মেঘের খামে অনুভূতি (পর্ব ০৭)


মারিয়ার বিয়ের পর প্রায় ৬/৭ মাস কেটে গেল। স্পৃহা এর মধ্যে মাত্র দুইবার খালামণির বাসায় এসেছিল। তবুও বাবা মা'র সাথে দুদিন থেকে আবার চলে গেছে। গতবার স্পৃহা ভার্সিটিতে এডমিশন নিতে পারেনি। সে অসুস্থ ছিল। একটা অপারেশনও হয়েছে। তাই এই বছরটা তার বসে বসেই কেটেছে। বেশির ভাগ সময়ই খালামণির বাসায় থেকেছে। ধরাবাঁধা তেমন পড়াশোনা ছিল না। সুস্থ হবার পর বাবা মা'ও তেমন চাপ দিত না। কিন্তু এবার সে ভার্সিটিতে এডমিশন নিবে। জয় অনেক আগে থেকেই বলছে স্পৃহাকে ঢাকা এনে পড়াশোনা করাবে। এডমিন নেবার সময় হয়ে এসেছে। জয় গিয়ে স্পৃহাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
'ভাইয়া আমি পাবলিকে চান্স পাবো তো?'
'পাবি না কেন?'
'এই বছরটা তো ফাঁকির উপর কেটেছে। তেমন কিছুই তো পড়া হয়নি।'
'আরে হবে হবে। চিন্তা করিস না। তোর মত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট যদি চান্স না পায় তাহলে আর কে চান্স পাবে বল তো? একটা বছর গ্যাপ গেছে তো কি হয়েছে। নিজের উপর থেকে কনফিডেন্স হারাবি না। তুই তো আর ইচ্ছে করে গ্যাপ দিস নি। অসুস্থ ছিলি। এবছর থেকে মন দিয়ে আবার সবকিছু শুরু কর। আমাদের ভেবলি তো খুব বড় চাকরি করবে।'
স্পৃহা এখানের পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। খালামণির বাসায় থেকেই ভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে। প্রথম দিন তাকে জয় সাথে করে নিয়ে এসেছে। সিএনজি থেকে নামার পর সামনে তাকিয়েই স্পৃহা জীবনকে দেখতে পেল। সাত মাস পর জীবনের সাথে দেখা হলো। সেদিন জীবন চলে আসার পর স্পৃহা আর কখনো জীবনকে দেখে নি। জীবন বাইক থেকে নেমে জয়ের কাছে এসে বলল,
'কি ব্যাপার এখানে আসতে বললি কেন?'
'আরে স্পৃহাকে নিয়ে এসেছি। ভাবলাম একা এসে কি করবো। তাই তোকেও আসতে বলেছি।'
স্পৃহা জীবনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো। জীবন কি স্পৃহাকে চিনতে পারছে না? ওর সাথে কি হাই হ্যালোও বলবে না? 
স্পৃহার ভাবনা শেষ হবার আগেই জীবন বলল,
'কেমন আছো স্পৃহা?'
স্পৃহা এমনটা আশা করছিল না। তবুও সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
'আলহামদুলিল্লাহ।'
ব্যস তাদের কথা এই পর্যন্তই। জয় স্পৃহাকে রেখে জীবনের সাথে চলে গেল। যাবার আগে বলল,
'বাসায় ফেরার সময় আমাকে কল দিস। এসে নিয়ে যাব।'
'আচ্ছা।'

জীবনকে নিয়ে জয় একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। জীবন একটা কথা প্রায়ই জয়কে জিজ্ঞেস করতে চায়। কিন্তু জিজ্ঞেস করার জন্য সঠিক সময় আর সঠিক সুযোগ পাচ্ছিল না। আজ জীবন বনিতা না করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
'জয় সত্যি করে একটা কথা বলবি?'
'তোর সাথে আমি কোন দিন মিথ্যা বলেছি বল তো।'
'তুই কি স্পৃহাকে পছন্দ করিস?'
জয় কোক খাচ্ছিল। জীবনের কথাটা শুনে মুখ থেকে কোক ফেলে দিয়ে কাশতে লাগলো। বলল,
'কি বললি আবার বল তো।'
'তুই শুনেছিস আমি কি বলেছি। আবার বলতে পারব না।'
'গাধা তোর এমনটা কেন মনে হলো যে,আমি স্পৃহাকে পছন্দ করি?'
