাই বা কম কিসে? স্পৃহার বিশ্বাস জীবন একদিন ঠিকই নূপুর নামের ঐ মেয়েটাকে ভুলে গিয়ে ওকে ভালোবাসতে শুরু করবে। 
'এই নাও এটা পরো।'
জীবন সাদা একটা লং গোল জামা হাতে নিয়ে স্পৃহার দিকে এগিয়ে দিয়ে কথাটা বলল। স্পৃহা কপাল কুঁচকে বলল,
'এটা?'
'হ্যা। এটাতে তোমাকে খুব মানাবে। এবার যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।'
স্পৃহা জামাটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। জীবন বিরবির করে বলল,
'আমার শ্বশুর শাশুড়ি আদর দিতে দিতে মেয়েটাকে যা তৈরি করেছে! নিজে নিজে এ কিছুই পারে না।'

জীবনের গাড়ি রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াল। জীবন বলল,
'তুমি ভেতরে যেতে থাকো। আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।'
স্পৃহা নেমে দাঁড়িয়ে রইলো একা একা ভেতরে গেল না। জীবনের সাথেই রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকেই জীবন মুচকি হাসলো। স্পৃহা তার সাথে হাঁটছিল সে স্পৃহার হাত ধরে নিলো। একটু সামনে যেতেই রায়হান জীবনকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। বলল,
'স্যার আপনি এখানে? '
'হুম। আপনার ম্যাডামকে নিয়ে এসেছিলাম একটু।'
'ওহ।' রায়হান ছেলেটা স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলল,
'হ্যালো ম্যাম। আজ প্রথম আপনাকে দেখলাম। আমি স্যারের অফিসে কাজ করি। আমার নাম রায়হান।'
স্পৃহা ছেলেটাকে সালাম দিলো। রায়হান জীবনকে বলল,
'স্যার যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে ম্যামকে নিয়ে আমাদের সাথেই বসুন না।'
'আরে না না। আপনাদের ডিস্টার্ব হবে। আমরা বরং অন্য কোথাও বসি।'
'না স্যার। আমাদের ডিস্টার্ব হবে না। আপনি এখানেই বসুন প্লিজ।'
রায়হানের এতো অনুরোধের পর জীবন স্পৃহাকে নিয়ে এই টেবিলেই বসলো। একটা চেয়ার টেনে স্পৃহাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে অন্য একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
'রায়হান সাহেব বসুন। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? '
স্পৃহা বসে ওর সামনে থাকা মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে এখানে কি করছে? তাও এই ছেলেটার সাথে। একে তো স্পৃহা ঐ দিন জীবনের সাথে ওর বাইকে দেখেছিল। এই মেয়েটার সাথে জীবনের কী সম্পর্ক? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন