পরাণ প্রিয়া - পর্ব ২৩ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


সালমা বেগম মোশারফ হোসেনের দিকে চশমাটা এগিয়ে দিয়ে,তুমি রাতে বসে বসে বই পড়তে কী মজা পাও একটু বলবে?
-সালমা রোজ তোমার এই একটা কথার আনসার দিতে আমার মোটেও ভালো লাগে না।নিবিড় আর প্রিয়তা বাড়ি ফিরেছে?
-ফিরেছে,কিন্তু প্রিয়তার জানি কি হয়েছে?
-কী হয়েছে?
-আমি কি করে জানবো? পার্টি থেকে এসেই নিজের রুমে চলে গেলো কারো সাথে কিছু না বলে। 
-হয়তো শরীর খারাপ।জানো সালমা? প্রিয়তাকে যদি আমি এই বাড়িতে না আনতে পারতাম সেদিন আমার আফসুস থেকে যেতো।আমি জানতাম আমার ছেলে সহজেই ওকে মেনে নিবে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিলো এই মেয়েই আমার রাগী গম্ভীর ছেলেটাকে ঠিক করতে পারবে। 
তাই হলো।নিবিড় সবার সাথে কথা বললেও প্রিয়তার সাথে কিন্তু ঠিক এখন কথা বলে।
-হ্যাঁ আমিও খেয়াল করেছি।আমার ছেলে এখন ইশারায়ও কথা বলতে শিখেছে কথাটা বলে দুজনেই হাসলো।

নিবিড় প্রিয়তার কাঁধে হালকা স্পর্শ করতেই, প্রিয়তা নিবিড়ের দিকে না তাকিয়েই ধীর গলায় বললো, আপনি এখনো ফ্রেশ হননি?অনেক রাত হয়েছে।সকালে আপনার অফিস আছে।গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
-তুমি ঘুমাবে না?
-আমি অধরার কাছে যাচ্ছি। আপনি ঘুমান।
-মানে? তুমি অধরার কাছে ঘুমাবে? তাহলে আমি কার কাছে ঘুমাবো?
-আপনি কী বাচ্চা নাকি? 
-শেটাপ প্রিয়তা, তুমি ভালো করে জানো আমি তোমায় ছাড়া ঘুমাতে পারি না।আর তুমি এখন আমাকে গল্প শুনাতে আসছো আমি আপনার সাথে ঘুমাবো না।পাইছোটা কি আমাকে?
-আজব ব্যাপার, একটা সামান্য ব্যাপারকে এতো সিরিয়াস নিচ্ছেন কেনো।এক রাতেরই তো ব্যাপার। 
-কোনো ব্যাপার ট্যাপার না।তুমি আমার সাথেই ঘুমাবে।
-আচ্ছা ওকে,আমি জুহিকে বলছি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।এইবার গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।
নিবিড় স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে, তোমার পার্টিতে কি হয়েছিলো? তুমি কি কাউকে দেখেছো?
প্রিয়তা চোখে মুখে হাসি ফুটিয়ে, কই না তো।আসলে আমার তখন প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিলো।তাই বাসায় চলে এসেছি।
-ওহ্ আগে বলবে তো।

নিবিড় ফ্রেশ হয়ে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে অফিসের কাজ করছে।প্রিয়তা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো,আচ্ছা বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে ওই বাড়ি বলুন আর এই বাড়ি বলুন কোনো বাড়িতেই আপনার মায়ের ছবি নাই কেনো।শুধু গ্রামের বাড়িতেই দেখলাম আপনার মায়ের ছবি।
কথাটা বলতেই নিবিড় গম্ভীর ভাবে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে।
প্রিয়তা নিবিড়ের তাকানো দেখে ঢোক গিলে,আসলে আমি,,, আসলে আমি,,ওকে আমি ভুল করে ফেলেছি।আর কখনো জানতে চাইবো না।
প্রিয়তার অবস্থা দেখে নিবিড় নিজেকে সংযত করে, ল্যাপটপের দিকে ফিরে,ছোটো মা কষ্ট পাবে তাই।
আসলে আমি চাই না মা কষ্ট পেয়ে এইটা মনে করুক আমরা উনাকে ভালোবাসি না।
প্রিয়তা আস্তে করে বললো,হুম।আপনার মাকে আপনি অনেক ভালোবাসতেন তাই না?