'স্পৃহার প্রতি তোর আচরণই সবটা বলে দিচ্ছে। তুই ওকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবিস।'
'ওকে নিয়ে ভাবি কারণ স্পৃহা নিজের খেয়াল রাখতে পারে না। আর না পারে নিজেকে রক্ষা করতে।'
'তাহলে তুই বলছিস ওর প্রতি তোর অন্য রকম কোনো ফিলিংস নেই?'
'না রে ভাই। স্পৃহাকে আমি বোনের চোখেই দেখি। ওকে কখনো প্রেমিকার চোখে দেখিনি। আর না ফিউচারে দেখব। স্পৃহার তো ভাই নেই। তাই ও আর তোহা আমাকে নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবাসে। আমাকে ভয় পায়। আমার সব কথা শুনে। তোহাটা চটপটে তাই ওকে নিয়ে কেউ তেমন চিন্তা করে না। কিন্তু স্পৃহা সবার থেকে আলাদা। ও নিজের মনের কথা কারো কাছে খুলে বলতে পারে না।'
জীবন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল,
'সরি দোস্ত আমি ব্যাপারটাকে অন্যরকম ভেবে নিয়েছিলাম।'
জীবন মনে মনে বলল,
'আমার চিন্তাভাবনা কত নিচ! সবাই তো আর একরকম হয় না। আমি আরশির সাথে সবাইকে মিলাচ্ছিলাম। ছি জীবন।'
জয় জীবনকে ইজি করার জন্য বলল,
'সমস্যা নাই। মজার কথা কি জানিস, আমার দুই ফুপুও এমনটা ভাবে। ওনারা তো ভেবেই নিয়েছেন আমি স্পৃহাকেই বিয়ে করবো। মা এই নিয়ে অনেক মন কষাকষি করেছে। কিন্তু আমি কাউকে কিছু বলি না। ওরা ওদের মত ভাবুক। যেদিন আমি বিয়ে করবো সেদিনই সবাই দেখতে পারবে।' 
জীবন চুপ করে আছে দেখে জয় বলল,
' ওসব কথা বাদ দে তো। তুই বল নূপুরের খবর কি?'
'জানি না রে। আমার মনে হয় নূপুরের বাসায় প্রবলেম চলছে। কিন্তু তুই তো জানিস। নূপুর যা মেয়ে কখনো সত্যিটা বলবে না।'
'আমি এটাই বুঝতে পারি না নূপুরের ভাইদের প্রবলেম কোথায়? তোরা দু'জন দু'জনকে ভালোবাসিস। তাহলে মাঝ থেকে ওরা কেন ভিলেন হচ্ছে? কেন মেনে নিচ্ছে না তোদের?'
'আমিও জানি না। নূপুর তো আমাকে ওর ভাইদের সাথে কথাও বলতে দেয় না।'
'বুঝি না বাবা। বোনে প্রেম করলে ভাই কেন ভিলেন হয়। আমরা তো কত সুন্দর করে মারিয়াপু আর সোম ভাইকে মেনে নিলাম।'
'সবাই কি আর এক হয়?'
'হুম। আচ্ছা চল আজ উঠা যাক।'

জীবন রাতে বাড়ি ফিরে এলো। এখানে আসতে তার ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে নিজের ফ্ল্যাটেই থেকে যায়। ব্যালকনিতে গিয়ে জীবন নূপুরকে কল করলো। দু'বার রিং হবার পর নূপুর ফোন তুললো।
'হ্যা বলো।'
নূপুরের গলাটা যেন কেমন শোনাচ্ছে। জীবন বলল,
'নূপুর তুমি কাঁদছিলেন? '
'না। কাঁদবো কেন? '
'দেখো নূপুর আমার সাথে মিথ্যা বলবা না। সত্যি করে বলো তুমি কেন কাঁদছিলে?'
'আরে বাবা বললাম তো। আমি কাঁদছি না। শুধু শুধু অকারণে আমি কেন কাঁদবো বলো তো?'
'তাহলে তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন?'
'ঠান্ডা লেগেছে। তাই হয়তো এমন লাগছে।'
'সত্যি বলছো?'
'হুম।'
'কি করছিলে এতক্ষণ?'
'তেমন কিছু না। শুয়ে ছিলাম।'
'শরীর খারাপ লাগছে? জ্বর এসেছি নাকি?'
'জ্বর আসেনি। শুধু একটু ঠান্ডা লেগেছে। তুমি ব্যস্ত হইও না তো।'
ফরিদা জীবনের রুমে এসে তাকে না পেয়ে ডাকলো, 
'জীবন! তুই কি ওয়াশরুমে?'
জীবন বড় আম্মুর আওয়াজ পেয়ে নূপুরকে বলল,
'বড় আম্মু এসেছে। এখন রাখি। একটু পরে আবার কল দিব।'
'এই শোনো। একটু পরে আর কল দিতে হবে না। আমি এখন শোব। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে দেখি। মাথাটা ব্যথা করছে।'
'তাহলে সকালে কথা হবে। রাখছি। লাভ ইউ।'
জীবন ফোন পকেটে রেখে রুমে এসে বলল,
'ডাকছিলে বড় আম্মু?'
'তোর সাথে একটু কথা ছিল বাবা। তুই কি এখন ঘুমাবি?'
'না। তুমি বলো কি বলবে।'
ফরিদা জীবনকে বিছানায় বসালেন। নিজেও জীবনের পাশে বসলেন। জীবনের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, 
'চুল বড় করছিস কেন? '
জীবন বড় আম্মুর হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
'কি বলবে সোজাসুজি বলো না। তুমি তো এ'কথা বলার জন্য আসোনি।'
'তুই আজকাল কোথায় থাকিস? বাসায় ঠিকমত আসিস না।'
'আমার ফ্ল্যাটে ছিলাম।'
'তোর নিজের বাড়ি থাকতে তুই কেন ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকিস? এটা তো তোরও বাড়ি। তুই তোর সবকিছু থেকে কেন অধিকার ছেড়ে দিচ্ছিস?'
'আমার এসব লাগবে না বড় আম্মু।'
'কেন লাগবে না? তোর বিষয়সম্পত্তি তুই কেন অন্যকে দিয়ে দিবি? আমি আর তোর মা যখন এবাড়িতে বৌ হয়ে আসি তখন সব তোর দাদাই দেখত। বিয়ের পর বাবা উনার দুই ছেলের মধ্যে সবকিছু ভাগাভাগি করে দেন। তোর বাবা তোদের ব্যবসা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। আর তোর বড় আব্বু একের পর এক ব্যবসায়ে লস খেতে থাকে। শেষে তো তার কাছে কিছুই ছিল না। তোর বাবা বড় ভাইকে নিজের বিজনেসে শেয়ার দেয়। তোর বড় আব্বু যখন একটু উঠে দাঁড়াল তখনই তোর বাবা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেল। ও একা যায়নি, আমার বোনকেও সাথে নিয়ে গেছে।'
জীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
'বড় আম্মু এখন ওসব কথা শুনতে চাচ্ছি না।'
'আচ্ছা আর বলবো না। কিন্তু তোকে আমার একটা কথা রাখতে হবে। তুই আমাকে কথা দে,তুই তোর সবকিছু বুঝে নিবি। তুই অফিসে যাবি।'
'কি দরকার? বড় আব্বু তো সব সামলাচ্ছেন।'
'এতদিন তুই পড়াশোনা শেষ করিস নি। বয়সও তেমন হয়নি তাই তোর বড় আব্বু সামলাচ্ছিল। কিন্তু এখন তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। মাস্টার্স কমপ্লিট করেছিস। এখন থেকে তোর বাবার বিজনেস তুই বুঝে নে বাবা। তোদের যা কিছু তা তুই দেখাশোনা কর।'
'বড় আম্মু তুমি বড্ড বেশি চিন্তা করছো। বিজনেস সামলানোর মত বয়স এখনো আমার হয়নি।'
'হয়েছে। আমি চাই তুই এখন থেকেই অফিসে যা। ঠিকমত কিছুদিন অফিস করলে তুই সব সামলে নিবি। তখন আমার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। আমি তোর জন্য লাল টুকটুকে একটা বৌ নিয়ে আসবো। আমি মরার আগে তোর সংসার,বৌ,বাচ্চা দেখে যেতে চাই।'
'মরার কথা কেন বলছো বলো তো? তুমিও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমি কীভাবে থাকবো?'
'আর বলব না। তাহলে তুই কিন্তু অফিসে যাবি।'
'পরে দেখা যাবে।'
'পরে দেখা যাবে না। তুই এক্ষুনি আমাকে কথা দে তুই এই সপ্তাহের ভেতরেই অফিস জয়েন করবি।'
'কি বাচ্চামু শুরু করলে তুমি!'
'জীবন আমার কথা তুই রাখবি না?'
'আচ্ছা যাও। যাব অফিসে। এখন খুশি?'
'হুম।'
'তাহলে খুশি খুশি গিয়ে এখন শুয়ে পড়ো তো। অনেক রাত হয়েছে। তুমি কেন এতো রাত জাগো? শরীর খারাপ করবে না?'
'তুইও তো এখনো জেগে আছিস।'
'বড় আম্মু!!'
'আচ্ছা যাচ্ছি বাবা। দেখো ছেলে কেমন মায়ের উপর চোখ পাকায়।'
জীবন হেসে ফেলে বলল,
'মা অবুঝ হলে ছেলেকে তো শাসন করতেই হয়।'
ফরিদা জীবনের রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন, 
'ফারজানা তোর ছেলেটা বড্ড অবুঝ রে। আর অনেকটা পাগলও। জীবন ঠিক তোর মতই সহজসরল। তুই যেমন সবাইকে বিশ্বাস করে নিতি। তোর ছেলেও তেমন হয়েছে। সবাইকে বিশ্বাস করে। তুই বেঁচে থাকলে জীবনকে নিয়ে গর্ববোধ করতি।'
বোনের কথা মনে করে ফরিদার মন খারাপ হয়ে গেল। ফরিদা আর ফারজানা আপন বোন ছিলেন। দুই বোনের দুই ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়। সম্পর্কে ফরিদা জীবনের খালামণি হয়। আবার জেঠিমাও হয়। জীবন যখন এইচএসসি দিয়েছে তখন তার বাবা মা দু'জনই কার এক্সিডেন্টে মারা যায়। ফরিদা সব সময়ই জীবনকে নিজের ছেলে মেয়ের মতই ভালোবাসতো। ফারজানা মারা গেলে ফরিদা জীবনকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয় নি। 

বড় আম্মুর কথামত পরের সপ্তাহ থেকেই জীবন অফিসে যাচ্ছে। বড় আব্বুর থেকে আস্তে আস্তে নিজের সবকিছু বুঝে নিচ্ছে। নতুন নতুন অফিসে জয়েন করেছে, সব কাজ বুঝে নিতে আর সবকিছু সামলে উঠতে জীবন এই কয়দিন ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যাতে করে নূপুরের সাথেও তেমন কথা হয়নি। তবুও জীবন কাজের ফাঁকে নূপুরকে কল করতে ভুলেনি। কিন্তু নূপুরই যেন ইচ্ছে করে জীবনের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছে। 
এদিকে স্পৃহার দিনকালও ভালোই কাটছে। নতুন নতুন মানুষ,নতুন বন্ধু, নতুন ক্লাস। সব পেয়ে সে জীবনের কথা ভুলেই গেছে। জয় এসে প্রতিদিন ক্লাসে দিয়ে যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে স্পৃহা একাই যাওয়া আসা করছে। জীবন অফিসে বসে আছে। আজও তার সামনে একগাদা ফাইল। জীবন এসবে মন লাগাতে পারছে না। সে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। একের পর এক নূপুরকে কল করেই যাচ্ছে। অনেক বার রিং হবার পর নূপুরের খোঁজ পাওয়া গেল। 
'হ্যা বলো কেন কল দিয়েছ?'
জীবন চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বলল,
'নূপুর কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছো?'
'হ্যা। আমি ঠিক আছি।'
'ফোন তুলছিলে না কেন? তোমার জন্য আমার টেনশন হচ্ছিল।'
'ফোন সাইলেন্ট করা ছিল। দেখতে পাইনি। আর সরি আমার জন্য তোমাকে টেনশন করতে হয়েছে।'
'নূপুর তুমি এমন ভাবে কথা বলছো কেন? বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে? ভাইয়ারা কিছু বলেছে?'
'কেউ কিছু বলেনি। আমি এখন রাখছি জীবন। একটু কাজ আছে।'
নূপুর সাথে সাথেই ফোন রেখে দিলো। জীবন অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কি হয়েছে এই মেয়ের? নূপুর ঠিক আছে তো? যে মেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জীবনের সাথে কথা বলেও ফোন রাখতে চায় নি। আজ সে দুমিনিটও ভালো করে ওর সাথে কথা বললো না। জীবন টাই ঢিলে করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। টেবিলে শব্দ করে ফোনটা রেখে পায়চারি করতে লাগলো। 

স্পৃহা দুদিন জ্বরে ভুগে আজ ক্লাসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছিল। মেহেরুন এসে বললেন, 
'কোথায় যাচ্ছিস তুই? '
'ক্লাসে যাব না?'
'কোনো ক্লাসে যাবার দরকার নাই। দু'দিন কি জ্বরেই না ভুগেছিস। তা কি ভুলে গেছিস? তুই আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। তানিয়া জানতে পারলে আমি তাকে কি জবাব দিতাম? পলাশ ভাববে আমি হয়তো ঠিক মত তার মেয়ের যত্ন নিই না। আর তাই জ্বরটা বেঁধেছে।'
'খালামণি এখন তো আমি ঠিক আছি।'
'কোথায় ঠিক আছিস? চোখ মুখ এখনো কত শুকনা লাগছে। তুই আরো কয়েকদিন রেস্ট দিয়ে তারপর বাড়ি থেকে বের হবি।'
'খালামণি!'
'কোনো খালামণি না। আগে শরীর স্বাস্থ্য তারপর লেখাপড়া। শরীর ঠিক না থাকলে লেখাপড়া করে লাভ কি? তোর খালুও এখন বাড়ি থেকে বের হতে না করেছে।'
খালামণি নাছোড়বান্দা। স্পৃহার সাধ্য নেই খালামণিকে বোঝানোর। তাই স্পৃহাই হার মেনে নিলো। আর বেশি জোড়াজুড়ি করলো না। আজকের দিনটাও তার ঘরে শুয়ে বসেই কাটাতে হবে। মেহেরুন চলে গেলে স্পৃহা বলল,
'সবাই যে আমাকে নিয়ে কেন এতো চিন্তা করে?'

ঐ দিনের পর আবার দু'দিন কেটে গেল জীবন নূপুরের সাথে কথা বলে না। নূপুরের ফোন অফ আসছে। এদিকে জীবন অস্থির হয়ে উঠেছে। না পারছে কোনো ভাবে নূপুরের সাথে যোগাযোগ করতে। আর না পারছে নূপুরদের বাসায় চলে যেতে। জীবন জানে না নূপুর এখন কোন পরিস্থিতিতে আছে। সে এখন তাদের বাসায় চলে গেলে নূপুরকে যদি আরো প্রবলেমে পরতে হয়। তাই জীবন চাইলেও নূপুরের বাসায় যেতে পারছে না। জীবন চায় না নূপুর তার জন্য সমস্যায় পরুক। হঠাৎ জীবনের ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। নূপুরের ম্যাসেজ ভেবে জীবন তাড়াহুড়ো করে ম্যাসেজ চেক করলো। হ্যা নূপুরই ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। জীবন ম্যাসেজটা পড়লো। ম্যাসেজে লিখা আছে। 
"জীবন আমরা সব সময় যে রেস্টুরেন্টে দেখা করতাম, তুমি আজ সেখানে দুই টার দিকে থাকতে পারবে? পারলে সময় করে এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। আর প্লিজ তুমি আমাকে কল দিও না। আমি ফোন অফ করে রেখেছিলাম। কি হয়েছে তা এখন তোমাকে কিছুই বলতে পারছি না। দেখা হলে সব বলবো।"
জীবন পরপর কয়েকবার লেখাগুলো পড়লো। সে বোঝার চেষ্টা করছে নূপুরের সাথে কি হয়েছে। জীবন একবার ভাবলো আজ আর অফিসে যাবে না। কিন্তু এতক্ষণ সময় বাসায় বসেই বা কীভাবে কাটাবে? তাই সে অফিসেই চলে যাবে। সেখান থেকে লাঞ্চ টাইমে নূপুরের সাথে দেখা করতে চলে যাবে। জীবন ঘড়ি পড়ে ওয়ালেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আরশির সামনে পড়ে গেল। আরশি জীবনকে দেখে বলল,
'বাহ! বেশ লাগছে তো তোমাকে। অফিস জয়েন করেছো নাকি?'
জীবন কিছু না বলে চলে আসছিল আরশি তার হাত ধরে বলল,
'কথা বলবে না? তুমি সব সময় আমাকে ইগনোর করো কেন বলো তো।'
'হাত ছাড় আরশি।'
'কেন? আমি কি তোমার হাত ধরতে পারবো না?'
'তুই তোর লিমিট ক্রস করিস না। সম্পর্কে আমি তোর ভাই হই, এটা মনে রাখিস।'
'আরে দূর কিসের ভাই। তুমি আমার খালা আর চাচার ছেলে। আমার নিজের ভাই আছে। তাই তোমাকে না ভাইয়ের চোখে দেখতে ঠিক ইচ্ছে করে না। বলতে পারো আমার ভালো লাগে না।'
জীবন কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল। যে মেয়ের লজ্জা নেই তার সাথে শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। জীবন হাত ছাড়িয়ে চলে আসছিল। আরশি বলল,
'এইযে হিরো। আমার বাবা কিন্তু তোমাকে মেয়ের জামাই বানাতে চায়। অবশ্য বাবার মত আমিও এটাই চাই। তাই বেশি ভাব নিও না। তুমি যতই নূপুর পায়েল এর পাল্লায় পড়ো,শেষমেশ তোমার বৌ তো আমিই হবো।'
জীবন পেছন ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
'তোর আর তোর বাবার এই স্বপ্ন কোনো দিনও সত্যি হবে না। আমার বৌ হবার স্বপ্ন তোর স্বপ্নই রয়ে যাবে। আর তোর বাবাকেও বলে দিস মেয়ের জন্য অন্য ছেলে খুঁজতে।'
জীবন হনহনিয়ে চলে গেল। আরশি জীবনের কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে হেসে বলল,
'তুমি না চাইলে কি হবে আমি তো চাই। আর বাবাও তা-ই চায়। আমার বাবা যা বলেন তাই করেন। আর বাবা বলেছে আমিই তোমার বৌ হবো।' 

স্পৃহা বের হবার সময় মেহেরুনকে ডেকে বলল,
'আসছি খালামণি।'
মেহেরুন কিচেন থেকে গলা উঁচিয়ে বললেন,
'স্পৃহা আজ মারিয়া আসবে। তুই কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে আসিস।'
'আচ্ছা। '
'এই শোন, তুই কি একা যাচ্ছিস?'
'না। জয় ভাইয়া ভার্সিটি পর্যন্ত নামিয়ে দিবে।'
'আচ্ছা তাহলে যা। আর সাবধানে যাস।'
'হুম।'
আজ মারিয়ার সাথে সাথে স্পৃহার বাবা মা'ও আসবে। কারণ আজ স্পৃহার জন্মদিন। তাই সবাই মিলে স্পৃহার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে। স্পৃহাকে আগে থেকে কেউ কিছু জানায়নি। কেউ উইশও করে নি। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে একেবারে রাতেই উইশ করবে। সবাই মিলে কেক কেটে আনন্দ করবে। বাসা সাজানোর জন্য আজ স্পৃহাকে ভার্সিটিতে যেতে দিয়েছে। সে বাড়িতে থাকলে সারপ্রাইজ প্ল্যান করা যেত না। আয়োজন দেখে স্পৃহা সব বুঝে ফেলতো। 

নূপুর রেস্টুরেন্টে এসে দেখে জীবন আগে থেকেই বসে আছে। নূপুর জীবনের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
'অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছো?'
'না একটু আগেই এসেছি।'
'কিছু অর্ডার করেছো?'
'না। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।'
'আচ্ছা তাহলে এখন কিছু অর্ডার করো। খুব খিদে পেয়েছে।'
জীবন খাবার অর্ডার করলো। নূপুর খাচ্ছে জীবন তার দিকে তাকিয়ে আছে। নূপুরকে দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো কিছুদিন ধরে বাড়িতে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে না। জীবনকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নূপুর খেতে খেতেই বলল,
'এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার খাবারের উপর চোখ দিচ্ছ? আমি জানি আমি এখন রাক্ষুসির মত করে খাচ্ছি তাই তুমি এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছো। কিন্তু বিশ্বাস করো। আমার সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে রাক্ষুসির মত একটা আস্ত গরু খেয়ে ফেলতে পারবো।'
জীবন বলল,
'তুমি খাও। আমি চোখ দিচ্ছি না।'
'আমি তো খাচ্ছিই। কিন্তু তুমিই তো কিছু খাচ্ছ না। খাবে না তুমি? '
'আমার খিদে নেই। তুমি খাও।'
'আচ্ছা।'
নূপুরের খাওয়া শেষ হলে জীবন বিল দিয়ে নূপুরকে নিয়ে উঠে গেল। রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে এসে নূপুর বলল,
'তুমি বাইক নিয়ে এসেছ?'
'না। অফিস থেকে গাড়ি করে এসেছি।'
'অফিসে জয়েন করেছো?'
'হুম। '
নূপুর মুখ কালো করে মনে মনে বলল,
'আমি তো কিছুই জানি না। তুমি অফিসে যেতে শুরু করেছ। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছ। গুছিয়ে নিচ্ছ নিজের জীবন।'
জীবনও মনে মনে বলল,
'তুমি তো কিছুই জানো না নূপুর। আমি তোমার জন্য অফিসে যেতে শুরু করেছি। বড় আম্মু বলেছিল, অফিসে জয়েন করার পর আমার জন্য বৌ খুঁজবে। আমি উনাকে তোমাদের বাসায় পাঠাবো। আর তাই তো আমি নিজের জীবন একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছি।'
'জীবন! '
'বলো।'
'চলো আজ তোমার গাড়ি করেই একটু ঘুরি। সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার সাথে থাকবো। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব।'
'বাসায় প্রবলেম হবে না?'
'নাহ।'
নূপুর নিজে নিজে বলল,
'আজ একেবারের জন্য সব প্রবলেম শেষ করার জন্যেই তো বের হয়েছি।'
জীবন নূপুরের শেষ কথা শুনতে না পেরে বলল,
'কিছু বলেছো?'
'না। কিছু বলিনি।'
ওরা গাড়িতে উঠেছে। জীবন গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। ওরা পাশাপাশি বসে আছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নূপুর অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। জীবন আড়চোখে নূপুরকে দেখছে। এই কয়দিন কি হয়েছিল জীবন তা নূপুরকে একবারো জিজ্ঞেস করেনি। নূপুরও নিজে থেকে কিছু বলে নি। তবে জীবন বুঝতে পারছে নূপুর ঠিক নেই। এই নূপুর আর আগের নূপুরের মধ্যে জীবন অনেক পার্থক্য লক্ষ করছে। যে মেয়েটা কথা বলা ছাড়া এক মিনিট চুপচাপ বসে থাকতে পারতো না। একনাগাড়ে হড়বড় করে এতো এতো কথা বলে ফেলত। আজ সে মেয়েটা জীবনের পাশে একদম চুপচাপ বসে আছে। নিজে থেকে একটা টু শব্দও করছে না। 

স্পৃহা অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আজ জয় তাকে নিতে আসেনি। রাস্তায় কোনো রিক্সা বা সিএনজিও নেই। এতদূর হেঁটে যাওয়া যাবে না। হঠাৎ একটা খালি সিএনজি এসে স্পৃহার সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার বলল,
'কই যাবেন আপা? উঠেন আমি নামাই দিয়া আসি। এহন তো মনে হয় না কোনো রিক্সা পাইবেন।'
স্পৃহা বলল,
'আমি যাব না। আপনি চলে যান।'
স্পৃহা এদিকেই যাবে। কিন্তু ড্রাইভার লোকটাকে তার কেনই যেন সুবিধার মনে হলো না। তাই স্পৃহা যেতে না করেছে। স্পৃহা না করলেও লোকটা যাচ্ছে না। স্পৃহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোত্থেকে দু'টা ছেলে এসে তার হাত চেপে ধরে জোর করে তাকে সিএনজিতে উঠাতে লাগলো। স্পৃহা কিছু না বুঝে চিৎকার দিতে নিলে, একটা ছেলে তার মুখ চেপে ধরলো। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন