রংধনু - পর্ব ১৯ - তাবাসসুম রিয়ানা - ধারাবাহিক গল্প


সেদিন সকালে নিশাদ ঠিক করে কুঞ্জনের সাথে কিছু কথা বলবে।কারন ও নিজে ও দেখেছিলো কুঞ্জন অনেকটা চুপ চাপ হয়ে গেছে।একদম নেই আগের মতো।কথা ও বলেনা তেমন।তাই অফিস থেকে কুঞ্জনের কলেজে চলে আসে।কুঞ্জনের টিফিন টাইম চলছিলো।তাই নিশাদ সেই সময় টাতেই যায়।ক্যান্টিনে গিয়ে দারোয়ানকে বলল কুঞ্জন কে খুঁজে আনতে।দারোয়ান কিছু সময়ের মাঝে কুঞ্জন কে ধরে আনে।ভাইকে দেখে ভয় পেয়ে যায় কুঞ্জন।চিন্তায় ভরে আসে ওর ছোট্ট মুখ।নিশাদ ভাইকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে ওর মাথায় হাত দিয়ে চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

''কেমন চলছে পড়াশুনা?"

কুঞ্জন কিছুটা স্বাভাবিক ভাবে বলল, 

''ভাল ভাইয়া।সব ঠিক আছে।"
''হুম।তোকে অনেক দিন যাবৎ ঠিক লাগছেনা।কি হয়েছে বল?"
''ভাইয়া সামনে এক্সাম।তাই চিন্তা লাগছে।আর কিছুনা।"
''সত্যি?"
''হুম।"
''ডোন্ট ওয়ারি।তোকে যতোটুকু টাইম পাবো পড়াবো।কিন্তু আগের মতো হাসি খুশি দেখতে চাই তোকে।"

কুঞ্জনের চোখ ভরে আসে।ও বলল,

''ভাই একটা আবদার।"
''কি?"
''একটু জড়িয়ে ধরবো তোকে।"

নিশাদ ভাইকে বুকে টেনে বলল,

''এটা আবার বলতে হয় বোকা ছেলে?তোকে কতো ভালবাসি জানিসনা।বকা দেই ভালো এর জন্য।বুঝোস না?"

ভাইয়ের বুকে এসে কুঞ্জন নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে।নিজের কর্মের ফল ভোগ করছে।কতোটা খারাপ হয়ে গেলে ধুমপান করেছিল।একটা বার ও কি পরিবারের কথা মাথায় আসেনি ওর?নিশাদকে অনেকটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কুঞ্জন।কিছুসময় পর সরে আসে নিশাদ।কুঞ্জন চোখ মুছে নেয়।নিশাদ বলল,

''আমি আসি।লাবনী কে জলদি বাসায় যাবি।কোন আড্ডা দিবিনা।"
''না দিবোনা।আমি বাসায় যাবো।"

নিশাদ হেসে বেরিয়ে গেলো।আজ কুঞ্জনের বুক অনেকটা হালকা লাগছে।ভাই ওকে খুব ভালবাসে।ভাই কে কষ্ট পেতে দেবেনাও।বেলা দরজা আটকে আসতেই বন্দনা আখতারকে দেখে লজ্জা পেয়ে যায়।বন্দনা আখতার নাক মুখ শিটকে বলল,

''ছেলেটা ও না একেবারে পঁচে গেলো।ছিঃ কিভাবে তোকে জড়িয়ে ধরেছিল।কিভাবে পারলি আমার ছেলেটাকে নষ্ট করতে?এই রং দিয়ে আমার ছেলেকে কালো জাদু করেছিস।আমার ছেলে তোকে প্রায়োরিটি বেশি দেয় আমার থেকে যেখানে আমি ওর মা।আর তুই ওর সো কল্ড ওয়াইফ।"

বেলার চোখ ভরে আসে।গলা আটকে আসে ওর।কান্না সামলাতে চেষ্টা করে।তখনই বন্দনা আখতার বললেন,

''এসব চোখের পানি দিয়ে আমার ছেলেকে পাগল বানিয়েছিস।তোর কারনে আমার কোন কথাই শুনে না।আমাকে মানে না তোর কারনে।আমার মুখে মুখে কথা বলে শুধু তোর কারনে।মহিলা জাতির নামে শয়তান তুই।সব কথা ছেলের কানে লাগাস।নাহলে যে ছেলে আগে সব কথা শুনতো সে আমার কথা শুনতে চায়না।উচ্চস্বরে কথা বলে আমার সাথে।"

বেলা এবার অনেকটা নিজেকে সামলে নেয়।ভিত্তিহীন কথা বলছেন ওর শাশুড়ী।বেলা বলল,

''মা শুনেন আপনার ছেলে কে সব বললে আপনি তের বছর আগে আপনার ছেলেকে হারাতেন।কিন্তু কিছু বলিনা আমি।সত্য কখনো লুকিয়ে থাকেনা মা।একসময় সবার সামনে ধরা পড়েই।"

কথা গুলো বলে আর দাঁড়ায় না বেলা সিড়ি বেয়ে রুমে যেতে থাকে।পিছন থেকে বন্দনা আখতার চিৎকার করে বলছিলেন,

''মুখ ফু্ঁটেছে তোর।অপেক্ষা কর।মনে করিসনা বিভানকে সব বলবো।কিন্তু বলবোনা। এমন কিছু করবো যেটা তোকে আমার ছেলের থেকে দূরে নিয়ে যায়।তোর এত বিশ্বাস ভেঙ্গে যায়।"

বেলা দৌড়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে কাঁদতে শুরু করে।এতোটা বছর ও কিভাবে সহ্য করছে কিভাবে টিকে আছে ওর অস্তিত্ব সেটা শুধু নিজেই জানে বেলা। এমন একটা দিন ও যায়নি যে তীব্র ধারালো তীক্ষ্ম কথা দিয়ে ওর বুক চিরে ফেলা হয়নি।প্রচন্ড লাগে কথা গুলো যখন ওর চরিত্র নিয়ে কথা উঠে।ওর অস্তিত্ব ওর দেশ কে নিয়ে কথা উঠে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠে বেলার।ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আদনান কল করেছে।বেলা চোখ মুছে কল রিসিভ করে।গলা পরিষ্কার করে বলল,

''বল।"
''আপা ঠিক আছোস?কথা এমন শুনাচ্ছে কেন?"
''আমি ঠিক আছি।তোরা কেমন আছিস?"
''আলহামদুলিল্লাহ।ভাই আর বন্দনা আন্টি কেমন আছেন?"
''ভালো।তোরা কি করিস সবাই?"
''এই ভাই অফিসে গেলো সাঁঝ ভার্সিটি হুমায়রা কুঞ্জন লাবনী ওদের স্কুল কলেজে।"
''ভালো।নাস্তা করলি?"
''হ্যা আপা।আচ্ছা আম্মা কথা বলবে।ধর কথা বল।"
''দে।"

জুলেখা বানু মেয়ের সাথে কথা বলতে শুরু করে।মা ফোন নিয়ে কথা বলতে শুরু করতেই বেলার যেন খুব কান্না পেয়ে যায়।খুব কষ্টে নিজেকে দমিয়ে নিয়েছিলো।কারন বুঝতে দিবেনা।মা যে কষ্ট পাবে।রিদ্ধিকে পড়িয়ে শেষ করে চারটায় বেরিয়ে আসে সাঁঝ।লিফট থেকে বেরুতেই দেখলো লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে সাইমন।সাথে আরেকজন মোটা হাবাগোবা টাইপ লোক।সাইমন আর লোকটা কি যেন বলছিলো।সাঁঝ ভাবছিলো সাইমন কে থ্যাংকস জানাবে।কিন্তু কিভাবে।এ লোকটাই বা কে?সাঁঝ দাঁড়ায় না।ভাবছিলো সাইমন এসে কথা বলবে কিন্তু সে আসেনি।সাঁঝ বেরিয়ে আসে।
বাসের জন্য দাড়িয়ে রুমাল দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখখান মুছে নেয়।
পাবলিক একটি বাস নিজের স্পীড কমিয়ে এনেছে।
কন্ডাক্টর চিৎকার করে বলছে ফার্মগেট ফার্মগেট।
আর অপেক্ষা না করে সাঁঝ উঠে যেতেই কন্ডাক্টর ওর নিতম্বে হাত লাগায় আলতো করে।সাঁঝ চোখ বড় করে তাকাতেই লোকটা হেসে সামনে তাকায়।সাঁঝ নিজেই বলতে লাগলো,

''লুচ্চামি করলে এমন এক জায়গায় এমন লাথি মারবো কেঁদে কুল পাবিনা  কুত্তার বাচ্চা।"

তখনই একজন বোরকা পরিহিতা বললেন,

'' কি হইছে আফা?"
''কিছুনা।কিছু লোককে সতর্ক করলাম।"

বলেই একটু হেসে মহিলার পাশে বসে যায় সাঁঝ।কন্ডাক্টরের মুখ দেখার মতো ছিলো।সাঁঝ হেড ফোন কানে গুঁজে বসে থাকে।ঘুৃম পাচ্ছে তবে ঘুমাবেনা ও।কন্ডাক্টর বারবার তাকাচ্ছে ওর দিকে।সাঁঝ রাগী ভাবে তাকাতেই লোকটা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।বিকেলে বেলা শুনতে পেলো অপরিচিত এক মেয়ের কন্ঠস্বর।খাট থেকে নেমে রুমের দরজা খুলে সিড়ির কাছে এসে দেখলো একটা মেয়ে এসেছে।বন্দনার সাথে হেসে কথা বলছে উর্দু ইংরেজি মিশ্র ভাষায়।বেলা নিচে নেমে আসতেই মেয়েটা বলল,

''ফুপি তোমার ডটার ইন ল?"
''নো বেবি সি ইজ লাইক আ মেইড।"
''তাহলে বিভানের রুমে কি করছিলো?"
''আরে বিভান শুধু ওর সাথে শোয় আর কিছুনা।"

বেলার খুব অপমানিত বোধ হতে থাকে। কি বলছে মা?বেলা কিছু না বলে পাকঘরে গিয়ে চা বসায়।মেয়েটা বলল,

''শুনেছিলাম বিভান বিয়ে করেছে।"

পাশ থেকে বন্দনা আখতার বললেন,
''দুর্ভাগ্যক্রমে হয়ে গেলো"
''হার এপেয়ারেন্স ইজ কোয়াইট কিউট।"

বন্দনা আখতার বললেন,

''ডোন্ট সে দ্যাট।মাথায় উঠে যাবে।চলো তোমাকে বিভানের রুম দেখাই।তোমার না খুব শখ ওর রুম দেখার?"

বেলা ডুকরে কেঁদে উঠে।ওর শ্বাস আটকে আসছে।মরে যাবে ও।ওর বেঁচে থাকা বড্ড কঠিন মনে হচ্ছে।বিয়ের মতো এতো পবিত্র সম্পর্কে মা কিভাবে এত খারাপ বানালো?আর মেয়েটার সামনে খুব ছোট করা হচ্ছিলো ওকে।মা ওকে একদমই সহ্য করতে পারেনা শুধুই কি ওর শ্যামবর্নের কারনে?নাকি বাঙ্গালী হওয়ার দরুন ও।
নিশাদ অফিস থেকে বেরিয়ে রিক্সা নেয় ইমতিয়াজের ঘরের পানে।ইমতিয়াজের বাসায় এসে রিক্সা থামতেই লোকটার ভাড়া দিয়ে নিশাদ ভিতরে ঢুকে যায়।ইমতিয়াজ নিশাদ কে দেখে বলল,

''কি খবর?"
''এইতো চলছে।ইদ্রি কই?"
"ঘুমোচ্ছে।তুই বস।চা পাঠাই।ইদ্রিকে ও ডেকে দেই।"

নিশাদ বিনা বাক্য ব্যায়ে বসে যায়।কিছু সময়ের মাঝে এসে উপস্থিত ধোঁয়া ছড়ানো গরম চা।সাথে চকলেট বিস্কিট,পুডিং চানাচুর।নিশাদ চা হাতে নিয়ে খেতে থাকে।একটু পর ইদ্রির দেখা মেলে।নিশাদ কে দেখে মুখ ভার হয়ে আসে মেয়েটার।থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর টপস পরেছিলো।নিশাদ রুমে চলে এলো ইদ্রির।নাস্তা গুলো আবার ও এ রুমে চলে এলো।নিশাদ ইদ্রির পাশে বসে বলল,

''যা করিয়েছিলাম প্র্যাকটিস করেছিলে?"

ইদ্রি চুপচাপ ল্যাপটপ খুলে সব দেখায়।নিশাদ বলল, 

''ভেরি গুড।আজ তোমাকে ফাইল বানানো শিখাবো।"

ইদ্রি চুপ করে আছে।নিশাদ দেখাতে থাকে ওকে ফাইল বানিয়ে।কিন্তু ইদ্রি কোন কথা বলছেনা।নিশাদ বুঝতে পারছেনা ইদ্রি বুঝছে নাকি কিছু?মেয়েটা কথা ও বলছেনা।কেমন ঘাড় শক্ত করে বসে আছে।নিশাদ বলল,

''কি প্রবলেম?না পড়তে চাইলে বলো আমি চলে যাই।নিজের ও টায়ার্ড লাগছে খুব।"

ইদ্রি মুখ শক্ত করে বলল

''আমি আমার বিজনেসে কাজ রাখছি।পড়াতে থাকুন।"

নিশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

''সেদিন খুব টেনশনে ছিলাম।সেটা চিন্তা ও করতে পারবেনা।আমার বোন ঘরে আসছিলোনা।আর রেগে গেলে কাকে কি বলি মাথা ঠিক থাকেনা আমার।সরি।"

ইদ্রি মুখ শত করে বলল,

''হেসে সরি বলুন।"

নিশাদ চমকে যায়।ও বলল,

''হেসে সরি বলার কি হলো?"
''এখন মনে হচ্ছে গা ছাড়া ভাবে সরি বলেছেন।হেসে বললে মনে হয় মন থেকে বলেছেন।"

নিশাদের রাগ লাগছে।মেয়েটা কি চায়?কেন ওর কাছে এতো আশা করে।মেয়েটা ওর ছাত্রী বন্ধুর ছোট বোন আর কিছুনা।তাহলে ওর এতো কিসের আশা?নিশাদ কষ্টে হেসে বলল,

''সরি।"

ইদ্রি বলল,

''মানবোনা।"
''তো কি করতে হবে আমাকে?"

রেগে বলল নিশাদ।ইদ্রি দুষ্টুমি মাঝা হাসি দিয়ে বলল,

''আপনার সাথে জাদুঘরে যাবো।ওখানে যাওয়ার অনেক শখ আমার।ভাইয়া নিচ্ছে না।আপনি নিয়ে যাবেন?"

নিশাদ বলল,

''এসব বলোনা।আমি তোমার এমন কেউ নই যে আমার সাথে বেরুবে তুমি।তাছাড়া আমার কাজ আছে।"

মুখ মলিন হয়ে আসে ইদ্রির।চোখের কোনে পানি জমে।জ্বলজ্বলে চোখে নিশাদের দিকে চেয়ে বলল,

''আপনি আমার টিচার।টিচারের সাথে যেতেই পারি তাইনা?যাবেননা?"

নিশাদ ইদ্রির ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে আটকা পড়তে চায়না।তবে মেয়েটার জ্বলজ্বলে অশ্রু সজল চোখ দেখে বলল,

''জানাবো আমি।"

ইদ্রি হেসে বলল,

''খুব জলদি চেষ্টা করবেন।"
''হুহ।পড়ো।"

নিশাদের দিকে আবার তাকায় ইদ্রি।লোকটাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চরম লাগে ওর।ও বলল,

''আপনার হাসিটা খুব সুন্দর।"
''সামনে ল্যাপটপ আর মুখে নয়।সামনে তাকাও।ওখানে তাকালে কিছু শিখতে পারবে।"

ইদ্রি হেসে কাজ করতে থাকে।

!!!!

শুয়ে থেকে বেলাকে দেখছে বিভান।আজ ওর শ্যামবতীকে বড্ড মলিন লাগছে।যা আগে কখনো লাগেনি।বিভানের ভয় হয় কি হলো ওর বেলার?সকালে ও ভালো দেখে গেলো কিন্তু এতটা মলিনতা বেলার ওপর গ্রাস করবে তা কখনো ভাবেনি বিভান।ভাববে কিভাবে?ভাবার কোন কারন দেখেনি বেলার মাঝে।হ্যা মাঝে মাঝে বেলার মন খারাপ দেখেছে যখন ওর বাবা মা ভাই বোনকে খুব মিস করে।কিন্তু বিভান আজ বেলার চোহারায় অন্যরকম কষ্ট দেখতে পাচ্ছে যা ওকে আগে কখনোই দেখতে হয়নি।রাতে আকাশের কালো ছায়া বেলার চেহারায় বিরাজমান।চোখজোড়ায় জমে  হাজারো কষ্টমিশ্রিত অশ্রু।বিভান পারেনা বেলার এমন রুপ নিতে।বেলাকে যে হাসলেই সুন্দর লাগে স্নিগ্ধ লাগে,লাগে আকাশে উড়ন্ত ছোট্ট চড়ুইপাখিদের মতো যারা সুখে গান গেয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়।
বেলাকে কেন যেন আজ মনে হচ্ছে শিকারীর তীরে বাঁধা কাতরানো পাখির মতো।যে বিভানের বুকে দাপাদাপি করে কেঁদেছিলো অনেক্ষন।কি এতো কষ্ট যা বেলাকে মরন যন্ত্রনার আঘাত দিচ্ছে।বারবার ওর ছোট্ট বুককে রক্তাক্ত করছে।
অজান্তে কোন কষ্ট দেয়নি তো বেলাকে?শতশত ভাবনায় পতিত হয়ে বুক খানা ভার হয়ে আসে বিভানের।পাশে বেলা অঘোরে ঘুমিয়ে আছে।খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে ওর বেলাকে।কপালের কোনে বিন্দু বিন্দু ঘাম জানান দিচ্ছে ওর শ্যামবতীর ক্লান্তির শেষ নেই।আসলে অশ্রু গুলোই যে আজ ঘামের রুপ ধারন করে পড়ছে  তা জানা নেই বিভানের।উঠে বসে বিভান।মনের অজান্তেই মায়ের ওপর তীব্র ক্ষোভ চেঁপে বসে।জুলিকে নিয়ে আসতে মানা করেছিলো তারপর ও শোনেনি মা।নিয়ে এসেছে মেয়েটাকে।ঘরে ফিরে জুলিকে দেখে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো বিভানের।মেয়েটা ডিভানের ওপর আরাম করে বসে কফি পান করছে।বিভান একবার ওর ওপর চোখ বুলিয়ে লজ্জায় নিজের নজর সরিয়ে নেয়।বিদেশে গিয়ে মেয়েটা নিজের সংষ্কৃতি ধর্ম ভুলে বসে আছে।সে জানে ঘরে একজন ছেলে মানুষ আছে।যার চোখের কোন স্থিতিশীলতা বলতে কিছু নেই।অর্ধনগ্ন অবস্থায় কোন মেয়ে দেখতে পেলে তো সে তাকাবেই।হাঁটুর ওপর কাপড় পরে মেয়ে টা কি বুঝাতে চায়?সে কি ভাবছে তাকে অপরুপা লাগছে?তাহলে ধারনা ভুল।অতি কুৎসিত লাগছে।বিভান জুলির থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মায়ের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো তখন জুলি ডেকে উঠে পিছন থেকে।বিভান পিছনে তাকায় নি তবে থেমে যায়।জুলি বলছে,

''হেই বিভান স্বাগতম জানাবেনা?কতোদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো।"

কথা বলতে বলতে বিভানের সামনে এসে দাঁড়ায় জুলি।বিভানের গালে হাত লাগানোর আগে বিভান সরে দাঁড়ায়।তারপর বলে, 

''নিজের লিমিটে থাকো।ঘুরতে এসেছো ঘুরে চলে যেও।ভাইদের সাথে কিভাবে ট্রিট করতে হয় শিখে নিও।"

কথা গুলো প্রচন্ড রেগে বলে সিড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে চলে যায় বিভান।জুলি কিছুটা অবাক হয়ে বিভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।বিভান বন্দনা আখতারের রুমে এসে দাঁড়ায়।বন্দনা আখতার খাটে বসে আঙ্গুর খাচ্ছেন।ছেলেকে দেখে মুখে হালকা হাসি টেনে বলেন,

''এসেছিস বাবা?"

গলায় সেই একই ঝাঁঝ রেখে বিভান বলল,

''তুমি তোমার ভাইয়ের মেয়েকে এনেছো ভালো কথা যতদ্রুত সম্ভব পাঠিয়ে দেবে।"

অবাক বন্দনা আখতার।তার ছেলে পুরোই পাল্টে গেছে বৌয়ের কারনে।ওনি বললেন,

''ও তোর সাথে বিজনেস করবে আর এখানে থাকবে।"
''কখনো হবেনা।ওকে নিজের দায়িত্বে চাকরী নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলো।"

বন্দনা আখতার কিছু বলবেন তার আগে বিভান বেরিয়ে যায় রুম থেকে।নিজের রুমে এসে দেখলো বেলা খাটে বসে মাথা নিচু করে বসে আছে।ম্লান হাসে বিভান।হাতের ঘড়ি খুলে বেলার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

''বেলা ঠিক আছো?"

বেলা কিছু বলছেনা।কোন জবাব না পেয়ে বিভান আবার ও ডাকে,

''বেলা কি হয়েছে?কিছু বলছি।"

বেলা কিছু না বলে বিভানের কোমড় জড়িয়ে জোরে কাঁদতে শুরু করে। বিভান ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে বুকে নিয়ে নেয়।বিভানের বুকে আশ্রয় পেয়ে বেলা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে।কাঁদতে থাকে অনবরত।বিভান ওকে খাটে বসিয়ে দরজা লাগিয়ে ওর পাশে এসে বসে।বেলার চোখ মুছে জিজ্ঞেস করে,

''কাঁদছো কেন?"

বেলা কিছু বলতে পারছেনা।অনেক্ষন নিজেকে সামলে নিয়েছিলো।কিন্তু বিভানকে দেখে আর কোনমতে সামলে নিতে পারেনি নিজেকে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।বেলাকে পানি খাইয়ে দেয় বিভান।বেলা চুপ হয়ে আছে কিছু বলছেনা।বিভান বলল

''ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর কি হয়েছে শুনবো।"
''কিছুই হয়নি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন আপনি।"

বিভান আলমারির কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,

''তবে কাঁদছিলে কেন এভাবে?"
''বাসার কথা মনে পড়ছিলো।"
''আমার তো এমন টা মনে হয়নি।"

চেহারায় ক্লান্তির ভাব এনে বেলা বলল, 

''বিভান আমি ঠিক আছি।আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা।খেয়েছেন?"
''না।"
''তাহলে নিচে এসে খেয়ে নিয়েন।"
''উহুম নিচে যাবোনা।উপরে নিয়ে এসো।"
''আচ্ছা।"

বিভান কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেলা নিচে গিয়ে বিভানের খাবার রেডি করে উপরে নিয়ে আসে।বিভান এসে খেতে শুরু করে।বেলা ম্লান হেসে লোকটাকে দেখছে।তারপর হঠাৎ করে বলল,

''বিভান আজ এত জলদি এলেন?"
''কাজ শেষ।তাই।কেন?"

বেলা মাথা নাড়ায়,

''না এমনি।"
বিভান একটু হেসে নেয়।বেলা প্লেট গুলো নিচে নিয়ে যায়।সেগুলো পরিষ্কার করে রুমে চলে আসে।বিভান বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে।বিভানের পাশে শুয়ে পড়ে বেলা।বিভান আড় চোখে নিজের স্ত্রী কে দেখে নেয়।বেলার পাতলা শাড়ীর ভেতর ওর সুন্দর করে আঁকা বাঁকা কাঁটা শরীরটা দেখে নেয় বিভান।ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে ওর বৌটার।গরম একটা নিশ্বাস এসে বুকে লাগে বিভানের।বেলার গায়ের কাপড়টা এয়ারকন্ডিশনারের বাতাসে শাড়ীর আঁচল টা উড়ছে।বারবার বেলার মসৃন কোমড় নজরে পড়ছে বিভানের।বিভান আর সামলাতে পারেনা হাত এগিয়ে বেলার কোমড় ছুঁয়ে সেদিকে এগিয়ে আসে।বিভানের স্পর্শে বেলা কেঁপে উঠে।বেলার মন চাইছিলো লোকটা ওকে একবার বৌ বলে ডেকে বুকে টেনে নিবে।ভাসিয়ে দেবে ভালবাসার সমুদ্রে।বিভান বেলার কোমড় কোমড়ের ভাজে ঠোঁট ছু্ঁইয়ে দিতেই বেলা চোখ বুজে নেয়।বিভান বেলার কোমড় থেকে সরে এসে ওর পিঠে ঠোঁট বুলিয়ে ব্লাউজের ফিতা আলতো টানে খুলে বেলাকে সামনে ফিরিয়ে নেয়।বেলা দূর্বল চোখে বিভানের দিকে চেয়ে আছে।কম্পন ধরানো কন্ঠে বলল,

''একবার বৌ বলে ডাকুন বিভান।"

বিভান বেলার পাশে হাত নিয়ে বালিশের ওপর রাখে।তারপর কপালে দুচোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলল,

''বৌ।"

বেলা হেসে স্বামীকে বুকে টেনে নেয়।বিভানকে বেলা আজ ভালবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছে।আদিম প্রেমের মায়া জালে আটকা পড়েছে দুজনে।একে অপরকে আবার ও আপন করে নিচ্ছে ঘনিষ্ঠ বাহুডোরে।নিশাদ ঘরে এসে দেখলো ইকরাম রাহমান চলে এসেছে।ছেলেকে দেখে একটুনইকরাম রাহমান।তারপর বললেন,

''দেখ বাড়ি থেকে নারিকেল নিয়া আসছি।তোর ছোট দাদি আমড়া পাঠাইছে।"

নিশাদ বলল,

''আব্বা কখন আসছো?"
''একটু আগেই।তুই অফিস থেকে আসলি।দেরি হইলো দেখি।"

নিশাদ একটু হাসল তারপর বলল,

''আব্বা ইমতিয়াজকে মনে আছেনা?
''হ্যা রে।"
''ওর বোন ইদ্রিকে কম্পিউটার শিখাচ্ছি।"
''বেতন দিবে?"
''না আব্বা ও তো ইমতিয়াজের বোন।ইমতিয়াজ আমার ছোট বেলার ফ্রেন্ড।ওদের থেকে কি বেতন নিবো?"
''হ তুই তো খুব জমিদার তাইনা?টাকা নিবেনা।"

নিশাদ কিছু না বলে রুমে গেলো।ডিনার করে কুঞ্জনের কাছে এসে বসেছে নিশাদ।কুঞ্জন কে জিজ্ঞেস করলো, 

''কি পড়ছিস?"
''ফিজিক্স ভাইয়া।"
''ওহ।সিলেবাস শেষ?"
''জি ভাইয়া।"
''পড়া ধরলে পারবি তো?"
''জি ভাইয়া।"
''আচ্ছা নৈব্যাক্তিক ধরি।"

নিশাদ কুঞ্জনকে প্রথম অধ্যায়ের নৈব্যাক্তিক ধরতে শুরু করে।পরদিন বিকেলে ভার্সিটির কিছু বই কিনার জন্য নীলক্ষেতে আসে সাঁঝ।মাস্টার্সের সব বই কিনতে পারেনি ও।কিছু বইয়ের শিট বানিয়ে নিয়েছে।তবে একটা বই লাগবে।এটা না কিনলে নয়।সাঁঝ বইয়ের দাম জিজ্ঞেস করছিলো।হঠাৎ কারোর কথায় মাথা ঘুরালো ও।পিছনে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে।সাইমনকে দেখে সাঁঝ মুখ ফিরিয়ে নেয়।সাইমন কিছুটা অবাক হয়ে সাঁঝের পিছে এসে দাঁড়ায়।সাঁঝ অনূভব করছে সাইমন ওর পিছে।পিছনে  তাকানোর জন্য অপেক্ষা করতে পারছেনা সাঁঝ।কিন্তু সাহস ও হচ্ছেনা।লোকটাকে দেখলে আপন মনে হয় খুব আপন তবে মনের কোন এক কোনে লজ্জা অনুভূত হয়।বই কিনে সাঁঝ ভাবছিলো সামনে চলে যাবে কিন্তু সাইমনের ডাকে পিছে ঘুরতে হলো ওকে।সাইমন কিছু না বলে ওর হাত ধরে টেনে ভিড় থেকে সরিয়ে আনলো।সাঁঝ নিজের আর সাইমনের হাত দেখছে।হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে বলল,

''এভাবে নিয়ে এলেন কেন?"
''কথা বলতে চাই আপনার সাথে।"
''আমার ও কিছু কথা আছে।"
''আগে তুমি বলো।"
''সেদিন আপনি না বাঁচালে মরে যেতাম আমি।সেজন্য ধন্যাবাদ।"
''একটু শুকনো ধন্যবাদ হয়ে গেলোনা?"
''ভেজা ধন্যবাদ কিভাবে দিব?"
''সেটারও উপায় আছে।আপনি চাইলে বলতে পারি।"
''বলুন।"

একটু হাসে সাঁঝ।সাইমন বলল, 

''একসাথে কফি খাই।আমার কথা ও বলা হবে আর আপনার ভিজা ধন্যবাদ ও।"

সাঁঝ সময় চেক করে বলল,

''দশমিনিট দিবো।বাসায় জলদি ফিরতে হবে।"
''শিওর।চলুন।"

সাঁঝকে নিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে সাইমন।ও ড্রাইভ করছে।সাঁঝ পাশে বসে আছে।হঠাৎ ও বলে উঠে,

''আপনার ভয় করছেনা?"
''কেন ভয় করবে?"

সাইমনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সাঁঝ।সাইমন বলল,

''এই একজন অপরিচিত লোকের সাথে গাড়িতে।নিজের জন্য ভয় লাগছেনা?"
''ভয়ের কি হলো?"
''দেখুন সাঁঝ যতোই বলুন আমি একজন পুরুষ তা মানতে হবে আপনাকে।"
''জি।কিন্তু আপনার ওপর বিশ্বাস আছে।"

বিশ্বাসের কথায় গাড়ি থামায় সাইমন।সাঁঝের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল,

''বিশ্বাস তাও আবার আমার ওপর কেন?"

সাঁঝ লজ্জা পেয়ে যায়।কি বলল ও?তারপর নিজেকে সামলে বলল,

''আপনার ওপর বিশ্বাস আছে বলতে আমার মনে হয় আপনি আমার কোন ক্ষতি করতে পারেননা।"

সাইমন সাঁঝের দিকে পুরোপুরি তাকায়।সাঁঝ লজ্জায় একদম মাথা নিচু করে বসে আছে।সাইমন বলল,

''কেন ক্ষতি করতে পারবোনা?আমি ও একজন পুরুষ।"

সাঁঝ এবার কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বলল,

''পুরুষে ও অনেক তফাৎ আছে।"
''যেমন।"
''কাল বাসে একজন থাপড় খেল তার বেয়াদবির জন্য।আর আপনি।আপনাদের মাঝে বিস্তর তফাৎ আছে।"

সাইমন কিছু টা অবাক হয়ে বলল,

''চড় মেরেছিলেন কেন?"
''মারবোনা আরে শালা আমার সাথে বেয়াদবী করেছিলো।একদম চড় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি আমি এমন মেয়ে নই।"

সাইমন হেসে ফেলে।তারপ বলল,

''আপনি মহিলা ডন।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন