উদাম শরীরে বসে আছে বিভান। হোটেলের ব্যালকনি দিয়ে রাস্তায় আসা যাওয়া মানুষ গাড়ি এমনকি রিক্সাগুলো দেখছে ও।ওর মন অবশ্য অন্যদিকে পড়ে আছে।একটাসময় মনে হতো পড়াশুনা জব ছাড়া জীবন চলে না।এগুলো থাকাই অর্থ জীবন।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জীবনে সব কিছুর পাশাপাশি ভালবাসাটাও দরকার আছে।যা বেলাকে দেখার পর বুঝতে পেরেছে।এখন যখন বুঝতে পারলো তখন নিশ্বাস ফেলবার জায়গা পাচ্ছেনা।নিশ্বাস আটকে আসছে।কেউ যেন গলা চেঁপে ধরেছে ওর।পুরো শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা অনূভব করছে।যন্ত্রনা হলো কষ্টের কাউকে না পাওয়ার কষ্টের যা অন্য সব যন্ত্রনা থেকে একেবারে আলাদা।বিভানের চোখজড়া জ্বলজ্বলে হয়ে আছে।ভীষন কষ্ট হচ্ছে।কেউ কারোর কষ্ট বুঝতে পারেনা।যার কারনে অবহেলা করে।বিভান চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।এখনো আশা আছে বেলাকে পাওয়ার? নাকি সব শেষ হয়ে গেছে। আর কতো নিজেকে বুঝিয়ে রাখবে ও?কতো বুঝাবে?কাল যে শ্যামবতীর বিয়ে।
বিভান রুমে ফিরে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফোনে বেলার নাচের ভিডিও টা দেখে নেয় একবার।সেটাকে ডিলিট করতে গিয়ে ও পারেনা।থাকুক না অন্তত এটাই যদি স্মৃতি হযে থাকতে পারে তাও ভালো।হঠাৎ সাঁঝের নম্বর থেকে মেসেজ আসে বিভানের নম্বরে।সেখানে লেখা ছিলো, শেষ বারের মতো দেখে যান"
বিভান কি বলবে বুঝতে পারছেনা।ওর খারাপ লাগছে।মেয়েটাকে আজ শেষবারের মতোইকি দেখবে?আরকি দেখা মেলবেনা?কিছুক্ষন খাটের ওপর বসে মেসেজ টির দিকে চেয়ে রইলো।কিছুক্ষন বাদে আবার ও মেসেজ এলো,
আপার ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়ান।ওখানে পেয়ে যাবেন।"
বিভান রিপ্লাই দিলো,
''রাজি হবেন ওনি?"
''সেটা আমার কাজ।আপনি আসুন।"
বিভান আর অপেক্ষা করলো না।শার্ট পরে বেরিয়ে পড়ে গাড়ি নিয়ে।এদিকে বেলাকে বের করে আনিয়েছে সাঁঝ।কিছু কাজ আছে শপিং এ।বেলাকে নিয়ে রিক্সা করে বেরিয়ে পড়ে সাঁঝ।বেলা খেয়াল করলো রিক্সা অন্যদিকে যাচ্ছে।কিছুটা অবাক হলো বেলা।সাঁঝকে প্রশ্ন করলো,
''কই যাচ্ছিস?"
''গেলেই দেখবি?"
''ওদিকে ভার্সিটি।সাঁঝ কি করতে চাইছিস?"
''আপা কথা বলিসনা।করতে দে আমাকে।"
বেলা চুপ থাকতে পারছেনা সাঁঝ কি করতে চাইছে আসলে?বেলা আবার ও বলল,
''বল কি করবি তুই?আমার কিছু ঠিক লাগছেনা।"
''আপা বিশ্বাস করিসনা আমাকে?"
''করি কিন্তু এ সময়ে কেন বের করেছিস?"
''বললাম তো গেলেই দেখবি।"
রিক্সা থেমে যায় বেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে।বেলা ও সাঁঝ দুজনেই নেমে পড়ে।ওরা দাঁড়িয়ে আছে।সাঁঝ কাকে যেন কল করেছে।তারপর কি বলে কল কেঁটে দিলো।বেলা বলল,
''কেউ কি আসবে?"
''হুম।"
বেলা অবাক।কে আসবে এখন?সাঁঝ কি বলছে কে আসবে?বেলা বলল,
''কাকে ডেকেছিস তুই?"
''একটু অপেক্ষা কর আপা।চলে আসবে।"
বেলার মাঝে অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে।কাকে ডাকলো এই মেয়ে কে জানে?বেলা কিছু বলতে যাবে তখনই একটা গাড়ি এসে থামলো ওদের থেকে একটু দূরে।বেলার চোখে আলো লাগে তীব্র।দুহাতে চেখ ঢেকে নেয় কিছুক্ষণের জন্য।তারপর আলো টা নিভে যায়।বেলা ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে দেখলো এক পুরুষ ছায়া ওদের সামনে আসছে হেঁটে হেঁটে।বেলার পুরো শরীর জমে গেলো যেন।রেগে সাঁঝ কে আড় চোখে দেখে নেয়।সাঁঝ একটু সরে দাঁড়ায়। ততক্ষনে বিভান বেলার কাছে আসতেই বেলা একটু সরে গিয়ে পাশে তাকিয়ে বলল,
''এগুলো কেমন অসভ্যতামি সাঁঝ?"
কথাটা বলে সাঁঝকে পায়না বেলা।তারপর ও বিভানের দিকে তাকাচ্ছেনা ও।লোকটার দিকে তাকাতে পারছেনা চোখে চোখ রাখতে পারছেনা।ভয় পাচ্ছে পরাজিত হওয়ার ভয়।বেলার হাত আলতো করে স্পর্শ করে বিভান তবে ধরেনি।বিভানের ঠোঁটে একটু হাসি।বেলার হাত ছুঁয়ে বলল,
''রুপচর্চা চলছে খুব?হাত তো বেশ কোমল।"
বেলা হাত সরিয়ে রেগে বলল,
''বাজে বকবেননা।কেন এসেছেন আবার?"
বিভান হাত সরিয়ে এবার একটু হেসে বেলার কাছে এগিয়ে এলো অনেকটা। দুহাত বেলার কাঁধে রেখে বলল,
''আমার শ্যামবতীকে দেখতে এসেছি।হয়ত আজই শেষ।"
বেলার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে।বিভান বলল,
''বেলা কেন বুঝতে চেষ্টা করছেননা আপনাকে ভালবাসি আমি।বুঝতে চাইছেন না কেন?ইদরীস আপনার জন্য ভালো নয়।খবর নিয়েছি আমি।বেলা বিশ্বাস করেন আপনাকে কখনোই কষ্ট পেতে দেবো না।শুধু আমার হয়ে যান।"
বিভান থেকে সরে এলো বেলা।রেগে বলল,
''কি যা তা বকছেন।আমার হবু স্বামীকে আমার সামনে খারাপ বলছেন।সাহস আছে আপনার।"
বিভান এগিয়ে এসে বেলার দুগাল ছুঁয়ে বলল,
''ভালবাসায় সাহস না থাকলে চলে?বলুন।"
বেলা সরে আসতে চাইলে বিভান ওর হাত ধরে ফেলে শক্ত করে।বেলা নিজেদের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
''এগুলো কি করছেনা বার বার?যা বলার দূরে থেকে বলুন।"
বেলার কথায় একটু হেসে সরে আসে বিভান।দূরে থেকে বলল,
''এখন সরিয়ে দিচ্ছেন অবহেলা করছেন।একটাবার পিছনে ঘুরে আসুন।ভাবুন আমাদের দেখা হওয়া থেকে পরের সময়গুলো।"
বেলা কেমন ভাবনায় পড়ে গেলো বিভানের কথায়।বিভান আবার বলল,
''চলুন ততক্ষনে একটু হেঁটে আসি।আশা করি মানা করবেননা।মৃত্যু দন্ডের আগে আসামীর ও কিন্তু শেষ ইচ্ছে পূরন হয়।সে হিসেবে আমার টা ও ঠিক তাই।"
________________________________________
বেলা বিভানের চোখের দিকে চেয়ে আছে।মানা করতে মন সায় দেয়নি ওর।বিভান সাঁঝকে বলল,
''সাঁঝ আমার গাড়িতে বসে থাকো।আমরা আসার আগে বের হবে না।"
সাঁঝ দূর থেকে হাত নেড়ে সম্মতি জানায়।বেলা বেরিয়ে পড়ে বিভানের সাথে।দুজনের মাঝে বেশ দূরত্ব।বিভান বলল,
''অন্তত একটু কাছে এসে হাঁটতে পারেন।এখন কিন্তু আমার ইচ্ছে মতো সব হবে।"
বেলা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই বিভান বলল,
''দেখুন তেমন কোন আবদার করবো না যা আপনাকে রাগিয়ে দেবে।শুধু কাছে এসে হাঁটেন।"
বেলা ওর কাছে এসে দাঁড়ায়নি তবে চুপ ছিলো।বিভসন নিজেই এসে দাঁড়ায় বেলার পাশে।ভার্সিটির আশেপাশে অনেক জায়গা ফুলের বাগান চায়ের দোকান অনেক কিছু আছে।বিভান হাঁটার মাঝেই বেলাকে দেখে।অাঁধারে সুন্দর লাগছে একদম স্নিগ্ধ লাগছে।বেলা বুঝতে পারছে বিভান ওকে দেখছে।তবে কিছু বলেনি ও।বিভান বলল,
''একটু গল্প করতে পারি তাইনা?"
নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় বেলা তারপর বলল,
''জি পারি।"
বিভান হেসে বলল,
''রাতের চাঁদ কেমন লাগে আপনার?"
''ভালো।আপনার?"
''ভালো তবে আমার চাঁদটা বেশি পছন্দের।"
বেলা বুঝতে পারছে বিভান ওকেই বলল কথাটা।তাই চুপ করে রইলো।আসলে কেমন অজানা শান্তি পাচ্ছে লোকটার সাথে।যেতেই মন চাইছেনা। বিভান আবার বলল,
''বিয়ের পর হানিমুন যাবেন তাইনা?"
''জানিনা।"
কথাটা কিছুটা রাগ করেই বলল বেলা।লোকটার মুখে কথা গুলো শুনতে রাগ লাগছে ওর।বিভান বলল,
''কিরন বলেছিলো দোকানে চা খাওয়াবে।কিন্তু খাওয়ালো না।"
''খাবেন?"
''আপনি খাওয়াবেন?"
''খাওয়ালাম।এখানে পাশেই একটা টং আছে।ওখানকার চা বেশ ভালো।"
''তাহলে আমরা খেতে পারি।বিল কিন্তু আমিই দিবো।"
বেলা হেসে বলল,
''দেখা যাক।"
ওরা দুজন চায়ের দোকানে চলে এলো।দোকানিকে মালাই চা বানাতে বলে ওরা বসে পড়লো।লোকটা বেলা বিভানকে অবাক চোখে দেখছে।বেলাকে চেনেন কিন্তু পাশের এই সুদর্শন পুরুষকে আগে দেখেননি।বেলা আর বিভান পাশাপাশি বসে আছে।বিভান বলল,
''মনে হচ্ছে অনেক বিক্রী হয় ওনার চা?"
''অনেক বিক্রী হয়।কি বলবো?আপনি একবার খেলেই বুঝবেন।"
কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল বেলা।বিভান বলল,
''তাহলে আমি দুকাপ খাবো এমনিতেই মাথা খুব পেইন করছে।"
বেলা জবাবে হেসে চায়ের দিকে চেয়ে রইলো।চা জাল হচ্ছে।বিভান বলল,
''আপনি মনে হয় প্রায়শই এখানে চা খান তাইনা?"
''ভার্সিটি এসেই খাই।আমার মনটা সতেজ হয়ে যায়।"
''হুম।বেলা!!"
বিভানের দিকে তাকায় বেলা।তারপর অস্ফুটস্বরে বলল,
''জি!!"
বিভানের চোখজোড়ায় পানি জমে আছে গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা শুধু।ম্লান হেসে বলল,
''কিছুনা।"
বেলা কিছু বলেনা তবে কলিজাটা ফেঁটে যাচ্ছে ওর।ভিতরে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে।চা হয়ে গেলো।একটা ছেলে এসে চা ধরিয়ে চলে গেলো।কাপ গুলো মাটির।বিভান চুমুক দিয়ে বলল,
''কলকাতায় ও মাটির কাপে চা দেয়।"
''ওহ। "
''তো সব প্রস্তুতি শেষ?"
''কিছুটা।"
একটু রেগে বলল বেলা কেন যেন বিভানের মুখে ওর বিয়ের কথা শুনতে অসহ্য লাগছে।চা খেয়ে উঠে আসে ওরা।একটু সামনে লেক দেখতে পায়।বিভান বলল,
''বেলা একটু দাঁড়ান।"
বিভানের ডাকে বেলার অস্থির পদযুগল থেমে যায়।বেলার বুকের ভিতর প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করে।বিভান বেলার হাত ধরে পানির সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
''একটা শেষ আবদার।প্লিজ পূরন করতে দিবেন।"
বেলার গলা কাঁপছে।কোনরকমে বলল,
''বলুন।"
বিভান যেন আশার আলো দেখতে পায়।তারপর উচ্ছাস কাঁটিয়ে বলল,
''জড়িয়ে ধরতে পারি?"
''এটা অন্যায় বিভান।"
''আজ এ শেষ অন্যায়টুকুই করতে দিন।"
বেলা কি বলবে ভেবে পেলোনা। ও হয়ত নিজে ও বিভানের বাহুডোরে বন্দী হতে চাইছে কিছুটা সময়ের জন্য।বিভান কিছু না বলে এসে বেলাকে জড়িয়ে ধরে হালকা ভাবে।বেলা নিজেকে থামাতে পারেনি।আলতো করে হাত রাখে বিভানের পিঠে।
বেলার চোখজোড়ায় পানি বাঁধা মানেনা।কেঁদে দিলো ও।কেন দেখা হয়েছিলো ওদের?কি করে অন্যকে স্বামী হিসেবে দেখবে ও?কতোটাসময় এভাবে ছিলো জানেনা।বৃষ্টি হওয়ার কারনে বাহিরে শীত পড়েছে।বিভান সরে আসে তবে দূরে নয় ওরা এখন ও একে অপরের অনেক কাছে।বিভান বেলার অশ্রুসজল চোখ দেখতে পাচ্ছে।বিভান বেলার চিবুক ধরে মাথা উঁচু করে ধরলো।বেলার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।বিভানের হাত বেলার চিবুক থেকে সরে এসে ওর চুলে চলে যায়।চুল গুলোর মাঝে আঙ্গুল চালিয়ে দেয়।বেলার কাঁধে বিভানের আঙ্গুলের স্পর্শ লাগতেই শরীর যেন ঝনঝন করে উঠে।বেলা অনেকটা এগিয়ে আসে বিভানের কাছে।বেলার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে ওর কপাল নাক চোখ সব গুলো লাল হয়ে আছে।বিভান বেলাকে দেখছে।বেলার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় বিভান। বেলা কিছু বলছেনা ওর পুরো শরীর যেন প্রান ফিরে পেয়েছে।বিভান বেলার চোখের পানে চায়।বেলা এবার এগিয়ে আসে বিভানের দিকে।তারপর বিভানের অধরে ঠোঁট রেখে আলতো করে চুমু খায়।বিভান অবাক।ভাবতেই পারেনি বেলা এমন কিছু করতে পারে।কিন্তু বেলা ওকে অবাক করে দিয়ে বিভানের ওষ্ঠে আবার ও চুমু খেয়ে নেয়।বিভানের হাত বেলার পিঠে চলে যায়।বিভান নিজেও বেলাকে সেই একই স্পর্শ গুলোয় মাতিয়ে তুলে।
অনেকটা সময় চলে যায়।বেলার খেয়াল হতেই লাফিয়ে সরে আসে।কি করছিলো ও?বিভানের দিকে তাকাতে পারেনি ও।অস্ফুটস্বরে সরি বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো মেইনরোডের দিকে।বিভান বেলার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো।এতোটাসময় ধরে হৃদয়ে কি অনুভূতি ছিলো বলার মতো না।বেলার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিভান ও দৌড়ে আসে। বেলা দ্রুততার সাথে সাঁঝকে টেনে বের করে গাড়ি থেকে।তারপর ছটফট করতে করতে বলল,
''এক্ষুনি চল।আমি থাকতে পারবোনা এখানে।"
সাঁঝ কিছু বুঝতে পারছেনা।ও ভেবেছিলো ওদের চলে যেতে বলবে কিন্তু বোনের এমন আকস্মিক আচরনে তাও বলতে পারেনা।
!!!!
অক্ষির সম্মুখেই সব যেন মুহূর্তে পাল্টে গেলো।
প্রচন্ড ভাবে টেনে বেলা সাঁঝকে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখনই বিভান বেলার হাত ধরতেই বেলা হাত ছাড়িয়ে নেয় তবে মাথা এখনো নিচু।ও প্রচন্ড অবাক নিজের কাজে।এতোক্ষন কিভাবে এমন স্পর্শ সহ্য করছিলো লোকটার?কাল ওর বিয়ে আর আজ?বেলা সামনে এগুতেই বিভান ডেকে বলল,
''বেলা প্লিজ কথা শুনুন।"
বেলা কোন জবাব না দিয়ে রিক্সা ডেকে উঠে যায়।বিভান চেয়ে থাকে বেলার যাওয়ার পথে।বিভানের চোখের কোনা বেয়ে গাল গড়িয়ে এক ফোঁটা অশ্রু কোনা পড়ে গেলো।তাহলে কি সব আকস্মিক ভাবে আবেগের কারনেই হয়ে গেছিলো?কিন্তু বিভান যে পারবেনা ওকে ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে।আর আজকের পর তো বেলা কে পাওয়ার আকুলতা অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছে।বিভান চায় বেলাকে অনেকটাই চায়।ওর পুরোটা জুড়ে বেলাকে চাই।এদিকে সারা রাস্তায় বেলা মাথা নিচু করে পুরো মুহূর্তটাকে ভেবে আসছিলো।নিজের ঠোঁট জোড়াকে দাঁত দিয়ে কামড়ে দিচ্ছিলো।কোনভাবেই কান্না সংবরন হচ্ছেনা।চোখ মুখ কুঁচকে সাঁঝের হাত চেঁপে ধরলো।নিজের হাতটাকে মনে হচ্ছিলো কেউ যেন চেঁপে ধরে গেলে দিচ্ছে।সাঁঝ দ্রুত পাশ ফিরে দেখে বেলার চোখজোড়া বেয়ে অঝোর গতিতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।একসময় ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে বেলা।সাঁঝ বোনের কাঁধ জড়িয়ে বলল,
''আপা কাঁদছিস কেন?"
বেলা সাঁঝের কথায় কোনপ্রকার জবাব দিতে পারেনি। সাঁঝ বোনকে জড়িয়ে ধরেছিলো এক পর্যায়ে।আসলে এমন অবস্থায় কিছু বলার ও নেই ওর।বাসায় ঢোকার আগেই বেলা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিল।চোখ মুছে সব ঠিকঠাক করে নেয়।ঘরে ঢুকতেই দেখলো ইদরীস কিছু ফলমূল নিয়ে এসেছে।সে অপেক্ষায় আছে বেলার।কিছু কথা বলে বের হবে।ঘরে ইদরীসকে দেখে মনটা কেমন করে উঠে।জুলেখা বানু মেয়েদের দেখে বললেন,
''তোরা শপিং কইরতে গেছিলি না?ব্যাগ কই?"
সাঁঝ জানে বেলা এখন কিছু বলার মুহূর্তে নেই।তাই ও বলল,
''আম্মা টেইলার্সে দিয়া আসছি।দিয়া দিবো।"
''আইচ্ছা।বেলা তুই ইদরীসরে নিয়া রুমে যা।ও কি কইবো তোরে।"
বেলা স্বাভাবিক দৃষ্টে ইদরীসের পানে চায়।লোকটা মুচকি হাসলো ওর দিকে।বেলা বলল,
''চলুন আমার সাথে।"
ইদরীস উঠে বেলার সাথে রুমে এলো।সামনে লাবনী ফ্লোরে খেলছে কিছু খেলনা দিয়ে।বেলা ইদরীসের সামনে বসলো।ইদরীস লাবনীকে দেখছে।বেলা বলল,
''কি বলবেন বলুন।"
লাবনীকে দেখে একটু হেসে ইদরীস বলল,
''ছোট শালী খুব কিউট তো। "
''হুম।"
''বেলা আপনি কই গিয়েছিলেন?"
বেলা অবাক করা দৃষ্টে ইদরীসের পানে চায় বেলা।লোকটার মুখে বিশ্রী হাসি। সে দাঁত কেলিয়ে বলল,
''ঐ লোকটার সাথে কি করছিলেন আপনি?"
বেলা অবাক লোকটা কি বলছ?বিভানকে দেখে ফেলেনি তো ওর সাথে।বেলা বলল,
'ঠিক বুঝলাম না।আপনি কার কথা বলছেন?"
''আপনি জানেন কার কথা বলছি আমি?বিয়ের আগে পরপুরুষের সাথে বাগানে ঢুকবেন।কাহিনী কি?আপনি কি ঠকাচ্ছেননা তো আমাকে?"
''দেখুন সে বন্ধু আমার।আর কিছুইনা।"
''ওহহো বন্ধু!!কি করছিলেন বন্ধুর সাথে?সে কি করেছে আপনাকে?যে এতো রাতে বাগানে ঢুকতে হলো।"
''দেখুন এমন কিছুইনা।আমাদের সাথে সাঁঝ ও ছিলো।বিশ্বাস করুন।"
''ওকে করলাম।আমি কাউকেই বলবনা আপনাদের বাসার।তবে বিয়ের পর আপনার বাহিরে বের হওয়া বন্ধ।ঘরেই থাকবেন।"
''আমার পড়াশুনা আছে চাকরী ও আছে।কিভাবে বলতে পারেন ঘরে থাকবো?"
''দেখুন বেলা কোনরকমের তর্ক বিতর্ক চাইনা।যা বলছি তাই হবে।আর আপনি না করতে পারবেননা এখন।অনেক দেরি হয়ে গেছে।বিয়ে তো আমাকেই করতে হবে।না হলে অনেক বড় ক্ষতি করবেন নিজের পরিবারের।আর বড় মেয়ে হিসেবে অবশ্যই এমন ক্ষতি চাননা আপনি।"
বলেই উঠে দাঁড়ায় ইদরীস।তারপর প্যান্টের দুপকেটে দুহাত ভরে ইদরীস বলল,
''বিয়ের পর বন্দিনী হয়ে যাবেন।সো আগ থেকে নিজেকে প্রস্তুত করে নিন।নয়তো আপনার এই ডান কাঁটতে সময় লাগবেনা আমার।"
বেলা অবাক চোখে ইদরীসের দিকে তাকায়।কিন্তু ইদরীস ওর জ্বলজ্বলে চোখজোড়া উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেলো।বেলার পুরো শরীর ঘেমে একাকার।কি করে ফেললো ও?লোকটার সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে ভুল হয়েছে ওর।তার হৃদয় একদম কালো।মন মানসিকতা খুব নিচু প্রকৃতির।এমন লোকের সাথে সংসার বাঁধবে কি করে?লাবনী হেঁটে এসে বেলার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
''তোনে নাও আপু।"
ছোট বোনকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকে বেলা।এরই মাঝে নিশাদ রুমে প্রবেশ করে।বেলার পাশে বসতে বসতে বলল,
''আপা ইদরীস ভাই কেন এসেছিলেন?"
বেলা চোখ মুছে গলা স্বাভাবিক করে বলল,
''আব্বাকে দেখতে এসেছিলেন মনে হয়।"
''ওহ।তা তোর সাথে কথা বলে গেছে তাইনা?"
''হুম।"
নিশাদ বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল,
''আপা তুই বিয়েতে মন থেকে রাজি তো?"
''হ্যা।কেন?কিছু হয়েছে?"
''না।নিজেকে আশ্বস্ত করে নিলাম।আর কিছুনা।"
বেলা ভাইয়ের দিকে চেয়ে হাসলো।এরই মাঝে আব্বা টেবিলে এসে খেতে বসেন।সারাদিনের কর্ম ব্যাস্ততা শেষে ভীষন ক্ষুধার্ত ছিলেন ওনি।বেলা বোনকে কোলে নিয়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়।ইকরাম রাহমান ভাতের লোকমা মুখে নিয়ে পাশে তাকিয়ে মেয়েদের দেখতে পায়।বেলা একটু হাসলো।ইকরাম রাহমান বলেন,
''কিরে আম্মা খাইছোস তোরা?"
বেলা হেসে বলল,
''আব্বা আপনি খান।সাঁঝ লাবনীকে নিয়ে যা।আব্বারে খাওয়া বেড়ে দেই।"
সাঁঝ এসে ছোট বোনকে কোলে নিয়প গেলো।বেলা বাবার প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে দিচ্ছে।ইকরাম রাহমানের চোখে পানি।খাওয়া শেষে ইকরাম রাহমান খাটে এসে বসেন।বেলা ওনার পা চেঁপে দিচ্ছে।ইকরাম রাহমান ক্রন্দনরত কন্ঠে বললেন,
''কেমনে তোরে বিদায় দিমু আম্মা?কেমনে আমার কইলছারে বিদায় দিমু?"
বেলার কান্না পাচ্ছে বাবার আর্তনাদে।ইকরাম রাহমান বললেন,
''মারে কষ্ট দিয়া থাকলে মাফ কইরা দিস আব্বরে।"
বেলা কেঁদে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।ইকরাম রাহমানের কান্নার গতিবেগ দ্বিগুন বেড়ে যায়।
_________________________________________
বাবা মেয়ের কান্নার শব্দে নিশাদ জুলেখা বানু সাঁঝ আদনান এসে হাজির।জুলেখা বানু ও নিশাদকে ধরে কাঁদতে শুরু করেন।রাতে হুমায়রা বেলার পাশে ঘুমানোর কথা ছিলো কিন্তু সাঁঝ বলল,
''তুই আপার পাশে সবসম ঘুমাস।যেয়ে আব্বা আম্মার সাথে ঘুম কুঞ্জন কে নিয়া।আপার সাথে আমি ঘুমাবো।"
সাঁঝের কথায় হুমায়রা কান্না করতে লাগে।ও বলে,
''আমি ও ঘুমাবো আপার সাথে।আপা সাঁঝ আপু কে বলো না।"
বেলা সাঁঝকে বলল,
''দুজনেই ঘুমা।"
সাঁঝ মাথা নেড়ে বলল,
''না আপা।ও আব্বা আম্মার কাছে ঘুমাবে।তুই বস আমি আসি।"
সাঁঝ হুমায়রাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবা মায়ের কাছে দিয়ে এলো।তারপর বেলার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বেলার পাশে এসে বসে।বেলা ভ্রু কুঁচকে বলল,
''অমন বড় ভাব নিয়ে কি বলতে আসছিস?"
''আপা এমন কিছু বিষয় আছে আমি ভালো বুঝি।"
বেলা অনেকটাই অবাক।কি বলতে চায় ওর বোন?বেলাকে অবাক করে দিয়ে সাঁঝ বলল,
''আপা ভালবাসা ব্যাপারটা জানিস শুধু শব্দ না একটা অনুভূতি।"
''তুই এতো কিছু কেমনে জানিস?"
''আপা তুই বড় কিন্তু এ বিষয়টা বুঝতেছিস না।আমি জানি তুই বিভান ভাইকে সরাতে ইদরীস ভাইয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিস।"
''এগুলো মিথ্যা।এমন কিছুই না সাঁঝ।"
বেলা এড়িয়ে যেতে চাইলো।সাঁঝ বলল,
''আপা।লুকাচ্ছিস কেন?এটা জানার পর ও ইদরীস লোকটা ভালো না।খুব নিচু প্রকৃতির মানুষ।আর বিভান ভাইকে ভালবেসে ও বলতে পারছিস না কারন আব্বা ভারতকে পছন্দ করে না তাইতো?"
''দেখ কোন ভালবাসা নাই।"
''আপা তুই যতোই চেষ্টা করিস পারবিনা।সিলেটে আসার আগের দিন বিভান ভাই আর তোর কথা শুনেছিলাম।বিভান ভাইয়ের কাছ থেকে আসার পর কান্না করেছিলি তুই।আসার পর থেকেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলি।"
বেলা বোনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
''তুই বিভান কে আমার কথা বলিস নি তো?আমার ভার্সিটি ড্যান্স ক্লাশের সামনে আসতে দেখেছি তাকে।তুই ঠিকানা দিয়েছিলি তাইনা?"
''জি আপা।আমি চাই বিভান ভাই তোকে পাক।কারন ইদরীসের কাছে ভালো থাকবিনা।সে তোকে ঘরবন্দী করে ফেলবে।"
''সাঁঝ এ নিয়ে কথা বলতে চাইনা ঘুমা তুই।"
সাঁঝ বলল,
''আপা তুই এতো বড় ভুল করিসনা।নিজেকে শেষ করে দিবি ইদরীস লোকটাকে বিয়ে করে।"
''দেখ না করতে পারবো না আমি।"
''আপা তুই বিভান ভাইয়ের কাছে চলে যা।এখন আব্বা আর ভাই বুঝবেনা।"
বেলা চোখ রাঙ্গিয়ে বোনের দিকে তাকায়।তারপর বলল,
''সাঁঝ তুই পাগল কি বলিস এগুলো?এটা করতে পারবোনা আমি। "
''আপা পারতে হবে।বিভান ভাই অনেক ভালো মানুষ।তুই ওনাকে হারিয়ে ফেললে পরে কষ্ট পাবি।"
''এমন কিছুই হবেনা।ঘুমা তুই।"
নিজের চোখের পানি আড়াল করতে চাইলো বেলা।সাঁঝ বোনকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
''আপা আমি কখনো চাইনা ইদরীস লোকটাকে বিয়ে কর তুই।আমাদের জন্য ভয় পাচ্ছিস তো।আল্লাহ রহমতে কিছু হবেনা।ইদরীসের এতো ক্ষমতা নাই যে সে কিছু করবে।"
বেলা বোনের দিকে তাকায়।বোনটার বয়স কম কিন্তু খুব বুঝে।ও বিভানকে খুব ভালবাসে আর আজকের পর থেকে আরো বেশি।ও কিভাবে ইদরীসকে বিয়ে করবে ভাবতেই বুকের একপাশ খালি হয়ে যায়।সাঁঝ বলল,
''আপা বিভান ভাই চলে যাবে।আর কখনোই আসবেনা হয়ত।ওনি অনেক কষ্ট পাবেন অনেক বেশি।তোরা দুজনেই কষ্টে থাকবি।"
বেলা এবার না পেরে বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগে।সাঁঝের কথা গুলো ওকে শান্তি দিচ্ছেনা।ভিতরের সব কষ্টের কথা গুলো বুক চিরে বেরিয়ে আসছে।সাঁঝ বোনের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
''আজকেই শেষ দিন কিছু করার।বিয়ের আগে যা করার করে নে।"
বেলা কিছু বলতে পারেনা কাঁদতে থাকে।দুজনেই ঘুমিয়ে যায়।বেলার চোখে ঘুম নেই।সাঁঝ ওর কোলে ঘুমিয়ে আছে।বেলার অশ্রু গুলো বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে।কখনো বাবা মায়ের অবাধ্য হয়নি। বড় মেয়ে হিসেবে সবই করেছে।কোন আবদার ও ছিলো না কখনো।আর আজ তো কাউকে ভালবাসে ও।তাকে ছেড়ে কিভাবে কাঁটাবে সারাটাজীবন আরেকজনের সাথে?ভাইবোন বাবা মা ওর জীবন কিন্তু আজ বুঝলো বিভান ওর নিশ্বাস।যা ছাড়া ও অচল। দম আটকে আসবে ওর?উঠতে পারবেনা কখনো।এদিকে বিভান হোটেলে এসে সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিতে থাকে।বড় অসহায় লাগছে নিজেকে।ঠোঁটে বেলার ছোঁয়া লেগে আছে আর মনে ওর প্রতিচ্ছবি।যা মুহূর্তে বেলার কাছে নিয়ে যায় ওকে।বেলার ভালবাসায় ওকে পূর্ন করে দেয়।কিন্তু কাল অন্যের হবে বেলা।বেলার পুরোটা জুড়ে থাকবে অন্য কেউ আর বিভান হয়ে যাবে অতীত।চোখ জোড়া ক্রমশ ভারু হয়ে আসে বিভানের।মদের মাতালতা আর সিগারেটের ধোঁয়া ওকে অন্য এক জগতে নিয়ে গেছে।পরদিন সকাল ভোরে বিভানের ঘুম ভাঙ্গে আজানের শব্দে।চোখ খুলে এলার্ম অফ করে নামাজ পড়ে নেয়।বেলার ভিডিও আবার দেখে শুয়ে পড়ে।সারারাত চোখ লাগাতে পারেনি।মন বেলার কাছে পড়ে আছে।শুধু মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন অন্য কারোর হয়েই গেলো।ও কিছুই পেলোনা জীবনে।তবুও সাঁঝের প্রতি ওর মায়া লাগে কারন সাঁঝের জন্যই বেলাকে দেখতে পেয়েছিলো।সকাল ছয়টায় আবার উঠে বসে বিভান।দরজায় নকের শব্দে কেঁপে উঠে বিভান।বাহির থেকে কেউ বলল,
''বিভান দরজা খুলেন।"