দুপুরের সুর্যের তীব্র রোদে চারিদিক জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে।সাঁঝ রিক্সা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করে।পাশ থেকে দোকানদার আর ক্রেতার দের বিতর্ক ফুচকাওয়ালাদের চিৎকার।সামনে দাঁড়িয়ে সাইমন।চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।সাঁঝ মৃদু হেসে সাইমনের দিকে এগিয়ে আসতেই কিছুটা চড়া কন্ঠে ও বলল,
''কতক্ষন দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আমি খেয়াল আছে?"
সাঁঝ মৃদু হেসে সাইমনের হাত ছুঁয়ে বলল,
''সরি।জানেন তো কতো ট্রাফিকজ্যাম থাকে।"
''হুম।কই যাবে এখন?"
সাঁঝ কিছুটা ভেবে বলল,
''পাশে একটা কফিশপ আছে।চলুন ওখানে যাই।"
সাইমন কিছু একটা ভেবে বলল,
''ওকে।"
সাইমন আর সাঁঝ সামনাসামনি বসে আছে।সাইমন কফির অর্ডার করে বলল,
''তা কি জানি বলতে?"
সাঁঝ মৃদু হেসে বলল,
''আপনি খুশি হবেন কিনা বুঝতে পারছিনা কিন্তু আমি অনেক খুশি।অনেকদিনের ইচ্ছা সফল হয়েছে।"
সাইমন একটু অবাক হয়ে বলল,
''কারন কি?"
সাঁঝ হেসে বলল,
''চাকরী হয়েছে আমার এয়াসিস্ট্যান্ট এ্যাকাউন্ট্যান্টের।"
সাইমনের উৎসাহ যেন নিমিষে ম্লান হয়ে এলো।কিছুটা সরে এসে ভ্রু কুঁচকে অন্যদিকে তাকায়।সাঁঝ কিছুটা আতঙ্ক অনূভব করে।মিনমিন করে জানতে চাইলো,
''আপনি খুশি নন?"
সাইমন ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
''সাঁঝ আমার খুশি অখুশি দিয়ে কিছু যায় আসেনা।কথা হলো তোমার নিরাপত্তা।সেখানে অনেক কলিগ থাকবে।অনেক ছেলে কলিগ থাকবে।তোমার বস ও ছেলে হতে পারে।আমি তোমাকে হারাতে পারবোনা।"
সাইমনের কথার অর্থ বুঝে বেশ রাগ আর পাশাপাশি খারাপ লাগে সাঁঝের। লোকটা কেন এমন করে?মাঝে মাঝে ওকে বিশ্বাস করতে পারেনা।সাঁঝ রাগী দৃষ্টিতে সাইমনের দিকে তাকায়।সাইমন ওর দিকে চেয়ে আছে।তার চোখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ।সাঁঝ চড়াও গলায় বলল,
''সাইমন ভালবাসা বিশ্বাসের ওপর বিরাজমান জানেন তো?বিশ্বাস না থাকলে কোন সম্পর্ক টিকে থাকতে পারেনা।আর আপনার মাঝে সেটার অভাব।কেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননা আপনি?কেন মনে হয় অন্য কারোর হয়ে যাবো আমি?কখনো ওয়েটিং এ দেখেছেন আমাকে?ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেখেছেন?তাহলে কেন এমন করেন?দেখুন এমন হতে থাকলে আপনি আমি কেউ সুখী হবোনা।চললাম।"
সাইমন এতক্ষন নিস্তব্ধ হয়ে থাকলে ও সাঁঝের চলে যাওয়ার কথায় হুঁশ ফিরে ওর।ব্যাপারটা হলো সাঁঝকে সন্দেহ করেনা।ভীষন ভালবাসে সাঁঝকে।হারিয়ে ফেলার ভয়ে সাঁঝকে নিজের কাছে রাখতে চায় পাশে রাখতে চায়।তবে সাঁঝ কষ্ট পাক সেটা চায়না।সাঁঝ বেরিয়ে গেলো কফিশপ থেকে।সাইমন উঠে দৌড়ে বেরিয়ে আসে।আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করে সাঁঝকে।মেয়েটা ভীষন রাগ করেছে।নাহলে এমন করেনা কখনো।সাইমন সাঁঝের নম্বরে কল দিয়ে হাঁটতে থাকে।হঠাৎ কিছু দূর এগিয়ে দেখলো সাঁঝ পিলারের পিছে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে।সাইমন কিছুটা মন খারাপ করে ওর দিকে এগিয়ে আসতেই সাঁঝ রেগে বলল,
''প্লিজ আগাবেননা।আমাকে একা ছাড়ুন।"
সাইমন সাঁঝের হাত চেঁপে ধরে বলল,
''দেখো রাস্তায় আমরা।গাড়িতে আসো।"
সাঁঝ চিৎকার করে বলল,
''যাবোনা আমি।আপনি চলে যান।"
সাইমন কিছুটা বাধ্য হয়ে সাঁঝকে কোলে তুলে নিতেই সাঁঝ চিৎকার করে বলল,
''ফালতামি করছেন?সিনেমা পেয়েছেন? নামিয়ে দিন।"
সাইমন মৃদু হেসে সাঁঝকে নিয়ে গাড়িতে বসে।গাড়ি স্টার্ট না দিয়ে সাঁঝকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
''দেখো সাঁঝ তুমি আমাকে চিনো।আমি কেমন জানো।আমার আপন ভাই আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।আমার আপন বলতে তুমি আর দাদি ছাড়া আর কেউ নেই।আমি তোমাকে ভালবাসি সাঁঝ।তোমাকে হারানোর ভয়টা সবসময় পাই তাই এমন করি।"
সাঁঝ কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
''আমাকে বিশ্বাস করা উচিৎ আপনার।আমি ও তো আপনাকে ভালবাসি।আপনাকে ও হারানোর ভয় থাকে আমার।জানি আমাদের জীবন টা এক নয়।কিন্তু অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করেছি।বড় ভাইয়া অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করিয়েছে।জব করে ভাইয়াদের সাহায্য করতে চাই আমি।আর কিছুনা।"
সাঁঝকে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয় সাইমন।ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
''সরি সাঁঝ।প্লিজ রাগ করোনা।আর এমন হবেনা।বাট তোমাকে সন্দেহ করি ভেবে মন ছোট করোনা।শুধু ভেবো ভীষন ভালবাসি।"
সাঁঝ মৃদু হেসে সাইমনের পিঠ জড়িয়ে ধরে চুপচাপ।
............................আজ সকালটা বেশ নতুন লাগছে ইদ্রির।কারনটা জানে তবুও মনের কোন একজায়গায় তীব্রক্ষোভ জমে। যখন তার সেই কথা গুলো মনে পড়ে ভীষন বিষিয়ে উঠে মনটা।নিজের ওপর ঘেন্না লাগতে থাকে।আর কাল কোন কথা বার্তা ছাড়াই নিশাদ ওকে এভাবে চুমু খাবে ভাবতেই পারেনি ইদ্রি।তার স্পর্শ গুলো শরীর মনে অদ্ভুত প্রশান্তি দিলে ও মনের মাঝে সেই কথা গুলো ভেসে উঠে বারবার।কাল সেই যে ঘরে ঢুকেছিলো।বের হয়নি ইদ্রি।সেভাবেই ঘুমিয়ে যায়।আর এখন বেলা এগারোটা।মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে।শাওয়ার নিলে ভালো লাগতো।ইদ্রি ফোন হাতে নিয়ে নোটিফিকেশন স্ক্রোল করতে করতে খেয়াল করলো ফোনের একদম উপরে মেসেজ এর নোটিফিকেশন এসে আছে।মেসেজ এ গিয়ে প্রচন্ড অবাক ইদ্রি।মেসেজটি এমন ছিলো,
পাগলাটে প্রেমিকের মতো তোমার কলেজের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা চকোলেট ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কিংবা বয়স কোনোটাই আমার নেই কিন্তু তবু আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে পাগলাটে হতে বেহায়া হতে।"
ইদ্রি ফিক করে হেসে পরক্ষনে মুখটাকে গম্ভীর করে নেয়।মেসেজটি সে পাঠিয়েছে।মনের মাঝে কেমন অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে যা ওর হৃদয়কে নাড়িয়ে দিচ্ছে একদম।সাঁঝ মেসেজটাকে আনসিন করে ফোন রেখে গোসলে চলে গেলো।গোসল সেড়ে বেরিয়ে আসে ইদ্রি।রুম থেকে বেরুতেই সৈয়দা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
''পেয়েছিস কি?"
ইদ্রি কিছুটা চমকে উঠে।মা রেগে কেন?কিছু জেনে গেলো নাকি?ইদ্রি বলল,
''কি মা?"
সৈয়দা বেগম এক ধাপ এগিয়ে রেগে বললেন,
''রাতে ঘরে ফিরে রুমে গেলি।এতোবার খেতে ডাকলাম।দরজা খুললি ও না জবাব ও দিলিনা।"
ইদ্রি কিছুটা কেঁপে উঠে মায়ের চিৎকার।ক্ষীন স্বরে বলল,
''মা খিদা ছিলোনা।ভাইয়ার সাথে বাহিরে খেয়েছিলাম।"
এবার যেন শান্ত হন সৈয়দা বেগম।বললেন,
''নাস্তা করতে বস।তোর ভাই এখন ও উঠেনি মনে হয়।"
ইদ্রি মৃদু স্বরে বলল,
''আমি ডেকে আনি?"
সৈয়দা বেগম বললেন,
''না,তুই খা। আমি ডেকে আনি।"
ইদ্রি চেয়ারে বসে খেতে থাকে।কিছুক্ষনের মাঝে ইমতয়াজ নেমে একটা পাউরুটি ডিম দিয়ে খেয়ে রুমে যেতে যেতে বলল,
''রুমে আসবি।কথা আছে।"
ভাইয়ের কথায় ইদ্রির ভয় হতে থাকে।খাওয়া সেড়ে উঠে ভাইয়ের রুমে আসে ইদ্রি।ইমতিয়াজ ওর সিঙ্গেল সোফায় বসে গ্রীনটি পান করছিলো।ইদ্রিকে দেখে বলল,
''ভালোই লুকিয়েছিস তোর প্রেমের কথা।তোর থেকে কখনোই এমন টা আশা করিনি।বড় ভাই না বন্ধু হয়ো ছিলাম।যাই হোক সেদিন তুই ছাদ থেকে ফেরার পর তোর গুনধর প্রেমিক আমার বেস্টফ্রেন্ড নিশাদ চিৎকার করে কাঁদছিলো।কেন জানিস?তুই তার জন্য জন্য বার্বিডল।সে এই বার্বিডলের অযোগ্য মনে করেছে নিজেকে।আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে ওর স্ট্যাটাস মিলেনা তাই।এখন একটা কথা বল আমাকে।সেটা হলো নিশাদের ঘর কখনো দেখেছিস কিনা জানিনা।তবে বলছি বেশি বড় না।এসি নেই।ফ্যান আছে।টেলিভিশন এতো বড় না।এখন তোকে নিশাদ যদি সেখান সে অবস্থায় রাখে। থাকতে পারবি?
ইদ্রি ভাইয়ের কথায় বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।ও নিশাদের বাসা দেখেছিলো।তবে ওর ভালো লেগেছিলো। সবচেয়ে বেশি সাঁঝ আপু আর আন্টিকে।বোনকে চুপ দেখে ইমতিয়াজ আবার জিজ্ঞেস করলো,
''কি হলো? বল।"
ইদ্রি মাথা নিচু করে ধীর কন্ঠে বলল,
''পারবো ভাইয়া। "
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে কাপ রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরতেই ইদ্রি গলা ভারি হয়ে আসে।কোনভাবেই নিজেকে থামাতে পারেনি।কেঁদে উঠে ইদ্রি।বলতে লাগলো,
''ভাইয়া সরি।আর কখনো লুকাবোনা।তোকে খুব ভালবাসি ভাইয়া।".
ইমতিয়াজ বোনের মাথায় হাত রেখে বলল,
''হুম।যা কলেজে যা।"
ইদ্রি সরে এসে চোখ মুছে নিয়ে বলল,
''জি যাচ্ছি।"
বলেই বেরিয়ে আসে ইদ্রি।বুকটা হালকা লাগছে। শান্তি লাগছে বড্ড।
..................................বিকেল থেকে পূর্না কেমন মলিন মুখ করে বসে আছে।পূজার সাথে খেলে আসার পর থেকে দরজার এক কোনায় বসে মন খারাপ করে আছে।বেলা ব্যাপারটা খেয়াল করে।কিছু বললে ও পূর্না চুপ ছিলো।বেলা কতোবার আদর করে কোলে নিতে চেয়েছিলো পূর্না কথাই বলেনি।বেলা অনেক্ষন অপেক্ষা করে মেয়েকে জোর পূর্বক কোলে নিয়ে খাটে বসিয়ে মেয়ের পাশে বসে বেলা।তারপর পূর্নাকে বুকে টেনে গালে চুমু দিয়ে বলল,
''কি হলো মা?এতো চুপ কেন?কেউ কিছু বলছে?"
পূর্না ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।দুহাত দিয়ে চোখ ডলতে থাকে।বেলা ভয় পেয়ে যায়।মেয়ে হঠাৎ এভাবে কাঁদতে শুরু করলো কেন? মেয়ের বেলা চোখ মুছে বলল,
''কি হয়েছে পূর্না?বলনা মা।ভয় লাগছে।"
পূর্না ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
''পুদার তিতার বলেতে তবাই গুততে দেতে।ওলা গুততে দাবে পরতু।আমলা কোতাও দাইনা।বাবা নেয়না কোতাও।আমি দাবো বাহিলে।"
বেলা মেয়েকে জড়িয়ে বলল,
''বাবা আসলে ঘুরে আসবো।"
পূর্না জেদী গলায় বলল,
''আতবোনা।"
বেলা অবাক কন্ঠে বলল,
''মানে?"
''কোতাও দাবো অনেকদিন তাকবো।তবাই মদা কব্বো।"
বেলা হেসে মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''আচ্ছা বাবা আসুক।বলবো আমরা কোথাও গিয়ে অনেক দিন থেকে আসি।আমাদের মামনি ঘুরতে যাবে তাইনা?"
পূর্না জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়।বেলা হেসে উঠে।রাতে ঘরে ফিরে আসে বিভান।বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো।বেলা ঠান্ডা শরবত নিয়ে স্বামীর পাশে এসে বসে।বেলা বলল,
''কি হলো?এতো ঘেমে আছেন যে?"
বিভান শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,
''আর বলোনা পাসপোর্ট অফিসে ছিলাম।এত টাইম নেয় এরা।"
বিস্ময়ের সুরে বেলা বলল,
''কার পাসপোর্ট? পূর্নার?"
বিভান ডকডক করে জুস গিলে ফেললো।তারপর বেলার হাতে গ্লাস ধরিয়ে বলল,
''হ্যা।তাছাড়া আমাদের পাসপোর্ট ও রিনিউ করতে হবে।"
বেলা ম্লান হেসে বলল,
''কোথাও যাবেন?"
বিভান হালকা শ্বাস ছেড়ে বলল,
''না তবে যদি কোথাও যাওয়া পড়ে তখন?তাই ভাবলাম করিয়ে নেই পূর্নারটাও।সাথে আমাদের টাও রিনিউ হোক।"
বিভান হঠাৎ বলল,
''পূর্না কই?"
বেলা হেসে বলল,
''খেয়ে ঘুম দিলো।পূজার সাথে খেলে এসে কান্না করছে।ও নাকি কই যাবে।পুজারাও নাকি ঘুরতে যাবে।এখন আপনার মেয়ে ও উঠে পড়ে লেগেছে ও যাবে কোথাও।"
বিভান বেলার কথায় মৃদু হেসে বলল,
''ঠিকই তো। ও আসার পর কোথাও যাইনি ওকে নিয়ে ঘুরতে।কোথাও যাওয়া উচিৎ।"
বেলা মাথা ঝাঁকায়।বিভান বলল,
''গোয়া চলো।"
''পূর্না যেখানে যাবে ওকে নিয়ে যেও।"
''সমুদ্র দেখবে ওর ভালো লাগবে।তারপরও সকালে কথা বলবো ওর সাথে।"
বেলা হেসে বিভানের হাত স্পর্শ করে।
!!!!
শিশির বিন্দুর মতোই ঝড়ছিলো বেলার চুলের পানি।ওর গলা বুকের ওপরের একটু অংশ আর পিঠের কোমড়ের কিছুটা অংশে পানি পড়ে ভিজে গেছে।বেলার পিঠের ওপর পড়ে থাকা লম্বা চুলগুলো জ্বলজ্বলে ঝড়নার মতো লাগছে।ওর কোমড়ের ভাজ শাড়ীর ওপর দৃশ্যমান।এমন দৃশ্যে প্রতিনিয়ত মোহিত হয় বিভান।আশেপাশের দিন দুনিয়ার কোন কিছুই ওর চিত্তে অবস্থান করেনা তখন।এমন দৃশ্য থেকে চোখফেরানো দায় হয়ে পড়েছে তের বছর পর ও। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেয়ালে হ্যালান দিয়ে দাঁড়ায় বেলা।ঠোঁটে মৃদু হাসি চেঁপে স্বামীকে দেখছে।বিভানের বুকের অস্থিরতার বেগ দ্বিগুন থেকে দ্বিগুন তালে প্রবাহিত হচ্ছে।বিভানের ঠোঁটজোড়া দুদিকে প্রসারিত হয়ে মিষ্টি হাসিতে রুপ নেয়।বেলা লজ্জা পেয়ে বলল,
''ওভাবে কি দেখেন?"
বিভান উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরনের গেঞ্জি ঠিক করে বলল,
''সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের প্রিয়তমা সহধর্মিণীকে।"
জবাবে হেসে বেলা বলল,
''তের বছর পর আজও ওভাবে দেখেন।কি আছে আমার মাঝে এতো?"
বিভান এসে বেলার কোমড় চেঁপে নিজের নিকটে এনে বলল,
''পাশের রুমটা খালি।মেয়ে ঘুমোয়।ওখানে দেখিয়ে দিবো কি আছে অতো?"
বিভানের ঠোঁটে নেশাবদ্ধ হাসি।বেলা বিভানের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
''এখন না।পূর্না উঠে খুঁজবে।"
বিভান বেলার দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
''আজ পর্যন্ত রাতে একবারো জাগেনি মেয়ে।এখনো জাগবেনা।তুমি চলো এখন।"
''ওর ভয় লাগবে।"
বিভান কিছু না বলে বেলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে জোরপূর্বক পাশের শোবার ঘরে নিয়ে এলো।বেলাকে রুমে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো ভিতর থেকে।বেলা চিন্তিত হয়ে বলল,
''দরজা কেন লাগাচ্ছেন?"
বিভান বিস্মিত দৃষ্টিতে বেলার দিকে চেয়ে বলল,
''দরজা লাগাবোনা?"
''ন না মানে?"
''বেলা পাগল তুমি।কিছু হবেনা।"
বিভান দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরে বেলার দুকাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে আনে।বেলার বুক তীব্র গতিতে কাঁপছে।বিভান বেলার কপালে চোখে তারপর দুগালে চুমু দিয়ে ওর ঠোঁটে এসে থামে।দুহাত চলে যায় বেলা পিঠে ব্লাউজের ফিতায়।বেলা দুহাতে বিভানের পিঠে চেঁপে ধরে জোরে খামচি বসিয়ে দেয়।বিভান কিছুটা যন্ত্রনা পেলে ও বেলাকে নিজের বুকে জাপটে ধরে খাটে শুইয়ে ওর গলায় মুখডুবায়।
বেলা কম্পিত গলায় বলল,
''পূর্না উঠেছে মনে হয়।"
বিভান ওর গলায় নাক ডুবিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
''বেলা প্লিজ এসময়টাতো আমাকে দাও।"
বিভান হঠাৎ উঠে নিজের গেঞ্জী খুলতে নিয়ে থেমে যায়।দরজার ওপাশে ছোট্ট হাতের নক পড়ছে।বেলা উঠে শাড়ী ঠিক করে ধীরে বলল,
''বলেছিলাম না এখন না।ও ভয় পাবে।"
বিভান নিচে নেমে নিজে নিজে বলল,
''কে জানতো ও এখন উঠবে?আগে তো এমন করেনি কখনো।"
বেলা রেগে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো।দরজা খুলে দেখলো পূর্না কেঁদে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে।হিঁচকি দিচ্ছিলো।বেলা দেখে ভয় পেয়ে গেলো।মেয়েকে কোলে নিয়ে চোখ মুছে বলল,
''সোনা মা কি হয়েছে?কাঁদছো কেন?"
বিভান ধুপ করে বসে খাটের ওপর।তবে মেয়ে কে কাঁদতে দেখে আর ওভাবে থাকতে পারেনা। উঠে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
''আম্মু কি হয়েছে?"
বেলা মেয়েকে নিয়ে খাটে এসে বসে।কাঁদছিলো পূর্না।বেলা বুকে নিয়ে বলল,
''কি হলো আম্মু?"
বিভান ওদের সামনে এসে বসে।পূর্না কান্নাজড়িয়ে আধবোলে বলতে লাগলো,
''তোমলা আমাতে এতা লুমে পেলে এতেতো।আমাল বয় লাগতে।তোমলা পতা।আদল কলোনা এত্তুও।"
বিভান মেয়েকে পিছন থেকে কোলে নিয়ে বলল,
''না আম্মু এমন বলেনা।আমরা কথা বলতে আসছিলাম।তোমার ঘুম ভেঙ্গে যেতো তাই ওখানে বলিনি,কাঁদেনা মা।"
বেলা আর বিভান মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়ে।বিভান পূর্নার ওপর দিয়ে বেলার কোমড় স্পর্শ করতেই বেলা মেয়ের থেকে চোখ সরিয়ে স্বামীর দিকে তাকায়।বিভানের হাতে হাত রেখে মৃদু হাসলো।বিভান ফিসফিস করে বলল,
''তুমি মাঝে আসো।"
পূর্না বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
''গুমাবো।কতা বলোনা।"
বিভান মেয়ের কথায় বোকা হয়ে চুপ করে রইলো।মেয়ের কথায় বেলা হেসে ওকে জড়িয়ে বুকে টেনে বলল,
''ঘুমা আম্মাজান।"
..................................তমার নম্বরটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে ইমতিয়াজ।সামনে কলিগ।ফোন ধরা সম্ভব না গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে।হঠাৎ ইমতিয়াজ বলল,
''এক্সকিউজ মি।একটা টেক্সট করতে হবে।"
লোকটা চুপ হয়ে গেলো।ইমতিয়াজ তমার নম্বরে মেসেজ করে দিলো।মেসেজ টি ছিলো।মিটিং এ আছি পরে কল দিচ্ছি।"
মিটিং শেষে ইমতিয়াজ চেয়ারে হ্যালান দিয়ে বসে তমার নম্বরে কল দেয়।কয়েকটা রিং হতেই অপরপাশ থেকে শুনতে পায় তমার কন্ঠে কিছু ইংরেজি কথা বার্তা।কথা শুনে মনে হলো বাহিরে কোন মিটিং চলছে।ইমতিয়াজ অবাক। মেয়েটা কল ধরলো কেন তাহলে?ইমতিয়াজ কথা শুনছিলো।কিছুক্ষন পর তমা বলল,
''বল।"
''মিটিং এ ছিলি?"
''জি।বল।"
''মিটিংয়ে থেকে কল রিসিভ করলি।আ'ম সরি ডিস্টার্ব করলাম।"
''আরে নাহ বল।"
''কল দিয়েছিলি।"
''কেন দিতে পারবোনা?"
''আরে নাহ সেটা না।বল কি খবর?"
''এই আছি।একা থাকি খারাপ না।বেশ ভালো আছি শালা।তা ভাবি কেমন আছে?"
ইমতিয়াজ চুপ হয়ে রইলো।ও নিজে তো ভালবাসকে পায়নি।ইমতিয়াজের নিস্তব্ধতায় অবাক তমা।বলল,
''ঠিক আছিস?"
''হা।বল!!"
''তুই বিয়ে করিসনি?"
ইমতিয়াজ ম্লান হেসে বলল,
''না দূর্ভাগ্যক্রমে।"
তমা শব্দ করে হেসে বলল,
''দূর্ভাগ্য কেন বলছিস?বল সৌভাগ্য।সিঙ্গেল লাইফটাই বেস্ট।"
''হুম।"
তমা খানিকটা ভ্রু কুঁচকে বলল,
''তুই ঠিক আছিস?"
''আরে হ্যা আছি।তুই বল না।"
''হুম। তা বাকি গুলোর কি খবর?"
ইমতিয়াজ হেসে বলল,
''আছে ওরা ভালো।ভূবনের বিয়ে হলো আমার কাজিনের সাথে।এইতো কিছুদিন আগে।তীর্থের মেয়ে আছে দুটো।আর ফারহান এংগেজড।কাব্য
নতুন বিয়ে করেছে।"
তমা একটু উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
''বোবা প্রানীটার কি খবর?"
ইমতিয়াজ ভ্রু কুঁচকালো,
''বোবা প্রানী!!!"
''তোর বেস্ট ফ্রেন্ড নিশাদ।"
ইমতিয়াজ হেসে ফেললো।বলতে লাগলো,
''ভালোই আছে।একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে আছে।"
''বিয়ে করেনি?"
''করেনি। ওর সামনে বিয়ের কথা বলা যায়না।"
''ওহ।কিন্তু কেন?
''ফেমেলির দায়িত্ব ওর ওপর।বড় ছেলে বুঝিস তো।তারওপর পাঁচভাইবোনের পড়াশুনার দায়িত্ব ওর ওপর। "
তমা কিছুটা চিন্তার স্বরে বলল,
''ওহ।তা এখনো কি বোবা প্রানী?"
''আরে নাহ।সবাই কি এক থাকে বল?এখন অনেক দায়িত্ববান ছেলে ভাই।"
তমা হঠাৎ বলল,
''একদিন আমার বাসায় চলে আয়।ফোনে এতো কথা বলা যায়না।সামনাসামনি বসে অনেক কথা বলবো।অনেক কথা আছে।"
''আমরা কোন রেস্টুরেন্টে দেখা করি?"
কিছুটা ইতস্তত বোধ করছিলো। তমা গম্ভীর গলায় বলল,
''তুই তোর ভার্জিনিটি নিয়ে ভয় পাচ্ছিস আই গেস।"
ইমতিয়াজ লজ্জায় জিভ কেঁটে বলল,
''ছি কি বলছিস!!!তেমন কিছুনা।কবে দেখা করবি বল?"
''পরশু চলে আয়।কাল একটা মিটিং আছে।তোকে এ্যাড্রেস টেক্সট করে দিবো।চলে আসবি।"
''শিওর।"
ইমতিয়াজ কল কেঁটে বসে রইলো।তমার কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলো।মেয়েটাও না একদম পাগলী টাইপ।
..........................'' মধ্যবিত্তের জন্য যোগ্যতা দিয়ে চাকরীর সন্ধান এবং সংগ্রাম করতে করতে হৃদয়ের অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছিলাম অনেক আগে।। সেই অস্তিত্ব এভাবে তুমি জানান দিলে যে আমার ক্লান্ত ব্যাস্ততা আর কাজ কোনকিছুই তোমাকে সেখান থেকে আলাদা করতে পারছেনা এখন।। কাজ করেও আমি কাজের মধ্যে নেই।। মনটা ছুটে যেতে চাচ্ছে তোমাকে এক ঝলক দেখতে।। আচ্ছা এবারও কি ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিবে যদি ছুটে আসি ?"
মেসেজ টা দেখে ইদ্রির চোখের কোনা ভরে।বুক কিছুসময়ের জন্য ভারি হয়ে আসে।কিছুক্ষন আগেই এসেছিলো মেসেজটা নিশাদের কাছ থেকে।শুধুভাবছিলো কতো স্ট্রাগল করেছিলো এতগুলো বছর। শুধু পরিবারকে ভালবেসে।তাহলে এই মানুষটা ওকেই না জানি কতো ভালবাসবে।ইদ্রি ফোনটা রেখে চোখের কোনা মুছে ক্লাশে মন দেয়।তবে ওর মন এখন নিশাদে পড়ে আছে।সেই রাতে নিশাদ যদি ওকে ভালবেসে কাছে টেনে নিতো তাহলে হয়ত এত দূরত্ব থাকতোনা।কিন্তু সে নিজের স্ট্যাটাস নিয়ে এতোটাই ভীত ছিলো যে ইদ্রির ভালবাসায় সাড়া ও দিতে পারেনি।কিন্তু সে ইদ্রিকে ভীষন অপমান করেছিলো নোংরা কথাবার্তা দিয়ে সেটা ইদ্রি চাইলে ও ভুলতে পারে না।ওর রক্তাক্ত হৃদয় এতসহজে নিশাদকে মাফ করতে পারবেনা।ইদ্রি ভীষন কষ্টে ক্লাশে মন দেয়।বুকটা বারবার অসহ্য যন্ত্রনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।কেন ভালবাসতে গেলো?কেন এতো অপমানিত হলো?কেন সে এভাবে উষ্ণ ছোঁয়ায় সেদিন ওকে মাতিয়ে তুলেছিলো?কেন বলতে পারেনি সামনাসামনি ভালবাসে?এর উত্তর খুঁজে পায়নি ইদ্রি এখনো।
........................এদিকে আজ দুদিন যাবৎ অফিস করছে সাঁঝ।বেশ ভালোই লাগছে।সবাই অনেক হেল্পফুল। বিশেষ করে ইন্দ্রানী ম্যাম।এতোটা কর্পোরেটিভ বস পাবে ভাবতেই পারেনি ও।মৃদু হেসে সাইমনের দিকে চোখ ফেরায় সাঁঝ।সে গাড়ি চালানোয় ব্যাস্ত।অফিস থেকে ফিরে আসার পথেই সাইমনের সাথে দেখা হয়ে গেলো।তারপর একসাথে বসে দুকাপ কফি আর এর বাসার পথে রওনা দেয়া।সাইমন চিন্তিত কন্ঠে বলল,
''ছেলে এমপ্লয়িরা কি বেশি কথা বলতে চাচ্ছিলো?মানে ওরা কি তোমার সাথে কথা বলেছিলো?দেখো রেগে যেওনা।তবে আমার ধারনা নেগেটিভ না।আজকালকার মানুষ অনেক খারাপ।একা মেয়ে পেয়ে সুযোগ সন্ধানী হয়ে উঠে।"
সাঁঝ হেসে ফেলল।বলল,
''তেমন কিছুনা।আমি ছেলেদের সাথে তেমন কথা বলিওনা আপনি ছাড়া।"
''হুম।"
বাসার সামনে আসতেই সাঁঝ তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।সাইমন ওকে হাত ধরে থামিয়ে সাঁঝের গালে চুমু দিয়ে বলল,
''ভালবাসি।"
সাঁঝ লাজরাঙা হয়ে বেরিয়ে দৌড়ে গেটের ভেতর ঢুকে যায়।সাইমন হাসছিলো।সাঁঝ দম নিতে থাকে জোরে জোরে।তারপর বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়।কলিংবেল চাঁপার কিছুক্ষন পর লাবনী দরজা খুলে।ওর মুখে আতঙ্কের ছোঁয়া।সাঁঝকে দেখে কম্পিত কন্ঠে বলল,
''কই ছিলি আপু?"
সাঁঝ বলল,
''অফিসে আর কই?অদ্ভুত প্রশ্ন করিস।"
লাবনী সরে যেতেই সাঁঝ ভিতরে প্রবেশ করে।
সাঁঝের চলন থামায় ইকরাম রাহমান চেঁচিয়ে বললেন,
''এসব নষ্টামি করতে অফিসে যাস?"