কৃষ্ণাবতী - পর্ব ১২ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


দুজনের খুনশুটির যেনো অন্ত নেই। তখন দেবব্রতের রুমের দরজা ঠেলে অন্না দেবের রুমে আসে। অন্নাকে এভাবে আসতে দেখে সৌদামিনী একটু হতচকিত হয়। অন্নাকে ভেতরে আসতে দেখে দেবব্রত কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
- কি রে টিচারের রুমে ঢুকতে কি পারমিশন লাগে না? 
- লাগে তো কিন্তু আমার জানা মতে তোমার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। আর এখন চারটা বাজে। সুতরাং এখন তোমার বাসায় যাবার সময়। তাই এখন তো তুমি আমার টিচার নও

অন্নার যুক্তি শুনে দেবব্রত হেসে দেয়। ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,
- তুই বাড়ি যাস নি কেনো? আর কৃষ্ণা কোথায়?
- এখানেই তো ছিলো

বলে পাশে তাকায় অন্না। কিন্তু কৃষ্ণা পাশে নেই৷ বরং দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে অন্নার সাথেই ঢুকতে চেয়েছিলো। কিন্তু সৌদামিনীকে বসা দেখে আর ভেতরে ঢুকে নি সে। দেবব্রত আর সৌদামিনীকে একসাথে দেখতে ভালো লাগে না কৃষ্ণার। শুধু মনে হয় সোমা মাসির কথাগুলো মনে পড়ে। তার মাষ্টারমশাই দিদিমনিকে পছন্দ করে। দিদিমনির সাথে তার বিয়েও ঠিক ছিলো। ব্যাপারগুলো মনে পড়তেই মনটা কালো আধারে ঢেকে যায় তার। দরজার বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে, অন্না তখন হাত টেনে ভেতরে নিয়ে আসে তাকে। ভেতরে ঢুকেও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো কৃষ্ণা। কৃষ্ণাকে দেখে অনেকটাই বিরক্ত হয় সৌদামিনী। ভালোই তো দেবব্রত এবং সে একাকিত্ব সময় কাটাচ্ছিলো। কিন্তু এর মাঝে কৃষ্ণা এসে পড়লো। অন্না একটি মেকী রাগের স্বরে বললো,
- এটা কিন্তু ঠিক নয় দাদাভাই, ভেবেছিলাম প্রাকটিক্যাল শেষে তোমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খাবো। দুপুরের তাড়ার জন্য খাওয়াটাও হয় নি আমার আর কৃষ্ণার। আর তুমি এখানে সুন্দর ইলিশ দিয়ে ভাত খাচ্ছো। 
- সেকি তোরা খাস নি?
- নাহ, সময় হয় নি। এখন কি তুমি যাবি নাকি তোমার খাওয়া শেষ?

দেবব্রত কিছু বলার আগেই সৌদামিনী বলে উঠে,
- তুমিও আমাদের সাথে বসে পরো না অন্না। 
- ইচ্ছে তো ছিলো সৌদামিনী দিদি কিন্তু দেখছোই তো কৃষ্ণাও আমার সাথে আছে। আর ওর নিরামিষ। ও মাছ খাবে না। 
- কলেজে কৃষ্ণাকে নিয়ে এলে যে আজ? 
- ও তোমাকে দাদাভাই হয়তো বলে নি, কৃষ্ণাকে এই কলেজেই ভর্তি করা হয়েছে। ও আমার সাথেই পড়াশোনা করছে। দাদাভাই এবার বল কি করবি? থাকবে নাকি আমাদের নিয়ে যাবে? 

অন্নার কথাটা শুনে সৌদামিনীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। কৃষ্ণার দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। কৃষ্ণা তখন ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কি অদ্ভুত না! কোনো কথা না বলেও, কোনো প্রতিবাদ না করেও মেয়েটি ধীরে ধীরে সব কিছু নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসছে। এই সময়টা তো তার আর দেবব্রতের একান্ত ছিলো। কিন্তু এখানেও তার ছায়া পড়েই গেলো। সারার কথা শুনে যে খেলায় সে মত্ত হয়েছে তাতে এখনই নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে সৌদামিনীর।
- তোকে না বলেছি ও তোর বৌদি হয়। নাম ধরে ডাকবি না। 

হঠাৎ দেবব্রতের হুংকার শুনে অবাক হয়ে সৌদামিনী তার দিকে তাকায়। অন্নাকে সে কৃষ্ণাকে বৌদি বলার জন্য বকছে, দেবব্রত তার স্ত্রীর সকল অধিকার কৃষ্ণাকে কি দিয়ে দিলো তবে! তখন জিহ্বা কেটে অন্না বলে,
- সরি, আসলে ক্লাসে তো আর ওকে বৌদি বলা যাচ্ছিলো না তাই ফ্লো ফ্লো তে বেরিয়ে গেছে। বলো না যাবে কিনা? বৌদি সকালে না খেয়ে বেরিয়েছে। 

কথাটা শোনামাত্র দেবব্রত কৃষ্ণার দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় আজ সকালে লুচি আর মাংস রান্না হয়েছে। তাই হয়তো খায় নি। তৎক্ষনাৎ প্লেটটা রেখে দিলো দেবব্রত। হাতটা ধুয়ে বললো,
- সরি রে দামিনী। আজ আর খেতে পারছি না। অন্য আরেকদিন না হয় খাবো। এর চেয়ে তুই ও বরং আমাদের সাথেই চল। ওখানেই খেয়ে নিবি। 
- না তোরা যা, আমাকে বাসায় নামিয়ে দিবি। 

বলেই সব গুছিয়ে নিলো সৌদামিনী। খানিকক্ষণ আগের উজ্জ্বল মুখটি নিমিষেই কালো হয়ে উঠলো। আবারো ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে তার হৃদয়। কান্না পাচ্ছে, গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার দেব সত্যি ই তার আর নেই। সে তার কাছে ক্রোশ দূর চলে গেছে। শুধু কৃষ্ণা ক্ষুধার কথা শুনতেই দেব প্লেটটা দেখে দিলো, একটাবার ভাবলো না সৌদামিনী ও তো না খাওয়া। সকাল সকাল উঠে তার জন্য রান্না করে এনেছে। শুধু তার পছন্দ বলে। পাত্তাই দিলো না দেব তার কষ্টের। তবে কি এখন দেবের ভাবনার বিচরণ কৃষ্ণাতেই হয়! দেবকে পাবার কোনো আশাই অবশিষ্ট রইলো না তার! কষ্ট গুলো গলায় আটকে আসছে সৌদামিনীর। এখানে দাঁড়ালে হয়তো অশ্রু বিসর্জন দিয়ে দিবে। তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নিলো সে। বিকেল হয়ে গেছে তাই দেব ই তাকে বাসায় পৌছে দিবে বলে তাকে আটকালো। নয়তো তখন ই বের হয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। যখন সিড়ি দিয়ে নামছিলো তারা, তখন দেব আর অন্না সামনে ছিলো আর কৃষ্ণা আর দামিনী পেছনে। দামিনীর মনে হতে লাগলো,
" আচ্ছা যদি এখান থেকে কাউকে ধাক্কা মারা হয় তবে কি সে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যাবে! কতটুকু পড়বে! ব্যাথা কি পাবে নাকি মরে যাবে! মরে গেলে তো পথের কাঁটাই সরে যাবে"

কৃষ্ণা এক সিড়ি এগিয়ে গেলেই দামিনীর ইচ্ছে হলো একটা ধাক্কা মারাই যাক। হাতটা এগিয়েও গিয়েছিলো। পরমূহুর্তে হাত গুটিয়ে নিলো সে। কতটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তার মন! একটা বাচ্চা মেয়েকে মেরে ফেলার মতো নোংরা পরিকল্পনা করতেও দুবার ভাবে নি সে। মনে মনে বলতে লাগলো,
" হায় ঈশ্বর, আমাকে পথ দেখাও। এই নোংরা চিন্তা যাতে আমার মনে না আসে কখনো "

কৃষ্ণাকে কাটিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এলো সৌদামিনী। নিজেকে হিন্ন মানসিকতার মানুষ মনে হচ্ছে। না পাওয়ার আক্ষেপ তাকে কতটা নিচ মন-মানসিকতার অধিকারী করে তুলেছে ভাবতেও খারাপ লাগছে তার। এটাই হয়তো বাস্তবতা, সৌদামিনীর মনে অন্ধকার এখনো প্রবেশ করে নি তাই হয়তো সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। অন্য কেউ হলে হতো নিজেকে নাও সামলাতো______

!!০৯!!

মুখে পেন্সিল ঠেকিয়ে বসে রয়েছে অর্জুন। তার সামনে একটি ফাকা ক্যানভাস। তাতে দুটো চোখ আঁকানো। এক মনে চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। পাশে রাখা ল্যাপটপে গাণ চলছে,

দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে--
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে ॥
      বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী--
         এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে ॥
         তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে,
         বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে।
      কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি
         আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে ॥

অর্জুনের ভাবনার গহীনে চোখজোড়া যেনো জেকে বসেছে। বিরবির করে বললো,
" কৃষ্ণাবতী সাহা - অর্জুন মিত্র, কৃষ্ণা-অর্জুন
নামের সাথে মিলেছে নাম
আত্নার মিলনের অপেক্ষা"

চোখ বন্ধ করলেই কৃষ্ণার টানাচোখ জোড়া চোখের সামনে ভাসছে তার। অর্জুনের বুঝতে বাকি রইলো না বেশ ঘোর অসুখে পড়েছে সে। তার অসুখকে খাটি বাংলায় বলা হয় "প্রেমের আঠা"। এর ঔষধ একটাই তা হলো "কৃষ্ণাবতী সাহা"। ভাবতেই ঠোঁটের কোনায় স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো তার।

কৃষ্ণার জিহ্বার হুট করেই কামড় পড়লো। লোকে বলে, 
"কেউ যদি কারোর নাম বেশি করে মনে করে তখনই জিবে কামড় পড়ে"____ কিন্তু কৃষ্ণার কথা কে মনে করছে! মামা? শিপ্রা? তা হবে না হয়তো কারণ আজই মামা ফোন করেছিলো দাঁদানের কাছে। মামি? সম্ভব ই না। তবে কি! ভেবেই বইয়ের থেকে মাথাটা তুলে দেবব্রতের দিকে তাকায় সে। দেবব্রত একনজরে পেপারে চোখ দিয়ে বসে আছে। চোখ না সরিয়েই গম্ভীর কন্ঠে বললো,
- আমার মুখে কি এলকোহল বানানোর প্রণালী লেখা আছে? 

সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো কৃষ্ণা। এই খচ্চর মাষ্টারমশাই কখনোই তাকে মনে করছে না। উফফ লোকটা এমন কেনো! মামাকে দেখতো মামীর জন্য কি সুন্দর বেলীফুলের মালা নিয়ে আসতে। কৃষ্ণার ধারণা বরেরা বুঝি বেলীফুলের মালা পড়িয়ে দেয় বউ দের৷ কিন্তু তার ক্ষেত্রে একেবারেই উলটো। তার বর তাকে রসায়ন পড়াচ্ছে। কৃষ্ণা মুখ ফুলিয়ে রসায়নের বিক্রিয়া কষতে লাগলো। তাও এই উছিলাতে দেবব্রতের রুমে তো প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। হঠাৎ কারোর চিৎকার শুনতে পায় তারা। দেবব্রত দৌড়ে গিয়ে দেখে......
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন