হঠাৎ করে দরজা খোলার শব্দ হলো। কেউ ভেতরে এসেছে। জীবন তাড়াতাড়ি করে গড়িয়ে স্পৃহা থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার আগের মতন মাটিতে শুয়ে পরলো। ছেলেটা ভেতরে এসে দেখলো জীবন স্পৃহা দু'জনই দু'জনের জায়গা আছে। আশরাফুল গলা উঁচিয়ে বলল,
'দুইডাই এহনো অজ্ঞান। পোলা মাইয়া একটারও জ্ঞান ফিরে নাই।'
আশরাফুল দেরি করলো না। আবার চলে গেল। জীবন উঠে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। বলল,
'জানোয়ার গুলোকে তো পরে শিক্ষা দিব। তার আগে স্পৃহাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। জয়কেও জানানো দরকার। কিন্তু এসব কিছুর আগে স্পৃহার জ্ঞান ফিরতে হবে।'
জীবন স্পৃহা কাছে এসে তাকে ডাকছে,
'স্পৃহা আমার কথা শোনো। স্পৃহা ওঠো প্লিজ। আমাদের এখান থেকে বেরুতে হবে। তুমি না উঠলে কীভাবে বের হবো। স্পৃহা।'
জয় সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তার সাথে শুধু সোম রয়ে গেছে। ওরা অফিসারের সাথে স্পৃহার ভার্সিটিতে এসেছে। অফিসার গেটের দারোয়ান এর কাছে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু দারোয়ান স্পৃহার কথা কিছুই বলতে পারলো না।
'স্যার আপনি কোন মেয়ের কথা জিগাইতাছেন তা আমি কেমনে কমু কন? কত কত মেয়ে এখানে পড়ে। আমি কি সবাইরে চিনি?'
'না চিনেন। কিন্তু আপনি তো সারাদিন এখানেই বসে থাকেন। গেটের সামনে থেকে যদি কোনো মেয়েকে জোর করে তুলে নেয়া হয় তা তো আপনার চোখ এড়াবে না।'
'না স্যার। আমি এখানেই ছিলাম। আজ সারাদিনে তেমন কিছু হতে দেখলে আমিই উপরে জানাইতাম। তারা ব্যবস্থা নিতো।'
'আপনাদের এখানে কি সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে?'
'জি স্যার আছে।'
'আজ সারাদিনের ফুটেজ রেকর্ড দেখা যাবে?'
'জি স্যার। আসেন আমার সাথে।'
অফিসার, জয়,সোম খুব মনোযোগ দিয়ে ফুটেজ দেখছে। স্পৃহা ক্লাস শেষ করে গেট থেকে বের হয়েছে। কিছুক্ষণ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। অফিসার বললেন,
'উনি হয়তো রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। রিকশা না পেয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। তার মানে এখানে কিছু হয়নি। উনার সাথে যা হয়েছে তা রাস্তায় হয়েছে।'
জয় আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। এতো চেষ্টার পরও স্পৃহার কোনো খোঁজ না পেয়ে জয় ভেঙে পরেছে।
'একটা মেয়ে তো আর হঠাৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। ওর সাথে কিছু না কিছু তো হয়েছে। স্পৃহা কোথায় তুই? কি অবস্থায় আছিস? বোন তুই যেখানেই থাকিস,ফিরে আয়। প্লিজ ফিরে আয়।'
অনেকক্ষণ ডাকার পর স্পৃহা একটু একটু করে চোখ মেলে তাকাচ্ছে। জীবন বলল,
'স্পৃহা আমার কথা শুনতে পারছো? এরা তোমাকে কখন এখানে এনেছে? তোমাকে কোথায় পেল?'
স্পৃহা চোখ খুলে সামনে জীবনকে দেখতে পেল। জীবনের কথা শুনতে পেয়ে স্পৃহা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। জীবন এখানে কোথায় থেকে আসবে? স্পৃহাকে যে ওরা এখানে নিয়ে এসেছে তা তো জীবনের জানার কথা না। শুধু জীবন কেন কেউই তো জানবে না। স্পৃহা কি তার এই দুঃসময়ে জীবনকে তার পাশে চাইছে? আর তাই কল্পনায় জীবনকে তার সামনে দেখতে পাচ্ছে?
জীবন আবার বলল,
'স্পৃহা তাকাও আমার দিকে? তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?'
স্পৃহা বুঝতে পারলো এটা তার স্বপ্ন বা কল্পনা না। জীবন সত্যিই স্পৃহার পাশে আছে। মুহুর্তেই স্পৃহার আজকের দুপুরের কথা মনে হয়ে গেল। ছেলে দু'টা জোর করে তাকে সিএনজিতে তুলে এনেছে। তার মুখে কিছু একটা স্প্রে করে তাকে অজ্ঞান করে ফেলেছে। জীবনকে দেখে স্পৃহা দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। তার মুখ বাধা তাই কথা বলতে পারছে না। তবুও সে কিছু বলার চেষ্টা করছে,
'উম,,,,
জীবন বললো,
'ভয় পেও না স্পৃহা। আমি আছি তোমার সাথে। এই দেখো আমি তোমার পাশে আছি। যে করেই হোক তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব।'
স্পৃহা কথা বলতে পারছে না। তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। সে ভেবেছিল আজ হয়তো তার সাথে খারাপ কিছু হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তাকে বাঁচানোর জন্য জীবনকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। স্পৃহাকে কাঁদতে দেখে জীবন বলল,
'কাঁদছো কেন? আমি আছি তো। আমি তোমার কিচ্ছু হতে দিব না। আমরা ঠিক এখান থেকে বেরিয়ে যাব।'
জীবন দুমিনিট চুপ করে ভাবলো। কিকরে এখান থেকে বের হওয়া যায়। দু'টা ছেলের সাথে ফাইট করা তার কাছে কোনো ব্যাপার না। কিন্তু মাথায় যে আঘাতটা পেয়েছে,তাতে তো সোজা হয়ে ওঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। আর সবথেকে বড় কথা সাথে স্পৃহা আছে। তাই জীবন কোনো রিস্ক নিতে পারবে না। তাকে এখান থেকে পালিয়েই বের হতে হবে। জীবন দেখলো স্পৃহার হাত পা মুখ বেঁধে রেখেছে। তার শুধু হাত বাধা। জীবন চাইলেই মুখ দিয়ে চেষ্টা করে স্পৃহার হাতের বাঁধন খুলে দিতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। অনেক কষ্টে স্পৃহার হাতের বাঁধন খুলে দিলে। স্পৃহা নিজে থেকেই তার পায়ের বাঁধন খুলে নেয়। টান দিয়ে মুখ থেকে কাপড়টাও সরিয়ে ফেলে। জীবনের হাতের বাঁধনও খুলে দেয়। স্পৃহা বিশ্বাস করতে পারছে না, সে এখান থেকে বের হয়ে যাবে। স্পৃহা কাঁদতে কাঁদতে জীবনকে জড়িয়ে ধরলো। জীবন বলল,
'ভয় পেও না। আমরা এক্ষুনি এখান থেকে বের হয়ে যাবো। ওরা আমাদের কিছু করতে পারবে না। তুমি শান্ত হও।'
স্পৃহা কাঁপতে কাঁপতে বলল,
'ওরা আমার সাথে,,,
সে সবটুকু বলতে পারলো না। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। জীবন বুঝতে পারছে স্পৃহা অনেক ভয় পাচ্ছে। জীবনে হয়তো সে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখে পরে নি। জীবন স্পৃহার মাথায় হাত রেখে বলল,
'ওরা আর তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি যতক্ষণ তোমার সাথে আছি ততক্ষণ তোমার কিছু হতে দিব না। এখন দেরি না করে আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে। ওরা মনে হয় আমার ফোন নিয়ে গেছে। আমরা এই সিচুয়েশানে আছি তা কাউকে জানানো দরকার।'
স্পৃহা জীবনকে ছেড়ে বসলো। তার হাত পা সমানে কাঁপছে। জীবনের শার্টে রক্ত দেখে স্পৃহা আরো ভয় পেয়ে গেছে। জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে একবার নিজের দিকে তাকাল। বলল,
'ওরা পেছন থেকে মাথায় আঘাত করেছে। মাথা ফেটে হয়তো রক্ত বের হয়েছে।'
জীবন আর দেরি না করে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখে আবার স্পৃহা কাছে চলে এলো।
'ওরা তিন জন বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। দরজা দিয়ে বের হওয়া যাবে না। অন্য কোনো পথ বের করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বের হতে হবে।'
রুবেল জনিকে সেই কখন ফোন দিয়েছে। জনি এখনও এসে পৌছায় নি। রুবেল রাগে কিড়মিড় করে বলল,
'শালার আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেন? এই জন্যই বলেছিলাম, একে কিছু জানানোর দরকার নেই। আমরা ফূর্তি করে চলে যাই। বাড়তি ঝামেলার দরকার নাই।'
রুবেল কথা শেষ করার পরপরই জনির জীপ এসে দাঁড়াল। তার সাথে আরো কয়েকটা ছেলে। জনি জীপ থেকে নেমে বলল,
'কই রে। তোরা না কইলি মাইয়া আনছোস। কই মাইয়া?'
লিটন বলল,
'ভেতরে আছে ভাই। '
'চল দেখি কেমন মাইয়া তুলছোস। সুন্দর না কালা।'
কথাটা বলে জনি হাসতে লাগলো। রুবেলের গা রাগে জ্বলছে। নিজে আসছে তো আসছে। সাথে আরো কয়েকটাকে কেন আনলো। ওরা ভেতরে গিয়ে দেখে ভেতরে কেউ না। না জীবন আর না স্পৃহা। রুবেল চিৎকার করে উঠে বলল,
'কোথায় গেল এরা? আমরা তো বাইরেই ছিলাম। তবে এরা বের হলো কীভাবে?'
আশরাফুল ডেকে বলল,
'পেছনে আরেকটা দরজা আছে। ওটা খোলা। মনে হয় এই দিক দিয়াই পালাইছে।'
ওরা সবাই দৌঁড়ে পেছনের দরজার কাছে গেল। জনি বলল,
'পলাইছ? মনে হয় না বেশি দূর গেছে। আমার জীপ আছে চল। সামনে আগাইলেই ওদের পামু। দেরি করিস না। আয় তাড়াতাড়ি।'
ওরা জীপে করে বেরিয়ে গেল স্পৃহা আর জীবনকে খুঁজতে।
রাত এখন সাড়ে বারোটার উপরে বাজে। জয় সোম বাসায় ফিরে এসেছে। ওদেরকে একা ফিরে আসতে দেখে মেহেরুন বললেন,
'তোরা একা এলি কেন? স্পৃহা কোথায়? ওকে কেন নিয়ে এলি না? কি হলো জয় কিছু বল।'
জয় কিছু বলতে পারছে না। স্পৃহাকে তারা খুঁজে পায়নি। এই কথা কীভাবে সবাইকে বলবে। তানিয়া অসুস্থ হয়ে পরেছেন। মেহেরুন তাকে একটু আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছেন। স্পৃহার চিন্তায় সবাই কেমন হয়ে গেছে। মেয়েটা হঠাৎ করে কোথাও চলে গেল। কি হলো মেয়েটার সাথে। স্পৃহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই কথা চারপাশে বেশ ভালোই ছড়িয়েছে। অনেকে ভাবছে স্পৃহা হয়তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। জয় অসহায়ের মত চেয়ারে বসে পড়ে বলল,
'মা স্পৃহাকে কোথাও পেলাম না। স্পৃহা কোথায় আছে কিছু জানি না। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে নাকি তাও বলতে পারছি না। কিডন্যাপ করলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে কিডন্যাপার কল দিত।'
জীবন স্পৃহাকে নিয়ে বড় রাস্তায় চলে এসেছে। তাদেরকে শহর থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে আসা হয়েছিল। স্পৃহা দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপাচ্ছে। জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে একটু দাঁড়াল। সে বলল,
'এখানে দাঁড়িয়ে একটু শ্বাস নিয়ে নাও। অনেকটা পথ তো দৌঁড়ে আসলাম।'
স্পৃহা জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
'আমরা বাসায় ফিরে যাব না?'
'যাব কিন্তু,,, ওরা আমাদের শহর থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। রাতও হয়তো অনেক হয়েছে। দেখছো না রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। গাড়ি পেলে নাহয় কোনোভাবে চলে যাওয়া যেত।'
জীবন তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা ঘড়িটাও খুলে নিয়েছে। জীবন মনে মনে গালি দিলো। স্পৃহা বলল,
'তাহলে আমরা রাতে কোথায় থাকবো? খালামণি আঙ্কেল জয় ভাইয়া আমার জন্য টেনশন করছে। ওরা তো জানে না আমি কোথায় আছি। নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমাকে না পেয়ে সবাই পাগল হয়ে উঠেছে।'
'বাসায় জানাবে কি করে আমার কাছে ফোন নেই। আশেপাশে কাউকে দেখতেও পারছি না। নির্জন রাস্তা। কোনো দোকান টোকান থাকলেও তো ওখান থেকে কল করা যেত।'
জীবন হঠাৎ স্পৃহার হাত ধরে তাকে হেঁচকা টান দিয়ে রাস্তা থেকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে গেল। ঝোপের আড়ালে বসে পড়ে হাত দিয়ে স্পৃহার মুখ চেপে ধরে রাখলো। হঠাৎ কি হলো তা স্পৃহা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে জীবনের হাত সরানোর চেষ্টা করছে। জীবন চোখের ইশারা করে বলল,
'চুপ কোনো কথা বলবে না। আর নড়াচড়াও করবে না।'
স্পৃহা জীবনের কথা শোনার জন্য রাজি ছিল না। সে নড়াচড়া করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটা জীপ আসার শব্দ হলো। স্পৃহা থেমে গেল। জীপটা এসে এখানেই থেমেছে। স্পৃহা জীবনের দিকে তাকালে জীবন তার হাত সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
'আমি দূর থেকে জীপ আসার শব্দ পেয়েছিলাম। ভাবিনি ওরা আসবে। তবুও সতর্ক হয়ে আগেই তোমাকে নিয়ে এখানে চলে এসেছি।'
জীপ থেকে জনি সবার আগে নামলো। তারপর রুবেল। আর রুবেলের পর এক এক করে সবাই নেমে দাঁড়াল। রুবেল বলল,
'সামনে তো দু'টা রাস্তা গেছে। এখন ওরা কোনদিক দিয়ে গেছে কীভাবে জানবো? '
'ওরা কোনোটাতেই যায়নি। আমরা জীপে করে এসেছি বলে এতো তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছি। ওরা দৌঁড়ে আর কতটুকু পথ আসতে পারবে। হতে পারে ওরা এখনো এখানেই আছে। আশেপাশে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে আছে।'
আশরাফুল জোরে ডেকে উঠে বলল,
'ভাই সত্যি কইছেন। ওরা এখানেই আছে। দেখেন মাইয়ার জুতা রাস্তার পাশে পড়ে আছে।'
রুবেল বলল,
'তার মানে ওরা জঙ্গলের ভেতর ঢুকেছে।'
স্পৃহা ওদের কথা শুনে কেঁপে উঠে জীবনের হাত খামচে ধরলো। তখন হঠাৎ জীবন ওভাবে টেনে নিয়ে আসায় পা থেকে কখন জুতা খুলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। স্পৃহা ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে জীবন বলল,
'ভয় পেও না। আমি আছি তো। আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই?'
স্পৃহা ফ্যালফ্যাল চোখে জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখছে। এই ছেলেটা তার কেউ হয় না। তাকে ভালো করে চিনেও না। তবুও তার জন্য কতকিছু করছে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। জীবন শক্ত করে স্পৃহার হাত ধরলো। বলল,
'একদম নড়বে না। পায়ের নিচে শুকনো পাতা। একটু নড়লেই খচখচ শব্দ হবে। তখন ওরা বুঝে যাবে আমরা এখানে আছি।'
জনি রুবেল তার দলবল সহ জঙ্গলে ঢুকে গেছে। তাদের পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। জীবন ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে। স্পৃহা ছেলে গুলোর হাতে পরলে সে একা কিছু করতে পারবে না। সে তো আর ফিল্মের হিরো না যে, একা একশো জনকে মেরে কাত করে দিয়ে হিরোইনকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলে যাবে। জীবন স্পৃহার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
'তোমার পায়ের ঐ জুতটাও খুলে দাও।'
স্পৃহা বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকাল। জীবন বলল,
'যা বলেছি তা করো।'
স্পৃহা জুতা খুলে দিলে জীবন তা হাতে নিয়ে তারা যেদিকে যাবে তার উল্টো দিকে ছুড়ে মারলো। শব্দ শুনে সবাই ওদিকে দৌঁড়ে গেল। এই সুযোগে জীবন স্পৃহাকে নিয়ে উল্টো দিক দৌড়াতে লাগলো। স্পৃহা মনে মনে জীবনের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না।
'কত বুদ্ধি উনার। আর আমিই গাধার মত সারাক্ষণ শুধু প্রশ্ন করে যাই।'
চলতে চলতেই জীবন স্পৃহা দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। যেন সে স্পৃহার মনে মনে বলা কথা শুনতে পেয়েছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ দৌঁড়ে এসে দু'জনই ক্লান্ত হয়ে গেছে। জীবন দাঁড়িয়ে গেলে স্পৃহা বলল,
'এখন কি করবো আমরা? রাস্তা থেকে তো অনেক দূরে চলে এসেছি। একেবারে জঙ্গলের ভেতরে৷ এখন থেকে বের হবো কীভাবে? '
'ভোর হবার আগে এখান থেকে বেরুনো যাবে না। আমার মনে হয় ওরা সকাল হবার আগ পর্যন্ত আমাদের খুঁজতে থাকবে। হতে পারে এখান থেকে বের হলে আমরা ওদের কাছে ধরা পড়ে যাব।'
জঙ্গলে থাকার কথা শুনে শুকনো মুখ করে স্পৃহা বলল,
'জঙ্গলে থাকবো? এখানে কত ধরনের জীবজন্তু থাকে। সাপ বিচ্ছু। যদি বাঘ থাকে,তাহলে তো আমাদের খেয়ে ফেলবে।'
স্পৃহার এমন বোকা কথা শুনে জীবন হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বলল,
'পাগল এই জঙ্গলে বাঘ আসবে কোত্থেকে? এখানে সাপ,বিচ্ছু, শেয়াল টেয়াল থাকতে পারে। কিন্তু বাঘ না। বাঘ মশাইয়ের এখনো এতো খারাপ দিনে আসেনি যে,তাকে জঙ্গল নামের এই ছোট ঝোপে থাকতে হবে।'
জীবনকে হাসতে দেখে স্পৃহা এখন নিজের কথার জন্যই লজ্জা পেয়ে গেল। সে মনে মনে বলল,
'আমি আর কোনো কথাই বলবো না।'
জীবন বড় একটা গাছের নিচে বসে পরলো। স্পৃহা দাঁড়িয়ে আছে দেখে তার হাত ধরে টেনে তাকেও বসিয়ে দিয়ে বলল,
'আমার ওই কথায় রাগ করেছো? আরে বাবা এই জঙ্গলে কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। দু একটা সাপ ব্যাঙ আছে। তুমি শুধু শুধু ভয় পেও না। ভোর হলেই আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাব। রাস্তা থেকে কোনো গাড়ি ধরে যে করেই হোক ঢাকায় পৌঁছে যাব। এখন একটু রেস্ট নাও। আজ সারাদিন তোমার সাথে যা যা হয়েছে তা হয়তো কোনো মুভির সিনকেও হার মানিয়ে দিবে।'
স্পৃহা জীবনের পাশে বসে রইলো। সত্যিই আজ তার সাথে যা যা হয়েছে, ছোট থেকে সে এসব ঘটনা শুধু মুভিতেই দেখেছে। বাস্তবে কখনো তার সাথে এমন হবে তা কল্পনাও করেনি। আজ যদি জীবন এসে তাকে না বাঁচাত,তাহলে এতক্ষণে তার সাথে কি হতো তা শুধু আল্লাহই জানেন। স্পৃহা বসে থাকতে থাকতে কখন জীবনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল তা সে বলতে পারবে না। জীবন অন্ধকারে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলো।
'এই ভীতু মেয়েটার সাথে আজ যা যা হয়েছে তাতে এর ভয় কেটেছে নাকি দ্বিগুণ বেড়েছে তা জানতে পারলে হতো।'
জীবন জেগে থেকে একা একাই হাসছে।
'আর খুঁজে লাভ নাই। ওরা হয়তো অন্যদিকে চলে গেলে। এই রাতের বেলা অন্ধকারে ওদের পাওয়া যাবে না। চল ফিরে যাই।'
লিটনের কথা শেষ হবার আগেই রুবেল লিটনের গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো। চোখ আগুন করে বলল,
'ফিরে যামু মানে? মেয়েটারে হাতের কাছে পেয়ে ছেড়ে দিমু? আর ঐ পোলা,ও ঐদিনও এই মেয়ের জন্য আমারে মারছে। আর আজও আমার হাত থেকে মেয়েটারে নিয়ে পালিয়ে যাবে। ওদের যতক্ষণ খুঁজে না পাই ততক্ষণ আমি ফিরে যামু না। তোরা যেতে চাইলে যা।'
জনি বলল,
'দেখ শুধু শুধু মাথা গরম করে লাভ নাই। সবাই মিলে তো খুঁজলাম। কোথাও তো পেলাম না। এতো বড় জঙ্গলে কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে? আর এখানে আছে নাকি তাও তো শিওর জানি না।'
রাত বাড়ছে। ওরা কোথাও জীবন আর স্পৃহাকে পেল না। ভোর হবার আর কিছু সময়ই বাকি আছে। অবশেষে রুবেল ওদের না পেয়ে ফিরে যাবার জন্য রাজি হলো। ওরা জীপে করে শহরের দিকে রওনা দিলো।
ভোরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে জীবনের ঘুম ভেঙে গেল। সে মাথা সোজা করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। ভোরের আলো রাতের অন্ধকার দূর করে দিয়েছে। কাল কি রাতটাই না পার করেছে ওরা। ভাবলেই কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। জীবন স্পৃহার দিকে তাকিয়ে দেখলো,স্পৃহা তার কাঁধে মাথা রেখে এক হাত জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। জীবন স্পৃহার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ছেলে গুলো যদি তাকে স্পৃহার কাছে নিয়ে না যেত। তাহলে সে স্পৃহাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাতে পারতো না। ওরা নিশ্চয়ই স্পৃহার সাথে খারাপ কিছু করতো। জীবন জোরে নিঃশ্বাস ফেলে স্পৃহাকে ডাকলো,
'স্পৃহা! স্পৃহা! ওঠো আমাদের তো ফিরে যেতে হবে।'
জীবনের ডাক শুনে স্পৃহা জাগলো না শুধু একটু নড়েচড়ে জীবনের হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। জীবন মুচকি হেসে স্পৃহার কানের কাছে গিয়ে একটু জোরে বলল,
'স্পৃহা ওরা চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। আমাদের পালাতে হবে।'
স্পৃহা লাফিয়ে উঠে বলতে লাগলো,
'কোথায় ওরা? এখন আমরা কি করবো? সকাল কখন হলো? আল্লাহ,,,
স্পৃহাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জীবন স্পৃহার মুখ চেপে ধরে বলল,
'আরে কেউ আসেনি। তুমি উঠছিলে না তাই একটু মজা করলাম।'
স্পৃহার চোখ থেকে সব ঘুম চলে গেছে। সে ড্যাবড্যাব করে জীবনের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবন তার সাথে এমন মজা করতে পারলো? কেউ কাউকে এভাবে ভয় দেখিয়ে ঘুম থেকে তুলে? জীবন স্পৃহার এমন অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে। মনে মনে বলছে,
'ভীতুর ডিম একটা। এতটুকু সাহসও নেই। এখন বুঝতে পারলাম জয় এমনি এমনি এর জন্য এতো চিন্তা করে না।'
স্পৃহা মনে মনে বলল,
'হাসলে ছেলেটাকে কত সুন্দর লাগে। তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।'
পরক্ষনে স্পৃহা আবার বলল,
'ছি ছি কি সব ভাবছি আমি? এসব ভাবা মোটেও ঠিক না।'
স্পৃহা যখন বুঝতে পারলো সে জীবনের হাত ধরে রেখেছে,তখন সাথে সাথে তাকে ছেড়ে দিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে দূরে সরে বসলো। জীবনও নড়ে সোজা হয়ে বসলো।