-প্রিয়তা ভালোবাসা আমি বুজি না।আমার জীবনে আমি চারজন নারীকে আমি বেশি প্রাধান্য দিয়েছি।
প্রিয়তা অবাক হয়ে,চার জন?তার মানে আপনার কারেক্টারে সমস্যা আছে।
-হোয়াট?
-তা না তো কি? চারজন!
-তোমার সাথে আমার কথা বলতেও বিরক্ত লাগে।কথা কে কথা রাখো না,ঝগড়ায় পরিনত করো।
-আমার কি দোষ আপনি,,,,
-শেটাপ, চারজন হচ্ছে আমার মা,আপু,জুহি আর তুমি।
-ও,,,,আগে বলবেন তো।
-প্লিজ আর জ্বালিও না।এবার ঘুমাও আমাকে আমার কাজ করতে দাও।

অফিসের মিটিং রুম থেকে মিটিং শেষ করে নিবিড় বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
আসার সময় প্রিয়তাকে বাড়ির গাড়ি করে যেতে দেখে একটু অবাক হলো।প্রিয়তার ফোনে ফোন দিতেই প্রিয়তা কল কেটে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে ফেলেছে।
নিবিড় বাড়িতে এসে দেখে নাদিয়া আর সালমা বেগম 
বসে কথা বলছে।নিবিড়কে দেখে নাদিয়া এগিয়ে এসে,ভাই তুই এই সময়? কিন্তু তুই এই সময় তো বাড়ি আসিস না।
-আপু প্রিয়তা কোথায় গেছে?
-ও তো বললো ওর একটা কাজ আছে তাই বেরিয়ে গেলো।
নিবিড় আর কিছু না বলে উপরে উঠে গেলো।

প্রিয়তা রেস্টুরেন্টের সামনে নেমেই ভিতরে ঢুকে সাজিদকে বসে থাকতে দেখে,স্যরি ভাইয়া লেট হয়ে গেলো।
-নো প্রবলেম ভাবী।কিন্তু আপনি আমাকে এখানে এভাবে ডাকলেন কেনো?নিবিড় জানতে পারলে আপনাকে আমাকে দুজকেই ভুল বুজবে।
-কিছু করার নেই ভাইয়া।আমি যে নিরুপায় হয়ে এখানে এসেছি।মানুষটা ছোটো বেলা থেকে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে আসছে।সে মানুষটাকে একটু শান্তি আমি দিতে চাই।
-ভাবী কী হয়েছে খুলে বলুন তো"
-রাফিয়ার সাথে আপনার কোথায় পরিচয় হয়েছে?
-ভাবী, অস্ট্রেলিয়ায়।ওরা সবাই ওইখানেই থাকে।কিন্তু কেনো?
-নিবিড়ের মাকে আপনি কখনো দেখেছেন? 
-না ভাবী।তবে শুনেছি নিবিড়ের মা অনেক সুন্দরী ছিলেন।নিবিড়ের মতো হয়তো।উনি মারা গেছে যেহেতু দেখবোই বা কি করে বলেন? তবে এখন যে মা উনাকে দেখেছি।
প্রিয়তা কোনো বনিতা না করেই বললো,উনি মারা যাননি।
-হোয়াট?
-হ্যাঁ রাফিয়ার মাই নিবিড়ের মা।
সাজিদ কথাটা শুনে সামনে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি এক নিশ্বাসে খেয়ে,ভাবী আপনি ঠিক আছেন তো?
-আমি একদম ঠিক আছি।প্লিজ ভাইয়া আপনি কাউকে বলবেন না।এবং কি নিবিড়কেও না।
-তাহলে?
-আপনি নিবিড়ের ছোটো বেলা থেকে সব জানেন? ওর মা কীভাবে মারা গিয়েছিলো?
-শুনেছি আগুনে পড়ে মরেছিলো।
-ভুল।আপনি রাফিয়াকে ফোন দিয়ে বলুন আপনি আর আমি ওদের বাসায় যাবো।বিয়ের শপিং এর ব্যাপারে কথা বলতে।
-তারপর? 
-আমি ওর পুরো পরিবার দেখতে চাই।সেদিন ওর বাবাকে দেখিনি।
-ওকে।
প্রিয়তার কথামতো প্রিয়তাকে নিয়ে সাজিদ রাফিয়ার বাড়িতে গেলো।প্রিয়তাকে দেখে নাজিফা বেগম খুশি হয়ে বসতে দিলো।
-তুমি এসেছো আমি খুব খুশি হয়েছি।কী খাবে বলো?
অবশ্য তোমার স্বামীর এতো নাম ডাক চারদিকে আমি বেশ অবাক হয়েছি।এতো অল্প বয়সে নিজেকে এতো বড় একটা জায়গায় দাঁড় করানো পসিবল না।কিন্তু তোমার স্বামী সেটা পেরেছে।
প্রিয়তা একটু অবাক হয়ে,আপনি আমার স্বামীকে দেখেছেন?
-হ্যাঁ একটু আগেও পেপারে দেখেছি।বেশ ভালো এবং স্মার্ট একটা ছেলে।নিজের প্রতি বিশ্বাস আর জেদ আছে ছেলেটার মাঝে।
প্রিয়তা বনিতা না করে,আপনার পরিচিত মনে হয়নি?
-মানে?
-মানে বলতে চাইছি আগে কখনো দেখেছেন?
-না তো।
রাফিয়া তুমি দাঁড়িয়ে কী দেখছো? সাজিদ এসেছে নাশতা দিতে হবে তো নাকি? দিপা কে বলো এদের নাশতা দিয়ে যাওয়া জন্য।আর তোমার বাবাকে ডাকো।
-আন্টি আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না।আমার আপনার সাথে কথা বলেই ভালো লাগছে।আসলে কি বলেন তো কেউ আমার স্বামীর ভালো কিছু বললেই আমার খুব ভালো লাগে।আচ্ছা আন্টি আমার স্বামীর নামটা আপনার কাছে কেমন লাগে?
-এক কথায় ছেলেটার মতো তার নামটাও সুন্দর। 
মোজাম্মেল হোসেন এসে,আরে সাজিদ তুমি কখন এলে? রাফিয়া গিয়ে বললো বিয়ের শপিংএর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছো।
প্রিয়তা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে,ঠিক বাবার চেহারার সাথে অনেক মিল।
সাজিদ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুজিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
মোজাম্মেল হোসেন সামনের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে,মেয়েটাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?
নাজিফা বেগম মুচকি হেসে, আরে সকালে পেপারে ছবিটা দেখিয়ে তোমাকে বলেছিলাম না,এই ছেলেটা সাজিদের বন্ধু ওর স্ত্রী।
-আচ্ছা মা বসো।
নাজিফা যত দেখছে পুরোই অবাক হচ্ছে।সবই তো উনার ঠিক আছে।কিন্তু উনি বাবার সাথে এতো নাটকের মানে কী? নিবিড়কে তার মায়ের সম্পর্কে কী বলবো? আমাকে আরও কিছু জানতে হবে।
প্রিয়তা কথায় কথায় বললো,তো আন্টি আপনাদের কি ভালোবেসে বিয়ে নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?  
-নাজিফা বেগম মুচকি হেসে, পাগল মেয়ে বলে কি? আসলে আমাদের ভালোবাসার বিয়ে।
কি গো তুমি কিছু বলছো না কেনো?
মোজাম্মেল হোসেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে,হ্যাঁ তোমার আন্টিকে পেতে আমার কতকিছু যে করতে হয়েছে।অবশ্য ও আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে।তবে সেসব ব্যাপার তোমাদের না জানাই ভালো।
-কেনো আংকেল, মানুষ খুন করলেন নাকি? নাকি আন্টির আগে কোথাও বিয়ে হয়েছিলো সেখান থেকে নিয়ে আসলেন?
হেসে হেসে প্রিয়তা কথাগুলো বললেও মোজাম্মেল হোসেন আর নাজিফা বেগম একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।
প্রিয়তা আর সাজিদ হা হা হা করে হেসে,আরে আন্টি আপনি দেখি সিরিয়াস মোডে চলে গেলেন।প্রিয়তা সবার সাথেই এমন করে।তাই না প্রিয়তা? 
প্রিয়তা তীক্ষ্ণ হাসি ফুটিয়ে, মাথা নাড়লো উপর নিচ।

প্রিয়তা বাড়ি এসে দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে।
প্রিয়তাকে দেখে সালমা বেগম দৌড়ে এসে,কোথায় গিয়েছিলি তুই?জানিস নিবিড় অফিস থেকে এসে তোকে খুঁজে যাচ্ছে।
-উনি বাড়িতে মানে? উনি তো এই সময় বাড়ি আসেন না।
নাদিয়া উঠে এসে,প্রিয়তা ভাই কেনো এসেছে আমরাও জানি না।আমার মনে হয় ভাই তোমাকে রাস্তায় দেখে এসেছে। এখন উপরে গিয়ে সামলাও।

প্রিয়তা তড়িঘড়ি করে উপরে উঠে গিয়ে দেখে নিবিড় ল্যাপটপ নিয়েই বসে আছে।প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে সামনে দাঁড়িয়ে, আপনি আমার উপর রেগে আছেন?
-কেনো?
-এই যে আপনাকে না বলে বাহিরে গেলাম।
-আমি জানি না তুমি কেনো গেছো, তবে এইটুকু বলবো তুমি যাই করো না কেনো কারো খারাপ করবে না।এবং কি কাউকে ঠকাবেও না।
-প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছলছল চোখে।এই মানুষটা সত্যিই বড় অদ্ভুত। 
প্রিয়তা নিবিড়ের পায়ের কাছে বসে,কোলে মাথা দিতেই নিবিড় চমকে উঠে ল্যাপটপটা সরিয়ে খাটের উপর রেখে দিয়ে,কি হয়েছে বুড়ী?  মন খারাপ?
প্রিয়তা ভারী গলায় বললো,না!
-তাহলে হঠাৎ নিজে থেকেই আমার কাছে? 
-আপনি এতোটা ভালো কেনো বলুন তো? 
-কতোটা?
 -জানি না।কাল আমার সাথে এক জাগায় যাবেন?
-কোথায়? আজ আমি যেখানে গিয়েছিলাম।তবে সেখানে গেলে আপনি মাথা ঠান্ডা রাখবেন এইটা আমাকে কথা দিতে হবে।
নিবিড় হাসি দিয়ে,তুমি আমায় তাহলে এমন জায়গায় নিবে কেনো যে জায়গা গেলে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারবো না?
-আপনার ভালোর জন্য।এতোটা বছর আপনি নিজেকে সবার মাঝে থেকেও আলাদা করে রেখেছিলেন।কাল আপনাকে আমি যা দেখাবো নিজেই হয়তো আমাকে ভুলবেন নয়তো,,,, 
নিবিড় প্রিয়তার কথাগুলো শুনে থমকে গিয়ে অপলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।প্রিয়তা উঠে ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করে নিলো।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে কানের দুল খুঁজে পাচ্ছে না দেখে উঠে অন্য ড্রয়ারগুলো খুলতেই দেখে সেদিনের ফাইলটা।দেড় বছরের কথা প্রিয়তা প্রায় ভুলেই গিছিলো।তাকে যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।নিবিড় কী সত্যিই তাকে তাড়িয়ে দিবে? নিজের সবকিছু দিয়ে নিবিড়কে যে ভালোবাসা দিয়েছি তাহলে সব কি মিথ্যে?  নিবিড় যে আমায় বললো আমি যেনো আর পিছনে পা না বাড়াই, সেটাও কি দেড় বছর পর সব মিথ্যে হয়ে যাবে? 
প্রিয়তার টপটপ করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ফাইলটা খুলতেই পিছন থেকে নিবিড় এসে ছোঁ মেরে ফাইলটা নিয়ে,এইটাতে হাত দিয়েছো কেনো তুমি?
তোমার সবকিছুতে এতো কৌতূহল কেনো? 
-আসলে আমি,, আমি,,, 
-কি আমি আমি করছো? আমার কোনো ফাইল খুলে দেখবে না আমার অনুমতি ছাড়া।
নিবিড় প্রিয়তার উপর এইভাবে চড়ে বসবে প্রিয়তা ভাবেনি।এই ফাইলতো সেদিন আমিকে পড়তেই দিয়েছিলো তাহলে আজ পড়তে চেয়েছি বলে রাগ দেখাচ্ছে কেনো?

নিবিড় ফাইলটা আলমারিতে রেখে প্রিয়তার কাছে এগিয়ে এসে,অভিমান নাকি রাগ করেছো?
-আমার মতো লোকের রাগ নেই।যার যখন ইচ্ছে হবে কাছে টেনে নিবে, আবার ইচ্ছে হবে ছুড়ে ফেলে দিবে।এইছাড়া রাগ বলতে কিছুই বুজি না। 
-নিবিড় প্রিয়তাকে কাছে টেনে নিয়ে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে,
-কাল কখন যাবে?
-আপনার কখন সময় হবে?
-সকালে রিসাদকে পুরোনো অফিসের ফাইল বুজিয়ে দিয়ে তারপর যাবো।
-হু।

প্রিয়তা সালমা বেগমকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে, মোশারফ হোসেনের কাছে গিয়ে,বাবা আপনার বুকের ব্যাথাটা কমেছে?
-হে রে।আগের থেকে এখন ভালোই লাগছে।
-বাবা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-বল!
-মা যেদিন মারা গিয়েছিলো সেদিন সত্যিই মা মারা গিয়েছিলো?
-কি বলতে চাইছিস তুই? 
-বাবা আস্তে।মা শুনতে পাবে।বাবা আমি সিরিয়াসলি বলছি,তুমি নিজের চোখে মাকে মরতে দেখেছো?
-না।আমি তো বাহিরে ছিলাম।কিন্তু তুই হঠাৎ এইগুলা জিজ্ঞেস করছিস কেনো?
-বাবা, সেদিন মা মারা যানি।তোমাদের সবাইকে সেদিন বোকা বানিয়েছে।

কথাটা বলতেই মোশারফ হোসেন উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। 
প্রিয়তা অবাক হয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে, বাবা তুমি আশ্চর্য না হয়ে দরজা বন্ধ করলে কেনো?
মোশারফ হোসেন, গম্ভীর হয়ে শান্ত গলায় বললো,কোথায় দেখেছিস নাজিফাকে?
প্রিয়তা অবাক হয়ে,বাবা!
-আমি জানি তুই বলতে চাইছিস নাজিফা বেঁচে আছে।হ্যাঁ আমিও জানি ও বেঁচে আছে।
প্রিয়তা পিছিয়ে গিয়ে দেওয়ালে সাথে ধাক্কা লেগে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
-তাহলে তুমি নিবিড় নাদিয়া আপু ছোটো মা সবাইকে ঠকাচ্ছিলে?
-না আমি কাউকে ঠকাইনি।উল্টো ওই ভদ্রমহিলা  আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে।আমার নিষ্পাপ ছেলে মেয়েকে ঠকিয়েছে।প্রিয়তা তুই শুনবি আমার সব কথা? এতো বছর যে কষ্ট বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলাম তুই শুনবি সব?তোর বিশ্বাস হবে এইসব?
-বাবা তুমি বলো আমি সব শুনবো।
-তাহলে শুন,আমি যখন নাজিফাকে বিয়ে করি তখন নাজিফার বয়স চৌদ্দ।আমি তো থাকতাম তখন মালেশিয়ায়।বিয়ে করে তিন মাসের মাথায় আবার চলে যেতে হয়েছে।কিন্তু নাজিফা আমার ভালোবাসা না বুজে, বুজে ছিলো দেবরের। আমি একবছর পর ফিরে এলাম।নাজিফা আর আমার সম্পর্ক কিন্তু বেশ ছিলো।কিন্তু কে জানতো এই ভালোবাসা শুধুই মিথ্যা। সেবারে নাদিয়া গর্ভে আসলো।বাড়ির সবাই অনেক খুশি।কিন্তু খুশি হয়নি নাজিফা।আমাকে বললো আমি এই বাচ্চা চাই না।নষ্ট করার কথাও বললো।অনেক বুজিয়ে সুজিয়ে নাদিয়া দুনিয়ায় এলো। তখন আমার অবস্থা ছিলো করুণ। মালেশিয়ায় দুই মাস থাকলে বাংলাদেশে থাকতাম এক মাস এইভাবে কয়েক মাস যেতেই ভুলের করনে নিবিড় গর্ভে এলো। সে তো আমায় খুন করার অবস্থায়।কিন্তু কেনো এমন করছে আমি কিছুই বুজতে পারিনি।যখন নিবিড় দুনিয়ায় এলো নাজিফা নিবিড়কে মোটেও কোলে নিতো না।আমি আর আমার মাই সব করতাম।কখনো অভিযোগ করেনি,ভেবেছিলাম বয়স কম।যখন বড় হবে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু কিচ্ছু ঠিক হয়নি।ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো।আর সে আমার থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। একদিন বাহিরে থেকে এসে দেখি আমার ছোটো ভাই ওকে জড়িয়ে ধরে আছে আর বলছে,তুমি এসব রেখে কবে যাবে আমার সাথে? আমি সব প্ল্যান আগেই ঠিক করে রেখেছি। 
আর নাজিফাও হাসি হাসি মুখ করে বললো,যাবো যাবো তোমার বলদ ভাইটা তো আমাকে এখনো চাড়ছে না।ওর কিছু টাকা হাতে আসুক তারপর না হয় যাবো।
সেদিন না জানার ভাণ করে চুপ করে ছিলাম।কারণ আমি জানতাম আমি জিজ্ঞেস করলে আমাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে আমার ছেলে মেয়েদের কষ্ট দিবে।
কেটে গেলো আরও একটা বছর তারপর ওরা দুজনে ইচ্ছে করেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।ঘরের কাজের মেয়েটা সেদিন ওই ঘরেই ছিলো। কি করছিলো আমি জানি না।আমি তো বাহিরেই ছিলাম।যখন আমি আসলাম তখন দাউ দাউ করে আগুন চারদিক ছড়িয়ে পড়ছিলো।নিবিড় আর নাদিয়া একে অপরকে জোড়াজোড়ি করে নিরব হয়ে বসে ছিলো।আমি যখন আমার রুমে গেলাম বুজতে পারলাম গহনা টাকা পয়সা যা ছিলো সব নিয়েই ওরা পালিয়েছে।লাশটা দেখেই কিন্তু আমি চিনে ছিলাম ও নাজিফা না। ছেলেমেয়ের কাছে তার মাকে আমি ছোটো হতে দিই কি করে বল মা? কথাগুলো বলতে বলতে মোশারফ হোসেনের গাল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে।তাই আমি নিবিড় আর নাদিয়াকে নিয়ে সেখান থেকে শহরে চলে আসি।কিন্তু আমি বাহিরে গেলে ওদের কে দেখবে? তাই তো নিয়ে এলাম ওদের নতুন মা।পরে বুজলাম আমি সত্যিই ওদের মা নিয়ে এসেছি।
প্রিয়তা নিজের চোখের পানিগুলো মুছে মোশারফ হোসেনকে জড়িয়ে ধরে,বাবা তুমি এতোটা কষ্ট বুকে নিয়ে এতোটা দিন কিভাবে ছিলে? কতটা ধৈর্য থাকলে একটা মানুষ পাহাড় সমান কষ্ট সহ্য করে? এতো কিছুর পরও তুমি মাকে একটা গালি দাওনি।ভদ্রমহিলা বলে ডাকো।বাবা বিশ্বাস করো তোমার প্রতি যে ভালোবাসা আমার দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। 
মোশারফ হোসেন কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না।তবুও ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, তুই নিবিড়ের মাকে কোথায় দেখেছিস?
প্রিয়তা কিছু লুকালো না প্রথম থেকে সব বললো। 
কিন্তু বাবা উনি নিবিড়ের নাম শুনেও চমকালো না। 
-চমকাবে কী করে? নিবিড়ের নামটা আমি ও চলে যাওয়ার পর দিয়েছিলাম।ও তো জানে ইশতিয়াক ইসলাম। 
আমার মনে হয় নিবিড়কে ওর সামনে না নেওয়াটাই ভালো হবে। 
-বাবা আমি তোমার এই কথা রাখতে পারলাম না।নিবিড় একজন অমানুষের জন্য কষ্ট পেয়ে আসছে এইটা ওকে জানতে হবে।নিজেকে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে আসছে, ওকে যে কষ্ট এতো বছর বয়ে বেড়াচ্ছে সেটা ওকে জানতে হবে। 
আমি যে ওকে এভাবে দেখতে চাই না। 
-তোর যা ভালো মনে হয় কর।

নিবিড় গাড়ি ড্রাইভ করছে আর প্রিয়তার সাথে কথা বলছে। 
-আচ্ছা কোথায় যাচ্ছি আমরা একটু বলবে?
-গেলেই বুজতে পারবে।কিন্তু তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে কোনো রিয়েক্ট করবে না।
-নিবিড় প্রিয়তার দিকে একবার তাকিয়ে,রিসাদকে সব বুজিয়ে দিয়েছি।
-হু।
-ভালো করেছি না?
-হু।
-কী হু হু করছো।
-গাড়ি থামান আমরা পৌঁছে গেছি।
-এইটা তো কারো বাড়ি মনে হচ্ছে।বাসা বাড়ি হয়তো।
-হু,এখানে বাসা ভাড়া দেওয়া হয়।
-বাসা ভাড়া দিয়ে কি করবে?
-আপনি চলুন তো।বাসা ভাড়া নিতে আসবো কেনো?
নিবিড়কে টেনে লিফটে উঠে ছয় তলায় এসে কলিং বেল বাজাতেই রাফিয়া দরজা খুলে দিলো।
নিবিড় রাফিয়াকে দেখে,মুচকি হেসে তুমি রাফিয়ার বাসায় আসবে আগে বলবে না? 
কেমন আছো রাফিয়া?
-এইতো ভাইয়া ভালো ভিতরে আসুন।
প্রিয়তা রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে, আমি কিন্তু না বলে আমার বরকে নিয়ে চলে এসেছি।আন্টি কোথায়?
আসলে আন্টি আমার বরের এতো প্রশংসা করলো, না এনে উপায় আছে?
-ভাবী আপনারা ভিতরে আসুন আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি।

প্রিয়তা নিবিড়কে নিয়ে ভিতরে গিয়ে ড্রইংরুমে বসে,একদম রিয়েক্ট করবেন না প্লিজ।নিজেকে যতোটা পারবেন কন্ট্রোল করবেন। 
-নিবিড় বিরক্তিকর নিশ্বাস ফেলে,আমার প্রশংসা করলো বলে আমাকে এখানে নিয়ে আসতে হবে? প্রিয়তা তুমি কী পাগল? তোমার কী বুদ্ধি সুদ্ধি কিছু আর হবে না নাকি? আমার অফিসের কাজ ফেলে আমাকে এখানে নিয়ে আসার কোনো,,,,,,,,,,,,,
নিবিড় আর কিছু বলতে পারলো না। নাজিফা বেগমকে আসতে দেখে সেদিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।প্রিয়তা নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবিড় চোখ মুখ হাতের পিঠ দিয়ে মুছে আবার সামনে তাকালো।চোখের পলক যেনো সরতেই চাইছে না। সমুদ্রের ঢেউ গুলো তার বুকে এসে বেঁধ করছে।গলাটা শুকিয়ে যেনো আটকে গেছে।কপাল বেয়ে বেয়ে ঘাম কানের ঘোরালি দিয়ে স্রোত নিচে নেমে যাচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন